মা
লেখক: সায়ক দত্ত চৌধুরী
শিল্পী: প্রমিত নন্দী
।১।
১৮/৮/২২৪৫
“রুনু, এই রুনু…”
ধড়মড় করে ঘুম থেকে উঠে বসলাম। দেয়ালের খুদে পর্দাটায় মায়ের ছবিটা ভাসছিল। ঘুরে তাকাতে হেসে বলে, “শিগগির ওঠ। দৌড়ে লাউঞ্জে যা। নইলে মিস করবি।”
তাড়াহুড়ো করে সাফসুতরো হয়ে লাউঞ্জে গিয়ে দেখি ততক্ষণে খুব ভিড় হয়ে গেছে সেখানে। মাইকে অ্যানাউন্স করছিল, “গোলন্দাজ টিম নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে গেছে। আর চার মিনিটের মাথায়…”
অমনি আমি ভিড় ঠেলেঠুলে একেবারে জায়েন্ট স্ক্রিনের সামনে। এখানটা ভিআইপিদের জায়গা। সিটগুলো তুলতুলে ভেলভেটে মোড়া। সামনে পর্দা জুড়ে ইরাবান নামের তারাটার হলদেটে শরীর জ্বলছে। ওটা মায়ের ভেলার ক্যামেরার ছবি। আমি জানি। স্ট্রাইকারদের দলটার একদম সামনে রয়েছে মায়ের ভেলা।
হঠাৎ পর্দা জুড়ে মায়ের মুখটা ভেসে উঠল, “আমরা প্রস্তুত।”
“নিশানা?” ভেলভেটোমোড়া সিটগুলোর একটা থেকে প্ল্যানেটিয়ার শিপ-এর ক্যাপ্টেন উমেদ সিং-এর ভারী গলাটা প্রশ্ন করল।
“নির্দিষ্ট আঘাতবিন্দুতে নিশানা বাঁধা হয়েছে।”
“ট্র্যাক্টর টিম?”
“তৈরি।”
পর্দায় ইরাবানকে ঘিরে চল্লিশটা আলোর ফোঁটা জেগে উঠেছে। ওরা মায়ের টিম। চল্লিশটা ভেলা। তাদের থেকে এগিয়ে আসা চল্লিশটা আলোর দাগ ইরাবানের শরীর থেকে অনেকটা দূরে একটা দপদপে সবুজ বিন্দুতে এসে মিলে গিয়েছে।
“সাঙ্ঘাতিক সাহসী মহিলা! স্টার বম্বিং-এর মত বিপজ্জনক কাজে স্বেচ্ছায়…” ভেলভেটের চেয়ারগুলো থেকে আরেকটা গলা ভেসে এল। মিশন ডিরেক্টর সামিরা। কাজটার জন্য মায়ের ভিডিও ইনটারভিউ নিয়েছিলেন। বিধাননগর ‘গরিব আশ্রয়’-এর লঝ্ঝরে কমিউনিকেশন সেট-এ ওঁর সম্ভ্রান্ত চেহারাটা দেখে, কথাবার্তা বলতে মা ভারী সঙ্কোচ করেছিল প্রথমে। সেটা অবশ্য স্বাভাবিক। কোথায় উনি, আর কোথায় মা! অ্যাস্টেরয়েড মাইনিং কোম্পানির সাধারণ গোলন্দাজ! মন্দার বাজারে সে-চাকরিটাও তখন গেছে। ‘গরিব আশ্রয়’-এর বিনিপয়সার ডর্মিটরিতে মা-মেয়েতে মাথা গুঁজে আছি। ইনটারভিউয়ের জন্য পাশের বাঙ্কের পলিমাসীর থেকে একটা ভালো জামা ধার করেছিল মা।
সামিরা বলেছিলেন, “লেজার কামান দিয়ে গ্রহাণু ভাঙা আর স্টার-বম্বিং এক কাজ নয়। এতটুকু ভুলচুক হলে পুড়ে ছাই হয়ে উড়ে যাবে। তোমার দক্ষতা আছে। কিন্তু সাহস আছে কি?”
মা মাথা নেড়ে শুধু বলেছিল, “আছে।”
সেদিন রাতে আমি মাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলাম, “তুমি কাজটা নিও না মা। যদি কিছু…”
মা হেসে বলেছিল, “কেন যাচ্ছি জানিস? ওখানে যে গ্রহটা তৈরি করা হবে, ফার্মের কর্মীদের জন্য সেখানে অনেক কম দামে ফ্ল্যাট দেবে বলে লিখেছে বিজ্ঞাপনে। আমরা আমাদের নিজের তৈরি গ্রহে থাকব। মাটির ওপরের বাড়িতে।”
“মাটির ওপরে? ধ্যাৎ! শহর তো সমুদ্রের নীচে হয়। যেমন আমাদের এই নিউ ক্যালকাটা।”
মা কথা না বলে ভিউস্ক্রিনে একটা পুরোনো বই জুড়ে দিয়ে বলেছিল, “আমার ঠাকুর্দার যিনি ঠাকুর্দা, এটা তাঁর ডায়েরি। দ্যাখ। তিনশো বছর আগে এইটা আমাদের বাড়ি ছিল। মানুষ আসলে মাটির ওপরেই থাকত।”
পর্দায় ভেসে ওঠা ছবিগুলো দেখে কী ভালোই যে লেগেছিল! পাহাড়ের ঢালে পাইনবন। বনের ফাঁকে একটা ছোট্ট কটেজ… পখিদের ওড়াউড়ি…
“আমি মায়ের কাঁধে মুখটা লুকিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “ওই গ্রহটাতেও এইরকম অনেক গাছ থাকবে?”
“হুঁউ।”
“পাখি?”
“অনেক”
সেদিন অনেক রাত অবধি আমরা গল্প করেছিলাম। কাজটা মা পেয়ে গিয়েছে। পরদিন ‘গ্রহ-কারিগর’-এর অফিসে হাজিরা। সেখান থেকে বিশাল প্ল্যানেটিয়ার শিপ-এ ইরাবানের দিকে রওনা। আমাকেও নিয়ে যাবে।
আমি কখনো খোলা আকাশ দেখিনি। মহাকাশ তো দূরের কথা। তাই উত্তেজনায় আমার ঘুম চলে গিয়েছিল। আর মায়ের তো হাজারটা গোছগাছ।
***
মায়ের মুখটা ফের পর্দায় ফিরে এসেছে। ভেলার ফোর্স ফিল্ডের ঢাকনার বাইরে ইরাবানের লকলকে আগুন। মা শান্ত গলায় বলে যাচ্ছিল, “ট্র্যাক্টর এক…”
“…তৈরি…”
ট্র্যাক্টর দুই…”
“…তৈরি…”
হঠাৎ আমার এমন গর্ব হল কী বলব! সামনের লাল ভেলভেটের চেয়ারটার ওপর দিয়ে উঁকি মেরে বললাম, “ওটা আমার মা।”
অমনি চেয়ারটা থেকে একটা বুড়োমত লোক পাশে দাঁড়ানো সিকিউরিটির লোকটাকে ইশারা করল । লোকটা খুব মুশকো। আমায় ঝুলিয়ে তুলে নিয়ে একেবারে পেছনে নামিয়ে দিয়ে বলে, “তুই ফোর্থ ডেক-এর মেয়ে না? ফের যদি ভিআইপি জোন-এ দেখেছি…”
আমি ওই লম্বা-চওড়া লোক গুলোর ভিড়ে পেছন থেকে কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছিলাম না। গুঁতোগুঁতি ঠেলাঠেলি করে আরেকবার সামনে যাওয়ার চেষ্টা করলাম, কিন্তু সিকিউরিটির লোকগুলো আমাকে চিনে ফেলেছিল। আমাকে দেখতে পেয়ে এবার গোটা অঞ্চলের বাইরে বের করে দিল। আমি জানতাম সেক্টর ডি তে আরেকটা টেলিভিসর আছে। এটার মতো বড় না হলেও ওটাতে লাইভ টেলিকাস্ট মোটামুটি ঠিকঠাক দেখতে পাওয়া যায়। আমি ছুটতে আরম্ভ করলাম।
সেক্টর ডি তে অনেকেই আমাকে চেনে, কাজেই সামনে গিয়ে দাঁড়াতে অসুবিধা হলো না। মায়ের ভেলাটা ততক্ষণে গোলন্দাজ দলের সামনে থেকে সরে গিয়ে চল্লিশ জনের ট্রাক্টর টিমের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। এটাই ইঙ্গিত গোলন্দাজ টিম তাদের কাজ শুরু করতে পারে। আমার মনে পড়ল মা কিভাবে তাদের কাজগুলো আমায় বুঝিয়ে বলেছিল।
সোলার নেবুলার গ্যাস আর ধুলো জমে তৈরি হয়েছিল আমাদের সৌরজগতের গ্রহগুলো। এখানে প্রায় সেই কাজগুলোই হবে, তবে কৃত্রিম পদ্ধতিতে । গোলন্দাজ দল কতগুলো নিউট্রন বোমা ফেলবে ইরাবানের উপর পূর্বনির্ধারিত লক্ষ্যে। প্রচন্ড বিস্ফোরণে সেখান থেকে ছিটকে উঠবে অগ্নিশিখা । ট্রাক্টর টিমের কাজ হল সেটাকে ধরে ফেলে একটা নির্দিষ্ট বিন্দুতে নির্দিষ্ট দূরত্বে টেনে নিয়ে যাওয়া। তারপরের কাজ কুলারদের। অবশ্য মায়ের অভিজ্ঞতার ফলে মা এমন একটা পদে ছিল যে সে এই তিনটি দলকেই প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিতে পারে।
রিভার্স কাউন্টডাউন শুরু হলো । জিরো বলার সাথে সাথে পঁচিশজনের গোলন্দাজ দল একসাথে পঁচিশটা নিউট্রন পাওয়ার রকেট ছুঁড়ল তাদের জি স্টার স্পেস স্ট্রাইকার মডিউলগুলো থেকে। কিন্তু ঠিক তখনই দেখা গেল ইরাবানে সৌরঝড়ের মত এক প্রবল ঘূর্ণির সৃষ্টি হয়েছে। এটা একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল। নিউট্রন বোমার আঘাতে যে দিকে ইরাবানের গ্যাসের অগ্নিকুন্ডটা ছিটকে ওঠার কথা, এর ফলে তার অভিমুখটা একেবারেই বদলে যেতে পারে। হলও তাই।
বোমাগুলো ফাটার সাথে সাথে এক বিশাল আগুনের গোলা এমনভাবে বেরিয়ে এল যে স্ট্রাইকার টিমের দুটো স্ট্রাইকার মডিউল সাথে সাথে ছাই হয়ে গেল। অন্য মডিউল গুলো প্রাণ বাঁচানোর জন্য যত জোরে সম্ভব এদিক ওদিক পালিয়ে বাঁচল। কিন্তু সর্বনাশের তখন আরো বাকি ছিল। দেখা গেল সেটা প্রচন্ড বেগে ধেয়ে আসছে আমাদের এই বিশাল প্ল্যানেটিয়ার শিপের দিকে। স্থির এই বিরাট জাহাজটাকে চালু করে সেই ধাবমান অগ্নিগোলকের গতিপথ থেকে সরানো অসম্ভব, আর আমাদের ফোর্স ফিল্ডের ক্ষমতা নেই এত বড় একটা আঘাত থেকে জাহাজকে বাঁচানোর। ভিসরে আমাদের সাক্ষাৎ মৃত্যুর আকার ক্রমশ বড় হতে লাগল। গোটা জাহাজে সাইরেনের তীব্র চিৎকার, ঘন ঘন ঘোষনা, লোকেদের দৌড়দৌড়ি, এসকেপ পডগুলোর সামনে প্রচন্ড ভীড় আর ঠেলাঠেলি জাহাজটাকে নরক করে তুলল। এসকেপ পডগুলোতে ভিআইপিদের জায়গা করে দিতে আর নিজেরাও তাতে চেপে বসার জন্য সিকিউরিটির লোকগুলো পিশাচের মত লেজার গান ফায়ার করতে লাগল।
আমি আবার ছুটতে ছুটতে ভি আই পি জোনের জায়ান্ট স্ক্রিনটার সামনে পৌঁছলাম। তার মধ্যে একইসাথে জাহাজের বাইরের দৃশ্য, অগ্নিগোলক, উমেদ সিং , সামিরার মুখ দেখা যাচ্ছে। ওঁরা দুজন এখনো জাহাজ ছাড়েন নি। মেগা কম্প আর অটোবট গুলো ইমার্জেন্সি সার্ভিস শুরু করেছে। কিন্তু আমার কেমন মনে হল অগ্নিগোলকটা যত দ্রুত ছুটে আসার কথা তত দ্রুত যেন আসছে না!
একটা ট্রাক্টর ভেলা। তীব্র বেগে ছুটতে ছুটতে সবুজ রশ্মি দিয়ে আটকাতে চেষ্টা করছে গোলকটাকে। কাজটা করতে গিয়ে খুব বিপজ্জনকভাবে কাছে এসে পড়ছে সেটার। মা! কিন্তু অতটুকু ভেলার কতটাই বা ক্ষমতা। লাভ হবে না কিছুই। কিন্তু মা কে দেখেই ট্রাক্টর টিমের বাকি সদস্যরা সচল হয়ে উঠল। পুরো ঝাঁকটা ছুটে এল সেইদিকে। মায়ের মুখ একবার ভেসে উঠল পর্দায়। দৃঢ়, ভয়হীন। ছোট ছোট ভেলাগুলো যেন লিলিপুটেদের মত বেঁধে ফেলার চেষ্টা করতে লাগল গালিভারকে। ওরা সাবধানে দূরত্ব বজায় রেখে রশ্মিগুলোকে কাজে লাগাতে চাইছিল, ফলে সেগুলোর টান ছিল কম। কিন্তু আমার মা অকুতোভয়। একেবারে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়া কাকে বলে সবাই তা দেখতে পাচ্ছিল। অগ্নিগোলকের গতি পরিবর্তিত হচ্ছিল। কিন্তু তা যথেষ্ট ছিল না। এমনসময় মায়ের গলা শুনতে পেলাম,
” থামানো যাবে না, স্টারপার্টের গতিপথ পাল্টাতে হবে।”
সাথে সাথে সামিরার নির্দেশে ট্রাক্টর রশ্মির ইনটেন্সিটি, ভেলার অবস্থান নিয়ে প্রয়োজনীয় ইনপুট পৌছতে লাগল ভেলাগুলোর কম্পিউটারে। অনেকেই নিজেকে বাঁচানোর জন্য অটোপাইলট অন করলেন। কিন্তু মায়ের ভেলাটা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল সেটার রাশ মায়ের হাতে। সবচেয়ে ছটফটে, সবচেয়ে কার্যকরী। এবার ধীরে ধীরে কাজ হচ্ছিল। অগ্নিগোলক অল্প অল্প করে ডানদিকে বাঁকছিল।
” স্টেলার জেট অন। ফুল থ্রটল। ফুল লেফট।” উমেদ সিং এর চিৎকার করে দেওয়া নির্দেশ সব স্পিকারে শোনা গেল। আমরা দমবন্ধ করে জায়ান্ট স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।
মায়েদের টান আর জাহাজের ঘুরে বেঁকে যাওয়ার ফলে অগ্নিগোলকটা আমাদের জাহাজের গা ছুঁয়ে বেরিয়ে গেল। প্রচন্ড ভাবে কেঁপে উঠল প্ল্যানেটিয়ার। যন্ত্রাংশ ভেঙে পড়ল অনেক জায়গাতেই, কিন্তু শেষ রক্ষা হল। আনন্দে হই হই করে উঠল সবাই। এমন সময় পর্দায় দেখলাম সর্বশক্তিতে টানার জন্য মায়ের ভেলা অতি বিপজ্জনকভাবে স্টার পার্টের কাছে চলে গেছে। এখন সেটা দ্রুত গতিতে নিরাপদ দূরত্বে যাওয়ার চেষ্টা করছে। ঠিক তখনই সেই আগুন থেকে ছিটকে বেরিয়ে এল একটা অগ্নিশিখা। শয়তানের হাতের মত মায়ের ভেলাটাকে টেনে নিল আগুনের সাগরে।
আমার মা পুড়ে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে, ছড়িয়ে যাচ্ছে, মিশে যাচ্ছে ওই মহাদ্যূতিতে। আমার চোখের সামনে সবকিছু দুলতে লাগল। আমি চিৎকার করে কাঁদতে চাইলাম। কিন্তু আমার চোখে কোন জল আসছে না কেন? আমার দু চোখে যেন আগুন ধরে গেছে। জ্বলে যাচ্ছে দু চোখ। আমার গলা দিয়ে গোঁ গোঁ করে একটা জান্তব আওয়াজ বের হতে লাগল। ভগবান, আমার দু চোখে বৃষ্টি নামাও, হে ভগবান। খুব কষ্ট, বড় কষ্ট। মা, ও মা, মা গো, ও মা।
।২।
১৮/৮/ ২৩১৩
চায়ের কাপ হাতে ওয়ালভিসরটার সামনে এসে বসলাম। আজ গ্রেটা দ্বিথ্বী গ্রহ সংসদে তার বক্তব্য রাখবে। আজ মহানির্নয়ের দিন।
আমার জীবনটা যেন ওই ওয়ালভিসরের ছবিগুলোর মতই চোখের সামনে দিয়ে ভেসে আসতে লাগল।
দ্বিথ্বীকে যেদিন তার পিতা নক্ষত্রের থেকে ছিনিয়ে আনা হয়েছিল সেদিন মোট ছত্রিশজন প্রাণ হারিয়েছিলেন। নব গ্রহ কারিগর সংস্থার হিসাবে সংখ্যাটা নাকি খুবই কম। মায়ের ভেলা সেই অগ্নিসমুদ্রে মিলিয়ে যাওয়ার পর যা সময় পাওয়া গিয়েছিল তাতে সাবসিডিয়ারি ট্রাক্টর টিম, কুলার টিমগুলো তাদের কাজের সুযোগ পেয়ে গিয়েছিল। সেই মহাতেজা অগ্নিগোলককে সঠিক কক্ষপথে স্থাপন করার পর কুলার টিম তাকে ঠান্ডা করার জন্য মহাকাশের যাবতীয় শীতলতা তার ওপর ঢেলে দিচ্ছিল। আমার শীত করছিল, প্রবল জ্বরের ঘোরে আমি নাকি ভুল বকছিলাম। আমাকে ঘুম পাড়ানো হয়েছিল। আমার সাথে ঘুমিয়ে পড়েছিল জাহাজের অন্য সব মানুষেরাও। দীর্ঘ আটচল্লিশ বছর ঘুমিয়েছিলাম আমরা সবাই। এর মধ্যে সেই স্টার পার্টকে গ্রহে রূপান্তরের নানা ধাপ পার করানো হয়েছে যন্ত্র সহায়কদের সাহায্যে। টেরাবটরা টেরাফার্মিং পদ্ধতিতে তৈরি করেছে বায়ুমন্ডল। মহাকাশযান থেকে বিভিন্ন প্রাণী ও উদ্ভিদের স্পিসিস কে নিয়ে যাওয়া হয়েছে সেই গ্রহে, বড় করা হয়েছে। আর তারপর কুড়ি বছর আগে, আমরা, মানুষেরা এই গ্রহে নামি।
মায়ের স্বপ্নের বাড়িতে স্থান হয়নি আমার, জায়গা পেয়েছিলাম অনাথাশ্রয়ে। আমার মত আরো বেশ কিছু কমবয়সী ছেলেমেয়ে, যাদের বাবা মা এই নতুন গ্রহে নতুন বসতি স্থাপন করতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছেন চিরকালের জন্য, তাদের সাথে ঠাঁই পেয়েছিলাম আমি। কলকাতার গরীব আশ্রয়ের থেকে অবশ্য অবস্থা ভালো ছিল। লেখাপড়ার সুযোগ, মোটামুটি ঠিকঠাক খাওয়া পরার ব্যবস্থা ছিল। এই নতুন গ্রহে আমাদের বড় হয়ে ওঠার সাথে সাথে গড়ে উঠছিল নতুন সভ্যতা, কারিগরি, সংস্কৃতি। দ্বিথ্বীকে নিয়ে অবশ্য নব গ্রহ কারিগর সংস্থা এমনকি পৃথিবীর অধিশ্বরদের গর্বের শেষ ছিল না। যদিও দ্বিথ্বী পৃথিবীর অর্ধেকের চেয়েও ছোট কিন্তু সে নাকি প্রাচীন ধরিত্রী মাতার মতই উর্বরা। আমি জানতাম এর কারণ। আমার মা মিশে আছে দ্বিথ্বীর বায়ু, জল, প্রতিটি ধুলিকণার সঙ্গে। মায়ের ভালোবাসা ছড়িয়ে আছে প্রতিটি উদ্ভিদ আর প্রাণীর অঙ্গে। তাই দ্বিথ্বী পৃথিবীর মত হয়েও পুরো পৃথিবীর মত নয়। এর উদ্ভিদ আর প্রাণী জগৎ বেড়ে উঠছে তাদের নিজের মত করে। আমার মা হারিয়ে যায়নি, এই গ্রহ আমার মা।
অনাথাশ্রয়েই আমার সাথে দেখা হয় গ্রেটার। গ্রেটা দত্ত। ছোটখাটো মেয়েটার মাথাটা শরীরের তুলনায় সামান্য বড়। চওড়া কপাল, বড়বড় ভাসাভাসা মায়াময় চোখ। খুব শান্ত আর দূর্বল বলেই হয়ত আমাদের অনাথাশ্রয়ের গুন্ডাগুলো ওর পিছনে লাগত বেশি। আমি ছিলাম একেবারে উলটো। শক্তপোক্ত, মারকুটে। মাথায় সবসময় যেন আগুন জ্বলত। কাউকে ভাল লাগত না। একদিন দেখছিলাম ওকে কয়েকজন জ্বালাতন করছে। কেন এত রাগ হল জানি না, মারপিটে জড়িয়ে পরলাম। তারপর ওকে অন্যদের হাত থেকে বাঁচান যেন আমার কর্তব্যে পরিনত হল। আর ও বুঝত আমায়। আমাকে কিভাবে সামলে রাখা যায়, কিভাবে পড়াশোনায় মন বসানো যায় তা ওর মত কেউ জানত না। আগে খুব দুঃখ হলে মাটিতে শুয়ে ঘাসে মুখ লুকিয়ে কাঁদতাম। ঠান্ডা হাওয়ার স্পর্শে মনে হত মা আদর করে দিচ্ছে। খুব আনন্দে ঝাঁপিয়ে পড়তাম নদীর জলে। মনে হত মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ছি। এখন ও ও আমার সাথে প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যেতে শিখল। ছোটবেলা থেকে ওর মা ছিল না। বাবাও মারা গিয়েছিলেন দ্বিথ্বী গঠনের দিনে। ও আমার সাথে এই গ্রহে ওর মা‘কে খুঁজে পেল।
আমাদের এই গ্রহে পৃথিবী থেকে সরাসরি মহাকাশযান পৌঁছেছিল আজ থেকে আট বছর আগে। নতুন বাসিন্দাদের অনেকেই ছিলেন পৃথিবীর অধিশ্বরদের প্রতিনিধি। এতদিন আমাদের গ্রহে যে ঘরোয়া সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠছিল তা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেতে শুরু করল। গঠিত হল গ্রহ সংসদ। এটা ঠিক করা হয়েছিল এ গ্রহ কোন দেশে বিভাজিত হবে না। এর কূফল আমরা পৃথিবীর ইতিহাস পড়ে জানতে পেরেছিলাম। আর আমরা চেয়েছিলাম এখানে এমন কোন প্রযুক্তি ব্যবহৃত হবে না যার ফলে এখানকার ইকোসিস্টেমের ক্ষতি হতে পারে। প্রথম গ্রহ সংসদ গঠিত হবার সময়ে এই দুটো বিষয়েই সকলে একমত হয়েছিল। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে কী দ্রুত বদলে যেতে লাগল চিন্তাধারা, মূল্যবোধ।
মূল সমস্যাটা শুরু হল বছর পাঁচেক আগে। ভূ অনুসন্ধানী দল খুজে বের করল দ্বিথ্বীর অতি গভীরে লুকিয়ে আছে এক অনন্ত সম্ভাবনা, এনার্জি স্পোর। এর এনার্জি কনটেন্ট নাকি প্রায় অসীম। আলো জ্বালানো থেকে শুরু করে মহাকাশ অভিযান, এর সাহায্যে অতি সহজলভ্য হয়ে উঠবে। আর সজলভ্য হবে, একশ্রেণির মানুষের কাছে, মুনাফা। আগে যা ছিল নেহাত বিজ্ঞানের অনুসন্ধিৎসা, তা হয়ে উঠল দখলদারির প্রতিযোগিতা।
পৃথিবীর ক্ষমতাশালীদের আকর্ষনের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠল আমাদের গ্রহ। আর তাদের মধ্যে দৌড়ে সবচেয়ে এগিয়ে রইল গ্রেগকর্প। গ্রেগরি জয়সোয়ালের বিশ্ববিখ্যাত কোম্পানি। আমাদের দেশ ভারতবর্ষের বংশোদ্ভুত, পৃথিবীর প্রথম পাঁচ ধনী ব্যক্তিদের মধ্যে অন্যতম, ইউনিস্পেস প্ল্যানেটারি মাইনিং কোম্পানির মালিক। পৃথিবীতে থাকতে হয় না এঁকে। থাকেন নিজস্ব মহাকাশহরে। চাঁদ আর পৃথিবীর মাঝে যে তিনটে মহাকাশহর আছে, তার একটা এঁর।
ওয়ালভিসরে দেখলাম গ্রহ সংসদের টেলিকাস্ট শুরু হয়েছে। দুশ পঞ্চাশজন প্রতিনিধির মধ্যে দুশো আটচল্লিশজন উপস্থিত। গ্রেটা আর তার সহমনস্করা দেখলাম এক সাথেই বসেছেন। গ্রেটা, সেদিনের সেই ছোট্ট কমজোরি মেয়েটা আজ বিশ্বের তাবড় শক্তিশালী ধনীদের চোখে চোখ রাখার ক্ষমতা অর্জন করেছে। ওর জন্যে আমার বেশ গর্ব হল।
দরজার কাছে একটা হালকা ফুরররর শব্দ শুনে সেদিকে তাকালাম। আমার পোষা লোমবেড়াল ‘ফুলো’ একটা বলের মত গোল হয়ে রোদে ঘুমোতে ঘুমোতে নাক ডাকাচ্ছে। এত নিরীহ প্রাণী বোধহয় এ গ্রহে আর নেই। শরমূষিকগুলো ওকে খুব জ্বালাতন করত। কিন্তু গত কয়েকবছরের চেষ্টায় ওদের সাথে আমার বেশ বন্ধুত্ব হয়েছে। এখন আর কোন সমস্যা নেই। আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে বাগানে এসে দাঁড়ালাম। সেখানে অতসী, কাঞ্চন, গন্ধরাজ আরো নানারকমের ফুল ফুটে আছে। মায়ের আঁচলের স্পর্শ্বের মত শীতল বাতাস আমায় আদর করল। মুথাঘাসের ওপর দিয়ে ছুটে যাচ্ছে ছোট্ট ব্যস্তসমস্ত পিপিলিরা। বিরাট পেয়ারা গাছটার ওপর থেকে একটা দোয়েল উড়ে এসে আমার কাঁধে বসল। নামানুষদের সাথে আমার এই বন্ধুত্ব করার ক্ষমতাটা আমি একটা অদ্ভুত ঘটনার মধ্যে দিয়ে জানতে পারি।
কলেজে পড়ার সময় আমাদের একটা অরণ্য ভ্রমনে যেতে হয়েছিল নব সুন্দরবনে। পাহাড়ের ঢালে এই অরণ্য বেশ শ্বাপদসংকুল। তাই আমাদের সাথে অস্ত্রধারী সিকিউরিটি গার্ড ছিল। একটা শুঁড়িপথে যেতে যেতে সকলকে চমকে আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল এক হলুদ বিদ্যুৎ। সুন্দরী বাঘিনী। আমার বন্ধুরা থরথর করে কাঁপছিল। গ্রেটার আঙুলগুলো চেপে বসেছিল আমার বাহুতে। সিকিউরিটি গার্ডদের লেজার টমিগুলোর টার্গেট ফাইন্ডার অ্যাক্টিভেটেড হয়ে উঠেছিল সাথে সাথে। কিন্তু আমার মাথায় কে যেন গুনগুনিয়ে বলতে লাগল,ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ও আমাদের আক্রমন করতে আসে নি। গতকাল রাতে দুই ব্যাঘ্রশাবকের জন্ম হয়েছে। ওর চিন্তা তাদের জন্য। চাপা গলায় সিকিউরিটি গার্ডদের বলেছিলাম টমিগুলো নামানোর কথা। আমার চোখে চোখ পড়ার পর বাঘিনীর দৃষ্টি নরম হয়েছিল। এক পা দু পা করে পিছিয়ে সে আবার জঙ্গলে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। সিকিউরিটি গার্ডদের বলেছিলাম শাবকগুলোর কথা। ওরা খুব অবাক হয়েছিল। জঙ্গলে ওদের নিত্য যাতায়াত। ওরা জানতে পারল না আর বাইরের লোক হয়ে এই তথ্য আমি জানলাম কী করে? পরে দেখা গেল আমি ঠিকই বলেছি।
আমার কাছ থেকে পুরো ব্যাপারটা শুনে গ্রেটা বলেছিল, “তোর তো অরণ্যসেনায় ভর্তি হওয়া উচিত।” তাই হয়ত হতাম, কিন্তু এ গ্রহের যন্ত্রসভ্যতার দ্রুত উন্নতি আর তার সাথে সামাজিক পটপরিবর্তন দেখে ঠিক করলাম ইঞ্জিনিয়ারিং এর দিকেই নজর দেব। গত দু বছর ধরে দ্বিথ্বী আর্কিটেকচারাল কর্পোরেশানে কাজ করছি আমি।
ঘরের ভিতর থেকে ওয়ালভিসরের আওয়াজ ভেসে এল, “এখন বক্তব্য রাখবেন নব কলকাতার তৃতীয় প্রতিনিধি গ্রেটা দত্ত।” আমি বাগান থেকে এসে সোফাটায় বসলাম।
গ্রেটার চোট্ট শরীরটা টানটান, চোখ প্রত্যয়ে ঝকঝক করছে। মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে ও মাথা উঁচু করে বলতে শুরু করল,
“মাতা ভূমিঃ পুত্রহম্ দ্বিথ্বীয়াঃ।
আজ ভাবতে হবে আমরা আমাদের মায়ের সাথে কেমন ব্যবহার করব। আমাদের এই শস্যশ্যামলা মায়ের প্রাণঢালা আশির্বাদ গ্রহণ করে বেড়ে উঠব, না অর্থনৈতিক উন্নয়নের দোহাই দিয়ে এমন সভ্যতা বিকশিত করব যা প্রকৃতিমায়ের অঙ্গচ্ছেদের কারণ হয়ে ওঠে। প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সভ্যতা বিকাশের কূফল কতটা হতে পারে তা আমাদের ধরিত্রী মাতার বর্তমান অবস্থা থেকে কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি। এনার্জি স্পোরের খনিজ উৎপাদন যে কী মারাত্মক দূষণ ও অন্যান্য বিপদের জন্ম দিতে পারে তা এখনই আমাদের চোখের সামনে আসতে শুরু করেছে।……”
এক নয়, একাধিক বিপদ এর মধ্যেই হয়েছে। সবচেয়ে মারাত্মকটা ঘটেছে সবুজ দ্বীপে। উপকূলে গড়ে ওঠা নিউটন নগর থেকে মাত্র বাইশ কিলোমিটার দূরে এই দ্বীপ। এখানে এনার্জি স্পোরের বানিজ্যিক উৎপাদন সম্ভাবনা নিয়ে গবেষণা শুরু করে গ্রেগকর্প। ব্যাপারটা অনেকেরই পছন্দ হয়নি। চিঠি লিখে প্রতিবাদ করা থেকে শুরু করে ধর্ণা, অবস্থান সবই করেছিল গ্রেটা আর তার সহযোগীরা। লাভ হয়নি। প্রচুর অর্থ ছড়িয়ে এনার্জি স্পোর মাইনিং অ্যান্ড এক্সপেরিমেন্টেশান ইউনিট টা ওখানেই বানানো হয়েছিল। কিছুদিনের মধ্যেই দ্বীপের জেলেরা লক্ষ্য করেছিল আশেপাশে মাছ মরে ভেসে উঠছে। তারপর এক রাতে সাইরেনের তীব্র শব্দ নিউটন নগর থেকেও শোনা গিয়েছিল। পরেরদিন দেখা গিয়েছিল তেজস্ক্রিয়তার মত এক অদ্ভুত বিকিরণের ফলে বিশাল বনানীর ঝলসে যাওয়া রূপ, পাওয়া গিয়েছিল মানুষ আর বন্যজন্তুর লাশ। কেঁপে উঠেছিল দ্বিথ্বী। প্রাথমিক অভিঘাতে গ্রেগকর্পের বেশ কিছু অফিসে ভাংচুরও চলে। তবে তার কোন সাংগঠনিক রূপ ছিল না। গ্রেটারা ও পথকে সর্বথা পরিত্যাজ্য বলে মনে করে।
এই নিয়ে একদিন গ্রেটার সাথে কথা হচ্ছিল আমার।
“দ্যাখ, আমি সাধারণ মানুষ। আমার মতে চরম প্রতিবাদ না হলে এইসব ধনকুবেররা কথা শুনবে না।” আমি বলেছিলাম।
“চরম প্রতিবাদ মানে ভাংচুর চালানো নয়। এতে আন্দোলনের ক্ষতিই হয় শুধু। অহিংসার যে কী প্রচন্ড ক্ষমতা তা সেই প্রাচীন যুগে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনেই দেখা গেছে।”
“ওখানে কিন্তু চরমপন্থীরাও ছিলেন। অনেকে বলেন তাঁদের জন্যেই ভারত স্বাধীন হয়েছিল।”
এমন সব বিতর্ক আমাদের মধ্যে প্রায়ই হত। কিন্তু একটা বিষয়ে আমরা একমত ছিলাম, এইসব ধনকুবেরদের অর্থলিপ্সা আর তাদের অনবরত ছড়ানো লোভের ফাঁদে পা দেওয়া মানুষ এই গ্রহের পক্ষে ক্রমশঃ বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।
আমাদের বোঝাটাই তো শেষ কথা নয়। অবাক হয়ে দেখছিলাম নিরন্তর প্রচারের সাহায্যে কিভাবে ভালো কে খারাপ আর খারাপ কে ভালো প্রমাণের চেষ্টা চলছে অনবরত। এনার্জি স্পোরের জন্য খননকার্য নাকি সভ্যতার অগ্রগতির জন্য অতি প্রয়োজনীয়, যারা এই মতের পক্ষে নয় তারা নাকি বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। নিজেদের স্বার্থটাকে সবার স্বার্থ হিসেবে দেখিয়ে কার্যসিদ্ধির যে নোংরামি চলে তা যুগে যুগে বহু মানুষকে বোকা বানিয়েছে। আমিও চারপাশে তার প্রমাণ পাচ্ছিলাম।
“ভুলে গেলে চলবে না আমরা আরেকবার সুযোগ পেয়েছি প্রকৃতির মাঝে সম্ভাবনাময় জীবন যাপনের। এ সুযোগ আমরা হয়ত আর পাবো না। নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগের সময় মাননীয় সদস্যরা এই কথাটা যেন স্মরণে রাখেন। নয়তো আমাদের উত্তরসুরীরা আমাদের ক্ষমা করবে না।” গ্রেটা তার বক্তব্য শেষ করল।
তারপরেও আরো কিছু সদস্য তাঁদের বক্তব্য রাখলেন। এরপর ভোট নেওয়ার পালা। এনার্জি স্পোরের খনিজ উত্তলনের পক্ষে যাঁরা ছিলেন একশ চুরানব্বইটি ভোট পেলেন তাঁরা। গ্রেটারা পেল মাত্র চুয়ান্নটি ভোট। দ্বিথ্বীকে ক্ষতবিক্ষত করার আইন রমরম করে পাশ হয়ে গেল। এই গ্রহে ডিপ এক্সক্যাভেশান করার আর কোন বাধা রইল না। আমি খুব একটা অবাক হলাম না। ওয়ালভিসরে দেখছিলাম ভীষণভাবে সুরক্ষিত এক্সক্যাভেশান সাইটটা দেখাচ্ছে। দিগন্তবিস্তৃত প্রান্তরের মধ্যে চারদিকে কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা। আমাদের এই জগদীশপুর থেকে সাড়ে তিনশ কিলোমিটার দূরে শুরু হবে তথাকথিত সভ্যতার নতুন পথ চলা। নাঃ, অনেক কাজ পড়ে আছে, এবার বেরোতে হবে।
বাইরে এসে হেলিপডটায় চেপে ইগনিশান অন করলাম। কাল সারা রাত জেগে অফিসের কাজের এমন ব্যবস্থা করে রেখেছি আজ ঘরে না থাকলেও সকলে ভাববে ওয়ার্ক ফ্রম হোম করছি। আজ আমার নিভৃতযাপনের দিন। ভেসে যাওয়ার সময় আমি মাঝে মাঝে পায়ের নিচে ভূমির বদলে অগ্নিসমুদ্র দেখতে পাই। আজও পাচ্ছি।
এক্সক্যাভেশান সাইটটা থেকে দশ কিলোমিটার দূরে ছোট অনামা জঙ্গলের পাশে হেলিপডটা নামালাম। এখন বেশ কিছুটা সময় আমি এই জঙ্গলেই কাটাবো। আগেও বহুবার কাটিয়েছি। অদূরবর্তী বসতির কেউ কেউ এখানে ক্যাম্পিংয়ের জন্য আসেন। আমি জানি আজ কেউ আসবে না। আজ ওদের বাৎসরিক কার্নিভাল। মোভিসরে দেখলাম একদল মানুষ প্ল্যাকার্ড, পোস্টার নিয়ে এক্সক্যাভেশান সাইটটায় বিক্ষোভ দেখাতে গিয়েছিল। সামান্য লাঠিচার্জেই তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে।
সন্ধ্যে নামল। এ বন আমার বাগানের মতই নিরাপদ ও পরিচিত। চাঁদ উঠল। নকল চাঁদ। একবছর আগে দেওয়া গ্রেগকর্পের উপহার। আমি জানতাম দ্বিথ্বীর এ অঞ্চলে আজ অন্তত চাঁদের আলো পড়বেই। কী আর করা যাবে। এগারোটার সময় নাইটশিফট শুরু হবে। গোটা সাইটটা চলে যাবে অটোবটের হাতে। এর পর তার আধ কিলোমিটারের মধ্যে কোন মানুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ। শ্যূট অ্যাট সাইটের নির্দেশ দেওয়া আছে।
দশটা নাগাদ বন থেকে বের হলাম।
বিস্তীর্ণ তৃণভূমি চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে। রাতচরা পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে মাঝে মাঝে। মাথার ওপর দিয়ে ভেসেও যাচ্ছে একটা দুটো। বেশ মৃদুমন্দ হাওয়া বইছে। খরগোশের মত ছোটখাটো দুএকটা প্রাণী এদিক ওদিক দৌড়ে গেল। বেশ টের পাচ্ছিলাম মাটির নিচে শরমূষিকগুলো তাদের গহ্বর শহরে ছোটাছুটি করছে। ব্যাটারা সবসময় ব্যস্ত। হাঁটতে ভালোই লাগছিল।
বহু দূর থেকে খনক যন্ত্রগুলো দেখতে পেলাম। সাইটের থেকে এক দেড় কিলোমিটার দূরে একটা মাটির ঢিপির ওপর আরাম করে বসলাম। এখন যন্ত্রগুলো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। অতিকায়, ভয়ানক। চাঁদের আলোয় ধারালো অস্ত্রের মত মাথা উঁচিয়ে রয়েছে। দ্বিথ্বীর জঠরে প্রবেশ করার জন্য প্রস্তুত। ঘড়িতে দেখলাম সাড়ে এগারোটা বাজে। আমি চুপচাপ বসে রইলাম। চোখটা জ্বালা জ্বালা করছে।
ঠিক বারোটার সময় মাটি কেঁপে উঠল। ক্ষেপনাস্ত্রের মত দাঁড়িয়ে থাকা এক্সক্যাভেটার আর বাড়িটা দুলে উঠল বিপজ্জনকভাবে, তারপর প্রচন্ড শব্দ করে ধ্বসে পড়ল। একটা লেলিহান আগুনের শিখা গ্রাস করল পুরো জায়গাটা। অটোবটগুলোর গুলি চালানোর শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। কাকে লক্ষ্য করে গুলি চালাচ্ছে কে জানে। ধোঁয়া, ধুলো আর আগুনে ঢেকে যাচ্ছে গোটা সাইটটা। ভেঙে পড়ছে প্রকৃতিকে খুবলে খেতে উদ্যত অসভ্যতার নখ আর দাঁত। নিজের চোখে ঘটনাটা দেখব বলে বিপদের সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এখানে এসেছি আমি। এ সুযোগ আর হয়ত কোনদিন পাবো না।
গর্ভিণী শরমূষিকদের সব বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য খোলসের মত এক অদ্ভুত ছদ্ম আবরণে মুড়ে রাখে এখানকার প্রকৃতি মা। সেই আবরণের মোড়কের ভিতর কী আছে তা তীক্ষ্মতম রেডারও ধরতে পারে না। এ খবর বোধহয় এখনো কেবলমাত্র আমিই জানি। এই সাইটটার আর্কিটেকচারাল প্ল্যান বের করেছিলাম খুব গোপনে, অনেক কষ্ট করে। তার দূর্বলতম স্থানগুলোতে মাটির নিচের গর্তে ছদ্ম আবরণে মোড়া সময়নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরকগুলো মুখে করে রেখে এসেছিল মা হতে চলা আমার ছোট্ট বন্ধুরা। ওরা আমার কথা বোঝে, আমার মতই এই গ্রহকে ভালোবাসে। আমাদের মায়ের শরীরে একটা আঁচড়ও আমরা মেনে নেব না। আমি জানি এরপর গ্রেগকর্প আরো সাবধান হবে, আরো বেশি করে আক্রমন শানাবে। কিন্তু ওদের বিরুদ্ধে লড়তে আমার একটুও ভয় করছে না। এ তো সবে যুদ্ধের শুরু। আর আমি একা নই।
Tags: kalpabiswa y7n1, science fiction, কল্পবিজ্ঞান গল্প, প্রমিত নন্দী, সায়ক দত্ত চৌধুরী
ভালো লেগেছে। টানটান উত্তেজনা ছিলো পুরোটা জুড়ে। সময় বদলালেও শ্রেণী বিভাজন ও শোষণের ধরন যে বদলায় না এই বিষয়টি দারুন ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। আর পরিবেশ নিয়েও ভালো বার্তা ছিল। সায়েন্সের সাথে প্রকৃতির যুগলবন্দী বেশ উপভোগ করেছি।
শুভেচ্ছা ও শুভকামনা রইলো। সামনে এমন লেখা আরও পড়তে চাই।
অনেক ধন্যবাদ উৎসাহ দেওয়ার জন্য। 😊