বিষ পাহাড়

  • লেখক: অরিন্দম দেবনাথ
  • শিল্পী: সুদীপ্ত রায়

বিষ পাহাড়

লেখক – অরিন্দম দেবনাথ

অলংকরণ – সুদীপ্ত রায়

 

রুনিত পাহাড়ের খাড়া পাকদণ্ডী বেয়ে মহারাজ রভিরান বর্মা একাকী চলেছেন পায়ে হেঁটে। আকাশে উজ্জ্বল হোলির চাঁদ। প্রায় ন্যাড়াপাহাড়ে মহারাজ রভিরানের পূর্বপুরুষরা পাথরের গায়ে সিঁড়ির মতো ধাপ কাটিয়েছিলেন বহু যুগ আগে। এই পাথুরে সিঁড়ি গিয়েছে পাহাড় শীর্ষে এক গুহা পর্যন্ত। এই গুহার অভ্যন্তরে মহারাজের গুরুদেব, দুজন শিষ্য নিয়ে বাস করেন।

     প্রাচীন বিশাল এক বটগাছ, গুহার মাথায় ছাতার মত দাঁড়িয়ে। অজস্র মোটা মোটা শেকড় গাছ থেকে নেমে এসে, গুহার মুখকে আড়াল করেছে। ন্যাড়া পাহাড়ের মাথায় এই একটাই গাছ। গুহার ভেতরে একটি থেকে উৎপন্ন একটি অতি শীর্ণ প্রাকৃতিক জলের ধারা, গুহা মুখ দিয়ে বেরিয়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে গড়িয়ে এঁকেবেঁকে অনেক পথ পাড়ি দিয়ে, পাহাড়ের এক খাড়া দেওয়াল বেয়ে ঝরনা হয়ে ঝাঁপ দিয়েছে পাহাড়ের পাদদেশে ছোট্ট এক জলাশয়ে। আশপাশের গ্রামের বেশ কিছু পুকুর এই জলাশয়ের সঙ্গে ছোট ছোট নালা দিয়ে যুক্ত। গ্রামবাসীরা এই জল পান করেন।

     দশজন অশ্বারোহী দেহরক্ষী বেষ্টিত হয়ে রাজধানী থেকে দীর্ঘপথ ঘোড়া ছুটিয়ে এসেও মহারাজ ক্লান্ত নন। তিনি চিন্তিত। পাহাড়ের পাদদেশে মহারাজ তার দেহরক্ষীদের জিন্মায় ঘোড়াকে সমর্পণ করে, একাকি নিরস্ত্র হয়ে পাহাড়ের পথ ধরেছেন। হাতে এখনও অনেক সময় আছে। তাই মহারাজ চলেছেন ধীর পদক্ষেপে।

     রাজধানী থেকে আসার পথে কয়েকটি গ্রাম পরিদর্শন করে এসেছেন তিনি। এই সব গ্রামের প্রজারা কিছু মাস হল অজানা পেটের রোগে ভুগছে। গ্রামের প্রায় সকলের হাতে আর পায়ে একধরনের চর্মরোগ দেখা দিয়েছে। মহারাজের কানে বেশ কিছুদিন আগেই খবরটা পৌঁছেছিল। কয়েকজন বদ্যি পাঠিয়েছিলেনও তিনি। কিন্তু রোগের কোন উপশম হয়নি।

     প্রতি বছর দোল পূর্ণিমার তৃতীয় প্রহরে মহারাজ রভিরান বর্মা গুরুদেবের দর্শন পেতে আসেন। মহারাজ রভিরান গুহার সামনে পৌঁছে একটা বড় পাথরের চাঙ্গড়ের উপর বসলেন। গুরুদেব তাঁর দুই শিষ্য নিয়ে থাকেন গুহার অভ্যন্তরে। এই পাহাড়ে আর কোনও মানুষের উপস্থিতি নেই। শিষ্যরা প্রতি সপ্তাহান্তে একটি নির্দিষ্ট সময়ে পাহাড়ের পাদদেশে গিয়ে আশপাশের গ্রামের মানুষের দান থেকে রসদ সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন। পাহাড়ের পাদদেশে একটা বড় পাথরের চাতালের ওপর আশপাশের গ্রামের মানুষ ফল-মূল-চাল রেখে যান। শিষ্যরা গিয়ে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু রসদ তুলে নেন গ্রামবাসিদের ওই অর্ঘ্য থেকে। বাকিটা পড়ে থাকে। গ্রামের মানুষজন ওই পড়ে থাকা সামগ্রীকে গুরুদেবের প্রসাদ মনে করে ফেরত নিয়ে যান। বহুকাল ধরে চলে আসছে এই রীতি।

     মহারাজ চুপ করে বসে আছেন। সারা দিনের ক্লান্তি ভিড় করছে চোখের ওপর। বাতাসের সোঁ সোঁ শব্দ আর নালা বেয়ে জল যাবার ধ্বনি ছাড়া আর কোনও আওয়াজ নেই। বিশাল ঘন বটগাছের পাতা ভেদ করে পূর্ণিমার আলো পৌঁছতে পারেনি গুহার মুখে। অনেকক্ষণ বসে থাকার ফলে মহারাজার চোখ অন্ধকার সয়ে গেছিল। মহারাজার মনে পড়ে গেল পিতার মৃত্যুর পর রাজার আসনে বসে গুরুদেবের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের কথা। দেশের রাজরীতি মেনে পূর্ণিমার আলোকে সঙ্গী করে দোল পূর্ণিমার রাতে একাকি এসেছিলেন পাথুরে সিঁড়ি বেয়ে। পথ ভুল হবার কোনও ভয় ছিল না। কারণ এই সিঁড়ি এসে শেষ হয়েছে গুহামুখে। কিন্তু ন্যাড়া পাহাড়ে একাকি উঠতে গা ছমছমিয়ে উঠেছিল।

     গুহার অন্ধকার প্রবেশ দ্বারের দিকে তাকিয়ে আছেন মহারাজা। যতক্ষণ গুরুদেব না স্মরন করছেন ততক্ষণ অপেক্ষা করতেই হবে। এমনকি নিজের উপস্থিতিও জানান দেওয়া যাবে না। এটাই রীতি।

     অন্ধকার গুহা মুখে একটা কবুতর ডেকে উঠল। মশাল হাতে গুহা মুখের বটগাছের শেকড়ের আড়ালকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে এলেন গুরুদেবের এক শিষ্য। মহারাজ উঠে দাঁড়িয়ে নত-মস্তকে প্রনাম জানালেন। পরনে সাদা আলখাল্লা। বয়স বোঝার উপায় নেই। কেশহীন মস্তক, বুক ছাড়িয়ে নেমে আসা সাদা দাড়ি। শীর্ণ চেহারা। মাহারাজ রভিরানের বয়স ষাট বছর। বত্রিশ বছর আগে পিতার মৃত্যুর পর রাজার আসনে বসেছিলেন তিনি। তার পর আঠাশ বার গুরুদেবের দর্শন পেয়েছেন তিনি। এত বছরে গুরুদেব বা তাঁর শিষ্যদের চেহারায় কোনও পরিবর্তন দেখেননি মহারাজ। গুরুদেব ও ওঁর শিষ্যদের বয়স কত জানা নেই মহারাজের। এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করার ধৃষ্টতাও মহারাজ দেখাননি কোনওদিন। রাজ্য পরিচালনা সংক্রান্ত বিষয় নিয়েই আলোচনা হয় প্রতিবার। মহারাজ লক্ষ্য করেছেন গুরুদেব প্রায় সব খবর রাখেন। অথচ উনি গুহা থেকে বাইরে আসেন না। এমনকি ওঁর দুই শিষ্য সপ্তাহে মাত্র একদিন পাহাড়ের নিচে নামেন ভক্তদের রেখে যাওয়া দানের খানিক অংশ সংগ্রহ করতে। কারো সঙ্গে কথাও বলেন না শিষ্যদ্বয়। তাহলে কি করে যে গুরুদেবের কাছে সব খবর পৌঁছয় সেটা একটা রহস্য।

     মশালধারীকে নিঃশব্দে অনুসরণ করে প্রশস্ত গুহার ভেতর একটা বড় পাথরের বেদীর সামনে পৌঁছলেন মহারাজ। বেদীর উপরিভাগ সমতল। তার ওপর একটা লোমশ কিছু বেছান। গুরুদেব চোখ বুজে শুয়ে আছেন লোমশ শয্যায়। একটা মশাল জ্বলছিল গুহার মাঝে। মশালের টিমটিমে আলোয় শুধুমাত্র গুরুদেব এবং ওঁর পাশে দণ্ডায়মান এক শিষ্য ছাড়া আর কোনও কিছুই নজরে আসে না। কানে আসে গুহার অভ্যন্তরে প্রবাহমান স্রোতের জলধ্বনি।

     মহারাজ গুরুদেবের শয্যার সামনে পৌঁছে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রনাম করে, হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে রইলেন। শিষ্য, যিনি মহারাজকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন তিনি গুরুদেবের শয্যার পাশে নিচু হয়ে গুরুদেবের কানে কানে কিছু বললেন। গুরুদেব ধীরে ধীরে উঠে বসলেন শয্যার ওপর। হাত তুলে মহারাজকে আশীর্বাদ করে সামনে একটি প্রস্তর নির্মিত আসন নির্দেশ করে বসতে বললেন। তারপর একটা ফল মহারাজের হাতে দিয়ে ইশারায় আহার করতে বললেন। প্রতিবার গুরুদেবকে প্রনাম করার পর এই ফল প্রসাদ পেয়েছেন। ফলটা মাঝারি লাল আপেলের মতো দেখতে, কিন্তু চতুষ্কোণ গড়নের। এটা কি ফল বা কোথায় পাওয়া যায় জানবার চেষ্টা করেননি মহারাজ। ফলটা সুস্বাদু নয়, কিন্তু প্রতিবার এই ফলাহার করার পর মহারাজ উপলব্ধি করেছেন যে শরীরের সব ক্লান্তি চলে গেছে। শরীরটা তরতাজা হয়ে গেছে যুবা বয়সের মতো।

     “রাজন কি খুব চিন্তিত?” গুরুদেবের ক্ষীণ কণ্ঠস্বর ভেসে এল যেন অনেক দূর থেকে।

     “হ্যাঁ গুরুদেব। এই পাহাড়ের পাদদেশে বেশ কয়েকটি গ্রাম আছে। কিছুদিন ধরে এই গ্রামগুলোতে এক ব্যাধি দেখা দিয়েছে। আমি আজই গ্রামগুলো পরিদর্শন করে এসেছি। গ্রামের অধিকাংশ প্রজা পেটে অসহ্য যন্ত্রণা ও ত্বকের ক্ষততে ভুগছে। কিছুদিন আগে রাজধানী থেকে কয়েকজন বৈদ্য পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু তারা রোগের উপশম করতে পারেনি।”

     মহারাজের কথা শুনতে শুনতে গুরুদেবের চোখ বন্ধ হয়ে গেছিল। অনেকক্ষণ নিশ্চুপ হয়ে বসে থেকে চোখ খুললেন গুরুদেব।

     “আমি ব্যাধি সম্পর্কে অবগত, কিন্তু উপশমের উপায় আমার এখনও অজানা রাজন।” অনেকক্ষণ সময় নিয়ে ধীরে ধীরে বললেন গুরুদেব।

     “তা হলে উপায়? ব্যাধি এখনও সামান্য কয়েকটা গ্রামে সীমাবধ্য। এ ব্যাধি ছড়িয়ে পড়লে মহামারীর রুপ ধারন করতে পারে! ইতিমধ্যে দুইজন মারা গেছে।”- মহারাজ বললেন।

     অনেকক্ষণ মৌন হয়ে রইলেন গুরুদেব।চোখ দুটো আবার বন্ধ হয়ে গেছে।

     “জানি রাজন। আমার অনেক বয়েস হয়ে গেছে, চলা ফেরার শক্তিও প্রায় হারিয়ে ফেলেছি। কথা বলতেও খুব কষ্ট হয়।” গুরুদেব আবার ধীরে ধীরে শুয়ে পরলেন। চোখ দুটো খোলা কিন্তু স্থির। যেন অনেক দূরের কিছু দেখছেন।

     “যদি আমার আশঙ্কা সত্যি হয়… রোগের উপশমের একটা উপায় আমি ভেবেছি।” গুরুদেব খুব মৃদুস্বরে বললেন।

     “আগামি পূর্ণিমার রাতে আপনি কি প্রস্তর খননে পারদর্শী কোনও বাস্তুকারকে নিয়ে আসতে পারবেন? সঙ্গে জনা কুড়ি প্রস্তর খননে বিশেষজ্ঞ শ্রমিক চাই। সবাইকে পাহাড়ের পাদদেশে রেখে, শুধু বাস্তুকারকে নিয়ে আপনি আমার কাছে আসবেন রাজন।”

     একটা কবুতর ডেকে উঠল। ওই কবুতর ডাকার অর্থ বিলক্ষণ জানেন মহারাজ। গুরুদেব এখন আবার গভীর নিদ্রায় চলে যাবেন। মহারাজ তাঁর পিতার কাছে শুনেছিলেন যে, গুরুদেব শুধুমাত্র প্রতি পূর্ণিমার রাতে খানিক সময়ের জন্যে জেগে ওঠেন। আর বাকি সময় নিদ্রামগ্ন থাকেন।

     মহারাজ আসন থেকে উঠে দাঁড়ালেন। গুরুদেবের আসনের সামনে গিয়ে সস্টাঙ্গে প্রনাম করলেন। বললেন যথা আজ্ঞা গুরুদেব।

     হাত তুলে আশীর্বাদ করলেন গুরুদেব।

     মশাল হাতে এক শিষ্য মহারাজকে পথ দেখিয়ে গুহার বাইরে নিয়ে এলেন।

     নত মস্তকে শিষ্যকে প্রনাম করে দ্রুত পাহাড় থেকে নামতে শুরু করলেন মহারাজ। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে।নিচে অনেক নিচে ঘন গাছের ঝোপে অন্ধকার জমাট বেঁধে রয়েছে।

     পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছে ঘোড়ায় চেপে বসলেন মহারাজ। রাজধানী পৌঁছতে পৌঁছতে দুপুর গড়িয়ে যাবে। হোলির আনন্দে মত্ত গ্রামগুলোর ঘুম ভাঙেনি এখনও।

     এই প্রথম একই বছরে দ্বিতীয় বার গুরুদেবের দর্শন পেতে চলেছেন মহারাজ রভিরান বর্মা। শুধু তাই নয় দ্বিতীয় কোনও ব্যক্তিকে সঙ্গে করে এই প্রথম গুরুদেব দর্শন। পাথর খননে বিশেষজ্ঞ বাস্তুকার ও শ্রমিকের প্রয়োজন পড়ল কেন মহারাজের বোধগম্য হয়নি। চর্ম ও পেটের অসুখের সঙ্গে পাথর খোঁড়ার সম্পর্ক কী, – অনেক ভেবেও মাথায় আসেনি মহারাজের। গুরুদেবের ওপর অটল আস্থা মহারাজের। ভ্রান্ত পথে রাজপরিবারকে চালিত করেননি কখনও।

     রাতের তৃতীয় প্রহর হতে এখনও খানিক বাকি। বাস্তুকারকে নিয়ে মহারাজ গুহা মুখের সামনে গুরুদেবের সাক্ষাতের অপেক্ষায়।সঙ্গী বাস্তুকার প্রচণ্ড উৎকণ্ঠায় আছেন। মহারাজ তাঁকে শুধুমাত্র কুড়ি জন পাথর কাটায় দক্ষ শ্রমিক জোগাড় করে,পাথর কাটার সব রকম সরঞ্জাম, মাসখানেকের রসদ ও তাঁবু কানাত সঙ্গে নিয়ে এই পাহাড়ের নিচে হোলি পূর্ণিমার পরের পূর্ণিমায় দ্বিপ্রহরে হাজির থাকতে বলেছিলেন। আর কিছু বলেননি। শিষ্টাচার মেনে মহারাজের হুকুম তামিল করেছেন বাস্তুকার। ন্যাড়া পাহাড়ের মাথায় সুবিশাল বট বৃক্ষের নিচে একটা গুহা মুখের সামনে মাঝরাতে কিসের প্রতীক্ষায় আছেন মহারাজ? বাস্তুকার শুধু জানেন এই পাহাড়ে মহারাজের গুরুদেবের আশ্রম। এই পাহাড়ে ওঠা সবার জন্যে অঘোষিত ভাবে নিষিদ্ধ। স্থানীয় মানুষের কাছে এই পাহাড়ের পরিচিতি বিষপাহাড় নামে।

     আচমকা একটা কবুতর ডেকে উঠল। তারপর একটা আলোর রেশ দেখা গেল গুহার ভেতরে। সাদা পোশাক পরা কেশহীন মস্তক, বুক পর্যন্ত দাড়ি সমৃদ্ধ এক বৃদ্ধ মশাল হাতে বট বৃক্ষের শেকড়ের আড়ালে থাকা গুহামুখ থেকে বেড়িয়ে এলেন। মহারাজ নতজানু হয়ে প্রনাম করলেন বৃদ্ধকে। দেখাদেখি বাস্তুকারও প্রনাম করলেন। বাস্তুকারকে হাতের ইশারায় অনুসরণ করতে বলে বৃদ্ধের পেছনে পেছনে চললেন মহারাজ। খানিক যাওয়ার পর গুহার ভেতরে একটা প্রশস্ত অংশে পৌঁছলেন সবাই। একটা মশাল জ্বলছিল আগে থেকে। বাস্তুকার দেখলেন এক উঁচু পাথরের বেদীর ওপর রোমশ শয্যায় শায়িত একজন অতি বৃদ্ধ মানুষ। মহারাজ বেদীর সামনে পৌঁছে সস্টাঙ্গে প্রনাম করলেন। বাস্তুকার অনুমান করলেন ইনিই মহারাজের গুরুদেব। তিনিও সস্টাঙ্গ হলেন।

     গুরুদেবের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন আরও একজন বৃদ্ধ, তিনি নিচু হয়ে গুরুদেবের কানে কানে কিছু বললেন। ধীরে ধীরে চোখ খুললেন গুরুদেব। হাত তুলে মহারাজকে আশীর্বাদ করে পাথরের আসন নির্দেশ করে বসতে বললেন। তারপর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বৃদ্ধকে অতি মৃদুস্বরে কিছু বললেন। বৃদ্ধ একটি নতুন মশাল প্রজ্বলিত করলেন। তারপর অনুসরণ করতে বলে ধীর পদক্ষেপে চললেন গুহার এক কোণায়। মেঝের কালো পাথরের ওপর অন্য কোন পাথর ঘষে আঁকা এক লেখচিত্রের সামনে দাঁড় করিয়ে বললেন “গুরুদেবের ইচ্ছে গুহার ভেতর থেকে উৎপন্ন এই জলধারার বর্তমান যাত্রাপথ মাঝ পাহাড়ে পরিবর্তন করার।”

     “বিগত বছরে প্রচণ্ড বৃষ্টিতে ধ্বস নেমে জলধারার গতিপথ এইখানে পরিবর্তিত হয়েছিল”- বলে লেখচিত্রের এক স্থানে অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন।“তারপর অনেকটা পথ পাহাড়ের অন্য এক ঢাল বেয়ে প্রবাহিত হয়ে এই জলধারা পাহাড়ের নিম্ন ভাগে এসে আবার পুরনো খাতে মিশে ঝাঁপ দিয়েছে পাহাড়ের পাদদেশের জলাশয়ে। এই জলস্রোতকে ফিরিয়ে আনতে হবে পুরনো পথে। গুরুদেবের মতে কাজটা জটিল কিন্তু কঠিন নয়। কাজটা সম্পন্ন করতে হবে অতি দ্রুত। বর্ষা আসার আগে।সম্ভব হলে এক পক্ষকালের মধ্যে।আশাকরি গুরদেবের কথা মত আপনি লোকজন প্রস্তুত রেখেছেন রাজন।”

     মহারাজ বললেন “পাহাড়ের পাদদেশে কুড়ি জন পাথর ফাটাতে পারদর্শী শ্রমিক অপেক্ষা করছেন বাস্তুকারের আদেশের অপেক্ষায়।”

     “ঠিক আছে রাজন, আপনি রাজধানী ফিরে যান। আর আজ থেকে তৃতীয় পূর্ণিমার রাতে গুরুদেবের  সঙ্গে এসে মিলিত হবেন। বাস্তুকার আপনার কোন জিজ্ঞাস্য আছে?”

     “এই জলস্রোত ধরে এগোলেই বুঝতে পারবেন জলস্রোত কোথায় গতি পরিবর্তন করেছে। পুরনো খাত একদম পরিষ্কার আছে। শুধু নতুন খাতকে রুদ্ধ করে জলের স্রোতকে পুরনো খাতে ফিরিয়ে আনতে হবে।”

     বাস্তুকার বললেন, “যথা আজ্ঞা।”

     বৃদ্ধ মশালটি তুলে নিয়ে গুহামুখের দিকে চললেন। মহারাজের দিকে ফিরে বললেন “গুরুদেবের  সঙ্গে আজ আর সাক্ষাৎ সম্ভব নয়। উনি নিদ্রামগ্ন হয়েছেন।”

     গুহার বাইরে বেড়িয়ে বৃদ্ধকে প্রনাম করে বাস্তুকারকে নিয়ে পাহাড় থেকে নামতে শুরু করলেন মহারাজ। উনি বুঝতে পারছেন না পাহাড়ের পাদদেশের গ্রামগুলোর অসুস্থতার  সঙ্গে জলস্রোতের খাত বদলের কি সম্পর্ক?

     ছয় পক্ষকাল পরে পূর্বপুরুষের কাটান রুনিত পাহাড়ের ধাপ বেয়ে পাহাড়ের মাথায় গুরুদেবের আশ্রমের দিকে চাঁদের আলোয় একাকি চলেছেন মহারাজ রভিরান বর্মা। এক বছরে তিনবার গুরুদেবের সাক্ষাৎ করতে চলেছেন তিনি। পথে রোগাক্রান্ত গ্রামগুলো দেখে এসেছেন। রোগের প্রকোপ অনেক কমে গেছে। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছে গ্রামের মানুষজন। দুশ্চিন্তার অবসান হয়েছে। বাস্তুকার শ্রমিকদের নিয়ে এক পক্ষকালের মধ্যেই জলস্রোতকে ফিরিয়ে দিয়েছিল পুরনো খাতে। গ্রামের মানুষজন জানতেও পারেনি পাহাড়ের ওপর কি ঘটেছে। কারণ এই পাহাড় নিষিদ্ধ পাহাড়। কিন্তু শুধু জলস্রোতের খাতকে বদলে রোগ উপশমের কারণটা এখনও অজানা।

     মহারাজ রাতের তৃতীয় পক্ষের আগেই গুহামুখের সামনে পৌঁছে অপেক্ষা করছিলেন। কবুতর ডেকে উঠতেই মশাল হাতে গুহা থেকে গুরুদেবের এক বৃদ্ধ শিষ্য বেরিয়ে এসে মহারাজকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন গুহার ভেতরে।

     গুরুদেবের শয্যার সামনে পৌঁছে সস্টাঙ্গে প্রনাম করে উঠে দাঁড়াতে গুরুদেব চোখ খুলে শয্যার উপর উঠে বসলেন। মৃদুস্বরে বললেন “রাজন কী জানার জন্যে উৎকণ্ঠিত, আমি অনুমান করতে পারছি।”

     “এই পাহাড়ের পাথরের স্তরে স্তরে মিশে আছে বিভিন্ন ধরনের খনিজ। ওই খনিজের বেশ কয়েকটি প্রাণিজগৎ এর জন্যে খুব বিপদজনক। এই কারনেই এ’ পাহাড়ের আরেক নাম বিষ-পাহাড়। আশ্রমের কয়েকটা কবুতর ছাড়া, এই পাহাড়ে কোন পশুপাখির দেখা পাবেন না। এই খনিজ এত বিষাক্ত যে কোন গাছও জন্মায় না পাহাড়ে। পুরো পাহাড়ে গুহার মাথার শুধু এই বট বৃক্ষটাই আছে। এটা যে কত প্রাচীন আমিও জানি না।” একটানা কথা বলে খানিক থামলেন গুরুদেব।

     “গতবছরের প্রচণ্ড বর্ষণে ধ্বস নেমে এই গুহাথেকে উৎপন্ন জলস্রোতের গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে বিষাক্ত খনিজের স্তরের উপর দিয়ে বইছিল। বিষাক্ত খনিজের সংস্পর্শে এসে জলও বিষাক্ত হয়ে উঠেছিল। আর এই বিষাক্ত জল গিয়ে পড়ছিল পাহাড়ের পাদদেশের জলাশয়ে। জলাশয়ের ওই জল ছোট-ছোট নালা বেয়ে আশপাশের গ্রামের পুকুরে জমা হচ্ছিল। এই বিষাক্ত জল পান করেই গ্রামের মানুষজন অসুস্থ হচ্ছিল। নতুন পথে প্রবহমান জলস্রোতকে ওর পুরনো খাতে ফিরিয়ে আনার ফলে জল আবার বিষমুক্ত হয়ে গেল।”

     এই পর্যন্ত শুনে গুরুদেবের শয্যার সামনে গিয়ে হাঁটু মুড়ে গুহার পাথরের মেঝেতে মাথা ঠেকালেন মহারাজ রভিরান বার্মা।

Tags: অরিন্দম দেবনাথ, কল্পবিজ্ঞান গল্প, তৃতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, বিজ্ঞানভিত্তিক গল্প, বিষ পাহাড়, সুদীপ্ত রায়

One thought on “বিষ পাহাড়

  • December 16, 2018 at 7:04 am
    Permalink

    Jomlo na ekdom. Climax e ektuo chomok nei. Purotai obvious.

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!