অপারেশন ডার্ক গডেস

  • লেখক: দীপ ঘোষ
  • শিল্পী: দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য (চিত্রচোর)

র‍্যাক্সরের ছোঁড়া লাল রঙের লেসার নাইফটা যখন বাতাস কেটে আমার দু পায়ের মাঝ দিয়ে চেয়ারটার সাথে গেঁথে গেলো, সত্যি বলছি ভেনাস-৯-এর অ্যান্ড্রয়েড নর্তকীর মুখটাই মনে পড়ে গেল। আর বোধহয় দেখাই হবে না ভেনাসের প্রাসাদ প্রতিম ড্যান্স বার আর ভার্চুয়াল ডেটিং এরেনাগুলো! লোকে বলে মরণকালে নাকি প্রিয়জনদের মুখ মনে পড়ে! অতএব বুঝতেই পারছেন, আমার জীবনে ওই বস্তুটির যথেষ্ট অভাব আছে। দেখেছেন, নিজের পরিচয় না দিয়েই নিজের সম্পর্কে বকবক শুরু করেছি। ডি-২৩-ওয়াই, মানে আমার ভেনাসের অ্যান্ড্রয়েড বান্ধবীও বলে এক কথা, আমি নাকি বড্ড বাজে বকি। আর দু পাত্তর পেটে পড়লে তো আর কথাই নেই! যাকগে আমার নাম প্রদীপ্ত বাসু, আকাশগঙ্গা শিপিং কর্পোরেশনের ফ্লাইট ন্যাভিগেটর। নামটা গালভরা হলেও ভাববেন না যে আমরা বিরাট কিছু কোম্পানি। এই সল সৌরজগতের মধ্যেই আমাদের ব্যাবসা আর হাতে সাকুল্যে একটাই আয়ন ড্রাইভ লাগানো রকেট। নাম যদিও এস এস সপ্তপদী, যার সাতটা ল্যান্ডিং গিয়ারের মধ্যে একটা আবার ভাঙা, আমরা আদর করে ডাকি ভটভটি বলে।

     এই যাহ্‌ আবার কোথায় চলে গেলাম কোথা থেকে। দাঁড়ান একেবারে প্রথম থেকে শুরু করি, ততক্ষণ র‍্যাক্সর ব্যাটা বিশ্রাম নিক একটু। আকাশগঙ্গা, মানে আমাদের কোম্পানিটা চালান রিটায়ার্ড কর্নেল সুশান্ত দাস। নাম সুশান্ত হলে কি হবে মানুষটা খুব রাশভরি, বয়স যে সত্তরের উপর হয়েছে তা দেখলে মোটেও মনে হয়না। আর হবেই বা কি করে, বুড়োর শরীরে ক’টা অগমেন্টেড কিট বসানো আছে কে জানে! এখনো আমাদের তিনগুন খাটতে পারে আর সেরকমই পিছনে লেগে থাকে আমাদের। তিনকুলে কেউ নেই কর্নেলের, কোম্পানিটা আর আমরা, মানে কর্মচারিরাই বুড়োর সবকিছু। আমরা মানে আমি, পাইলট জিত চক্কোত্তি, মেডিক্যাল অফিসার বিষ্ণু সরকার আর আমাদের ফার্স্ট মেট কাম রাধুনে কাম হিসাবরক্ষক সাধন দে।

     আমাদের অফিস নিউ কলকাতার সেক্টর পাঁচশো এগারোতে। এরকম বনেদী পাড়াতে কর্নেল অফিসটা বাগালেন কী করে সে এক বিস্ময়! একবার জিত আমায় বলেছিল কর্নেলরা নাকি বনেদী বাঙালি, ওর পূর্বপুরুষ সেই চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে ইন্ডাসে আছে। যা টাকাকড়ি আছে তাতে বুড়োর কিছু না করলেও চলতো। কিন্তু আর্মি থেকে রিটায়ার্ড হবার পরেই খুলে বসলো শিপিং কোম্পানি। আর্মি থেকেই তুলে আনল আমাদের সবাইকে, বুড়োর হুকুমে বছরের পর বছর আর্মি ফ্রিগেটে কাটিয়েছি, তাই মনে মনে যতই গালমন্দ করি না কেন, কর্নেলের মুখের কথায় যেকোন বিপদের মুখে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি আমরা।

     আকাশগঙ্গা কিন্তু আর পাঁচটা শিপিং কোম্পানির মত নয়। আমরা সেই কাজগুলোই করি, যেগুলো অন্যেরা করার সাহস পায় না বা হেসেই উড়িয়ে দেয়। যেমন গতবছরে গ্যানিমিদের সমুদ্র থেকে যে বিলুপ্তপ্রায় তিন মাথাওয়ালা হাঙ্গরটা চুরি গেছে, সেটা কী করে বিখ্যাত ব্যাবসায়ী গোল্ডআর্থ ম্যাক্সটারের স্যাটালাইট চিড়িয়াখানায় পৌঁছল, সেটা বোধহয় আমরা ছাড়া খুব কম লোকই জানে। তাই মাসখানেক আগে যখন অফিসে ঢুকেই দেখলাম গেঁড়ে ওস্তাদ কর্নেলের ঘরে ঢুকেছে আর দরজার বাইরে লালবাতি জ্বলছে, এর মানে নতুন আসাইনমেন্ট। গেঁড়ের আসল নাম কি কেউ জানে না। রোগা মাঝারি চেহারা, মাথায় কাঁচা পাকা ঝাঁকড়া চুল, মাথায় সবসময় কালো অক্টাগ্লাসের পিছন থেকে আটটা বড় বড় চোখের ভিতর থেকে লাল আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে, মানে পুরো তিনশ ষাট ডিগ্রি নজর চলছে। না চললে অবশ্য গেঁড়ের সেই দাম থাকতো না কলকাতার উপরমহলে, ওর ব্যাবসাটাই তো খবর বেচা। সারা সলের কোথায় কি স্ক্যান্ডাল চলছে থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর প্রাচীন বই কিংবা একবিংশ শতাব্দীর হলো-মুভির কপি, সব খবর ওর মাথার এক্সট্রা ডিস্কে। তাই ওকে কর্নেলের ঘরে দেখেই সেদিন বুঝেছিলাম কপালে দুঃখ আছে, গেঁড়ের দেওয়া খবর কিছু ভালো হতে পারেনা। তারপর কর্নেলের ঘর থেকে বেরিয়ে যখন ব্যাটা আমার টেবিলের পাশে এসে দাঁড়াল, তখন থেকেই আমি একটু অস্বস্তিতে ভুগছিলাম।

     – “কি বাসু, আছো কেমন?”

     যতটা পারি নির্লিপ্ত মুখ করে বললাম, “এই চলে যাচ্ছে আর কি।”

     – “তা বেশ। চলে তো যাবেই। আগের মাসে একটা ইরোটিক ম্যাসাজার ইন্সটল করেছো বেডরুমে দেখলাম। তা তোমার ভেনাসের বান্ধবী জানে তো?”

     মুখে একটা সাতেরো অক্ষরের গালাগালি এসে গেছিল। দাঁতে দাঁত চেপে সেটাকে হজম করে নিলাম। খুব কষ্ট করে মুখে একটা দ্যাখন হাসি চাপিয়ে বললাম, “কি যে বলেন দাদা! কোথা থেকে পান এই সব ভুলভাল খবর?”

     – “আমার খবর ভুল হয় না ব্রাদার। যাই হোক, এনজয় করে নাও যতদিন পারো। যাও, এখুনি কর্নেল সাহেব মিটিং ডাকবেন।”

     তখন কি বুঝেছিলাম ছাই যে গেঁড়ের কথাটা এত তাড়াতাড়ি ফলে যাবার মত অবস্থা হবে!

     কর্নেলের মিটিং রুমে ঢুকে দেখলাম সবাই হাজির। জিত আর বিষ্ণুর বয়স কম, নতুন কাজের গন্ধ পেলে ওরাই সবথেকে খুশি হয়। আমাদের মধ্যে সাধনদাই একমাত্র সংসারী আর ঠাণ্ডা মাথার মানুষ। মুখেও কম কথা বলেন মেপে মেপে, বাজে কথার মানুষই নন। তিরিশ বছর মিলিটারিতে কাটানো সাধনদার আরেকটা গুন হল কোন ব্যাপারেই ভদ্রলোক উত্তেজিত হন না। সময় মেপে অফিসে ঢোকেন আবার বেরিয়ে যান। ছুটির পরে মাঝে মাঝে ওনাকে দেখি রাস্তার উলটো দিকের বারটায় একা হুইস্কি হাতে বসে আছেন। আমাদের স্নেহ করলেও একটু দূরত্ব বজায় রাখেন। পাইলট জিতের সাথেই ওর তাও একটু মাখামাখি আছে। আমরা আড়ালে বলি জিতকেই বোধহয় দত্তক নেবেন সাধনদা।

     যাই হোক, কর্নেল একটা হলোটেপ নিয়ে ঘরে ঢুকলেন, “হ্যালো ফ্রেন্ডস, বুঝতেই পারছো আমরা নতুন একটা কাজ হাতে পেয়েছি। যদিও কাজটা বেশ সাধারন, কিন্তু আইনের চোখে ভীষণ নিষিদ্ধ। ধরা পড়লে কোম্পানি তো লাটে উঠবেই, বছরখানেক সংশোধনাগারেও কাটাতে হতে পারে। তবে কাজটার কথা বলার আগে কিছু তথ্য তোমাদের জানানো দরকার।”

     হলোটেপটায় একবার চোখ বুলিয়ে কর্নেল ঘুরলেন জিতের দিকে, “জিত তোমার এই চক্রবর্তী পদবীটার মানে সম্পর্কে কোন ধারণা আছে ?”

     – “না… মানে জানেন তো স্যার, আমার জন্ম টাইটানের মিলিটারি একাডেমীতে। ছোটবেলা থেকেই বাবা মার সাথে সম্পর্ক খুব কম। তাই কোন ধারনাই নেই।” 

     – “আচ্ছা, আমি বলছি শোন। এই তথ্যগুলো খুব গোপন আর্কাইভ থেকে চুরি করা। এসব তোমার চোদ্দ পুরুষের কেউ জানে না। চক্রবর্তী হল বামুন নামে এক উপজাতির পদবী। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ, যেটাকে আমরা ধর্মযুদ্ধ বলেও জানি, তারও আগে এই উপজাতিকে পাওয়া যেত এই কলকাতাতেই। এদের সাথে ওই ধর্ম ব্যাপারটার নাকি বেশ জোরালো সম্পর্ক ছিল। ব্যাপারটা আমার কাছেও ঠিক পরিষ্কার নয়, তবে জানো তো ধর্মযুদ্ধের পরেই পৃথিবী থেকে সমস্ত ধর্মের চিহ্ন মুছে ফেলা হয়। এই সব সম্পর্কিত সমস্ত তথ্য, বই বা হলোটেপ নষ্ট করে দেওয়া হয়। পরের বেশ কিছু প্রজন্মকে বাধ্যতামূলক ব্রেইন ইরেজিং-এর ভেতর দিয়ে যেতে হয়, যাতে ধর্মের কোন চিহ্ন না থাকে মানবজাতির উপর। যাই হোক চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধ বা রোবোযুদ্ধের আগের এগারশো বছর মানবসভ্যতায় কোন বড় মাপের যুদ্ধ আর হয়নি। কিন্তু ধর্মের উপর নিষিদ্ধতা এখনো বজায় আছে।”

     – “কিন্তু এসবের সাথে আমাদের কাজের কি সম্পর্ক স্যার?”, অধৈর্য গলায় বলে উঠলো বিষ্ণু।

     – “সম্পর্ক আছে, জানোই তো আমি দরকার ছাড়া কথায় সময় নষ্ট করি না। তবে কি জানো, তোমার নামটাও এক ধর্মের কোন শক্তিশালী দেবতার নাম। এই দেবতারা বোধহয় অন্যগ্রহের অনেক উন্নত জাতি ছিল, যাদের বহু হাজার বছর আগে মানুষ খুব মেনে চলতো। তাদের মূর্তিও বানাতো। তিনমাস আগে থর অভয়ারণ্যের নিচে একটি টাইম ভল্টে এমন একটি ধর্মের দেবতার মূর্তি পাওয়া গেছে। মূর্তিটি মানবাকৃতি হলেও ভয়ানক এক মহিলার আদলে গড়ে তোলা। যারা ওটি প্রথম উদ্ধার করে তাদের আতঙ্ক কাটানোর জন্যে একদিন করে ব্রেন ওয়াশের ব্যবস্থা করতে হয়েছে। খুব উঁচু দু-তিন জন সরকারি কর্মচারী ছাড়া এটার খবর কেউ জানে না। কাউকে দেখতেও দেওয়া হয়নি মূর্তিটা। আমার কাছে খবর আছে এই দেবতার নাম নাকি কালী।” 

     – “বুঝতে পেরেছি, আর এই মূর্তিটা আমাদের চুরি করে কোথাও পাচার করতে হবে এই তো?”, বলে উঠলাম আমি।

     – “ব্রাইট বয়! এই জন্যেই তোমায় এত পছন্দ করি বোস।”, স্বপ্রশংস দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন কর্নেল। “আশা করি ওবেরনের সব থেকে বড় ক্যাসিনো সুটানুটির মালিক অর্ধদেব ভট্টের নাম শুনেছ? সলের সবথেকে বড়লোকদের মধ্যে একজন। ভদ্রলোক একজন এই ধর্ম ব্যাপারটার উৎসাহী সমর্থকও বটে। গোপনে ওনার ক্যাসিনোতে ধর্মচর্চা হয় শুনেছি। কিন্তু সেখানে ঢোকার ক্ষমতা এই সৌরজগতের জনা কুড়ি পঁচিশ ধনীর বেশি কারো নেই। ওনার ধারণা ভট্ট বংশের পূর্বপুরুষরা এই কালী নামক দেবতার ভক্ত ছিল। তাই এই মূর্তিটা ওনার চাই যে কোন মুল্যে।”

     – “তার মানে মূর্তিটা চুরি করতে হবে আমাদের, আর তারপর ওবেরনে পাচার এই তো?” সাধনদা নিশ্চিন্ত মুখে বললেন।

     – “না হে, ভট্ট আমাদের কাজটা অনেকটাই এগিয়ে রেখেছে। সেই মূর্তি মাটির নিচের ভল্ট থেকে হাওয়া হয়ে গেছে পাঁচ দিন আগেই। সিল করা বাক্স যেমন ছিল তেমনই পড়ে আছে, আর ওই বাক্স কেউ কোনদিন খুলবেও না। আমাদের কাজ শুধু ওটাকে জায়গা মতো পৌঁছে দেওয়া। তবে…”, একটু থামলেন কর্নেল। “একটাই সমস্যা, র‍্যাক্সর কে, তা আশা করি সবাই জানো।”

     – “ইয়েস, কর্নেল! সলের স্পেস নেভিকে নাকে দড়ি দিয়ে নাচিয়েছে এই বদমাশ দস্যুটা। জেনোসাইড থেকে স্লেভ ট্রেডিং অথবা নিষিদ্ধ অস্ত্রের চোরাচালান- এগুলো সবই করেছে শয়তানটা। আমরাও নেভিতে থাকার সময় মাসছয়েক ঘুরেছিলাম ওকে ধরার জন্যে। প্রচণ্ড বুদ্ধিমান আর নৃশংস ভীনগ্রহী এই র‍্যাক্সর। তার ওপর সিলিকন ভিত্তিক প্রাণী হওয়ার জন্যে আমাদের মতো কার্বন নির্ভর প্রাণীদের উপর ওর কোন মায়া নেই।” জিত গড়গড় করে বলে গেল।

     – “হ্যাঁ, আর সেই র‍্যাক্সরের কাছে পৌঁছেছে এই মূর্তির খবর। যেটা আমরা জানতাম না, সেটা হল র‍্যাক্সরের প্রজাতি প্রচণ্ড কুসংস্কারি আর মূর্তি উপাসক। ও খবর পেয়েছে যে প্রাচীন যুদ্ধবাজরা এই মূর্তির উপাসক ছিল, তাই এটা সংগ্রহ করতে পারলে ওর গোষ্ঠীর কাছে সম্মান অনেক বেড়ে যাবে।”

     – “কিন্তু আমাদের মহাকাশযান র‍্যাক্সরের ফ্রিগেটের সঙ্গে কিছুতেই পেরে উঠবে না!”, একমুখ ধোঁয়া টেনে বললেন সাধনদা। আমাদের মধ্যে একমাত্র উনিই কর্নেলের সামনে ধূমপানের সাহস রাখেন।

     – “সেইজন্যেই গেঁড়ে আমাদের একটা নতুন ইম্পালস বুস্টার ধার দিচ্ছে। র‍্যাক্সরের বিরাট ফ্রিগেট এই সৌরজগতের মধ্যে আমাদের বুস্টার লাগানো ছোট্ট রকেটকে ধরতেই পারবেনা।”, তৃপ্তির হাসি হাসলেন কর্নেল।

     পরের কয়েকদিন আমাদের অফিসে তৎপরতা ভীষণ বেড়ে গেল। নতুন বুস্টারটা লাগাতেই অনেক সময় লেগে গেল। এর মধ্যেই একদিন গভীর রাতে একটা ক্যামোফ্লাজ করা হোভার ভ্যান এসে অফিসের গ্যারেজে নামল। আমরা ঝটপট একটা বড় সিল করা বাক্স নামিয়ে কর্নেলের অ্যান্টিচেম্বারে ঢুকিয়ে ফেললাম। বাক্সটার যা মাপ তাতে অনায়াসে একটা বড়সড় মানুষকে ঢুকিয়ে দেওয়া যায়। জিত আর বিষ্ণুর খুব ইচ্ছে ছিল বাক্সটা খুলে দেখে মূর্তিটা। কিন্তু কর্নেল হাঁ হাঁ করে দৌড়ে এসে আমাদের বাইরে বার করে দিয়ে একটা বায়োলক লাগিয়ে দিলেন দরজায়। একমাত্র কর্নেল আর সাধনদা ছাড়া কেউ খুলতে পারবেনা এই দরজা। পরে সাধনদাকে বিস্তর দামি তামাক আর মদের লোভ দেখিয়েও আমরা কেউ দরজা খোলাতে রাজি করতে পারলাম না।

     তবে কর্নেল যখন বললেন কাজটা ঠিকঠাক সারতে পারলে ভট্ট নিজের খরচায় সুতানুটি ক্যাসিনোতে একমাস ছুটি কাটাতে দেবেন, তখন মূর্তি দেখতে না পাওয়ার দুঃখ আমরা সবাই ভুলে গেলাম। একমাস কেন, আমাদের সারা বছরের মাইনের টাকাতেও আমরা সুতানুটির একদিনের খরচাও চালাতে পারব না। এদিকে সাধনদা কদিন ধরে মুখ শুকনো করে ঘুরছে, জিত খবর আনল সাধনদার বউ মারাত্মক রেগে গেছে সাধনদার একা সুতানুটি যাবার আর ছুটি কাটানোর খবরে। নেভির অভিজ্ঞ সৈন্য সাধনদা কিন্তু একেবারেই কাবু বউয়ের কাছে। একদিন তো দেখলাম কপালে বড় হিলিং টেপ লাগিয়ে অফিসে ঢুকল। জিত চোখ টিপে বলে গেল গৃহযুদ্ধের রেশ। যাই হোক দিন এগিয়ে আসছে আমাদের অভিযানের। আর্থ কাস্টমসে কোনরকম অসুবিধে হবে না, ঠিক জায়গায় সব ব্যবস্থা করে রেখেছেন কর্নেল। তাছাড়া সপ্তপদীর গোপন লাগেজ কম্পার্টমেন্ট খুঁজে বের করার সাধ্য কোন স্ক্যানারের নেই। চিন্তাটা শুধু র‍্যাক্সরকে নিয়ে। ওর হয়ে কাজ করার লোকের অভাব নেই, এতদিনে ও নিশ্চয়ই জেনে গেছে দেবী মূর্তিটা আমাদের কাছেই।

     অবশেষে আমরা বেরিয়ে পড়লাম ওবেরনের উদ্দেশ্যে। বেরনোর আগের দিন কর্নেল আর সাধনদা সারাদিন কি যেন পরামর্শ করে কাটালো অ্যান্টি চেম্বারে। আমাদের কেউ কিছুই বলল না। পৃথিবী থেকে ফোবসের রিফুয়েলিং স্টেশন পর্যন্ত আমরা নির্বিঘ্নেই পৌঁছে গেলাম। মুশকিলটা হল তারপরেই, রাডারের ডান কোণ থেকে শিকারি বাজের মতো আমাদের পিছু নিল ক্লোক করে থাকা একটা ফ্রিগেট। যদিও আমরাও তৈরিই ছিলাম। কর্নেলের নির্দেশে বুস্টারটা চার্জ করলো জিত। কিন্তু একি! গতিবেগ বাড়ার বদলে কমে যাচ্ছে দ্রুত! সাধনদা আর বিষ্ণু ছুটে গেলো ইঞ্জিনরুমে। কিছুক্ষণের মধ্যেই কমুনিকেটরে যা জানাল, তা শুনে রাগে গা জ্বলে গেলো। গেঁড়ে ঠকিয়েছে আমাদের, ওর দেওয়া বুস্টার কাজ তো করেইনি, উলটে অকেজো করে দিয়েছে আমাদের আয়ন ইঞ্জিন। আমরা মহাকাশে অসহায় র‍্যাক্সরের ফ্রিগেটের কাছে। যদিও আমি বিপদ সংকেত পাঠিয়ে দিয়েছি, কিন্তু সবথেকে কাছের নেভি পেট্রোলটাও আসতে আধঘন্টা নেবে। ততক্ষণে র‍্যাক্সর আমাদের কচুকাটা করে মূর্তি নিয়ে হাওয়া!

     দেখতে দেখতে ফ্রিগেটটা আমাদের সপ্তপদীর সাথে ডক করলো। আমরা লেসার পিস্তল নিয়ে তৈরি হচ্ছিলাম, কিন্তু কর্নেল ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলেন। হ্যাঁ, র‍্যাক্সরের দলের অস্ত্রশস্ত্রের কাছে আমাদের এই কটা সামান্য পিস্তল কিছুই না।

     এয়ার লক দিয়ে পাঁচটা চার ফুট উচ্চতার পোকার সাথে ঢুকলো র‍্যাক্সর। বাকি স্বজাতির মতোই চেহারা, তবে গড়নে বেশ বড়সড়, পিঠের খোলসটা কালো চকচক করছে, দেখলেই বোঝা যায় পোকাগুলোর নেতা। প্রত্যেকের কোমরে বাঁধা সারি সারি মারণাস্ত্র। আমরা সবাই হাত তুলে একদিকের দেওয়ালে গিয়ে দাঁড়ালাম। কর্নেল এগিয়ে গিয়ে বললেন, “আমাদের এইভাবে আটকানোর মানে কি র‍্যাক্সর? জানোই তো আমরা ছোটখাটো মালপত্র চালান করি। এবার ওবেরনের জন্যে কিছু হাইব্রিড গরুর দুধ আর চীজ নিয়ে যাচ্ছি। আমাদের কাছে ওগুলো দামি হলেও তোমার তো একদিনের জ্বালানীর খরচও ওতে উঠবে না!”

     কর্নেলের কথা শুনে খুব বিচ্ছিরি শব্দ করে হেসে উঠলো জীবগুলো। কমুনিকেটরের মধ্যে থেকে যান্ত্রিক গলায় র‍্যাক্সর বলে উঠল, “নিজেকে খুব চালাক মনে করো, তাই না দাস? পাকা খবর না নিয়ে আমি মাঠে নামি না। ওই প্রাচীন মূর্তিটা আমার চাই। আমি জানি ওটা এই জাহাজেই আছে। এখন ভালোয় ভালোয় বলবে নাকি অন্য রাস্তা দেখতে হবে?”

     কর্নেল চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, “বলে দিলেই কি আমাদের ছেড়ে দেবে তুমি? সে সুখ্যাতি তো তোমার নেই।”

     “আচ্ছা, না বললেও খবর বের করার অন্য রাস্তা আছে আমার।” এই বলে রেডিওতে কাকে যেন ডাক দিলো র‍্যাক্সর। আর তারপরেই এয়ার লক দিয়ে ঘরে এসে ঢুকল গেঁড়ে ওস্তাদ। তার মানে ব্যাটা প্রথম থেকেই দুনম্বরী করেছে, কাস্টমসকে বোকা বানানোর জন্যে প্রথমে ব্যবহার করেছে আমাদের, আর তারপরে ষড়যন্ত্র করে আমাদের ইঞ্জিন খারাপ করে ধরিয়ে দিয়েছে র‍্যাক্সরের কাছে।

     ব্যাটা ঘরে ঢুকেই ভাঁটার মতো চোখ পাকিয়ে দেঁতো হাসি হেসে বলল, “কি গো বন্ধুরা, কেমন লাগছে র‍্যাক্সরের দলকে? চিন্তা কোর না, মূর্তিটা পেয়ে গেলে ওরা যাবার আগে সপ্তপদী উড়িয়ে দিয়েই যাবে তোমাদের সুদ্ধু।”

     এরপরেই আর মাথার ঠিক রাখতে না পেরে ঝাঁপ দিতে গেছিলাম গেঁড়ের দিকে। কিন্তু তার আগেই র‍্যাক্সরের লেসার ছুরিটা আমার দু পায়ের ফাঁক দিয়ে উড়ে গিয়ে চেয়ারটায় গেঁথে গেল। বুঝতে পারলাম শয়তানটা হাইটে ছোট হলেও ক্ষিপ্রতায় ওর সাথে আমরা পারব না।

     “তোরা বুঝিসনি যে গেঁড়ে তোদের এই ভাঙ্গা রকেটে বুস্টার লাগানোর নাম করে মূর্তি লুকোনোর জায়গাটাও দেখে নিয়েছে। তোদের এখনি মারতে পারতাম, কিন্তু শুনলাম দেবীর সামনে মারলে নাকি আমার ভাগ্য খুলে যাবে।” র‍্যাক্সর ইশারা করতেই গেঁড়ে দেওয়ালের একটা অংশে চাপ দিলো। নিঃশব্দে খুলে গেল গোপন একটি দরজা, পিছনে একটা আলমারির মতো জায়গায় দাঁড় করানো আছে সেই সিল করা বাক্সটা। একটু ইতস্তত করে র‍্যাক্সর কর্নেলকে খুলতে বলল বাক্সটা। কর্নেল গম্ভীর মুখে এগিয়ে গিয়ে বাক্সের গায়ের লিভারটা ধরে টান মারলেন। গলগল করে অনেকটা সংরক্ষক বাষ্প বেড়িয়ে এলো বাক্সটা থেকে। আর তার মধ্যে দেখতে পেলাম এক ভয়ংকর নারীমূর্তি। ঘন কালো গায়ের রঙ, মাথায় এলো চুল, মুখে কোন অতীতের জিঘাংসা আর রাগ ফেটে পড়ছে। জিভটা বেরিয়ে পড়েছে মুখের বাইরে, চারখানা হাতে বিরাট একটা ধাতুর ধারালো অস্ত্র, গায়ে লাল রক্ত রঙের কাপড় জড়ানো, সব মিলিয়ে যেন জীবন্ত বিভীষিকা!

     এই মূর্তি দেখে গেঁড়েও  চমকে গিয়ে কিছু যেন বলতে গেল র‍্যাক্সরকে। কিন্তু তার আগেই র‍্যাক্সর আর তার পাঁচ স্যাঙ্গাত ছুটে গিয়ে ঘিরে ধরল মূর্তিটাকে, চোখে তাদের মুগ্ধ দৃষ্টি আর ভয়।

     চোখের কোন দিয়ে দেখলাম সাধনদা পকেট থেকে একটা ছোট্ট যন্ত্র বার করে একটা বোতাম টিপল। আর তারপরেই যেন একটা ঘূর্ণিঝড় শুরু হয়ে গেল ঘরটায়! বাক্সের মধ্যের সেই ভয়ানক নারীমূর্তি যেন নিমেষে প্রাণ ফিরে পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল র‍্যাক্সর আর তার স্যাঙ্গাতদের উপর। আর তার সাথে খ্যানখ্যানে গলায় অসংখ্য গালি। কিছু বোঝার আগেই র‍্যাক্সর আর তার দুই সঙ্গী কুপোকাত হল অস্ত্রটার ঘায়ে। আর বাকি তিনজন এতটাই ভয় পেয়ে গেল যে তাদের লেসার বন্দুকগুলো কেড়ে নিয়ে বেঁধে ফেলতে আমাদের কোন বেগই পেতে হল না।  গেঁড়ে এই তালে সরে পড়ার তালে ছিল, কিন্তু কর্নেলের একটা রদ্দা খেয়ে আটখানা চোখ উলটে সুয়ে পড়ল। গেঁড়ে সুদ্ধু সবাইকে বেঁধে ফেলার পরে কর্নেল আরাম করে চুরুট ধরালেন একটা। ততক্ষণে আমরা সময় পেয়েছি সেই কালীমূর্তির দিকে ভালো করে নজর দিতে। আরে! এতো চেনা চেনা লাগছে! সাধনদার দজ্জাল বউ অরুণিমা বউদি না? কিন্তু তার গায়ের রঙ এরকম কালো কুচকুচে হল কী করে? আর সে বাক্সটার মধ্যেই বা মূর্তি সেজে করছে কী?

     কর্নেলের দিকে তাকাতেই তিনি ইশারায় বুঝিয়ে দিলেন পরে সব প্রশ্নের উত্তর দেবেন। ইতিমধ্যে আমি র‍্যাক্সরের ফ্রিগেটে খবর পাঠিয়েছি যে তাদের নেতাকে বাঁচাতে গেলে তারা যেন ধরা দেয়। কিন্তু রাডারে নেভির জাহাজগুলো দেখতে পাবার পরই ফ্রিগেটটা চাচা আপন প্রান বাঁচা নীতি অনুসরণ করে পালিয়েছে। র‍্যাক্সর, গেঁড়ে ওস্তাদ আর তাদের চ্যালাদের নেভির হাতে তুলে দেওয়ার পরে কর্নেল জানালেন, প্রথম থেকেই তার গেঁড়ের উপর সন্দেহ ছিল। বুস্টারটা লাগানোর পরেই তিনি সুযোগ খুঁজছিলেন কিভাবে র‍্যাক্সরকে ধরার জন্যে উলটো ফাঁদ পাতা যেতে পারে। তারপর সাধনদা যখন বউয়ের হাতে পেটানি খেয়ে অফিসে এলো তখনই কর্নেলের মাথায় খেলে গেল বুদ্ধিটা। কুসংস্কারগ্রস্ত র‍্যাক্সরকে ভয় পাওয়ানোর সব থেকে সহজ উপায় জ্যান্ত কালীমূর্তি! আর এই ফাঁকে সাধনদার স্ত্রীকেও নিয়ে যাওয়া যাবে সুতানুটি! মতলব মতো সাধনদাও পরের দিনই বৌদিকে শক রে দিয়ে অজ্ঞান করে পিগমেন্ট  আর জিন সার্জারি করে কালী সাজায়। তারপর সময় মতো বাক্স বদল করে সপ্তপদীতেও তোলা হয়। পুরো সময়টাই বৌদিকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছিল। র‍্যাক্সররা কালীমূর্তি দেখে ঘাবড়ে যেতেই সাধনদা সুইচ টিপে ঘুম ভাঙিয়ে দেয়। তারপর ঘুম ভাঙতে রেগে আগুন বউদি যা করেছেন তা কর্নেলের বুদ্ধিমতই। যাই হোক বউদিকে বুঝিয়ে সুজিয়ে আর সুতানুটির ছুটির লোভ দেখিয়ে আমরা সবই শান্ত করলাম। এ যাত্রায় সাধনদার প্রাণ আর বিয়ে দুইই বেঁচে গেল বোধহয়। ইতিমধ্যে সপ্তপদীর গুদামের চীজের বাক্স থেকে বেরিয়েছে আসল কালীমূর্তি, যা রাখা ছিল সবার চোখের সামনেই।

    র‍্যাক্সরকে ধরিয়ে দিয়ে আর মূর্তিটা ভট্টবাবুকে পৌঁছে দিয়ে, আমাদের সকলেরই ব্যাংক ব্যালেন্স বেশ বেড়ে গেছিল তা আশা করি না বললেও চলে। আর তারপর? তারপর আমরা সুতানুটির ক্যাসিনোর প্রবাবিলিটি ফিল্ড তৈরি করা চোরকে কেমন করে ধরলাম, সে আরেক গল্প!  

Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, দীপ ঘোষ, দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য্য, প্রথম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা

Leave a Reply

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!