লেম বনাম ডিক: স্তানিসোয়াভ লেম কোনো কমিউনিস্ট গুপ্তচর সংস্থার নাম নয়
লেখক: দীপ ঘোষ
শিল্পী: দীপ ঘোষ
সময়টা ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বর মাস। এফবিআইয়ের দপ্তরে একটি অদ্ভুত চিঠি এসে পৌঁছল। চিঠিটা অদ্ভুত কারণ তার বিষয়বস্তু। সময়টা ঠান্ডা যুদ্ধের, আমেরিকার মননে জাঁকিয়ে বসেছে সোভিয়েত আর কমিউনিস্ট ভীতি। চিঠিতে বলা হয়েছে সেই কমিউনিস্টদেরই এক ষড়যন্ত্রের কথা, তারা নাকি কল্পবিজ্ঞানের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছেন বামপন্থী ভাবধারা আমেরিকানদের মধ্যে। সমস্ত বড় কল্পবিজ্ঞানের সংস্থা ও প্রকাশকদের নাকি ইতিমধ্যেই হাত করে ফেলা হয়েছে, লেখকদের মধ্যেও ছড়িয়ে আছে কমিউনিস্ট গুপ্তচর, আর তাদের মাথা এক গুপ্তসমিতি, তারা ব্যাবহার করছে এক ছদ্মনাম – ‘স্তানিসোয়াভ লেম’ অথবা ‘L.E.M’।
কে এই স্তানিসোয়াভ লেম? স্তানিসোয়াভ হেরম্যান লেমের জন্ম ১৯২১ সালের পোল্যান্ডে। আমরা যারা ইংরেজি সাইফি পড়তে অভ্যস্ত লেমের নাম তাদের কাছে খুব একটা পরিচিত নয়। কারণ লেমের সমস্ত সাইফি, প্রবন্ধ, দর্শন সংক্রান্ত লেখা বা সমালোচনামূলক লেখা – সবই ছিল পোলিশ ভাষায়। কিন্তু পরে লেমের গল্প প্রায় পঞ্চাশটিরও উপরের ভাষায় অনুবাদ হয়েছে এবং বিক্রি হয়েছে সাড়ে চার কোটির উপরে বই। বিখ্যাত কল্পবিজ্ঞান লেখক ও সমালোচক থিওডর স্টারজিওনের মতে লেম পৃথিবীর অন্যতম বিখ্যাত কল্পবিজ্ঞান লেখক। অনেক সিনেমাপ্রেমীর কাছে লেমের পরিচিতি তাঁর ‘সোলারিস’ বইটির উপর আধারিত সিনেমাগুলির জন্যে। গত বছর (২০২১ সাল) লেমের জন্মশতবার্ষিকীও ছিল বটে।
সোলারিস (১৯৭২) – পরিচালনাঃ আন্দ্রেই তারকোভস্কি
তাহলে এইরকম এক বিখ্যাত ইউরোপীয় লেখকের নামে এমন অদ্ভুত অভিযোগ কে বা কারা করেছিল আর তার কারণই বা কী ছিল? লেমের জীবনীকার ওইচে ওরলিন্সকির (Wojciech Orliński) বই থেকে জানা যায় গত শতাব্দীর দুই সেরা কল্পবিজ্ঞান লেখকের মধ্যে বন্ধুত্ব আর শেষে শত্রুতার এক অদ্ভুত নাটকের কথা, যার কুশীলব হয়েছিল এফবিআই থেকে পোলিশ কমিউনিস্ট পার্টিও। চিঠিটি লিখেছিলেন আর এক বিখ্যাত আমেরিকান কল্পবিজ্ঞান লেখক ফিলিপ কিনড্রেড ডিক। ১৯৬২ সালে ‘ম্যান ইন দি হাই ক্যাসল’ লেখার পরে ডিক তখন খ্যাতির মধ্যগগনে। মাত্র ৩৩ বছর বয়সে পেয়েছেন কল্পবিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার হুগো। ‘উবিক’ এবং ‘ডু অ্যান্ড্রয়েডস ড্রিম অফ ইলেকট্রিক শিপ’ -এর মত গল্পগুলি নিয়ে চলছে নিরন্তর চর্চা কল্পবিজ্ঞান সমাজে। এর মধ্যেই ডিক লিখে বসলেন এমনই এক অভিযোগ। তাঁর চিঠিতে জানালেন – লেম নামে কোনো ব্যক্তির অস্তিত্বই নেই, একটি কমিউনিস্ট কমিটি এই ছদ্মনামের আড়ালে বামপন্থী প্রচারের উদ্দেশ্য আমেরিকান সাইফিকে কালিমালিপ্ত করে চলেছে। এই বক্তব্যের পিছনে ডিকের যুক্তি ছিল যে লেমের লেখনীশৈলী বিভিন্ন লেখায় আলাদা, তিনি কখনো কখনো এমন অদ্ভুত সব শব্দ এবং ভাষা ব্যাবহার করেন তাঁর অনেক লেখাতে যেগুলি সাধারণত অন্যান্য লেখায় সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। ডিকের কথায় কমিউনিস্ট পার্টি ইতিমধ্যেই আমেরিকার অন্যতম প্রকাশনার দখল নিয়ে নিয়েছে যেখান থেকে বামপন্থী কল্পবিজ্ঞানই শুধু প্রকাশিত হয়ে চলেছে। এই ষড়যন্ত্রের পিছনে লেম ছাড়াও আরো যাদের প্রতি আঙুল তোলা হয়েছিল তাদের মধ্যে ছিলেন পিটার ফিটিং, ফ্রেডরিক জেমসন এবং ফ্রাঞ্জ রটেনস্টেইনার, যিনি ছিলেন লেমেরই সাহিত্য এজেন্ট। ডিক লিখেছিলেন – সাহিত্য সমালোচনার ও গুরুগম্ভীর প্রবন্ধের নামে একমুখী বদ্ধ চিন্তাভাবনার চর্চা করতে বাধ্য করা হচ্ছে, যার ফলে কল্পবিজ্ঞানের জগতে মুক্তচিন্তা ও মতামত আদানপ্রদান বন্ধ হতে চলেছে। এমনকি ডিকের মতে আমেরিকান কল্পবিজ্ঞানের অন্যতম সংস্থা ‘সায়েন্স ফিকশন রাইটার্স অফ আমেরিকা’ পর্যন্ত এই ষড়যন্ত্রের সাথে যুক্ত হয়েছে।
ফিলিপ কে ডিক
অন্য কেউ হলে এফবিআই হয়ত এই তত্ত্ব উড়িয়ে দিত। কিন্তু সোভিয়েতের সাথে ঠান্ডা যুদ্ধের জমানায় অনেকেই সাহিত্য সংস্কৃতির মধ্যে দিয়ে বামপন্থার আগ্রাসনের ভয় পাচ্ছিলেন। লৌহপর্দার ওদিক থেকে কমিউনিস্ট ধ্যানধারণা যাতে কল্পবিজ্ঞানের মধ্যে দিয়ে আমেরিকার তরুণ ও যুবসমাজকে ভাসিয়ে যেতে না পারে, তা নিয়ে এফবিআই এবং অন্যান্য অনেকেরই দুশ্চিন্তা ছিল। সেই সময়ের পোলিশ ক্ষমতাশীল সরকার সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টিরই অনুগত ছিল, কিন্তু লেম নিজে সেই পার্টির সদস্য ছিলেন না। বরং তিনি প্রচুর বার পার্টির নীতির সমালোচনাই করেছেন। পোলিশ পিপল রিপাবলিকের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের সখ্যতা লেম কোনোদিনই ভালো ভাবে নিতে পারেননি। এমনকি বিদেশী প্রকাশক ও এজেন্টদের সাথে লেমের সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়ার পিছনেও ছিল কমিউনিস্ট পার্টির সিকিউরিটি সার্ভিস। ১৯৮১ সালে যখন পোল্যান্ডে সৈন্যবাহিনির শাসন চালু হয় তখন লেম ঠিক করেন যে করেই হোক দেশ ছাড়োতে হবে। ১৯৮৩ সালে অস্ট্রিয়া থেকে অমন্ত্রণ পেয়ে লেম সস্ত্রীক ভিয়েনা চলে যান আর সেখানেই পরের পাঁচ বছর ছিলেন।
স্তানিসোয়াভ লেম
লেমের জীবন এবং লেখা থেকে পরিষ্কার যে সোভিয়েতের সাথে তাঁর কোনোরকম সম্পর্ক ছিল না। তাহলে এরকম গুরুত্বপূর্ণ অথচ অদ্ভুত অভিযোগের পিছনে ডিকের উদ্দেশ্য কী ছিল? এর উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ষাটের দশকে, যখন লেম ‘সায়েন্স ফিকশন অ্যান্ড ফিউচারোলজি’ বইতে ডিককে প্রতিভা হীন হাতুড়ে লেখক বলে উল্লেখ করেন। আসলে সেই সময়ের কমিউনিস্ট লৌহ কপাটের ভিতরে বসে আমেরিকান কল্পবিজ্ঞান সম্পর্কে খুব বেশি জানা সম্ভব ছিল না। তাই লেমের মনে আমেরিকান বা পশ্চিমি কল্পবিজ্ঞান নিয়ে খুবই নিচু ধারণা ছিল। অবশ্য লেম কল্পবিজ্ঞানকে কড়া সমালোচকের চোখে দেখতেন, তাঁর নিজের প্রিক্স দ্যা পাইলট’ বইটির উপর লেখা সমালোচনাই তার প্রমাণ। লেমের ভক্ত রটেনস্টেইনার ডিকের লেখা কিছু বিখ্যাত বই ১৯৭২ সালে লেমকে পাঠান। ডিকের লেখা ‘ম্যান ইন দ্যা হাই ক্যাসেল’ লেমকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। কিন্তু ‘উবিক’ উপন্যাসটি পড়ে লেম তাঁর প্রকাশককে জানালেন উপন্যাসটি তিনি পোলিশে অনুবাদ করতে চান। এমনকি তিনি তাঁর পরের প্রবন্ধে লিখলেন আমেরিকান কল্পবিজ্ঞান লেখকদের মধ্যে ডিক যেন বুজরুকদের দলের মধ্যে ভবিষ্যৎদ্রষ্টার মতো উজ্জ্বল।
Philip K. Dick: A Visionary Among the Charlatans নামক সেই দীর্ঘ প্রবন্ধের সার সংক্ষেপ এখানে উৎসাহী পাঠকদের জন্যে অনুবাদ করে দেওয়া হল।
ফিলিপ ডিক তার সমালোচকদের কাজটি সহজ করার মতো মোটেও জীবনযাপন করেন না। যেহেতু তিনি তাঁর ফ্যান্টাসটিক জগতের মাধ্যমে যতটা না একজন পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেন, তার থেকেও বেশি গোলকধাঁধায় হারিয়ে যাওয়ার এক মানুষের কথা মনে পড়ে তাকে দেখে। তাঁর কাজের প্রকৃত মূল্যায়ন ও সমালোচনার প্রয়োজন আজ আরো বেশি, কিন্তু তিনি তা পাননি। ডিকের কাজের একটি বৈশিষ্ট্য, তাঁর জঁরের লেখা সম্পর্কে অস্পষ্টতার থাকা সত্ত্বেও এর স্বচ্ছন্দতা, যা হাতুড়ে কারিগরদের দ্বারা গ্রাম্য মেলার পণ্যের কথা মনে করিয়ে দেয়। সেই কারিগররা, যারা একধারে চতুর অথচ নির্লোভ, তারা যে কতটা প্রতিভার অধিকারী তা তারা নিজেও জানে না। ডিক যেন নিয়ম মেনে আমেরিকার কল্পবিজ্ঞানের পেশাদারদের কাছ থেকে বহু ব্যবহারে জীর্ণ নির্মাণ সামগ্রীর ধ্বংসস্তূপ নিয়েছিলেন, আর প্রায়শই সেই পুরোনো ধারণাগুলিতে মৌলিকতার ঝলক যোগ করতেন। এই সব উপকরণ দিয়ে তাঁর নির্মাণগুলি কিন্তু সত্যিকারের নিজের। এই জগত যেন উন্মাদ হয়ে গেছে, সময়ের আকস্মিক এলোমেলো প্রবাহ এবং কার্য-কারণের একটি বমনউদ্রেককারী ও দুর্বোদ্ধ মানচিত্র, উন্মত্ত পদার্থবিজ্ঞানের জগত – এসবই সন্দেহাতীতভাবে তাঁর আবিষ্কার। যদি ডিকের লেখাগুলি সম মানের নাই বা হয়, বা সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি নাও করা যায়, তাহলেও কেবলমাত্র অস্বাভাবিক প্রভাব শক্তির দ্বারাই সেগুলিকে সেই পাল্প ঘরানার অংশ বলা যায়, যাতে বৌদ্ধিক মূল্যের অভাব থাকলেও এবং মূল কাঠামো কিন্তু মৌলিক – এটাই তো কল্পবিজ্ঞান তৈরি করে। এই ধরণের কল্পবিজ্ঞানের ভক্তরা ডিকের লেখার সবচেয়ে খারাপ দিক দ্বারা আকৃষ্ট হয়—আমেরিকান এসএফ-এর বহুচর্চিত তীব্র গতির কাহিনি, তারাদের কাছে পৌঁছানোর গল্প, এবং প্লটের এক মোচড় থেকে অন্য মোচড়ের দিকে অগ্রসর হওয়ার হঠকারী কার্যকলাপের বর্ণনা। কিন্তু এরাই আবার তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে যে, গল্পের ধাঁধাগুলি উন্মোচন করার পরিবর্তে, তিনি শেষ পর্যন্ত পাঠককে যেন এক যুদ্ধক্ষেত্রে ছেড়ে দেন, যে ক্ষেত্র যেন রহস্যের আভায় আচ্ছন্ন, যতটা সৃষ্টিছাড়া ততটাই অপরিচিত। তবুও ভ্রম উৎপাদনকারী এবং নবজন্মের কৌশলের তাঁর যে উদ্ভট মিশ্রণ, তাকে মহল্লার দেয়ালের বাইরে বেশি সমালোচক পছন্দ করেনি। এই বহিরাগতরা তাঁর আমেরিকান কল্পবিজ্ঞানের থেকে অলসভাবে নেওয়া নানা অগোছালো সাজসরঞ্জাম দ্বারা নিরস্ত হয়েছে।
ডিক রাজি হলেন অনুবাদের অনুমতি দিতে। কিন্তু সমস্যা হল অন্য জায়গায়। কমিউনিস্ট শাসনে পোল্যান্ডের থেকে বিদেশি টাকা দেওয়া নেওয়া করা ছিল প্রায় অসম্ভব। অর্থাৎ রয়ালটি নিতে হলে ডিককে পোল্যান্ডে এসে সেই টাকা নিয়ে সেটি পোল্যান্ডেই খরচ করে যেতে হবে। একইভাবে পোল্যান্ডের লেখকেরা ইউরোপের বাকি দেখগুলি বা আমেরিকায় গিয়ে তাদের প্রাপ্য রয়ালটি বুঝে নিয়ে আসতেন। কিন্তু ডিকের ক্ষেত্রে সমস্যাটি ছিল অনেক জটিল। ১৯৭২ সালে বিবাহ বিচ্ছেদ ও নিয়মিত নেশার দ্রব্য সেবনের ফলে ডিকের মানসিক সমস্যা খুব বেড়ে যায়। এরমধ্যে বাজারে প্রচুর দেনা করে তিনি প্রায় গৃহহীন হয়ে পড়েন। আত্মহত্যারও চেষ্টা করেন সেই সময়। তাই এর মধ্যে পোল্যান্ডে প্রমোদ ভ্রমণের চেয়ে রয়ালিটির টাকাটা ডলারে পাওয়ার জন্যে তিনি উৎসুক ছিলেন। লেম প্রচুর চিঠির মাধ্যমে ডিককে সমস্যাটি বোঝানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু চিঠিতে ডিক কখনো ভীষণ বন্ধুভাবাপন্ন আবার কখনো অভিযোগ তোলেন লেম তাঁকে অপমান করে ঠকিয়ে দিচ্ছেন। লেম এমনকি পোল্যান্ডে ডিকের চিকিৎসার বন্দোবস্ত করবেন বলে কথা দেন। কিন্তু ডিক অনড়, আর তাঁর উপরে তখন ভর্তি হয়েছেন মানসিক চিকিৎসার হাসপাতালে। স্বপ্ন আর বাস্তবের মধ্যে ফারাক করতে পারছেন না। প্রায় দেড় বছর চিঠি চালাচালির পরে বিরক্ত লেম শেষ পর্যন্ত ডিককে বলেন প্রকাশকের সাথেই টাকার অংকটা বুঝে নিতে। পোলি
শ পিপল পার্টিই যে বইয়ের বিক্রি থেকে লেখকের সম্মানিকের পরিমাণ সবটাই নিয়ন্ত্রণ করে এই কথা ডিক বিশ্বাস করতে পারেননি।
এর ফলে ডিক লেমের নামে অভিযোগ করেন এফবিআইয়ের কাছে। যদিও সেই সময় ডিকের মানসিক সুস্থতা নিয়ে সন্দেহ আছে। বিশেষ করে নিজের নামের যে সই তিনি ঐ চিঠিগুলিতে করেছেন সেগুলি একেবারেই অন্যরকম। এফবিআই এই চিঠিগুলিকে কতটা গুরুত্ব দিয়েছিল জানা যায়না, তবে লেমের এতে কিছুই এসে যায়নি। তাঁর সেই সময় আমেরিকা যাবার কোনো কারণ ছিল না আর আমেরিকার আইনও পোল্যান্ডে প্রয়োগের কোনো উপায় ছিল না। সেই জন্যে এতবড় একটি ঘটনা নিয়েও পরে লেম বা ডিক কেউই নিজেরদের আত্মজীবনীতে কিছুই লেখেননি। অনেক বছর পরে এফবিআই যখন তাদের চিঠির আর্কাইভ প্রকাশ করে তখন এই ঘটনা লোকসমক্ষে আসে। তবে এতে সোজাসুজি লেমের ক্ষতি না হলেও আমেরিকার লেখকদের মধ্যে লেমের প্রতি বিরূপ ধারণা তৈরি হয়ে গেছিল। ১৯৭৩ সালে সায়েন্স ফিকশন রাইটার্স অফ আমেরিকা লেমকে তাদের সাম্মানিক সদস্যপদ প্রদান করে। কিন্তু ১৯৭৬ সালে ৭০ শতাংশ সদস্য ভোটদান করে লেমের সস্যপদ কেড়ে নেন। যদিও তাতে লেমের জনপ্রিয়তা কোনভাবেই হ্রাস পায়নি। তবে লেম আরেক আমেরিকান লেখিকা উরসুলা লে গুইকে জানিয়ে দেন তিনি লে গুইয়ের বই আর অনুবাদ করতে পারবেন না। অন্যদিকে ডিকও নিষিদ্ধ ড্রাগ সেবনের পাশাপাশি অসংখ্য অবাক করা কল্পবিজ্ঞান লিখে যেতে থাকেন।
২০২০ সালে লেমের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে পোলিশ লেখক ও পরিচালক মেট্যুস পাকুলা একটি নাটক লেখেন এই ঘটনাটি অবলম্বনে – লেম বনাম ফিলিপ ডিক। নাটকে ‘ব্লেড রানারের’ লেখক ডিকের সাথে ‘সোলারিসের’ লেখক লেমের দেখা হয়। কল্পবিজ্ঞান জগতের দুই পথ প্রদর্শক, রাশিয়ান লৌহ প্রাচীরের দুপাশের দুই বিপরীত সমাজ আর সংস্কৃতি থেকে উঠে এসে নিজেদের কল্পবিজ্ঞানকে চেহারা দেওয়া দুই জিনিয়াস, নাটকের মাধ্যমে মুখোমুখি হন সব শেষে।
আজ লেমের জন্মশতবর্ষের পরে দাঁড়িয়ে প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের এই অদ্ভুত রাজনৈতিক টানানপোড়েনে আটকে পড়া দুজন অসহায় লেখকের কথা ভাবলে অবাক লাগে। আবার পরমূহূর্তেই মনে হয়, সত্যিই কি অবাক হবার কিছু আছে? আমাদের অবস্থা কি এর থেকে পালটেছে খুব বেশি? বহু লেখক আজও বলি হন রাজনীতির যূপকাষ্ঠে।
আমরা শুধু স্বপ্নই দেখতে পারি হয়ত এক সমান্তরাল দুনিয়ায় ডিক আর লেম অনুবাদ করছেন একে অপরের লেখা।
তথ্যসূত্র – ১) আউট অফ দিস ওয়ার্ল্ডঃ দ্যা লাইফ অফ স্তানিসোয়াভ লেম – ওইচে ওরলিন্সকি
২) কালচার ডট পিএল – পোলিশ কালচারাল সাইট
৩) রবার্ট অ্যাবারনাথির অনুবাদে স্তানিসোয়াভ লেমের লেখা – ফিলিপ কে ডিকঃ আ ভিসন্যারি অ্যামোং দ্যা শার্লাটানস
* লেখাটির একটি সংস্করণ শারদীয়া অদ্ভুতুড়ে ২০২১ সালে প্রকাশিত হয়েছিল।
Tags: kalpabiswa y7n1, Stanislaw Lem, দীপ ঘোষ, স্তানিসোয়াভ লেম