রোজামের যন্ত্রদাস
লেখক: সন্দীপন গঙ্গোপাধ্যায়
শিল্পী: রনিন
Domin: (Smile) Now, the thing was how to get the life out of the test tubes, and hasten development and form organs, bones and nerves, and so on, and find such substances as catalytics, enzymes, hormones in short – you understand?
Helena: Not much, I’m afraid.
Domin: Never mind. (Leans over couch and fixes cushion for her back) There! You see with the help of his tinctures he could make whatever he wanted. He could have produced a Medusa with the brain of Socrates or a worm fifty yards long— (She laughs. He does also; leans closer on couch, then straightens up again) —but being without a grain of humor, he took into his head to make a vertebrate or perhaps a man. This artificial living matter of his had a raging thirst for life. It didn’t mind being sown or mixed together. That couldn’t be done with natural albumen. And that’s how he set about it.
Helena: About what?
Domin: About imitating Nature. First of all he tried making an artificial dog. That took him several years and resulted in a sort of stunted calf which died in a few days. I’ll show it to you in the museum. And then old Rossum started on the manufacture of man.
Helena: And I’m to divulge this to nobody?
Domin: To nobody in the world.
— R. U. R. (ROSSUM’S UNIVERSAL ROBOTS), Act One, By Karel Capek,
[English translation by Paul Selver and Nigel Playfair]
মধ্যযুগের প্রথমার্ধে ফিউডাল ইয়োরোপের অর্থনীতিতে ‘সার্ফডম’ নামে এক ধরনের ভূমিদাসত্বের প্রচলন হয়। এর অধীন সার্ফদের ভবিতব্যই ছিল সারাজীবন মালিকের জমিতে বেগার খেটে যাওয়া। পরবর্তীকালে সার্ফরা অবশ্য শর্তসাপেক্ষে কিছু কিছু ক্ষমতা লাভ করেছিল। দেশভেদে এই শ্রেণি বিভিন্ন নামে পরিচিতি পায়। যেমন ইংল্যান্ডে ভিলেইন, কোটার বা কোটিয়ার; রাশিয়ায় খলপ প্রভৃতি। চেক – স্লোভাগ ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্গত পশ্চিম শ্লাভিক ভাষায় এই ধরনের দাস প্রথার অনুষঙ্গে প্রাচীন একটা প্রচলিত শব্দ ছিল ‘রোবোটা’, যার অর্থ বাধ্যতামূলক শ্রমিক। এই শব্দের উৎস লুকিয়ে আরও প্রাচীন ‘র্যাব’ শব্দের মধ্যে, যার মানেও ছিল দাস।
ফ্যান্টোমাস শিরোনামে কিউবিস্ট পর্বে য়োসেফ ক্যাপেকের আঁকা এক বিখ্যাত ছবি (১৯১৮)
১৯২০ – ১৯২১ সাল নাগাদ য়োসেফ চ্যাপেক নামে প্রাথমিকভাবে কিউবিস্ট ঘরানার একজন চেক চিত্রশিল্পী এবং কবি তাঁর ভাই ক্যারলের লেখা এক নতুন নাটকের মধ্যে এই প্রাচীন চেক শব্দের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ ‘রোবটি’ শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটান যা ইংরেজি অনুবাদে ‘রোবট’ শব্দের রূপ নেয়। এই নাটকের নাম দেয়া হয় ‘RUR’ যা ছিল চেক ভাষায় Rossumovi Univerzální Roboti বা ইংরেজিতে Rossum’s Universal Robots এর একটি শব্দসংক্ষেপ বা অ্যাক্রোনিম। অনেক বিশেষজ্ঞ এও দাবি করেছেন যে এই নাটকের শিরোনামে ব্যবহৃত ‘রোজাম’ শব্দ আসলে ‘রিজন’ বা যুক্তিবোধ থেকে উঠে আসা। পিটার মাহের এবং ক্যাথি পোর্টারের অনুবাদে তো সরাসরি রিজন শব্দই ব্যবহার করা হয়েছিল এই প্রেক্ষিতকে তুলে ধরার জন্য। তবে কি যুক্তিজালে আবদ্ধ কৃত্রিম দাসত্বের নান্দীমুখকেই তুলে ধরে এই শব্দ? নাটকের আখ্যানে আগামী পৃথিবীতে সমাজের চালিকাশক্তি হিসেবে যন্ত্রদাসের প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরতা এবং সেই যন্ত্রদাসদের বিদ্রোহের ফলে শেষে মানব প্রজাতির প্রায় ধ্বংসের একটা রেখাচিত্র তুলে ধরা হয়েছিল। তবে ক্যারল চ্যাপেকের এই নাটকে রোবটের যে সামগ্রিক অবয়ব প্রকাশ পেয়েছে তা ঠিক মেকানিক্যাল ম্যান, অটোমেটন বা অ্যান্ড্রয়েড নয়, যে ধারণা আরো অনেক আগে থেকেই ছিল। এখানে দেখানো রোবটেরা আসলে মানবদেহের কোষ-কলা-অঙ্গ-তন্ত্রের বিন্যাস থেকেই নির্মিত । কিছুটা রি-অ্যানিমেশনের থিম বা জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এর একটা আদিম ঝলক যেন দেখতে পাই এই রোবটের নির্মানের বর্ণনায়।
যবনিকা ভেদ করে এই নাটকের গর্ভাঙ্কে প্রবেশ করবার আগে ওই সময়ের অলিন্দ নিলয়ের সাক্ষরটা একবার দেখে নেওয়া যাক, যে বীক্ষা আমাদের সাহায্য করতে পারে রোবটের ধারণার যৌক্তিক কাঠামো এবং দর্শনকে এই শতবর্ষের পথচলা পেরিয়েও অনুধাবন করতে। বিশেষ করে এই একবিংশ শতাব্দীর দু-শতক পেরিয়ে যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে অনেকে সভ্যতার আগামী চালিকাশক্তি বলে ভেবে নিয়েছেন তখন এই ফিরে দেখাটা সময়ের দাবী।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের রণাঙ্গনে মানুষের গণ জিঘাংসার উগ্র স্বরূপ প্রকাশিত হবার পর স্বাভাবিকভাবেই পৃথিবী আর আগের মতো রয়ে যায়নি। মানবসভ্যতা বিশেষ করে আমাদের অস্তিত্বের ধারণাগত কিছু দর্শন আমূল বদলে যায়। জার্মান এক্সপ্রেশনিজম নামে এক ধরনের দার্শনিক মতবাদ এই সময়ের সামান্য কিছু আগে থেকেই ইউরোপীয় মননে আসন পাতলেও যুদ্ধ পরবর্তী সমাজ রাজনীতির হতশ্রী চেহারা বিশেষত ওয়াইমার রিপাবলিকের অন্দরে যুযুধান রাজনৈতিক শক্তিগুলো যে ভয়ঙ্কর গৃহযুদ্ধের পরিবেশ তৈরি করেছিল তার এক বিকৃত রূপ প্রকাশিত হয় এর মধ্যে দিয়ে। এর দু-এক বছর আগেই ১৯১৭ সালে অবশ্য মানুষের ইতিহাসে সমাজবিজ্ঞানের অন্যতম বড় পরীক্ষাটা হয়ে গেছে বলশেভিক বিদ্রোহের মধ্যে দিয়ে, যদিও শ্বেত আর লাল ফৌজের ধুন্ধুমার সংগ্রামের ওই প্রহরে এই পরীক্ষার চূড়ান্ত ফলটা জানা বাকি। ১৯১৮ সাল নাগাদ যুক্তি এবং বৌদ্ধিক পারম্পর্য্য নিয়ে পাশ্চাত্য দর্শনের আঙিনায় বিংশ শতাব্দীর এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা গ্রন্থ ট্রাকটাটুস লজিকো-ফিলসফিকাস প্রকাশিত হয়, যার লেখক ছিলেন প্রখ্যাত অস্ট্রিয়ান-ব্রিটিশ দার্শনিক ল্যুডউইগ ভিটগেনস্টাইন। পরবর্তীকালে অ্যালান ট্যুরিং এর প্রস্তাবিত ট্যুরিং টেস্ট এর মধ্যে দিয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং রোবটিক্সের যে যৌক্তিক ভিত্তির নীলনকশা লেখা হয়েছিল তারও আগে অক্সিডেন্ট দর্শন এবং ভাষাতত্ত্বের ভিত্তিভূমি থেকে ওই একই প্রশ্নগুলো রেখেছিলেন ভিটগেনস্টাইন। এই জগৎ সম্পর্কে আমাদের বোধের ছবিটা আমরা অন্যকে বোঝাতে পারি কেমনভাবে বা এই প্রশ্নকেই আরও বিস্তার করলে বলা যায় ভাষার মধ্যে দিয়ে যেভাবে আমরা পরস্পরের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করি ঠিক তেমনভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিধর যন্ত্রকে কি আমরা নির্দেশ জানাতে পারি? এই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে পরবর্তীকালে আবিষ্কৃত কম্পিউটার প্রোগ্রামিং ল্যাঙ্গোয়েজ এর সিনট্যাক্স বা গঠনের মধ্যে দিয়ে যা একদিক থেকে রোবটিক্স এর সঙ্গেও ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
ক্যারেল চ্যাপেক (১৮৯০-১৯৩৮)
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে, মুক্তবুদ্ধি চর্চার এই পটভূমিকাতেই গড়ে উঠেছিলেন ক্যারেল চ্যাপেক। চেক ইন্টেলেকচ্যুয়াল মহলের গুরুত্বপূর্ণ বৃত্তে তার অবাধ বিচরণ ছিল। ওই সময় দাদা য়োসেফের সঙ্গে জাতীয় সংবাদপত্র ‘নারোদনি লিস্টি’ এর সম্পাদকীয় দপ্তরও সামলাতে হয় তাঁকে। প্রাথমিকভাবে য়োসেফের সঙ্গে মিলিতভাবে ছোটগল্প এবং নাটক লেখায় হাত পাকাচ্ছিলেন তিনি এইসময়। তাঁর ওই সময়কার লেখালেখির মধ্যে স্বৈরাচার বিরোধী একটা চিন্তা দানা বাঁধছিল যা পরবর্তীকালে ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট (পরে নাৎসি) এবং ফ্যাসিস্টদের বিরূদ্ধে নানা রচনায় প্রকাশ পায়, এমনকি মত প্রকাশের অধিকার রূদ্ধ হওয়ায় তিনি বলশেভিক মতবাদের বিরূদ্ধেও ছেড়ে কথা বলেননি। ‘আর ইউ আর’ নাটকের প্রেক্ষিতের মধ্যে এই পুরো আবহটা ধরা পড়েছিল।
তিন অঙ্কে বিভক্ত এই নাটকের প্রাণকেন্দ্রে আছেন রোজাম নামে এক বিজ্ঞানী, মেরিন বায়োলজি সংক্রান্ত গবেষণায় জড়িত থেকে যিনি এক বিশেষ ধরনের জৈব রাসায়নিক যৌগ আবিষ্কার করে বসেন যার বৈশিষ্ট্য ছিল প্রোটোপ্লাজম এর মতো, অর্থাৎ সজীব কোষের গঠনগত এবং কার্যকরী নানা দিকের সঙ্গে এর মিল ছিল। রোজাম ঠিক করেন এই যৌগের সাহায্যে মনুষ্যেতর কোনও প্রাণীর আদল বানাবেন যা প্রমাণ করবে ঈশ্বরের অনস্তিত্বকে, কিন্তু রোজামের ভাইপো তার কাকার বিরূদ্ধে গিয়ে মানুষের মতো এক আদল বানাতে চান এই গবেষণার মধ্যে দিয়ে যা তার বাণিজ্যিক স্বার্থ মেটাবে। এমনকি মতের বিরোধিতা করার জন্য তিনি তার কাকাকে ওই দ্বীপের মধ্যে আটকে রাখেন। এরপর কেটে যায় অনেকগুলো বছর। খ্রিস্টীয় ২০০০ সনে রোজামের ওই কারখানা সারা পৃথিবীতে কৃত্রিম মানুষ বা রোবট সরবরাহ করে চলেছে ততদিন। রোবট ততদিনে হয়ে উঠেছে উৎপাদন নির্ভর মুক্ত বাজারের এক অন্যতম চালিকাশক্তি। কিন্তু এখানেই মানবিক মূল্যবোধ, মানবাধিকার সংক্রান্ত কিছু প্রাথমিক দ্বন্দ্বের মুখোমুখি হই আমরা। রোবট নির্ভর অর্থনীতির ওই ক্ষণে ‘লীগ অব হিউম্যানিটি’ এর প্রতিনিধি হেলেনা নামে এক চরিত্র দাবী জানায় রোবটের জন্যেও সেই সমস্ত অধিকারের জন্য যা মানব কর্মীদের জন্য স্বীকৃত। যদিও হেলেনা তাঁর দাবীর জন্য রোবট উৎপাদন ফ্যাক্টরির কর্তৃপক্ষের কাছে হাস্যাস্পদ হলেন কিন্তু তাঁর এই প্রশ্নটা খুব গুরুত্বপূর্ণভাবে দেখা দেয় ভবিষ্যতে। এর দশ বছর পরের কথা, মানুষের প্রজনন হার অনেকটা কমে এসেছে তখন। মানব সভ্যতার বিরূদ্ধে যন্ত্রদাসেরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে, যে বিদ্রোহের আঁচ চলে এসেছে রোজামের দ্বীপেও। মানবসভ্যতার অস্তিত্বের কাছেই রোবটেরা বিপদ সংকেত জানাচ্ছে তখন। এইসময় কৌশল করে হেলেনা নষ্ট করে ফেলেন রোবট তৈরি করার সেই ফর্মূলা। এ সত্ত্বেও যন্ত্রের সঙ্গে এই যুদ্ধে শেষ হয়ে যায় মানুষের অস্তিত্ব, রোবটেরা কেবল বাঁচিয়ে রাখে অ্যালকুইস্ট নামে রোবট তৈরির কারখানার একজন মূল প্রযুক্তিবিদকে। অ্যালকুইস্ট এর উদ্যোগে রোবটদের শরীর আবার ব্যবচ্ছেদ হতে শুরু করে সেই হারানো সূত্র খোঁজার জন্য। নাটকের একেবারে শেষে অ্যালকুইস্ট এর বোধোদয় হয় এই জেনে যে প্রাইমাস আর হেলেনা নামে দুই রোবটই আগামী সভ্যতার আদম এবং ইভ। এদের মধ্যে মানুষের চেতনা এবং বোধের অনেকটা দানা বেঁধেছে ততদিনে।
‘আর ইউ আর’ নাটকের এক দৃশ্য
১৯২০ সালে প্রকাশিত হওয়ার পরে এই নাটক প্রথমবার প্রাগের জাতীয় থিয়েটারে মঞ্চস্থ হয় ১৯২১ সালের ২৫ জানুয়ারি নাগাদ। যদিও একটি শখের নাট্যদল এর আগেও ছোটখাটো একটা প্রযোজনা করেছিল। পল সেলভার এর অনুবাদে এই নাটকের ইংরেজি অনুবাদের প্রথম প্রযোজনা হয় ১৯২৩ নাগাদ। তার আগেই অবশ্য নিউ ইয়র্ক শহরের গ্যারিক থিয়েটারে এর মঞ্চাভিনয়ের সূত্রপাত হয়ে গেছিল। অন্যান্য মাধ্যমেও সমাদৃত হয় এই নাটক। প্রখ্যাত অস্ট্রিয়ান-জার্মান পরিচালক ফ্রিৎজ ল্যাং পরিচালিত আইকনিক জার্মান এক্সপ্রেশনিস্ট সায়েন্স ফিকশন ছায়াছবি মেট্রোপলিশ (১৯২৭) এর গল্পে মারিয়া চরিত্রের কৃত্রিমভাবে নির্মিত সত্তার মধ্যে ক্যারেল চ্যাপেকের রোবটের বর্ণনার একটা ছায়া দেখা যায়। ১৯৩৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সোভিয়েত ছায়াছবি ‘লস অফ সেনসেশন’ আদতে ১৯২৯ সালে প্রকাশিত ‘আয়রন রায়ট’ নামের উপন্যাস আধারিত হলেও এর নির্মানের অনেকটা জুড়ে ছিল আর ইউ আর। এমনকি ছবিতে দেখানো রোবটের গায়েও এই ‘আর ইউ আর’ তকমা ছিল। টেলিভিশনের একেবারে আদিযুগে ১৯৩৮ সালে বিবিসি টেলিভিশনে এই নাটকের একটি সংক্ষিপ্ত রূপ প্রদর্শিত হয়।
১৯৩৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সোভিয়েত ছায়াছবি ‘লস অফ সেনসেশন’ এর এক গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য
ব্রিটেনে খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল এই নাটক। পপুলার জনমানসে এই পরিচিতিকে কাজে লাগিয়ে ১৯২৮ সালে সেদেশে এরিক নামে বাণিজ্যিকভাবে প্রদর্শিত এক রোবটের গায়ে ‘আর ইউ আর’ এমব্লেম ছাপা ছিল।
যদিও মেধাজীবী মহলে এই নাটকের একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয়। ‘আর ইউ আর’ নাটকে রোবটের বর্ণনার মধ্যে দিয়ে মানবসভ্যতার যে ছবি তুলে ধরা হয়েছিল তা পরবর্তীকালে প্রকাশিত আইজ্যাক অ্যাসিমভের লেখা রোবটিক্স এর প্রাথমিক তিনটে সূত্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে ব্যাস্তানুপাতিক। চ্যাপেকের বয়ানে মানবসভ্যতার এই বিরোধাভাসের সমীকরণ আসিমভ পছন্দ করেননি। অনেক বিশেষজ্ঞ পরবর্তীকালে এমনকি এই দাবীও করেছেন যে আসিমভ এর সূত্রগুলো আসলে এই নাটকে বয়ান করা ঘটনা যাতে বাস্তবে না ঘটে সেই উদ্দেশ্যেই লেখা হয়। ১৯৪২ সালে প্রখ্যাত সম্পাদক জন ক্যাম্পবেলের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘অ্যাস্টাউন্ডিং সায়েন্স ফিকশন’ পত্রিকার মার্চ সংখ্যায় আইজ্যাক আসিমভের লেখা রানঅ্যারাউন্ড গল্পে প্রাথমিক এই সূত্রগুলো দেখা যায়, পরে যা ‘আই, রোবট’ সংকলনের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল। সংক্ষেপে এই সূত্রগুলোর বক্তব্য হল:
(১) রোবট কোনও মানুষের ক্ষতি করবে না, বা নিষ্ক্রিয় ভূমিকা নিয়ে কোনও মানুষের ক্ষতি ডেকে আনবে না।
(২) রোবট মানুষের আদেশ পালন করতে বাধ্য থাকবে, যদি না তা প্রথম সূত্রের বিরোধিতা করে।
(৩) রোবট আত্মরক্ষা করবে, যতক্ষণ না তার এই আত্মরক্ষার চেষ্টা প্রথম অথবা দ্বিতীয় সূত্রের বিরোধিতা করে।
এই গল্প বিশেষ করে এই প্রাথমিক সূত্রগুলোর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংক্রান্ত অন্যতম শ্রেষ্ঠ গবেষক মারভিন মিনস্কি তাঁর গবেষণার বিষয় নির্বাচনের জন্য এই গল্পের ঋণ স্বীকার করেছেন অকুন্ঠভাবে। পরে ‘দ্য এভিটেবল কনফ্লিক্ট’ শিরোনামে ওই একই পত্রিকায় প্রকাশিত এবং এই একই সংকলনের অন্তর্ভুক্ত আর একটা গল্পের মধ্যে এই প্রাথমিক সূত্রের সীমা প্রসারিত হয়, রোবটের ভূমিকা নেয় মেশিন বা যন্ত্র। আরও পরে অ্যাসিমভের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তি ফাউন্ডেশন সিরিজের ‘ফাউন্ডেশন অ্যান্ড আর্থ’ উপন্যাসের শেষে যোগ হয় আরেকটা সূত্র যার ক্রমিক শূন্য। নতুন এই সূত্রের প্রেক্ষিতে আগের সূত্রগুলোও একটা পূর্ণাঙ্গ চেহারা নেয়। এই শূন্য অংকের সূত্রের বয়ানটা একবার শুনে নেওয়া যাক।
(০) রোবট মানব প্রজাতির কোন ক্ষতি করবে না, অথবা নিষ্ক্রিয় ভূমিকা নিয়ে সামগ্রিক মনুষ্যত্বের ক্ষতি ডেকে আনবে না।
প্রাথমিক সূত্রগুলোর কিছু যৌক্তিক অসম্পূর্ণতা অনেকটাই দূর হয় এই বয়ানে। রোবট হয়ে দাঁড়ায় একক ব্যক্তির বদলে সামগ্রিক মানব প্রজাতির বেনিফ্যাক্টর বা হিতকারী।
অ্যাসিমভের রোবটের সূত্রের আবহে রোবটিক্স নিয়ে আরও কিছু সূত্রের প্রচলন হয়েছে পরবর্তীকালে। ‘আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ গবেষণা নির্ভর আধুনিক প্রযুক্তি শিল্পের পরিভাষায় একে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে। এর মধ্যে আধুনিক রোবটিক্স এর গুরুত্বপূর্ণ একজন গবেষক মার্ক টিল্ডেন এর সূত্রগুলো প্রণিধানযোগ্য।
(১) রোবট সবসময় তার নিজের অস্তিত্ব রক্ষায় সচেষ্ট হবে।
(২) রোবট তার অস্তিত্বের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির উৎসকে তার নিজের নিয়ন্ত্রণাধীনে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাবে।
(৩) রোবট তার প্রয়োজনীয় শক্তির জন্য আরও ভালো উৎসের সন্ধান করে যাবে।
এই বয়ানগুলো কিন্তু অ্যাসিমভের সূত্রের থেকে বেশ কিছুটা বিপ্রতীপ ভূমিকায় চলে যায়। তার মানে দাঁড়াল যে, একবিংশ শতাব্দীর এই নতুন দশকের প্রাক্কালে তার একশো বছরের পথচলা শেষ করেও ক্যারেলের চ্যাপেকের ‘আর ইউ আর’ নাটক আজও কিছু প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে মানবসভ্যতাকে। চ্যাপেকের নাটকে যান্ত্রিক দ্বান্দ্বিকতার সঙ্গে সভ্যতার বিকাশের মিথোস্ক্রিয়ায় একটা নিকষ কালো সম্ভাব্য পরিণতির ছবি উঠে এসেছিল। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে সভ্যতার নিয়ামক ভেবে যাওয়া এই সময়ে দাঁড়িয়ে সেই দ্বন্দ্বগুলো যেন আজও আরও বেশি সত্যি এখন। মুক্ত বাণিজ্যের দোর খুলে গেছে, আমাদের সেই শীতাতপ বাজার যাপনে রোবটেরা কি অল্টার ইগো হয়ে দেখা দেবে আজ মানব অস্তিত্বের দোরে?
Tags: প্রচ্ছদ কাহিনি, প্রবন্ধ, রনিন, ষষ্ঠ বর্ষ প্রথম সংখ্যা, সন্দীপন গঙ্গোপাধ্যায়
কী চমৎকার একটি লেখা সন্দীপন গঙ্গোপাধ্যায়ের। তাঁর জ্ঞান ও ভাষার মুন্সীয়ানায় নির্মিত ধীশক্তির পেছনের জটিল দর্শন ও দ্বন্দ্ব উন্মোচিত হয়েছে স্বচ্ছতায়। উনি বলেছেন চ্যাপেকের নাটকটি আজও প্রাসঙ্গিক, খুবই সত্য। তবে এই মুক্ত বাণিজ্যের বাজারেও কিছু নিয়ম নীতি কার্যকর রয়েছে – মানব ক্লোনিং মনে হয় না নিকট ভবিষ্যতে অনুমোদিত হবে। অন্যদিকে রোবোটের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানব জীবনের কিছু শ্রম লাঘব করলেও বৃহত্তর সমস্যায় একেবারেই fail করেছে, সেটা বর্তমান ভাইরাস দুর্যোগেই বোঝা যাচ্ছে। আমরা ডিজিটাল সমাজ তৈরি করতে পারি, কিন্তু যতক্ষণ না আমরা জীববিদ্যায় জয়ী হচ্ছি ডিজিটাল যুগ আমাদের সাহায্য করতে পারবে না। ন্যানোবট দিয়ে শরীর ঠিক রাখার চিন্তা খুব ভাল আইডিয়া এবং কিছু ক্ষেত্রে কার্যকরী, কিন্তু সমাজের সামগ্রিক স্বাস্থ্য বজায় না রাখলে সেটি সফলতা পাবে না। সন্দীপন গ.কে অনেক ধন্যবাদ লেখাটির জন্য, আমার জ্ঞানের পরিধি বাড়ানোর জন্য।