শতবর্ষে ‘রোবট’, চেক প্রজাতন্ত্রের শ্রেষ্ঠ উপহার

  • লেখক: জারোস্লাভ ভেইস, ভাষান্তর: দীপ ঘোষ
  • শিল্পী: সুপ্রিয় দাস

আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগে রাশিয়ান-বেলারুশিয়ান বর্ডারের কাছে পেট্রোভিচি (Petrovichi) গ্রামে অ্যাজিমভদের (Azimovs) ইহুদি পরিবারে এক শিশুর জন্ম হয়। বাবা-মা বাচ্চাটির নাম দেন আইজ্যাক। তাঁর সঠিক জন্ম তারিখ জানা যায় না, আন্দাজ করা হয় অক্টোবর ১৯১৯ থেকে ১৯২০ এর শুরুর দিকের মধ্যে তাঁর জন্ম। ১৯২৩ সালের তেসরা ফেব্রুয়ারি, আর এম এস বাল্টিকে চড়ে অ্যাজিমভের পরিবার নব্য সোভিয়েত রাশিয়া ছাড়লেন, গন্তব্য নিউ ইয়র্ক। নতুন দেশে পৌঁছে তারা নিজেদের পদবী পালটে রাখলেন অ্যাসিমভ আর তিন সন্তানের মধ্যে বড় আইজ্যাকের জন্মসাল নথিভুক্ত করলেন দোসরা জানুয়ারি, ১৯২০ বলে। তখন কি আর কেউ ভেবেছিল যে সেই ছোট্ট আইজ্যাক বড় হয়ে বিশ্ববিখ্যাত হবে।

     ওদিকে আইজ্যাকের জন্মের প্রায় একই সময়ে সদ্য প্রতিষ্ঠিত চেকোস্লোভাকিয়ার ক্যারেল চ্যাপেক ছিলেন এক তিরিশ বর্ষীয় উদীয়মান সাহিত্যিক। চ্যাপেক তখন প্রাগের ন্যাশনাল থিয়েটারের জন্যে একটি নতুন নাটক লেখার কথা ভাবছিলেন। নাটকের প্রধান চরিত্ররা হবে ‘কৃত্রিম শ্রমিক’ অথবা ‘জীবন্ত ও বুদ্ধিমান যন্ত্র’। কিন্তু নাম কী দেওয়া যায় এমন যন্ত্রের? প্রথমেই যে নামটা মাথায় এসেছিল তা হল লেবারস (labors)। নামটির উৎপত্তি অবশ্যই ইংরেজির লেবার শব্দটি থেকে যা শব্দতত্ত্ব অনুসারে এসেছিল ল্যাটিন লেবরে (labore) থেকে। ল্যাটিন শব্দটির অর্থ শ্রম, তবে তার সঙ্গে কঠোর শ্রম, ক্লান্তি, কঠোরতা বা কষ্টও বোঝানো হয় এই শব্দটি দিয়ে। কিন্তু, নামটা ঠিক পছন্দ হল না ক্যারেলের। জোসেফ চ্যাপেক ছিলেন সেই সময়ের এক নামী শিল্পী ও ক্যারেলের বড় ভাই, মাঝে মাঝেই লেখালেখি করতেন দুজনে একসঙ্গে। দাদার মতামতকে খুব গুরুত্ব দিতেন ক্যারেল। দাদা ছবি আঁকতে আঁকতে একটা ব্রাশ দাঁতে চেপে বলল, নাম রাখ রোবট— এইভাবেই ঘটনাটার বর্ণনা দিয়েছিলেন ক্যারেল। রোবট কথাটা এসেছিল স্লাভিক ভাষা থেকে, এর অর্থও লেবর শব্দের মতোই, কিন্তু তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল সার্ফডমের ইতিহাস।

     ক্যারেল চ্যাপেক আর ইউ আর (R.U.R) লিখতে শুরু করেছিলেন ১৯২০ সালের প্রথম দিকে। নাটকের নামটি নেওয়া হয়েছিল ‘রোসামস ইউনিভার্সাল রোবটস’ এর অদ্যক্ষর থেকে, যেটি ছিল নাটকে রোবট তৈরির সংস্থা। পরিকল্পনা ছিল বছরের শেষের দিকে নাটকটি প্রাগের ন্যাশনাল থিয়েটারে অভিনীত হবে। সেইমতো ১৯২০ সালের নভেম্বর মাসে নাটকটি প্রকাশিত হয় অ্যাভেনটিনাম থেকে, প্রচ্ছদ করেছিলেন জোসেফ। কিন্তু ন্যাশনাল থিয়েটারে নাটকটির অভিনয়ের দিন পিছিয়ে যাওয়ায়, র‍্যাডেক কারলোভ (Hradec Králové) শহরের একটি অ্যামেচার নাটকের দল সেটি অভিনয়ের পরিকল্পনা করে। এইভাবে প্রাগের ন্যাশনাল থিয়েটারের বদলে এক ছোট্ট অনামা শহরে কিছু শৌখিন অভিনেতা ও এক রেলওয়ে ইন্সপেক্টরের পরিচালনায় দোসরা জানুয়ারি ১৯২১ সালে প্রথম আর ইউ আর অভিনীত হল। এর তিন সপ্তাহ পরে ২৫ জানুয়ারি প্রাগের ন্যাশনাল থিয়েটারে শুরু হবে আর ইউ আর-এর জয়-যাত্রা যা চলবে টানা ছয় বছর, এমনকী কালো বাজারে বিক্রি হবে যার টিকিট।

*  *  *

আসিমভের মতোই, খুব কম বয়সেই চ্যাপেকের রোবট পৌঁছল আমেরিকার মাটিতে। সেদিক থেকে দেখলে ছোট্ট আসিমভেরও চার মাস আগে ৯ অক্টোবর ১৯২২ সালে ব্রডওয়ের গ্যারিক থিয়েটারে ‘থিয়েটার গিল্ড’-এর সৌজন্যে আর ইউ আর-এর আমেরিকান প্রিমিয়ার শো সম্পন্ন হল।

     আর ইউ আর নাটকের উপনামে লেখা ছিল ‘কালেক্টিভ ড্রামা ইন ইন্ট্রোডাকটরি কমেডি অ্যান্ড থ্রি অ্যাক্টস’। নাটকটি আমেরিকাতেও বিখ্যাত হয়ে উঠল সহজেই। এটা হওয়ারই ছিল, আসলে চ্যাপেক নাটকে সেই সময়ের খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেছিলেন— সমাজের উপর যান্ত্রিক সভ্যতার ক্রমবর্ধমান ক্ষতিকর দিক (বিষয়টি চ্যাপেকের আরও অনেক নাটকেই বার বার উঠে এসেছে)। একই সঙ্গে রূপকের মাধ্যমে সমাজকে সাবধান করে দিয়েছিলেন যে যদি তা সুকুমার-বৃত্তি ও মানবতা ভুলে এক যান্ত্রিক নির্দয় ব্যবহারিক পুঁজিপতির হাতের পুতুলে পরিণত হয় তাহলে কী সর্বনাশ হতে পারে।

     তারপর থেকে নাটকটির রূপকল্পের বহুরকম ব্যাখ্যা শোনা গেছে। কেউ বলেছেন চ্যাপেক স্বার্থপর পুঁজিবাদের নির্মম সমালোচনা করেছেন, আবার কেউ বলেছেন, না না ব্যাপারটা ঠিক উলটো, উনি আসলে সাবধান করে গেছেন সমাজ বিপ্লব আর বৈপ্লবিক পরিবর্তনের কুফল নিয়ে। কারও মনে হয়েছে নাটকের মূল চরিত্রগুলি আসলে মানুষ, কেউ বলেছেন উঁহু রোবটদের নিয়েই এই নাটক।

     শতবর্ষের আলোকে হয়তো সময় হয়েছে চ্যাপেকের দৃশ্য-কল্প ও রূপককে আবার ফিরে দেখার। রোসামের ইউনিভার্সাল রোবট কোম্পানি আজকের পাশ্চাত্যের বায়োটেকনোলজি কোম্পানিগুলির সঙ্গে যেন তুলনীয়। একই রকম আকাশচুম্বী উচ্চাশা, অঢেল সম্পদ, সর্বগ্রাসী দুনিয়ার বাজার দখলের তাড়না, এবং সারা পৃথিবীর সমস্ত জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা, এ যেন আজকের গুগল, টেসলা আর অ্যাপেলের মিলিত রূপ! হেলেনা গ্লোরি, নাটকের নায়িকা, আজ যেন আন্তর্জাতিক কোনও মানবাধিকার সেচ্ছাসেবী সংগঠনের কর্মী। রোবটরা হল মানুষেরই হাতে তৈরি বিভিন্ন পণ্য যা ধ্বংস করছে বা করে দিতে পারে শুধু আমাদেরই নয়, সমগ্র পৃথিবীকেই।

     আর ইউ আরের সমালোচনা যে হয়নি তা কিন্তু নয়, তবে অবশ্যই জগৎজোড়া প্রশংসার তোড়ে সেসব অনেকটাই চাপা পড়ে গেছে। বিশেষ করে সমকালীন চেকোস্লোভাকিয়ার বামপন্থী সাংস্কৃতিক আঁভ-গার্দ সংগঠন চ্যাপেকের তীব্র সমালোচনা করেছিল এই বলে যে চ্যাপেক শুধু কিছু জনপ্রিয় বিষয়কে কেন্দ্র করেই উপদেশ দিয়ে গেছেন, নতুন কিছু বলেননি। এমনকি এও বলা হয়েছে যে জনপ্রিয়তা পাওয়ার লোভেই অন্তঃসারশূন্য নাটকটি আন্তর্জাতিক নাট্য-সমাজের দিকে তাকিয়েই রচিত।

     অবশ্যই চ্যাপেকের পরিকল্পনা তা ছিল না। কিন্তু সেটাই হল, যেখানেই আর ইউ আর অভিনীত হল সেখানেই চ্যাপেকের জয়জয়কার ছড়িয়ে পড়ল। ১৯২১ সালে জার্মানির অ্যাকেনে, তার পরের বছর ওয়ারশ, বেলগ্রেড, আর ১৯২৩ সালে নিউ ইয়র্কে নাটকটি অভিনীত হওয়া শুরু হল। সেই বছরই আর ইউ আর পৌঁছে গেল লন্ডন, ভিয়েনা, বার্লিন, জুরিখ এবং তার পরের বছর প্যারিস, বুদাপেস্ট হয়ে টোকিও আর ক্র্যাকও-তে। পরের দশ বছরের মধ্যে নাটকটি অনুদিত হয়েছিল ইউরোপের প্রায় সব ভাষাতেই। বর্তমান সময় এমনকী থাই ও ফিলিপিনো ভাষাতেও অনুদিত হয়েছে আর ইউ আর।

     সমকালীন লেখক, চিন্তাবিদ ও দ্য ওয়ার অব দ্য ওয়ার্ল্ডস সহ অনেক বিখ্যাত কাহিনির রচয়িতা এইচ জি ওয়েলস নাটকটির ভূয়সী প্রশংসা করেন, এমনকি এর জন্যে তিনি নোবেল কমিটির কাছে চ্যাপেকের নাম মনোনয়ন করেন। ১৯৩৮ সালে বিবিসি টেলিভিশনের জন্যে আর ইউ আরকে নাট্যরূপ দেয় আর এটিই ছিল ইতিহাসের প্রথম কল্পবিজ্ঞানের নাটক যা টেলিভিশনে দেখানো হয়েছিল।

     অন্যদিকে শুধু সাংস্কৃতিক জগৎই নয়, বিজ্ঞান ও সামাজিক জীবনেও রোবট শব্দটি ঝড় তুলল। রোবট যদি কোনও মানুষ হত তাহলে সে নিশ্চয়ই আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় একজন বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠত। কিন্তু তার বদলে সে হয়ে উঠল এক সাংস্কৃতিক বিস্ময়, প্রযুক্তি-বিজ্ঞান দ্বারা শাসিত সভ্যতার প্রতীক।

     তবে রোবটের আধ্যাত্মিক জনক ক্যারেল চ্যাপেককেই এই বিজয়যাত্রার জন্যে সমস্ত কৃতিত্ব দেওয়া ঠিক হবে না। সমান কৃতিত্বের অথবা হয়তো তার থেকে বেশির দাবীদার রোবটের দত্তক পিতা, তিরিশ বছরের ছোট আইজ্যাক আসিমভ।

*  *  *

ব্রুকলিনের ক্যান্ডির দোকান মালিকের ছেলেটি কলোম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে জুলজি নিয়ে পড়া শুরু করেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত বায়োকেমিস্ট্রিতে ডিগ্রী নিয়ে ছেলেটি পড়ানো শুরু করল বোস্টন ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিনে। ছেলেটি কিন্তু ছোটবেলা থেকেই কল্পবিজ্ঞান লিখত, এসব ডিগ্রী পাওয়ার অনেক আগে থেকেই, তার মধ্যে অনেকগুলিই প্রশংসিতও হত। মার্চ ১৯৩৯ সালে অ্যামেজিং স্টোরিজ পত্রিকায় তার লেখা প্রথম গল্প প্রকাশিত হল— মেরুনড অব ভেস্তা। সেই বছরেই জুন মাসে সে লিখতে শুরু করল তার প্রথম রোবটের গল্প রোব্বি, যা প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪০ সালে সুপার সায়েন্স স্টোরি পত্রিকায় সেপ্টেম্বর সংখ্যায়। তবে সেই সময়ের সম্পাদক ফ্রেডরিক পোল কিন্তু নামটা পালটে দেন, ছাপা হয় ‘স্ট্রেঞ্জ প্লেফেলো’ নামে। আসিমভ কোনওদিন এই গল্পের নাম পালটানো মেনে নিতে পারেননি।

     কল্পবিজ্ঞান প্রসারের কেন্দ্র চিরকালই আমেরিকা ছিল। ১৯৪০-৫০ সালে আমেরিকার সত্য তরুণ ছেলেপুলেরা, যারা সেই বয়সে লুকিয়ে চুরিয়ে মেয়েদের দিকে তাকায় সবে, তারাই ছিল কল্পবিজ্ঞানের প্রধান পাঠক আর ভক্ত। সেটা ছিল আমেরিকান শতাব্দী, তারা পুজো করত দুই আমেরিকান ইশ্বরকে— রবার্ট এ হাইনলাইন আর আইজ্যাক আসিমভ। তৃতীয় ঈশ্বর ছিলেন সাগরপারের ব্রিটিশ লেখক আর্থার সি ক্লার্ক।

     আসিমভকে কল্পবিজ্ঞানের ইতিহাস মনে রাখবে দুটি বিশেষ উপধারায় তাঁর অসংখ্য বই ও আইডিয়ার অবদানের জন্যে। প্রথমত মহাবিশ্ব-ব্যাপী ইতিহাস ও মহাকাব্য-সম ফাউন্ডেশন সিরিজের জন্যে। আর অন্যদিকে রোবট নিয়ে অসংখ্য ছোটগল্প ও উপন্যাস লিখে গেছেন তিনি। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য পঞ্চাশের দশকের ‘আই, রোবট’ ও অন্যান্য গ্রন্থের অন্তর্গত কয়েক ডজন ছোটগল্প, ‘দ্য স্টিল কেভ’ (১৯৫৪), ‘দ্য নেকেড সান’ (১৯৫৭), রোবটস অব দ্য ডন (১৯৮৩) এবং ‘রোবটস অ্যান্ড এম্পায়ার’ (১৯৮৫) – এই উপন্যাসগুলি বিখ্যাত।

     যে কোনও ধারার আবিষ্কর্তারা যেমন সেটির বেড়ে ওঠার জন্যে প্রয়োজনীয়, ঠিক ততটাই দরকার সেই ধারাকে সঠিক রাস্তা দেখানো ও সর্বদা পুষ্টি জোগানোর মতো মানুষও। আর অ্যাসিমভ ঠিক তাই করেছিলেন। বহুচর্চিত নকল প্রাণ বা জীবন্ত যন্ত্রের (হোমানকুলি, অ্যান্ড্রোয়েড, অটোমেটন) সঙ্গে চ্যাপেকের রোবটই শুধু নয়, বিজ্ঞানসম্মতভাবে রোবটিক্সের তথ্য আর ব্যাখ্যাও তিনি জুড়ে দিলেন। এবার নিজের তৈরি জগতে আইনবিদ নয়, বরং প্রাণীবিজ্ঞানীর প্রজ্ঞায় তিনি জুড়ে দিলেন তিনটি অলঙ্ঘনীয় নিয়ম যা মেনে সেই জগতের মানুষের পাশাপাশি থাকবে রোবটরা।

     ক) রোবট কোনও মানুষের ক্ষতিসাধন করতে পারবে না অথবা নিষ্ক্রিয় থেকে কোনও মানুষের ক্ষতির কারণ হতে পারবে না।

     খ) রোবট সবসময় মানুষের কথা শুনে চলবে, যদি না সেই নির্দেশের জন্যে প্রথম নিয়ম ভঙ্গ হবার কোনও সম্ভাবনা তৈরি হয়।

     গ) রোবট সর্বদা নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করার চেষ্টা করবে, যদি না সেই চেষ্টার জন্যে প্রথম ও দ্বিতীয় নিয়ম ভঙ্গ হবার সম্ভাবনা তৈরি  হয়।

     এই নিয়মগুলো তৈরি করে আসিমভ কিন্তু তাঁর জগতের সবথেকে প্রাথমিক পদক্ষেপটা দৃঢ় করলেন, রোবটের থেকে আর ভয় পাওয়ার কিছু রইল না মানুষের, রোবট হয়ে উঠল মানুষের রক্ষাকর্তা, ভৃত্য এবং বন্ধুও। রাজনৈতিক ভাষার বলতে হয় অ্যাসিমভ রোবটকে মানুষের মুখোশ পরিয়ে দিলেন। কিন্তু বহু বছরের সমাজতান্ত্রিক অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখেছি আসিমভের কাজটির গুরুত্ব অবশ্যই আছে, তবে তা নেহাতই সাময়িক আর নিষ্ফল। টার্মিনেটর সিরিজের সিনেমাগুলি আমাদের সেই শিক্ষাই দেয়।

     এবং এই কারণেই আজকের দিনেও অ্যাসিমভের নিয়মগুলি সমান প্রাসঙ্গিক। তাদের পালটানো হয়েছে কখনও, কখনও আরও বিস্তৃত করা হয়েছে, আর তা শুধু গল্পের জগতেই নয়, আমাদের ক্রমবর্ধমান বুদ্ধিমান যন্ত্রের দুনিয়াতেও। বুদ্ধিমান যন্ত্র এসে গেছে যুদ্ধের মহড়ায়, কলকারখানায়, হাসপাতালের অপারেশনের টেবিলে, এমনকি বাড়ির রান্নাঘরেও। আমাদের সৌভাগ্য এখনও পর্যন্ত তারা যন্ত্রই। এখনও তারা রোবটদের মতো আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গী হয়ে ওঠেনি— চ্যাপেকের প্রাইমাস আর হেলেনা, অথবা অ্যাসিমভের রোব্বি বা ড্যানিয়েল ওলিভাওয়ের মতো।

*  *  *

অ্যাসিমভ তাঁর পপুলার সায়েন্সের বইগুলিতে কিন্তু বহুবার রোবটের চেক উৎস আর চ্যাপেকের কথা উল্লেখ করেছেন, তবে নাটকটি কিন্তু তাঁকে সেইভাবে প্রভাবিত বা আগ্রহী করতে পারেনি।

     আমি যখন ১৯৮৮ সালে নিউইয়র্ক সেন্ট্রাল পার্কে তাঁর বহুতলের ফ্ল্যাটে তাঁর মুখোমুখি হয়েছিলাম, তখন আমি তাঁকে এই প্রশ্নটাই জিজ্ঞাসা করেছিলাম। আসিমভ শান্ত স্বরে বলেছিলেন— হ্যাঁ, আমি নাটকটা পড়েছি, কিন্তু আমার লেখার মধ্যে এই নাটকের কোনও ছাপ তুমি পাবে না। অ্যাসিমভের মতে নাটকের পরিকল্পনাটা খারাপ নয়, কিন্তু নাটকের মধ্যে মূল দ্বন্দ্ব আর বিষয়টা আসলে রোবটদের নিয়ে নয়। অন্তত অ্যাসিমভ নিজে মনে করেননি রোবটরা নাটকে তাঁকে আগ্রহী করার মতো অপরিহার্য ছিল।

     চ্যাপেক এই কথা শুনলে কী বলতেন তা আর আজ বলা সম্ভব নয়। হয়তো তিনি এর উত্তর দেওয়া প্রয়োজনীয়তাই অনুভব করতেন না। হাজার হলেও চ্যাপেক আর অ্যাসিমভের মধ্যে দূরত্ব শুধু কয়েক প্রজন্মেরই না, সাংস্কৃতিক ধ্যানধারণা এবং দৃষ্টিভঙ্গিও ছিল তাঁদের আলাদা।

     স্লোভানিক ভাষা ও সাহিত্য গবেষক প্রফেসর উইলিয়াম ই হারকিনস বলেছেন, এই নাটকটি চ্যাপেকের সবথেকে অপছন্দের ছিল। তাঁর মতে চ্যাপেকের আর ইউ আরের প্রতি এই অবহেলার সবথেকে বড় নিদর্শন তাঁর খবরের কাগজের সাক্ষাৎকারটি, যেখানে চ্যাপেক বলেছেন এই নাটকটি যে কেউই লিখতে পারত।

     হয়তো সত্যিই এই নাটক যে কেউই লিখতে পারত, কিন্তু দিনের শেষে নাটকটি এসেছিল তাঁর কলমে। আমরা চিরকৃতজ্ঞ থাকব সেই কলমের কাছে যে একশো বছর আগে, প্রাগে সবথেকে বিখ্যাত চেক চরিত্রটির জন্ম দেয়। নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করে নিউ ইয়র্কের অ্যাসিমভ তাকে ছড়িয়ে দিলেন পৃথিবীর কোণে কোণে, সৃষ্টি হয়েছিল এক অধুনা উপকথার। আর আজকে প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতি সেই উপকথাকে বাস্তবের মাটিতে এনে ফেলেছে।

লেখক: জারোস্লাভ ভেইস একজন চেক সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক এবং রাজনৈতিক ও মিডিয়া পরামর্শদাতা। তিনি নিজে বেশ কিছু কল্পবিজ্ঞানের গল্প ও উপন্যাস লেখা ছাড়াও অনেক ব্রিটিশ ও আমেরিকান লেখকের কাহিনির অনুবাদ করেছেন। জারোস্লাভ ১৯৯৪ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের নেইম্যান ফেলো হিসেবে নিযুক্ত হন। তিনি বহু বছর চেক রাষ্ট্র-সভার রাষ্ট্রপতির প্রধান পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেছেন। এখন তিনি প্রাগ নিবাসী।

Tags: জারোস্লাভ ভেইস, দীপ ঘোষ, প্রচ্ছদ কাহিনি, ষষ্ঠ বর্ষ প্রথম সংখ্যা, সুপ্রিয় দাস

Leave a Reply

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!