যখন সময় থমকে দাঁড়ায়

  • লেখক: ব্র্যাডনার বাকনার; অনুবাদ: রাকেশকুমার দাস
  • শিল্পী: প্রমিত নন্দী

মূল গল্প: The Day Time Stopped Moving

 

ঠান্ডা মাথায় এ কাজ করার লোক ছিল না ডেভ মিলার। খবরের কাগজে যেমন মাঝেমধ্যেই দেখা যায় সংসারের জ্বালায় মানুষ আত্মহত্যা করছে, সেরকম বিষাদগ্রস্ত মানুষ একেবারেই ছিল না সে। কিন্তু সেদিন যে কী হল, পাঁড় মাতাল হয়ে মিলার বাড়ি ফিরেছিল গজরাতে গজরাতে, আর ওর রিভলভারটাও সেদিন গর্জে উঠেছিল। বেসিনের গায়ে দাঁড়িয়ে নিজের কপালের রগের কাছে কালো শীতল বন্দুকটা ঠেকিয়ে ট্রিগার টিপেছিল সে।

রান্নাঘরের জানলার ঘোলাটে কাচের মধ্য দিয়ে আসা ভোরের ক্ষীণ আলোয় ধূসর কাগজের চিঠিটা দেখা যাচ্ছিল। মিলার দ্রুত চিঠিটা খুলতে লাগল বিড়বিড় করতে করতে, “এই জন্যেই শালা আমার মাথাটা গরম হয়ে যায়…”

পনেরো মিনিট আগে, অর্থাৎ ভোর প্রায় সাড়ে পাঁচটা নাগাদ মিলার যখন নেশায় টলতে টলতে ঘরে ঢোকে, তখনই সে হেলেনের চিঠিটা দেখতে পায়। এই ভোরবেলা ঘরে ফেরার ব্যাপার শুধু আজ নয়, গত এক বছরে প্রায় দিনই হয়েছে, দোকান থেকে একটু দেরি করে ফিরেছে। মিলার একটা ওষুধের দোকান চালায়, সেটা খুব বেশি দূরেও নয়, হাঁটাপথেই। কিন্তু মিলারের এই একটু দেরি করে ফেরা মানে মোটামুটি ১০-১২ ঘণ্টা! দোকান বন্ধ করেই মিলারের ঢুকুঢুকু শুরু হয়ে যায় আজকাল। হেলেন বহুবার শাসিয়েছে। যে ভয়টা পাচ্ছিল মিলার, আজ সেটাই হয়ে গেল। হেলেন ঘর ছেড়ে চলে গেছে।

চিঠিটা খুব বেশি বড়ো নয়, কিন্তু বড়োই হৃদয়বিদারী।

“দুর্দিনে স্বামীর পাশে থেকে তাকে সাহায্য করতে কোনো মেয়েই আপত্তি করে না। আমিও কষ্টেসৃষ্টে সংসার চালিয়ে নিতাম না হয়। গত বছর যখন তোমার ব্যাবসা বন্ধ হয়ে যায় তখন আমি বলেছিলাম যে-কোনোভাবে আমি তোমাকে সাহায্য করব। কিন্তু তুমি আমাকে সাহায্য করতেই দাওনি। সব টাকা আর সময় তুমি মদ, রেস আর জুয়ায় লাগিয়েছ। টাকা রোজগার করার জন্য কোনো চেষ্টাই তুমি করনি। আমি এক মাতালের স্ত্রী হয়ে সংসার চালিয়ে নিতে পারতাম, কিন্তু একজন কাপুরুষের স্ত্রী হিসেবে ভাবলে নিজের ওপরেই ঘেন্না হয়।”

“ঘেন্না হয়? কাপুরুষ? আমাকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য এই সব কাণ্ড তাই না? আজ আমি তোমাকে শিক্ষা দেব” নিজের মনে মিলার বলতে লাগল। “কি আমার মহান সাহায্য করতেন মহারানি! আহা ধন্য হয়ে যেতাম মাইরি। মদ খেয়ে ফিরলেই শালা সারাদিন শুধু ঘ্যানর ঘ্যানর! আরে বাবা একটা ঘোড়ার পেছনে পঁচিশ টাকা লাগালে যদি পাঁচশো পাওয়া যায়, তা সে কোন শালা লাগাবে না? নাঃ ওঁর তাতেও আপত্তি!”

তরল অ্যালকোহলে যদি মনের বিষণ্ণতা দ্রবীভূত হয়ে যায়, তাহলে একটু বেশি মদ্যপান কি খুব দোষের?

রাগে মিলার আরও শক্ত হয়ে গেল, ট্রিগারে আঙুলটা আরও চেপে বসল। বন্দুকের হ্যামার নেমে আসার ঠিক আগে, এক মুহূর্তের জন্য যেন মিলারের মাথায় একটা নতুন উপলব্ধি খেলা করে গেল। তাহলে কি পুরো ব্যাপারটায় প্রকৃতপক্ষে দোষ তার নিজেরই? হেলেন হয়তো ঠিকই বলেছে— সে সত্যিই কাপুরুষ। এই গ্লানি তার বুকে কাঁটার মতো বিঁধল। হেলেনের মতো অনুগত স্ত্রী আর হয় না।

রাতের বেলা করে হুইস্কি না গিলে ব্যাবসার নতুন কোনো প্ল্যান নিয়ে ভাবতে পারত। খদ্দেরদের সঙ্গে আরও ভদ্র ব্যবহার করার চেষ্টা করতে পারত। অন্তত খোঁয়ারির মধ্যে নিজের মেজাজ দেখিয়ে খদ্দেরদের মুখঝামটা কি না দিলেই নয়? আর জানা কথাই যে রেস খেলে কেউ বড়োলোক হয়নি। এই ব্যাবসা, মদ আর ঘোড়া— সব মিলিয়ে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে মিলার। আর তারই দুঃখজনক পরিণামের মুখোমুখি আজ— নেশার ঘোরে উন্মত্ত মিলার আজ নিজের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে।

ক্রোধের তীব্রতায় বিচারবুদ্ধি সমস্ত হারিয়ে ফেলেছিল মিলার। চিবুক উঁচিয়ে বন্দুকটা আরও শক্ত করে ধরে দাঁতে দাঁত পিষে বলল, “আমাকে ছেড়ে যাবে তুমি? দেখ তাহলে আমি কী করি…”

পরের মুহূর্তেই বন্দুকের হ্যামার সজোরে আঘাত করল ফায়ারিং পিনে।

ডেভ মিলার দেখিয়ে দিল সে কী করতে পারে।

পরের মুহূর্তেই মিলার চোখ খুলল একটা ঘণ্টা বাজার শব্দে। কোন ঘণ্টার আওয়াজ সেটা বুঝতে কোনো কষ্ট হওয়ার কথা নয় মিলারের। তার কাছে একেবারেই সুপরিচিত শব্দ। দোকানের কাউন্টারে ক্যাশবাক্সের সঙ্গে যে ঘণ্টা লাগান থাকে সেই ঘণ্টার আওয়াজ— টিং।

ক্যাশবাক্স সামনেই হাট করে খোলা। কাউন্টারের মার্বেলের স্ল্যাবের উপর ৫ ডলারের একটা নোট রাখা। মিলার চারপাশে চোখ বোলাতে লাগল।

মিলার বসে আছে ওষুধের কাউন্টারের পেছনে। ডানদিকে ফাউন্টেন সোডার কাউন্টারের কাছে একজোড়া যুবক-যুবতী বসে ঠান্ডা পানীয় খাচ্ছে। ফোয়ারার অপর দিকে সিগারেটের কাউন্টার। আর সোজাসুজি খোলা দরজা, তার পাশে ম্যাগাজিন র‍্যাক। আর মিলারের মুখের সামনে একজন মহিলা খদ্দের দাঁড়িয়ে।

“যাহ্‌ শালা, আমি এটা স্বপ্ন দেখলাম?”

ঘামে জ্যাবজেবে কপাল থেকে একফোঁটা ঘাম গড়িয়ে পড়ল। হারমানের ওখানে জুয়া খেলার সময় কী পান করেছিল, মিলারের মনে পড়ল— অত্যন্ত বাজে খেতে ছিল সেটা। কিন্তু মারিউয়ানা ছাড়া এমন দৃষ্টিভ্রম তো সেইসব সস্তা মদের কম্ম নয়!

এই কাউন্টারে সে এল কী করে? এই মহিলাই বা কে?

মহিলার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখেই মিলার চিন্তার জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে এল। আগে এই খদ্দেরের ব্যাপারটা মেটানো যাক। তারপর শান্ত মনে ভেবে বের করা যাবে কী হল না হল।

মিলারের হাতটা প্রায় ক্যাশবাক্সেই ছিল, কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ল না পাঁচ ডলারের নোটের পরিবর্তে কত টাকা সে ফেরত দেবে।

মহিলার দৃষ্টি এড়াতে টাকার বাক্সে তাকিয়ে থেকেই মিলার বলে উঠল, “হুম… দেখি… কত যেন বললাম আপনাকে?”

মহিলা কোনো উত্তর দিল না। মিলার গলা খাঁকরে আবার বলল,

“এক্সকিউজ মি ম্যাম, কত যেন বললাম আপনাকে? পঁচাত্তর সেন্ট?”

মহিলা এবারও কোনো জবাব দিল না। ঠিক তখনই এই স্টোরে বিরাজমান গভীর নিস্তব্ধতার ব্যাপারটা খেয়াল করল মিলার।

মিলার ধীরে ধীরে মহিলার মুখের কাছে নিজের মুখটা নিয়ে এসে ভালো করে মহিলার চোখটা নিরীক্ষণ করল। মহিলা একটা ভদ্রতাসুলভ হাসি নিয়ে নির্বিকারভাবে যেমন চেয়েছিল, তেমনই চেয়ে রইল। মহিলা একটুও নড়ল না, চোখের পলকও ফেলল না। ঠোঁট খোলা, সামান্য দাঁত দেখা যাচ্ছে, জিভটা টাগড়ায় লেগে রয়েছে— যেন কিছু বলতে গিয়ে কোনো শব্দ অর্ধেক উচ্চারণ করে মাঝপথে আটকে গেছে।

মিলারের কান খাড়া হয়ে উঠল। অনুভব করল চুলগুলোও খাড়া হতে শুরু করেছে। ফাউন্টেন সোডার কাউন্টারের দিকে নজর ফেরাল সে। তাকিয়ে যা দেখল তাতে মিলারের অন্তরাত্মা যেন কেঁপে উঠল।

যে মেয়েটা ফাউন্টেন কোক খাচ্ছিল সে গ্লাসটা ঠোঁটে ছুঁইয়েই রেখেছে কিন্তু একটুও পানীয় মুখের ভেতরে টানছে না। তার পুরুষ বন্ধুটির গ্লাসটি কাউন্টারের উপর রাখা। সে একটি সিগারেট টেনে ধোঁয়া ছেড়েছে। সেই ধোঁয়াটি একটা ধূসর রঙের বড়ো বেলুনের মতো স্থির হয়ে মুখের সামনে ভেসে রয়েছে, আর একটি প্রান্ত সরু হয়ে তার দুই ঠোঁটের ফাঁকে ঢুকে গেছে। মিলার যতক্ষণ চেয়ে রইল, ধোঁয়া একটুও নড়ল না।

কিছু একটা অলক্ষুণে, অলৌকিক কাণ্ড ঘটে চলেছে এখানে।

মিলারের শিরদাঁড়া দিয়ে শঙ্কার ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। দ্রুত ক্যাশবাক্সের কাছে ফিরে গিয়ে একটু সাহস করে মহিলার গাল স্পর্শ করল। গালের উষ্ণতা স্বাভাবিক কিন্তু একদম পাথরের মতো শক্ত। মিলার তাকে ঠেলারও চেষ্টা করল, প্রথমে আস্তে তারপর গায়ের সমস্ত জোর দিয়ে। কিন্তু কোনো অলৌকিক বলে মহিলা যেন দু-টনের ব্রোঞ্জের মূর্তির মতো ভারী হয়ে গেছে। মহিলাকে সামান্যতম টলান তো গেলই না, মহিলার মুখের ভাবও বিন্দুমাত্র বদলাল না।

ভয়ে কেঁপে ওঠা গলায় সোডা কাউন্টারের পিটকে জোরে ডেকে উঠল মিলার।

“অ্যাই পিট” চিৎকার করে উঠল মিলার, “এসব কী হচ্ছে বলত এখানে?”

সোনালি চুলের ছোকরা পিট গ্লাস পরিষ্কার করছিল কাপড় দিয়ে। সে ফিরেও তাকাল না। মিলার পেছন থেকে গিয়ে তার ঘাড় ধরে ঝাঁকুনি দিল। কিন্তু পিটকে একচুলও নড়ান গেল না।

মিলার বুঝল এ নেশার ঘোরে ভুল দেখা নয়। কোনো এক অজানা দুর্বোধ্য ফাঁদে আটকা পড়ে গেছে সে। হঠাৎ খেয়াল হল বাড়ি গিয়ে দেখা যাক হেলেন আছে কি না। হেলেনের কথা মনে পড়তেই মিলারের উদ্বেগ কিছুটা যেন হালকা হল। হেলেন তার গভীর নীলাভ চোখ নিয়ে মিলারের কথা মন দিয়ে শুনবে নিশ্চয়ই, আর বোঝার চেষ্টা করবে কী ঘটেছে।

দোকান থেকে বেরিয়ে মিলার ছুটে গেল তার গাড়ির কাছে। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও দরজা খুলতে পারল না গাড়ির। সে নিশ্চিত ছিল যে দরজা লক করা ছিল না। কিন্তু সে হাতলই ঘোরাতে পারল না। হাজার কুস্তির প্যাঁচ-পয়জার, গালিগালাজ কিছুই কোনো কাজে এল না।

হঠাৎই মিলার নতুন এক আশঙ্কায় কাঁটা হয়ে গেল। যতদূর নজর যায় রাস্তা বরাবর— সামনের ক্রসিং, তার পরের ক্রসিং, তারপর রাশি রাশি বাড়ির সামনে ঝাপসা হয়ে যাওয়া শহর— কোথাও কিচ্ছুটি নড়ছে না।

সমস্ত গাড়ি চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। কোনো গাড়ি মোড়ে বাঁক নিচ্ছে, কোনোটা অন্য গাড়িকে ওভারটেক করছে— তারা যে যার জায়গায় স্থির। একটা গাড়ি সেফ জোনে দাঁড়িয়ে, গাড়ির থেকে একজন লোক ফুটপাতে নামতে গিয়ে মাঝপথে আটকে রয়েছে। রাস্তা থেকে প্রায় আধা ফুট ওপরে তার পা ঝুলে রয়েছে। পথচারীরা ফুটপাথে এক পা বাড়িয়ে স্তব্ধ হয়ে আছে। টেলিফোন পোস্টের উপরে একটা পাখি উড়ছে, মনে হচ্ছে আকাশের গায়ে কেউ যেন তার ডানায় আঠা লাগিয়ে সেঁটে দিয়েছে।

অস্ফুটে একটা শব্দ করে মিলার বাড়ির দিকে দৌড় লাগাল। অন্তত পনেরো মিনিটের আগে মিলার একটুও গতি কমাল না। নিজের পাড়ায় ঢুকে, পরিচিত গাছ আর লতাগুল্মে ঘেরা পরিচিত ঘরবাড়িগুলো দেখে একটু আশ্বস্ত হল। কত দিনের পরিচিত অথচ আজ কত আলাদা।

শরতের ঝরা খয়েরি আর হলুদ পাতা চারদিকে ভেসে রয়েছে, বাতাস যেন বরফের মতো জমে রয়েছে এখানে। রাস্তায় দুটি কুস্তি-রত বাচ্চাকেও দেখা গেল, যারা এখন কোনো আধুনিক ভাস্কর্যে পরিণত হয়েছে। পোড়া পোড়া একটা গন্ধ পেয়ে মিলার তাকিয়ে দেখল একটা লোক শুকনো পাতায় আগুন দিয়েছে, সেই আগুনের লেলিহান শিখাগুলো একদম স্থির হয়ে সাপের মতো দাঁড়িয়ে আছে, একটুও নড়ছে না।

মিলার নিজের বাড়ির পথে ঢুকে প্রথমেই সদর দরজা দিয়ে ঢোকার চেষ্টা করল। দরজা যথারীতি লক করা, এদিকে ডোরবেলটাও হাজার চেষ্টা করে টেপা গেল না। পাহাড়ের মতো অটল হয়ে রয়েছে। চাবি দিয়ে দরজা খোলা গেল না দেখে মিলার পিছন দিক থেকে ঢুকতে গেল।

পেছনের পর্দাও ব্যাঙ্কের ভল্টের দরজার মতো লৌহ-কঠিন হয়ে রয়েছে। মিলার তাতেই দমাদম ধাক্কা মারতে লাগল—

“হেলেন! হেলেন! তুমি ভেতরে আছো? কী যে হল ছাই! তোমাকে…”

বলতে বলতেই মিলার থেমে গেল। ঘরের মধ্যে শ্মশানের নিস্তব্ধতা ছাড়া আর কিছু ছিল না। তার “হেলেন হেলেন” ডাকটাই প্রতিধ্বনিত হয়ে তাকে ভেঙিয়ে দিয়ে গেল।

সারা পৃথিবীটা ডেভ মিলারের কাছে একটা মৃত গ্রহ, যেখানে একমাত্র সে নিজে বেঁচে, একমাত্র সে-ই হেঁটে চলে কথা বলে বেড়াতে পারে। নিজের ঘরে ঢোকার চেষ্টা করে ব্যর্থ হওয়ার পর আর ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করেনি। কিন্তু রান্নাঘরের জানলা দিয়ে উঁকি মেরে দেখার চেষ্টা করেছিল ভেতরে, তার মৃতদেহটি পড়ে আছে কি না দেখতে। আবছা অন্ধকারের ভিতর তার চোখ তেমন কিছু ঠাহর করতে পারেনি।

ঘুমের ঘোরে হেঁটে চলার মানুষের মতো টলতে টলতে সে বাড়ির সামনে দিকে এল। এসেই মাথায় হাত দিয়ে বারান্দায় ধুপ করে বসে পড়ল। সে যে আত্মহত্যা করেছে সে বিষয়ে আর কোনো সন্দেহ নেই। সে এখন মৃত, আর এটা নিশ্চয়ই নরক বা ওই জাতীয় কোনো জায়গা— প্রায়শ্চিত্তের জন্য অনির্দিষ্টকাল ধরে তার আত্মাকে ঘুরে বেড়াতে হবে। গভীর অনুশোচনায় ডুবে গেল মিলার।

সব কিছুর মূলে এই মদ— কেন যে মদ খাওয়া ধরেছিল। মনে মনে খিস্তি করে উঠল মিলার। শেষ পর্যন্ত কি না কাপুরুষের মতো আত্মহত্যা করতে গেল সে? ভেবেই বিতৃষ্ণায় ভরে উঠল তার মন। শেষের একটা বছর যদি আবার বাঁচার সুযোগ পেত সে…

তবুও তার অন্তঃস্থল থেকে কেউ একটা বলছিল যে সে মরেনি। এটা মৃত্যুর ওপারের দুনিয়া নয়, এটা তার পরিচিত জগৎই। এখানে কী হয়েছে এটা তার সাধারণ বোধবুদ্ধির বাইরে। কিন্তু এটুকু নিশ্চিত যে এ জগতে কোনো পরিবর্তনশীল বা গতিশীল বস্তুর দেখা পাওয়া অসম্ভব। একটা নুড়িও মিলার পা দিয়ে সরাতে পারছে না। এমনকী সামান্য একটা ঘাসও মিলারের পায়ের চাপে নুইয়ে পড়ছে না। যেন বিধাতার অদৃশ্য অমোঘ অঙ্গুলি-স্থাপনে জগতের দোদুল্যমান দাঁড়িপাল্লা একদম নিষ্কম্প হয়ে পড়েছে।

মিলারের হঠাৎ খেয়াল পড়ল তার মাথা প্রবলভাবে ধরে রয়েছে। মাথা যন্ত্রণার পাশাপাশি মুখেও একটা বিস্বাদ ভাব। একটা ব্রোমাইড ট্যাবলেট কফিতে ফেলে খেলেই এটা কেটে যাবে। কিন্তু বিধি বাম। একটা রেস্তোরাঁ খুঁজে পাওয়া গেলেও কফির কাপ নাড়ানো গেল না, ব্রোমাইডের কৌটোও খোলা গেল না। সেখানে দেখা গেল কাস্টমারকে দেওয়া কফির উপর ধোঁয়া স্থির হয়ে আটকে রয়েছে, একদম ইঁটের মতো শক্ত।

রাস্তায় ফিরে এসে মিলারের চোখ ছলছল করে উঠল। “হেলেন!” অস্ফুট আবেদনে বলে উঠল মিলার, “হেলেন, সোনা আমার! তুমি যে কোথায় গেলে…”

অখণ্ড নীরবতা ভঙ্গ করে কেউই উত্তর দিয়ে গেল না।

কিন্তু, হঠাৎই মিলারের মনে হল কী যেন নড়তে দেখা যাচ্ছে!

তক্ষুনি মিলারের ঠিক ডানদিক থেকে কী যেন একটা এসে মিলারের পায়ের কাছে এসে পড়ল। নরম আর বাদামি রঙের লোমে ঢাকা। মিলার কিছু বুঝে ওঠার আগেই খেয়াল করল সেই জিনিসটা ভেজা লাল জিভ দিয়ে তার পা চাটতে লেগেছে। মিলার বসে পড়ল ভালো করে দেখতে। একটা পুলিশ কুকুর!

কুকুরটিও আরেকটি নড়নচড়নশীল জীব দেখতে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা। কিছুতেই মিলারকে উঠে দাঁড়াতে দেবে না। কাঁধের উপর পা তুলে দিয়ে মিলারের মুখ চাটার চেষ্টা করতে লাগল। মিলারও হেসে উঠল জোর গলায়।

“তুই আবার কোত্থেকে এলি বাবা” মিলার বলে উঠল, “তোর সঙ্গেও কেউ কথা বলছে না বুঝি?” তোর নাম কী?”

কুকুরটায় গলায় একটা ভারী বকলস দেখল মিলার, তাতে পিতলের নেমপ্লেটে নামটা লেখা রয়েছে, “মেজর”।

“যাক, তাও একটা সঙ্গী পাওয়া গেল। কী বলিস মেজর?” মিলারের গলায় কিছুটা আশ্বস্ত ভাব দেখা গেল। মেজর ঘোঁৎঘোঁৎ ছাড়া কিছুই জবাব দিল না। মিলার মেজরের কানের পেছনটা চুলকে দিতে দিতে বলতে লাগল, “এখন কী করা যায় বলত মেজর? একটু চারদিকটা হেঁটে দেখা যাক? বলা যায় না তোর নাকের জোরে যদি আরও বন্ধুর খোঁজ পাওয়া যায়।”

দু-পা যেতে না যেতেই মিলারের মাথায় সময় কাটানোর নতুন উপায় এল। লাইব্রেরি! বলা যায় না সেখানে এমন কোনো বই পাওয়া যেতে পারে যা দিয়ে এই পরিস্থিতিতে কিছুটা সুবিধা হতে পারে। সব কিছুর মূলে যদি তার আত্মহত্যা থাকে তাহলে মাথায় অস্ত্রোপচার করতে পারার মতো কোনো সার্জারির বই-টই যদি থাকে…

কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের দেখা গেল একটা বিল্ডিং-এর ভেতর কংক্রিটের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে। সিঁড়ি দিয়ে উঠে ঘূর্ণায়মান দরজা ঠেলে ঢুকতেই লাইব্রেরিয়ানকে দেখা গেল হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে।

মিলারও ভদ্রতা দেখিয়ে হেসে বলল, “আপনাদের কাছে ব্রেন সার্জারির উপর কোনো বই…” বলতে বলতেই টের পেল যে একথা বলা নিরর্থক। কেউ জবাব দেবে না। এ নিজের সঙ্গেই কথা বলার সামিল।

কিন্তু মিলারকে অবাক করে জবাব এল পরক্ষণেই। বইয়ের তাকের পেছন থেকে যেন কেউ মুচকি হাসল। তার পর মিলার শুনতে পেল কে যেন বলল,

“আপনি পেলেও জানাবেন আমাকে, আমি নিজেও ঠিক বুঝে উঠতে পারছি না।”

হলঘরের এক কোন থেকে এক বয়স্ক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। মাথায় অর্ধেকটা টাক, জঙ্গলের মতো ধূসর রঙের ভুরু আর মুখে একটা বিষণ্ণ হাসি। ভদ্রলোকের কানের উপরে একটা পেনসিল গোঁজা আর হাতে একটা নোটবই।

“আরে আপনিও…” ভদ্রলোক বলতে বলতে মিলারের কাছে আসছিলেন, “মানে, আমি ভাবলাম কি না আমিই কি না একমাত্র ব্যক্তি…”

মিলার তাড়াতাড়ি এসে হাত মেলাল।

“আমিও খুব যে মহান তা নই, আমিও তাই ভেবেছি আমিই একা চলে ফিরে বেড়াচ্ছি” মিলার স্বীকার করল, “গত দু ঘণ্টা ধরে আমি আমি শুধু এটাই চাইছিলাম আমার মতো কোনো দুর্ভাগা যদি থাকে তার সঙ্গে যেন দেখা হয়ে যায়।”

“হ্যাঁ, সেটা ভাবাই স্বাভাবিক।” ভদ্রলোক মিলারকে বিড়বিড় করে আশ্বস্ত করল। “তবে আপনার কেস আর আমার কেস সম্পূর্ণ আলাদা। মানে… এই ঘটনার জন্য আমিই দায়ী বলা যেতে পারে।”

“ঘটনা? আপনি? মিলার থতমত খেয়ে গেল, “আ… আমি ভাবলাম কি না…”

ভদ্রলোক হাতের নোট বইয়ের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল, পাতায় পাতায় কী সব হিজিবিজি হিসাবনিকাশ করা। মিলার এতক্ষণে ভদ্রলোককে ভালো করে দেখার সুযোগ পেল। ভদ্রলোকের বয়স বছর ষাটেকের মতো হলেও কাঁধ চওড়া, লম্বা ভারিক্কী চেহারা। পরনে একেবারে বেমানান সবজেটে রঙের কুঁচি-দেওয়া লম্বা ঝুলের জামা, তার ওপর গ্যালেস দিয়ে প্যান্ট পরা। টুথব্রাশের মতো ঘন জঙ্গলের ভুরু, নীচে তীক্ষ্ণ ও একাগ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা চোখজোড়া আলাদাভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

“এই যে, সমস্যাটা এখানেই হয়েছে, দেখুন এখানে…” ভদ্রলোক আস্তে আস্তে বলে উঠল, “আমি অ্যামপ্লিফিকেশনের তিনটে ধাপ রেখেছিলাম। কিন্তু চারটের কমে এ কাজ হওয়ার ছিল না এখন মনে হচ্ছে। যার জন্য এই দশা সম্পূর্ণ হচ্ছে না।”

“মাফ করবেন, আপনার কথাটা ঠিক বুঝলাম না।” মিলার বলল, “মানে… আপনি কিছু করেছেন… যার ফলে…”

“আমার তো তাই মনে হয়, এটা আমারই কর্ম,” পেনসিল দিয়ে টাক চুলকাতে চুলকাতে ভদ্রলোক বলে উঠল, “আমার নাম জন এরিকসন। ওয়ানামেকার ইন্সটিটিউটের নাম শুনেছেন?”

মিলার শুধু বলে উঠল “ও আচ্ছা আচ্ছা!” যেন সব বুঝে ফেলেছে। ওয়ানামেকার ইন্সটিটিউটের প্রধান হলেন এই জন এরিকসন। বিজ্ঞানের জগতে আণবিক শক্তি নিয়ে প্রথম কাজ করেছিল এই ওয়ানামেকার ইন্সটিটিউট।

এরিকসন হঠাৎই তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে মিলার খুঁটিয়ে দেখতে লাগল।

“আপনি কি অসুস্থ ছিলেন?” এরিকসন জানতে চাইলেন।

“না… ঠিক অসুস্থ নয়…” মিলার বলল, “আ… আমি আসলে… কয়েক ঘণ্টা ধরে আমি নেশা করে বেহুঁশ ছিলাম।”

“নেশা করে?” এরিকসন মুখের ভিতরে জিভ দিয়ে গালটা ঘষতে ঘষতে মাথা নাড়তে লাগল, “কিন্তু তাতে তো এমন হওয়ার কথা নয়। অন্য কোনো কেস আছে। আমি যে ইম্পালসরটা ইউজ করেছি সেটা ততটাও ক্ষমতাশালী নয়। কুকুরের কেসটা বোঝাই যাচ্ছে, বেচারা গাড়ি চাপা পড়েছিল। আর জীবিত অবস্থা থেকে মৃত অবস্থায় যাওয়ার ঠিক মুহূর্তটায় ও ধরা পড়ে গেছে।”

“হুম্…” মিলার বুঝতে পারল এরিকসন কী বোঝাতে চাইছে, “তাহলে সত্যি কথাটা বলতেই হয়। আ… আমি… আত্মহত্যা করেছি। বুঝতেই পারছেন কতটা নেশার ঘোরে ছিলাম। আমাদের বংশে আজ পর্যন্ত কোনো আত্মহত্যার ইতিহাস নেই। সেই ইতিহাস তৈরি করার জন্যেই আমাকে গলা অবধি মদ গিলতে হয়েছিল।”

এরিকসন বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়ল। “বুঝলাম। সে কিন্তু ইতিহাস যে আপনি তৈরি করতে পেরেছেন সে বিষয় আমার সন্দেহ আছে। যাক গে…” মিলারের চোখে একটু উল্লাসের ভাব দেখা দিতেই এরিকসন হাত তুলে মিলারকে নিরস্ত করে বলল, “আনন্দিত হওয়ার কিছু হয়নি। দেখুন মশাই, আমরা তিনজন খুবই কঠিন গ্যাঁড়াকলে পড়ে গেছি। আমাদেরকেই এই অবস্থা থেকে বেরনোর ব্যবস্থা করতে হবে। আর শুধু আমরা তিনজন না, না জানি আরও কত লোক আমাদের মতো ফেঁসে আছে এই জগতে।”

“যদি কিছু মনে না করেন, একটু বুঝিয়ে বলবেন আসলে কী হয়েছে?”

“নিশ্চয়ই… ভেরি সরি। আমার আগেই বলা উচিৎ ছিল। দেখুন মিস্টার… কী যেন আপনার নামটা?”

“মিলার। ডেভ মিলার।”

“হ্যাঁ ভাই, ডেভ। আমার মনে হচ্ছে এই পরিস্থিতি থেকে বের হতে হতে আমরা একে অপরের সঙ্গে ভালোভাবে পরিচিত হয়ে যাব। যাই হোক। আপনি জানেন বোধ হয় ‘টাইম’ বা সময় কী তা নিয়ে বিজ্ঞানের জগতে অনেক তত্ত্ব আছে। আমি আবার এইসব তত্ত্ব নিয়ে পাগলের মতো চর্চা করি। কেউ বলে সময় অসীম, কেউ বলে সময় বিশাল এক কেঁচোর মতো! আমি এগুলোর কোনোটাই বিশ্বাস করি না, কারণ এদের মতে সময়কে প্রতি মুহূর্তে তৈরি করা হচ্ছে। আমার ধারণা এই তত্ত্ব নেহাতই কল্পনাপ্রসূত।”

“আমার মতে সময় চির-বিদ্যমান। এটা আংটার পর আংটা জুড়ে জুড়ে কোনো এক ক্রম-বর্ধমান শিকলের মতো নয়। কারণ এই শিকলের সামনের প্রান্ত যদি থাকে, তাহলে এর শেষ প্রান্তও আছে। কিন্তু এমন কোনো কাল ধারণা করা কি সম্ভব যখন সময় বলে কিছু নেই? তাই আমার মনে হয় এই সময় অনেকটা গোলাকার রেললাইনের মতো। শুরু বা শেষ বলে কিছু নেই। এই রেলপথে যাত্রার মধ্যেই আমাদের জন্ম-মৃত্যু হয়ে থাকে। কোনো একটি স্থানে আমাদের বর্তমানের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের অতীত ও ভবিষ্যতও বিরাজ করে।”

এ সব শুনে মিলারের মাথা ভোঁ-ভোঁ করছিল। মিলার মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, “আমি এই বিজ্ঞানের জগতে একেবারেই আনাড়ি। এ জিনিস বোঝা আমার দ্বারা সম্ভব না।”

“স্বাভাবিক! আমি যেই বিষয়ে সারাজীবন নিজেই হতবুদ্ধি হয়ে হাতড়ে গেছি, আপনি একবারে সেটা বুঝে যাবেন এ আশা করাই অন্যায়। সবচেয়ে সহজ করে আমি যেটা বলতে পারি তা হল, মনে করুন আমরা এমন এক ট্রেনে যাত্রা করছি যা আজীবনকাল ধরে এক বিশাল চক্রাকার পথে ঘুরে চলেছে।”

“এখন কেউ চাইলেও এই ট্রেনের আগে গিয়ে ভবিষ্যৎ দেখে আস্তে পারবে না, বা ট্রেন ছেড়ে দিয়ে চুপচাপ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে আবার ট্রেনের ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করতে পারবে না। এখন আমার যা পরিকল্পনা ছিল সেটা হল এই বৃত্তাকার পথের মাঝখান বরাবর আরেকটি রাস্তা তৈরি করা যাতে মানুষ ট্রেনের পিছনের কামরায় উঠে পড়তে পারে। আপনি, আমি আর এই কুকুরটা মিলে প্রায় সেটাই সম্ভব করে তুলছিলাম আরেকটু হলেই।”

“আরেকটু হলেই মানে?” মিলার একটু ঝেঁঝেই জিজ্ঞাসা করল।

“আমরা কোনোভাবে এই রাস্তার মাঝামাঝি আটকে গেছি। আমরা এমন একটি মুহূর্তের মধ্যে বাস করছি যেখান থেকে এগিয়ে বর্তমানে আসতে পারছি না, বা পিছিয়ে অতীতেও যেতে পারছি না। আমারই বানানো টাইম ইম্পালসর মেশিন আমাদের অনন্তকালের জন্য এখানে এনে ফেলেছে। বলতে পার আমরা এক দ্বীপের মধ্যে আটকা পড়ে আছি।”

“কিন্তু… তাহলে অন্যরা সব কই? আমার স্ত্রী? তার কী অবস্থা?” মিলারের মনে এই প্রশ্ন উদয় হল।

“তারা সবাই এখানেই আছে,” এরিকসন জবাব দিল, “তুমি যদি খুঁজে বের করতে পার তাহলে তোমার স্ত্রীকেও দেখতে পাবে। কিন্তু তাকে তুমি এক মূর্তির মতো দেখবে। কারণ আমাদের কাছে সময় বলে কিছুর অস্তিত্ব নেই। এখানে একটা জিনিস যা আমি আগে ভাবিনি তা হল যে এই সময়ের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অনুপলের মধ্যেও যে বেঁচে থাকা যায় এটা আমার ধারণার বাইরে ছিল। আর যারা জীবিত থেকে মৃত অবস্থার মাঝামাঝি রয়েছে তাদের জন্য সময়ের এই নিয়মকানুন অন্যরকমভাবে প্রযোজ্য হয়।”

“তার মানে আপনি বলতে চাইছেন আমরা আসলে মৃত?” তিক্তস্বরে বলল মিলার।

“একেবারেই না। আমরা তো ঘুরছি, ফিরছি, কথা বলছি। কিন্তু আমরা একেবারে জীবন-মরণের সীমানার কাছাকাছি রয়েছি। আমি যখনই ইম্পালসরে হাই পাওয়ার দিয়েছি তখনই কিছু একটা গড়বড় হয়েছে মনে হয়। আমার মনে হয় সেইসময় কোনো দুর্ঘটনা হয় যন্ত্রে, তার ফলস্বরূপ আমার মৃত্যুও আসন্ন হয়ে পড়ে। ঠিক সেই সময়টাতেই তুমিও আত্মহত্যা করতে গেছিলে।”

একটু ভেবে এরিকসন বলল, “ডেভ, আমরা হয়তো মরতে চলেছি। কিন্তু আমাদের সামনে একটাই রাস্তা খোলা, সেটা হল এই যন্ত্রটাকে কোনোরকমে ঠিক করা। এটা ঠিক হলে এর সাহায্যে আমরা হয় অতীতে নয় বর্তমানে ফিরতে পারব। অতীতে ফিরলে হয়তো এ যাত্রা বেঁচে গেলেও যেতে পারি, বর্তমানে ফিরলে মৃত্যুকে বরণ করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।”

“তাই করুন। অন্তত এই পরিস্থিতির থেকে তো রেহাই পাওয়া যাবে।”

“আমি তো লাইব্রেরি এসেছিলাম কিছু দরকারি বইয়ের জন্য। আমার নিজের বইগুলো আমার স্টাডিরুমে রয়ে গেছে— সে ঘরে তো ঢুকতেই পারছি না। আর এখানেও বইগুলো যেন সিমেন্টের মতো আটকে আছে। নাড়ানো যাচ্ছে না। আমাদের হয়তো ল্যাবেই ফিরে যেতে হবে।”

মিলার মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ, তাই চলুন। হয়তো মেশিনটা দেখলে আপনার মাথায় নতুন কোনো বুদ্ধি আসতে পারে।”

“তাই যেন হয়”, বিষণ্ণ হেসে এরিকসন বলল, “নয়তো এতক্ষণ তো ব্যর্থতা ছাড়া কিছুই পাইনি।”

লাইব্রেরি থেকে ওয়েস্ট উইলশায়ার হাঁটাপথে পাক্কা একঘণ্টার রাস্তা। ওয়ানামেকার ইন্সটিটিউটের বিশাল ব্রোঞ্জ আর কাচের দরজাগুলো বন্ধ হয়ে রয়েছে। কিন্তু এরিকসন অন্য দিকে নিয়ে গেল মিলার আর কুকুরটাকে।

“পেছন-দরজা দিয়ে আমরা ওপরে ওঠার চেষ্টা করব। আমাদের অফিসের দরজাগুলোতে উপরের দিকটায় কাচের পাল্লা সরিয়ে ঘুলঘুলির মতো বাতাস আসা-যাওয়ার ব্যবস্থা করা যায়। সেগুলো বা সাধারণ ঘুলঘুলি ইত্যাদি দিয়ে নিশ্চয়ই কোথাও না কোথাও আমরা ভেতরে ঢোকার রাস্তা পাব।”

পেছন দিকটায় আসতেই দেখা গেল দুজন স্ট্যাচু একটা বিশাল আলমারির মতো কী একটা নিয়ে যাচ্ছে। পেছনের মূর্তি হয়ে থাকা লোকটার ঘাড়ে উঠে আলমারির উপর দিয়ে হেঁটে আবার সামনের লোকটার কাঁধে ভর দিয়ে ওরা দরজার দিয়ে ঢুকে গেল কোনোমতে। তারপর সিঁড়ি ভেঙে পনেরো তলা অবধি হেঁটে উঠল— যে তলায় ল্যাব আছে এরিকসনের। এসে দেখা গেল দরজা বন্ধ। দরজায় লেখা আছে ‘অ্যাপয়েনমেন্ট ছাড়া প্রবেশ নিষেধ’।

দরজার ওপরে একটা ঘুলঘুলি পাওয়া গেল যা কি না এসি-র সুড়ঙ্গের সঙ্গে যুক্ত। ঘুলঘুলির ঢাকনা সরিয়ে কোনোরকমে তারা ওই ধাতব অন্ধকার সুড়ঙ্গে প্রবেশ করল। মেজরকেও ঠেলেঠুলে ঢুকিয়ে দেওয়া হল। কিছুদূর টেনে-হিঁচড়ে যাওয়ার পর আরেকটি ঘরের ঘুলঘুলি দিয়ে ওরা বেরল।

এই ঘরে দেখা গেল রিসেপশনিস্টের টেবিল রয়েছে, তার পেছনে শক্ত মুখে এক মহিলা বসে আছে। তার পাশ দিয়ে মিলাররা ল্যাবে প্রবেশ করল।

জন এরিকসনের ল্যাবরেটরি ঘরটা বেশ আলোকিত। একদিকের দেওয়ালে বিশাল কাচ লাগানো, আর ওপরে খোলা স্কাইলাইট। টাইম ইম্পালসর যন্ত্রের উপর রোদের ফালি এসে পড়ছিল স্কাইলাইট থেকে। রাস্তায় আসতে আসতে যদিও বিজ্ঞানী ভদ্রলোক এই যন্ত্রের কার্যপ্রণালী সংক্ষেপে বুঝিয়ে দিয়েছিল মিলারকে, তাও মিলার খুব যে বুঝেছে তা মনে হল না। রাস্তায় ইলেকট্রিক পোস্টের ওপরে যেমন তিনটে ট্রান্সফরমার সার বেঁধে বসানো থাকে, মিলারের কাছে যন্ত্রটা তার থেকে বেশি কিছু মনে হচ্ছিল না। একটাই পার্থক্য, এখানে ট্রান্সফরমারগুলো ওপর থেকে ঝুলে থাকা বিশাল এক ব্রোঞ্জের গোলকের সঙ্গে সংযুক্ত করা।

“দেখ হে মিলার, দেখ এই রাক্ষসকে যে আমাদের এই বিপদে ফেলেছে,” এরিকসন ঈষৎ রাগত স্বরে বলল, “আইন, সমাজ যে মেনে নেবে ততটাও সভ্য নয় এই রাক্ষস, আবার শক্তিতেও অনেক পিছিয়ে। ভালো করে দেখে নাও।”

মিলার পকেটে হাত দিয়ে ভ্রু কুঁচকে দেখতে লাগল জটিল যন্ত্রপাতি। কিছুক্ষণ দেখার পর ঘরের আরেকটি জিনিসের দিকে তার নজর গেল। ইম্পালসরে যেরকম ট্রান্সফরমারের মতো যন্ত্র লাগান, ঠিক সেরকম আরেক সেট রয়েছে ঘরের আরেক কোনে।

“ওটা কী?” মিলার সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞাসা করল, “এই এখানে মনে হচ্ছে একই জিনিস লাগানো।”

“হ্যাঁ, ঠিক বলেছ।”

“কিন্তু… আপনি তখন বললেন না যে আপনার আরেক লেভেল এনার্জি দরকার ছিল?”

“হ্যাঁ, আরেক প্রস্থ এনার্জি সোর্স থাকার দরকার ছিল।”

“তাহলে…” মিলার একবার যন্ত্রের দিকে তারপর এরিকসনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “এটা এটা ব্যবহার করেননি কেন?”

উত্তেজিত মিলারকে দেখে কিঞ্চিৎ মজাই পেল এরিকসন, “করতে পারতাম, কিন্তু কী দিয়ে ওটাকে জুড়ব?”

“কেন? তার দিয়ে?”

বিজ্ঞানী আঙুল দিয়ে গোল করে পেঁচানো একটা তারের কুণ্ডলী দেখিয়ে বলল, “দেখা যাক চেষ্টা করে, ওটা নিয়ে আসো দেখি…”

মিলার ওটা আনার জন্য দ্রুত যেতে গিয়ে অর্ধেক গিয়েই থেমে গেল। “উফ্, বুঝেছি”, মুচকি হেসে বলল, “এ তার তো শালা এখন এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং এর মতো অনড় হয়ে রয়েছে। আমিও পাঁঠার মতো কথা বলি।”

এরিকসন হাসতে গিয়েও হঠাৎ সিরিয়াস হয়ে গেল।

“দেখ ভাই, সত্যি কথা সোজাসুজি বলাই ভালো। আমি এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার তেমন কোনো রাস্তা দেখছি না। কিন্তু তাও আশা ছাড়তে পারছি না। কারণ এই মেশিনটা এখনও চলছে কিন্তু। একে যদি আরেক প্রস্থ বিদ্যুৎ দেওয়া যায়, তাহলে এই অনিশ্চয়তার দশা থেকে মুক্তি পেতে পারি। কিন্তু মুশকিল হল, এই অনড়-অটল জগতে কী করে পঁচিশ ফুট লম্বা তার পাব?”

হঠাৎ হাতের আঙুলে কি একটা ভেজা স্যাঁতসেঁতে ঠেকল মিলারের। নীচে তাকিয়ে দেখল মেজর তার দিকে একটা সহানুভূতির দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। মিলার কানের পেছনটা চুলকাতে শুরু করতেই মেজর বেশ আশ্বস্ত হয়ে চোখ বুঝল। মিলার মনে মনে ভাবছিল এমন টেনশনের সময়ে তাকে যদি কেউ এরকম আদর করে দিত! হেলেন যে কোথায়!

মিলার ঠান্ডা গলায় বলল, “এখান থেকে বেরতে না পারলে তো আমরা না খেয়েই মরব।”

“না, সেটা হয়তো হবে না। আমার এখনও খিদে পায়নি। আর খিদে পাবে বলেও মনে হয় না। আমাদের শরীর কিন্তু এখনও ওই এক সেকেন্ডের মধ্যেই রয়েছে। আর এক সেকেন্ডের মধ্যে কারোর দুম করে খিদে পেয়ে যায় না। এই এক সেকেন্ডকেই রাবারের মতো টেনে বড়ো করা হয়েছে মনে করে নাও, এর মধ্যে কোনো রোগ হয়ে মরারও সম্ভাবনা নেই।”

“আমাদের শরীরের কোনো পরিবর্তন হতে দেওয়া যাবে না, বুঝলে?” এরিকসন বলল, “বিষ বা ছুরি-বন্দুক— এসব থেকে একটু দূরেই থাক তুমি।”

মিলারের হতাশায় কালো হয়ে থাকা মুখে হঠাৎ দুষ্টু হাসি দেখা গেল।

“একটা রফা করা যাক,” মিলার বলল, “আমাদের যন্ত্রপাতি নিয়ে এই কাজ-টাজ শেষ হয়ে গেলে আমরা আর একসঙ্গে থাকব না, যে যার মতো নিজের পথ দেখব। একসঙ্গে থাকলে আমি শুধু আপনাকে দোষ দেব এই ঘটনার জন্য, যদিও আমি সমানভাবে দায়ী। আমি চাই না কোনোরকমেই আপনাকে দোষ দিতে। আপনার কী মত?”

এরিকসন মিলার হাতটা নিজের মুঠোয়ে নিয়ে বলল, “তুমি ভুল কিছু বলনি। কিন্তু আমি একটা উপদেশ দেব, নেবে? মদটা ছাড়ো। মদ আর আইরিশম্যান— একেবারে তেল আর জলের মতো। কোনোদিন মিশ খায় না। তুমি একটু চেষ্টা করলেই কয়েকদিনের মধ্যে তোমার দোকান আবার দাঁড় করিয়ে দেবে।”

“থ্যাংকস”, মিলার উজ্জ্বল চোখে বলল, “আমিও আপনাকে কথা দিচ্ছি, এক সাপের কামড় খেলে প্রতিষেধক হিসেবে হুইস্কি খাওয়া ছাড়া আর কোনো কিছুই আমাকে মদের গ্লাসের কাছে নিয়ে যেতে পারবে না।”

এর পরের দুই ঘণ্টা ল্যাবরেটরিতে নৈরাশ্য বিরাজ করেছিল। কে জানত কিছুক্ষণের মধ্যেই আশার নতুন আলো নৈরাশ্যের আঁধার ঘুচিয়ে দেবে?

এরিকসন সাহেবের বিজ্ঞানে অনেক ব্যুৎপত্তি থাকতে পারে, কিন্তু আশার আলো আনতে সক্ষম হল মিলার। মিলার খুব সাধারণ মানুষের মতো চিন্তা করছিল যে কীভাবে দুটি যন্ত্রাংশের মধ্যে বিদ্যুৎ-সংযোগ পূর্ণ করা যায়। পকেটে হাত দিয়ে সে হাঁটতে হাঁটতে সে চিন্তা করছিল। পকেটের খুচরো পয়সা আর চাবিতে ঝনঝন শব্দ হচ্ছিল। হঠাৎ মিলার দাঁড়িয়ে পড়ল। দাঁড়িয়ে পকেটটাকে আবার ঝাঁকাল, ঝনাৎ।

“এরিকসন সায়েব!” মিলার দম নিয়ে বলল, “পেয়ে গেছি আমাদের তার, এই দেখুন।”

বিজ্ঞানী ভদ্রলোক মিলারের দিয়ে তাকিয়ে থাকল, তাও কিছু বুঝতে পারল না।

“হ্যাঁ, তার কই?” অবিশ্বাসের চাহনি দিয়ে বলল এরিকসন।

“আরে আমরা তো এটা আগে ভেবেই দেখিনি…” মিলার সোৎসাহে বলে উঠল, “আমার কাছে চাবি আছে, আপনার কাছে চাবি আছে… তা ছাড়া কয়েন আছে, হাতঘড়ি আছে, ছুরি আছে… এগুলো একটার পর একটা লাগিয়ে বড়ো তারের মতো করা যাবে কি না ?”

এরিকসন স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল, যেন কারেন্ট খেয়ে হতভম্ব হয়ে গেছে।

তারপর জোর গলায় বলে উঠল, “কেন হবে না? তবে আমাদের কাছে যা আছে তা যথেষ্ট হবে কি না সন্দেহ! পঁচিশ ফুট লম্বা করতে হবে অন্তত।”

সঙ্গে সঙ্গে দুজনে তাদের পকেট খালি করতে শুরু করে দিল। টান মেরে যে যার হাতঘড়ি খুলে ফেলল, চাবি, ছুড়ি, পেনসিল ইত্যাদি যার কাছে যা ছিল সব মেঝের মধ্যে ডাঁই করে রাখতে লাগল।

“ভগবান করুক যেন কুলিয়ে যায়। শুধু একটা তারের দৈর্ঘ্য মতো জিনিসপত্রের জোগান চাই। ট্রান্সফরমারে আগে থাকতেই কারেন্ট গোঁজা আছে। শুধু ওটার সঙ্গে গ্লোবটার পজিটিভ পোলের একটা কানেকশন করতে পারলেই কেল্লা ফতে।” পাতলা চুলের মধ্য দিয়ে আঙুল বোলাতে বোলাতে বলল এরিকসন।

দুজনে ছোটাছুটি করে জিনিসপত্র দিয়ে তার বানাতে লাগল। মিলার ছুরি দিয়ে তার ঘড়ির স্ট্র্যাপ আড়াআড়ি কেটে ফেলল, কাটা অংশটা আবার জুড়ে আরও বেশি দৈর্ঘ্যের পরিবাহী বানাতে চাইল। ঘড়িটাকে সাবধানে ভেঙে ভেতরকার কিছু যন্ত্রাংশ দিয়েও কিছুটা তার তৈরি করা গেল। ধাতব মুদ্রাগুলিও অনেকটা প্রয়োজন মেটাল।

অর্ধেক জিনিসপত্র দিয়েই দশ ফুট মতো তার বানানো গেল। পেন-পেনসিল যা ছিল সেগুলোও কেটে তারের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হল। চাবির রিং এক্ষেত্রে খুবই সাহায্য করল। এইভাবে মোটামুটি আঠেরো ফুট তৈরি হওয়ার পর কাজের গতি কিছুটা থমকে গেল।

মিলারের কপাল থেকে দরদর করে ঘাম পড়ছিল। নিজের আংটিটা কেটে সোজা করে নিয়েছে সে গায়ের জোরে। এরিকসনের কোমরের গার্টার থেকে আর গ্যালেস এর বেল্ট থেকে কিছু ধাতুর আংটা মতো পাওয়া গেল। তাতেও কয়েক ইঞ্চি বাড়ানো গেল। কিন্তু তারপর তাদের থেমে যেতে হল। আর কিছুই যোগ করা গেল না। তখন মাত্র এক ফুট বাকি!

মিলার বিরক্তিতে মুখ কুঁচকে আওয়াজ করল। ছুরিটাকে হাওয়াতে ছুড়ে দিয়ে বলল, “এটা দিয়েও ইঞ্চি চার-পাঁচ পাওয়া যাবে, কিন্তু তারপর?”

এরিকসনও বিমর্ষ হয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। হঠাৎ কী যেন ভেবে তুড়ি মেরে উঠল।

“জুতো খোল,” এরিকসন প্রায় চিৎকার করে উঠল, “জুতোয় অনেক পেরেক আছে, সব ক-টাকে কেটে বার করে দাও তো মিলার।”

দশ মিনিটও লাগল না জুতোগুলোর একটা বড়োসড়ো চামড়ার স্তূপে পরিণত হতে। এরিকসনের নিপুণ হাত একেকটা পেরেককে টেনে টেনে বার করেছে অনেক ব্যথা সহ্য করে। পেরেকগুলোকেও লাইনে যুক্ত করার পর দেখা গেল আর মাত্র ছয় ইঞ্চিরও কম দূরত্ব বাকি।

মিলারের জুতো থেকেও আরও কিছু পেরেক পাওয়া গেল। কিন্তু সেগুলো যুক্ত করেও তিন ইঞ্চির মতো বাকি রয়ে গেল।

“মাত্র তিন ইঞ্চির জন্য হেরে গেলাম?” এরিকসন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “বর্তমান কাল থেকে মাত্র তিন ইঞ্চি দূরে, কিন্তু তাও মনে হচ্ছে হাজার মাইলের কম নয়।”

মিলারের মনে হচ্ছিল তাকে যেন কেউ জাঁতাকলে পিষেছে, ব্যথায় সারা শরীর যেন টাটিয়ে ছিল। হঠাৎ মেজরের ঠান্ডা নাকের স্পর্শ মেজরের হাতে লাগতেই হঠাৎ করে চমকে উঠে নড়ে উঠতেই সারা গা ব্যথায় টনটন করে উঠল। বিরক্তি ও অনিচ্ছা সত্ত্বেও মিলার মেজরের ঘাড়ে চুলকে দিতে লাগল।

“শালার দুনিয়ায় আর কোনো মেটাল নেই যা আমাদের কাজে আসতে পারে… আর এদিকে এ দেখো সুখেই আছে।” মিলার গজগজ করতে লাগল।

মিলারের মেজাজ গরম দেখেও মেজর কুঁই-কুঁই করতে করতে মিলারকে ঠেলতে লাগল। মিলারও ধৈর্য হারিয়ে মেজরকে জোরে ঠেলে দিল দূরে, “যা তো… ভাল্লাগছে না ছাই…”

তারপরেই চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, “আরে দাঁড়া দাঁড়া, এই তো পেয়েছি! তোর তো শালা মেটালের নেমপ্লেট রে!”

এক পলকের মধ্যে চৌকো পিতলের পাতটা মিলারের হাতে চলে এল। এরিকসন ছোঁ মেরে মিলারের হাত থেকে সেটা নিয়ে নিল। তারপর যেটুকু ফাঁক ছিল তার আর গ্লোবের পজিটিভ পোলের মধ্যে সেই জায়গাটা পূর্ণ করে দিল।

“ব্যাস হয়ে গেছে!” এরিকসন হেসে বলল, “কি হে মিলার! শেষ পর্যন্ত আমরা এই অবস্থা থেকে বেরতে পারছি, অ্যাঁ? জানি না বর্তমানে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মৃত্যু হবে না মৃত্যুকে পাশ কাটানোর মতো সময় পাব… তাও আমরা যাচ্ছি।”

ঝনাৎ করে ধাতব পাতের উপর মেজরের নেমপ্লেটটা পড়তেই বিদ্যুৎপ্রবাহ শুরু হয়ে গেলে। ট্রান্সফরমারটা গোঁ-ও আওয়াজ করে চলা শুরু করে দিল। তারের একাধিক জোড় থেকে চড়চড় আওয়াজ আসতে লাগল ছোটো ছোটো স্ফুলিঙ্গের। গোঁ-ও আওয়াজটা ধীরে ধীরে বাড়তে লাগল আর মাথার উপরে ব্রোঞ্জের গোলকটা কেমন যেন সবজেটে রং নিতে লাগল। মিলারের মনে হল মাথাটা অদ্ভুতভাবে কেমন যেন হালকা হয়ে যাচ্ছে। তারপর এক ঝটকা মতো লাগল আর তার পারিপার্শ্বিক থেকে এরিকসন, মেজর আর ল্যাবরেটরি উধাও হয়ে যেতে লাগল।

কে যেন খুব চিৎকার করছে।

“ডেভ, ডেভ! কি গো শুনছ?”

আরে! হেলেনের গলা না?

হ্যাঁ তাই তো! মিলার টের পেল হেলেন কোলের উপর তার মাথাটা শুইয়ে মুখের কাছে ঝুঁকে আছে।

“যাক বাবা তুমি বেঁচে আছো!”

“হেলেন! তু… তুমি এখানে?” মিলার অস্ফুট স্বরে বলে উঠল।

“আমার মন টিকল না এখান থেকে চলে গিয়ে। তোমাকে ছেড়ে আমি থাকতে পারলাম না। আমি সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে এলাম। বাড়িতে ঢুকতে যাব এমন সময় বন্দুকের আওয়াজ পেলাম ভেতর থেকে। তার দৌড়ে এসে তোমাকে তুললাম। ডাক্তারও এসে পড়ল বলে, খবর দিয়েছি পাঁচ মিনিট আগে।”

“পাঁচ মিনিট? আমি গুলি চালিয়েছি মাত্র পাঁচ মিনিট হল?”

“ছয়-সাত মিনিট হবে। আমি তো ঢুকেই ডাক্তারকে ফোন করলাম।”

মিলার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এত সব কাণ্ড তাহলে বোধ হয় সব স্বপ্নে হয়েছে। না হলে মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে এত কিছু তো হওয়ার নয়।

“কিন্তু গণ্ডগোলটা করলাম কোথায়? এত বেহেড মাতালও ছিলাম না যে নিজের মাথা মিস করে যাব!”

হেলেন বেসিনে পড়ে থাকা পিস্তলের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল, “ওই ঠাকুরদার আমলের পয়েন্ট ফোর-ফাইভটার কথা বলছ? সে তো সিভিল ওয়ারের পর থেকে পড়ে ছিল আলমারিতে, ব্যবহার হয়নি। গুলির ভেতরে বারুদে ড্যাম্প ধরে গেছে হয়তো। বারুদে বিস্ফোরণটাই ঠিকঠাক হয়নি। বুলেট ফায়ার হয়েছে ঠিকই কিন্তু এত আস্তে হয়েছে যে তোমার কিছু হয়নি। কিন্তু তুমি আমাকে কথা দাও আর কোনোদিন এমন চিন্তাও করবে না ডেভ। আমি আর তোমার কাজ নিয়ে কোনো খোঁটা দেব না।”

“তুমি খোঁটা দেওয়ার কোনো সুযোগ আর পাবে না আর, বুঝলে হেলেন। অনেক লোকের মতো বেশি বেশি পড়াশোনা আমি তেমন করিনি বটে, কিন্তু আসল শিক্ষা আমি ঠিক পেয়ে গেছি। দোকানটা কীভাবে দাঁড় করানো যাবে সে বুদ্ধি আমার আছেই, কিন্তু এতদিন শালা আলস্য করে কাটিয়েছি, কোনোদিন চেষ্টা করিনি। আমার মনে হচ্ছে এখনি উঠে আমি যুদ্ধে যাওয়ার মতো করে কাজে লেগে যেতে পারি। তারপর তুমি তো আছোই, দুজনে মিলে ঠিক সামলে নেব। নেব না সোনা?”

মিলারের কাঁধের খাঁজে মুখ রেখে হেলেন কাঁদতে কাঁদতে কী যেন বলতে লাগল। ভালো করে শোনাও গেল না, বোঝাও গেল না। কিন্তু ডেভ মিলার ঠিক বুঝতে পারছিল হেলেন কী বলতে চাইছিল।

কিন্তু জন এরিকসন, তার ‘টাইম ইম্পালসার’ যন্ত্র, মেজর নামের কুকুর— এদের স্মৃতিটাকে মিলার স্বপ্ন বলেই মেনে নিয়েছিল। কিন্তু পরের দিন রাত্রিবেলা ‘ইভনিং কুরিয়ার’ পত্রিকাটি হাতে পড়তেই একটা খবরে তার নজর চলে গেল।

গবেষণাগারে বিশিষ্ট বিজ্ঞানীর রহস্যময় মৃত্যু, তদন্তে পুলিশ

বিশেষ প্রতিবেদন: ওয়ানামেকার ইন্সটিটিউটের প্রধান বিশিষ্ট বিজ্ঞানী জন এম. এরিকসনকে গত রাতে মৃত অবস্থায় আবিষ্কার করে তার সহকর্মীরা। বিজ্ঞানী এরিকসন যেমন জনপ্রিয় তেমনই বিজ্ঞানের দুনিয়ায় যথেষ্ট অবদান রেখে গেছেন। সাম্প্রতিককালে ওঁর প্রকাশিত ‘টাইম ল্যাপ্স’ থিয়োরিটি বিজ্ঞান-জগতে বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।

দুটি অদ্ভুত ঘটনা এই মৃত্যুকে সন্দেহজনক করে তুলেছে। প্রথম ঘটনা হল ওই গবেষণাগারেই একটি জার্মান শেফার্ড কুকুরের মৃতদেহ আবিষ্কার হয়েছে, যার মাথাটি ভারী কিছু দিয়ে থেঁতলানো। আরেকটি অদ্ভুত ব্যাপার হল ঘরের এক কোন থেকে অপর কোন অবধি ছোটো ছোটো ধাতব জিনিসের একটা সারি দেখা গেছে। মনে করা হচ্ছে বিদ্যুতের তারের মতো ব্যবহার করা হয়েছে এই সারিকে। কিন্তু পুলিশ এই ধারণা নাকচ করে দিয়েছে, কারণ গবেষণাগারেই পর্যাপ্ত পরিমাণ অব্যবহৃত বৈদ্যুতিক তারের কুণ্ডলী পাওয়া গেছে।

————————————————————————————–

প্রথম প্রকাশ: অ্যামেজিং স্টোরিজ, অক্টোবর ১৯৪০

Tags: kalpabiswa y7n1, science fiction, কল্পবিজ্ঞান গল্প, প্রমিত নন্দী, ব্র্যাডনার বাকনার, রাকেশকুমার দাস

10 thoughts on “যখন সময় থমকে দাঁড়ায়

  • July 10, 2022 at 12:33 am
    Permalink

    অসাধারণ অনুভূতি হল গল্পটা পড়ে।

    Reply
    • July 21, 2022 at 2:32 pm
      Permalink

      অনেক ধন্যবাদ পাঠ-প্রতিক্রিয়ার জন্য।

      Reply
      • August 1, 2022 at 11:48 am
        Permalink

        ভালো অনুবাদ। গল্পও সুন্দর। কল্পবিশ্বকে ধন্যবাদ।

        Reply
        • August 19, 2022 at 11:35 pm
          Permalink

          অনেক ধন্যবাদ আপনার উৎসাহব্যঞ্জক মন্তব্যের জন্য।

          Reply
  • July 22, 2022 at 11:49 am
    Permalink

    দারুণ অনুবাদ। গল্পটিও চমৎকার।

    Reply
    • August 19, 2022 at 11:37 pm
      Permalink

      অনেক ধন্যবাদ আপনার মন্তব্যের জন্য।

      Reply
  • July 22, 2022 at 11:50 am
    Permalink

    ভালো অনুবাদ।

    Reply
  • July 23, 2022 at 8:18 pm
    Permalink

    খুব প্রিয় গল্প। সাবলীল অনুবাদ হয়েছে। গল্পের নামের বাংলাটাও খুব কাব্যিক। তবে শেষে একটা ছোটো লেখক পরিচিতি থাকলে ভালো হত। গল্পটি ছদ্মনামে লেখা। লেখকের আসল নাম এড আর্ল রেপ।

    Reply
    • August 19, 2022 at 11:41 pm
      Permalink

      অনেক ধন্যবাদ। সত্যি লেখক পরিচিতি একটু থাকলে ভাল হত। লেখা জমা দেবার তাড়াহুড়োতে খেয়াল ছিল না।

      Reply
  • February 15, 2023 at 9:51 pm
    Permalink

    যেমন চমৎকার গল্প তেমনই সাবলীল অনুবাদ। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে ।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!