শ্বেত মৃত্যু

  • লেখক: Stanislaw Lem; অনুবাদ: সায়ক দত্ত চৌধুরী
  • শিল্পী: দীপ ঘোষ

মূল গল্প: The White Death, যা Mortal engines গ্রন্থের অন্তর্গত।

অ্যারাজেনা গ্রহে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল মাটির নীচে। এর কারণ তার একেশ্বর সম্রাট মেটামেরিক; যিনি নিরক্ষীয় অঞ্চলের পুরো তিনশো ষাট ডিগ্রি জুড়ে ছিলেন, আর তার ফলে নিজের রাজত্বকে ঘিরে ছিলেন কেবলমাত্র শাসক হিসেবেই নয় ভিত্তি ও ঢাল হিসেবেও; চাইতেন তার অতিপ্রিয় প্রজা এন্টেরাইটদের মহাকাশ থেকে নেমে আসা আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে। তাঁর আদেশেই গ্রহের উপরিতলে বিনা অনুমতিতে এমনকী একটা নুড়িপাথরও সরানো যেত না। ফলে অ্যারাজেনার মহাদেশগুলো উষর, রুক্ষ, প্রাণহীন হয়ে পড়ে থাকত। মাঝে মাঝে ঝলসে ওঠা বিদ্যুৎ তার সুকঠিন অগ্নিপ্রস্তরের পাহাড়গুলোকে কেটে ছিন্নভিন্ন করত আর উল্কার ঝাঁক বন্য আক্রোশে মাটিকে ক্ষতবিক্ষত করে গহ্বরের আল্পনা আঁকত। অথচ ভূ-গহ্বরের দশ মাইল নীচেই ছিল সম্পূর্ণ অন্য চিত্র। সেখানে দেখা যেত এন্টেনটেসদের। সেই গ্রহমাতার ফাঁপা অন্তঃস্থলে ছড়ানো থাকত উজ্জ্বল স্ফটিকের বাগান এবং সোনা ও রূপার তৈরি মনোমুগ্ধকর বহুতল প্রাসাদের সারি। সে সকল প্রাসাদের কোনটার আকার ডুডেকাহেড্রনের, কোনটার আইকসাহেড্রনের কোনটার আবার হাইপারবোলয়েডের যাতে আপনি যদি নিজের প্রতিবিম্ব দেখেন তার আকার হবে দু হাজার গুন বড়ো; যা দেখে আপনি নিজেকে দানব বংশের প্রতিভূ হিসেবে ভাবতেই পারেন। এইসব স্থাপত্য কেবল এন্টেরাইটসদের বাস্তুবিদ্যার পারদর্শীতার নিদর্শনই ছিল না, জাঁকজমক আর জ্যামিতিক আকারের প্রতি তাদের ভালোবাসার কথাও জানাত। লম্বা লম্বা নলের মাধ্যমে তারা সেই ভূগর্ভে আলো নিয়ে আসত। সে আলো কখনো বয়ে আসত পান্না, কখনো হীরা, কখনো চুণীর মধ্যে দিয়ে, ফলে তারা ইচ্ছামতো সৃষ্টি করতে পারত ভোর, দুপুর বা রক্তিম সন্ধ্যার পরিবেশ। তারা নিজেদের আকৃতিতে এতটাই মোহিত ছিল যে পুরো সভ্যতাটাই তাদের আয়নার মতো প্রতিফলিত করত। তাদের গাড়িগুলো ছিল স্ফটিকে তৈরি, চলত গরম গ্যাসের শক্তিতে। সেগুলোতে কোনো জানলা ছিল না, কারণ গোটাটাই তো স্বচ্ছ। তাতে চড়ে তারা যখন ভেসে যেত, তাদের সেই গর্বিত গমন চারিদিকের অট্টালিকায়, মন্দিরের গায়ে বহুবার প্রতিফলিত হত, সৃষ্টি করত এক অপূর্ব মায়াবী রঙিন উজ্জ্বলতা। এমনকি তাদের নিজস্ব আকাশও ছিল, যেখানে আগুনে বানানো মলিবডেনাম আর ভ্যানাডিয়ামের জালে বর্ণময় পাথুরে স্ফটিক ও লোহিতক শোভা পেত।

উত্তরাধিকার সূত্রে আর চিরস্থায়ীতার কারণে মেটামেরিকই ছিলেন শাসক। তাঁর ছিল এক শীতল, সুন্দর, বহু অঙ্গ প্রত্যঙ্গবিশিষ্ট কাঠামো, যার প্রাথমিক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গতে তাঁর মন অধিষ্ঠিত ছিল। যখন দীর্ঘদিনের গভীর চিন্তা ও সিদ্ধান্তগ্রহণ করতে করতে সেটার স্ফটিক জাল নিঃশেষিত হত, তখন মন স্থানান্তরিত হত অন্য অঙ্গে, আর এমন অঙ্গ তাঁর ছিল দশ লক্ষেরও বেশি। মেটামেরিক নিজে ছিলেন অরিজেনদের উত্তরসূরী, যদিও তাদের তিনি কখনই দেখেননি। তিনি কেবল জানতেন অরিজেনরা এক অদ্ভুত প্রজাতির হাতে, যেটা তাদের মহাকাশ অভিযানের মাধ্যমে নিজেদের সৌরজগতের বাইরেও আক্রমণ চালাত, নিশ্চিহ্ন হতে বসেছিল। সেই সময় তারা নিজেদের যাবতীয় জ্ঞান এবং টিকে থাকার ইচ্ছেকে একপ্রকার আণুবিক্ষণিক পারমাণবিক বীজে উপ্ত করে তার সাহায্যে অ্যারাজেনার পাথুরে প্রান্তরকে উর্বরা করে তুলেছিল। তারা নিজেদের নাম অনুসারেই এই গ্রহের নামকরণ করে। তারা কিন্তু এখানে কখনো পা রাখেনি। কারণ তারা চেয়েছিল তাদের নিশ্চিহ্নকারী শত্রুরা, যাদের তারা ফ্যাকাসে জাতি বলে ডাকত, যেন কখনো সন্দেহও না করে যে মহাবিশ্ব থেকে অরিজেনরা সম্পূর্ণ মুছে যায়নি। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত যে কোনো মূল্যে এই গ্রহের সুরক্ষা তারা বজায় রাখতে চেয়েছিল। এন্টেনটেসরা, যারা মেটামেরিকের থেকে উদ্ভুত, নিজেদের এই অস্বাভাবিক উৎপত্তির কথা প্রচার করতে চাইত না।

অরিজেনদের এই বীভৎস বিনাশ, এন্টেনটেসদের এই উত্থানের কথা এক ভিসুভীয় আদিস্ফটিকে লিপিবদ্ধ করে গ্রহের সুগভীর অভ্যন্তরে লুকিয়ে রাখা ছিল। তাদের অভিমত ছিল এই ইতিহাস কেবলমাত্র শাসকই জানুক আর মনে রাখুক।

গ্রহের অভ্যন্তরে পাথর আর চুম্বকীয় ভূস্তর কেটে বসতি বিস্তারের সময় মেটামেরিক দক্ষ খনকদের প্রাচীরের সারি বানাতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেগুলো নিক্ষেপ করা হয়েছিল মহাশূন্যে। সেই প্রস্তর প্রাচীরগুলো গ্রহের চারদিকে বিভিন্ন কক্ষপথে পাক খেয়ে এমন নারকীয় বাধার সৃষ্টি করেছিল যে তাকে পার করে কোনো কিছুর পক্ষেই অক্ষত অবস্থায় মহাকাশ থেকে নেমে আসা অসম্ভব ছিল। ওই গ্রহে যোগাযোগ অসম্ভব বুঝে মহাকাশের অভিযাত্রীরা ওই অঞ্চলটাকে এড়িয়ে চলত। একে তারা নাম দিয়েছিল ‘কালী ঠোক্কর’ কারণ সেখানে কালো ব্যাসাল্ট আর পোফ্রির বিশাল চাঁইগুলো সমানে একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা খেত। ফলস্বরূপ সেগুলো সমানে উল্কাবৃষ্টির সৃষ্টি করত। তার সঙ্গে ওটা বহু ধুমকেতুর জন্মস্থান ছিল। আজও বৃশ্চিক নক্ষত্রপুঞ্জের বিভিন্ন অঞ্চলে যত উল্কাপিণ্ড আছড়ে পড়ে ওটাই তার বেশির ভাগের উৎপত্তিস্থল ।

প্রবল উল্কাবৃষ্টি ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ে অ্যারাজেনার পাথুরে মাটিকে ছিন্নভিন্ন করত। নিরন্তর প্রবল আঘাতে ছিটকে উঠত আগুনের স্রোত যার ফলে রাত হয়ে উঠত আলোকময় দিনের মতো। আবার দিনে সেই উল্কাবৃষ্টি এত ধুলো আর ধোঁয়ার মেঘ সৃষ্টি করত যে তার ফলে অকালে রাতের আঁধার নেমে আসত। কিন্তু তার সামান্যতম কম্পনও এন্টেনটেসদের জগতে পৌঁছাতে পারত না। কেউ যদি সেই প্রবল পাথুরে ঘুর্ণাবাত্যার মধ্যে দিয়ে সেই গ্রহে নামার সাহস করত, যা প্রকৃতপক্ষে অসম্ভব, তবে সে দেখতে পেত গ্রহটা যেন এক বহু ক্ষতচিহ্নে ভরা খুলির মতো। এমনকী এন্টেরাইটরা সেই পাতাললোকে প্রবেশের যে দ্বার তৈরি করেছিল তাও দেখতে ছিল এক ক্ষতবিক্ষত পাথরের খণ্ডের মতো।

চার হাজার বছর ধরে কেউ সেই গ্রহে পৌঁছাতে পারেনি। তাও মেটামেরিক একদিনের জন্যেও তাঁর নিরন্তর নজরদারির কড়া নির্দেশ শিথিল করেননি।

একদিন এন্টেরাইটদের একটা দল মাটির উপর উঠেছিল পরিদর্শনের কাজে। হঠাৎ করেই তারা দেখতে পেল ধু ধু প্রান্তরে দৈত্যাকার পানপাত্রের মতো কী যেন একটা কাত হয়ে পড়ে আছে যার অনেকটাই মাটি আর নুড়িপাথরের মধ্যে গাঁথা। সেটার গায়ে বহু ছিদ্র আর আঘাতের দাগ। তৎক্ষনাৎ বহুমাত্রিক নক্ষত্রবিদদের পাঠানো হল। তারা সবকিছু দেখেশুনে জানাল যে ওটা প্রকৃতপক্ষে অজানা জগত থেকে ছিটকে পড়া এক বিশাল নক্ষত্রযানের অংশ। যা বোঝা যাচ্ছে যানটা বেলনাকার, সবেগে আছড়ে পড়ার ফলে যার সামনের দিকটা অনেকটাই মাটির নীচে ঢুকে রয়েছে। যতটুকু দেখা যাচ্ছে তার বেশির ভাগই ভুসাকালি মেখে কালো হয়ে আছে। পিছনের পেয়ালার মতো অংশগুলো দেখে তাদের মাটির নীচের অবতল প্রাসাদগুলোর কথা মনে পড়ে গেল। মাটির গভীর থেকে সাঁড়াশির মতো দেখতে যন্ত্রের ঝাঁক উঠে এল। তাদের সাহায্যে অতি সাবধানে গোটা ভাঙাচোরা যানটাকে উদ্ধার করে পাতাল রাজ্যে নিয়ে যাওয়া হল। তারপর মহাকাশযানটা আছড়ে পড়ায় যে গর্তটা সৃষ্টি হয়েছিল সেটাকে এন্টেরাইটরা বুজিয়ে সমতল করে ফেলল যাতে বাইরে থেকে দেখে, সেখানে যে বহির্বিশ্বের কোনো যন্ত্র পড়েছিল, তা কোনোদিন বোঝা না যায়। সব কাজ শেষ হলে পাতাল জগতের প্রবেশপথটা বুম করে একটা ফাঁপা আওয়াজ তুলে বন্ধ হয়ে গেল।

সুবিশাল, মহার্ঘ্য, আলোকদীপ্ত, প্রধান পরীক্ষাগারে সেই ঝুলকালি মাখা মহাকায় যানটার ধ্বংসাবশেষ পড়ে ছিল। ওটাকে একটা পুড়ে কালচে হয়ে যাওয়া গাছের গুঁড়ির মতো দেখতে লাগছিল। বিজ্ঞানীরা কিন্তু জানতেন এই পরিস্থিতিতে কী করতে হবে। তাঁরা প্রথমে চকমকে স্ফটিক দিয়ে সেটার উপরিতল পরিষ্কার করে হীরার টুকরো দিয়ে সেটাকে কেটে ফেললেন। ওটার নীচ থেকে বেরিয়ে এল দ্বিতীয় একটা আবরণ। অদ্ভুত ধরণের, ঝকঝকে সাদা। এটা তাঁদের কিছুটা হতবুদ্ধি করলেও শেষমেশ সে আবরণ কার্বোরেন্ডাম ড্রিল দিয়ে কেটে ফেলা গেল। এবার বেরিয়ে এল তৃতীয় একটা স্তর। সেটাকে আর কিছুতেই ছিদ্র করা গেল না। সেই আবরণে একটা সাদাসিধে দরজা দেখতে পাওয়া গেল, কিন্তু সেটাকে কিছুতেই খোলা গেল না।

সবচেয়ে বয়স্ক বিজ্ঞানী ওফানির দরজাটাকে খুব ভালো করে পর্যবেক্ষণ করলেন। নানা পরীক্ষানিরীক্ষার পর বোঝা গেল দরজাটা শব্দে সাড়া দিতে পারে। কোনো একটা নির্দিষ্ট শব্দ উচ্চারণ করলেই সেটা খুলে যাবে। কিন্তু তারা সেই শব্দটা জানত না, জানার কোনো উপায়ও ছিল না। তারা বহুক্ষণ ধরে নানা শব্দ উচ্চারণ করল, যেমন ‘মহাবিশ্ব’, ‘নক্ষত্র’, ‘চিরকালীন উড়ান’, এমনি আরো কত কিছু। কিন্তু দরজার পাল্লা যেমন বন্ধ ছিল তেমনই রইল।

“মনে হচ্ছে মেটামেরিককে না জানিয়ে আমাদের এই দরজা খোলার চেষ্টা করাটা ঠিক হচ্ছে না।” ওফানির বললেন। “আমি যখন খুব ছোট্ট, একটা কিংবদন্তী শুনেছিলাম যে মহাবিশ্বে নাকি এক শ্বেতবর্ণের জীব আছে যারা ধাতুর তৈরি প্রাণীদের শিকার করে বেড়ায়। ধাতব জীবনকে ধ্বংস করে তারা নাকি প্রতিশোধ নেয়।”

কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত সকলে প্রচণ্ড ভয়ে বাকরূদ্ধ হয়ে দেখল, দেওয়ালের মতো বড়ো অংশটাতে আটকানো বিরাট দরজাটা খুলে গেছে। এতক্ষণ বহু সাধ্যসাধনাতেও যেটার পাল্লাগুলোকে নাড়ানো যায়নি, “প্রতিশোধ” শব্দটা উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গেই সেটা সক্রিয় হয়ে উঠেছে।

সঙ্গে সঙ্গেই সামরিক সাহায্য চেয়ে পাঠানো হল। যখন ‘আগুন ছোঁড়া’-র দল প্রস্তুত হল তখন নীল-সাদা স্ফটিকের আলো ছড়িয়ে অনুসন্ধানকারীরা তাদের সঙ্গে সেই মহাকাশ যানের স্থির অন্ধকার অন্দরে প্রবেশ করল।

ভিতরের প্রায় সব যন্ত্রপাতিই ভেঙেচুরে একাকার হয়ে গিয়েছিল। ঘণ্টার পর ঘণ্টা তারা সেই ধ্বংসস্তূপের মধ্যে ঘুরে বেড়াল। ওরা কোনো না কোনো চালক বা নাবিককে খুঁজে বেড়াচ্ছিল, কিন্তু তেমন কারো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া গেল না। তারা একবার ভাবল এই জাহাজটা জীবন্ত নয়তো? হতেই পারে, কারণ তাদের রাজাই তো এই জাহাজটার চেয়ে হাজারগুন বড়ো, অথচ তিনি এক চিন্তাশীল জীব। কিন্তু তড়িৎ পরিবহনকারী তার আর যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করে দেখা গেল সেগুলো এত ছোটো, সরল কিম্বা হালকাভাবে সংযুক্ত যে জীবনের কোনো বিকাশ তাদের মাধ্যমে হওয়া অসম্ভব। নাঃ, এ জাহাজ কেবলমাত্র এক উড়ন্ত যান, চালক ছাড়া একেবারেই ঠান্ডা, নিস্ক্রিয়।

একটা ঘরে, দেখে বোঝা যাচ্ছিল সেটাই জাহাজটার পরিচালন কক্ষ, ধাতব বর্মে ঢাকা দেওয়ালের ধারে, আশপাশে কিছু জায়গায় দেখা গেল একটা অদ্ভুত লাল রঙের তরল জমে আছে। মনে হল কোনো কারণে সেই রক্তিম তরল চারদিকে ছিটকে পড়েছিল। কাছে যেতে সেটা তাদের রূপালি আঙুলগুলো রাঙিয়ে দিচ্ছিল। এছাড়া সেখানে তারা খুঁজে পেল কিছু ভিজে লাল রঙের ছেঁড়া কাপড় আর সাদাটে রূপালি শক্তমতো অজানা কিছুর টুকরো। সেগুলো খুব শক্ত নয় অবশ্য, খানিকটা চকের মতো। তাদের স্ফটিকের আলোতে অল্প আলোকিত সেই ছায়াময় ঘরের অন্ধকারে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে না জানি কেন এক অজানা ভয়ে তাদের অন্তরাত্মা পর্যন্ত কেঁপে উঠল। কিন্তু ততক্ষণে সম্রাটের কাছে খবর পৌঁছে গিয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি তাঁর প্রতিনিধিদল পাঠিয়ে দিলেন। কঠোর আদেশ এল যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই বিদেশি যানটিকে তার যাবতীয় যন্ত্রপাতি সমেত ধ্বংস করে ফেলতে হবে, বিশেষত তার আরোহীদের পারমাণবিক আগুনে পুড়িয়ে নিঃশেষ করতে হবে।

বিজ্ঞানীরা জানাল যানটিতে কেউই ছিল না। কেবলমাত্র অন্ধকার, ভাঙা যন্ত্রপাতি, জাহাজটির ছিন্নভিন্ন অন্ত্র, লোহিত তরল, ধুলো আর ভেসে বেড়ানো লাল রঙের ছোপ ছোপ কুচি কুচি বস্তুখণ্ড ছাড়া তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। প্রধান রাজ প্রতিনিধি আদেশ দিলেন পারমাণবিক চুল্লিগুলো জ্বালানোর।

“সম্রাটের নামে জানানো হচ্ছে,” তিনি বললেন, “লালবর্ণের যা যা এই বিনাশ তরণীতে পাওয়া গেছে তা সবই শ্বেত মৃত্যুকে বয়ে আনতে পারে। আর একবার সে প্রবেশ করতে পারলে জীবিত সকলকে আক্রমণ করে হত্যা করবে।”

“যদি শ্বেত মৃত্যু থাকেও, তবে সে এখন আর আমাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। কারণ এই জাহাজে জীবনের কোনো অস্তিত্ব নেই, আর এই জাহাজে যেই আসার চেষ্টা করুক, আমাদের ঘুরন্ত পাথর পাঁচিলে ধাক্কার ফলে সে নিঃসন্দেহে মারা গেছে।” তারা বলল।

“সেই ফ্যাকাশে শয়তানদের ক্ষমতা অসীম। বার বার মারা যাওয়ার পরেও বার বার তারা বেঁচে ওঠে। এমনকি তাদের নিজেদের সূর্যের সীমানার বাইরেও। হে পরমাণু বিশ্লেষক, আগুন জ্বালো।”

এ কথা শুনে প্রাজ্ঞ আর বিজ্ঞানীরা চিন্তিত হয়ে পড়ল। তবে বিনাশের এই বার্তা তারা ততটা বিশ্বাস করল না, তাদের মনে হল তেমন সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তবু তারা পুরো জাহাজটাকে প্রথমে প্ল্যাটিনামের নেহাইয়ের ওপর রেখে পিটে পিটে চূর্ণবিচূর্ণ করে ফেলল, তারপর তার টুকরোগুলোকে তীব্র তেজস্ক্রিয় আগুনে এমনভাবে পোড়ালো যাতে প্রতিটি পরমাণু আলাদা হয়ে যায়; কারণ কে না জানে যে পরমাণুরা ইতিহাসবিমুখ, কোনো প্রতিশোধ বা আগ্রাসনের উত্তরাধিকার তারা বহন করে না। তারা সকলে সমান। পবিত্রতম নক্ষত্র, মৃত গ্রহ, কিম্বা উন্নত প্রাণীদেহ, মহাবিশ্বের যেখান থেকেই তারা আসুক না কেন, তাদের মধ্যে ভালো মন্দের ভেদাভেদ থাকে না। সেজন্যেই তাদের ভয় পাওয়ার মতো কিছু নেই।

তবু এরপরেও এই পরমাণুগুলোকে জমিয়ে তারা একটা তাল বানিয়ে সুদূর নক্ষত্রের দিকে ছুড়ে ফেলল। তারপর স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, “আমরা রক্ষা পেলাম। এখন আর কোনো ক্ষতির সম্ভাবনা নেই।”

কিন্তু যখন প্ল্যাটিনামের হাতুড়িগুলো জাহাজটাকে গুঁড়িয়ে ফেলছিল, রক্তে ভেজা কাপড়ের অতিসূক্ষ্ম ছিন্ন সুতো থেকে ঝরে পড়ল এক অদৃশ্য বীজগুটি, এত ছোটো যে বালির একটা অতিক্ষুদ্র দানাও তেমন কয়েকশো-কে চাপা দিতে পারে।

ভাসতে ভাসতে সেটা পৌঁছে গেল ধুলো আর ছাই জমা একটা পাথুরে গুহাকোণে। তারপর এক রাত্রে তার থেকে বেরিয়ে এল ছোট্ট একটা অঙ্কুর। সাদা রঙের। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটার পাশে গজিয়ে উঠল আর একটা, তারপর আরেকটা। এভাবেই দুই থেকে তিন, তিন থেকে চার, কয়েকশো, কয়েক হাজার। তারপর সেগুলো বহতা বায়ুর গ্যাস থেকে টেনে বের করতে লাগল অক্সিজেন আর জলীয় বাস্প। এর সঙ্গে সঙ্গে মরিচা বাসা বাঁধল সেই ঝকঝকে শহরের মূল স্তম্ভগুলোতে, আর অদৃশ্য মাকড়শার জালের মতো ছড়িয়ে গেল, জড়িয়ে গেল ধাতুর গায়ে। এন্টেরাইটরা যখন জেগে উঠল তারা জানতেও পারল না তাদের অন্তঃস্থলে বাসা বেঁধে রয়েছে সাক্ষাৎ মৃত্যু, তারা তার বাহকে পরিণত হয়েছে। এক বছরের মধ্যেই তারা প্রত্যেকে মৃত্যুমুখে ঢলে পড়ল। গুহাগুলোর মধ্যে যন্ত্ররা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, স্ফটিক থেকে আলো বেরোনো বন্ধ হল আর এক বাদামি কুষ্ঠ উজ্জ্বল সৌধশিখরগুলো খেতে শুরু করল। যখন শেষতম পরমাণু থেকে তাপ উৎপাদন বন্ধ হল, নিকশ রাত্রি ছাইল চারিদিকে, সেই আঁধারে ভঙ্গুর কঙ্কাল ভেদ করে, করোটির ওপর সাম্রাজ্য বিস্তার করে, দৃষ্টিহীন কোটর ভরতি করে পড়ে রইল একটা স্যাঁতসেঁতে, সাদা, মনখারাপ করা, সর্বগ্রাসী আস্তরণ।

Tags: kalpabiswa y7n1, science fiction, Stanislaw Lem, কল্পবিজ্ঞান গল্প, দীপ ঘোষ, সায়ক দত্ত চৌধুরী, স্তানিসোয়াভ লেম

2 thoughts on “শ্বেত মৃত্যু

  • July 1, 2022 at 11:25 pm
    Permalink

    খুব সুন্দর অসংখ্য ধন্যবাদ লেখক কে এত ভালো একটি গল্প অনুবাদ করার জন্যে 🙏

    Reply
    • July 29, 2022 at 7:18 pm
      Permalink

      অনেক ধন্যবাদ উৎসাহ দেওয়ার জন্য।

      Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!