মারকত নন্দিনী

  • লেখক: সুমিত বর্ধন
  • শিল্পী: অদ্রীজা বর্ধন

দীর কিনারা বরাবর খুঁটি পুঁতে তার ওপরে কাঠের তক্তা বসানো জেটি বলতে ব্যস ওইটুকুই তার একপাশ দিয়ে আওয়াজ করে ছুটে চলেছে চলেছে বর্ষায় ভরে ওঠা ভৈরবী নদী অন্যপাশের উঁচু পাড়ের ওপর সার দেওয়া মালগুদাম

     জল কাদায় জেটিটা মাখামাখি হয়ে আছে একপাশে জড় করে রাখা কয়েকটা প্যাকিং বাক্সের অবস্থা তথৈবচতবু তারই মধ্যে একটার ওপরে কোনরকমে বসে পেছনের দিকে তাকায় বর্ণা

     চওড়া মেঠো রাস্তাটা জেটি থেকে উঠে মালগুদামের পাশ ঘেঁষে চলে গেছে বারগাঁ’র একদম শেষ সীমানায় কমিউনিটি হল অবধি। অন্যদিন এই সময়ে রাস্তায় লোক চলাচল শুরু হয়ে গেলেও আজ রাস্তা ফাঁকা গতকাল মাঝরাত অবধি আগমন দিবসের হৈহুল্লোড় আর তারপর ভোররাতের তুমুল বৃষ্টির পর এই সকালে বারগাঁ যেন ঝিমিয়ে আছে।

     আগমন দিবস। বছরের এই দিনটাতেই বুকের ভেতর হিমঘুমে শুয়ে থাকা হাজার দশেক অভিযাত্রী নিয়ে মারকতে নেমেছিল মোহিনীদুর্ভিক্ষ, মহামারী আর যুদ্ধ পীড়িত পৃথিবীর দুঃস্বপ্ন পেছনে ফেলে নতুন জীবন গড়ার হয়েছিল শুভারম্ভ

     কতদিন আগে নেমেছিল মোহিনী মারকতে? বর্ণার মনে নেই। ইতিহাসে বরাবরই তার বিশেষ আগ্রহ নেই। তবে মানুষ এ গ্রহের মাটিতে যখন পা রাখে তখন তার মায়ের বয়স শৈশব পেরোয়নি। আর বর্ণা এ গ্রহের প্রথম প্রজন্ম।

     নদীর ওপারের ঘন জঙ্গলের ভেতরে থেকে হঠাৎ ভেসে আসে থলকাছিমের খক্‌খক্‌ ডাক। গাছের আস্তানা ছেড়ে আচমকাই আকাশে ছিটকে যায় নীল সারসের ঝাঁক। জঙ্গল যেখানে নদীর জলে এসে মিশেছে, কোমরের হোলস্টারে হাত রেখে সেদিকে তীক্ষ চোখে তাকায় বর্ণা। কেশরীগোসাপের পাল হয়ত জল খেতে এসেছে। এই ভরা নদী তারা পার হবার চেষ্টা করবে এমন সম্ভাবনা যদিও খুবই কম, তবু সাবধানের মার নেই।

     দূর থেকে কানে আসে স্টিমার সাইরেনের ভারী আওয়াজ, নদীর বাঁকে আকাশের গায়ে দেখা দেয় ধোঁয়ার ধূসর কালো রেখা।

     মোহিনীগঞ্জের স্টিমার আসছে।

     জঙ্গলের দিকে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে, স্টিমারের আসার পথের দিকে নজর রাখে বর্ণা

     স্টিমারে তার মা আসছে

     মোহিনী যেখানে নেমেছিল, সেটা এখন মোহিনীগঞ্জ। মারকতে মানুষের প্রথম আর সবচাইতে বড় বসতি বর্ণাদের ছোট শহরটার নাম এককালে বাহিরগ্রাম ছিল, এখন লোকের মুখে মুখে বারগাঁ হয়ে গেছে

     দিনে একবার করে এই দুই বসতির মধ্যে যাতায়াত করে স্টিমারমোহিনীগঞ্জ থেকে নিয়ে আসে ওষুধ, যন্ত্রপাতি, কাপড়, আটা ইত্যাদি। যাবার সময়ে বারগাঁ থেকে নিয়ে যায় কাঠ, সব্জী আর শুকনো মাছ

     আর খমীনের তেল

     নানান ওষুধের মূল উপাদান

     বারগাঁর যেটুকু বাড়বাড়ন্ত সেটা ওই খমীনের তেলের জন্যেই

     সাইরেনের শব্দ তুলে স্টিমার এসে লাগে ঘাটে তার আওয়াজে যেন হঠাৎ ঘুম ভাঙে বারগাঁয়ের শুরু হয়ে যায় মানুষের আনাগোনা, ব্যস্ততা আর গুদাম থেকে নামিয়ে এনে জেটিতে মাল জমা করার কাজ

     স্টিমারের ডেক থেকে পাটাতন এসে পড়ে জেটিতে

     লম্বা পায়ে নেমে আসেন এক দীর্ঘাঙ্গী মহিলা মাথার ছোট করে ছাঁটা চুলে দুএকটা রূপোলী আঁচড় ছাড়া বয়সের আর কোন সাক্ষ্য নেই ঋজু শরীরে টানটান পিঠের ওপর আলগা করে ফেলা জলপাই রঙের লম্বা ব্যাগ, ডান দিকের ঊরুতে বাঁধা হোলস্টার থেকে উঁচিয়ে থাকে পিস্তলের বাঁট

     উর্ব্বী খমীন জাহাজের ক্যাপ্টেন বারগাঁর মেয়র

     বর্ণার মা

     উর্ব্বীর পেছনে ঢিমে তালে স্টীমার থেকে নামেন আর একজন। চওড়া কাঁধ, মাথার কাঁচাপাকা চুল পনিটেলের আকারে টানটান বাঁধা পিঠে রাইফেল

     খমীন জাহাজের সেকেণ্ড ক্যাপ্টেন মুত্থুস্বামী

     এগিয়ে আসে বর্ণা

     কেমন হল মা তোমার ট্রিপ?

     – প্রত্যেকবার যেমন হয় এবারে বাড়তি কেবল আগমন দিবসের উৎসব, আর উত্তরে একটা তামার খনির খোঁজ পাওয়া গেছে, সে নিয়ে নানান তক্কাতক্কি

     – তামা ! ভালো খবর তো! ইলেক্ট্রিক যন্ত্রপাতি বানাতে খুব কাজে দেবে

     – সে অনেক দূরের কথা। জঙ্গল সাফ করে খনি থেকে তামা বের করে কাজে লাগাতে আরো কমপক্ষে দুবছর।

     – তা যাক্‌গে চলো

       – মায়ের পিঠ থেকে লম্বা ব্যাগটা তুলে নিয়ে শহরের দিকে পা বাড়ায় বর্ণা

     – বর্ণা!

দাঁড়িয়ে পড়েন উর্ব্বী

     – কি হলো? দাঁড়িয়ে পড়লে কেন?

খানিকটা ইতস্ততঃ করেন উর্ব্বী

     – বর্ণা, তোকে একটা কাজের দায়িত্ব নিতে হবে

ভ্রু কোঁচকায় বর্ণা

     – কি কাজ?

     মোহিনীগঞ্জে ডক্টর সুবেশ একটা নতুন রিসার্চ ইন্সটিটিউট চালু করেছেন। মারকতের গাছপালা পশুপাখি নিয়ে নানান গবেষণা করছেন তাঁর একজন ছাত্রকে আমার সঙ্গে পাঠিয়ে দিয়েছেন –

     – তোমার সঙ্গে পাঠিয়েছেন? কেন?

     এখানে কিছু রিসার্চ স্টাডি করতে চায় খমীনের মরশুম এসে গেল, জানিস্‌ই তো, আমার কত কাজ যে কদিন থাকে তুই একটু দেখাশোনা করিস

     দেখাশোনা মানে?

     কি আর, সঙ্গে সঙ্গে থাকিস যা জানতে চায় দেখিয়ে দিসএদিক ওদিক ঘুরিয়ে দেখাস ওই তো নেমেছে স্টিমার থেকে

     স্টীমারের দিকে তাকায় বর্ণা জেটিতে এসে দাঁড়িয়েছে তারই বয়সী একটা ছেলে পরণে সাদা জামা, মাথায় তেরছা করে বসানো চওড়া কানাতের টুপি, মুখে অল্প দাড়িকোমরে পিস্তল দূরস্থান, একটা ছোরা পর্যন্ত নেই হাতে একটা হলুদ রঙের চামড়ার সুটকেস

     শহুরে ফুলবাবু!

    – মানে এখন আমাকে ওর ট্যুরিস্ট গাইডের কাজ করতে হবে? পারবো না!

     প্রায় ফেটে পড়ে বর্ণা

     ধমক দেন উর্ব্বী

     – আস্তে বর্ণা! ভদ্রতা সভ্যতা আর কবে শিখবি? আর নাক উল্টোচ্ছিস যে, কালকে মোহিনীগঞ্জে তোর কোন কাজ পড়লে তোরও তো কারোর সাহায্য লাগবে। শুভ্র, এদিকে এসো

     হাসিহাসি মুখ করে কাছে এসে দাঁড়ায় শুভ্রহাড় পিত্তি আরো জ্বলে যায় বর্ণার কিন্তু তাকে আর কিছু বলার সু্যোগ দেন না উর্ব্বী

     – শুভ্র, এ বর্ণা তোমাকে এ সব দেখিয়ে দেবে বর্ণা, আগে ওকে কমিউনিটি সেণ্টারে থাকার একটা ব্যবস্থা করে দেচল্‌ মুত্থু

     লম্বা পা ফেলে শহরের রাস্তা ধরেন উর্ব্বাবর্ণার দিকে একবার চোখে টিপে তাঁর সঙ্গে পা মেলান মুত্থুস্বা্মীও।

     রাগটা আর চেপে রাখতে পারে না বর্ণা

     – কি? দাঁড়িয়ে রইলে যে? চলো! কোলে করে নিয়ে যেতে হবে নাকি?

     ঝাঁঝালো কণ্ঠে কথাগুলো বলে পা বাড়ায় বর্ণা সামনের দিকে

     রাগের কারণ না বুঝতে পেরে হতভম্ব ভাবে তার পিছু নেয় শুভ্র

     শুভ্রটি যে আদতে একটি আয়েসী শহুরে ফুলবাবু সে সমন্ধে বর্ণা’র মনে যদি এতটুকুও সংশয় থেকে থাকত, কমিউনিটি সেণ্টার পৌঁছে সেটুকুও আর রইল না

     বারগাঁয়ের সবকটা দোতলা বাড়ির মধ্যে এই কমিউনিটি সেণ্টারটাই যা তিনতলা। তিনতলাটা ডর্মিটরি, বাইরে থেকে কেউ এলে এখানেই থাকে দোতলায় মেয়রের অফিস, কমিউনিকেশন রুম, বন্দুকখানা আর একটা ছোটখাট সংগ্রহাশালা। একদম নিচের তলার বিশাল হলঘরটা নামে ক্যাণ্টিন হলেও, দরকার পড়লে বারগাঁয়ের বাসিন্দাদের মিটিং এখানেই হয়।

     ডর্মিটরিতে পরপর রাখা খাট খাটের পাশে নিচু টুলে জলের বোতল আর মোমবাতি

     মোমবাতি দেখে কিঞ্চিৎ অপ্রসন্ন মনে হল শুভ্রকে

     – ইলেক্ট্রিক নেই?

     – না, নেইকমিউনিটি সেন্টারের দোতলার অফিস আর একতলার ক্যাণ্টিন ছাড়া বারগাঁয়ের কোথাও আর ইলেক্ট্রিক নেই

     বর্ণার গলা বরফের মতনই শীতল

     শীতলতাটুকু শুভ্রর গায়ে আদৌ লাগলো বলে মনে হল না

     – সে কি ! মোহিনীগঞ্জে তো প্রায় সবার ঘরেই ইলেক্ট্রিক রয়েছে!

     – তুমি কি গতকালই পৃথিবী থেকে মারকতে নামলে?

     বর্ণার কণ্ঠের শীতলতা প্রায় তরল নাইট্রোজনের মাত্রা ছুঁয়েছে

     – কই না তো! কেন?

     শুভ্রর ওপর তরল নাইট্রোজেনের কোন প্রভাব হল না

     – না হলে এইরকম অদ্ভূত প্রশ্ন করতে না মোহিনীগঞ্জের ইলেক্ট্রিক আসে শ্যামলাঝোরার টার্বাইন থেকে। আমাদের জেনারেটরে ডিজেল পুড়িয়ে ইলেক্ট্রিক বানাতে হয়

     – ওহো! তোমাদের ডিজেল বেশী নেই বোধহয়?

     – না, নেইআর যা আছে সেটা অন্য কাজের জন্যে জমিয়ে রাখতে হয় বুঝলে?

     বর্ণার কন্ঠস্বরের উত্তাপের মিটারের কাঁটাটা তরল নাইট্রোজেনের মাত্রার উল্টোদিকে সরে এখন প্রায় গলন্ত লোহা ছুঁইছুঁই

     – অন্য কাজ কোন কাজ?

     না, গলন্ত লোহারও কোন প্রভাব নেই

     – খমীন জাহাজের জ্বালানী ! আর কিছু জানতে চাও?

     – না না, বুঝতে পেরেছিশুধু –

     খাটের পাশের টুল থেকে জলের বোতলটা তুলে নাড়ায় শুভ্র,

     – শুধু এতে একটু জল ভরে এনে দাও এটা একদম খালি

     বর্ণার পায়ের দুমদাম শব্দ বোধহয় একতলার ক্যাণ্টিন অবধি শোনা গেল

     বর্ণা ভেবেছিল আর শুভ্র’র ধার মাড়াবে না, সে নিজের ইচ্ছেমত যা খুশি করুক। কিন্তু তাতেও তার হাত থেকে রেহাই পাওয়া গেল না

     দুপুরের দিকে সে কমিউনিকেশন রুমে একটা রেডিও মেরামত করার চেষ্টা করছে, হন্তদন্ত হয়ে মুকুল এসে হাজির হলো মুকুলের বয়স বছর সাতেক হবে, এমনিতে লাজুক স্বভাবের ছেলে, কথা কমই বলে, কিন্তু আজ যে কোন কারণেই প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে পড়েছে

     – দিদি শিগ্গির চলো

     – কেন রে, কি হয়েছে?

     – তোমাদের কে গেস্ট এসেছে না? খাঁচা খুলে সব হাতিহাঁস ছেড়ে দিয়েছে!

     মুকুল তার মুখের দিকে বড়বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে, অতএব ঠোঁটে প্রায় এসে যাওয়া গালাগালিটা গিলে নিয়ে দৌড় দিল বর্ণা

     হাতিহাঁসের খাঁচাটা কমিউনিটি সেন্টারের পেছন দিকে প্রায় দুমানুষ উঁচু, লোহার জাল দিয়ে ঘেরা

     এবং খালি

     কেবল এক কোনে একটা ভাঙা বাক্সের ওপর বসে শুভ্র, কোলের ওপর খোলা নোটবইসামনে পড়ে পা বাঁধা একটা হাতিহাঁস

     বর্ণাকে দেখে একটা কায়দা মার্কা হাসি হাসে শুভ্র

     – আরে এসোতোমার দেরি হচ্ছে দেখে আমি নিজেই একটু স্টাডি করতে এসে গেলাম অদ্ভূত না? পাখি হলে কি হবে, বিবর্তনের ফলে পালক সব হারিয়ে ফেলেছে, গায়ে কেবল মোটা কালো চামড়া আর গলাটা লক্ষ্য করেছ, কত লম্বা? জলের অনেক নিচ থেকে উদ্ভিদ ছিঁড়ে খায় জলচর বলে পায়ের পাতা চেটালো, আর ডানা দুটোও পাখনার মত হয়ে দাঁড়িয়েছে

     সকালের মত তরল নাইট্রোজেনের শীতলতা ফের ভর কর বর্ণার কণ্ঠে

     – ওগুলো আমি রোজই সকাল বিকেল দেখি। কিন্তু তুমি বাকি হাঁসগুলোকে ছেড়ে দিয়েছে কেন?

     মাথার টুপিটাকে একটু কায়দা করে বেঁকিয়ে নেয় শুভ্র

     – ওহো বাকিগুলো পালিয়ে গেছে বুঝি? খেয়াল করিনি!

     – বাঃ !

     তরল নাইট্রোজেন এবার জমে বরফ হবার পথে!

     নাঃ, কোন প্রতিক্রিয়া আসেনা শুভ্র’র থেকে। সে তখন নোটবুকের নীল স্ক্রীনে মন দিয়ে কি লিখতে ব্যস্ত।

     অতএব বর্ণাকেই একবার গলা খাঁকারি দিতে হয়

     – পালিয়ে যাওয়া হাঁসগুলোকে তো ধরতে হবে

     – নিশ্চই, নিশ্চই ধরে ফেলো

     নোটবুক থেকে মাথা না তুলেই জবাব দেয় শুভ্র

     – আমি ধরব?

     – হ্যাঁ হ্যাঁধরে ফেলো আমার কথা ভাবতে হবে না, আমি এখানে নিজের কাজ ঠিক চালিয়ে নেব

     মুখ নিচু করেই হাত নাড়ায় শুভ্র

     একটা প্রলয়ঙ্করী অগ্ন্যুৎপাতে বর্ণা ফেটে পড়ার আগেই তার জামায় টান পড়ে।

     – দিদি, হাঁসগুলোকে ধরতে যাবে না?

     মুকুল সঙ্গে তারই বয়েসী আর কয়েকটা কচিকাঁচা

     অগ্ন্যুৎপাতটা একটা লম্বা নিশ্বাস হয়ে বেরিয়ে আসে বর্ণার পাঁজর কাঁপিয়ে

     – চল্‌

     হাতিহাঁস ধরার কাজটা সহজ নয়অনেকদিন বাদে মুক্তির স্বাদ পেয়ে তারা তখন উর্দ্ধশ্বাসে এদিক সেদিক দৌড়চ্ছে প্রথমে তাদের পেছনে তাড়া করে তাদের কোথাও কোনঠাসা করো, তারপর তাদের পনেরোবিশ কেজি ওজনের চেহারাটাকে পাঁজকোলা করে খাঁচা অবধি বয়ে আনো সে বয়ে আনাটাও সুখকর নয়শুভ্র যতই বলুক বিবর্তনের ফলে হাতিহাঁস তাদের পালক হারিয়েছে, সেই আদি পালকের গোড়াগুলো তাদের শরীরে রয়ে গেছে কাঁটার মতনই, জড়িয়ে ধরলে হাতে বেঁধে তারপর বন্দীদশায় ফেরৎ যাবার পথে ঠুকরে আঁচড়ে প্রতিবাদ জানাতেও তারা মোটেও কসুর করে না

     সব হাঁস যতক্ষণে খাঁচায় ফেরৎ গেল, ততক্ষণে দিনের আলো প্রায় ফুরিয়ে এসেছে, সাথে ফুরিয়ে এসেছে বর্ণার সোজা হয়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতাও। হাতিহাঁস বয়ে বয়ে তার পিঠ আর কোমর ব্যাথায় টনটন করছে জ্বলে যাচ্ছে হাঁসের কাঁটা ফোটা হাত দুটো

     খাঁচার দরজাটা বর্ণা শেষবারের মত বন্ধ করছে, বেড়াতে বেড়াতে শুভ্র এসে হাজির হল, ঠোঁটে হাড় জ্বালানো হাসি

     – কি বর্ণা, সব হাঁস পাওয়া গেল?

     পিঠের পেছনে হাতটা মুঠো করে বর্ণা

     – তোমার কি মনে হচ্ছে?

     খাঁচার ভেতর উঁকিঝুঁকি মারে শুভ্র

     – হ্যাঁ সবকটাই তো রয়েছে মনে হচ্ছে তবে ধরতে একটু বেশী সময় লেগে গেল না?

     বর্ণার মুঠো করা হাতটা অজান্তেই ধীরে ধীরে শরীরের সামনের দিকে আসতে থাকে

     – তা, তুমি একটু সাহা্য্য করলেই পারতে, তাড়াতাড়ি হয়ে যেত হাঁসগুলোকে তুমিই যখন ছেড়ে দিয়েছিলে

     খাঁচার দিকে তাকিয়ে নাক সিঁটকোয় শুভ্র

     – ওগুলোকে ঘাড়ে করে বওয়া ঠিক পোষায় না

     – কেন? শহরের পরিষ্কার জামা কাপড় নোংরা হয়ে যাবে বলে? তার জন্যে আমরা গাঁইয়ারা তো আছিই, না কি?

     বর্ণার পাকানো মুঠিটা ওপর দিকে উঠতে থাকে শুভ্র’র উঁচু নাকের ওপর ওটা দমাস করে বসিয়ে দেওয়ার ইচ্ছেটাও অদম্য হয়ে উঠতে থাকে তার মনে

     কিন্তু তার ইচ্ছাপূরণের আগেই হন্তদন্ত হয়ে এসে হাজির হন উর্ব্বী

     – বর্ণা, তোকে কি একটা কাজের ভারও দেওয়া যায় না? সব হাতিহাঁস ছেড়ে দিয়েছিস, শহর শুদ্ধু লোকে বিরক্ত মুকুলকে হাঁসে ঠুকরে দিয়েছে, তার মাও রাগারাগি করছে

     বিস্ময়ে ক্ষোভে বর্ণার মুখ দিয়ে কথা বেরোয় না। মায়ের মুখের দিকে খানিক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে পেছন ফিরে হাঁটা দেয় নীরবে

     চোখের চেপে রাখা জলটা যদি কোনরকমে শুভ্রর সামনেই বেরিয়ে পড়ে, তাহলে অপমানের আর শেষ থাকবে না

     শুভ্র আবার কোন ঝামেলা পাকায় তার ঠিক নেই, তাই সকালে ঘুম ভাঙতেই হন্তদন্ত হয়ে কমিউনিটি সেণ্টারের দিকে পা বাড়ায় বর্ণা

     কিন্তু কমিউনিটি সেণ্টার অবধি যেতে হয় না, তার আগেই দেখা মেলে শুভ্রর স্টিমারঘাটের রাস্তাটা দিয়ে একটা বাক্স দড়ি বেঁধে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে আসছে সে

     বর্ণাকে দেখে কায়দা করে মাথার টুপিটা ঠিক করে শুভ্র

     – আমার কয়েকটা জিনিষপত্র আজই স্টিমারে এল

     থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে বর্ণা শুভ্রকে বিশ্বাস নেই, কাছে গেলেই হয়ত তাকে দিয়ে বাক্সটা বওয়াবে।

     অনুমান মিথ্যে হয় না তার, দড়ি ধরা হাত দুটো বর্ণার দিকে বাড়িয়ে ধরে শুভ্র

     – এটাকে কমিউনিটি সেণ্টারের ওপরের তলায় নিয়ে যেতে হবে

     নিজের হাতদুটো শরীরের দুপাশে ছড়িয়ে দেয় বর্ণা,

     – নিয়ে যাও, নিয়ে যাও

     কেমন বিস্মিত দেখায় শুভ্রকে,

     – আমি নিয়ে যাব?

     – আরে হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিয়ে যাও আমার কথা চিন্তা করতে হবে না, আমি আমার কাজ একা ঠিক চালিয়ে নেব

     একটা হতাশ ভঙ্গীতে মাথা নিচু করে ফের বাক্সের দড়ি টানতে শুরু করে শুভ্র

     খানিক বাদে যখন কমিউনিটি সেণ্টারের কমিউনিকেশন রুমে এসে বসে বর্ণা, তখনও সিঁড়ি দিয়ে বাক্স টেনে তোলার আওয়াজ আসছে

     নিজের মনেই খানিকটা হেসে রেডিও নিয়ে পড়ে বর্ণা

     কিন্তু রেডিও মেরামতির কাজ তার বেশিক্ষণ করা হয়ে ওঠে নাহঠাৎই নিচ থেকে কানে আসে কচিকাঁচাদের গলায় হৈচৈ

     জানলা দিয়ে উঁকি মারে বর্ণা। মুকুল আর তার দলবল জড় হয়েছে নিচে, সবার দৃষ্টি কমিউনিটি সেণ্টারের ছাদের দিকে

     আতঙ্কে ছাদের দিকে ছুট দেয় বর্ণা, শুভ্র আবার তাকে কোন ফ্যাসাদে ফেলার যোগাড় করছে কে জানে!

     ছাদের দরজা খোলা, একদিকে পাঁচিলের ওপর হেলানো একটা চওড়া তক্তা ছাদের মেঝের অনেকখানি জুড়ে ছড়ানো একটা রঙচঙে কাপড়

     – কি করছো তুমি এখানে?

     নিচু হয়ে রঙীন কাপড়টা আরো ছড়িয়ে দিচ্ছিল শুভ্র, উঠে দাঁড়ায় বর্ণার কথায়

     – এটাকে টেস্ট করব

     বর্ণা খেয়াল করে রঙীন কাপড়টা থেকে অনেকগুলো দড়ি এসে শেষ হয়েছে শুভ্র’র বুকে পিঠে বাঁধা বেল্টে

     – টেস্ট করবে মানে? কি এটা?

     গর্বের হাসি হেসে নিচে পড়ে থাকা কাপড়টার দিকে ইঙ্গিত করে শুভ্র

     – পাওয়ার প্যারাশুট মোহিনীর ডেটাবেস থেকে ডিজাইনটা জোগাড় করেছি। তারপর পুরনো ফেলে দেওয়া যন্ত্রপাতির পার্টস থেকে এটা বানিয়েছি

     সামান্য ঘুরে নিজের পিঠের দিকটা দেখায় শুভ্র

     পিঠে বাঁধা একটা গোল ফ্রেম ফ্রেমের ভেতর একটা প্রপেলারের আকারের পাখা, নিচে একটা ছোটখাট ইঞ্জিন

     – এ দিয়ে কি হবে? তুমি কি আকাশে ওড়ার চেষ্টা করছ নাকি?

     – নয়ত কি? এমনি এত পরিশ্রম করলাম নাকি? ওই পেছন দিকের তামাঝুরি গাছের মাথায় কাঠশেয়ালের বাসা আছে দেখেছি একদম ওপর থেকে ছবি তুলব

     হাতের আঙুলে পরা হিরের মতন ঝকঝকে ক্যামেরা লেন্সটা তুলে দেখায় শুভ্র

     বিস্ময়ে হাঁ হয়ে যায় বর্ণার মুখ শুভ্রকে কেবল শহুরে বাবু ভাবাটা তার ভুল হয়েছিল। এ তো একেবারে উন্মাদ!

     মাটিতে পেতে রাখা কাপড়টা আর একেবার ভাল করে পেতে দিয়ে কোথায় একটা সুইচ টেপে শুভ্র। গর্জন করে ঘুরতে থাকে তার পিঠে বাঁধা প্রপেলারের পাখা

     শুভ্রকে চেপে ধরবে, নাকি তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিরস্ত করবে স্থির করতে না পেরে স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে বর্ণা

     ছুটতে শুরু করে শুভ্র, টান লেগে হাওয়ায় ভেসে ওঠে তার পেছনে বাঁধা প্যারাশুট

     ছুটতে ছুটতে পাঁচিলের গায়ে হেলান দেয়া তক্তাটা বেয়ে পাঁচিলে উঠে পড়ে শুভ্র

     তারপর বর্ণা কোনরকম বাধা দেবার আগেই ঝাঁপ দেয় পাঁচিল থেকে

     একটা অস্ফূট আর্তনাদ বর্ণার প্রায় গলার কাছে এসে আটকে যায়, শুভ্রর পেছনে সেও ছুটে যায় পাঁচিলের পাশে

     না তিনতলার ওপর থেকে মাটিতে আছড়ে পড়ে না শুভ্র প্যারাশুট আর পিঠের প্রপেলারে ভর করে সে উড়ে যায় ওপরে আকাশের দিকে

     নিচে আনন্দে চিৎকার করে ওঠে বাচ্ছারা খানিকটা ওপরে ওঠার পর আকাশেই একটা চক্কর কেটে পেছনের দিকে ফিরে আসে শুভ্র, কমিউনিটি সেণ্টারের মাথার ওপর দিয়ে উড়ে চলে যায়া শহরের বাইরের দিকে

     হৈহৈ করে তার পিছু নেয় বারগাঁর বাচ্ছারা

     হুড়মুড় করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসে বর্ণা, সেও পিছু নেয় বাচ্ছাদের

     বারগাঁর মানুষজন থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে এক অদ্ভূত শোভাযাত্রা দেখে আকাশে প্যারাশুট বেঁধে ওড়ে শুভ্র, নিচে তার পেছনে ছোটে বাচ্ছারা, আরা বাচ্ছাদের পেছনে ছোটে বর্ণা

     কমিউনিটি সেণ্টার আর হাতিহাঁসের খাঁচা পার হয়েই খানিকটা খালি জমি ঢালু হয়ে গেছে উঠে গেছে ওপরের দিকে মাঠের শেষপ্রান্তে একটা উঁচু তামাঝুরি গাছ, চেটালো পাতার ফাঁক দিয়ে নেমে এসে পেঁচানো তামার তারের মতন তার অজস্র লতানে শেকড় স্পর্শ করেছে মাটি

     গাছের ওপর প্যারাশুট ধরে সশব্দে চক্কর কাটে শুভ্র, আঙুলের ক্যামেরা তুলে তাক করে গাছের মাথার দিকে। নিচ থেকে তাকিয়ে দেখতে থাকে বর্ণা আর বারগাঁর ক্ষুদেরা

     রোটরের আওয়াজে চমকে উঠে গাছের মাথা থেকে আকাশে লাফিয়ে ওঠে গায়ে তামাটে সাদা ডোরাকাটা কয়েকটা লোমশ প্রাণী, পেছন আর সামনের পায়ের মাঝখানের চামড়াসর্বস্ব ডানা মেলে উড়তে থাকে আকাশে

     হৈহৈ করে ওঠে বাচ্ছারা,

     কাঠশেয়াল !! কাঠশেয়াল !!

     আওয়াজে ঘাবড়ে গিয়ে এদিক সেদিক আরো ছিটকে যায় প্রাণীগুলো আর তার মধ্যে একটা গিয়ে ধাক্কা মারে শুভ্রর গায়ে

     আচমকা ধাক্কায় কেমন ব্যালেন্স টলে যায় শুভ্রর, প্যারাশুট হেলে গিয়ে সে হঠাৎ করে মুখ নিচু করে পড়তে থাকে নিচের দিকে।

     থেমে যায় বাচ্ছাদের হট্টগোল, সবাই মিলে তাকিয়ে থাকে শুভ্রর দ্রুতগতিতে নিচে নামতে থাকা শরীরটার দিকে

     শেষ মুহুর্তে সামলে নেয় শুভ্র, দড়ির টানে সোজা করে নেয় প্যারাশুট, শরীরটাকেও সোজা করে পা দুটো নামিয়ে আনে মাটির দিকে

     পিঠের প্রপেলার শুভ্রকে ঠেলতে থাকে সামনের দিকে

     সামনের দিকে, যেখানে হাতিহাঁসের খাঁচা

     মাটিতে নামতে পারে না শুভ্র তার আগে উড়ন্ত অবস্থাতেই তার সামনে ছড়ানো পা দুটো সজোরে আঘাত করে খাঁচার দরজায়

     ধাক্কা সামলাতে না পেরে শুভ্র ছিটকে পড়ে মাটিতে উড়তে থাকা প্যারাশুট লুটিয়ে পড়ে আপাদমস্তক ঢেকে দেয় তার

     আর সে ধাক্কাতে উপড়ে যায় খাঁচার দরজার ছিটকিনি হাট হয়ে খুলে যায় দরজা

     মুক্তির আনন্দে তীক্ষ্ণ আওয়াজ তুলে খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে হাতিহাঁসের পাল

     এবং তারপর গত দিনের পুনশ্চ

     অর্থাৎ হাতিহাঁস বওয়া, তাদের কাঁটার খোঁচা এবং ঠোঁটের ঠোক্কর খাওয়া, এবং সর্বশেষে ফের উর্ব্বীর ধমক

     মানুষ খুন করার প্রবল ইচ্ছেটাকে কোনমতে বাগে এনে তবে সে রাত্রে ঘুমোতে পারে বর্ণা

     স্পীডবোটটার হাল ধরে নদীর ঢেউয়ের ওপর দিয়ে দক্ষ হাতে নাচিয়ে নাচিয়ে অন্য পাড়ের দিকে নিয়ে যায় বর্ণাচওড়া কানাতের টুপি মাথায় দিয়ে নৌকোর অন্যদিকে বসে থাকে শুভ্র।

     শুভ্রর নদীর ওপারের জঙ্গলটা দেখতে চাওয়ার ইচ্ছেটাতে প্রথমে একেবারে সটান না করে দেবে ভেবেছিল বর্ণা। কিন্তু তারপর তার মাথায় এল জঙ্গলে নিয়ে গেলে শুভ্রর পক্ষে আবার করে কোন নতুন ফ্যাসাদ বাধানোর সম্ভাবনা কম।

     হালের মোচড়ে বোটটাকে পাড়ে ঠেকায় বর্ণা। দড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলে একটা গাছের নিচু ডালে।

     বোট ছেড়ে মাটিতে পা রাখে শুভ্র, পাখার ঝটপট আওয়াজ তুলে উড়ে যায় দুতিনটে নীল সারস

     বোট থেকে রাইফেল তুলে নিয়ে সেফটি টানে বর্ণা, শুভ্রকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যায় আগে

     – দেখে এসো, এই জঙ্গলে কেশরী গোসাপের অভাব নেই

   সেকি, বন্দুক হাতে তুমি থাকতেও?

     শুভ্রর ব্যঙ্গের একটা ঝাঁঝালো জবাব দিতে গিয়েও চুপ করে গেল বর্ণা। শুভ্রর চামড়ায় যে কোন কথারই প্রভাব পড়ে না, তা সে এই দুদিনেই দেখে নিয়েছে। খামোখা নিজের মাথা গরম করে লাভ নেই।

     উঁচু গাছগুলো আকাশ ছুঁয়েছে, তাদের পাতার ফাঁক দিয়ে নিচে নেমে আসা রোদছায়ার আলো আঁধারির মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলে বর্ণা, পেছনে ধীরে ধীরে কমে আসে নদীর জলের শব্দ।

     খানিক হাঁটার পর ক্রমশঃ কমে আসতে থাকে গাছের ভিড়, তারপর হঠাৎই ফুরিয়ে যায় একটা ঘাসে ঢাকা মাঠের সীমানায়।

     মাঠের ঠিক আগে একটা ঢিবির পেছনে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ে বর্ণা, পাশে রাইফেল রেখে আঙ্গুল তুলে দেখায় সামনের দিকে।

     – থলকাছিম

     মাঠে চরে বেড়ায় কয়েকটা ছপেয়ে প্রাণী, পিঠে তাদের গোলাকার পাটকিলে রঙের খাঁজকাটা খোলস, মাটি থেকে সে খোলসের উপরিভাগ অন্ততঃ হাত তিনেক উঁচুতে হবে

     বর্ণার পাশে উপুড় হয়ে মাঠে চরতে থাকা প্রাণীগুলোর ওপর চোখ রাখে শুভ্র

     – এগুলোকে কাছিম বলাটা ভুল।

     – তাই?

     বর্ণার প্রশ্নে শ্লেষের ছোঁয়াটুকু শুভ্র’র গায়ে লাগলো বলে মনে হল না

     – হ্যাঁ বিপদে পড়লে এরা ছুটে পালায়, কাছিমের মত খোলসের মধ্যে নিজেদের গুটিয়ে নেয় না।

     – ভাগ্যিস বললে ! না হলে তো জানতেই পারতাম না!

     – হ্যাঁ, খোলসটা মারকতের মাংসভোজী শিকারী প্রাণীদের থেকে বাঁচার জন্যে বাড়তি সুরক্ষা।

     – আচ্ছা ! তাই নাকি? তুমি কত কিছু জানো দেখছি!

     ব্যঙ্গের খোঁচাটা এতক্ষণে বোধহয় শুভ্র’র গায়ে লাগে বর্ণার দিকে ফিরে সে কিছু একটা বলতে যাবে, ঠোঁটে আঙুল ঠেকিয়ে বর্ণা থামিয়ে দেয় তাকে

     মাঠে চরতে থাকা পশুগুলো হঠাৎ কেমন সতর্ক হয় উঠেছে মোটা চামড়ার বর্ম বসানো মাথাটা তুলে চেষ্টা করছেহাওয়ায় কিছুর ঘ্রাণ পেতে

     খুব সম্ভব কোন শিকারী প্রাণীর উপস্থিতি টের পেয়েছে তারা

     রাইফেলের স্কোপটা দিয়ে দূরের মাঠ আর তার পেছনের জঙ্গলের সীমানাটা দেখতে চেষ্টা করে বর্ণা

     – কি হল বর্ণা

     – শ্‌শ্‌শ্‌ দেখতে দাও থলকাছিমগুলো সাবধান হয়ে গেছে হয়ত আশেপাশে কেশরী গোসাপ আছে

     স্কোপ দিয়ে খুঁটিয়ে দেখেও কিছু নজরে পড়ে না বর্ণার

     – ইয়ে, বর্ণা

     – বিরক্ত কোর না বলছি না দেখতে দাও! কাছাকাছি কোথাও কেশরী গোসাপ থাকতে পারে

     – ইয়ে, সেইজন্যেই তো তোমার থেকে দুএকটা জিনিষ জানতে চাইছি

     রাইফেলের স্কোপ থেকে চোখ তোলে না বর্ণা,

     – কি?

     – কেশরী গোসাপ কি এই লম্বায় সাতআট ফুটের মতন হয়?

     – হ্যাঁ!

     – ল্যাজটা প্রায় শরীরের মতনই মোটা

     – হ্যাঁ!

     – সামনের দুটো পায়ের তুলনায় পেছনের পা চারটে খুব ছোট হওয়ার দরুণ ল্যাজ আর শরীরের শেষের দিকটা প্রায় মাটিতে ঘষটে চলে?

     – হ্যাঁ!

     – চোঙের মতন মুখটা ঘাড়ের কাছে চওড়া হয়ে শুরু হয়ে সামনের দিকে ক্রমে ছুঁচলো হয়ে এসেছে? আর চওড়া দিকটা ঘিরে লালচে হলুদ রঙের কেশর?

     বিরক্ত হয়ে রাইফেলের স্কোপ থেকে চোখ সরায় বর্ণা

     – হ্যাঁ কিন্তু তখন থেকে তুমি এসব প্রশ্ন করছ কেন? আমার পড়া ধরছো নাকি?

     – এইজন্যে যে একটু দূরেই ওইরকম দেখতে একটা প্রাণী থলকাছিমগুলোর ওপর লক্ষ্য রাখছে ওই যে ওইদিকে

     ঘাড় ঘোরায় বর্ণা তাদের থেকে কিছুটা দূরে ঝোপের আড়াল থেকে মাথা উঁচু করে থলকাছিমের পালের ওপর নজর রাখে একটা কেশরী গোসাপ

     গলার স্বর আরো এক পর্দা নেমে আসে বর্ণার।

     – আমাদের দেখতে পায় নিআস্তে আস্তে পেছনের দিকে চলে এসোএরা দল বেঁধে শিকার করে আরো কয়েকটা এদিক ওদিক লুকিয়ে থাকতে পারে

     উঠে দাঁড়িয়ে সন্তর্পণে পিছু হটতে থাকে দুজনে কেশরী গোসাপের মনোযোগ তখন থলকাছিমের পালের দিকে, তার নজর এড়িয়ে দুজনে পেছিয়ে যায় খানিকটা

     কিন্তু শেষরক্ষা হয় না

     হাওয়ায় ঘ্রাণ নিতে থাকা একটা থলকাছিম হঠাৎই টের পায় তাদের উপস্থিতি তাদের দিকে মুখ ফিরিয়ে ডেকে ওঠে খক্‌খক্‌ শব্দে

     পালের বাকি থলকাছিমগুলোও একজোটে তাদের দিকে ফিরে গলা মেলায় একই আওয়াজে, তারপর প্রাণপণে দৌড় লাগায় মাঠ ছেড়ে

     মাথা ঘোরায় কেশরী গোসাপ, কপালের তিনটে নিষ্পলক চোখ দিয়ে খানিক্ষণ জরিপ করে তাদেরতারপর তার লম্বা ছুঁচলো মুখটা একদম ডগা থেকে তিনটে চঞ্চুতে ভাগ হয়ে খুলে যায় ফুলের পাপড়ির মতন, প্রকাশ পায় করাতের মতন ধারালো দাঁতের সারি

     মুখ উঁচু করে একটা রক্ত জল করা তীক্ষ্ণ আওয়াজে চিৎকার করেওঠে কেশরী গোসাপ।

     তারপর এঁকেবেঁকে ছুটে আসে বর্ণা আর শুভ্রর দিকে

     কাঁধে রাইফেল তুলে দুদুবার গুলি ছোঁড়ে বর্ণা, লক্ষ্যভ্রষ্ট হয় দুটোই

     – পালাও!

     বন্দুক নামিয়ে ছুট দেয় বর্ণা

     একহাতে মাথার টুপি চেপে ধরে ছোটে শুভ্র, তার পেছনে রাইফেল হাতে দৌড়য় বর্ণা, আর তাদের পেছেন ঝোপঝাড় ভাঙার শব্দ তুলে ছুটে আসে বিশাল আকারের কেশরী গোসাপ

     এক মূহুর্ত থেমে ফের গুলি চালায় বর্ণা কিন্তু ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে সরীসৃপের মতন বিদ্যুতবেগে এঁকেবেঁকে ছুটে আসতে থাকা প্রাণীটিকে আঘাত করা অত সহজ নয় গুলি বেঁধে একটা গাছের গায়ে, অব্যাহত থাকে কেশরী গোসাপের আক্রমণের গতি

     ফের দৌড়য় বর্ণা খেয়াল করে শুভ্র এগিয়ে গেছে অনেকটা আগে, কানে আসছে নদীর জলের শব্দ আর খানিকটা গিয়ে স্পীডবোটে উঠে পড়তে পারলেই রক্ষা পাওয়া যাবে পশুটার হিংস্র কামড় থেকে

     নদী অবধি পৌঁছনো হয় না তার আগেই ঝোপঝাড় ভাঙার আওয়াজে বর্ণা টের পায় কেশরী গোসাপ এসে পড়েছে প্রায় তার ঘাড়ের ওপর

     পেছন ফিরে আর একবার গুলি চালানোর চেষ্টা করে বর্ণা, কিন্তু তার আর সুযোগ পায় নাকেশরী গোসাপ লাফিয়ে পড়ে তার ওপর

     একদম শেষ মুহুর্তে রাইফেলটাকে আড়াআড়ি ধরে শরীরটাকে কেশরী গোসাপের নখের আঘাত থেকে বর্ণা বাঁচায় বটে, কিন্তু টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যায় মাটিতে

     তারপরে শুরু হয় এক অসম লড়াই

     মাটিতে চিৎ হয়ে পড়ে থাকে বর্ণা, তার উঁচু করা দুহাতে আড়াআড়ি ধরা রাইফেল, রাইফেলের ওপর ভর দিয়ে কেশরী গোসাপের সামনের দুই পা

     রাইফেলের বেড়া টপকে বর্ণার শুয়ে থাকা শরীরটার দিকে মাথাটা নিয়ে আসার চেষ্টা করতে থাকে কেশরী গোসাপ আর তার তাকে প্রাণপণ শক্তিতে দুহাতে ঠেলে সরিয়ে বাধা দেয় বর্ণা গোসাপের ফাঁক হয়ে থাকা তিনটে লম্বা চঞ্চুর পেছনের মুখগহ্বর থেকে বর্ণার গায়ে ঝরে পড়ে লালা, তার দুর্গন্ধময় শ্বাস মেশে বর্ণার নিঃশ্বাসে

     মারকতের আদিম পশুর আসুরিক শক্তির সাথে পেরে ওঠা মানুষের পক্ষে দুঃসাধ্য বর্ণা বুঝতে পারে তার হাত দুটো আস্তে আস্তে ভাঁজ হয়ে যাচ্ছে নিচের দিকে, আর সাথে সাথে কেশরী গোসাপের ধারালো চঞ্চুগুলো নেমে আসছে তার গলার দিকে

     হঠাৎই গোসাপের শরীরের পেছনে উঁকি দেয়একটা টুপি পরা মাথা

     শুভ্র!

     কেশরী গোসাপ তার উপস্থিতি টের পাবারআগেই শুভ্র লাফিয়ে পড়ে তার পিঠের ওপর, দুহাতে জড়িয়ে ধরে লালচেহলুদ কেশর বসানো গলা

     আচমকা আক্রমণে খানিক হকচকিয়ে যায় কেশরী গোসাপ মাথাটা ঘুরিয়ে নিয়ে আক্রমণ করতে চেষ্টা করে শুভ্রকেতাতে না সক্ষম হয়ে বর্ণার ওপর থেকে সরিয়ে নেয় শরীরের ভারপিঠটাকে বেঁকিয়ে চুরিয়ে ফেলে দিতে চেষ্টা করে শুভ্রকে

     গোসাপের পিঠে এদিক ওদিক দোলে শুভ্র, টুপি ছিটকে যায় মাথা থেকে, কিন্তু তবু কেশর বসানো গলাটায় দুহাতের আঁটুনি আলগা হয় না তার

     সু্যোগ ছাড়ে না বর্ণা রাইফেলের ওপর থেকে কেশরী গোসাপের চাপ খানিকটা কমে যেতেই সরিয়ে নেয় একটা হাত কোমরের নিচে চাপা পড়ে যাওয় হোলস্টার থেকে হিঁচড়ে বের করে আনে পিস্তল

     তারপর গোসাপের গলায় নলটা ঠেকিয়ে চাপ দেয় ট্রিগারে

     একবার। দুবার বারবার

     উন্মত্তের মত ট্রিগার টিপতে থাকে বর্ণা, যতক্ষণ না একটা ক্লিক আওয়াজ তুলে পিস্তল জানান দেয় যে ম্যাগাজিন খালি হয়ে গেছে

     – বর্ণা

     শুভ্র’র গলার আওয়াজ যেন বহু দূর থেকে ভেসে আসে

     মাথা ঘোরায় বর্ণ। 

     এক পাশে মাটিতে শুয়ে হাঁপায় শুভ্র

     – বর্ণা।

     – কি?

     বর্ণার মনে হয় তার নিজের গলাটাও অনেক দূর থেকে আসছে

     মাথা তুলে ইঙ্গিত করে শুভ্র

     – মরে গেছে!

     ওপরের দিকে তাকায় বর্ণা, গোসাপের মাথাটা ঝুলে গেছে একদিকে, কপালে বসানো তিনটে চোখেই নিভে এসেছে আদিম বুভুক্ষার আগুন, গুলি লাগা গলা থেকে রক্ত ঝরে পড়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে তার জামা

     গোসাপের নিথর ভারী শরীরটার নিচে থেকে নিজেকে টেনে হিঁচড়ে বের করে আনে বর্ণা রাইফেলে ভর দিয়ে কোনমতে উঠে দাঁড়ায় মাটি থেকে

     – শুভ্র!

     উঠে বসে শুভ্র

     – কেশরী গোসাপ দল বেঁধে শিকার করে এখনি আরো কয়েকটা এসে পড়তে পারে

     আঙুলের ক্যামেরা দিয়ে কয়েকটা ছবি তুলে নেয় শুভ্র গোসাপের শরীর থেকে কয়েকটা নমুনা ছুরি দিয়ে কেটে ভরে নেয় একট ছোট বাক্সে

     – চলো !

     রাইফেলে ভর দিয়ে আগে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটে বর্ণা, তার পেছনে শুভ্রবাড়তে থাকে নদীর জলের আওয়াজ।

     নদীর পাড়ে পৌঁছে স্পীডবোটের দড়ি খোলে বর্ণা। বোটে উঠে স্টার্ট দেয় ইঞ্জিনে

     কিন্তু বোট ছাড়তে যাবার আগেই হঠাৎ বাধা দেয় শুভ্র

     – দাঁড়াও, দাঁড়াও!

    – কি হলো আবার?

     মাথায় হাত দেয় শুভ্র

     – দেখছো না, টুপিটা ফেলে এসেছি টুপি ছাড়া আমি কোথাও যাই না

     – তোমার মাথা খারাপ নাকি? বললাম না, আরো কেশরী গোসাপ থাকতে পারে?

     – কিচ্ছু হবে না, এখনই চলে আসছি তুমি বোটের স্টার্ট বন্ধ কোরো না

     হাত নেড়ে গাছের আড়ালে হারিয়ে যায় শুভ্র

     জলের আর ইঞ্জিনের শব্দের মধ্যে একা বসে থাকে বর্ণা মুহূর্তগুলো জমে মিনিট হয়, মিনিটগুলোও লম্বা হয়ে একটা এক একটা ঘন্টার মত লাগতে থাকে

     যখন ধৈর্য্যের প্রায় শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে বর্ণা, ঠোঁটের ডগায় প্রায় বুদ্বুদের মতন উঠে আসব আসব করছে বাছাবাছা গালাগালি, তখনই এক হাতে মাথার টুপি চেপে ধরে গাছপালা ভেদ করে দৌড়তে দৌড়তে হাজির হয় শুভ্র।

     – ছাড়ো, ছাড়ো বোট ছেড়ে দাও

     বর্ণার অপেক্ষায় না থেকে, নিজেই জলে নেমে বোটাটাকে খানিকদূর ঠেলে নিয়ে যায় শুভ্র তারপর এক লাফে উঠে পড়ে জল থেকে বোটে

     – চলো! চলো চলো!!

     শুভ্র’র তাড়ার কারণটা না বুঝলেও হাতের চাপে ইঞ্জিনের রেশ বাড়িয়ে দেয় বর্ণা বোট লাফিয়ে চলে আসে মাঝ নদীতে

     আর প্রায় সঙ্গেই সঙ্গেই গাছপালার আড়াল থেকে নদীর পাড়ে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ে দুদুটো কেশরী গোসাপ, শিকার ফস্কে গেছে দেখে খোলা মুখের তিনটে চঞ্চু আকাশের দিকে তুলে পরের পর ক্রুদ্ধ চিৎকারে ভরিয়ে ফেলে বাতাস।

     সকালের আলো ফুটতে এখনো অনেক দেরি আকাশের বুকে পাণ্ডুর আলো বিলোয় মারকতের ক্ষয়াটে চাঁদ জীবক, সে আলোয় চিকচিক করে রূপসী

     খমীন জাহাজ রূপসীর চেহারায় রূপ সামান্যই আকৃতিতে যেন একটা বিশাল স্ফীতাকার কুশন মাটি থেকে কম করে ছমানুষ সমান উঁচু, দৈর্ঘ্য একশো ফুট ছাড়িয়েছে

     কুশনের তলার দিকে ঠিক মাঝখানটায় যেন তাচ্ছিল্য ভরে গুঁজে দেওয়া একটা লম্বাটে বাক্স হিলিয়াম ঠাসা কুশনের তুলনায় সেটাকে নিতান্তই ছোট মনে হলেও সেটাও আড়ে বহরে কম হবে না

     দুমানুষ উঁচু এই বাক্সটা টানা চলে গেছে একদম কুশনের শেষ অবধি এইটা জাহাজের বসতকুটিএকাধারে মালগুদাম, যন্ত্রগৃহ আর বায়ুনাবিকদের বাসস্থান রূপসীতে মানুষের ব্যবহারের জায়গা কেবল এই অংশটুকুই

     বাকিটুকু ফাঁপা এবং কোষের মত অসংখ্য প্রকোষ্ঠে ভাগ করা ওড়ার ঠিক আগে রূপসীর পেটের মধ্যে রাখা সিলিণ্ডারে ভরা তরল হিলিয়ামকে গ্যাসে পরিণত করে ভরে ফেলা হবে ওই সব প্রকোষ্ঠেবাতাসের চাইতে হাল্কা হয়ে এয়ারশিপ রূপসী ভেসে উঠবে আকাশে

     বসতকুটির ওপরের দিকে বসানো কাঁচের জাফরি বসানো ককপিটটা অন্ধকারে হীরের মতই ঝকঝক করে তার নিচে বসতকুটিরের সামনের দেওয়াল ঢালু হয়ে মাটি ছোঁয় র‍্যাম্পের মতন র‍্যাম্প দিয়ে রূপসীর নাবিকেরা ঠেলে তোলে মালপত্র আর নানানমেশিন প্রবেশ পথের আলোকিত চতুষ্কোণে আঁকা তাদের মসীবর্ণ সিল্যুয়েট এক এক করে হারিয়ে যেতে থাকে বসতকুটির সুবিশাল গর্ভ নীড়ে

     ভিড়ের একদম শেষে আলোর বুকে কিছুক্ষণের জন্যে পরিস্ফূট হয়ে ওঠে একটা টুপি মাথায় দেওয়া চেহারা

     শুভ্র

     মিটিং এ খমীন শিকারে শুভ্রর আসার কথাটা তোলার সময়ে উর্ব্বী একবার বর্ণার দিকে তাকাতে ভোলেননি। বর্ণার প্রতিবাদটা তাঁর প্রত্যাশিত ছিল

     কিন্তু সে প্রতিবাদ বর্ণা করল এতটাই দুর্বল ভাবে, যে কেবল হাত নেড়েই তাকে খড়কুটোর মত উড়িয়ে দিতে উর্ব্বীর লাগল কয়েক সেকেণ্ড মাত্র

     নিজের ওপরেই রাগ হয় বর্ণারআরো জোর গলায় তার আপত্তি জানানো উচিৎ ছিলো শহুরে বাবু আবার কি ঝামেলা পাকাবে তার ঠিক নেই

     একটা সাইরেন বেজে ওঠে, এয়ারশিপের প্রবেশপথে বৃত্তাকারে ঘুরতে থাকে হলুদ রঙের আলো

     খমীন জাহাজের ভেতর পা রাখে বর্ণা। তার পেছনে বন্ধ হয় র‍্যাম্প। নিভে যায় হলুদ আলো, থেমে যায় সাইরেনের আওয়াজ

     গর্জন করে ওঠে এয়ারশিপের তলায় চার কোনে বসানো চারটে হোভার রোটর হাওয়ার স্তম্ভে ভর করে হাল্কা দুলুনি দিয়ে মাটি ছেড়ে ভেসে ওঠে খমীন জাহাজ রূপসী

     চারপাশে একবার চোখ বোলায় বর্ণাএইটা বসতকুটির মেন ডেক দুপাশে দোতলা সমান উঁচু দেওয়ালএকদিকের দেওয়ালের গায়ে বসানো লোহার লম্বা টানা বারন্দাবারন্দার নিচে থরেথরে সাজানো নানা বাক্স, ক্রেট আর ব্যারেল, প্রত্যেকটা শক্ত বাঁধনে আটকে রাখা মেঝের সাথেবারন্দা সামনের দিকে শেষ হয়েছে ওপরের ককপিটের এয়ারলকে

     ককপিটের উল্টোদিকে ছাদ থেকে মেঝে অবধি জোড়া দেওয়ালতার গায়ে বসানো এয়ারলকএর পেছনে যাত্রীখানা নাবিকদের কেবিন, ডাইনিং হল আর প্যান্ট্রি

     নিজের অজান্তেই এয়ারলকের হাতলে হাত রাখে বর্ণা শুভ্র এখানেই থাকবে কি করছে একবার দেখে এলে—

     চিন্তাটা মাথায় আসতেই শক লাগার মতনই এয়ারলক থেকে হাত সরিয়ে নেয় বর্ণা শুভ্রকে দেখার জন্যে জাহাজে অনেক লোক আছে তার মাথা না ঘামালেও চলবে

     নিজের ওপর রাগটা আরো চড়ে যায় বর্ণার, লোহার সিঁড়ি বেয়ে দেওয়ালের বারন্দায় উঠে হাঁটা দেয় ককপিটের দিকে

     ককপিটে পাশপাশি বসে থাকেন উর্ব্বী আর মুত্থুস্বামী, দৃষ্টি তাঁদের আটকে সামনে স্তরে স্তরে সাজানো নানা আলোকিত ডায়াল, মিটার আর স্ক্রীনের ওপর ককপিটের ঘেরাটোপের মধ্যে দিয়ে এসে পড়ে পূবের প্রথম লালচে আলো, নিচে দেখা যায় ভৈরবীর বাঁকে বারগাঁর ঝাপসা চেহারা

     আরো ওপরে ওঠে রূপসী, পূবের আলো পেছনে ফেলে জয়স্টিক বেঁকিয়ে জাহাজ ঘোরান পশ্চিমে, যেখানে আকাশ ঢেকে রেখেছে পাহাড়ের মত উঁচু মেঘ

     ওখানেই আকাশে খমীন মেঘের সাথে চরে

     মেঘের চাদরের তলা থেকে মাঝে মধ্য উঁকি মারে পশ্চিমের অস্তগিরি পর্বতমালা মেঘের ওপর খমীনের সন্ধানে মন্থর গতিতে ভাসে রূপসী

     বিশাল আকাশের কোথায় খমীন আছে খুঁজে পাওয়া সোজা নয় সুতরাং সবাই পালা নজর করে রাখে। ডাইনিং হলে লাগানো সেন্সর স্ক্রীনের দিকে কেটে যায় অলস দুটো দিন

     তৃতীয় দিন ব্রেকফাস্ট খেতে বসে বর্ণা কফির মগে সবে একটা চুমুক দিয়েছে, স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে কেউ একজন চিৎকার করে ওঠে

     – খমীন! খমীন!!

     সেন্সারের কালো কাঁটাটা ঘুরতে ঘুরতে বারবার একটা কালো ফুটকিতে ধাক্কা খেয়ে ‘পিং’ শব্দ করে উঠছে!

     বেজে ওঠে সাইরেনশুরু হয়ে যায় ব্যস্ততা আর হুড়োহুড়ি লকার থেকে হলুদ রঙের প্রেসার স্যুট বের করে সবাই গায়ে চড়াতে চড়াতেই ছুট লাগায় সামনের মেন ডেকের দিকে

     স্যুটের জিপারটা টেনে দিয়ে অভ্যস্ত কায়দায় এক এক করে সব চেক করে বর্ণা রেডিও, অক্সিজেন সিলিণ্ডার, হিলিয়ামের বোতল, লাইফ জ্যাকেট, প্রত্যেকটা কাজ করছে কিনা দেখে নেয় মিলিয়ে

     খমীন শিকারে একটা সামান্য ভুলও ডেকে আনতে পারে মৃত্যু এখানে ঢিলেমির কোন জায়গা নেই

     কোমরে আর পিঠের বেল্টগুলো টাইট করছে বর্ণা, পাশে এসে দাঁড়ায় শুভ্র গায়ে প্রেসার স্যুট, ঠোঁটে সবজান্তা হাসি

     – তাহলে আমরা এখন খমীন শিকারে যাচ্ছি

     – তাই নাকি? আমি ভাবলাম আমরা হাতিহাঁস ধরতে যাচ্ছি

     – হাঃ হাঃ আরে ওইসব পুরনো কথা ভুলে যাওভাবতে পারো, কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা মারকতের অন্যতম মহাজীবটির মুখোমুখি হব

     ফের তরল নাইট্রোজেনের তাপমাত্রার ছোঁয়া লাগে বর্ণার কন্ঠস্বরে

     – খমীন শিকারে আমি আগেও গেছি

     – অবশ্যই কিন্তু এবারের ব্যাপারটা একটু আলাদা

     – কেন? তুমি সঙ্গে আছো বলে?

     – একদম! তবে ঠিক আমি নাবরং বলতে পারো আমার বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গী এবারে তোমার সফরসঙ্গী

     দুদিন আগের জমিয়ে রাখা ঘুষিটা প্রায় চালিয়েই দিচ্ছিল বর্ণা কিন্তু তার আগেই ককপিট থেকে মেন ডেকে নেমে আসেন মুত্থুস্বামী

     – রেডি ঠিক দুমিনিট

     – স্বর পাল্টে আরো জোরে বাজে সাইরেন ককপিট আর যাত্রীখানার প্রবেশপথের মাথার লাল আলো জ্বলে উঠে জানান দেয় এয়ারলক সীল হয়ে গেছে একটা পাক খেতে থাকা লাল আলো ভরিয়ে ফেলে মেন ডেক

     প্রেসার স্যুটের হুড মাথায় টেনে দেয় বর্ণামুখের ফেস প্লেট এঁটে নিয়ে খুলে দেয় অক্সিজেন সিলিণ্ডারের ভাল্ভ

     একটা সোঁসোঁ আওয়াজ জানান দেয় খালি হয়ে যাচ্ছে মেন ডেকের বাতাস। নেমে আসছে প্রেসার

লাল আলোটা রঙ পাল্টে হলুদ হয়ে যায় কমে আসে সাইরেনের শব্দ

     – গো!!

     রেডিওতে ভেসে আসে মুত্থুস্বামীর গলা

     ছুট লাগায় সবাই সিঁড়ি দিয়ে উঠে পড়ে ডান দিকের লোহার বারন্দায়

     দেওয়ালের গায়ে বসানো একটা লিভারে টান দেন মুত্থুস্বামী, দুপাশে সরে যায় দেওয়াল নজরে আসে নীল আকাশের নিচে সাদা মেঘের আস্তরণ

     দরজার বাইরে রূপসীর গায়ে বসানো টানা লোহার বারন্দায় পা রাখে বর্ণা

     প্রেসার স্যুটের উষ্ণ আস্তরণ সত্ব্বেও ঠাণ্ডা গায়ে ফোটে ছুঁচের মতন।

     বারন্দার শেষ প্রান্তের দিকে ছুট লাগায় রূপসীর নাবিকের। 

     বারন্দা যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে রপসীর শরীরের সাথে ক্ল্যাম্প দিয়ে আটকানো একটা ক্ষুদে এয়ারশিপ। শুচি

     এয়ারশিপ অবশ্য নামেই লম্বাটে ব্লিম্পের নিচে ঝোলনো একটা ফ্রেম আঁটা ধাতব পাটাতন কেবল

     শুচির পাটাতনে লাফিয়ে ওঠেন মুত্থুস্বামী, পেছনে অন্যরা

     আবার জোর আওয়াজে বাজে সাইরেন, বন্ধ হয়ে যায় রূপসীর গায়ের স্লাইডিং দরজা কড়কড় করে ওঠে রেডিও, ভেসে আসে মুত্থুস্বামীর গলা।

     – গো!

     খটখট আওয়াজে খুলে যায় ক্ল্যাম্প, রূপসী থেকে আলগা হয়ে শূন্যে ভাসতে থাকে শুচি

     বাঁ দিকে বাঁক নেয় রূপসী, ক্ষুদে এয়ারশিপকে ফেলে সরে যায় দূরে

     পাটাতনের সামনে বসানো জয়স্টিকে চাপ দেন মুত্থুস্বামী মৃদু আওয়াজ তুলে ঘুরতে আরম্ভ করে ব্লিম্পের গায়ে বসানো টার্বো রোটর, প্রায় নিঃশব্দে শুচি এগিয়ে চলে সামনের দিকে।

     রেডারে চোখ রেখে দিক ঠিক করেন মুত্থুস্বামীসামনে উঁচু হয়ে থাকা একটা তুলোর পাহাড়ের মতন মেঘের মধ্য্যে দিয়ে চালিয়ে নিয়ে যান শুচিকে

     মেঘের অভ্যন্তরে এক নিশ্ছিদ্র সাদা কুয়াশার মধ্য দিয়ে কেবল রেডারে ভরসা করে চলতে থাকে শুচি

     তারপর হঠাৎই একটুকরো নীল আকাশের ঝলকের সাথে ফুরিয়ে যায় মেঘ আর উঁচু মেঘের পাহাড় ঘেরা এক আসমানী উপত্যকার মাঝে ভাসতে থাকা এক দানবিক প্রাণীর প্রায় ঘাড়ের ওপর এসে পড়ে শুচি

     শিরা টানা ঘোলাটে চামড়ার পাখনায় বাতাস কাটে একশো ফুট লম্বা এক মহাজীব রোদের আলো পড়ে ঝকঝক করে তার বিচিত্র রঙীন আঁকিবুঁকি টানাগাত্রত্বকপ্রায় তিনমানুষ চওড়া মুখগহ্বর ঘিরেস্পন্দিত হয় সূক্ষ্ম রোমের বিচিত্র বলয় মাথার ওপরে হাওয়ায় দোল খায় দুটো শরীর তন্তু, বেড় তাদের গাছের কাণ্ডের থেকে কম হবে না

     খমীন !

     রোটর বন্ধ করেন মুত্থুস্বামী টের পেলেই পালাবে খমীন মেঘের আড়ালে একবার গা ঢাকা দিলে তাকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে

     কন্ট্রোল থেকে সরে এসে মুত্থুস্বামী হাত রাখেন সামনে বসানো হারপুনের কামানে

     কামানে পোরা হারপুনের শেষপ্রান্তে বাঁধা দড়ি টেনে এনে জড়ানো রয়েছে লাটিমে বর্ণা সরে আসে তার পাশেলাটিম চালু রাখা তার কাজ

     আঙুলের ক্যামেরা তুলে খমীনে’র দিকে তাক করে শুভ্র রেকর্ড করার জন্যে বিড়বিড় করে বলা কথাগুলো ভেসে আসে প্রেসার স্যুটের রেডিওতে

     – খমীন কোন এক সময়ের উভচর প্রাণী বিবর্তনের ফলে আকাশচারী চর্বি থেকে তৈরি হয় নানান প্রয়োজনীয় ওষুধসামগ্রী

     – গো !

     শুভ্রর গলা ছাপিয়ে ভেসে আসে মুত্থুস্বামীর আদেশ

     একটা বিষ্ফোরণের শব্দ করে কামানের মুখ থেকে ছিটকে যায় হারপুন আমূল বিঁধে যায় আকাশে নিশ্চিন্তে ভাসতে থাকা খমীনের গায়ে ফোয়ারার মত ছড়িয়ে যায় রক্ত

     কানে তালা লাগানো একটা উন্মত্ত চিৎকারে বাতাস ভরিয়ে ফেলে খমীন লম্বা শরীরটা তার ধনুকের মতন বেঁকে ছিটকে যায় ওপরের দিকে

     মাথা ঘুরিয়ে আঘাতটা কোথা থেকে এসেছে বুঝতে চেষ্টা করে বিশালাকায় খমীন তারপর মেঘের মধ্য ডুব দিয়ে ছুটে যায় সামনের দিকে

     বনবন করে ঘুরতে থাকে হারপুনের দড়ির লাটিম, তাকে হাতে ঠেলে আরো গতি দেয় বর্ণা কোন মতে লাটিম আটকে গেলে উপড়ে যাবে সবশুদ্ধু, হয়ত বা চুরমার হয়ে যাবে পুরো এয়ারশিপটাই

     মেঘের তলায় দিয়ে ছুটতে থাকে খমীনবনবন করে পাক খায় লাটিম, তেতে ওঠে সেই দুর্বার আবর্তনেধোঁয়া উঠতে থাকে দড়ি থেকে একটা স্প্রেবটল থেকে কুল্যান্ট ছেটাতে থাকে বর্ণা তেতে ওঠা লাটিমকে ঠাণ্ডা করার জন্যে

     আচমকা থেমে যায় লাটিমের ঘোরা মেঘের তলায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে ক্লান্ত খমীন

     বর্ণার দিকে তাকিয়ে একেবারে সবজান্তার মত মাথা ঝাঁকায় শুভ্র

     – বেশীক্ষণ নীচে থাকতে পারবে না

     গা জ্বলে যায় বর্ণার কন্ঠস্বরে একেবারে অ্যাসিড চুঁইয়ে পড়ে তার

     – ওহো তাই নাকি? আমি তো ভাবলাম বোধহয় মেঘের তলা থেকে আর উঠবেই না!

     যথারীতি কোন প্রভাব পড়ে না শুভ্রর ওপর

     – না, না, উঠে পড়বে, উঠে পড়বে! শরীরের ছোট ছোট খোপে ভরা অ্যামোনিয়া গ্যাসের দৌলতেই খমীন ভেসে থাকে।

     – বোঝো! আর আমি ভাবতাম খমীন পাখির ডানা নেড়ে মতই ওড়ে!! আর ডানা নাড়া বন্ধ করলেই ডুবে যায়

     খোঁচাটা গায়েই মাখে না শুভ্র

     – আরে না না! পাখনাগুলো তো কেবল দিক পাল্টানোর জন্যে ডুব দেওয়ার আগে খমীন খোপের মাসল্‌গুলো টাইট করে বাড়িয়ে দেয় ভেতরের প্রেসারপ্রেসারে তরল হয়ে যায় অ্যামোনিয়া বিনা গ্যাসে শরীর ভারী হয়ে যায়, খমীন ডুবতে থাকে নিচে

     – ও আচ্ছা!! তারপর আবার নিচ থেকে লাফ দিয়ে উঠে পড়ে বুঝি?

     – না না বেশীক্ষণ শরীরের মধ্যে ওই মারাত্মক চাপ বজায় রাখা সম্ভব নয় চাপ আলগা করলেই তরল অ্যামোনিয়া পরিণত হয় গ্যাসে খমীনও ভেসে ওঠে ওপরে

     কি একটা বলতে গিয়েও গলায় কথাটা আটকে যায় বর্ণা’র কোন এক কারণে শুচি’র সবাই তার দিকে এক দৃষ্টে চেয়ে রয়েছে দুএকজনের ফেসপ্লেটের পেছনে চওড়া হাসিটাও নজর এড়ায় না তার

     তার খেয়াল হয় যে সে এতক্ষণ কথা বলছিল প্রেসার স্যুটের রেডিওতে, এবং সে কথোপকথন উপভোগ করছিল শুচি’র সবকটা মানুষ

     কানদুটো তেতে গরম হয়ে ওঠে বর্ণার শুভ্র’র ফেসেপ্লেটের ওপরেই একটা ঘুষি বসিয়ে দেওয়ার জন্যে নিশপিশ করতে থাকে তার হাত

     কিন্তু তার আগেই সমস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে দুচারজন

     – উঠেছে। উঠেছে!

     সাদা মেঘের ওপর রক্তবাষ্পের প্রলেপ ছড়িয়ে ভাসছে খমীন

     মাথার ওপর হাতটা তোলেন মুত্থুস্বামী লাটিমের গায়ে একটা লিভারে চাপ দেয় বর্ণা।

     ধীরে ধীরে উল্টোদিকে ঘুরতে থাকে লাটিম, হারপুনের দড়ি জড়াতে থাকে লাটিমের গায়ে, অল্প অল্প করে এয়ারশিপ শুচি এগোতে থাকে খমীনের বিশাল দেহটার দিকে

     দড়িটা যখন টানটান হয়ে এসেছে, তুলে রাখা হাতটা নামান মুত্থুস্বামী

     লাটিমের গায়ে লিভারটা ছেড়ে দেয় বর্ণা, থেমে যায় লাটিম

     ফের হাত তোলেন মুত্থুস্বামী লাটিমের নিচে বসানো একটা সুইচে চাপ দেয় বর্ণা

     চোখে দেখা যায় না বটে, কিন্তু সুইচ অন হবার সাথে সাথে হারপুনের দড়িরে ভেতরে বসানো তারের মধ্যে দিয়ে ছুটে যায় একটা উঁচু ভোল্টেজের বিদ্যুৎ তরঙ্গ

     আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে আর্তনাদ করে ওঠে খমীন, ফের মেঘের নিচে ডুব দিয়েদৌড় দেয় সামনের দিকে

     ফের দুরন্ত গতিতে ঘোরে লাটিম, ফের তাকে সামলাতে থাকে বর্ণা

     কিছুক্ষণ বাদে থেমে যায় লাটিমের ঘোরা আর তারও কিছুক্ষণ বাদে আবার ভেসে ওঠে খমীন

     ফের ছুটে যায় বিদ্যুতের ঘাতক তরঙ্গ, ফের আর্তনাদ করে ডুব দেয় খমীন

     বারংবার পুনরাবৃত্তি হতে থাকে একই মারণ অনুষ্ঠানের

     অবশেষে জীবনীশক্তি নিঃশেষ হয়ে আসে খমীনের শেষ বিদ্যুতের আঘাতের পর তার নিঃস্পন্দ দেহটা ভাসতে থাকে নিস্তেজ ভঙ্গীতে

     এবারে লাটিম সম্পূর্ণ গুটিয়ে শুচি খমীনের শরীরটার কাছে না আসা অবধি হাত নামান না মত্থুস্বামী

     শুচি এসে ভেড়ে খমীনের প্রাণহীন দেহটার পাশে এয়ারশিপের পাটাতন থেকে একজন লাফিয়ে নামে খমীনের ওপর, তার গায়ে বেঁধা হারপুনের দড়ি খুলে ছুঁড়ে দেয় শুচিতে

     ফ্যুটের রেডিও কড়কড় করে ওঠে অনেকগুলো গলার শব্দে টুকরো টুকরো নির্দেশ আসে যায় শুচি আর রূপসীর মধ্যে

     কিছুক্ষণের মধ্যে নজরে আসে রূপসীর বিশাল চেহারাটা রোটরে বাতাস কেটে আসে মন্দ গতিতে ভেসে আসে সে

     খমীনের ভাসতে থাকা শরীরের কাছেই স্থির হয়ে দাঁড়ায় রূপসী

     শুচিকে নিয়ে উড়ে যান মুত্থুস্বামী, লাগিয়ে দেন রূপসীর গায়ে দরজা খুলে সবাইকে নিয়ে নেমে আসেন মেন ডেকে

     সম্পূর্ণ উঠে যায় বারন্দার উল্টোদিকের দেওয়ালটা মেঝেতে বসানো মেশিনের ঢাকা খুলে ফেলে রপসীর নাবিকেরা মেঝেটা টেলিস্কোপের মতন লম্বা হয়ে বেরিয়ে ঠেকে গিয়ে খমীনের গায়ে

     মেঝেতে বসানো দুটো বিশাল লাটিম থেকে কাছি টেনে কাছির মাথার বিশাল হুক বিঁধিয়ে দেওয়া হয় খমীনের শরীরের দুই প্রান্তে

     চালু হয় মেশিন, ভেতরে তার জ্বলে ওঠে ফার্নেস

     লেসার ছুরি আর ধারালো কোদাল হাতে খমীনের পিঠে লাফিয়ে ওঠে নাবিকের দল

     তারপর শুরু হয় শিকারের ফসল ঘরে তোলার পালা

     চমকে ওঠে লেসার ফলার লালচে শিখা, ফালাফালা হয়ে যায় খমীনের চামড়া ঝপঝপ করে পড়ে কোদাল, উঠে আসে তালতাল খমীনের চর্বি হাতে হাতে তুলে চর্বি ঢালা হয় মেশিনের ফার্নেসে, চর্বি গলে তেল হয়ে বেরিয়ে আসে মেশিনের অন্য দিক দিয়ে একের পর এক পিপেতে ভরা হয় খমীনের তেল, তারপর পিপে গড়িয়ে নিয়ে গিয়ে মজুত করা হয় আর এক কোনে

     খমীনের শরীরের একদিকের চর্বি কেটে নেওয়া হলে তার মাথা আর ল্যাজের দিকে বসানো বিশাল হুক দুটো তুলে গেঁথে দেওয়া হয় একটু ওপরে। একপাক ঘোরে লাটিম, টান পড়ে কাছিতে, ঘুরে যায় খমীনের শরীর। তার দেহের অক্ষত অংশ থেকে ফের চলতে থাকে চর্বি তোলার পালা

     মেদ রক্ত তেলে মাখামাখি হতে থাকে রূপসীর মেন ডেক প্রেসার স্যুটের আপাদমস্তক আবরণ সত্ত্বেও যেন নাকে ঢুকতে থাকে চর্বি পোড়া দুর্গন্ধ

     মুহূর্ত মাত্র সময় নেই মৃত্যুর সাথে সাথেই খমীনের শরীর থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে যেতে আরম্ভ করে অ্যামোনিয়া গ্যাস ভারী হয়ে অল্প অল্প করে ডুবতে শুরু করে খমীনের শরীরসুতরাং বিন্দুমাত্র কালক্ষেপ না করে সবার সাথে হাত লাগায় বর্ণা

     কাজের হুড়োহুড়ির মধ্যেই দুএকবার চারদিকে চোখ বুলিয়ে নেয় বর্ণা না, শুভ্র কোথাও নেই সেই শুচি থেকে নামার পর থেকেই তার টিকি পাওয়া যাচ্ছে না

     মুচকি হাসে বর্ণা শহুরে বাবু রক্ত দেখে ভয়ে কোথাও ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে

     হঠাৎ কড়কড় করে ওঠে রেডিও, ভেসে আসে উর্ব্বীর গলা,

     – বাজপতঙের ঝাঁক। উত্তরে

     দুগুণ ব্যস্ততা বেড়ে যায় রপসীর নাবিকদের দুএকজনের সঙ্গে বর্ণাও ছোটে রাইফেল আনতে দূরবীনে চোখ রাখে কেউ কেউ

     খমীনের শরীর থেকে তোলা হয়ে যায় শেষ চর্বিটুকু তার গায়ে বসানো হুকদুটো খুলতে ব্যস্ত গয়ে পড়ে কয়েকজন

     চোখে দূরবীন লাগিয়ে কেউ একজন চেঁচিয়ে ওঠে,

     – বাজপতঙ! বাজপতঙ

     দূর দিগন্তে নজরে আসে পাখির কালো ঝাঁক

     রাইফেলের স্কোপে চোখ রাখে বর্ণানা পাখি নয় মাথায় বাজের মত ঠোঁট থাকলেও, যে প্রাণীগুলো আসছে, তাদের চেহারার আদল পতঙ্গের মতনআলোর রামধনু ছেটকানো বিশাল স্বচ্ছ ডানায় ভর করে তাদের মিশ্‌কালো খাঁজকাটা লম্বা শরীরগুলো তীব্র গতিতে ধেয়ে আসে সামনে

     বাজপতঙ মারকতের শবভোজী অতিকীট মৃত জীবজন্তুই প্রধান খাদ্য, তবে দুর্বল হলে জীবিত প্রাণীতেও অরুচি নেই

     জ্বলে ওঠে মেন ডেকের হলুদ আলো বাজতে থাকে সাইরেন পিছু হটে বসতকুটির ভেতরে সরে আসে চর্বি গলানোর মেশিন, ওপর থেকে নেমে আসে দরজা

     আড়াল হয়ে যায় নীল আকাশ আর সাদা মেঘের মাঝে ভাসতে থাকা মারকতের মহাজীবের ক্ষতবিক্ষত দেহাবশেষ

     নিভে যায় হলুদ আলো, বন্ধ হয় সাইরেনের আওয়াজ, নিভে যায় ককপিট আর যাত্রীখানার এয়ারলকের লাল আলো

     বারন্দায় উঠে একটা কাঁচের জানলায় চোখ রাখে বর্ণা কালো ছত্রাকের মতন খমীনের শরীর ঢেকে ফেলেছে বাজপতঙের ঝাঁক, বিশাল অবয়বটা ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছে মেঘের নিচে

     মারকতের বিবর্তনে খমীন এক অনবদ্য সৃষ্টিনিরীহ প্রাণী আকাশ প্ল্যাঙ্কটন খেয়ে বেঁচে থাকে স্বার্থের খাতিরে আমরা তাকে মারি যন্ত্রণা দিয়ে তারপর খুবলে নিই তার শরীর বাজপতঙের থেকে আমরা আলাদা কি ভাবে?’

     কানে বাজে শুভ্র’র কথাগুলো

     – বর্ণা !!

     মুত্থুস্বামীর ধমক ভেসে আসে রেডিওতে

     সম্বিত ফিরে পেয়ে লাটিমের নিচে সুইচটা টেপে বর্ণা হারপুনের কাছি বেয়ে ছুটে যায় বিদ্যুত তরঙ্গ, তীব্র আর্তনাদ করে মেঘের নীচে ডুব দিয়ে ছুট লাগায় খমীন, ঘুরতে থাকে লাটিম

     আজ কেমন কাজে মন দিতে পারে না বর্ণা, বারবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে

     প্রথম দিনের খমীন শিকারের পর থেকেই শুভ্র এড়িয়ে গেছে বর্ণাকেদূরে দূরে থেকেছে খুব সচেতনভাবেই

     আমল দেয়নি বর্ণা বরং নিজের মনেই হেসেছে শহুরে বাবুর মার্জিত রুচিতে বোধহয় রক্তদর্শন সহ্য হয় নি

     দু’দিন আগে শুভ্রকে একা পেয়ে সেই কথাটাই শোনাতে গিয়েছিল বর্ণা বুকের কাছে দু’হাত ভাঁজ করে শুভ্র তখন ডাইনিং হলের কাঁচের জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে

     কিন্তু জানলার কাঁচের ওপর শুভ্রর ছায়াটার দিকে নজর পড়তেই থমকে গিয়েছিল বর্ণা।

     শুভ্রর দুচোখ দিয়ে গড়িয়ে নামছে জলের ধারা

     বক্রোক্তিটা আর করা হয়নি বর্ণার কথাগুলো কেমন আটকে গিয়েছিল গলায়, অনেকটা অস্বস্তি নিয়েই বেরিয়ে এসেছিল বর্ণা ডাইনিং হল থেকে

     আজ খমীন শিকারে বেরোনোর আগে বর্ণা নিজেই ডাকতে গিয়েছিল শুভ্রকে

     ঘাড় নেড়ে শুভ্র জানিয়েছিল সে যাবে না

     – কেন?

     না করতে চেয়েও প্রশ্নটা করে ফেলেছিল বর্ণা

     মুখ তুলে তাকিয়েছিল শুভ্র বর্ণা’র দিকে শূন্য, উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি তার

     মারকতের বিবর্তনে খমীন এক অনবদ্য সৃষ্টি নিরীহ প্রাণী আকাশ প্ল্যাঙ্কটন খেয়ে বেঁচে থাকে। স্বার্থের খাতিরে আমরা তাকে মারি যন্ত্রণা দিয়ে তারপর খুবলে নিই তার শরীর বাজপতঙের থেকে আমরা আলাদা কি ভাবে?

     ধোঁয়া তুলে ঘুরপাক খেতে থাকা লাটিমের গায়ে কুল্যান্ট স্প্রে করতে করতে বর্ণা’র মাথায় ঘুরপাক খায় শুভ্রর প্রশ্নটা

     বাজপতঙের থেকে আমরা আলাদা কি ভাবে?

     মেঘের নিচ থেকে উঠে আসে খমীন সুইচের চাপে ফের ছুটে যায় বিদ্যুৎ তরঙ্গ

     কোন প্রতিক্রিয়া আসে না নিস্পন্দ অবস্থায় ভাসতে থাকে খমীনের দেহ

     লিভারের চাপে উল্টোদিকে ঘোরে লাটিম শুচি এসে ভেড়ে খমীনের শরীরের পাশে

     কোদাল হাতে বর্ণা লাফিয়ে ওঠে খমীনের ওপর হারপুনের দড়ি খুলে ছুঁড়ে দেয় শুচিতে

     রেডিওতে টুকরো টুকরো কথা ভাসে বর্ণাকে রেখে উড়ে যায় শুচি, ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে রূপসী

     আবার কাঁটার মতন খচ্‌খচ্‌ করে ওঠে শুভ্র’র প্রশ্নটা

     বাজপতঙের থেকে আমরা আলাদা কিভাবে?

     উঠে যায় রূপসীর বসতকুটির দেওয়াল ফসল তোলার অপেক্ষায় লেসার ছুরি আর কোদাল হাতে অপেক্ষা করে নাবিকেরা

     আর ঠিক সেই মুহুর্তেই প্রাণ ফিরে পা খমীন, আকাশ ফাটানো চিৎকার করে ডুব দেয় মেঘের নিচে

     খমীনের পিঠে উপুড় হয়ে পড়ে যায় বর্ণা, গড়িয়ে যেতে থাকে নিচের দিকে

     শূন্যে ছিটকে যাবার আগে হাতের কোদালটা সজোরে বসিয়ে দেয় বর্ণা খমীনের পিঠে, তারপর সর্বশক্তি দিয়ে শরীরটাকে ওপরের দিকে টেনে এনে জাপটে ধরে খমীনের গায়ে বেঁধা হারপুনটা

     রেডিওতে ভেসে আসে মুত্থুস্বামীর উৎকণ্ঠার চিৎকার,

     – বর্ণা লাইফ ভেস্ট! লাইফ ভেস্ট!

     আতঙ্কের অবশতা কাটিয়ে বর্ণা চাপ দেয় কোমরের হিলিয়ামের বোতলের ভাল্ভে তরল হিলিয়াম গ্যাস হয়ে ভরে ফেলবে পিঠের লাইফ ভেস্ট, খমীনের পিঠ ছেড়ে বর্ণা ভেসে উঠতে পারবে বাতাসে

     খট করে একটা আওয়াজ হয় বটে, কিন্তু গ্যাস পৌঁছয় না লাইফ ভেস্টে

     আবার চাপ দেয় বর্ণা ছাড়া পায় না সিলিণ্ডারে বন্দী তরল হিলিয়াম।

     আবার আবার ভাল্ভে বারবার চাপ দিতে থাকে বর্ণা

     কোন ফল হয় না

     শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত নেমে যায় বর্ণার

     হিলিয়াম বোতলের ভাল্ভ খারাপ হয়ে গেছে

     মেঘের মধ্যে দিয়ে দুর্বার বেগে ছুটতে থাকে বিশালাকার খমীন

     – লাইফ ভেস্ট কাজ করছে না

     রেডিওতে বর্ণার চিৎকারটুকুশোনার সাথে সাথেই রূপসীর বাইরে বাঁধা শুচির দিকে ছুট লাগিয়েছিলেন মুত্থুস্বামী। কিন্তু বসতকুটির দরজার লিভারে হাত রাখার আগেই রেডিওতে ভেসে আসে উর্ব্বীর আতঙ্কিত কণ্ঠস্বর।

     বাজপতঙ!

     পা দুটো যেন জমে মাটির সঙ্গে আটকে যায় মুত্থুস্বামীর

     – কোথায়?

     – খমীন থেকে বেশি দূরে নয়

     একটা অস্ফূট গালাগালি বেরিয়ে আসে মুত্থুস্বামীর গলা থেকে

     ধীরে ধীরে ভেসে চলা এয়ারশিপ শুচির পক্ষে বাজপতঙের আগে খমীন অবধি পৌঁছনো সম্ভব নয় আর বাজপতঙের ঝাঁকের মধ্য পড়লে বর্ণাকে বাঁচানো অসম্ভব মাত্র কয়েকটা বাজপতঙই একটা পূর্ণবয়স্ক মানুষকে স্রেফ কয়েক মিনিটের মধ্যেই পরিণত করে ফেলতে পারে কঙ্কালে

     মেন ডেকের অন্যদিকে দৌড় লাগান মুত্থুস্বামীএয়ারশিপ নয়, এখন প্রয়োজন আর দ্রুত যানের

     মিনিকপ্টার! মিনিকপ্টার বের করো জলদি!

     কাপড়ের ঢাকা খুলে টানতে টানতে মিনিকপ্টার সামনের দিকে নিয়ে আসে দুতিনজন মুত্থুস্বামী লক্ষ্য করেন তাদের মধ্যে রয়েছে শুভ্রও

     মিনিকপ্টার সাঙ্ঘাতিক উন্নত কোন যান নয় অবশ্য দুটো সীটের চারপাশে একটা ধাতব ফ্রেম, মাথায় চওড়া রোটর বসানো। হাল্কা দ্রুতগতি এই বায়ুযান রূপসীতে মজুত করা থাকে এমার্জেন্সীর জন্যেই।

     লাফিয়ে মিনিকপ্টারে ওঠেন মুত্থুস্বামীসীট বেল্ট লাগিয়ে ওপরে ওঠান ইঞ্জিনের সুইচ।।

     গর্জন করে ওঠে মিনিকপ্টার, দুবার পাক খায় রোটর

     আর তারপরেই বন্ধ হয়ে যায় ইঞ্জিন, থেমে যায় রোটর

     আবার সুইচ ওঠান মুত্থুস্বামী আবার গর্জে উঠেই স্তিমিত হয়ে যায় ইঞ্জিনের আওয়াজ

     আবার আবার আবার

     বারবার সুইচ তুলতে থাকেন মুত্থুস্বামী

     কোন হেরফের হয় না, প্রাণ পায় না মিনিকপ্টার

     ঘামে নামে মুত্থুস্বামীর সমস্ত শরীর বেয়ে অস্ফূট নয়, এবার উচ্চস্বরেই গালাগালি বেরিয়ে আসেই তাঁর মুখ থেকে

     – *#@&# মিনিকপ্টার স্টার্ট নিচ্ছে না!!

     কে একটা ছুটে চলে যায় মিনিকপ্টারের পাশ থেকে নজর দেন না সেদিকে মুত্থুস্বামী, বারবার সুইচ অন করে বৃথা চেষ্টা করতে থাকেন মিনিকপ্টার চালু করার

     রেডিও মারফৎ একটা হৈচৈ ভেসে আসে মুত্থুস্বামীর কানে লোকজন দৌড়য় সামনের ল্যান্ডিং র‍্যাম্পের দিকে

     সেদিকে তাকিয়ে অবশ্য খুব একটা কিছু বুঝতে পা্রেন না মুত্থুস্বামীকেবল নজরে পড়ে রঙবেরঙের একটা বিরাট কাপড় উড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে ল্যাণ্ডিং র‍্যাম্পের খোলা দরজা দিয়ে

     – মিনিকপ্টার স্টার্ট নিচ্ছে না !!

     কথাটা বর্ণার কানে যেন একটুকরো জ্বলন্ত কাঠকয়লার মতন এসে পড়ে

     পৃথিবীর যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, মহামারী পেছনে ফেলে মারকতে নতুন সভ্যতা গড়ে তোলার মূল্য প্রতিটি পদে পদে চোকাতে হয় মানুষের প্রাণের বিনিময়ে হিংস্র জীব, রোগ, দুর্ঘটনা, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, মারকত তার মাশুল আদায় করে নেয় নানানমুদ্রায়মানুষের আয়ুতে এখানে কোন নিরাপত্তার রক্ষাকবচ পরানো নেই, প্রাণ যেতে পারে এখানে যখন তখন

     বড় হয়ে ওঠা থেকে এসব কথা বর্ণা জানে তবে তার সময় যে এত তাড়াতাড়ি এসে যাবে সে ভাবতে পারে নি

     রেডিওতে ভেসে আসে উর্ব্বীর গলা,

     – বর্ণাধৈর্য হারাস না মুত্থু শুচিকে নিয়ে বেরিয়ে গেছে, আমিও রূপসীকে নিয়ে আসছি তোর কাছে হাল ছাড়িস না বর্ণা

     একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বর্ণামায়ের কথাগুলো যে তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্যে স্তোকবাক্য তা তার থেকে ভালো আর এই মুহূর্তে কেউ জানে না বাজপতঙের ঝাঁকটা এখান থেকে খালি চোখেই দেখা যাচ্ছে। শুচি কিম্বা রূপসী আসতে আসতে অবশিষ্ট থাকবে কেবল তার শরীরের হাড়গুলো

     উঠে দাঁড়ায় বর্ণা খমীনের পিঠে বেঁধা হারপুনে একটা পা জড়িয়ে নিয়ে ব্যালেন্স করে নেয় শরীরটা

     তারপর খমীনের পিঠ থেকে কোদালটা খুলে নিয়ে অপেক্ষা করে অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুর

     স্বচ্ছ ডানায় রামধনুর রং ছিটকে এক এক করে বাজপতঙ এসে বসতে শুরু করে খমীনের গায়ে চকচকে কালো শরীরে বসানো কয়েক চিমটে হীরের কুঁচির মতন চোখ দিয়ে তারা জরীপ করে চারপাশ

     দুএকটার চোখে পড়ে যায় হারপুনে ঠেসান দিয়ে দাঁড়ানো বর্ণার চেহারাটা হুকের মতন বাঁকানো ধারালো ঠোঁটের ফাঁকে তীব্র শিস দেওয়ার আওয়াজ তুলে ডানার ঝাপটে তারা উড়ে আসে তার দিকে

     হাতের কোদালটা সবেগে চালায় বর্ণা কোদালের আঘাতে দুটুকরো হয়ে যায় কয়েকটা বাজপতঙের লম্বা শরীর, ঝরে পড়ে গাড় সবুজ রঙের কীটরস। আরো কয়েকটা আঘাত এড়িয়ে ডানার গুঞ্জন তুলে উড়ে যায় যায় কোদালের আওতার বাইরে

     উড়ে আসে আরো কয়েকটা আবার চলে বর্ণার কোদাল

     কোদালের আঘাতে পড়ে যাওয়াসবকটি বাজপতঙের জায়গা নিতে থাকে তার দ্বিগুণ সংখ্যক বাজপতঙ

     চলতে থাকে বর্ণার কোদাল, ঝরতে থাকে কীটরস ডানার গুঞ্জন আর শিসের তীব্র শব্দে ভরে ওঠে বাতাস।

     হাত অবশ হয়ে আসতে থাকে বর্ণারসময় যে ফুরিয়ে আসছে বুঝতে অসুবিধে হয় না তারহাতদুটো কোদাল চালাতে অক্ষম হয়ে পড়লেই বাজপতঙের ঝাঁক ঝাঁপিয়ে পড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে তার শরীর

     আবার মনে পড়ে যায় শুভ্রর করা প্রশ্নটা

     বাজপতঙের থেকে আমরা আলাদা কিভাবে?

     উত্তরটা বোধহয় আর জানা হল না

     – বর্ণা !

     রেডিওতে ভেসে আসে শুভ্রর গলা

     ক্লান্ত কণ্ঠে সাড়া দেয় বর্ণা

     – এখন ঠিক তোমার সঙ্গে কথা বলার মতন সময় নেই শুভ্র

     – না না! ওপরের দিকে তাকাও! ওপরে

     বাজপতঙের ওপর কোদাল চালানোর ফাঁকেই কোনরকমে একবার ওপর দিকে তাকায় বর্ণা

     পিঠে বাঁধা প্রপেলার, মাথার ওপর প্যারাশুটের রঙীন চাঁদোয়া, দুহাতে প্যারাশুটের দড়ি ধরে আকাশ থেকে নেমে আসে শুভ্র।

     – আমাকে ধরো! আমাকে ধরো!

     একটা বিশাল শিকারী পাখির মতন শুভ্র লাফিয়ে পড়ে খমীনের পিঠে, কয়েক পা ছুটে এসে ধাক্কা খায় বর্ণার গায়ে

     কোদাল ফেলে দিয়ে দুহাতে শুভ্র’র গলা জড়িয়ে ধরে বর্ণা

     এতটুকু মাত্র না থেমে একই গতিতে শুভ্র দুকদম যায় ছুটে যায় সামনে, খমীনের পিঠ থেকে লাফ দেয় শূন্যে

     বাতাসের টানে প্যারাশুট বর্ণা আর শুভ্রকে সরিয়ে নিয়ে যায় খমীনের পিঠ থেকে দূরে

     শিসের ক্রুদ্ধ আওয়াজ তুলে পিছু নেয় বাজপতঙের ঝাঁক

     আকাশের বুকে শুরু হয় এক মারণ বাঁচন প্রতিযোগিতা

     অবশ্য কিছুক্ষণের মধ্যেই বর্ণা বুঝতে পারে যে সে প্রতিযোগিতা অসম বাজপতঙের চিকণ শরীর আর চওড়া ডানার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জেতা দুদুটো শরীরের ভার বওয়া প্যারাশুট আর পিঠে বাঁধা প্রপেলারের ক্ষমতার বাইরে

     শুভ্রর ঘাড়ের ওপর দিয়ে বর্ণা দেখতে পায় করে ক্রমশঃ এগিয়ে আসছে বাজপতঙের ঝাঁক

     শুভ্র তাড়াতাড়ি! তাড়াতাড়ি!

     কিন্তু এর থেকে তাড়াতাড়ি যাওয়াটা শুভ্রর সাধ্যের বাইরে। সে প্যারাশুটের দড়ি টেনে যাত্রাপথ বেঁকিয়ে চুরিয়ে চেষ্টা করে পেছন থেকে বাজপতঙের ঝাঁককে ঝেড়ে ফেলতে, কিন্তু প্রত্যেকবারই নির্ভুল লক্ষ্যে তারা পিছু নেয় তার

     সভয়ে বর্ণা লক্ষ্য করে ধীরে ধীরে দূরত্ব কমিয়ে ফেলছে বাজপতঙের ঝাঁক, চলে আসছে কাছে

     আচমকাই ডানার ঝাপটায় একটু বেশীই জোর লাগায় একটা বাজপতঙ, ছিটকে চলে আসে শুভ্রর পিঠের ঠিক পেছনে ক্রুরতায় ঝলসে ওঠে তার হীরের মতন চোখগুলো, হুকের মত ধারালো ঠোঁট দুটো ফাঁক হয়ে তৈরি হয় শুভ্রর শরীর খুবলে নেওয়ার জন্যে

     আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে বর্ণা

     আর হঠাৎ একরাশ সবুজ কীটরস ছড়িয়ে টুকরো টুকরো হয়ে যায় বাজপতঙ

     কিছু বুঝে উঠতে পারার আগেই একই দশা হয় আরো কয়েকটা বাজপতঙের, আর একই সঙ্গে রেডিওতে ভেসে ওঠে অনেকগুলো কণ্ঠে হর্ষধ্বনির আওয়াজ

     কি হচ্ছে বোঝার জন্যে এদিক ওদিক তাকায় বর্ণা

     তার বিস্মিত নজরে পড়ে খানিক দূরেই ভাসছে শুচি আর তার পাটাতন থেকে বিরামহীন ভাবে রাইফেল থেকে গুলি চালাচ্ছে রূপসীর নাবিকেরা

     বেশ কয়েকটা বাজপতঙ মারা পড়ার পর রণে ভঙ্গ দেয় বাকিগুলো উল্টোদিকে উড়ে ফেরৎ যায় খমীনের ভাসতে থাকা শবের দিকে

     আবার উল্লাসের আওয়াজ ওঠে শুচি থেকে

     শুচির কাছে প্যরাশুটে ভর করে চক্কর কাটে শুভ্র

     সামনের কন্ট্রোল থেকে হাত নাড়েন মুত্থুস্বামী

     – বর্ণাকে মানিয়েছে ভালো!!

     বাজপতঙের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার পর ফেলতে যাওয়া স্বস্তির নিঃশ্বাসটা কিরকম আটকে যায় বর্ণার গলায়সে যে শুভ্রর কণ্ঠলগ্না হয়ে রয়েছে, সে কথাটা আচমকাই খেয়াল হয় তার

     কানদুটো তেতে গরম হয়ে ওঠে বর্ণার, শুচিতে নাবিকদের ফেসপ্লেটের পেছনে কান এঁটো করা হাসিগুলো কল্পনা করে নিতে মোটেও কষ্ট হয় না তার, রেডিওটা নীরব থাকলেও কয়েকটা খিক্-‌খিক্ হাসির শব্দও যেন স্পষ্ট শুনতে পায় সে।

     সবার সামনে এইরকম বেইজ্জতি হওয়ার জন্যে শুভ্রর ওপর চেপে রাখা রাগটা ফের চাগাড় দিয়ে ওঠে বর্ণার মনেশুভ্রর কানের গোড়ায় একটা ঘুষি বসিয়ে দেওয়ার জন্যে হাতটা নিশপিশ করতে থাকে তার।

     একটা হাত প্রায় তুলে এনেছে বর্ণা, রেডিওতে ভেসে আসে উর্ব্বীর গলা

     – উত্তরে একটা ঝড় উঠেছে, আর এদিকেই সরে আসছে এখান থেকে যত তাড়াতাড়ি সরে যাওয়া যায় ততই ভালো

     উত্তরের দিকে তাকায় বর্ণা দিগন্তে সেখানে কালোর ছোঁয়া লেগেছে

     মুখ ঘুরিয়ে পেছনের দিকে রওনা দেয় শুচি প্যারাশুটে ভর করে তার পিছু নেয় শুভ্র

     রূপসীর পাহাড়ের মতন বিশাল চেহারাটা নজরে আসে কিছুক্ষণের মধ্যেই

     বসতকুটির দেওয়ালের গায়ে শুচিকে লাগিয়ে দেন মুত্থুস্বামী বর্ণাকে নিয়ে ল্যাণ্ডিং র‍্যাম্পে পা রাখে শুভ্র

     অনেকগুলো কন্ঠে আনন্দের চিৎকার ভেসে আসে রেডিওতে, অনেকগুলো হাত বর্ণাকে ধরে নিয়ে সরিয়ে আনে মেন ডেকের ভেতরের দিকে

     ল্যাণ্ডিংর‍্যাম্পের দরজায় হাঁটুতে দুহাত হাঁটুতে রেখে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে পড়ে শুভ্র। নিঃশ্বাসের সঙ্গ তাল রেখে পিঠটা ওঠা নামা করে তার রঙীন গালিচার মত প্যারাশুট ছড়িয়ে থাকে তার পেছনে

ল্যাণ্ডিংর‍্যাম্পের পেছনের আকাশটা তখন আরো কালো হয়ে উঠেছে

     ঘুরতে আরম্ভ করে হলুদ আলো, বাজতে আরম্ভ করে সাইরেন, এতক্ষণের উত্তেজনায় আড়ষ্ট পেশীগুলো শিথিল হয়ে আসে বর্ণার শরীরে

     আর ঠিক সেই মূহুর্তে পেছনের কালো আকাশ থেকে একটা দমকা বাতাস ছুটে এসে সজোরে টান দেয় শুভ্রর প্যারাশুটে

     চিৎ হয়ে মেঝেতে আছড়ে পড়ে শুভ্র পালের মত ফুলে উঠে প্যারাশুট তাকে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে যেতে থাকে ল্যাণ্ডিং র‍্যাম্পের খোলা দরজার দিকে

     কেউ একজন ঝাঁপ দিয়ে পড়ে মেঝের ওপর দুহাতে জড়িয়ে ধরে শুভ্রর একটা পা কিন্তু প্যারাশুটের দুর্নিবার টান তার দুহাতের বেষ্টনীর মধ্যে থেকে শুভ্রর পা ছাড়িয়ে তাকে নিয়ে যায় দরজার মুখে।

     শরীরটা দরজার বাইরে বেরোতে বেরোতে দুহাতে দরজার একটা কিনারা প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে শুভ্রকিন্তু বাতাসের বজ্রমুষ্টিতে ধরা প্যারাশুট তবুও তাকে অল্প অল্প করে টেনে নিয়ে যেতে থাকে বাইরে

     আরো কয়েকজনের সঙ্গে দৌড়য় বর্ণা শুভ্রর দিকে

     সময়ের গতি যেন শ্লথ হয়ে আসে বর্ণার কাছে নিজের পায়ের প্রতিটি ওঠা নামা সে অনুভব করে, দেখতে পায় দরজার কিনারা থেকে এক এক করে হাতের আঙুল ছেড়ে গিয়ে শুভ্রর শরীরটা অল্প অল্প করে এগিয়ে যাচ্ছে ল্যাণ্ডিং র‍্যাম্পের বাইরের শূন্যতার দিকে, বুঝতে পারে সে শুভ্র অবধি পৌঁছতে পারলেও বাতাসের দুর্দম শক্তির সঙ্গে লড়াই করে তাকে বাঁচাতে পারবে না

     পায়ের কাছে কি চকচক করে

     ভাল করে তাকিয়ে দেখে বর্ণা

     লেসার ছুরি একটা লেসার ছুরি পড়ে আছে মেঝেতে।

     নিচু হয়ে মেঝে থেকে ছুরিটা তুলে নেয় বর্ণা, তার আঙুলের চাপে বেরিয়ে আসে লেসারের লাল শিখা

     গতি এতটুকু না কমিয়ে শুভ্রর দিকে ঝাঁপ দেয় বর্ণা, লেসার ছুরি ধরা হাতটা লম্বা করে বাড়িয়ে দেয় সামনের দিকে

     নিজের শরীরটা শুভ্রর দেহের ওপর আছড়ে পড়ার সাথে সাথেই লেসার ছুরি ধরা হাতটাকে ধনুকের মত ডান থেকে বাঁদিকে ঘোরায় বর্ণা

     একের পর এক লেসারের শিখা স্পর্শ করে প্যারাশুটের দড়ি, পটপট করে কেটে যায় শুভ্র আর প্যারাশুটের বাঁধন

     শুভ্রকে ছেড়ে দিয়ে একটা বিশাল রঙীন পাখির মতন ওলটপালট খেতে আকাশের বুকে মিলিয়ে যায় প্যারাশুট।

     আবার অনেকগুলো হাত শুভ্র আর বর্ণাকে টেনে আনে ভেতরে

     বন্ধ হয়ে যায় ল্যাণ্ডিং র‍্যাম্প সোঁ সোঁ শব্দে হাওয়া ভরে মেন ডেকে

     নিভে যায় হলুদ আলো। থেমে যায় সাইরেনের আওয়াজ

     প্রেসার স্যুটের ফেসপ্লেট আর হুড খুলে ফেলে হাঁপায় বর্ণা চুলগুলো তার ঘামে ভিজে লেপ্টে থাকে মাথায়, কপাল বেয়ে নামে অবিশ্রান্ত ঘামের ধারা

     হুড খুলে ফেলে শুভ্রও উদ্‌ভ্রান্ত চোখে তাকায় বন্ধ ল্যাণ্ডিং র‍্যাম্পেরদিকে

     – আমার প্যারাশুট !

     যেন ছোট ছেলে কোন খেলনা হারিয়ে ফেলেছে

     মাথা একেবারে তেতে ওঠে বর্ণার প্রায় একেবারে শুভ্রর নাকের কাছে মুখটা নিয়ে এসে চেঁচিয়ে ওঠে রাগতস্বরে

     – প্রাণে বাঁচলে তাতেও হল না? আবার প্যারাশুটও চাই?

     সে যে দোষ কি করল বুঝতে না পেরে হকচকিয়ে যায় শুভ্র

     পেছন ফিরে হাঁটা দেয় বর্ণা, তার পায়ের দুমদাম শব্দ বোধহয় পৌঁছে যায় ককপিট অবধি

     হতভম্ব হয়ে তার যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে থাকে শুভ্র

     সেদিনের মতনই আর এক সকাল জেটিতে দাঁড়িয়ে থাকে বর্ণা দূর থেকে ভেসে আসা ভারী সাইরেনের আওয়াজ জানান দেয় মোহিনীগঞ্জের স্টিমার আসছে

     সেদিন আর এইদিনে অনেক তফাৎ আজ বর্ষার চিহ্ন মাত্র নেই, ঝকঝক করে রোদ মাখা আকাশ। বারগাঁর ঘুম ভেঙেছে আজ আগে আগেই, জেটিতে নজরে পড়ে মানুষের ব্যস্ত ভিড় আর হাঁকাহাঁকি।

     আরও একটা তফাৎ

     সেদিন বর্ণা কাউকে নিতে এসেছিল আজ এসেছে কাউকে ছাড়তে

     একবার তাকায় বর্ণা চামড়ার হলুদ সুটকেসটা জেটিরে ওপর রেখে স্টিমারের আসার পথের দিকে তাকিয়ে আছে শুভ্র

     সেদিন যাদের নিতে এসেছিল বর্ণা, তারা তার আপনজন, অনেকদিনের চেনা

     আজ যাকে ছাড়তে এসেছে, তার সঙ্গে বর্ণার পরিচয় এই কয়েকদিনের মাত্র

     কিন্তু তবু তার বুকের ভেতরে এমন একটা চিনচিনে ব্যাথা মোচড় দেয় কেন?

     – তোমার রিসার্চের জন্যে ডাটা কিছু পেলে?

     মাথা ঘোরায় শুভ্র কেমন অন্যমনস্ক লাগে তাকে

     কি বললে? রিসার্চ? ও হ্যাঁ,হ্যাঁ রিসার্চের জন্যে প্রচুর ডাটা পাওয়া গেছে

     ফের মাথা ঘুরিয়ে স্টিমারের আসা দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে শুভ্র

     আর একবার সাইরেনের আওয়াজ তুলে স্টিমার এসে ভেড়ে ঘাটেশুরু হয় মানুষ আর মালপত্রের ওঠা নামা

     সুটকেসটা তুলে নিয়ে স্টিমারে ওঠার সিঁড়িতে পা রাখে শুভ্র

     – মোহিনীগঞ্জ এলে অবশ্যই দেখা কোরো

     উত্তর দিতে গিয়েও উত্তর দিতে পারে না বর্ণা, কি একটা যেন আটকে যায় গলার কাছে নীরবে সে মাথা নাড়ে কেবল

     স্টিমারের ডেক থেকে একবার হাত নাড়ে শুভ্র, তার পর মিলিয়ে যায় ভিড়ের মধ্য

     পেছন ফিরে হাঁটা দেয় বর্ণা, খানিক্ষণ এলোমেলো ঘুরে এসে দাঁড়ায় কমিউনিটি সেণ্টারের সামনে

     কমিউনিটি সেণ্টারের কাছে কয়েকটা সঙ্গী জুটিয়ে বল খেলে মুকুল। বর্ণাকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়ে খেলা ছেড়ে

     – দিদি, তোমাদের গেস্ট চলে গেলো?

     – হ্যাঁ

     বর্ণার বুকের ভেতরের ব্যাথাটা আবার যেন কেমন চাগাড় দিয়ে ওঠে মুকুলের কথায়

     দোতলার কমিউনিকেশন রুমে এসে রেডিও সারাতে বসে বর্ণা, কিন্ত কিছুতেই কাজে মন দিতে পারে না

     মাত্র এক পুরুষ আগে মানুষের পা পড়া একটা গ্রহের জঙ্গলের পাশে তার আশৈশব কেটেছে পদে পদে প্রাণান্তকর বিপদের মোকাবিলা করাটা তার অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে সেই ছোটবেলা থেকেই শরীরের জ্বালা যন্ত্রণা তার কাছে মোটেও অপরিচিত না কিন্তু আজকের এই অচেনা ব্যাথাটাকে কিছুতেই বাগে আনতে পারে না সে

     কিছুক্ষন চেষ্টার পর রেডিও মেরামতিতে বিরতি দিয়ে নিচের ক্যান্টিনে নেমে আসে বর্ণা

     ক্যান্টিন ফাঁকা, কেবল এক কোনের একটা টেবিলে কিছু কাগজপত্র নিয়ে মুত্থুস্বামীর সঙ্গে কিসব আলোচনা করেন উর্ব্বী বর্ণার দিকে একবার তাকিয়ে দেখে ফের মন দেন নিজের কাজে

     অন্য আর একটা টেবিলে গিয়ে বসে বর্ণা হোলস্টার থেকে পিস্তল্টা বের করে তার আগাপাস্তলা পালিশ করতে থাকে একটা কাপড়ের টুকরো দিয়ে

     আচমকাই হাট হয়ে খুলে যায় ক্যান্টিনের দরজাটালম্বা পায়ে ভেতরেঢোকে শুভ্র তার জামাকাপড় ভিজে জবজব করছে, অঝোরে জল ঝরে পড়ে হাতের সুটকেস থেকে

     লাফিয়ে ওঠা হৃৎপিণ্ডটাকে কোন মতে বাগে এনে, যথাসম্ভব নির্লিপ্ত কন্ঠে বর্ণা প্রশ্ন করে,

     – কি হল, এমন ভিজে কাপড়ে ফেরত এলে যে?

     সুটকেসটা মাটিতে রেখে দুপাশে হাত ছড়িয়ে দেয় শুভ্র

     – কি করবো! স্টিমার ছেড়ে দিয়েছিল, বলল আর ফেরৎ যেতে পারবে না তো কি আর করা, আঘাটায় নেমে জল ঠেলে আসতে হল

     – কিন্ত নামলে কেন?

নিজের খালি মাথার দিকে ইঙ্গিত করে শুভ্র,

     – আর কেন! টুপিটা ভুলে ফেলে গেছি টুপি ছাড়া যাই কি করে?

     বর্ণার যতদূর মনে আছে আছে শেষবার স্টিমারে সে শুভ্রকে মাথা টুপি দেওয়া অবস্থাতেই দেখেছিল কিন্তু তবু মুখে একটা অবাক হওয়ার ভান ফুটিয়ে তোলে

     – সে কি! কোথায় ফেললে? চলো খুঁজে দেখি!

     শুভ্রর সঙ্গে ক্যান্টিন থেকে বেরিয়ে যায় বর্ণা

     বুকের হাতুড়িপেটাকে বাগে আনতে ব্যস্ত না হয়ে পড়লে অবশ্য বর্ণা খেয়াল করতো যে কফির মগে মুখ গুঁজে হাসি চাপার চেষ্টা করছেন মুত্থুস্বামী।

     কফির মগ থেকে মুখ সরিয়ে মুচকি হাসেন মুত্থুস্বামী

     – দিদি, বর্ণা যদি জানতে পারে শুভ্রকে পাঠানোর জন্যে ডক্টর সুবেশকে তুমিই বলেছিলে?

     চাপা গলায় ধমক দেন উর্ব্বা

     – চুপ কর্‌ মুত্থু, বর্ণার কানে গেলে ঝামেলা বাধাবে

     বাইরে তখন হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মুকুলএর আগে সে দিদিকে দুদুবার হাতিহাঁস খুঁজতে সাহায্য করেছে কিন্তু এবার সঙ্গে গিয়ে টুপি খুঁজে দিতে যাবার কথা বলতেই দিদি আর দিদির গেস্ট দুজনেই কেন অমন নানা করে উঠল সে ঠিক বুঝতে পারে নাতাছাড়া টুপি খুঁজতে গিয়ে দুজনকেওইরকম পাশাপাশি হাঁটতেই বা হবে কেন, আর হেসে হেসে এওর গায়ে গড়িয়ে পড়তে হবে কেন, তাও তার মাথায় ঢোকে না।

     একসঙ্গে পথ চলতে থাকা দুটো মানুষের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে ফের বন্ধুদের সঙ্গে বল খেলায় মন দেয় মুকুল।

     নদীর জলের শব্দ ছাপিয়ে দূরে কোথাও একটা থলকাছিম ডেকে ওঠে খক্খক্‌ শব্দে

Tags: অদ্রীজা বর্ধন, উপন্যাস, কল্পবিজ্ঞান উপন্যাস, দ্বিতীয় বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পূজাবার্ষিকী, মারকত নন্দিনী, সুমিত বর্ধন

10 thoughts on “মারকত নন্দিনী

  • September 29, 2017 at 6:01 pm
    Permalink

    অন্যরকম লেখা।
    বেশ ভালো লাগলো।
    আরও চাই।

    Reply
  • September 30, 2017 at 5:53 am
    Permalink

    বেশ ভালো লাগলো। হোয়েল শিকারের কাহিনীগুলো তার ইমোশনগুলোর সাথে কল্পজগৎকে মিশিয়ে দারুণ সৃষ্টি

    Reply
  • October 1, 2017 at 10:08 am
    Permalink

    Khub bhalo laglo. Adventure shikar prem sob miliye jomjomat.

    Reply
  • October 1, 2017 at 8:11 pm
    Permalink

    Ekdomi onnorokom… Science, adventure, kolpana, shikar, and sobsesh e bhalobasa… Puro golpotar uposthapona besh legeche…

    Reply
  • October 7, 2017 at 6:50 am
    Permalink

    এক সমান্তরাল নৃতত্ত্বের বিনির্মান। চেনা ইতিহাসের কাছাকাছি অথচ ‘দূরে কোথাও’। আর লিরিক্যাল শব্দ বন্ধনী এক অন্য মাত্রা দিয়েছে লেখাটাতে। কুর্নিস জানাই সুমিত দা।

    Reply
  • December 6, 2017 at 12:08 pm
    Permalink

    এক নতুন পৃথিবীর বুকে প্রাগৈতিহাসিক ঘি আর আগুনের এই খেলা বড্ড ভালো লাগল। সলিড, সিম্পলি সলিড।

    Reply
  • February 15, 2019 at 7:54 pm
    Permalink

    এ যে দেখি দুই বর্ধন, এ বলে আমায় দেখ ও বলে আমায় দেখ ! অদ্রীশের ঘরানা নয় তো ? অনেক দেরিতে গল্পটা পড়লাম। কোথায় ২০১৭ আর কোথায় ২০১৯। ‘কল্পবিশ্ব’ খুবই ভালো কাজ করছে। আমরা হলাম ‘আশ্চর্য !’ যুগের লোক। ‘কল্পবিশ্ব ‘ আমাদের কাছে বড় দেরিতে এলো। অদ্রীশ শুনলাম খুবই অসুস্থ, ওর আরোগ্য কামনা করি। অদ্রীশ আর সত্যজিৎ বাংলার কল্পবিজ্ঞানকে নতুন জীবন দিয়েছেন আর দিয়েছেন বাংলার নতুন কল্পবিজ্ঞান লেখকদের এক নতুন দিগন্ত, ” কল্পবিশ্ব”ই সেই নতুন দিগন্তের যাত্রিবাহী বিমান, বাংলার কল্পবিজ্ঞানীদের যা বয়ে নিয়ে যাবে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে । যাত্রাপথ শুভ হোক!
    —গুরনেক সিং

    Reply
    • February 20, 2019 at 11:54 pm
      Permalink

      আপনার এই স্বীকৃতিটুকু আমার লেখার পথের পাথেয় হয়ে রইল । তবে আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ, আপনি আবার কলম ধরুন । গ্রহ-গ্রহান্তরের যাত্রায় আপনার মত পথিকৃৎদের সঙ্গে না নিয়ে আমরা যাই কি করে !

      Reply
  • March 28, 2019 at 10:57 pm
    Permalink

    এই নতুন পৃথিবী নিয়ে আরো অনেক অনেক লিখুন দাদা। দারুন লাগলো। অপেক্ষায় রইলাম।

    Reply
  • November 15, 2019 at 12:05 pm
    Permalink

    খুব মিষ্টি একটা গল্প। এমন কেন সত্যি হয়না আহা!

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!