Wednesday, December 11, 2024

নন-ফিকশনঃ বিশ্বখ্যাত বৈজ্ঞানিক নাসির অল-দিন অল-তুসি – এক বহুমুখী প্রতিভা – অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়ঃ উত্তরাধিকারঃ ওয়েব সাহিত্য পুরস্কার ২০১৭

bigganarupbandyo01

বিশ্বখ্যাত বৈজ্ঞানিক নাসির অল-দিন অল-তুসি – এক বহুমুখী প্রতিভা

অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়

পারস্য দেশে আব্বাসিদ খলিফারা রাজত্ব স্থাপন করার পর সেখানে স্বর্ণ যুগের পত্তন হয়। আব্বাসিদরা ছিলেন হজরত মহম্মদ বংশের। তাদের তৃতীয় সুলতান হারুন অল রশিদের সময় পারস্য দেশ বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, শিল্পকলায় বিশেষ ভাবে পারদর্শী হয়ে ওঠে। কিন্তু পরবর্তীকালে আব্বাসিদ খলিফাদের প্রভাব কমতে থাকে। এই সুযোগে মঙ্গোল রাজা চেঙ্গিস খান তার সাম্রাজ্য বিস্তার করবার জন্য পারস্য আক্রমণের প্রস্তুতি নিতে শুরু করে। সমৃদ্ধ শহর বাগদাদ ও খোরাসানে রাজনৈতিক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়। পারস্যে মুসলিম রাজত্বে ফাটল ধরলে শিল্প ও বিজ্ঞান চর্চায় তার প্রভাব দেখা দিতে থাকে।

এই পটভূমিকায় ১২০১ খ্রিস্টাব্দে পারস্যের খোরাসান প্রদেশের তুস নামে এক ছোট্ট জায়গায় জন্ম হয় খাজা ইবন মহম্মদ ইবন অল-হাসান অল-তুসি বা সংক্ষেপে নাজির অল-দিন অল-তুসির। এই জায়গাটি বর্তমান ইরানের উত্তর পূর্ব দিকে অবস্থিত। এক ধার্মিক পরিবারে তুসির জন্ম হয়। তখনকার পারস্য সমাজে ধার্মিক পরিবারগুলিতে পড়াশুনোর চর্চা বেশি হত। ফলে ছোটবেলা থেকেই তুসি পড়াশুনোতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তার প্রিয় বিষয় হয়ে ওঠে গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞান।খুব সম্ভব অল-তুসি খুব অল্প বয়সে পিতৃহারা হন। চাচার সযত্ন তত্ত্বাবধানে অল্প বয়সেই পদার্থ বিদ্যা ও তর্কশাস্ত্রেও  তাঁর বিশেষ বুৎপত্তি দেখা যায়। উচ্চতর শিক্ষা লাভ করার জন্য অল-তুসি নিশাবুর শহরে চলে যান। জ্ঞানের সুতীব্র পিপাসায় তিনি নিশাবুর শহর ছেড়ে পাড়ি দেন পারস্যের অন্য স্থানগুলিতে, যেখানে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানচর্চার সুবিধা ছিল। বাগদাদ, মুসিল, ইস্পাহান সফর শেষে তার জ্ঞানের ভাণ্ডার আরও সমৃদ্ধ হয়।  এই সময়ে তিনি ইসমাইলি সুলতানদের সংস্পর্শে এসে তাদের দরবারে একজন অত্যন্ত গুণী এবং প্রভাবশালী মানুষ হিসাবে খ্যাতি লাভ করেন। আলামুটে সুলতানের রাজপ্রাসাদে ইসমাইলি শাসক আল অল-দিন মহম্মদের প্রধান উপদেষ্টা পদে নিযুক্ত হন তুসি।

ইতিহাসবিদদের ধারণা অনুযায়ী, শুধু মুসলিম শাসিত দেশগুলির জন্যই নয় ;এই সময় ছিল পৃথিবীর সবচাইতে দুর্দিন। তার প্রধান কারন, মঙ্গোলদের আগ্রাসন। চেঙ্গিস খানের নেতৃত্বে অনেক আগে থেকেই মঙ্গোলরা সসাগরা পৃথিবীতে একছত্র শাসন কায়েম করতে বদ্ধ পরিকর হয়ে ওঠে। অস্থির সমাজে ইতিহাসের সত্যতা পাওয়া দুষ্কর। স্বৈরাচারী শাসক স্বার্থে লিখিত ইতিহাসে হারিয়ে যায় কার্যকারণ। কেউ এমনও লিখে গেছেন যে, অলতুসি সিয়া মতাবলম্বী ছিলেন বলে, ইসমাইলি  সম্প্রদায়ের একদল সন্ত্রাসবাদী তুসিকে অপহরণ করে নিয়ে যায় আলামুট দুর্গে।

ঘটনা যাই ঘটুক, ইতিহাসের দলিল প্রমান করে যে তুসির জীবনের একটা বড় অংশ আলামুট দুর্গে অতিবাহিত হয়েছিল। সেখানে এই সময়ে তিনি রাজ্য পরিচালনা সংক্রান্ত আইনি দস্তাবেজ লেখেন, যার গুনগত মান এত উচ্চ ছিল, পরবর্তীকালেও শাসকেরা তার প্রয়োগ করে ফললাভ করে। বিভিন্ন ধর্ম পুস্তকও লেখেন। আশ্চর্যের বিষয় হল, শাসকদের সাথে একসাথে বসবাস করে, তাদের রাজ্য পরিচালনায় পরামর্শ দাতা হিসাবে কাজ করলেও ধর্ম নিয়ে তাদের সাথে বিভেদ ছিলনা তুসির। অথচ তাঁর সিয়া ধর্মমত আর ইসলামিদের ধর্মমতে বিস্তর ফারাক ছিল। জানা যায় নিজে ধর্মযাজক হয়ে কাজ করলেও বিজ্ঞান চর্চার ক্ষেত্রে সব ধর্মের মানুষকে সমান ভাবে জ্ঞান অন্বেষণে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন অলতুসি। এই কারণে তিনি বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেন। কোনও কোনও পণ্ডিতের মতে অলতুসির নিপুণ রাজনৈতিক পারদর্শিতা থাকায় নিজের ও অপরের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় যাতে বাধা সৃষ্টি নাহয় সে ব্যাপারে তিনি অতিশয় যত্নবান ছিলেন এবং সেই জন্যই বিভিন্ন শাসকদের সাথে কাঁধে কাধ মিলিয়ে চলতে হয়েছে তাঁকে।

    আলামুট দুর্গে বসবাস কালে ত্রিকোণমিতি নিয়ে তুসির আগ্রহ বাড়তে থাকে। ১২৪৭ সালে লিখে ফেলেন ‘শকল অল-কাট্টা’ (Treatise on Complete Quadrilateral) নামের বিশ্ববিখ্যাত বইটি। তিনিই বিশ্বের সর্ব প্রথম বিজ্ঞানী, যিনি ত্রিকোণমিতিকে জ্যোতির্বিজ্ঞান থেকে পৃথক করে ফেলেন। ত্রিকোণমিতি গণিতের নিরপেক্ষ বিষয় হিসাবে গণ্য হয়। গণিতজ্ঞদের ধারণা, তুসিই প্রথম ত্রিকোণমিতির সাইন তালিকা (sine table) প্রবর্তন করেন। এই বইটিতে ধনাত্মক বাস্তব সংখ্যার (positive real number) সংজ্ঞা পাওয়া যায়। ৪০০ বছর পর স্যার আইজ্যাক নিউটন এই সংজ্ঞা আবার নতুন করে লেখেন।

গ্রীক বিজ্ঞান চর্চা অল-তুসিকে প্রভাবিত করে। তিনি ফার্সি ভাষায় অনুবাদ করেন টলেমি, আরকিমিডিস এবং ইউক্লিডের বৈজ্ঞানিক  পুঁথিগুলি। অনুবাদের কাজ করতে গিয়ে টলেমির কাজে কিছু ত্রুটি তার দৃষ্টি এড়ায় না। টলেমির প্রবর্তিত সমকারি (Ptolemy equant) কে ভুল প্রমাণিত করে   তিনি দূরবর্তী গ্রহগুলোর অবস্থান জানবার জন্য এক বিশেষ যন্ত্র প্রবর্তন করেন। দুটি গোলাকার চাকতি দিয়ে যন্ত্রটি তৈরি হয়। ছোট চাকতিটির ব্যাস বড় চাকতিটির ব্যাসের অর্ধেক। এই দুটি চাকতি একসাথে ঘোরার সময় যদি ছোট চাকতির কৌণিক বেগ (angular velocity) বড় চাকতির কৌণিক বেগের দ্বিগুন হয় আর ঘোরার সময় ছোট চাকতিটি বড়টিকে ভিতর থেকে স্পর্শ করে থাকে, তবে দেখা যাবে ছোট চাকতির উপরিস্থিত একটি বিন্দু সরলরেখায় বড় চাকতিটির ব্যাস বরাবর সামনে ও পিছনে দুলছে। অর্থাৎ ওই বিন্দুটির গতি হবে simple harmonic motion।

তুসি-কাপ্‌ল্‌ প্রস্তাবিত হলে জ্যোতির্বিজ্ঞানের অনুসন্ধানে টলেমির সমকারি পরিত্যক্ত হয়ে যায়। প্রায় দুশো বছর পর নিকোলাই কোপার্নিকাস তার বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধানে তুসি-কাপ্‌ল্‌ ব্যবহার করেন।

কীভাবে কোপার্নিকাসের হাতে সে তথ্য আসে, তাও বড় চমকপ্রদ। জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং ইতিহাসবিদ জে এল ই ড্রেয়ার ১৯০৬ সালে একটি বই লেখেন – ‘Hystory of the Planatory Systems from Thales to Kepler’। এই বইটিতে তুসি-কাপ্‌ল্‌ সম্বন্ধে বিশদ বিবরণ দেন। তাঁর মতে, আরবি ভাষায় লেখা পারস্যের পুস্তকভাণ্ডার কোন কারণে রোমে ভাটিকানে পৌঁছে যায়। বিভিন্ন বর্বরদের আক্রমণ তার অন্যতম কারণ হতে পারে। বর্বররা রত্নভাণ্ডার লুট করবার সময় ইসলামিক পুস্তকাগার থেকে প্রচুর বই লুট করে নিয়ে যেত। তুসির লেখা বইটি খুব সম্ভব কোপার্নিকাসের হাতে আসে ভাটিকানেই। ঘটনা যাই ঘটে থাকুক, তুসি-দন্ধের উপযোগিতার কথা স্বয়ং কোপারনিকাসও লিপিবদ্ধ করে রেখে গেছেন। তুসির এই অনবদ্য কাজটির হদিস পাওয়া যায় তাঁর লেখা ‘অল- তধকিরা ফি ইল্ম অল-হায়া’ (Memoirs of Astronomy) এবং ‘তাহরির অল-মাজেস্টি’ বইটিতে।

১২৫৭ খ্রিস্টাব্দে ইসমাইলি দুর্গ আক্রমণ করে মঙ্গোল নেতা হুলাগু খান। চেঙ্গিস খানের নাতি হুলাগু খান ছিল অত্যন্ত পরাক্রমশালী যোদ্ধা। পারস্যে মুসলিম শাসনের পতন ঘটিয়ে মঙ্গোল শাসনের পত্তন করার চেঙ্গিস খানের অসফল বাসনা সফল হয় হুলাগু খানের আক্রমণে। বাগদাদে আব্বাসিদ খলিফাদের শাসনের অবসান হয়ে মঙ্গোল শাসন কায়েম হয়। আলামুট দুর্গ হুলাগু খানের হাতে চলে যায়। সম্ভবত অলতুসি বাধ্য হন হুলাগু খানের বশ্যতা স্বীকার করতে। বাগদাদ অভিযানে হুলাগুর সঙ্গী হন অলতুসি স্বয়ং।

    অকস্মাৎ তুসির মঙ্গোল প্রীতির কারণ খুঁজতে আজও ইতিহাসবিদরা মাথার চুল ছিঁড়ে ফেলেন। তার মত দক্ষ বৈজ্ঞানিক ও ধার্মিক মানুষ কেন বর্বর মঙ্গোলদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন তার কারণ অনেকে মনে করেন, পারস্যের বিপুল শিল্পকলা, পুঁথি আর বৈজ্ঞানিক তথ্য মঙ্গোলদের হাত থেকে রক্ষা করতেই তুসিকে বশ্যতা স্বীকার করতে হয়েছিল। মঙ্গোলদের সাথে সহযোগিতা করার আরও একটি কারণ হল,পারস্যে একটি অত্যাধুনিক মানমন্দির গড়ে তোলার জন্য তুসির আজীবন আগ্রহ। হুলাগু খান ভাগ্যগণনায় বিশ্বাস করত। স্বৈরাচারী রাজাদের অনেকেই জ্যোতিষ চর্চাকে গুরুত্ব দিত। কারণ জীবনের প্রতি পদে তাদের জন্য অপেক্ষা করে থাকত গোপন বিপদ আর রাজদ্রোহ। সাম্রাজ্য হারাতে হবে কিনা, সম্মুখ যুদ্ধে হুলাগুর জয়ের সম্ভাবনা কতটা, সে বিষয়ে মতামত নেবার জন্যই অলতুসি সিয়া মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে মন্ত্রী পদে বহাল করে হুলাগু খান।

তুসির খ্যাতি অন্য অনেক দেশের মতো সুদূর চিন দেশেও ছড়িয়ে পড়েছিল। হুলাগুর ভাই মঙ্গু খান ছিল অত্যন্ত মেধাবী। তাঁর জ্যোতিষ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানে বেজায় আগ্রহ ছিল। জানা যায়, সে নাকি হুলাগু খানকে অনুরধ করে তুসিকে চিনে পাঠাতে। তুসির সহায়তায় চিনে একটি আধুনিক মানমন্দির বানানোর পরিকল্পনা করে মঙ্গু খান। তাঁর সে স্বপ্ন, স্বপ্নই থেকে যায়। ১২৫৯ খ্রিষ্টাব্দে হুলাগু খানের অর্থনৈতিক সহায়তায় অলতুসি মারাঘায় গড়ে তুললেন সেই সময়ের সর্বাধুনিক মানমন্দির, ‘রসদ খানেহ’। এই মারাঘা স্থানটি বর্তমানে আজারবাইজানে অবস্থিত। মারাঘা মানমন্দিরে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন হলে সেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে ছাত্ররা পড়তে আসতো। সুদূর চিন দেশ থেকে ছাত্ররা এখানে জ্যোতির্বিদ্যা চর্চার জন্য ভর্তি হতো। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠাগারে চার লক্ষের বেশি বইয়ের সম্ভার ছিল। জ্যোতির্বিজ্ঞান ছাড়াও দর্শন, ঔষধ (medicine) আইন এবং ধর্ম বিষয়ে পড়ার সুযোগ ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার খরচ চালানো হতো ওয়াকাফ (মুসলিম ধর্মীয় ট্রাস্টকে বলা হয় ওয়াকাফ) থেকে, যার তত্বাবধান করতেন তুসি স্বয়ং।

মারাঘা মানমন্দিরে কাজ করবার সময়টি তুসির বৈজ্ঞানিক জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সময়। রাজনীতি, ধর্ম, আইন আদালত থেকে নিজেকে সরিয়ে তিনি সম্পূর্ণ ভাবে আত্মনিয়োগ করেন বিজ্ঞান সাধনায়।  মানমন্দিরে পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে গড়ে তোলা পরিসংখ্যানের বহু মুল্যবান দলিল তিনি লিখে যান। মারা যাওয়ার এক বছর আগে ১২৭২ সালে তুসি চার খন্ডে ইলখানি টেবল (জিজ-ই-ইলখানি) নথিবদ্ধ করেন। ইলখান টেবলে গ্রহপুঞ্জের গতিবিধির সঠিক তথ্য পাওয়া যায়। তুসিই সর্বপ্রথম ছায়াপথের সঠিক চরিত্র অনুধাবন করেন। মানমন্দিরে পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে সিদ্ধান্তে আসেন, ছায়াপথ আসলে ছোট বড় বহু নক্ষত্রের সম্মেলন। প্রায় সাড়ে তিনশো বছর পর ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে গ্যালিলিও গ্যালিলি টেলিস্কোপের সাহায্যে এই সত্য প্রমাণ করে দেখান।

১২৬২ খ্রিস্টাব্দে তুসি পাটিগণিতের সুত্র লিপিবদ্ধ করেন তার ‘জামি অল-হিসাব বি-অল –তাখত ওয়া –অল-তুরাব’  নামক বইটিতে। বইটি তিনটি খন্ডে বিভাজিত। প্রথম খণ্ডে পূর্ণসংখ্যা ও তার প্রয়োগের উপর লেখা। দ্বিতীয় খন্ডে ভগ্নাংশ ও তার গণনা বিবৃত। তৃতীয় খন্ডে ষাটের সংখ্যাভিত্তিক গণনা বিশদে লেখা। এই গণনার ভিত্তিতে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা তদানীন্তন কালে গবেষণা করতেন।

অলতুসির বিজ্ঞান অনুসন্ধিৎসা বিস্ময়কর। চার্লস ডারউইন বিবর্তনবাদ প্রবর্তন করবার জন্য আজও স্মরণীয়। কিন্তু বিবর্তন বাদের প্রথম প্রবর্তক অল-তুসি। ডারউইনের ৬০০ বছর আগে তুসি বিবর্তন সম্বন্ধে অত্যন্ত মুল্যবান বই লেখেন। তিনি মনে করতেন শুরুতে পৃথিবীর সমস্ত মৌলিক উপাদান ছিল একপ্রকারের। পরবর্তী সময়ে, বস্তুর অন্তর্নিহিত সংঘাতে সৃষ্টি হয় পৃথক পৃথক উপাদান। কিছু বস্তু অন্যগুলির চাইতে বেশি দ্রুত উন্নত হতে থাকে। সৃষ্টি হয় খনিজ পদার্থ, গাছপালা, কীট পতঙ্গ ও পশু। প্রকৃতির সাথে লড়াই করে বেঁচে থাকার প্রচেষ্টায় প্রাণীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। যেমন দাঁত, নখ, বিষ ইত্যাদি সৃষ্টি হয়। আবার তিনি যুক্তি দিয়ে বুঝিয়েও দেন, কেমন করে শুধু বেঁচে থাকার স্বার্থে, কিছু প্রাণী পরস্পর নির্ভরশীল হয়ে যৌথ জীবন যাপন করে । মানুষ সৃষ্টি হবার আগে পশুদের মধ্যে যা কিছু পার্থক্য, সব ছিল প্রাকৃতিক। মানুষের জন্ম হবার পর তার বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ ঘটতে থাকে। ইচ্ছাশক্তি, দৃষ্টিশক্তি আর জ্ঞানের প্রয়োগে মানুষ অন্য পশুদের সাথে পৃথক হয়ে যায়। কিন্তু প্রাকৃতিক কারণেই অন্য পশুদের সাথে তার কিছু মিল থেকেই যায়। তুসি মনে করতেন, একমাত্র ইচ্ছাশক্তি আর আত্মিক বিকাশের পথেই মানুষের উন্নতি সম্ভব।

১২৭৪ খ্রিষ্টাব্দে একদল ছাত্রের সাথে মারাঘা থেকে বাগদাদ যাওয়ার পথে অসুস্থ্য হয়ে মারা যান তুসি। সারাজীবন রাজনৈতিক অস্থিরতা পূর্ণ সমাজ এবং নিরন্তর যুদ্ধের মধ্যে থেকেও অলতুসি তার বিজ্ঞান চর্চা থেকে একচুলও বিচ্যুত হননি। তার উদার মনোভাব দেশ বিদেশের জ্ঞানী –বিজ্ঞানীদের একত্রে কাজ করবার স্বাধীনতা দেয়। নিজে ধার্মিক হওয়া সত্ত্বেও জ্ঞানচর্চায় ধর্মের ভেদাভেদ মানতে চাননি। তুসিকে সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যে চাঁদের পশ্চিম প্রান্তে ৫২ কিমি ব্যাস ও ৩ কিমি গভীর গর্তের নাম দেওয়া হয় ‘নাসিরুদ্দিন ক্র্যাটার’। রাশিয়ান ভাষাতেও অনুবাদ করা হয়। ইরান সরকার (১৯৯৩) এবং আজারবাইজান সরকার (২০০৮) তুসির স্মৃতির উদ্দেশ্যে ডাকটিকিট প্রকাশ করে।

অলতুসির জ্যোতির্বিজ্ঞানের তথ্যমূলক অনুসন্ধান পরবর্তীকালে ডেনমার্কের জ্যোতির্বিজ্ঞানী টাইকো ব্রাহের কাজকেও প্রভাবিত করে। বিখ্যাত মানমন্দির বিশেষজ্ঞ উলুঘ খান বাল্যাবস্থায় মারাঘা মানমন্দির দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে পরবর্তীকালে সমরখন্দে (১৪৪৮ সাল) একটি মানমন্দির নির্মাণ করেন। শোনা যায়, মোগল আমলে জয় সিং দিল্লীতে ‘যন্তর মন্তর’ নামের মানমন্দির গড়ে তোলেন তুসির কাজ অবলম্বন করে। বিস্ময়কর এই বহুমুখী প্রতিভাধর মানুষটি আজও গবেষণার বিষয় হয়ে রয়েছেন সারা বিশ্বে।

তথ্যসুত্র

  1. Abbas Ali Shameli , “Nasir al-Din Tusi and His Socio-Political Role in the Thirteenth Century”, published by Ahlul Bayt World Assembly, vol. 11, No.2, pp. 51-69, 2010.
  2. Planetary Motion – A Historical Perspective, by Norriss S. Hetherington, Greenwood press, 2006
  3. “Nasir al-Din al-Tusi.” World Eras, edited by Susan L. Douglass, vol. 2: Rise and Spread of Islam, 622-1500, Gale, 2002.
  4. “Nasir al-Din at-Tusi.” Science and Its Times, edited by Neil Schlager and Josh Lauer,vol. 2, Gale, 2001.
  5. New Results In the Research on Some Mathematical Works of Nasir Al-Din Al-Tusi, by A. Babayev and V. F. Medzlumbeyova, Institute Mathematics and Mechanics of the National Academy of Sciences of Azerbaijan.
  6. Science History Publication Ltd., provided by NASA Astrophysics Data System, pp. 128-130.
  7. Politics, Patronage and the Transmission of Knowledge in 13th – 15th Century Tabriz, edited by Judith Pfeiffer, BRILL, 2014, pp.15-34.

 

error: Content is protected !!
Verified by MonsterInsights