দ্বীপ
লেখক: অর্ঘ্যজিৎ গুহ
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
প্রতি রাতের মতো আজও ঘুমটা ভেঙে গেল। সেই একই স্বপ্ন ভেসে ভেসে আসছে বারবার… বারবার! কোনো এক অদৃশ্য ষড়যন্ত্রকারীর পরিচালনায় যেন এই দুঃস্বপ্নটা মঞ্চস্থ হচ্ছে রোজ। রোজ রাতে আমার শরীর যখনই ক্লান্ত হয়ে এই এক কামরার ফ্ল্যাটটার এককোনায় রাখা বিছানাটায় গা এলিয়ে দেয়, ভেবে নেয় চোখ বুঝলেই হয়তো নেমে আসবে নিশ্চিত নিদ্রা ঠিক তখনই এই বিভীষিকার শুরু হয়। প্রথমে নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম যে এ সবই অতিরিক্ত মদ্যপান ও জুয়ার আসরে রাতের পর রাত কাটানোর জন্যেই হয়তো, কিন্তু না আজ বহুদিন হয়ে গেল মদের বোতলটা ছুঁয়েও দেখিনি। শহরের অন্ধকার গলির পিটারের জুয়ার আসরেও পা রাখিনি আজ বহুদিন। তবুও নিস্তার পাইনি… প্রতিটা রাত আমার কাটে একটা দমচাপা আতঙ্কে! চোখ বুজে আসার কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ঘিরে ধরে একটা ঘন কালো আঁধারের চাদর… সেই জীবন্ত অন্ধকারের পিণ্ডটাকে আমি অনুভব করতে পারি, স্পষ্ট বুঝতে পারি তার চলাফেরা। অন্ধকারটা যেন আমার বুকের উপর চেপে বসে, আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে বারবার… বারবার চেষ্টা করি নিজেকে ছাড়ানোর সেই নাম না জানা অদৃশ্য মৃত্যুদূতের হাত থেকে… তবুও একটা পিচ্ছিল নরম শরীর যেন আমার বুকের উপর চেপে বসে। কোনো এক হিংস্র শ্বাপদের মতো চেয়ে থাকে আমার দিকে। সেই চোখ আমি দেখেছি… হ্যাঁ দেখেছি আমি… প্রতি রাত… হ্যাঁ প্রতিটা রাতে সেই চোখ আমায় দেখে, আমার বিছানায়, আমার এক কামরার ঘরটায় সে ঘুরে বেড়ায়… হয়তো কিছু খোঁজে… যে জিনিস তারই এক ও একমাত্র! অনেক ভেবেও এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা আমি পাইনি! তবুও এই স্বপ্নের মধ্যেই আমি পাই এক অন্ধকারের গন্ধ। কয়েক মুহূর্তের এই স্বপ্নেই আমার গা গুলিয়ে ওঠে। আর মনে হয় যেন সেই অন্ধকারটা আমার অসহায়তা দেখে মজা নিচ্ছে। মনে হয় ছুটে গিয়ে খোলা জানালাটা দিয়ে ঝাঁপ দি খোলা রাস্তাটার উপর। হয়তো সেটাই ভবিতব্য! কোনোদিন শুনবেন হয়তো কোনো এক ভবঘুরের মৃতদেহ পাওয়া গেছে শহরের কোনো এক নোংরা গলিতে।
বহু খুঁজেও এর কোনো ব্যখ্যা আমি পাইনি, তবে এটুকু বুঝেছিলাম একমাত্র আমার শেষ সমুদ্র অভিযানের সঙ্গে এই দুঃস্বপ্নের কোনো না কোনো মিল আছেই। তা ছাড়া আর কোনো যুক্তিগ্রাহ্য ঘটনা এ মুহূর্তে মনে আসছে না।
অর্ধ-উন্মাদ ও নেশাখোর হয়ে ওঠার আগে আমি এক অভিজ্ঞ মাল্লা ছিলাম। ছিলাম বলছি এই কারণে যে সেই জীবনটাকে পিছনে ফেলে এসেছি আজ অনেকদিন।
লন্ডন বন্দর থেকে সেবার পাড়ি জমিয়েছিলাম নিউ ইয়র্কের উদ্দেশে।
তবে যদি জানতাম এই সফর আমার জীবন বদলে দেবে তাহলে হয়তো যেতাম না। তখনও গন্তব্য বেশ অনেক দিনের পথ, সঙ্গী বলতে আমাদের ছোট্ট জাহাজটার দশ জন মাঝিমাল্লা আর ক্যপ্টেন। সেই রাতে হঠাৎ একটা বিস্ফোরণে ঘুম ভেঙে যায়। কোনোরকমে বাইরে বেরিয়ে এসে যা বুঝলাম আমাদের জাহাজ জলদস্যুদের কবলে পড়েছে। পাশের কেবিনের সহকর্মীর মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখলাম কিছুটা এগিয়েই। চারদিক থেকে ভেসে আসছে গুলির শব্দ আর আর্তনাদ! জলদস্যুরা সংখ্যায় অনেক। আমরা শত চেষ্টা করলেও পেরে উঠব না। নিজেকে যতটা সম্ভব আড়াল করে লাইফবোটগুলির দিকে নিয়ে গেলাম। কোনোরকমে নিজেকে একটা নৌকায় লুকিয়ে আস্তে আস্তে দড়ি আলগা করতে লাগলাম। আর অল্প কিছুক্ষণ! ব্যাস তারপরেই হয়তো মুক্তি! অবশেষে সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাত থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাতের আকাশের পথ চিনিয়ে দেওয়া অসংখ্য নক্ষত্রদের সঙ্গী করে ভেসে গেলাম অজানার পথে।
হায় ঈশ্বর তখনও যদি জানতাম… জলদস্যুদের হাতের নির্মম মৃত্যুও হয়তো এই দুস্বপ্নের তুলনায় অনেক বেশি সুখের হত।
জানি না ঠিক কতদিন ভেসে বেরিয়েছিলাম। খাদ্য বলতে শুধু ছিল লাইফবোটের মাঝে রাখা কিছু শুকনো খাবার আর বিস্কুট। প্রথম কয়েকদিনের হিসেব আমার মনে ছিল, তারপরের স্মৃতি সবই ঝাপসা। শুধু এটুকু মনে ছিল স্রোতে গা ভাসিয়ে আমার লাইফবোটটা দক্ষিণ দিকে চলেছিল। নিজের ভবিতব্যের কাছে প্রায় হারই মেনে নিয়েছিলাম এক প্রকার। অনাহারে, তৃষ্ণায় পাগল হতে বসেছিলাম ঠিক তখনই এক সন্ধেয় আমার ঘুম ভাঙে বুকের কাছে একটা পিচ্ছিল আর ঠান্ডা কিছুর স্পর্শে। নিজেকে কোনোমতে সামলে নিয়ে বুঝতে পারলাম এসে পড়েছি একটা স্থলভাগে। কীভাবে ভেসে এসেছিলাম আমি জানি না, তবে যতটুকু মনে পড়ল তাতে খেয়াল হল একটা অদ্ভুত সুর ভেসে এসেছিল আমার কানে। চরম মায়াবী আকুল ছিল সেই সুর। হয়তো সেইটা শুনেই নিজের নৌকাটা চালিয়ে এখানে এসে উপস্থিত হয়েছিলাম আর ক্লান্তিতে জ্ঞান হারিয়েছিলাম আমি। নিজের শরীরটাকে টেনেহিঁচড়ে এগোতে লাগলাম সেই নাম না জানা সমুদ্র সৈকতটা ধরে। কত ঘণ্টা সেভাবে হেঁটে ছিলাম মনে নেই। তবে এটুকু মনে আছে একটা প্রাণীরও দেখা আমি পাইনি, শুনিনি কোনো শব্দও! দ্বীপটার চরম নীরবতা যেন আমায় আরো একা করে দিচ্ছিল প্রতি মুহূর্তে। তবুও কীসের একটা অমোঘ আকর্ষণে যেন চলতেই থাকলাম।
কতদিন যে দ্বীপটার এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত হেঁটেছিলাম আজ আর খেয়াল পড়ে না। তবে এটুকু মনে আছে যতক্ষণ জেগে থাকতাম আমি হাঁটতাম… হাঁটতাম এক টুকরো খাবারের আশায় আর… এক চিলতে ছায়ার খোঁজে। কখনো পেতাম, কখনো পেতাম না। খাবারের মধ্যে জুটত কিছু ফল বা ফলের মতো কিছু। সেই উদ্ভিদগুলোও ছিল বড়ো অদ্ভুত। সেগুলি আমার মস্তিস্কের জ্ঞানের পরিধির কোনো চেনা উদ্ভিদ ছিল না। চেনা কিছু গুল্ম আর ক্যাকটাসের মতো আকারের হলেও তারা অদ্ভুতভাবে এক জায়গায় জড়ো হয়ে থাকত। আমরা জাহাজ বেঁধে রাখার দড়িগুলি যেভাবে এক জায়গায় জড়ো করে রাখতাম, অনেকটা সেরকম। তবে এভাবে বললে হয়তো বর্ণনা করতে কিছুটা সুবিধে হবে বলে বলা, আসলে সেগুলি ছিল আরো অনেক বেশি জটিল। মাটি থেকে উঠে আসা কাণ্ডগুলি ছিল প্রচণ্ড লম্বা। মাটি থেকে উঠে এসে সেই শুকনো লম্বা লতানো কাণ্ডগুলি আরো অনেক শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে অবশেষে যেন পথ হারিয়ে এক জায়গায় পেঁচিয়ে গেছে। শাখা-প্রশাখাগুলিতে ঝুলে থাকা ফলগুলি ছিল অনেকটা মানুষের হাতের মতো। খাবার সময় একটা একটা আঙুলের মতো অংশ ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতাম। মনে হত এক সময় হয়তো পুষ্টিকর রসে ভরা ছিল সেই অংশগুলো। সেগুলোর স্বাদ কেমন ছিল তা আমি জানি না হয়তো দীর্ঘদিনের অনাহারে, তৃষ্ণায় স্বাদকোরকগুলো শুকিয়ে গেছিল। সেই ফলগুলো অতিকষ্টে খেয়ে সেই শুকনো ডালপালাগুলো কেটে কোনোরকম একটা ছায়ার ব্যবস্থা করতাম কখনো।
খাবারের সন্ধান শেষ হলে শুরু হত আরো এক অনুসন্ধান। এই নাম না জানা দ্বীপ থেকে মানব সভ্যতায় ফেরার পথের। আমার এতদিনের নাবিক জীবনে কখনো এরকম অদ্ভুত দ্বীপে আমার পা পড়েনি। সূর্যের সঙ্গে পৃথিবীর দূরত্ব যেন এখানে সবচেয়ে কম। এতটা উষ্ণতা যে কোনো মানব শরীর মানিয়ে নিতে পারে সেটার কোনোরকম আন্দাজ আমার ছিল না। হিসেব লাগানোর চেষ্টা করেছিলাম, হয়তো কর্কটক্রান্তি রেখার আশপাশের কোনো নাম না জানা দ্বীপে আমার ঠাঁই হয়েছে অথবা কালো মহাদেশের কোনো অজানা প্রান্তে আমায় জঞ্জালের মতো ভাসিয়ে এনে ফেলেছে এই মহাসাগর। প্রতি রাতে আকাশের নক্ষত্রমণ্ডলগুলোর অবস্থান দেখে বালির উপরে নক্সা বানাতাম। তবে আমার সমস্ত জ্ঞান ভুল প্রমাণ হতে লাগল প্রতিদিন। প্রথম প্রথম নিজের ক্ষুধার্ত শরীর, দুর্বল মস্তিস্ক আর সারাদিনের তাপপ্রবাহের ফলে জন্ম নেওয়া ক্লান্তি ও দিকভ্রষ্ট হওয়ার দোহাই দিয়ে নিজেকে স্বান্তনা দিলেও আমি জানতাম আমার হিসেবগুলো ছিল একদম সঠিক। আজও ঈশ্বরের দিব্যি কেটে আমি বলতে পারি আমার শরীর শত নেশার বশবর্তী হলেও দিক নির্ণয়ের ক্ষমতা আমার প্রশ্নাতীত। তবে এক সন্ধেয় অনুধাবন করলাম এই দ্বীপে দাঁড়িয়ে নক্ষত্রমণ্ডলের অবস্থান দেখে নিজের অবস্থান নির্ণয় করা এক প্রকার দুঃসাধ্য। কারণ পৃথিবীর কোনো অঞ্চলেই নক্ষত্রমণ্ডল এত দ্রুত নিজেদের অবস্থান পরিবর্তন করে না। গত রাতের হিসেব অনুযায়ী এই দ্বীপের অবস্থান ছিল উত্তমাশা অন্তরীপের ঈশান কোণে, আজকের হিসেব অনুযায়ী সেই দ্বীপের অবস্থান দাঁড়িয়েছে দক্ষিণ মেরুর আশপাশের কোনো এক অঞ্চলে! এই গরমিল দেখা দিতে লাগল নিত্যদিনের হিসেবে। অবশেষে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে ছেড়ে দিলাম সেই হিসেবনিকেশ। নিজের মনেই নাম দিলাম এই দ্বীপের “জীবন্ত দ্বীপ”। এমন এক দ্বীপ যে নিজেই আমার মতো পথ হারিয়েছে এই অসীম সাগরের বুকে।
তবে একটা বিষয় আকাশের ধ্রুবতারার মতো স্থির ছিল সেটা হল দিনের বেলার চরম তাপ আর সন্ধে নামার মুখেই সেই প্রথম রাতের শোনা একটানা একঘেয়ে শিসের শব্দ। ক্ষুধা-তৃষ্ণায় অর্ধ উন্মাদ অবস্থাতেও প্রথম প্রেমে পড়া কোনো প্রেমিকের মতো অপেক্ষা করে থাকতাম সেই সুরটার জন্য। যেন ওই একটাই দায়িত্ব ও কর্তব্য বিধাতা লিখে দিয়েছেন আমাকে। রোজ সন্ধেয় সেই সুরটার ব্যাখ্যা করার জন্য নিজের মনকে কোনোভাবে একাগ্র করার প্রস্তুতি নিতাম। তবে তারতম্য লক্ষ করিনি কোনোদিন। সেই একটানা “শিস”। একটা চরম আকুলতা, একটা অন্তহীন অনুনয় ছিল সেই সুরে। প্রার্থনা ও বেদনারও আভাস পেতাম সেই শিসের সুরে। দিনের এই বিশেষ সময়টাতেই যেন একত্র হয় কেউ বা কারা এই দ্বীপের কোনো এক প্রান্তে। এক অদ্ভুত মন্ত্রবলে নিজের ক্লান্ত ক্লিষ্ট শরীরটাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতাম সেই অদ্ভুত “জীবন্ত” দ্বীপের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে, হয়তো কোনো একদিন সেই শব্দের উৎসের সন্ধান পাব এই আশায়। যতদিন গেছে তত সেই অদ্ভুত দ্বীপের গভীরতর অংশে নিজেকে খুঁজে পেয়েছি। আর খুঁজে পেয়েছি আরো কিছু সেই অদ্ভুত উদ্ভিদ। সেই অদৃষ্টপূর্ব উদ্ভিদগুলো আমাকে দিনেরবেলায় ছায়া আর সামান্য কিছু ফল দিলেও সেগুলি যে আদৌও কোনো মানুষের খাদ্য সেটা আমার কল্পনারও অতীত ছিল। দ্বীপের এই অংশের উদ্ভিদগুলো ছিল কিছুটা তাজা আর জীবন্ত আর ফলগুলোও ছিল রসালো। তবে সেগুলো ছিল অদ্ভুত রকম কষাটে আর মাংসল। নিজের একমাত্র অস্ত্র ছোরা দিয়ে সেগুলোকে কাটতে রীতিমতো বেগ পেতে হত। আঙুলের মতো অংশগুলো কেটে ফেলার পরে এক রকম অদ্ভুত নীলচে-সবজে রঙের তরল চারদিকে ছিটকে পড়ত। এরকম ফল আমার অভিজ্ঞ নাবিক জীবনে কোনো বন্দরের সরাইখানার খাদ্যতালিকাতেও আমি খুঁজে পাইনি। এমনকি কালো অন্ধকার আফ্রিকা মহাদেশের শহরের, বন্দরের গুজবে কান দিলেই যেখানে অসভ্য আদিবাসীদের কাঁচা মাংস, এমনকি নরখাদকদের উপকথাও কানে আসত, যেসব শুনে আমাদের মতো সুসভ্য জাতির লোকেরা কখনো হেসে গড়িয়ে পড়ত আর দুর্বল হৃদয়ের মাঝিমাল্লারা ভয়ে কুঁকড়ে থাকত, তারাও হয়তো কোনোদিন এই অদ্ভুত অখাদ্য “ফল” এর বিবরণ শোনেনি! দিনের পর দিন সেই ফল খেয়েই আমার ক্ষুন্নিবৃত্তি করতে হয়েছে। যত গভীরে যেতে শুরু করেছিলাম সেই দ্বীপের তত বেশি যেন “জীবন্ত” হয়ে উঠছিল সেই লতানো উদ্ভিদটা। আমার ছোরার প্রতিটা কোপের যেন প্রতিবাদ জানাতে লাগল সেই লতানো উদ্ভিদগুলো। আমার ছোরার কোপে অদ্ভুতভাবে কেঁপে উঠত সেগুলো।
কত দিন, কত মাস বা কত বছর যে এভাবেই কাটিয়েছিলাম জানি না। হয়তো ছয় মাস, হয়তো ছয় বছর! শুরুর দিকে দাগ মাটিতে দাগ কেটে কেটে দিনের হিসেব রাখলেও একসময় সেই অভ্যেসও ত্যাগ করেছিলাম। একটা চরম বিষাদ যেন ঘিরে ধরেছিল আমাকে। প্রতিদিনের একই রোজনামচা যেন আমার গা সওয়া হয়ে গেছে। এই এতগুলো দিন সাগর দিয়ে ভেসে যাওয়া কোনো জাহাজ আমার চোখে পড়েনি। হয়তো কোনো অজানা কারণে নাবিকরা এই পথ এড়িয়ে যায়। হয়তো আমিই এই দ্বীপের আবিষ্কর্তা। দেশে ফিরে গিয়ে নিজের অভিযানের গল্প লিখব আমি। সেই গল্প ছেপে বেরোবে পত্রপত্রিকায়। সেই গ্ল্প পড়ে উৎসাহিত হয়ে দলে দলে অভিযাত্রীরা পাড়ি জমাবে এই দ্বীপের উদ্দ্যেশে। এসব ভেবে আমি রোজ রোমাঞ্চ আনুভাব করতাম। তবে ক্রমে বুঝতে পারলাম শুধুমাত্র কোনো জলযানই নয়, এই দ্বীপের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়া কোনো পাখিও এতদিনে আমার নজরে পড়েনি। সম্ভবত আমিই এই দ্বীপে পা দেওয়া প্রথম কোনো প্রাণী! মাঝে একাকীত্ব যেন ঝাঁকিয়ে বসতে লাগল আমার উপর। কখনো উন্মাদের মতো ছুটে বেড়াতাম। কখনো চিৎকার করতাম। এসব করে গলা শুকিয়ে এলে আমি হাঁপাতাম। জামা ছিঁড়ে বানানো থলিটা থেকে সেই কেটে আনা ফলের সবজে নীল রস গলায় ঢালতাম। চরম অসহ্য ছিল সেই স্বাদ। তাতে গলা ভিজলেও তেষ্টা মিটত না। তখন এক ফোঁটার জলের আশায় হাতের আঙুল দিয়ে মাটি আচঁড়াতাম, ছোরাটা দিয়ে প্রাণপণে খুঁচাতাম। তবে কোনোদিনও এক ইঞ্চি গর্তও আমি করতে পারিনি। শুধু এক জায়গায় না, জেদের বশে দ্বীপের বিভিন্ন জায়গায় একইভাবে চেষ্টা চালিয়েছিলাম আমি। কিন্তু কি অদ্ভুত! যেন কোনো কচ্ছপের খোল ভেদ করবার চেষ্টা করছে কোন এক ছোটো পিঁপড়ে। শুধুই ব্যর্থতা আর ব্যর্থতা।
এভাবেই কবে যেন পৌঁছে গেছিলাম দ্বীপটার এই প্রান্তে জানি না। ক্লান্তিতেই হয়তো ঘুম নেমে এসেছিল দুই চোখে গতরাতে। ঘুম ভেঙে এই একটানা কান ফাটানো শব্দে। প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠে বুঝলাম এই শব্দ আমার চেনা। এই শব্দের টানেই একসময় এই দ্বীপের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ঘুরে বেড়াতাম উদ্দেশ্যহীনভাবে। তবে এখন এই শব্দের তীব্রতা যেন সহ্যের সীমার অতীত। কান পাতা যাচ্ছে না সেই শিসের আওয়াজে। দিনের বেলায় এতটা প্রাবল্য এর আগে কোনোদিন আমার কানে এসে পৌঁছায়নি। যেন শব্দটা আসছে একদম সামনের কোনো জায়গা থেকেই। দু-হাতে কান চেপে ধরে এগিয়ে গেলাম বেশ খানিকটা পথ। বেশ বুঝতে পারছিলাম শব্দের তেজটা বাড়ছে। শব্দটায় এখন সেভাবে প্রার্থনা বা অনুনয়ের প্রভাব নেই। যেটা আছে সেটা হল একটা তীব্র বিপদ সঙ্কেতের আভাস। অনেকটা… হ্যাঁ অনেকটা সাইরেনের মতো। যেন কাউকে সাবধান করে দিচ্ছে কেউ বা কারা। সামনের রাস্তাটা যেন বেশ খাড়া। বুঝতে পারলাম আমি একটা প্রায় উঁচু ঢিবির মতো স্থানের দিকে এগিয়ে চলেছি। তবে আমি ভুল ছিলাম। যতই এগোতে লাগলাম ততই বুঝতে পারলাম যেই স্থানটাকে ঢিবি বলে ভাবছিলাম সেট আসলে একটা পর্বতের পাদদেশ মাত্র। আমার কল্পনার থেকেও উঁচু সেই পর্বত। নিজেকে নিতান্তই একটা পিঁপড়ের মতো মনে হতে লাগল যেন। এই দ্বীপে এতদিন কাটিয়ে দেওয়ার পরে কোথাও কোনো পাহাড় এমনকি উঁচু টিলাও অব্দি চোখে পড়ে কখনো। আজ এই সুবিশাল পর্বতের আবির্ভাব যেন বড়োই অস্বাভাবিক ঠেকল। মনে হল যেন রাতারাতিই গজিয়ে উঠেছে এই পর্বত। নিজের মনকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম হয়তো পর্বতটা এখানেই ছিল এতদিন, আমিই পথ হারিয়ে আজ এর সামনে এসে পড়েছি। নিজেকে সামলে নিয়ে আবার পথ হাঁটা শুরু করলাম পাহাড়ের গা বেয়ে। সেই একটানা তীক্ষ্ণ শব্দটা এখন অনেকটা যেন গা সওয়া হয়ে গেছে। কান দিয়ে প্রবেশ করলেও শরীর মনে কোনোরকম অস্থিরতার জন্ম দিচ্ছে না নতুন করে। আমার মস্তিস্ক তখন একটাই লক্ষ্যে স্থির। যেভাবেই হোক এই অদ্ভুত পাহাড়ের চূড়ায় আমায় উঠতেই হবে। যে সমস্ত অদ্ভুত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন আমি এতদিন ধরে হয়ে এসেছি হয়তো তারই শেষ খুঁজে পাব আমি এই পাহাড়ের শীর্ষে বা অপর প্রান্তে।
পাহাড়টা বন্ধুর। পাথরের খাঁজগুলো ধরে হাতড়ে হাতড়ে উঠতে লাগলাম। দুর্বলতাই হোক বা ক্ষুধার তাড়না। হাতের পেশি যেন শিথিল হয়ে আসতে লাগল। শিসের মতো শব্দটার তীব্রতা যেন পাহাড়রটার উচ্চতার সঙ্গে সঙ্গে উত্তরোত্তর বেড়েই চলেছে। বুঝতে পারলাম শব্দটার উৎসের কাছাকাছি পৌঁছাচ্ছি ধীরে ধীরে। নিজের হাতের দিকে একবার তাকালাম। প্রায় ক্ষত বিক্ষত। তবুও নিজের ক্লান্ত অবসন্ন দেহটাকে টেনে এনে হাজির করলাম একটা খাঁজ মতো জায়গায়। আরাম করে নিজের শরীরটাকে টান হয়তো করা যেত না তবে গুটিসুটি মেরে পিছনের পাথুরে দেওয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে রাতটুকু কাটিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। আলো কমে আসছিল দ্বীপটাতে। খাবারের থলিতে কিছু কেটে আনা ফল ছিল। সেগুলির মধ্যে থেকেই একটা দাঁত দিয়ে টেনে টেনে ছিঁড়ে খেতে শুরু করলাম। একটা অদ্ভুত কৌতূহল কাজ করছিল যেন শরীর-মনে। কোনো নতুন কিছু যেন অপেক্ষা করে আছে এই পাহাড়ের শৃঙ্গে। গোধূলির ডুবন্ত সূর্যের দিকে তাকিয়ে রইলাম বেশ খানিকক্ষণ। মনের মধ্যে একটা চিন্তা ভেসে এল। হয়তো আমার দিন ফুরিয়ে এসেছে। আগামী কয়েকদিনেই হয়তো বিধাতা ওঁর নিজের মতামত জানিয়ে দেবেন। হয়তো এই পর্বতের শৃঙ্গ থেকেই হদিশ পাব সভ্যতায় ফেরার। হয়তো এই নির্জন নাম না জানা দ্বীপে, যেই দ্বীপের হয়তো আমিই একমাত্র প্রাণী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ব নীরবে অথবা এই প্রায় বিষাক্ত গুল্মের বিষক্রিয়ায় আর্তনাদ করতে করতে। একটা অদ্ভুত ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে পড়তে চাইছিল। শরীর তার শেষ সীমায় হয়তো পৌঁছেও গিয়েছিল। কোনোরকমে নিজের পিঠ আর মাথাটা ঠেকিয়ে দিলাম পাথুরে দেওয়ালে। ক্লান্ত চোখের সামনে আবছাভাবে সেজে উঠছে রাতের আকাশ।
এক অদ্ভুত অনুভূতিতে ঘুমের জাল আমার ছিঁড়ে গেল। ঠিক কতক্ষণ আমি ঘুমিয়েছিলাম আমি জানি না কারণ এই দ্বীপে এসে সময়ের জ্ঞান লোপ পেয়েছে আমার অনেকদিন। স্পষ্ট বুঝতে পারলাম আমার পিঠের কাছে পাথরের দেওয়ালটায় একটা আন্দোলন হচ্ছে। খুব মৃদু। তবুও হচ্ছে, এই কথা আমি শপথ করে বলতে পারি। ভূমিকম্প! বা ধ্বস কী? তবে আন্দোলন একটা যে হচ্ছে সেটা যেন স্পষ্ট। বুঝলাম আমার এই আশ্রয় আর নিরাপদ নয়। যত দ্রুত সম্ভব এগিয়ে যেতে হবে। আবার শুরু হল যাত্রা। কখনো হাতড়ে, কখনো খানিকটা সোজা হয়ে, কখনো বা পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা সেই গুল্মের ডাল ধরে, কখনো বা বুকে ভর দিয়ে শুরু হল আমার যাত্রা। যেই যাত্রা হয়তো বা মুক্তির, হয়তো বা চির মুক্তির।
নিজের শরীরের উপর নিয়ন্ত্রণ যেন হারিয়ে ফেলছিলাম ধীরে ধীরে। সমস্ত ইচ্ছাশক্তি যেন নিঃশেষ হয়ে আসছিল। এতক্ষণ যেই শব্দটা আমার কানে সহ্য হয়ে এসেছিল বলে মনে হচ্ছিল সেই শিসের মতো শব্দটার শব্দ যেন আবার হঠাৎ বেড়ে গেছে পাহাড়ের এই অংশে। যেন ঠিক পায়ের নীচেরই কোনো গুপ্তকুঠুরি থেকে আসছে শব্দটা। শব্দটার চরিত্র যেন কিছু পরিবর্তন হয়েছে আবার। প্রার্থনার তালের সঙ্গে যেই শব্দটা মিশেছে সেই ছন্দটা যেন অনেকটা কোনো জংলি আদিবাসীদের দামামার মতো। যেন কোনো শিকারের চারদিকে জড়ো হয়েছে সমস্ত আদিবাসী গ্রাম। পাথরের দেওয়ালে কান পাতলে স্পষ্ট কানে আসছে সেই শব্দ। আবার নতুন উদ্যমে চলতে শুরু করলাম। আবার সেই একঘেয়ে পাহাড়ি পথ। সেই একইভাবে নিজের শরীরকে টেনে নিয়ে যাওয়া। সাক্ষী রইল আকাশের চাঁদ আর অগণিত নক্ষত্র। এক সময় যাদের আশ্রয় করে পথ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করতাম আজ তারাই যেন ব্যঙ্গের হাসি হাসছে আমার দিকে। চোখ বন্ধ করে একটা লম্বা নিশ্বাস নিলাম। হয়তো আজকের রাতটাই আমার শেষ। তবুও এই শব্দের হদিশ আমাকে পেতেই হবে যদিও শরীর যেন নিজের অন্তিম সীমায় পৌঁছে গেছে। তবে দাঁড়িয়ে থাকা মানেই এই ধ্বস বা ভূমিকম্পের জন্য অপেক্ষা করা। একটা নিরাপদ জায়গার খোঁজে কোনোরকমে পা বাড়ালাম। হয়তো কোনো পাথর কিছুটা আলগা হয়ে এসেছিল বা কোনো গর্তে আমার পা পড়েছিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝলাম আমি গড়িয়ে যাচ্ছি কোনো একটা অন্ধকার গহ্বরের মধ্যে দিয়ে। সত্যিই কি গড়িয়ে যাচ্ছি নাকি কেউ টেনে নিয়ে যাচ্ছে আমায় কোনো অসীম অন্ধকারের মধ্যে? কিছু একটা যেন আমার পা, আমার কোমর ছাড়িয়ে আমার বুকের কাছে উঠে আসছে খুব দ্রুত। আমার নিশ্বাস আটকে আসছিল। ঠিক কতক্ষণ সেই একটানা নরক যন্ত্রণা আমি সহ্য করেছিলাম জানি না। একসময় হার মানলাম।
যখন জ্ঞান ফিরল চোখ খুলতেই বুঝতে পারলাম যেই অংশটায় এসে আমি পড়েছি সেটা একটা গুহার মতো কোনো একটা অংশ। হয়তো ওই পাহাড়টারই কোনো একটা ভাগে অবস্থিত ছিল সেই গুহাটা। অদ্ভুতভাবে লক্ষ করলাম জায়গাটায় খুব অল্প হলেও আলো আছে। একটা অদ্ভুত রঙের আলোর আভায় যেন ঘিরে আছে গুহাটা। অনেক খুঁজেও গুহাটার দেওয়ালে বা ছাদে কোনো আলো বা বাতাস আসার কোনো ফাঁক আমার চোখে পড়েনি। তবে বুঝেছিলাম আলো বা বাতাস কোনোটারই অভাব নেই সেভাবে এই গুহাটায়। যদিও বাতাস এখানে যথেষ্ট ভারী ও কিছুটা দুর্গন্ধযুক্ত। তব এই দুর্গন্ধ আমার কিছুটা হলেও চেনা। প্রথম দিকে যখন ওই লতানো গাছগুলির ফল কেটে খেতাম, সেগুলো পচে এলেও ঠিক এরকম গন্ধ পেতাম। নিজের শরীরের দিকে একবার তাকালাম। স্থানে স্থানে চামড়া ফেটে রক্ত বেরিয়ে আসছে। ক্লান্ত অবসন্ন রক্তাক্ত শরীরটা তাও একটা নিরাপাদ আশ্রয়ের আনন্দে সমস্ত ক্লান্তি যেন ভুলে গেল। গুহার দেওয়াল ধরে এগিয়ে যেতে লাগলাম। অদ্ভুত রকম সেই দেওয়ালগুলো। আবছা আলো ছায়ায় আর হাতের স্পর্শেই বুঝতে পারছিলাম দেওয়ালগুলো অসম্ভব রকমের মসৃণ। মনে হয় যেন কোনো আদিম মানুষ তার সমস্ত দক্ষতা উজার করে দিয়ে সেই দেওয়ালগুলোকে এরকম বানিয়েছে। তবে কালের প্রভাবেই হয়তো কিছু জায়গা কোনো সামুদ্রিক শৈবাল জন্মেছে। কখনো দাঁড়িয়ে, কখনো হামাগুড়ি দিয়ে, কখনো বুকে ভর দিয়ে চলতে লাগলাম সেই গুহার মধ্যে দিয়ে। একটা অদ্ভুত বায়ুপ্রবাহ যেন বয়ে চলেছে গুহার গলিগুলোর মধ্যে দিয়ে। সেই বায়ুপ্রবাহ কিছুটা দুর্গন্ধ যুক্ত হলেও আমার কাছেই সেটাই ছিল নিশ্বাসপ্রশ্বাস চালিয়ে যাওয়ার একমাত্র মাধ্যম। এই গোলকধাঁধার শেষে এসে পৌঁছালাম গুহার এক বিশেষ অংশে। অনেকক্ষণ যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করাতে পারছিলাম না। একটা অদ্ভুত মায়াময় আলোয় যেন গুহাটা ঢেকে রয়েছে। সেই অদ্ভুত শিসের মতো আওয়াজটা এখানে যেন সবচেয়ে তীব্র। তবুও এক অদ্ভুত নেশায় যেন আমায় সেসব ভুলিয়ে দিয়েছিল। চোখের সামনে তখন এক অদ্ভুত দৃশ্য। গুহার ছাদ থেকে নেমে এসেছে রক্তাভ এক অদ্ভুত রকমের স্ফটিক। গুহার পুরো অংশটাই যেন সেই স্ফটিকের আলোয় লালচে রঙ্গে ছেয়ে আছে। উন্মাদের মতো ছুটে গেলাম সেই হিরের মতো স্বচ্ছ পাথরগুলোর দিকে। একে একে ভেঙে টুকরো টুকরো করতে থাকলাম একেকটা স্ফটিকের স্তম্ভ। গুহার দেওয়াল থেকেও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তুলতে লাগলাম সেই রক্তস্ফটিক। কতক্ষণ যে সেই রক্তস্ফটিকগুলো নিয়ে সময় কাটিয়েছিলাম জানি না। তবে এক সময় হয়তো ক্লান্ত হয়েই থেমে গেছিলাম। খেয়াল পড়ল গুহার দেওয়ালের দিকে, একটু আগেও এখানে সেই রক্তস্ফটিকের একটা স্তর ছিল। এখন যেন একটা আবছা ছবি ভেসে উঠেছে। নিজের মনকে এই বলে বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে গুহার গা দিয়ে গড়িয়ে আসা কোনো তরলের প্রভাবেই হয়তো এরকম নক্সার জন্ম হয়েছে। তবু কৌতূহলবশত এগিয়ে গেলাম দেওয়ালের দিকে। যেগুলিকে তরল গড়িয়ে আসা নক্সা মনে হচ্ছিল সেগুলির নিখুঁত বিবরণ দেখে থমকে গেলাম। যেন কোনো আদিম মানব এঁকে রেখে গেছে নিজেদের গল্প। চমকে যেতে হয় দেওয়াল জোড়া সেই সমস্ত গুহাচিত্রগুলো দেখে। যেন কোনো আধুনিক শহরের চিত্র প্রদর্শনীর মধ্যে চলে এসেছি। আরো খানিকটা এগিয়ে গেলাম দেওয়ালের দিকে। ছবিগুলো দেখছিলাম আর নিজের মনে মনে একটা কাহিনি সূত্র বানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছিলাম। প্রাথমিকভাবে নজরে পড়ল কিছু কিছু প্রাগৈতিহাসিক জীবের ছবি। যারা এই পৃথিবীর বুকে শাসন করেছিল মানুষের আবির্ভাবেরও কোটি কোটি বছর আগে! ভাবলে অবাক হতে হয় কে বলল সেই গল্প এই আদিম মানুষদের? কে লিখে গেছিল সেই ইতিহাস? দেওয়াল ধরে ধরে আরো এগিয়ে গেলাম। সমস্ত দেওয়াল জুড়ে সেই প্রাচীন অতিকায় প্রাণীদের ভিড় ইতস্তত। তাদের মধ্যে কিছু স্থলজ কিছু জলজ। প্রায় একই রকম ছবি দেখে দেখে চোখ যেন ক্লান্ত হয়ে এসেছিল। তবুও নিজের মস্তিষ্কের তাড়নায় দেখতে লাগলাম, ছবিগুলোর ক্রম আমার মগজ ততক্ষণে বুঝে নিয়েছে। ছাদের থেকে ছবিগুলো আঁকা শুরু হয়ে দেওয়াল বেয়ে নীচের দিকে নেমেছে। একে একে সেখানে আবির্ভাব হয়েছে চতুষ্পদ প্রাণীর, দেওয়ালের এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য মাছেদের ছবি, কিছু বুকে ভর দিয়ে চলা প্রাণীরও দেখা মিলল দেওয়াল জুড়ে। কী অদ্ভুত! পাশের ছবিতে দেওয়ালের উপরের দিকে নজর পড়ল বাঁদরের মতো এক শ্রেণীর প্রাণীরও। দেওয়ালের নীচের দিকে আসতে আসতে তাদের আয়তন বেড়েছে। বদলে গেছে তাদের দাঁড়ানোর ভঙ্গি। যতই দেখছি ততই যেন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাচ্ছি। ক্ষুধা, তৃষ্ণা সব যেন ভুলে গেছি কোনো এক আশ্চর্য জাদুবলে। ওই তো তারা দু-পায়ে ভর দিয়ে হাঁটছে, শিকার করছে, খাবার জ্বলসে খাচ্ছে। লম্বা দাঁতওয়ালা বাঘ বা অতিকায় হাতির ছবি সবই স্থান পেয়েছে তাতে। কে এই শিল্পী? শিল্পী নাকি বিজ্ঞানী নাকি ইতিহাসবিদ? কী অদ্ভুত দক্ষতায় পাথরের গায়ে ফুটিয়ে তুলেছে এক আশ্চর্য দলিল! কী ছিল তাদের উদ্দেশ্য? কে শিখিয়েছিল তাদের এই ইতিহাস! কোনো ইতিহাসবিদ তাদের এভাবে শিখিয়েছিল অতীতের পাঠ?
গুহার দেওয়াল ধরে ধরে নিজের শরীরটাকে আরো টেনে নিয়ে যেতে লাগলাম আর গভীরে। এখানেও সেই একই রক্তাভ স্ফটিকের সারি। তাদের আলোয় সমস্ত গুহার দেওয়াল যেন রক্তিম হয়ে উঠেছে। শরীরের সমস্ত ক্লান্তি যেন ধুয়ে গেছে এই ঐতিহাসিক জাদুঘরের খোঁজ পেয়ে। মনে মনে বললাম শুধু “এই দ্বীপের নয় এই গুহার, এই ঐতিহাসিক গুহারও আবিষ্কর্তা আমি, হ্যাঁ আমিই!” সারা পৃথিবীতে আর কেউ নেই যে এই দাবি করতে পারে। শিশুর মতো গুহার এদিক ওদিক ছুটতে লাগলাম আহত শরীরটাকে নিয়ে। কখনো মেঝেতে বসে শিশুর মতো দেখতে লাগলাম সেই ইতিহাসের দলিলগুলো। কিছু ছবি দেখে মনে হল মানুষরা তখন উপাসনা করতে শিখেছে। কোনো একটা জলভাগের উপর ভেসে থাকা একটা জিনিসের দিকেই যেন তাদের নজর। ডাঙায় তারা দল বেঁধে এসে দাঁড়িয়েছে। দেওয়ালের যত নীচের দিকে চোখ বোলালাম ততই যেন অবাক হতে লাগলাম। ওই আশ্চর্য জীব, যার কোনো সুস্পষ্ট আকার নেই, তার জন্যেই যেন মানুষগুলো আগুন জ্বালিয়েছে, তাকে ঘিরেই শিকার করছে। সেই জীবটার সামনেই এনে জড়ো করে রাখা হয়েছে হাতি, বাঘ, সিংহ ও আরো অদ্ভুত পুরাকালের জানোয়ারদের। বলি? সম্প্রদান? তবে কে সেই দেবতা? এই প্রথমবার ছবিগুলোকে একটু বেমানান লাগতে শুরু করল। এই প্রথম শিল্পীর সম্পর্কে আমার সন্দেহ হল, কারণ পরের পর ছবিগুলোতে কেবলমাত্র যেন সেই নাম না জানা, আকার আকৃতিহীন প্রাণীটার ছবি। আর আশ্চর্যজনকভাবে প্রতি ছবিতে সেই প্রাণীর আকৃতি যেন বেড়েই চলেছে। হঠাৎ দেখলে মনে হবে যেন আগের শিল্পী এখানেই ছবি আঁকার কাজে অবসর নিয়ে নতুন শিল্পীকে দায়িত্ব দিয়েছেন এবং সেই শিল্পীর যেন আকার আকৃতির অনুপাতের জ্ঞান একদমই শূন্য। তবে খেয়াল করলে বোঝা যায় আকারের বৃদ্ধি ঘটেছে শুধুমাত্র সেই নামহীন প্রাণীটারই। অন্য জীবদের কোনো পরিবর্তন হয়নি। আমার হতবাক হওয়ার যেন আরো বাকি ছিল। পরের ছবিটাই আমাকে পাথরের মতো স্থির করে দিল, কারণ দেওয়াল জুড়ে যে প্রাণীর ছবি এখানে আঁকা তার আকার আকৃতি সম্পর্কে শিল্পীর যেন কোনো ধারণাই ছিল না। সমস্ত দেওয়াল জুড়েই সেই প্রাণীর ছবি। এতক্ষণ ধরে যেই সমস্ত প্রাণীর গুহাচিত্র দেখে এসেছি এই প্রাণী যেন যেন তাদের থেকে কয়েক হাজার গুন বড়ো। সেই প্রাণীর পায়ের সামনে মানুষগুলো যেন কোনো ক্ষুদ্র পিপড়ের মতো। কী এই নামহীন, আকারহীন প্রাণী যার কাছে মাথা নুইয়ে প্রাগৈতিহাসিক মানুষরা উপাসনা করত। শিকার করে এনে ভেট চরাতো? তার কোনো উত্তর আমি পাইনি। শুধু দেওয়াল জুড়ে দেখতে লাগলাম সেই অজানা অচেনা প্রাণীর আকার আকৃতিহীন অবয়বের ছবি। ঘটনার কোনো তারতম্য নেই। শিল্পীও এঁকে গেছেন একের পর এক ছবি। দেবতা! হ্যাঁ দেবতাই! মানুষ একমাত্র একেই ভয় পায়, তাই তুষ্ট করার জন্য উপাসনা করে, ভেট চরায়! তবে এই দেবতার নাম আমার জানা ছিল না। হয়তো পৃথিবীর কেউই জানে না। কারণ যেই মানুষ পাথর ঘষে সবে আগুন জ্বালাতে শিখেছে, বল্লম বানিয়ে শিকার করতে শিখেছে তার কাছে “ধর্ম” নামক প্রতিষ্ঠানের কোনো অস্তিত্ব থাকার প্রশ্নই ওঠে না। তাহলে কি এই নামহীন, আকার আকৃতিহীন প্রাণীটাই কি এই পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীনতম? নাকি এ সবই সেই আদিম মানব দলের কল্পনা মাত্র! তাহলে এর আগের এই নিখুঁত ছবিগুলো! সেগুলি তো মিথ্যে নয়! অদ্ভুত একটা অসুস্থতা ঘিরে ধরল যেন। ছবিগুলো বড়ো একঘেয়ে হয়ে আসছিল যেন। যেন হঠাৎ করেই থেমে গেল ইতিহাসের সেই যাত্রা। আরো কিছুটা এগিয়ে গেলাম। দৃশ্যপট কিছুটা বদলে গেল যেন অপ্রত্যাশিতভাবেই। কোনো প্রাণীর চিহ্ন নেই। নেই কোনো মানুষের ছবিও। দেওয়াল জুড়ে একটা অদ্ভুত আকৃতির একটা স্থলভাগের ছবি। যেন শান্ত উন্নত পৃথিবীর মানুষের কোনো বাসস্থান। তবে মাঝের ছবিগুলোর অর্থ বুঝলাম না। যেন ইতিহাসবিদ ওই অধ্যায়টাই বাদ দিয়ে চলে গেছেন। কৌতুহলবশত আবার কিছুটা পিছিয়ে গেলাম। খুব মনোযোগ সহকারে দেখতে লাগলাম দেওয়ালগুলোকে। ব্যবহৃত রঙের তারতম্যটা বুঝতে পারলাম। একটা সাদাটে আভা যেন ঘিরে রেখেছে ছবিগুলোকে। কোনো বিশেষ সময় কী? একটা হিসেব লাগানোর চেষ্টা করলাম। তুষারযুগ! হ্যাঁ তুষারযুগই বটে। যেগুলিকে ফাঁকা দেওয়াল ভেবেছিলাম সেগুলি আসলে তুষার যুগের প্রতীক। অর্থাৎ শিল্পী এখানেও নিখুঁত। পর পর ছবিগুলির একটা বিন্যাস করার চেষ্টা করলাম। আদিম মানুষের আবির্ভাব, তাদের বিবর্তন, নামহীন ঈশ্বরের উপাসনা তারপরেই নেমে আসে তুষারযুগ, যেই যুগের শেষে আবার নতুন রূপে জেগে উঠেছিল পৃথিবী! সব হিসেব যেন মিলে যেতে শুরু করল।
তবে কোথায় গেল সেই নামহীন ঈশ্বর? তার কোনো ছবি নজরে এলো না। তবে কি তুষার যুগেই মৃত্যু হয়েছিল সেই আকার আকৃতিহীন দৈত্যাকার প্রাণীর? যার কাছে পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীই তুচ্ছ! এরপরের ছবিগুলো যেন বড়ো বেশি সুন্দর। একটা স্থলভাগের ছবি, যেখানে পাহাড় আছে, সৈকত আছে। কিছু প্রাণী আর মানুষ বসবাস করছে সেখানে। আগের মতো আগুন জ্বালিয়ে, শিকার করে দিন কাটাচ্ছে তারা। শেষ ছবিটা, হ্যাঁ শেষ ছবিটা যেন আমার শিরদাঁড়ার উপর দিয়ে শীতল স্রোত বইয়ে দিল। কিছু মানুষ হতে বল্লম নিয়ে জড়ো হয়েছে একটা অদ্ভুত দর্শন প্রাণীর সামনে। প্রাণীটা অনেকটা সাপের মতো লতানো। কোনো একটা মানুষকে সেটা ধরে রেখেছে তবে… কোনো চেনা নাগপাশ নয় সেটা। সাপটা মানুষটাকে ধরে রেখেছে তার হাতের মতো একটা অংশ দিয়ে! এই প্রাণী আমার চেনা! গত কয়েক মাস বা কয়েক বছর ধরে হয়তো এগুলিকে “ফল” ভেবে খেয়ে এসেছি। আর কোনো গুহাচিত্র দেখার মতো মানসিক বল আমার ছিল না। তবুও যতদূর মনে পড়ে আমি দেখেছিলাম আরো কিছু। আমি দেখেছিলাম সেই “স্থলভাগ” কে প্রাণীশূন্য হতে। প্রতি ছবিতেই সেই লতানো প্রাণীর আধিক্য, যেন তারাই দখল নিয়েছিল সেই দ্বীপের।
কীভাবে হাতড়ে, বুকে ভর দিয়ে নিজের শরীরটাকে গুহার বাইরে বের করে এনেছিলাম আমি জানি না। কতদিন সময় লেগেছিল তাও আমার মনে নেই। শুধু মনে আছে আমি আলো দেখেছিলাম। দিনের আলো। আর সেই “জীবন্ত” দ্বীপের কোনো এক উঁচু জায়গা থেকে আমি একটা জাহাজ দেখতে পেয়েছিলাম। হয়তো মরীচিকাই ভেবেছিলাম। তবুও ছুটেছিলাম। কখনো দৌড়ে, কখনো গড়িয়ে আমি ছুটে যেতে গেছিলাম সেই জাহাজটার দিকে।
কতদিন পর আমি জানি না। নিজেকে আবিষ্কার করেছিলাম একটা হাসপাতালের বিছানায়। দু-চোখ বেয়ে আনন্দের অশ্রু নেমে এসেছিল আমার। জেনেছিলাম আর্খাম শহরের মানসিক হাসপাতালে আমার ঠাঁই হয়েছে। নিজেকে পাগল ভেবে ভেঙে পড়ার থেকে জীবন্ত দেখার আনন্দ অনেক গুন বেশি। হয়তো সত্যিই আমি পাগল হয়ে গেছিলাম। মাঝেমাঝেই ডাক্তাররা আমার খোঁজ নিতে আসতেন। তাদেরকে একই গল্প আমি বলতাম। তাদের শরীরী ভাষায় আমি বুঝতাম তারা বিশ্বাস করছেন না কিছুই তবুও নেহাত কর্তব্যের খাতিরে সেই একঘেঁয়ে গল্পই শুনে যেতেন। একমাত্র একজন কমবয়সি যুবক, হয়তো স্থানীয় কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানের ছাত্র, আমার কথা বেশ মন দিয়ে শুনত। হয়তো তার গবেষণার কাজে লাগতে পারে আমার মতো একটা “সাবজেক্ট”। একদিন ছেলেটির নাম জিজ্ঞাসা করায় সে নাম বলেছিল গিলম্যান, সে নাকি পদার্থবিদ্যার ছাত্র। পদার্থবিদ্যার ছাত্রের কেন যে আমার গল্পের প্রতি এত উৎসাহ আমি বুঝিনি। ছেলেটা আসত প্রায় রোজ। প্রায় লুকিয়েই। বড়ো অদ্ভুত লাগত। বহুদিন তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। কখনো সোজা সহজ উত্তর সে দেয়নি, কখনো প্যাঁচানো অঙ্কের সমস্যা বা পদার্থবিদ্যায় বলা অন্য মাত্রায় ভ্রমণের গল্প বলে আমার কথা এড়িয়ে যেত। একদিন চুপ করে রইলাম। ওর কোনো কথার জবাব দিলাম না। বুঝলাম ছোকরা সেটা টের পেয়েছে। নিজেই বলতে শুরু করল এক আজব কাহিনি। এই জগৎ মানে আজকের আধুনিক জগৎ সৃষ্টির বহু আগে, বিশালাকার সরীসৃপ সৃষ্টিরও বহু আগে এক বিশাল বিস্ফোরণ হয়েছিল এই ছায়াপথে। সৃষ্টি হয়েছিল গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্র। তবে কারা ঘটিয়েছিল সেই বিস্ফোরণ? পদার্থবিদ্যায় সেই ঘটনার কার্য কারণ বর্ণনা থাকলে জীববিদ্যাই নাকি তার বিরোধিতা করে। এই বিস্ফোরণ নাকি হয়েছিল দুই ব্রহ্মাণ্ডের! রাজত্বের দখল নিয়ে। সেই ব্রহ্মাণ্ডের একমাত্র মানুষই নাকি শক্তিশালী জীব নয়। এমন অনেক জীব আছে যাদের কাছে মানুষ নেহাতই ধুলোর মতো তুচ্ছ। সেই সর্বক্ষমতাশালীই এই জগতের প্রভু। পৃথিবীর যে কোনো ধর্মে উল্লেখিত যে কোনো দেবতার থেকেও প্রাচীন সেই দেবতা। তারই রোষে ধ্বংস হয়ে গেছিল সেই বিশালাকার প্রাণী। পৃথিবী শান্ত হওয়া অব্দি সেই প্রাচীন দেবতা আশ্রয় নিয়ে ছিল মহাসাগরেরই বুকে। একসময় মানুষ তার খোঁজ পেল। তাকে খুশি করার জন্য উপাসনা শুরু করল।
ছেলেটি চাপাস্বরে বলে যেত, আমি শুনতাম। আমার চোখের সামনে ভেসে উঠত আমারই দেখা ছবিগুলো। ছেলেটি আবার বলা শুরু করত, তুষারযুগের গল্প। কীভাবে সেই দেবতা নিজের আকার বদলে বরফের চাদরে লুকিয়ে ফেলেছিল। আবার উষ্ণতা ফিরে পেয়ে বদলে ফেলেছিল নিজেকে। ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করায় সে বলেছিল সে নাকি এতদিন এসব পড়েছিল “নেক্রনমিকন” নামক নিষিদ্ধ বইতে। বইটা নাকি শুধুমাত্র বিশেষ কয়েকজন অধ্যাপকের অনুমতিতেই ইস্যু করা হয় লাইব্রেরি থেকে। সে নিজেও ধরা পড়ার ভয়ে পুরোটা পড়ে উঠতে পারেনি। তবুও একমাত্র এই বইটাতেই নাকি প্রমাণ আছে পৃথিবীর সৃষ্টির, তাতেই লেখা আছে ধ্বংসের কারণ। আমার সেসব কথায় বিশ্বাস হত না। আমি শুধু জানতে চেয়েছিলাম সেই প্রাণীর আকার সম্পর্কে। উত্তরে ছোকরা বলেছিল সেই প্রাণীর বিশালতা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। তবে সে এতটাই বিশাল যে তার মধ্যেই গড়ে উঠতে পারে একটা আলাদা প্রাণীজগৎ, বসবাস করতে পারে কয়েক লক্ষ মানুষ, পশু পাখি, তাদের খাদ্যের অভাব হবে না কোনোদিন তবে সেই দেবতার ক্ষুধা একবার প্রকট হলে এক নিমেষে নিঃশেষ হয়ে যাবে সেই প্রাণীকূল। সমস্ত প্রাণীদের রক্তরস শুষে নাকি সেই দেবতা নিজের শরীরে জমিয়ে রাখেন। সেগুলিই নাকি তাকে পরবর্তী মহাপ্রলয়ের জন্য শক্তি প্রদান করবে। বিশ্বাস করুন পাঠক সেই আধ পাগল ছেলেটার কথা আমি অবিশ্বাস করতেই চাইতাম, ভাবতাম আমার অসহায়তার সুযোগ নিয়ে হয়তো আমাকে নিয়ে ঠাট্টাই করছে। তবে পারতাম না। বিশ্বাস করুন পাঠক আমি ওর কথা অবিশ্বাস করতে পারতাম না, কারণ আমার অভিজ্ঞতার একমাত্র ব্যখ্যা আমি এই ছোকরার কথাতেই পেতাম। প্রায় ছয় মাস আমি মানসিক হাসপাতালে ছিলাম। ছেলেটার সঙ্গে শেষের দিকে আর দেখা হত না। পরে শুনেছিলাম ছেলেটারও কিছু মানসিক রোগ দেখা দিয়েছিল। হয়তো অতিরিক্ত পড়াশোনা, গবেষণার চাপে অথবা নেশার প্রভাবেই সেরকমটা হয়েছিল। তবে আমি জানি ওই অদ্ভুত নিষিদ্ধ বই আর আমার অভিজ্ঞতাই ওকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াতো সেই নামহীন, আকারহীন দেবতার উদ্দেশে, হয়ে চাইলেও নিজের পিঠে আশ্রয় দিতে পারে কয়েক লক্ষ প্রাণীকে আর চাইলেই এক লহমায় ধ্বংস করে ফেলতে পারে তাদের।
হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার দিন আমার কিছু জিনিস ফেরত পেয়েছিলাম। তাতে সেই রক্তাভ স্ফটিকের একটা টুকরোও ছিল। জানি না ওটা কীভাবে রয়ে গেছিল আমার কাছে। তবুও ওটা নিয়েই রাস্তায় নেমে এসেছিলাম একটা কাজ আর আশ্রয়ের খোঁজে। অবশেষে একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই জুটেও গেল। এই ঘটনা যেন প্রায় ভুলতেই বসেছিলাম। তবুও শেষ কয়েক মাসের দুঃস্বপ্নে আবার সে ফিরে ফিরে আসছে। কিছুদিন আগেই শুনতে পেলাম গিলমান ছোকরা অদ্ভুতভাবে মারা গেছে। একদল ইঁদুর নাকি ওর দেহটা খুবলে খুবলে খেয়েছে। এই শহরে যে আমার গল্প শোনার মানুষ আর কেউ রইল না।
জানি না এর পরিণতি কী হতে চলেছে।
Tags: অর্ঘ্যজিৎ গুহ, বড় গল্প, সপ্তম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা