যোগ্যতম
লেখক: ঐষিক মজুমদার
শিল্পী: প্রমিত নন্দী
“আমি অধ্যাপক আই… আইজাক রদ… রদেনস্টাইন।…আইজাক রদেনস্টাইন! এ আবার কিরকম নাম স্যার?” – ধাতব পাতটা মুখের সামনে আঁকড়ে ধরে সবিস্ময়ে প্রশ্ন করল আমার প্রধান সহকারী গিমিচ।
এর উত্তর আমারও জানা নেই। দীর্ঘ দু-বছরের অক্লান্ত সাধনায় যে লিপির পাঠোদ্ধার আমরা করতে পেরেছি, এই মুহূর্তে যে লিপির যথাসাধ্য নির্ভুল অনুবাদ খোদিত রয়েছে গিমিচের ধরা ওই ধাতব পাতে, সে লিপির অস্তিত্বই ছিল আমাদের জ্ঞানের পরিধির বাইরে। তাই বিস্ময় আমারও অতলান্ত। তবুও সেই মনোভাব গোপন রেখে সহকারীকে সংক্ষিপ্ত নির্দেশ দিলাম, “আমরা যেমন-যেমন লিখতে পেরেছি, তেমনটাই পড়ে যাও!”
“আমি অধ্যাপক আইজাক রদেনস্টাইন, দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ ও গবেষণার পরে আমাদের জাতির বিবর্তনের এই ইতিহাস লিপিবদ্ধ করে যাচ্ছি। এই আখ্যান আমি রেখে যেতে পারতাম কোনো আধুনিক মাধ্যমে। কিন্তু বিশেষ একটা কারণে এই জলনিরোধী কাগজ-এর (সম্ভবত মূল লিপিটি যে পাতলা এবং নমনীয় অজানা পদার্থের তৈরি পাতে লেখা ছিল, সেই পদার্থের নাম। শব্দটা আমাদের অভিধানে নেই।) ওপর লিখতে বাধ্য হচ্ছি। সে কারণ আর কিছুই নয়, যাদের উদ্দেশ্যে বিবর্তনের এই ইতিবৃত্ত রেখে যাওয়া, ভবিষ্যতের সেই অনগ্রসর উত্তরসূরীরা হয়তো আধুনিক মাধ্যমের পাঠোদ্ধার করতে পারবে না…”
এবারে আর কৌতুকের হাসি গোপন করতে পারল না গিমিচ।
“ভবিষ্যতের অনগ্রসর উত্তরসূরী… হা হা হা! কথাটা শুনলেন স্যার? আদিম কালের ওঁরা নাকি আমাদের চেয়েও উন্নত ছিলেন! এই লেখাটা… এই লেখাটা স্যার পুরোটাই জালিয়াতি নয় তো?”
এই দীর্ঘ দু-বছর ওই লেখার অনুবাদের মাঝে আমারও যে কখনো-কখনো তেমন মনে হয়নি তা নয়, কিন্তু…
মনের ভাব গোপন রেখে অবিচলিত ভঙ্গীতে বললাম, “পড়ে যাও!”
গিমিচ আবার পড়তে শুরু করল।
“আজ থেকে প্রায় পাঁচশো বছর আগে, খ্রিস্টীয় একবিংশ শতাব্দীর (খৃস্টীয় অব্দ সম্ভবত তৎকালীন কোনো কাল-সূচক – এখানে টীকায় উল্লেখ করেছি আমরা) মধ্যভাগে দাঁড়িয়ে যে মুহূর্তে আমি অনুমান করি ধ্বংস আসন্ন, সেই মুহূর্তেই স্থির করে নিই আমার কি করণীয়। আমার মস্তিষ্কের সমস্ত জ্ঞান-বুদ্ধি, আবেগ-অনুভূতি, ইচ্ছা-অনিচ্ছা আমি ধীরে-ধীরে সঞ্চারিত করতে থাকি আমার নিজের তৈরি সুপার-কম্পিউটারে (এ নামটিও আমাদের অচেনা! সম্প্রতি আমরা জটিল গণনার কাজে যে যান্ত্রিক গণক ব্যবহার করছি, সেরকম কিছু কি?)। একসময় সেই কম্পিউটার হয়ে ওঠে আমার মস্তিষ্কের প্রতিলিপি।
হ্যাঁ, আজ আমি, আইজাক রদেনস্টাইন, আসলে এই যন্ত্র। আমার নশ্বর দেহ বিলীন হয়ে গেছে কবেই!
প্রথমেই আমি এই যন্ত্রকে স্থাপন করেছিলাম জলতলের অনেক ওপরে। হিমালয় পর্বতের এক দুর্গম গুহায়, এক সুরক্ষিত ক্যাপসুলের ভেতর। সেখান থেকেই আমার যান্ত্রিক ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে এতদিন প্রত্যক্ষ করেছি সভ্যতার এই আশ্চর্য পট-পরিবর্তন। কিন্তু আজ আমার মেয়াদ ফুরিয়ে এসেছে। পারমাণবিক শক্তি-চালিত এই ক্যাপসুলের জ্বালানীর ভাণ্ডার এখন শূন্যপ্রায়। তাই চিরতরে চেতনা লুপ্ত হয়ে যাওয়ার আগে আমার অভিজ্ঞতার এই দলিল রেখে যাচ্ছি – যদি কোনোদিন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের হাতে পৌঁছয়, সেই আশায়!”
ইঙ্গিতে গিমিচকে থামতে বলে গভীর চিন্তায় ডুবে গেলাম আমি। এই অংশ থেকেই ক্রমশ দুর্বোধ্য, প্রহেলিকাময় হয়ে উঠেছে এই আখ্যান। অনেকগুলো জিনিসের কোনো ব্যাখ্যা মিলছে না।
যেমন, ওই পারমাণবিক জ্বালানীর কথাটা। যে জীর্ণ, ভগ্নপ্রায় ধাতব গোলক থেকে এই লিপি উদ্ধার করা হয়েছে, নিশ্চয় সেটাকেই এখানে ক্যাপসুল বলে উল্লেখ করা হয়েছে। লেখকের দাবী অনুযায়ী, ওই গোলকে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহৃত হয়েছিল। কিন্তু তা কী করে সম্ভব? পদার্থের পরমাণুতে যে প্রবল শক্তি নিহিত থাকে, এই আবিষ্কার তো একেবারে হাল আমলের। পরীক্ষামূলকভাবে পরমাণুকে ভেঙে আমাদের বিজ্ঞানীরা সেই শক্তিকে মুক্ত করতে পেরেছেন বটে, কিন্তু তার ব্যবহারিক প্রয়োগ এখনও দূর-অস্ত! তাহলে?
ধন্দের দ্বিতীয় কারণ ওই ক্যাপসুলের আবিষ্কার-স্থল।
আমাদের এই গ্রহের বিস্তীর্ণ জলরাশিকে ঘিরে রয়েছে অনেক কম ঘনত্বের একটা স্তর, যার নাম বায়ুমণ্ডল। তার বাইরে অন্তহীন মহাশূন্য। বহুযুগ আগেই বিজ্ঞানীরা প্রমাণ করেছেন, সেই মহাশূন্যে ভাসমান রয়েছে আমাদের গ্রহের মতো আরো অনেক গ্রহ, আমাদের সূর্যের মতো আরো অনেক নক্ষত্র।
এ তো গেল জলের ওপরের কথা। আর জলের নীচে?
জলের নীচে যে জমি, তা সর্বত্র সমতল নয়। তার এক-একটা বিস্তৃত অংশ তলভাগের থেকে অনেক উঁচু। মূলত এই অংশগুলোর ওপরেই স্মরণাতীত কাল থেকে আমাদের সভ্যতা গড়ে উঠেছে। এই উঁচু জায়গা থেকে আবার কিছু-কিছু অঞ্চল খাড়া উঠে গেছে ওপরে, জলের উপরিতল ভেদ করে অনেকটা প্রসারিত হয়েছে বায়ুমণ্ডলের ভেতর।
জলের অনেক ওপরে এরকমই এক খাড়াই এলাকার এক গহ্বর থেকে পাওয়া গেছে ওই গোলক বা ক্যাপসুল। বায়ুভেদী ওই খাড়াইকেই নিঃসন্দেহে লিপিতে হিমালয় পর্বত নামে উল্লেখ করা হয়েছে। সংশয় সেখানেই। ওই প্রাচীন কালে সেই উচ্চতায় পৌঁছনো সম্ভব হল কী করে?
ব্যাপারটা অসঙ্গত এবং অবাস্তব। হাল আমলে দুঃসাহসী অভিযাত্রীরা বহুবারই ওই খাড়াই ঢালের অনেক উচ্চতায় পাড়ি জমিয়েছেন। কিন্তু তা সম্ভব হয়েছে আধুনিক বায়ু-যানের জন্যই। তা ছাড়া শ্বাস-অযোগ্য পরিবেশ আর প্রখর সূর্যালোকে টিঁকে থাকার জন্য ব্যবহার করতে হয়েছে বিশেষ ধরণের পোশাক। ওই সুদূর অতীতে এরকম অভিযান… সে তো অসম্ভব! কিন্তু তাহলে ওই ক্যাপসুল সেই উচ্চতায় পৌঁছল কী করে?
আর ঠিক এই কারণেই গিমিচের মতো আমার অনুবাদকারী দলের অন্য সদস্যরাও সন্দেহ প্রকাশ করেছিল— পুরো ব্যাপারটাই একটা প্রকাণ্ড ভাঁওতাবাজি! আমাদের কোনো আদি পূর্বপুরুষ নয়, বরং বর্তমানের কোনো সুদক্ষ জালিয়াত-চক্র কোনো এক গোপন অভিযানের মারফৎ ওই ক্যাপসুলটি যথাস্থানে রেখে আসে। তার আগে প্রচুর মাথা খাটিয়ে তারাই উদ্ভাবন করে ওই অদ্ভুত, অজানা লিপি। কিন্তু…
এখানেই একটা বিরাট কিন্তু আছে। ওই গোলক বা ক্যাপসুল উদ্ধারের পরেই দেশের সরকার তা তুলে দিয়েছিল জিমিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানীর হাতে। ক্যাপসুলের সঠিক বয়স নির্ণয় সম্ভব না হলেও সেই বিজ্ঞানীরা নিশ্চিতভাবেই জানান, বস্তুটি প্রাগৈতিহাসিক! ভেতরের লিপিটিও তাই।
কোনো আধুনিক প্রতারক-চক্রের হাতে ওই সুপ্রাচীন গোলক বা লিপি আসবে কোথা থেকে?
আর সেই লিপির সূত্রেই রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করি আমি, অর্থাৎ ভাষাতত্ত্ববিদ অধ্যাপক চিলিচ। ওই অপরিচিত লিপিতে দাঁত ফোটাতে পারেননি বিজ্ঞানীকুল। হালে পানি না পেয়ে তাঁরা মানে-মানে এর পাঠোদ্ধারের দায়িত্ব আমার হাতে সমর্পণ করেন।
এখনও মনে পড়ে, প্রথমবার এই লিপি হাতে পেয়ে শিহরিত হয়ে উঠেছিল আমার সর্বাঙ্গ। কারণ এর সঙ্গে আমাদের পরিচিত কোনো প্রাচীন লিপির বিন্দুমাত্র সাদৃশ্য নেই। প্রধান সহকারী গিমিচ এবং আমার চারজন ছাত্রকে নিয়ে একটা দল গঠন করে আমি অর্থ উদ্ধারে ব্রতী হই। প্রতিটি অক্ষর ধরে ধরে আমরা বিশ্লেষণ করি— তারা কোথায়, কীভাবে এবং কতবার প্রযুক্ত হয়েছে। বারংবার বিচার করি প্রতিটি শব্দও। একটা ব্যাপার লক্ষ করে তখনই বিস্মিত হই। বহিরঙ্গের মিল না থাকলেও, এ ভাষার সঙ্গে আমাদের ভাষার ব্যাকরণগত সাদৃশ্য প্রচুর। এতেও স্বরবর্ণ ও ব্যাঞ্জনবর্ণ আছে। আছে বিশেষ্য, বিশেষণ, ক্রিয়াপদের ব্যবহার। এটা বোঝার পর আমাদের কাজ কিছুটা হলেও সহজ হয়।
দীর্ঘ দু-বছর পরে অসাধ্য সাধন করেছি আমরা। এই মুহূর্তে গিমিচের ধরা ধাতব পাতে মুদ্রিত রয়েছে ওই লেখার সম্ভাব্য অনুবাদ। শেষবারের মতো তা খতিয়ে দেখছি আমরা। মনোমত হলে হয়তো কয়েকদিনের মধ্যেই তুলে দেব কর্তৃপক্ষের হাতে।
“স্যার, আবার পড়ি?” গিমিচের ডাকে চমক ভাঙল।
“হ্যাঁ হ্যাঁ, নিশ্চয়ই!” অনুমতি দিলাম আমি।
“আজ এই গ্রহকে দেখে কেউ বিশ্বাস করবে না, একদিন এ ছিল সম্পূর্ণ অন্যরকম। স্বপ্নের মতো অন্যরকম। রূপকথার মতো সুন্দর। সেদিন আকাশ ছিল এই জলরাশির মতোই সুনীল। স্থলভাগে ছিল উদ্ভিদের সবুজ, পরিণত শস্যের সোনালি, ফুল-পাখি-প্রজাপতির বিচিত্র বহুবর্ণ কোলাজ। সেদিন শিশুর কলতানে, প্রেমিক-প্রেমিকার মুগ্ধ গুঞ্জনে, কর্মীর কর্মব্যস্ততায় মুখরিত হয়ে থাকত এই গ্রহের বাতাস। সেই বাতাসে বুক ভরে শ্বাস নিতাম আমরা। … স্যার, এই জালিয়াত অত্যন্ত ধুরন্ধর! আমাদের পুরাণে একটা আজগুবি গল্প আছে না, আদিপুরুষের বাস ছিল বাতাসের জগতে? সেই গল্পকে সুকৌশলে কাজে লাগিয়েছে এই বদমাশ! বোঝাতে চেয়েছে, এই লিপির লেখক ছিলেন পুরাণে বর্ণিত সেই বায়ুলোকের বাসিন্দা! স্যার, আপনি নিজে কি পুরাণের ওই ছেলে-ভোলানো কথায় বিশ্বাস করেন?”
পৌরাণিক গল্পের সঙ্গে সাদৃশ্য আমারও নজর এড়ায়নি। উত্তেজিত গিমিচ-কে অতিকষ্টে শান্ত করলাম। আমার ইশারায় সে আবার কুড়িয়ে নিল কাহিনির ছিন্নসূত্র।
“কিন্তু এত কিছু সুন্দরের মধ্যে ছিল একটিমাত্র অসুন্দর। আমরা। আমাদের এই জাতি। ঈর্ষাতুর। পরশ্রীকাতর। বিদ্বেষপরায়ণ।
সৃষ্টির উষালগ্ন থেকেই আমাদের ইতিহাস দ্বন্দ্ব আর বিরোধের ইতিহাস। আদিম যুগ থেকেই বারংবার আমরা লিপ্ত হয়েছি যুদ্ধবিগ্রহে। তবে ক্ষয়ক্ষতি ব্যাপক আকার ধারণ করে বিংশ শতাব্দীতে, যখন পরপর দুটি বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেয় এই গ্রহের অধিকাংশ দেশ। তবে সেই ক্ষতিও অন্তিম প্রলয়ের কাছে বালখিল্যের মতো।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ লগ্নেই পরমাণু বোমার প্রয়োগে দুটি শহর ধ্বংস হতে দেখে শিউরে উঠেছিল অবশিষ্ট সভ্যতা। কিন্তু কালবিলম্ব না করে শক্তিধর রাষ্ট্রের শাসকরা নিজেদের পরমাণু অস্ত্রের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করতে থাকেন। প্রত্যেকের মুখে ছিল একটিই যুক্তি— নিজের দেশের নিরাপত্তা।
এতৎসত্ত্বেও বহুদিন ঠেকিয়ে রাখা গিয়েছিল তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ছোটোখাটো যুদ্ধ বা সন্ত্রাস চললেও, পরমাণু অস্ত্র প্রয়োগ করেনি কেউ। সবারই ভয় ছিল, একই উপায়ে প্রত্যাঘাত করবে প্রতিপক্ষও। এই ভীতিজনিত ভীষণা শান্তির মেয়াদ ছিল আরো প্রায় একশো বছর। তারপরে আর রোখা গেল না অনিবার্যকে। অতি সামান্য অছিলায় দ্বন্দ্বে জড়াল দুই পরাক্রান্ত দেশ। অচিরেই অংশ নিল অন্যরাও। যথেচ্ছ ব্যবহৃত হল পরমাণু অস্ত্র।
তার আগেই অবশ্য যন্ত্র-আমি আশ্রয় নিয়েছি পাহাড়ের এই গুহায়। আমার যান্ত্রিক ইন্দ্রিয় এবং বহুসংখ্যক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র দূরগামী যান্ত্রিক চর বা ড্রোনের সাহায্যে নজর রেখেছি ঘটনাবলীর ওপর।
পারমাণবিক বিস্ফোরণের বীভৎস ফলাফল আমাদের অজানা ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ছাড়াও কয়েকটি দুর্ঘটনা আমাদের আগেই সে শিক্ষা দিয়েছিল। পৃথিবীর অন্য বিজ্ঞানীদের মতোই আমারও ধারণা ছিল, প্রথম ও প্রধান বিপদ আসবে তেজস্ক্রিয় বিকিরণের দরুণ। তীব্র উত্তাপে অনেকে তো ভস্মীভূত হবেই, যারা বেঁচে থাকবে তাদের জীবন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠবে দুরারোগ্য ক্ষত, অঙ্গহানি, এমনকী কর্কটরোগে। তারপরে ধীরে-ধীরে প্রতিকূল হয়ে উঠবে পরিবেশ। ক্রমেই নিশ্চিহ্ন হবে উদ্ভিদ, নষ্ট হবে ভারসাম্য। যুদ্ধ থেমে যাওয়ার পর অবশিষ্ট বিশ্ব ধ্বংসের সম্মুখীন হবে পরবর্তী কয়েক দশকে।
বাস্তবে কিন্তু বিপদ এল অতিদ্রুত, অনেকটাই অপ্রত্যাশিত এক পথে। একযোগে বহুসংখ্যক পারমাণবিক বিস্ফোরণের ফলে আচমকা অনেকটা বেড়ে গেল ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা। সেইসঙ্গে বায়ুমণ্ডলের যে ওজোন স্তর ছিল পৃথিবীর রক্ষাকবচ, নিমেষে তা লুপ্ত হল। অপ্রতিহত হয়ে উঠল সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনী রশ্মির দাপট।
এই দুইয়ের মিলিত প্রভাবে দ্রুত গলে যেতে লাগল দুই মেরুর বরফ, হু-হু করে বাড়তে লাগল জলস্তর। সে সময় দক্ষিণ দিকে আন্টার্কটিকা মহাদেশ ছিল, যার অধিকাংশই বরফ। সেই মহাদেশের প্রায় আশি শতাংশ গলে গিয়ে…
…বলে কী স্যার! বরফের তৈরি আস্ত একটা মহাদেশ!” আবার থামল গিমিচ, সবিস্ময়ে আমার দিকে চেয়ে বলল, “আমরা তো জানি, প্রাকৃতিক বরফ দেখা যায় শুধুমাত্র দুই মেরুবিন্দুতে। কয়েকটা ভাসমান হিমশৈল, ব্যাস!”
“পড়ে যাও!” সংক্ষেপে বললাম আমি।
“… আশি শতাংশ গলে গিয়ে মাত্র কয়েকটা দিনের মধ্যে বরফ-গলা জলে প্লাবিত হল বিশ্ব। প্রতিকারের উপায় আবিষ্কারের আগেই সমস্যা চলে গেল নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
সেই মহাপ্লাবনে এক লহমায় তলিয়ে গেল আমাদের সমস্ত বড়ো-বড়ো শহর। অসহায়ের মতো ডুবে মরল নারী-পুরুষ-শিশু। সামান্য যে কয়েকজন প্রাণরক্ষা করতে পেরেছিল বিভিন্ন জলযানে সওয়ার হয়ে, কিছুদিনের মধ্যেই খাদ্য ও পানীয় জলের অভাবে শেষ হয়ে গেল তারাও। কেউ-কেউ গেল হিংস্র জলচর প্রাণীর জঠরে। শুধু আমরা নই, সেই সর্বগ্রাসী প্লাবনে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল অন্যান্য স্থলচর প্রজাতির প্রাণী, এমনকী পাখিরাও। দু-দিন আগেই যেখানে ছিল বিস্তীর্ণ সব মহাদেশ, আজ সেখানে অতলান্ত সমুদ্রের অগাধ জলরাশি। পাহাড়ের সুউচ্চ আশ্রয় থেকে তীব্র আতঙ্ক ও হতাশায় চেয়ে রইলাম আমি। এই কি সেই অন্তিম ক্ষণ? সেই মহাবিচারের লগ্ন? এভাবেই কি শেষ হয়ে যাবে আমাদের এত দিনের, এত গর্বের সভ্যতা?…
… স্যার, এ তো সাঙ্ঘাতিক এক কাহিনি ফেঁদে বসেছে!” গিমিচের স্বরে এখন অবিশ্বাসের সঙ্গে মিশেছে সুস্পষ্ট সমীহ, “প্রমাণ করতে চাইছে, এককালে জলভাগ থাকলেও আমাদের মহাদেশগুলি ছিল সেই জলের ওপরে, আর সেখানেই গড়ে উঠেছিল বায়ুলোকের সভ্যতা! ওই মহাপ্রলয়ের পরেই সব কিছু চলে যায় জলের তলায়!”
গভীর চিন্তায় তলিয়ে গেছিলাম আমি। অন্যমনস্ক ভাবেই তার কথায় সায় দিলাম। তারপর ইঙ্গিত করলাম আবার পাঠ শুরু করতে।
“সব কিছু কিন্তু শেষ হল না!” আবার পড়তে লাগল গিমিচ, “কিছুদিন পরেই থামল প্রলয়, শান্ত হল ভূপৃষ্ঠের জলরাশি। সমস্ত মহাসমুদ্র একসঙ্গে মিশে গিয়ে সে তখন এক অবিচ্ছিন্ন অতি-সমুদ্র। তখন দেখলাম টিকে রয়েছে কিছু অনগ্রসর জনজাতি। তাদের বাস হিমালয় ও অন্যান্য পর্বতের সুউচ্চ উপত্যকায়। সমুদ্র সেখানে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়েছে, অন্তত তখনকার মতো।
কিন্তু প্রাণে বেঁচে গেলেও সভ্যতার সঙ্গে তাদের আর কোনো সংস্রব রইল না, কারণ আধুনিক জগৎ তখন নিশ্চিহ্ন। বাধ্য হয়েই তারা ফিরে গেল আদিম জীবনে। আবার শূন্য থেকে শুরু। জীবনধারণের জন্য ফল ও পশুমাংসের ওপর নির্ভরতা, কোথাও বা একেবারে প্রাথমিক স্তরের চাষবাস। তাদের সেই সংগ্রামের সাক্ষী রইলাম আমি।
কিন্তু তাতেও নিস্তার নেই। পরিবেশের তেজস্ক্রিয়তা এবং প্রখর সূর্যালোকে অনেকেই আক্রান্ত হতে থাকল চর্মরোগ, এমনকী কর্কটরোগেও। তার ওপর গ্রহের তাপমাত্রা তখনও বাড়ছে, ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে জলস্তর। সমুদ্র ধীরে-ধীরে দখল করতে লাগল তাদের বাসভূমি।
এই পরিস্থিতিতেও দেখলাম, মানিয়ে নিচ্ছে তারা। আরো কয়েক দশকের ভেতর ডাঙার বদলে জলেই আকণ্ঠ ডুবে থেকে আর সাঁতার কেটে দিনের তীব্র দাবদাহ থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় বেরোল। উদরপূর্তির উদ্দেশ্যে আদিম পাথর আর কাঠের তৈরি অস্ত্রে তারা ঘায়েল করতে লাগল জলের প্রাণীদের। প্রথম-প্রথম হিংস্র জলচরদের আক্রমণে প্রাণ হারাচ্ছিল অনেকে। কিন্তু যতই দিন গেল, সঙ্ঘবদ্ধভাবে তারা প্রতিহত, এমনকী পর্যুদস্ত করতে শিখল সেই আক্রমণকারীদের। তারিফ করতে বাধ্য হলাম আমি।
বিস্ময়ের মাত্রা আরো বাড়ল, যখন দেখলাম তাদের পরবর্তী প্রজন্ম জন্মের পর থেকেই সন্তরণে পটু। এমনকী শিশুরাও বাতাসে শ্বাস না নিয়ে জলের নীচেই থাকতে পারে অনেকটা সময়। কী উপায়ে? একটু বিশ্লেষণ করতেই বুঝতে পারলাম, ক্রমেই বাড়ছে ওদের ফুসফুসের ক্ষমতা। প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টার ফলেই সম্ভব হচ্ছে এই অভিযোজন। এরা যেন উভচর, জলে আর স্থলে কাটায় সমান-সমান সময়।
চমকের আরো বাকি ছিল। এর পরবর্তী প্রজন্মের শারীরিক পরিবর্তন হল আরো প্রকট। তাদের হাত-পায়ের আঙুল দেখলাম পাতলা পর্দা দিয়ে জোড়া; ফলে অনেকটা যেন জলচর প্রাণীর প্যাডলের মতো আকৃতি ধারণ করেছে সেই হাত-পা। একদিন গাছ থেকে নেমে মাটিতে হাঁটতে কাজে লেগেছিল যে সব প্রত্যঙ্গ, আজ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাদেরই বিবর্তন ঘটেছে জলের ভেতর যাতায়াতের জন্য। চামড়াও এখন অনেকটা পুরু, সম্ভবত তেজস্ক্রিয় বিকিরণ থেকে বাঁচার জন্য। দেখলাম, আমাদের এই উত্তরসূরীরা জলেই বেশি স্বচ্ছন্দ। অন্তহীন অতিসমুদ্রে তারা পাড়ি দেয় বহুদূর, অনায়াস-ডুবে পৌঁছে যায় তার তলদেশে। ডাঙায় উঠলেই বরঞ্চ হাঁটে চার পায়ে, অদ্ভুত আড়ষ্ট ভঙ্গীতে।
পঞ্চম প্রজন্ম ভূমিষ্ঠ হল জল-ফুসফুস নিয়ে!
নিজের চোখকে প্রথমে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মাথার দু-পাশে মাছের মতো কানকো, তার বিচলনের ফলে ফুসফুসে ঢুকছে সমুদ্রের জল। সেই জলে দ্রবীভূত অক্সিজেনেই চলছে শ্বাসকার্য। এই প্রজন্মেই ঘুচে গেল ডাঙার সঙ্গে সর্বশেষ যোগাযোগটুকুও। সে ডাঙাও অবশ্য তখন প্লাবিত। নতুন এই প্রাণীরা সমুদ্রের তলদেশেই গোড়াপত্তন করল এক আদিম সভ্যতার।
আমার ক্যাপসুলের জ্বালানীর ভাণ্ডার শেষ হওয়ার আগে সৌভাগ্য হয়েছে পরবর্তী আরো পাঁচটি প্রজন্মকে প্রত্যক্ষ করার। তাদের মধ্যে অব্যাহত রয়েছে এই আশ্চর্য বিবর্তনের ধারা। ধীরে-ধীরে আবির্ভূত হয়েছে আরো অনেক নতুন বৈশিষ্ট্য। মেরুদণ্ডের শেষপ্রান্তের কশেরুকা প্রলম্বিত হয়ে সৃষ্টি হয়েছে লাঙ্গুল, যা সাঁতারের সময় দিক-পরিবর্তনে সহায়ক। আরো বেড়েছে ত্বকের ঘনত্ব। চোখের পাতা লুপ্ত হয়ে এসেছে পুরু স্বচ্ছ আবরণ।
একই সঙ্গে এগিয়ে চলেছে তাদের সভ্যতা। এর মধ্যেই তারা উদ্ভাবন করেছে জলের ভেতর ব্যবহারের উপযোগী প্রাথমিক কিছু পাথুরে যন্ত্রপাতি। প্রাকৃতিক গুহায় আশ্রয় নেওয়ার পাশাপাশি জলের নীচে তৈরি করেছে ঘর। নিঃসন্দেহে বলা যায়, এরা এগোবে আরো অনেক, অনেক দূর।
আজ চিরবিদায়ের মুহূর্তটিতে দাঁড়িয়ে আমি তাই আনন্দিত, শিহরিত। আজ মনে পড়ছে একেবারে প্রথম জীবনে পড়া জীববিদ্যার একটি সূত্র – যোগ্যতমের উদবর্তন। সেই মহান তত্ত্বের উদ্গাতা মহর্ষি বিজ্ঞানীকে আমার প্রণাম। এই দুনিয়ার প্রতিকূলতার মধ্যে লড়াই করে বেঁচে থাকে সে-ই, যে যোগ্যতম। তারই বৈশিষ্ট্যগুলি সঞ্চারিত হয় পরবর্তী প্রজন্মে। তার সঙ্গে যোগ হয় নতুন-নতুন বৈশিষ্ট্য, আর এভাবেই এগিয়ে চলে বিবর্তনের ধারা। সেই বিবর্তনের বলে বলীয়ান হয়ে শেষ অবধি টিকে থাকতে পারে সেই যোগ্যতম প্রজাতিটিই।
এই অন্তিম লগ্নে আমার মনে আর বিন্দুমাত্র সংশয় নেই। আমি সগর্বে ঘোষণা করে যাচ্ছি— আমরাই সেই যোগ্যতম জাতি। আমাদের ভালো-মন্দ, মহত্ব-ক্ষুদ্রতা, বিবেচনা-হঠকারিতা— সব কিছু নিয়ে আমরাই প্রাণীজগতের শ্রেষ্ঠ। তার কারণ আর কিছু নয়, আমাদের বিবর্তনের ক্ষমতা। মানিয়ে নেওয়ার সেই অপরিসীম ক্ষমতার কারণেই আমাদের পথ চলা কোনোদিন শেষ হবে না। যে কোনো পরিস্থিতিতে সভ্যতার বর্তিকাটি থাকবে আমাদেরই হাতে। এই গ্রহের ভবিষ্যৎকে আবার চূড়ান্ত উৎকর্ষ আর সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাব আমরা… আমরা… আমরাই…”
এই হর্ষোৎফুল্ল জয়ধ্বনির মধ্যেই শেষ হয়েছে ওই আশ্চর্য আখ্যান। ধাতব পাতটা মুখের সামনে থেকে নামাল গিমিচ। স্তম্ভিত বিস্ময়ে সে কয়েকবার নিঃশব্দে খোলা-বন্ধ করল তার মুখ। দেখা গেল ঝকঝকে ধারালো দাঁতের সারি।
অবশেষে বলল কোনোমতে, “কিন্তু স্যার, এই আজগুবী গল্প কি সরকারের হাতে তুলে দেওয়া যাবে? বিজ্ঞানীরা তো প্রশ্নে-প্রশ্নে ঝাঁঝরা করে দেবে আমাদের! বলবে, সঠিক অনুবাদ করতে না পেরে মনগড়া কাহিনি লিখেছি আমরা!”
ভুল কিছু বলেনি। নিষ্পলক দৃষ্টিতে অনেকক্ষণ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম আমি।
তারপর মৃদুস্বরে বললাম, “না, এই অনুবাদ দেওয়া যাবে না। বরং এক কাজ করা যাক!”
ঘরের একদিকে দেওয়ালের গায়ে সারি-সারি তাক। সবচেয়ে উঁচু তাকের দিকে নির্দেশ করলাম আমি।
“এই পাতটাকে তুমি ওই উঁচু তাকে তুলে রাখো। তারপর একটা নতুন ফাঁকা পাত নিয়ে এসো। একটু মাজা-ঘষা করে একটা নতুন গল্প লিখে ফেলি দু-জনে মিলে!”
স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল গিমিচ। ঘরের ভেতরের জল স্বচ্ছ, শোধনযন্ত্রে শোধিত। সামনের দুই উপাঙ্গে পাতটা আঁকড়ে ধরে পেছনের দুই উপাঙ্গ ও লেজের সাহায্যে সেই জল ঠেলে তরতর করে ওপরে উঠে গেল ও। উঠতে-উঠতে অস্ফূটে স্বগতোক্তি করল, “যত্ত সব গাঁজাখুরি!”
সেদিকে তাকিয়ে আমি লাঙ্গুল আন্দোলন করলাম। সম্মতির লক্ষণ।
ওর কথাই সত্যি হোক! উদ্ভট কল্পকাহিনিই হয়ে থাক এই ভয়ঙ্কর আখ্যান!
Tags: kalpabiswa y7n1, science fiction, ঐষিক মজুমদার, কল্পবিজ্ঞান, প্রমিত নন্দী