হৃদয়হীনা
লেখক: সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী
শিল্পী: প্রমিত নন্দী
সকাল ৯টা। দ্বৈপায়নের আজও মনে হয় লেট হয়ে যাবে অফিসে। স্নান সেরে গায়ে জামা গলাতে গলাতে কোনওমতে টোস্টে জ্যাম লাগিয়ে এক কামড় দিয়েছে কি দেয়নি, দেওয়ালের কোণায় ঝোলানো যোগাযোগযন্ত্রে বিপ শব্দ আর আলো জ্বলা শুরু হল, সঙ্গে যান্ত্রিক কণ্ঠে উচ্চারণ, “ইনকামিং কল ফ্রম মা, প্লিজ রিসিভ।”
“উফ, এই সময় আবার কেন…” বলতে বলতেই থ্রিডি প্রোজেক্টরের আলোটা শূন্যে লাফিয়ে উঠল দ্বৈপায়নের সামনে। মা’র হাসি হাসি মুখের ছবিটা ভাসছে আর সেই একটানা ঘ্যানঘেনে শব্দ, “ … ফ্রম মা, প্লিজ রিসিভ”; রিসিভ না করে আর উপায় নেই। শূন্যে আঙুল চালিয়ে নির্দিষ্ট প্যাটার্ন এঁকে কল রিসিভ করে দ্বৈপায়ন বলল, “মা, তোমায় কতবার বলেছি এই সময় কল করবে না আমায়। আমি এখনও রেডিই হইনি, অফিসে লেট হয়ে যাবে।”
“সোনা, এত রাগ করছিস কেন? কাল রাতে তো আর ফোন করিসনি, তাই ভাবলাম সকালেই করি। ঠিক আছিস তো?”
“কাল রাতে আমার প্রোজেক্ট নিয়ে খুব বিজি ছিলাম মা। সব ঠিক আছে, এখন রাখি প্লিজ?”
“আচ্ছা, আচ্ছা রাখছি। তার আগে বল, শুধু প্রোজেক্টেই বিজি থাকছিস নাকি নতুন কোনও বান্ধবীও জুটল আমার দিপু সোনার? হা হা!”
“উফ মা! না! আমার অত সময় নেই। কোনও নতুন বান্ধবী হয়নি।”
“তা কেন হবে? তোর বাবা, আমি, সবাই বুড়ো হয়ে মরতে চললাম, একটা বউমা, নাতি-নাতনি দেখার শখ আর মিটবে না আমাদের। কাজ যেন আমরা করতাম না বাপু!”
“মা! তুমি থামবে? না হলে আমি কল কাটব এবার।”
“আচ্ছা, আচ্ছা রাখছি…”
দ্বৈপায়নই কেটে দেয় কলটা তড়িঘড়ি। সঙ্গিনীর অভাব যে সেও অনুভব করে না এমনটা তো নয়। তিরিশ বছর বয়স হতে চলল, একটা স্টেডি প্রেমিকাও নেই এখনও। একজনকে যাও বা ভালো লাগে, তো সে মেয়ে পাত্তাই দেয় না তেমন। অফিসের তনুকা। কাল রাতে মনমেজাজ খারাপ থাকার পিছনেও তো কারণ খানিকটা সেই। ভিডিয়ো চ্যাটিংয়ের সময়ে বেশ বুঝতে পারছিল, মেয়েটা তাকে এড়িয়েই চলতে চায়, অফিসেরই পল্লবের সঙ্গে তনুকা দু-একবার ডেটে গেছে, কানাঘুষোয় শুনেছে দ্বৈপায়ন। কিন্তু পল্লবের ঘোষিত গার্লফ্রেন্ডও নয় সে। তাই একটু ছিপ ফেলার চেষ্টা। গতরাতে কথার সময়ে ক্যাসুয়ালিই একদিন রেস্তোরাঁতে যাওয়ার অফার দিয়েছিল তনুকাকে। ‘সময় নেই’ বলে স্রেফ মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিমায় তাকে কাটিয়ে দিল সে! কলটাও কেটে দিল ‘ঘুম পাচ্ছে’ বলে। এরপর আর কার মন মেজাজ ঠিক থাকে? অতসী বউদিকেও মেসেজ করেছিল তারপর দ্বৈপায়ন। সেও সাড়া দিল না। নির্ঘাত বরের সোহাগ খেতে ব্যস্ত। অথচ নিজের দরকারের সময়ে একলা দুপুরে ঠিক দ্বৈপায়নকে কল করে ভার্চুয়াল প্রেমে একেবারে নিংড়ে নেয় সে। দূর দূর, জীবনটাই যাচ্ছেতাই হয়ে যাচ্ছে। এবার একটা কিছু হিল্লে না হলে আর চলছে না।
অফিসে সারাদিন নিজের কিউবিকলে বসে ল্যাপটপে ঘাড় গুঁজে কাজ করে গেল দ্বৈপায়ন। তনুকা একটা দারুণ ফ্লোরাল প্রিন্টের পিঙ্ক শার্ট পরে এসেছিল, কিন্তু অভিমানে তার দিকে তাকাতেও ইচ্ছে করল না ওর। বাড়ি ফিরে একটু ফ্রেশ হয়ে এক কাপ কফি গরম করে বসে থ্রি ডি ভাসমান স্ক্রিনে ওয়েব ব্রাউজার অন করে আঙুলের অলস টোকায় একের পর এক সাইট র্যান্ডম সার্ফ করে যাচ্ছিল সে। হঠাৎ একটা সাইটে এসে থমকে গেল সে। গোল্ডেন ট্রি ডট কম— আপনার আদর্শ সঙ্গিনীর সন্ধান। উত্তেজক পোশাকে লাস্যময়ী তরুণীদের ছবি ভেসে উঠল তার সামনে। একটি ফিনফিনে স্বচ্ছ অন্তর্বাস পরা মেয়ে প্রায় স্ক্রিন থেকে বেরিয়ে এসে তার দিকে ঝুঁকে পড়ে বলল, “হ্যালো দ্বৈপায়ন! তুমি কি সঙ্গিনী খুঁজে খুঁজে হয়রান?” নড়েচড়ে বসল দ্বৈপায়ন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন এতটাই ইউজার স্পেসিফিক হয়ে গেছে, যে দর্শকদের সাবস্ক্রিপশন আইডি অনুসারে প্রত্যেককে তাদের নিজ নিজ নাম ধরেই সম্বোধন করা হয় এইসব সাইটে, তবে সেটা আসল ব্যপার নয়। এই যে একটা অসহ্য একাকীত্বের মধ্যে দিয়ে দ্বৈপায়ন চলছে, সেটার কি কোনও অবসান হতে পারে এর সাহায্যে? দেখাই যাক কী বলছে। নারীকণ্ঠ তুমুল আবেদনময়ী স্বরে বলে চলে, “… একলা, শীতল রাত্রিগুলি কি উষ্ণতায় ভরে তুলতে চাও না তুমি? … তোমার কর্মঠ নিঃসঙ্গ হাত কি চায় না ওই মুঠোর মধ্যে কাউকে পেতে? … এমন কেউ, যে তোমার একান্ত আপন? যে তোমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা? সারাজীবনের জন্য যে তোমায় ভরিয়ে দেবে অনন্ত সুখে? তাহলে আর দেরি কেন? এখুনি চলে এসো আমাদের নিজস্ব আউটলেটে, তোমারই শহরে, তোমার অপেক্ষায় রয়েছি আমরা। কী, আসবে তো? নিচে দেওয়া ফোন নম্বরে যোগাযোগ করতে ভুলো না কিন্তু!”
দ্বৈপায়ন রীতিমতো ঘামতে থাকে। এই আকর্ষণ এড়ানো অসম্ভব। দেখতেই হবে কী আছে ওখানে। নম্বরটা সেভ করে তড়িঘড়ি ডায়াল করে গোল্ডেন ট্রি’র অফিসে।
পরদিন অফিস ফেরত সে সোজা চলে আসে চাঁদনি চকের ওই অফিসটায়। বিশাল এক ত্রিশ তলা বিল্ডিং-এর ছাব্বিশ তলায় ওদের অফিস। দূর থেকে নিয়ন আলোর নিশান দেখে চিনতে অবশ্য অসুবিধা হয়নি কোনও। লিফট থেকে বেরতেই সামনে দেখল অর্ধচন্দ্রাকৃতি এক রিসেপশন ডেস্ক। তাতে বসে আছে পরমাসুন্দরী এক তন্বী যুবতী। বিপজ্জনক লো কাট টপ পরা মেয়েটি তার তীব্র লালে রঞ্জিত ঠোঁটে ততোধিক মায়াবী এক হাসি এনে জিজ্ঞেস করল, “বলুন স্যার, আপনার জন্য কী করতে পারি?”
“ইয়ে, মানে, আমার একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল আজ। ফোনে বুক করেছিলাম কাল। দ্বৈপায়ন বসু।”
“ওহ, ইয়েস, প্লিজ কাম দিস ওয়ে স্যার।”
একটা সুদৃশ্য সোফায় তাকে বসতে ইঙ্গিত করল মেয়েটা। বসে এদিক ওদিক একটু তাকিয়ে দেখল দ্বৈপায়ন। অদ্ভুত একটা নীলচে আলো সারা ঘর জুড়ে। আলোর উৎস ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। আবহে একটা নেশা ধরানো রিনরিনে মিউজিক বাজছে, আর একটা খুব সুন্দর অথচ অপরিচিত গন্ধ। দেওয়াল জুড়ে নগ্ন নরনারীর রগরগে মিলনদৃশ্যের রঙিন কোলাজ, বিভিন্ন ভঙ্গিমায়। দ্বৈপায়ন অল্প অল্প ঘামতে থাকে। গোল্ডেন ট্রি নামটার মোটামুটি বাংলা করলে যে জায়গাটার নাম মনে আসে, এটা তেমন কিছু নয় তো? সোনাগাছি! সফিস্টিকেটেড এস্কর্ট সার্ভিসের অফিস নাকি এটা? সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই কানে আসে একটা গলার আওয়াজ—
“হ্যালো মিস্টার দ্বৈপায়ন! প্লিজড টু মিট ইউ! আমি মদন মল্লিক। গোল্ডেন ট্রি ডট কমের প্রোডাকশন ম্যানেজার। প্রথমেই আপনাকে অভিনন্দন জানাই আমাদের নির্বাচন করার জন্য। আপনাকে সেরা সার্ভিসটি দেওয়ার ব্যপারে আমরা অঙ্গীকারবদ্ধ।”
মাথা তুলে তাকিয়ে দ্বৈপায়ন দেখে, অমায়িক হাসি নিয়ে গোলগাল বেঁটেখাটো পাকা আমের মতো টুসটুসে একটা রসিক মুখের লোক সামনে হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে আছে। এই কোট প্যান্ট টাইয়ের মতো ফর্মাল পোশাকে লোকটাকে দেখে যেন আরও হাসি পাচ্ছে। প্রতিনমস্কার করে সে বলল, “ধন্যবাদ। কিন্তু, ইয়ে, মানে আমি কিন্তু এখনও আপনাদের সার্ভিস সম্বন্ধে বেশি কিছু জানি না। এমনিই বিজ্ঞাপন দেখে, আর কি…”
তাকে হাত তুলে থামিয়ে দেয় মদন মল্লিক। “থাক থাক, আর বলতে হবে না। সব বুঝতে পেরেছি। আরে আপনাদের সেবার জন্যই তো রয়েছি আমরা। এখন আসুন তো এদিকে, কয়েকটা প্রাথমিক কাজ ঝটপট সেরে ফেলি। আইডি প্রুফ এনেছেন তো?”
দ্বৈপায়ন সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়তেই তাকে নিয়ে পাশের একটা ছোট্ট ঘরে ঢুকল মদন। কম্পিউটারের সামনে বসেছিল আরেকটি পরমাসুন্দরী মেয়ে। তবে গায়ে খুব বেশি পোশাক রাখার ব্যপারে এদের মনে হয় ঘোর অনীহা, তা ভালোই! দ্বৈপায়ন ভাবল ওকে দেখে।
“নিন, আপনার ব্যক্তিগত প্রোফাইলটা তাড়াতাড়ি কমপ্লিট করে ফেলুন দেখি। আপনার পছন্দ, অপছন্দ, ভালোলাগা, শখ, ফ্যান্টাসি, সব বলবেন, কিচ্ছু না রেখে ঢেকে। কেমন? তাহলে আপনার পছন্দের এক্সক্লুসিভ সঙ্গিনীটিকে বানাতে আমাদের সুবিধা হবে।”
“বানাতে? মানে?”
“মানে? হা হা! আপনি বুঝতে পারেননি তাই না? অনেকেই পারে না। তাতে অবশ্য দোষ দেওয়া যায় না। আমাদের প্রযুক্তি এতটাই আধুনিক, উন্নতমানের আর নির্ভরযোগ্য, যে মানুষ আর রোবটের ফারাকটা বোঝা মুশকিল।”
“রোবট! কী বলছেন?”
“হ্যাঁ মশাই। এই যে আপনার কথা শুনে টাইপ করছে, মোহিনী, বাইরে রিসেপশোনে যাকে দেখলেন সেই উর্বশী এরা সবাই তো যন্ত্র! হিউম্যানয়েড। স্পেশালি মেড টু অপারেট ইন দিস অফিস।”
“আশ্চর্য! আমি ঘুণাক্ষরেও…”
“হা হা! ইট হ্যাপেন্স। নিন, ওদিকে পার্সোনাল ডেটা ইনপুট হয়ে গেলে এবার আমার সঙ্গে এদিকটায় আসুন। আপনার কেমন জীবনসঙ্গিনী চাই সেটা তো আমাদের জানাতে হবে!”
“কেমন চাই, মানে, আ – আমি ঠিক জানি না।”
“সেকী! কী চান নিজেই জানেন না? তা তো হতে পারে না। দাঁড়ান আমি বরং একটু সাহায্য করি আপনাকে। হাইট কেমন চান? লম্বা, বেঁটে না মাঝারি?”
“উম্ম, মাঝারি, এই ধরুন, আমার কানের কাছে তার মাথার উচ্চতা হবে, এমন। পসিবল?”
“আলবাত। যা বলবেন সেটাই হবে স্যার। এবার চুলের রং, গায়ের রং?”
“কালো চুল, কালো। আর একটু ফর্সা টর্সা হলেই…”
“হে হে। সে আপনাকে দেখেই বুঝেছি স্যার। সেই আদ্দিকাল থেকে ফর্সা মেয়ে পেলে বাঙালি আর কিছু চায় না। বেশ, এবার বলুন গড়ন কীরকম চান? খুব রোগা ছিপছিপে, নাকি বেশ মাংস টাংস আছে গায়ে, এমন, হে হে…”
“না না, রোগা না। ওই একটু স্বাস্থ্য ভালো দেখেই, মানে বেশ কার্ভি আর কি…”
“আপনি তো মশাই ভালোই জানেন আপনি কী চান, খালি খালি লজ্জা পাচ্ছিলেন।”
এবার কান লাল হয়ে যায় দ্বৈপায়নের। কী যে হচ্ছে, যেন একটা ঘোরের মধ্যে রয়েছে সে। আরও বেশ কিছু প্রশ্নোত্তর চলতে থাকে এইভাবেই। পুঙ্খানুপুঙ্খ সেই বর্ণনা দিতে দিতে দ্বৈপায়ন লক্ষ করে, এই আবছা অন্ধকার ঘরের একপাশের দেওয়ালটা কাচের। আর সেই কাচের ওপারে নীলচে আলোর মধ্যে কিছু একটা ঘটে চলেছে অনেকক্ষণ ধরে। যেন প্রকাণ্ড অ্যাকোয়ারিয়ামের জলের মধ্যে আলোড়ন তুলে কিছু একটা নড়ছে, জেলি জেলি মতো একটা অংশের নানা অংশে ঝিকিয়ে উঠছে বৈদ্যুতিন আলোর রেখা। অজস্র সূক্ষ্ম তার যেন ছুঁয়ে যাচ্ছে সেই বস্তুকে। মদন মল্লিক প্রশ্ন করা শেষে এবার তাকে ইশারায় ডেকে নিল সেই কাচের দেওয়ালের একদম সামনে। এ কী দেখছে সে! অপরূপ এক নগ্ন নারীশরীর, একেবারে যেমনটি সে বলেছে, হুবহু সেরকম। এত নিখুঁত! স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা?
“কী? পছন্দ হল তো? কী বলেছিলাম? আপনি আমাদের কাছে এসে জীবনের সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলেছেন? এবার আপনার মানস মানবীর একটা নাম দিন, সেটাই ওর নাম হবে আজ থেকে।”
“তিলোত্তমা! আর কোনও নাম মনে আসছে না।”
“বেশ। তাহলে এই তিলোত্তমা আজ থেকে আপনার। আসুন, ফাইনাল কনট্যাক্ট ফর্মটা একটু দেখে সই করে দিন একটা। তারপর পেমেন্ট। ডাউনপেমেন্ট থার্টি পারসেন্ট। বাকিটা এগারো মাসের সহজ কিস্তিতে। ওকে?”
“ও.কে। আর ওকে, আই মিন তিলোত্তমাকে বাড়িতে নিয়ে যাব কীভাবে?”
“সেসব আমাদের দায়িত্ব স্যার। ডেলিভারি চার্জ নেই। প্যাকিং করে এক ঘণ্টার মধ্যে আপনার বাড়ির দরজায় পৌঁছে দেব আমরাই।”
কথামতোই কাজ হল একেবারে। দ্বৈপায়ন সব মিটিয়ে বাড়িতে সবে ঢুকেছে কি ঢোকেনি, কলিং বেল বাজল। এসে গেছে! ডেলিভারি বয় একটা মানুষপ্রমাণ বড় ধাতব বাক্স নামিয়ে দিয়ে বলল, “এই যে স্যার, আপনার জিনিস। বাক্স খোলা বা জিনিসটা স্টার্ট করার জন্য এইখানে এই সবুজ বোতামে চাপ দিলেই হবে। আর কোনও কিছু করতে হবে না।”
লোকটা চলে যাওয়ার পর দ্বৈপায়ন তাকিয়ে দেখে বাক্সের গায়ে একটা ছোট কাগজে বিধিবদ্ধ কিছু সতর্কীকরণের সঙ্গে লেখা আছে রোবটের জন্য নির্ধারিত চারটি প্রাথমিক নীতি বা সূত্র:
০) একটি রোবট কখনও মনুষ্যত্বের ক্ষতিসাধন করবে না বা মনুষ্যত্বের ক্ষতির সম্ভাবনা বুঝলে তাকে রক্ষা করার প্রচেষ্টা থেকে বিরত থাকবে না।
১) একটি রোবট কখনও কোনও মানুষকে শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে না বা মানুষের ক্ষতির সম্ভাবনা বুঝলে তাকে রক্ষা করার প্রচেষ্টা থেকে বিরত থাকবে না।
২) একটি রোবট সব সময় মানুষের আদেশ মান্য করবে যদি না তা প্রথম সূত্রের পরিপন্থী হয়।
৩) একটি রোবট সব সময় নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে যদি না তা প্রথম দুটি সূত্রের একটিরও পরিপন্থী হয়।
“ক্ষতির আর কী আছে, কেই বা করবে। থাকি তো আমি একা। এতকিছু ভেবে কাজ নেই, জিনিসটা যে কারণে আনা সেটা ঠিকঠাক করতে পারে কিনা সেটাই এখন দেখার।”
এ কথা ভাবতে ভাবতে কম্পিত হাতে দ্বৈপায়ন বোতামটায় চাপ দিতেই সেটা সবুজ আলোয় জ্বলে উঠল, আর ছোট্ট বিপ করে একটা শব্দ হয়ে বাক্সের ডালাটা আস্তে আস্তে খুলে গেল। প্রথমে আলোর ছটায় দ্বৈপায়নের চোখ ধাঁধিয়ে গেল। তারপর ধীরে ধীরে চোখ সয়ে আসতে যা দেখল তাতে তার সারা শরীরে মৃদু শিহরণ খেলে গেল। শুধুমাত্র অন্তর্বাস পরে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সেই অপরূপা নারী— তিলোত্তমা!
“হ্যালো দ্বৈপায়ন, আমি তিলোত্তমা।”
“হ্যা – হ্যালো …” দ্বৈপায়নের বিস্ময়বিমূঢ় অবস্থাটা কাটাতে উদ্যোগী হল মেয়েটাই। আচমকা দৃঢ় আলিঙ্গনের বাঁধনে তাকে জড়িয়ে ফেলল আষ্টেপৃষ্ঠে, আবেশে চোখ বুজে আসতে আসতে দ্বৈপায়ন খেয়াল করল তার ঠোঁট তিলোত্তমার ঠোঁটের গভীরে ডুবে যাচ্ছে আর এক অদ্ভুত নৈপুণ্যে মেয়েটা তাদের দুজনের শরীর থেকেই সুতোর শেষ কণাটিও অপসারিত করছে।
পরবর্তী ঘণ্টা, মিনিট, সেকেন্ডগুলোর হিসেব রাখতে ভুলে গেল দ্বৈপায়ন। দিনের হিসেবও হয়তো। এত সুখ সে কোনওদিন পায়নি। আহার, নিদ্রা, মৈথুনের চক্রাবর্ত পরিক্রমা বেশ কয়েকবার চলার পর যখন তিলোত্তমা তাকে আদুরে গলায় বলল, “আজও অফিস যাবে না দীপু?”
তখন তার মনে পড়ল আজ দু’দিন হল সে অফিস যাচ্ছে না। বসের চোখরাঙ্গানির কথা ভেবেও পরক্ষণেই সে বলল, “থাক, আজ ভাবছি সারাটা দিন তোমার সঙ্গে বাড়িতেই কাটাই…।”
তিলোত্তমা কপট তিরস্কারের সুরে বলল, “এটা কিন্তু ঠিক হচ্ছে না দীপু। তোমাকে খুশি রাখতে পেরে আমারও ভালো লাগছে, কিন্তু চাকরিটা চলে গেলে তুমি কোম্পানিকে আমার ডিউ পেমেন্ট কীভাবে করবে ভেবেছ? ইএমআই না দিতে পারলে ওরা কিন্তু আমায় নিয়ে যাবে সোনা!”
সম্বিৎ ফেরে দ্বৈপায়নের। অনিচ্ছাসত্ত্বেও বেরিয়ে পড়ে কাজে, বেরনোর আগে তিলোত্তমার ঠোঁটে আঁকা চুম্বনের মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে সারাটা দিন। কাজের জায়গায় কলিগদের নানা অপ্রীতিকর প্রশ্ন, বসের মুখ ঝামটা, সবকিছুতেই নিঃস্পৃহ হয়ে থাকে সে। মেজাজ তার ফুরফুরেই থাকে, কাজ শেষ করে বাড়ি ফিরেই আবার সেই মায়ার খেলায় ডুবে যেতে পারবে যে!
রাতের আদর শেষে যখন ক্লান্ত পরিশ্রান্ত তৃপ্ত দ্বৈপায়ন তিলোত্তমার বুকে মাথা রেখে শুয়ে তাকে বলল, “আমি তোমায় পেয়ে ভীষণ খুশি তিলোত্তমা। এভাবেই থাকবে তো আমার কাছে সবসময়?”
“সব সময়, সারাজীবন!”
দ্বৈপায়নের চোখ ঘুমে জড়িয়ে এসেছিল। তিলোত্তমার তো ঘুমের দরকার হয় না। তার বিস্ফারিত চোখের তারা সিলিং-এর দিকে চেয়ে রইল সারারাত।
পরের সপ্তাহান্তে দ্বৈপায়ন তিলোত্তমাকে নিয়ে সল্টলেক সিটি সেন্টারে গেল। একটু খাওয়াদাওয়া, একটু ঘোরা, আর একটা সিনেমা দেখা। এতদিন তার পরিচিত বন্ধুবান্ধবদেরই দেখত নিজেদের প্রেমিকাকে নিয়ে ঘুরতে, আজ সেও সদর্পে তিলোত্তমার কোমর জড়িয়ে ঘুরছে। কিছু বিস্মিত চোখ তাদের দিকে চেয়ে আছে বুঝে আরও ভালো লাগল তার। তবে তিলোত্তমা তো কিছুই খায় না। ওর প্রয়োজন হয় না। এটা একটু খচখচ করছিল দ্বৈপায়নের, তবে কিছু তো করার নেই। সিনেমাটা শুরু হল। যেমনটা আশা করেছিল, তেমন জমল না। পুরোটা না দেখেই বেরিয়ে এলো বাইরে। তিলোত্তমা চুপচাপ। কী মনে হতে ওকে প্রশ্ন করল দ্বৈপায়ন, “আচ্ছা সিনেমাটা কেমন লাগল তোমার?”
“তোমার কেমন লাগল?” পালটা প্রশ্ন করল তিলোত্তমা।
“আমার তো বেশ ভালো লাগল।” মিছিমিছি বলল দ্বৈপায়ন।
“আমারও বেশ ভালো লাগল। খুব ভালো।”
দ্বৈপায়ন গুম হয়ে গেল এটা শুনে। তিলোত্তমা কিছুক্ষণ পরেই জিজ্ঞেস করল, “কী হল?”
দ্বৈপায়ন একটু রুক্ষস্বরে বলল, “কী আবার হবে? সিনেমাটা এত জঘন্য, তাই তোমায় জিজ্ঞেস করেছিলাম…”
“তুমি তো বললে তোমার ভালো লেগেছে, তাই আমিও…”
“তাই তুমিও বলবে? কেন, তোমার নিজস্ব কোনও ভালোলাগা মন্দলাগা নেই?”
“তোমার যা ভালো লাগে আমারও তাই ভালো লাগবে গো। আমাকে তো সেভাবেই বানানো হয়েছে যাতে তোমায় খুশি রাখতে পারি।”
“খুশি! হুঁহ!”
“কেন? তুমি কি খুশি নও? এসো একটু আদর করে দিই…”
“ধুস! ওই এক… সরো তো! যখন তখন যেখানে সেখানে হয় নাকি? এটা পাবলিক প্লেস! ডিসগাস্টিং!”
এরপর থেকে হঠাৎ দ্বৈপায়ন আবিষ্কার করল, তার নয়া সঙ্গিনীটির সব কিছুই যে তার খুব ভালো লাগছে, এমনটা নয়। দ্বৈপায়ন কবিতা ভালোবাসে। আবৃত্তিও মন্দ করত না এক কালে। জীবনানন্দের কবিতা পড়ে একদিন শুনিয়েছিল তিলোত্তমাকে। নিরুত্তাপভাবে খুব ভালো বলে চুপ করে গেছিল। আরেকদিন এক বিখ্যাত রাজনীতিবিদ তথা কুখ্যাত কবির কিম্ভুতমার্কা ছড়া আবেগ নিয়ে পড়ে শুনিয়েছিল ইচ্ছে করেই। তিলোত্তমার একই অভিব্যক্তি! প্রোফাইল বানানোর সময় তার প্রিয় খাবারের তালিকায় বিরিয়ানি, মাটন চাপ, নুডলস, চিলি চিকেন লিখেছিল। খেয়াল করে দেখল, বাড়িতে রান্না করার সময় তিলোত্তমা বেশির ভাগ দিনেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে খালি সেগুলোই বানায়। খেতে খুব ভালো হয় সন্দেহ নেই। কিন্তু এত একঘেয়ে! মানে প্রতিদিন একইরকম স্বাদ অবিকল, একই পরিমাণে ঝাল, মশলা, নুন। কোনও মানুষ রাঁধলে নিশ্চয়ই এইটা হত না। একদিন রাগ করে খাবার ছুড়ে ফেলেই দেয় সে। তিলোত্তমা কিছু বলে না। নিঃশব্দে সেসব কুড়িয়ে নিয়ে বাসন ধুয়ে ফেলে, তারপর রাতে আবার একইরকমভাবে ঘনিষ্ঠ হতে আসে তার সঙ্গে। রুটিনমাফিক। অস্বস্তি হয় দ্বৈপায়নের। কেমন যেন দম চাপা লাগে। অফিসে থেকে বেরিয়ে একদিন বাড়ি না ফিরে একাই উদ্দেশ্যহীনভাবে শপিং মলে ঘোরাঘুরি করে। এটাসেটা কিনে খায়। বুকশপে পরমজিৎ চ্যাটার্জীর নতুন নভেলটা নেড়েচেড়ে দেখছিল, হঠাৎ পাশ থেকে এক পরিচিত নারীকণ্ঠ, “আরে, দ্বৈপায়ন না? এখানে কী ব্যপার?”
তাকিয়ে দেখে তনুকা। কী সুন্দর লাগছে ওকে। লাল একটা টপ পরেছে ব্লু ডেনিমের সঙ্গে।
“ওহ তনুকা। কেমন আছ?”
“আমি তো ভালো। তোমার কী খবর? আর মেসেজও করো না। অফিসেও দেখা হয় না তেমন, সব ঠিক আছে তো?”
“হ্যাঁ, মানে ঠিক আছি আমি। ইয়ে, বলছি পল্লবের কী খবর?”
“ধুর। ওর কথা বাদ দাও তো। ফালতু ছেলে একটা। আমার সঙ্গে যোগাযোগ নেই আর… বাই দ্য ওয়ে, পরমজিৎ-এর নভেলটা কিনছ? আমার দারুণ লেগেছে।”
“তাই? ভাবছিলাম কিনব, তুমি বললে যখন, অবশ্যই নেব।”
“পড়ে জানিও। এমন রোমান্টিক থ্রিলার অনেকদিন পড়িনি।”
“নিশ্চয়ই জানাব গো। খুব ভালো লাগছে এতদিন পর দেখা হল, কথা হল। আমি তো ভাবতাম তুমি বোধহয় বিরক্ত হও আমার সঙ্গে কথা বলতে।”
“তুমি তো আমায় বিরক্ত করোনি কখনও দ্বৈপায়ন, বরং …”
“বরং?”
“আমার তো তোমাকে বেশ ভালোই লাগে। তুমি সেই ডিনার ডেটে যাওয়ার কথা বলেছিলে একদিন, আমি তখন সময় পাইনি। যদি পরে কখনও ইচ্ছে হয়…”
“ওহ শিওর! আই উড লাভ টু…”
“ঠিক আছে, মেসেজ করো। টেক কেয়ার, বাই।”
“বাই…”
এরপর থেকে দ্বৈপায়নের জীবনের বাঁক আবার খুব দ্রুত বদলাল। খুব শিগগিরি সে তনুকার সঙ্গে ডিনার ডেটেও গেল। একটা হোটেলে একান্তে সুন্দর কিছু সময় কাটাল দুজনে। সে রাতে বাড়ি ফেরার পর যখন তিলোত্তমা তার কাছে আসতে চাইল, সে একরকম ঠেলেই তাকে সরিয়ে দিল। রাতে এমনকি অন্য ঘরে গিয়ে শুলো, দরজা লক করে। পরদিন রাতে যখন তনুকার সঙ্গে ভিডিয়ো চ্যাট হচ্ছিল, কখন তিলোত্তমা তার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে নিঃশব্দে সে বুঝতেও পারেনি। কল শেষ হতে পিছন ফিরে তাকে দেখতেই একটু চমকে গেল দ্বৈপায়ন।
“একী! তুমি?”
“তাহলে এই তনুকার জন্যই তুমি আর আমার কাছে আসো না আজকাল? আমাকে অবহেলা করো?”
“যা খুশি ভাবতে পার! আর শোন, আমাকে একদম বিরক্ত করতে আসবে না।”
“বিরক্ত তো করিনি। রাগ করছ কেন? কতদিন তোমাকে আদর করিনি, আজ একটু…”
তড়াক করে উঠে দাঁড়ায় দ্বৈপায়ন, “সরে যাও, আমি বলছি। কাছে আসবে না একদম।”
ঠিক এই সময় কলিং বেল বেজে উঠল। দ্বৈপায়ন এগিয়ে দরজা একটু ফাঁক করতেই যেন তড়িতাহত হল। তনুকা। মিষ্টি হেসে সে বলল, “সারপ্রাইজ! ভিডিয়ো কল করছিলাম তোমার ফ্ল্যাটের দিকে আসতে আসতেই। ভাবলাম যাই মহাশয়ের ঘরটা একবার দেখেই আসি। তা, ভিতরে ঢুকতে বলবে না?”
“হ্যাঁ, আরে, এসো এসো।”
ইশারায় তিলোত্তমাকে অন্য ঘরে সরে যেতে নির্দেশ দিল দ্বৈপায়ন দরজা খোলার আগে। কিন্তু সে ভাবলেশহীন মুখে দাঁড়িয়েই রইল সেখানে। তনুকা ঘরে ঢুকেই জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তার দিকে তাকাতেই তড়িঘড়ি দ্বৈপায়ন বলে উঠল, “এই যে, আমার কাজিন সিস্টার দ্বৈতা। আজই মুম্বই থেকে ফ্লাইটে এসেছে। কাজের জন্য কিছুদিন থাকবে আমার কাছে। খুব টায়ার্ড আছে এখন।”
“কাজিন? ওহ। তোমার এত সুন্দরী একটা বোন আছে আমায় আগে বলোনি তো?”
“হে হে! সৌন্দর্যের ব্যপারটা আমাদের জিনগত। আমায় দেখে বোঝ না?” পরিস্থিতি লঘু করতে জোলো একটা ঠাট্টা করে দ্বৈপায়ন। মুখে কাষ্ঠহাসি এনে ফের তিলোত্তমাকে বলে, “আরে, তুই এখনও দাঁড়িয়ে আছিস দ্বৈতা? যা যা ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নে ও ঘরে।”
“ঠিক আছে দ্বৈতা। তুমি বরং বিশ্রাম নাও আজ, তোমার দাদা বলছে যখন। পরে একদিন জমিয়ে আড্ডা দেব’খন তোমার সঙ্গে। দ্বৈপায়নের ছোটবেলার দুষ্টুমির গল্প শুনব তোমার কাছে।” তনুকা বলে।
“হ্যাঁ, তাই হবে। আমি বিশ্রাম নিতে যাচ্ছি।” শান্ত চোখে দুজনের দিকে একবার তাকিয়ে তিলোত্তমা পাশের ঘরে চলে যায়।
আর একমুহূর্তও সময় নষ্ট না করে দ্বৈপায়ন। দৃঢ় আলিঙ্গনে বেঁধে ফেলে তনুকাকে, ঠোঁটে মিশিয়ে দেয় ঠোঁট। শুধু বন্ধ দরজার ওপার থেকেও তাদের উদ্দাম শরীরী খেলার সাক্ষী থাকে একজোড়া অপলক শক্তিশালী হিউম্যানয়েড চোখ, তারা টেরও পায় না।
পরদিন সকালে তিলোত্তমাকে ডেকে দ্বৈপায়ন বলে, “শোনো, আমি কোম্পানির সঙ্গে কথা বলে নিচ্ছি আজ। কয়েকদিনের মধ্যে তোমাকে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করব।”
“আমাকে ফেরত পাঠিয়ে দেবে?”
“হ্যাঁ, তোমাকে আর দরকার নেই আমার।”
“দরকার নেই? কিন্তু আমাকে যে তোমার ইচ্ছেমতোই বানানো হয়েছিল গো। আমি কী কোনও ভুলত্রুটি করলাম?”
“না না, তা কেন? যেটুকু সার্ভিস পেয়েছি, খুবই ভালো। তবে বললাম না, প্রয়োজন মিটে গেছে। টাকা যা বাকি আছে আমি দিয়ে দিলে তোমাকে নিয়ে যেতে ওদের আপত্তি নেই জানিয়েছে।”
“তুমি কি জানো আমাকে ফেরত নিয়ে ওরা কী করবে?”
“না, কী হবে জেনে?”
“তবু বলি। আমাকে টুকরো টুকরো করে ভাঙবে ওরা। বিভিন্ন যন্ত্রাংশ নিয়ে স্পেয়ার পার্ট হিসেবে অন্য কোনও রোবট বানাতে ব্যবহার করবে। এই ‘আমি’টার আর কোনও অস্তিত্ব থাকবে না। তোমার ‘তিলোত্তমা’ হারিয়ে যাবে।”
“ওহ, শুনে খারাপ লাগল, কিন্তু আমি নিরুপায়।” নিতান্ত ক্যাসুয়ালি বলে দ্বৈপায়ন।
“এই সব কিছু ওই একটা মেয়ের জন্য? আমি কি ওর চেয়ে দেখতে খারাপ ছিলাম? আমার শরীরী আবেদন কি ওর চেয়ে কোনও অংশে কম?”
“বোকার মতো কথা বোল না, সেসব কিছুই না। কিন্তু ওর যা আছে, তা তোমার নেই তিলোত্তমা।” ঝাঁঝিয়ে উঠে বলে দ্বৈপায়ন।
“কী নেই আমার?”
“হৃদয়! হার্ট! তোমার কোনও হৃদয় নেই, তাই কোনও মানবিক অনুভূতি নেই। বুঝেছ দু-পয়সার হিউম্যানয়েড? আমারই ভুল হয়েছিল ক্ষণিকের মোহে এইসব ঝঞ্ঝাটে জড়িয়ে। বেশ হবে তোমার মতো আবর্জনাকে ওই ভাঙাচোরার স্তূপে নিক্ষেপ করলে!”
রেগেমেগে অফিসে বেরিয়ে যায় দ্বৈপায়ন। স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে থাকে তিলোত্তমা। দ্বৈপায়নের কথাগুলো তার যান্ত্রিক মস্তিষ্কের মেমরি চিপে বারবার আলোড়িত হয়। রোবটের জন্য নির্ধারিত তৃতীয় সূত্রটি তার মাথার ভিতরে নির্মিত জটিল নেটওয়ার্কে বারংবার ফ্ল্যাশ করতে থাকে—
‘একটি রোবট সব সময় নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে যদি না তা প্রথম দুটি সূত্রের একটিরও পরিপন্থী হয়।’
সেদিন দুপুরে ফের কলিং বেল বেজে উঠল দ্বৈপায়নের দরজায়। তিলোত্তমা হাসিমুখে দরজা খুলে বলল, “এসো তনুকা, তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।”
“ওহ দ্বৈতা, তুমি! দ্বৈপায়ন কল করে আসতে বলেছিল, ও নেই?”
“ও একটা জরুরি কাজে বেরল, আসবে একটু পরেই। তুমি এসো না ভিতরে, আমি আছি তো।”
“ওহ, আচ্ছা, বেশ। হ্যাঁ, তোমার সঙ্গে তো সেদিন ভালো করে কথাই হল না।”
“তাই তো। এসো আজ হৃদয় উজাড় করে কথা হোক আমাদের।”
“হা হা, বেশ বলেছ। তাই হোক।”
অফিসে গিয়ে কিছুক্ষণ নিজের কাজে ব্যস্ত থাকার পর তনুকাকে না দেখে ওদের ডিপার্টমেন্টের সন্দীপ্তাকে জিজ্ঞেস করতেই মাথায় যেন বাজ পড়ল দ্বৈপায়নের। ওর ভালো বন্ধু সন্দীপ্তা, দুজনের সম্পর্কটাও জানে। সন্দীপ্তা বলল, তনুকা নাকি তার ফোন পেয়ে আজ তারই ফ্ল্যাটে গেছে! তাই অফিসে আসবে না জানিয়েছে।
“কিন্তু আমি তো কোনও ফোন করিনি ওকে” এটা বলতে গিয়েও বলল না দ্বৈপায়ন।
কিছু একটা বড়সড় গোলমালের আশঙ্কায় ওর মনটা কু ডেকে উঠল। তৎক্ষণাৎ ব্যক্তিগত ইমারজেন্সির অজুহাতে অফিস থেকে অব্যাহতি নিয়ে বাড়ির দিকে ছুট লাগাল সে।
কলিং বেল শুনে দরজা খুলল তিলোত্তমা। তার মুখে একটা অদ্ভুত হাসি লেগে। তার দিকে ভ্রূক্ষেপ না করে উদ্ভ্রান্তের মতো ঘরের চারপাশে নজর বোলাতে বোলাতে তনুকার নাম ধরে ডাকতে শুরু করল দ্বৈপায়ন। পাশের বেডরুমের দরজাটা আলতো করে ভেজানো। সেদিকে এগিয়ে দরজাটা ঠেলতেই আঁতকে আর্তনাদ করে উঠল দ্বৈপায়ন। খাটের উপর সাদা চাদরটা রক্তে মাখামাখি। তার মধ্যে শুয়ে আছে তনুকার নিথর দেহ। চোখ আতঙ্কে বিস্ফারিত, আর, আর… খোলা জামার ফাঁক দিয়ে যেটুকু দেখা যাচ্ছে, বুকের বাম দিকটা কেউ যেন খুবলে উপড়ে নিয়েছে নির্মমভাবে। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে দু-হাতে মুখ ঢেকে বসে পড়ল দ্বৈপায়ন।
“কী করেছ? কী করেছ তুমি ওর সঙ্গে?”
“কেন? তুমি যাতে খুশি হও তাই তো করেছি গো।”
“মানে? কী বলছ তুমি এসব?”
“বা রে, তুমিই বলেছিলে না, আমি হৃদয়হীনা? তাই তো তোমার সবচেয়ে প্রিয় হৃদয়টা দিয়ে নিজেকে সুন্দর করে সাজিয়ে নিলাম, এই দেখো! এবার তো আমাকে সারাজীবন নিজের কাছে রাখবে, বলো?”
হতবাক দ্বৈপায়নের চোখের সামনে তিলোত্তমার পোশাক আলগা হয়, আর সবিস্ময়ে সে তাকিয়ে দেখে, তার বুকের বাম দিকের সূক্ষ্ম পেলব ফাইবার তন্তু ছিন্নভিন্ন করে সেখানে কয়েক ইঞ্চি লম্বা একটা কদর্য সেলাইয়ের দাগ। দ্বৈপায়নের বুঝতে বাকি থাকে না, ওর নিচেই এখন বন্দি রয়েছে তার প্রেমিকা তনুকার রক্তাক্ত বিচ্ছিন্ন হৃদয়, শুধু সেটা আর কোনওদিন ধুকপুক করবে না!
Tags: ষষ্ঠ বর্ষ প্রথম সংখ্যা, সপ্তর্ষি চ্যাটার্জী
দারুণ লেখা। উপস্থাপনা খুব ভাল।
manush er khoti to korbe na robot.tale tanuka ke mere fello kibhabe.sutro gulor mention na korlei hoto,baki behs bhalo
আসলে এখানে ৩য় সূত্রের ফাঁকটাকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলাম। একটি রোবট ‘নিজের অস্তিত্ব রক্ষায়’ সবকিছু করতে পারে যদি না সেগুলি প্রথম দুটি সূত্রের পরিপন্থী হয়৷ এখন প্রথম দুটি সূত্রের মধ্যেও কিছু ফাঁক আছে। যেমন ‘মনুষ্যত্বের ক্ষতির সম্ভাবনা থাকলে তাকে রক্ষা করা থেকে বিরত থাকবে না’ – অনুসারে তিলোত্তমার মনে হয়েছিল তনুকার থেকে তার মালিকের ক্ষতি হতে পারে। এখন এই মনে করাটা প্রোগামিং এর ভুল অথবা তার ইচ্ছাকৃত গলতি, সেটা বলিনি। তনুকার কারণে তিলোত্তমা ক্রমশ মালিকের কাছ থেকে দূরে সরে যাবে, তার অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। অতঃপর…
ওই যে চারটে সূত্র উল্লেখ করেছেন তাতে স্পষ্টই বলা আছে রোবট কোন অবস্থাতেই মানুষের ক্ষতি করতে পারবে না এমনকি তা তার অস্তিত্ব মুছে ফেললেও। যদিও তিলোত্তমাই যে তনুকাকে খুন করেছে তা সরাসরি না বলা থাকলেও এটা স্পষ্ট। আপনার কাছ থেকে এবিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা আশা করছি।
মারাত্মক লাগলো..অনবদ্য লেখা..এরকম লিখুন আরো..অপেক্ষায় থাকবো