কালজয়ী

  • লেখক: সায়ংতরী ঘোষ
  • শিল্পী: প্রমিত নন্দী

প্রকাণ্ড ড্রয়িং-রুমটার সঙ্গে মানানসই বিশাল সোফার এক কোণে জড়োসড়ো হয়ে বসেছিল আকাশ। ছোটো শহর থেকে ছোটো-ছোটো ধাপ বেয়ে উঠে এসে ঝাঁ-চকচকে জোহানেসবার্গে ছোট্ট স্টার্ট-আপ শুরু করার পরে এই দু-বছরে উন্নতি তার অনেক হয়েছে। কিন্তু এই মাপের কোনো খদ্দের ওদের আজ পর্যন্ত কখনও জোটেনি। নাথান তো শুনে বিশ্বাসই করতে পারছিল না। চোখ কপালে তুলে সে বলেছিল, “দিস ইস ইনসেন! সত্যি বলছ? সৌর লাহিড়ী, মানে, দি সৌর লাহিড়ী ইস আস্কিং ফর আস?”

অবাক আকাশও হয়েছিল, কিন্তু তার বিশ্বাস আছে নিজেদের কাজের ওপর। প্রফেসর ও বিজ্ঞানী বাবার সাধারণ সন্তান হওয়ার দরুণ ছোট্টবেলা থেকে সে জানে হাড়-ভাঙা খাটুনি আর অধ্যবসায়ের দাম। বাবা বিশ্বাস করতেন যে তথাকথিত প্রতিভা বা বুদ্ধিমত্তা আকাশের নেই। কিন্তু তিনি তো কোনোদিন ভাবতেও পারেননি যে সেই আকাশ আজ বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করেই এমন জায়গায় উঠে আসবে যে এরকম একটা আভিজাত্যে ঠাসা ঘরে বসে কাস্টমারের সঙ্গে তার কাজের কথা আলোচনা হবে। আকাশ তাই সৌর লাহিড়ীর কাছ থেকে মেল’টা পেয়ে তত’টা ঘাবড়ায়নি। বিরাট বড়ো ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করার অভিজ্ঞতা তার বহুদিনের।

জায়গাটা খুঁজে পেতে আজ অবশ্য আকাশ-কে একটু বেগ পেতে হয়েছে। জোহানেসবার্গ শহর ছাড়িয়ে পূর্বদিকে প্রায় দু-ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে দালস্ট্রাম পৌঁছে গেছিল সে। জায়গাটা বেশ ফাঁকা, ছড়ানো ছেটানো ছোটো-বড়ো ঝিল, আর বিশাল এলাকা জুড়ে কতকগুলি সাবেকী অভিজাত পরিবারের এস্টেট। বিভ্রান্ত হয়ে আধঘণ্টা ঘোরাঘুরির পর পুরু পাথুরে দেওয়ালের পাঁচিলে ঘেরা পুরোনো আমলের কাসল ধাঁচের বাড়িটায় পৌঁছালো আকাশ। হাতে সময় নিয়ে বেরিয়েছিল বলে অন্তত অ্যাপয়েন্টমেন্টের সময়টা পেরিয়ে যায়নি। সোফায় বসে ফাইলপত্র সামলে নিয়ে আলতো করে ঘাড়ের পেছনে হাত দিয়ে রেকর্ডারটা অন করে দিল আকাশ। সঙ্গে সঙ্গে এক ইঞ্চি জায়গা জুড়ে নীলচে সবুজ চাপা আলোর ওঠানামা শুরু হল খুব ঢিমে লয়ে। বিজ্ঞাপনের চটকে শখ করে ‘মেমোরেবল’ কোম্পানির একখানা ছোট্ট আর্টিফিসিয়াল মেমোরি আকাশ যোগ করিয়েছিল তার মেরুদণ্ডের গোড়ায়; মাত্র পাঁচ টেরাবাইটের জিনিসটা ব্যবহার করার মতো কোনো স্মরণীয় ঘটনা গত আট মাসে তার জীবনে ঘটেনি। তার প্রতিদিনের মামুলি জীবনযাত্রার জন্যে জন্মসূত্রে পাওয়া, ভরসার অযোগ্য, অতিদূর্বল মনুষ্যমস্তিষ্কখানিই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু আজ খুব স্পেশাল দিন। আজ সৌর লাহিড়ীর ইন্টারভিউ দিয়েই মেমোরেবল-এর উদবোধন হোক।

নিজেকে একটু গুছিয়ে নিয়ে আকাশ ঘরটাকে দেখতে লাগল। প্রাচীনতার ইঙ্গিতগুলিকে স্পষ্টভাবে সামনে রেখে আধুনিক সমস্ত চাকচিক্য দিয়ে সাজানো বসার ঘরটি; তাই সাজসজ্জার বাহুল্য দেখার মতো। দেওয়াল-জোড়া সিংহের পোর্ট্রেট থেকে মেঝেতে ওজনদার দামি কার্পেট, কোনো কিছুরই অভাব নেই। তবু সর্বত্র একটা রুচির ছাপ আছে। হতেই হবে, হাজার হোক, পৃথিবীবিখ্যাত লেখকের বাড়ি বলে কথা! আর যে সে লেখক না, বাঙালি থ্রিলার লেখক, যিনি কিনা বিশ্বজয় করে বসে আছেন!

“রাইট অন টাইম”, হঠাৎ একটা গমগমে কণ্ঠস্বর আকাশের চিন্তার রেখাগুলিকে মুহূর্তে অবিন্যস্ত করে দিল। চমকে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে হাতে-ধরা ফাইল-খানা পিছলে পড়ে গেল মাটিতে।

“সরি, স্যার… গুড মর্নিং, স্যার…” কোনোরকমে কথাগুলো বলে আকাশ মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ইস, ফার্স্ট ইম্প্রেশনটা মাঠে মারা গেল!

“গুড মর্নিং, প্লিজ,” হাসিমুখে কথাগুলি বলে হাতের ইশারায় আকাশকে বসতে বললেন ভদ্রলোক। তারপর লম্বা লম্বা পা ফেলে ওর ঠিক সামনে ধোঁয়াটে কাচের সেন্টার টেবিলটার ওপাশের সোফাটায় জাঁকিয়ে বসলেন তিনি।

সৌর লাহিড়ী! এরকম একটা মানুষকে নামজাদা সব পত্রিকার কভার ভিডিয়োতে দেখা আর ড্রইং রুমের সোফায় সামনে থেকে দেখার তফাতটা আকাশের গায়ে-কাঁটা দেওয়া শিরশিরানিটাই বুঝিয়ে দিচ্ছিল। সত্তর পেরিয়েও চেহারার জৌলুস অক্ষত যেন। সাদা ধবধবে ব্যাকব্রাশ করা চুল, দাড়ি-গোঁফহীন পরিপাটি চেহারা, বুদ্ধিদীপ্ত গভীর চোখের দৃষ্টি রিমলেস চশমা-খানা ভেদ করে ঝকঝক করছে।

“ইটস অ্যান অনার টু মিট ইউ, স্যার” হৃদয় থেকেই কথাটা বলল আকাশ।

“তুমি তো বাঙালি? ভট্টাচারয়া দেখলাম মনে হল, এ সারনেম তো বেঙ্গলের বাইরে হয় বলে জানি না।” আকাশকে হতচকিত করে পরিষ্কার বাংলায় বললেন ভদ্রলোক। কথাবার্তাটা যে বাংলায় হতে পারে, আর এতখানি স্বচ্ছন্দ হতে পারে, আকাশ ভাবতেও পারেনি।

“হ্যাঁ, স্যার, বাঙালি…”

“কোথায় বাড়ি?”

“হুগলি…”

“আচ্ছা, আচ্ছা… মানে একেবারে সমুদ্র-সৈকতের লোক তো তুমি… খুব ভালো, খুব ভালো,” একটু অন্যমনস্কভাবে চশমার কাচ মুছতে মুছতে বললেন ভদ্রলোক। তারপর চশমাটা চোখে তুলে একটা অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমি দ্য কুইল-এর মি. উইন্ডেলের কাছে তোমাদের কথা শুনি। শোনামাত্রই তোমাদের কোম্পানির কাজের আইডিয়াটাই আমার ভীষণ ভালো লাগে।”

“থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার। আসলে আমাদের কোম্পানি ‘এপিক’-এ আমরা চেষ্টা করছি একজন সাহিত্যিককে তার সমস্ত সম্ভব পাঠক-পাঠিকার কাছে পৌঁছে দেওয়ার। শিল্পীদের ক্ষেত্রেও একই রকম একটা সুযোগ তৈরি করার…” একটু হেসে যোগ করল আকাশ, “প্রতিভাবান শিল্পীদের ক্ষেত্রে অনেক সময় সবাই বলে না যে ‘হি ওয়াজ অ্যা ম্যান বিফোর হিস টাইম?’ এ ব্যাপারটার সঙ্গেই আমাদের সরাসরি সংঘাত বলতে পারেন।”

“ভেরি নাইস… তবে আইন-কানুনের ব্যাপারগুলো একটু বুঝিয়ে বলো তো… এই টাইম পারমিট নিয়ে নানান সমস্যা তো আজ থেকে দেখছি না, সেই ছোট্টবেলা থেকে কত কি দেখলাম এই নিয়ে…”

“সে নিয়ে একেবারে চিন্তা করবেন না, স্যার। ‘এপিক’এর প্রতিটি প্রজেক্ট পুরোপুরি সেকশন ৬১-সি অ্যাপ্রুভড।”

“বেশ, বেশ”, খানিকটা আশ্বস্ত হয়ে লাহিড়ী বললেন, “আমরা হলাম পুরোনো আমলের মানুষ, বুঝলে তো… টাইম মুভমেন্ট যখন হচ্ছে, তখন স্কুলে পড়ি… এ নিয়ে প্রথমটায় ঢাক-ঢাক গুড়-গুড়টা ছিল বেশি… তারপর ফিফটিস-এ যখন লিগাল স্ট্রাকচারটা পরিষ্কার হয়ে গেল তারপর থেকে কত রকম উদ্যোগ, কত নতুন বিজনেস… কিন্তু এ ব্যাপারটার মধ্যে যে এতটা ক্রিয়েটিভ একটা দৃষ্টিভঙ্গী যোগ করা যায়, তোমাদের কথা শুনে প্রথম সেটা বুঝলাম।”

এ পর্যন্ত বলে একটু ইঙ্গিতপূর্ণভাবে একটু থেমে, সামনে ঝুঁকে পড়ে টেবিলের ধোঁয়াটে কাচের ওপর মুখের ছায়া ফেলে লাহিড়ী বললেন, “দ্যাখো আকাশ… তোমায় আকাশ বলতে পারি তো?”

“সিউর স্যার…”

“দ্যাখো, আমার বয়স হয়েছে… বাইশ বছর বয়েস থেকে আজ এই তিয়াত্তর অব্দি শুধু লিখে যে খ্যাতি পেয়েছি, আর যে পরিমাণ টাকা রোজগার করেছি, বুঝতেই পারছ, এরপর আমার এখানে দাঁড়িয়ে আর বেশি কিছু চাওয়ার থাকতে পারে না… নাউ, আই ওয়ান্ট দ্য কার্টেন টু ফল উইথ অ্যা ব্যাং… একটা জবরদস্ত রিটায়ারমেন্ট, বুঝলে? আর সে জন্যেই তোমাকে ডাকা…”

সৌর লাহিড়ীর রিটায়ারমেন্ট প্রজেক্ট! আকাশের চোখের সামনেটা ঝাপসা হয়ে গেল যেন এক মুহূর্তের জন্যে। এক লাফে ওদের কোম্পানির নাম কোন উচ্চতায় উঠে যাবে, ভাবতে গিয়েই হিমশিম খেয়ে গেল সে। কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বিহ্বলতা কাটিয়ে সে গলায় একটা গদগদ ভাব এনে বলল, “এটা তো আমাদের কাছে একটা বিশাল বড়ো পাওয়া, স্যার। কথা দিচ্ছি, আপনাকে হতাশ করব না। আপনি কী চাইছেন আমাকে বুঝিয়ে বলুন, প্রত্যেকটি ছোটো-ছোটো জিনিসের খেয়াল রাখা হবে, ‘এপিক’এর পক্ষ থেকে এটুকু আমি বলতে পারি।”

“গুড, ভালো লাগছে তোমায় কনফিডেন্ট দেখে… তাহলে শোনো, এক কথায় বলতে গেলে, আমি একটা ফোর-ফোল্ড পাবলিকেশন চাইছি আমার লাস্ট নভেলের জন্যে। দুই-এক-এক… এই হবে ডিস্ট্রিবিউশন। বলো, পারবে?”

ফোর ফোল্ড! উরিব্বাস! কাজটা কঠিন হবে। টাকা-পয়সা, কেনা-কাটা, ইনভেস্টমেন্ট, লোকবলের একটা দ্রুত হিসেব মনের মধ্যে করতে করতে আকাশ বলল, “পারব না কেন, স্যার? কিন্তু পাস্টে পাবলিশ করবেন? মানে সাধারণত সবাই ফিউচারটাই…”

ডান হাতটা হঠাৎ তুলে ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে লাহিড়ী বললেন, “সাধারণত যা হয়, সেটা সৌর লাহিড়ীর ক্ষেত্রে হবে ভাবছ কেন? সাধারণত কি কেউ ফোর-ফোল্ড পাবলিশ করে?”

ভদ্রলোক কথাগুলো বলার সময় হঠাৎ করে কেমন যেন কঠোর হয়ে গেলেন বলে একটু যেন হোঁচট খেল মখমলের মতো মসৃণ আলোচনার সুর। সামলে নিয়ে গলার স্বরে অনেকখানি উচ্ছ্বাস ভরে নিয়ে আকাশ বলল, “সে তো বটেই, স্যার। ইট হ্যাজ টু বি সামথিং এক্সট্রাঅর্ডিনারি!”

কথাটা শুনে আবার খানিক নরম হয়ে লাহিড়ী বললেন, “হুম। আমি দুটি পাস্ট পাবলিকেশন চাই, এবং দুটিই হবে বিসি টাইম। তার সঙ্গে একটা প্রেজেন্ট আর একট ফিউচার। দ্যাখো, আমি তোমার পয়েন্টটা বুঝছি না তা নয়। আমি ভেবে দেখেছি অনেক, বুঝলে? পাস্ট পাবলিকেশনে উপার্জন কম, বইয়ের কাটতি কম, লেখকের খ্যাতির সম্ভাবনা একেবারে মিনিমাম… সব বুঝছি… কিন্তু, আমি আমার খ্যাতির কথাটা আর ভাবছি না। এখন আমি চাইছি সত্যি সত্যি একটা কালজয়ী কিছু সৃষ্টি করতে। আমার থেকে অনেক বড়ো হোক আমার শেষ লেখাটা, যদি আমার যেই কলমের জোর থেকে থাকে।”

“আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছি, স্যার আপনার ইচ্ছেটা”, আকাশ আত্মবিশ্বাসী সুরে বলে, “আপনি যে নভেলটা আমাদের দেবেন তার চারটে ভার্সান তৈরি করে যখন আপনার সামনে রাখব, আপনি সেখানেই বুঝতে পারবেন আমাদের ইনভল্ভমেন্টের লেভেলটা। স্যার আপনি কোন পিরিয়ডে গল্পটা লিখেছেন? এখনকার সময়ে?”

“এখনকার সময়,” মাথা হেলিয়ে সায় দিয়ে বলেন লাহিড়ী, “সাল ২৭৬৭। আমার লেখা গল্প এ বছরই তোমরা সরাসরি পাবলিশ করছ। আজ হল বাইশে ফেব্রুয়ারি… আমি এই পাবলিকেশনটা জুলাই মাসে এক্সপেক্ট করতে পারি?”

“ডেফিনিটলি, স্যার।”

“বেশ। আর বাকি তিনটে নভেল তোমরা ক্রিয়েট করছো। তাই তো?”

“একদম। আপনি স্থান, কাল, পাত্র বলে দেবেন। আমাদের টিম সেইমতো আপনার নভেল রিরাইট করবে। গল্প যতটুকু না বদলালেই নয়, শুধুমাত্র সেইটুকুই বদলানো হবে। আমাদের এখনও পর্যন্ত যত কাজ তাতে আসল লেখার সঙ্গে মিনিমাম সিমিলারিটি ইনডেক্স ছিয়াশি পারসেন্ট।”

“খুব ভালো। তবে আমার মনে হয় যেহেতু আমার দুটো পাবলিকেশন পাস্টে হচ্ছে, তোমাদের আরো একটু ফ্লেক্সিবিলিটি দরকার হতে পারে। সেক্ষেত্রে তোমরা পঁচাত্তর অবদি নামতে পারো দরকার পড়লে।”

“ওয়াও। থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার। সেভেন্টি ফাইভ অবদি ফ্রিডম পেলে আমরা যে ভালো কাজই ডেলিভার করব সে নিয়ে আমার অন্তত কোনো সন্দেহ নেই… ইয়ে, স্যার, আপনি বলছেন বিফোর ক্রাইস্ট টাইমে পাব্লিশ হবে… মোটামুটি কত খ্রিস্টপূর্বাব্দ ডিসাইড করেছেন?”

“সব ভেবে রেখেছি। প্রথমটির সময়কাল, মোটামুটি ১২০০ বিসি। স্থান, বৈদিক ভারত। আমার নিজের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলিকে আমি এই শেষ প্রজেক্টটায় ইনক্লুড করতে চাই। নিজের দেশ হিসেবে তাই ভারত থাকছে। দ্বিতীয়টা অবিশ্যি আরেকটু পরের দিকে। মোটামুটি ৪০০ বিসি। ইস্তানবুল। তবে তখন তো ইস্তানবুল ছিল না, ওটা তুমি ইন জেনারেল পার্সিয়া, মানে যাকে আমরা পারস্য বলি সেইটে ধরতে পারো। আমার স্ট্রাগল পিরিয়ডে অনেকটা সময় ইস্তানবুলে কাটিয়েছি। ওখানকার অলিগলি, রাস্তাঘাট আমার ঘরবাড়ি হয়ে গিয়েছিল একটা সময়ে। তাই ওটাই আমার সেকেন্ড চয়েস।”

“ওকে স্যার।” যেহেতু সমস্ত কথাবার্তাই মেমোরেবলে স্টোর হচ্ছে তাই এত ডিটেইল লিখে নেওয়ার কোনো দরকার পড়ল না আকাশের। সে একটু ইতস্তত করে বলল, “ইয়ে, মানে স্যার, কোম্পানি পলিসি হিসেবে আপনাকে আরেকবার আমি জাস্ট বলে রাখছি যে পাস্ট পাবলিকেশনের টার্মস… মানে একেবারেই নিয়মরক্ষার জন্যে বলছি আর কি… প্রথমত, আপনার নাম কোনোভাবে গল্পটির সঙ্গে যুক্ত করা যাবে না। আমরা সার্ভে করে মাঝারি মানের কোনো একজন লেখককে বেছে নিচ্ছি, আমরা তার মাথায় গল্প প্ল্যান্ট করছি, সিমিলারিটি ইনডেক্স বজায় রাখার জন্যে আমরা প্রতি দু-একদিনে লেখকের মেমোরি রিফ্রেশ করছি, আস্তে আস্তে বিভিন্ন ডিটেইল যোগ করছি। লেখক এ ব্যাপারে কোনোকিছু টের পাচ্ছেন না, নিজের লেখা মনে করেই লিখছেন। যদি প্রজেক্ট সফলতা পায়, লেখা নাম করে, তাহলে আমরা চেষ্টা করব লেখকের নাম যেন তত পপুলার না হয়। শুধু লেখাটাই যেন খ্যাতি পায়। দ্বিতীয়ত, যদি যথেষ্ট কালেকশন না হয়, তাহলে লসটা আপনার হচ্ছে, ‘এপিক’ এর জন্যে কোনোভাবে দায়ী থাকছে না। বা আর্থিক দিক থেকেও আমাদের কিছু করার থাকছে না।”

“অবশ্যই” হেসে বললেন লাহিড়ী, “আমি এগ্রি করছি। তুমি এসব নিয়ে একেবারে চিন্তা কোরো না। এ প্রজেক্ট ফেল হলে তোমাকে আমি মোটেও দুষব না। তোমরা তো শুধুমাত্র আমার ইন্সট্রাকশানই ফলো করছ।”

হালকা হাসি মুখে টেনে এনে আকাশ বলল, “ওকে স্যার। তিনটে নিয়ে কথা হয়ে গেল। লাস্ট পাবলিকেশনটা…”

“ওটা ফিউচারে হচ্ছে। আমি ওটা নিয়ে খুব একটা বদারড নই। স্থান, কাল, আমি তোমাদের হাতে ছেড়ে দিলাম। সাউথ আমেরিকা, আফ্রিকা… যে কোনো ফ্লারিশিং জায়গা, যেখানে বিক্রিটা ম্যাক্সিমাম করা যাবে। তোমরা ভাবো, শুধু ফাইনাল করে নেক্সট মিটিং-এ আমাকে জানিয়ে দিও যে কোথায় কখন বইটা বেরোবে।”

এটাও একটা বড়ো প্রাপ্তি। ভদ্রলোক তো ভীষণ রকম কো-অপারেট করছেন, মনে মনে ভাবলো আকাশ। পাস্ট স্টোরিলাইনটা জম্পেশ করে সাজাতে হবে। ওঁকে নিরাশ করা যাবে না।

হাসি হাসি মুখে আকাশ বলল, “তাহলে তো স্যার সব কথা হয়ে গেল। আপনি নভেলের সফট কপি আমাকে মেইল করে দিন, আর নিশ্চিন্তে থাকুন। আমি আপনাকে যোগাযোগ করবো সপ্তাহ-খানেকের মধ্যেই। শুধু একটা অনুরোধ আছে, স্যার… বলব?”

“আরে… বল বল…”

“এটা আসলে স্যার আমার কাজ করার একটা ধরণ… মানে, আমার জায়গায় আমার অন্য কোনো কর্মচারী এলে আপনাকে বলত না, আমি নিশ্চিত… আসলে আমি প্রেফার করি একবার পুরো নভেলের প্লটটা লেখক যদি খুব সংক্ষেপে একবার আমাকে নিজে বলেন। এতে আমার আপনার অনুভূতিগুলোর সঙ্গে গল্পের বিশেষ বিশেষ ঘটনাগুলোকে লিঙ্ক করতে সুবিধে হয়। আমি বিশ্বাস করি এতে রিরাইটিং অনেক বেটার হয়। তাই, যদি আপনি একটু ছোটো করে গল্পটা…”

“এ তো খুব ভালো প্রস্তাব” হেসে বললেন সৌর লাহিড়ী, “আমি দু-এক কথায় বলছি। গল্পের শুরু হচ্ছে একজন অতি নিষ্ঠুর এভিক্টেড আর্মিম্যানকে নিয়ে, যে দারুণ যোদ্ধা, অতি বুদ্ধিমান এবং দেশের সরকারের বিরুদ্ধে তিতিবিরক্ত। আসলে এই লোকটি ভলান্টারিলি একটা জেনেটিক এক্সপেরিমেন্টে যোগ দেয়, যার ফলে ওর শক্তি ও আকৃতি খানিকটা পাশবিক হয়ে যায়। মিনোটর জানো তো?”

“হ্যাঁ, অবশ্যই” বলে আকাশ, “মহিষের মতো মাথা, মানুষের দেহ… খুব সম্ভবত প্রাচীন ক্রিটের কাহিনি…”

“ঠিক তাই” একটা সন্তোষের হাসি হেসে বললেন লাহিড়ী, “ইমাজিন করো, সেই রকম ধরণের একটা চেহারা। তা সেই লোক একটি আনট্রেসেবল দ্বীপে বসে একটি বিশাল সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীকে অঙ্গুলিহেলনে চালনা করে, এবং অতি কৌশলে সারা পৃথিবীর সমস্ত দেশের আইনের আওতার বাইরে থাকার ব্যবস্থা করে নেয়। মানুষের ব্যাক্তিগত ইনফরমেশনকে হাতিয়ার করে সেই লোক সমস্ত কিছুর উর্দ্ধে উঠে গিয়ে পৃথিবীর একনায়ক হওয়ার স্বপ্ন দেখতে থাকে। এখানে গল্পটাকে সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছে, এবং কীভাবে সে এই ইমিউনিটি অ্যাচিভ করে সেটা বলা হয়েছে। এই হল আমাদের ভিলেন। এই পরিস্থিতিতে একটি সাধারণ আদিবাসী মেয়ে, যার সে অর্থে কোনো বলার মতো ব্যাকগ্রাউন্ড নেই, তাকে একটি স্পেশাল ইন্টারন্যাশনাল ইনটেলিজেন্স এজেন্সি অতি গোপনে ট্রেন করে, এবং সকলের অনুরোধে তাকে ওই ভিলেনের সঙ্গে লড়তে হয়। কীভাবে সেই সাধারণ মেয়েটি এই অসাধারণ কাজটি করল, এটা তারই গল্প। ওর জার্নি’টা। ওর লড়াই। শেষে জয়। বুঝলে তো?”

“অসাধারণ” স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলল আকাশ, “একটি সাধারণ মেয়ে এভাবে একটা গ্লোবাল লড়াই-এ সবাইকে রিপ্রেজেন্ট করছে, ভাবতেই অবাক লাগছে। ভীষণ নতুন আইডিয়া। এ তো শুনেই আমার পুরোটা পড়তে ইচ্ছে করছে।”

“হাঃ হাঃ হাঃ,” অট্টহাসি করে ওঠেন লাহিড়ী, “সে তো তুমি পড়বেই। প্লটটা মাথায় আসতেই আমার মনে হয়েছিল দিস ইস ইট।”

“খুব ভালো। ওকে স্যার, থ্যাঙ্ক ইউ ফর এভরি থিং। আমি তাহলে উঠি? আপনি মেইলটা করে দিন কাইন্ডলি…?”

“নিশ্চয়ই, তুমিও আমায় টোটাল এস্টিমেটটা জানিও।”

“ওটা নেক্সট মিটিং-এ জানাতে পারবো, স্যার।”

“ওকে ওকে, নো প্রবলেম… ওহ হ্যাঁ, ভালো কথা, একটা অনুরোধ আমারো আছে। সাউথ আফ্রিকা আসার পর থেকেই আমি একটা জিনিস নিয়ে ভীষণ ফ্যাসিনেটেড, বুঝতে তো? সেটা হল সিংহ! শহরতলিতে এই বাড়িটা কেনার পর আমার খুব শখ হয়েছিল যদি এবার একটা সিংহশাবককে অ্যাডপ্ট করা যায়! এখনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সিংহের ব্যাপারে আমার আসলে একটা ভয়ানক দূর্বলতা আছে। তা… এই নভেলে, আমার লিড, ওই আফ্রিকান ট্রাইবাল মেয়েটির একটি পোষা সিংহ রেখেছি। একটু দেখ, ওই ব্যাপারটা কিন্তু ইনট্যাক্ট রাখতে হবে সব ক-টা ভার্সানে।”

ঘাড় হেলিয়ে সায় দিয়ে, বিদায় জানিয়ে আকাশ বেরিয়ে এল। গাড়িটা স্টার্ট দেওয়ার আগে আর্টিফিশিয়াল মেমোরি-রেকর্ডারের সুইচটা অফ করল সে।

ফুরফুরে মনে হাইওয়েতে গাড়ি তুলে নাথানকে ফোন লাগাল, “হ্যালো, ভাই! গল্প তো জমে গেছে। আমি এসে ডিটেলে বলছি… শুধু এটুকু শুনে রাখো, মহিলা প্রটাগোনিস্ট, অ্যাকশন ড্রামা। ক্রাইম আছে, ভিলেন আছে, পলিটিক্স আছে, ফেমিনিসম আছে, ক্রাইসিস আছে, তার সমাধান আছে… সব মিলে জমাটি ব্যাপার… আর সবচেয়ে বড়ো কথা লাহিড়ীর রিটায়ারমেন্ট প্রজেক্ট… ভাবতে পারছিস ভাই?… আরে হ্যাঁ… তাহলে আর বলছি কি…? পাস্টে পাবলিশ করবে বলছে, ১২০০ বিসি, ইন্ডিয়া… ঠিকঠাক লেগে গেলে দিস ইস গোয়ইং টু বি অ্যান এপিক… এ আমাদের ইন্ডিয়ান সোসাইটির পার্ট হয়ে যাবে, বস্‌… আমি তো মনে মনে কত কী প্ল্যান করে ফেলেছি অলরেডি… বিসি ভার্সানের জন্যে ভিলেনের একটা নামও মাথায় এসেছে?… আরে শোন না ভাই, নামটা শোন… মহিষাসুর… … হ্যাঁ, মানে করলে ‘বাফেলো মনাস্টার’ বলতে পারিস বই কি, কিন্তু মহিষাসুরটা অনেক বেশি ইমপ্যাক্টফুল, অনেক ভয়ানক শোনাবে কমপ্যারাটিভলি… এবার লিড ক্যারাক্টারের নামটা মানানসই করে ভাবতে হবে… সামথিং শর্ট, বোল্ড, ইন্ডিয়ান… কি বলিস?”

Tags: kalpabiswa y7n1, science fiction, কল্পবিজ্ঞান গল্প, প্রমিত নন্দী, সায়ংতরী ঘোষ

3 thoughts on “কালজয়ী

  • June 28, 2022 at 12:03 am
    Permalink

    সুন্দর আইডিয়া। শেষটা আরেকটু জমাতে পারলে ভালো হত।

    Reply
  • June 30, 2022 at 10:55 pm
    Permalink

    লেখাটা খুব ভালো লাগলো। বেশ অন্যরকম…

    Reply
    • August 23, 2022 at 11:15 pm
      Permalink

      চমৎকার আইডিয়া। আমার একবার মনে হচ্ছিল যে সৈর লাহিড়ী নিজেই হয়তো একটা চক্রান্তে জড়িত। যেখানে লেখার মাধ্যমে পৃথিবী জয়ের একটা ছক ইমপ্লান্ট করা থাকবে যার সূত্র ধরে বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল পালটে যেতে পারে। কিন্তু এই চমকটাও অন্য রকম।

      Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!