2BR02B

  • লেখক: কার্ট ভোনেগাট, অনুবাদ: রাকেশকুমার দাস
  • শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব

জীবনে সমস্যা? হাজার সমস্যার একটাই সমাধান। ফোন তুলুন আর ডায়াল করুন

সব দিক থেকে বিচার করলে সবকিছু একেবারে চমৎকার, কোথাও কোনো খুঁত নেই বললেই চলে। সারা দেশে কোনো দরিদ্র মানুষ নেই, ঝুপড়ি-বস্তি নেই, কানা-খোঁড়া নেই, পাগলাগারদ নেই, জেলখানাও নেই। নেই যুদ্ধের কোনো সুদূর সম্ভাবনাও। রোগ-জরা-ব্যাধি আমরা কবেই জয় করে ফেলেছি। বার্ধক্যের কষ্টও আর আমরা ভোগ করি না। দুর্ঘটনায় মরা ছাড়া স্বাভাবিক মৃত্যু আর দেখা যায় না— এক যদি না আপনি যেচে মৃত্যুবরণ করতে চান! সে অতি-উৎসাহীদের একপ্রকার অ্যাডভেঞ্চার ছাড়া কিছুই নয়। আমাদের দেশ অর্থাৎ আমেরিকার জনসংখ্যা ঠিক চার কোটিতে বেঁধে ফেলা হয়েছে। তার কম নয়, একটু বেশিও নয়।

পরিষ্কার ঝকঝকে দিন, প্রসূতি হাসপাতালে স্ত্রীকে ভর্তি করিয়ে ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করছিলেন এডওয়ার্ড কে. ওয়েলিং জুনিয়র। বয়স মাত্র ছাপ্পান্ন বছর। যেখানে মানুষের গড়-আয়ু একশো উনত্রিশ বছর, সেখানে একে নব্যযুবক ছাড়া আর কি-ই বা বলা যেতে পারে? বা তরুণ তুর্কি? বিশাল ওয়েটিং রুমে তিনি ছাড়া আর কেউ ডেলিভারির জন্য অপেক্ষারত ছিল না। একদিনে একাধিক দম্পতির সন্তান হওয়াটা এখন খুবই বিরল ঘটনা।

এই প্রথমবার বাবা হতে চলেছেন তিনি। এক্স-রে পরীক্ষায় ধরা পড়েছে ট্রিপলেট অর্থাৎ একসঙ্গে তিনটি সন্তান জন্মাতে চলেছে তাদের।

একটা চেয়ারে মাথায় হাত রেখে কুঁজো হয়ে ঠায়ে বসে ছিলেন ওয়েলিং ভদ্রলোক। তাঁকে এতটাই বিবর্ণ আর মলিন লাগছিল যে পাশের রংচটানো দেওয়ালের সঙ্গে একেবারে মিশে গেছেন যেন। ওয়েটিং রুমের অবস্থাও তথৈবচ— দেওয়ালের রং চটানো, জিনিসপত্র এলোমেলো, অগোছালো। কেমন একটা বিষণ্ণতার আভাস চারপাশে। চেয়ার আর অ্যাশট্রে ইত্যাদি দেওয়ালের পাশ থেকে সরিয়ে এক জায়গায় জড়ো করে রাখা রয়েছে। মেঝেতে আর অন্যান্য আসবাবের উপর সাদা কাপড় ফেলে সেগুলোকে ঢেকে রাখা হয়েছে যাতে ধুলো বা রং না লাগে।

আসলে ঘরটিকে নতুন করে সাজানো হচ্ছে। স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করেছে এমন একজনের স্মৃতির উদ্দেশে তৈরি করা হচ্ছে ঘরটিকে।

ঘরের আরেক প্রান্তে আরেকজন মানুষ ছিলেন অবশ্য। প্রায় দুশো বছরের কাছাকাছি বয়সের এক শিল্পী, অ্যালুমিনিয়ামের মইয়ের মাঝামাঝি উচ্চতায় বসে দেওয়ালে আঁকা একটি মিউরালে রং লাগিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর মুখ চোখ দেখে মনে হচ্ছে না যে খুব খুশি মনে এই কাজ তিনি করছেন। আগেকার দিন হলে এই শিল্পী ভদ্রলোকটিকে দিব্যি বছর পঁয়ত্রিশের যুবক বলে চালিয়ে দেওয়া যেত। বার্ধক্যরোধের ওষুধ বেরোনোর আগে অবধি যেটুকু বয়স বাড়ার বেড়েছে, তারপর আর খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি চেহারার।

দেওয়ালের ছবিতে দেখা যাচ্ছে একটি চমৎকার পরিপাটি একটি বাগান, সেখানে সাদা সাদা পোশাক পরা ডাক্তার আর নার্সেরা মাটি খুঁড়ছে, চারা লাগাচ্ছে, কীটনাশক ছড়াচ্ছে, সার দিচ্ছে ইত্যাদি। আর বেগুনি ইউনিফর্ম পরে কিছু পুরুষ ও মহিলা আগাছা কাটছে, শুকিয়ে যাওয়া গাছ ও পাতা কুড়িয়ে পোড়াতে নিয়ে যাচ্ছে একটা চুল্লিতে। মধ্যযুগে হল্যান্ডে বা আগেকার জাপানেও এত সুন্দর গোছান বাগান দেখা যেত কি না সন্দেহ আছে। প্রতিটা গাছ যেন পুরো মাত্রায় মাটি, জল, বায়ু, পুষ্টি ইত্যাদি পেয়ে বড়ো হয়েছে।

“যদি ছেড়ে যেতে বল, আর ভালোবাসছো না,

কি করব তবে আমি বলে দাও সোনা?

এক বেগুনিজামা মেয়ের হাত ধরে,

আমি হারিয়ে যাব এই পৃথিবী ছেড়ে,

কোন শিশুকে দিয়ে যাব শহরের এক কোনা। “

জনপ্রিয় এই গানটা গাইতে গাইতে হাসপাতালের একজন কর্মচারী করিডোর দিয়ে হেঁটে এসে ছবির সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। পোশাকআশাক দেখে আর্দালিগোছের মনে হয়।

“একদম আসল মনে হচ্ছে,” শিল্পীর দিকে তাকিয়ে বলল, “মনে হচ্ছে পুরো বাগানের মধ্যে ঢুকে গেছি।”

শিল্পী ভদ্রলোক কর্মচারীটির দিকে তাকিয়ে বেঁকা হেসে বললেন, “সত্যি সত্যি যে তুমি বাগানের ভেতরে নেই সে ব্যাপারে এত নিশ্চিত হচ্ছ কী করে?”

“হেঁ হেঁ।”

“কি বলে জানত বাগানটাকে? জীবনের আনন্দ-উদ্যান”

“সবই ড. হিৎজের মহিমা” কর্মচারীটি দেওয়ালে আঁকা সাদা পোশাক পরা একজনের দিকে দেখিয়ে বলল।

যার কথা বলা হল তিনি হলেন এই হাসপাতালের প্রধান প্রসূতি-বিশেষজ্ঞ ড. বেঞ্জামিন হিৎজ। একেবারে তাকলাগানো সুদর্শন ও সুপুরুষ ভদ্রলোক।

“অনেকগুলো মুখ তো এখনো বাকি আপনার, শেষ হবে?” কর্মচারীটি বলল।

দেওয়ালে আঁকা অনেকগুলো মানুষের মুখ এখনো আঁকা বাকি। তাদের বাকি দেহটা আঁকা হয়ে গেছে, শুধু মুখটা আঁকা হবে কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী ব্যক্তির মুখের অনুকরণে, সেই ব্যক্তি এই হাসপাতালের কোনো পদাধিকারী হতে পারে বা জাতীয় নিকাশ দপ্তরের শিকাগো অফিসের কোনো হোমরাচোমরা হতে পারে।

“আপনি একেবারে ঠিক যেমন দেখতে তেমন আঁকতে পারেন। প্রতিভা নিয়ে আপনার গর্ব করা সাজে।”

“তোমার কি মনে হয় এই ছবি এঁকে আমি গর্ব অনুভব করি? জীবনের চিত্র হিসেবে এই আঁকা কি আমার নিজের কল্পনা বলে মনে হয় তোমার ছোকরা?” শিল্পী খেঁকিয়ে উঠলেন। মুখটা যেন ঘৃণায় ভরে উঠেছে।

“তাহলে জীবনের চিত্র আসলে কেমন হওয়া উচিত ছিল বলে মনে হয় আপনার?”

শিল্পী মাটিতে বিছানো হিজিবিজি রং লাগা সাদা কাপড়টা দেখিয়ে বললেন, “এই রং লাগা কাপড়টা নিয়ে গিয়ে ফ্রেম করে রাখ হে, দেওয়ালের ছবিটার থেকে অনেক সৎ এটা।”

“আচ্ছা খিটখিটে লোক তো মশায় আপনি।”

“কেন খিটখিটে হওয়া কি আজকাল বেয়াইনি হয়ে গেছে?”

“ভালো না লাগলে নম্বর তো আছেই— এক ফোনেই…” কর্মচারী বাকিটা আর শেষ করল না।

সবাই জানে কোন ফোনের কথা বলতে চাইল। এই পৃথিবীতে যারা আর বেঁচে থাকতে চায় না, তারা এই নম্বরটিতে ফোন করে। খুঁজলে এরকম অনেক দপ্তর পাওয়া যাবে, “অটোম্যাট”, হ্যাপি হুলিগান”, “এখানে পিঞ্জর”, “ক্যাটবক্স”, “শুভযাত্রা”, “জন্নত ইয়াহাঁ”, “কিস-মি-কুইক”, “অমর্ত্যবাহন”, “সুইটি আর কেঁদো না”, “হাকুনামাটাটা”, “অন্তর্জলি”, “টাটা, মামনি” ইত্যাদি স্থানবিশেষে বিভিন্ন নামে এটি পরিচিত।

নম্বরটি হল 2BR02B। নম্বরটি মনে রাখার শুধু একটি লাইন মনে রাখলেই হবে, টু বি অর নট টু বি। জাতীয় নিকাশ দপ্তর পরিচালিত পৌরসভার গ্যাসচেম্বারগুলির নম্বর এটা।

***

চিত্রশিল্পী বললেন, “সে চিন্তা তোমায় করতে হবে না। আমার যাবার সময় হলে আমি নিজেই চলে যেতে পারব, তোমাদের ওই কিস-মি-কুইকে গিয়ে আমাকে নাম লেখাতে হবে না, বুঝলে? “

“ও দাদু আবার আত্মনির্ভর।” কর্মচারী মুচকি হেসে বলতে লাগল, “কিন্তু বড্ড ঝামেলায় ফেলবেন আপনি অন্য লোককে। ভাবুন তো আপনার বডি নিয়ে যাওয়ার জন্য কত কষ্ট করতে হবে অন্য লোককে৷ একটু তো দয়া করুন তাদের।”

“তাতে আমার…” বলে শিল্পী একটি অসামাজিক শব্দবন্ধ উচ্চারণ করে বোঝালেন যে সেই সব লোকের কষ্টে তার কিছুই যায় আসে না।

কর্মচারী হাসতে হাসতে ওখান থেকে চলে গেল। শিল্পী নিজের মনেই বলতে থাকলেন, “একটু আধটু ঝামেলা থাকলেই বোধ করি ভালো হত।”

ওয়েলিং বসে বসে পুরো কথোপকথনটি শুনছিলেন। এসব শুনে হঠাৎ কী যেন অস্ফুট স্বরে বিড়বিড় করে আবার নিস্তব্ধ হয়ে গেলেন।

এমন সময়ে মোটাসোটা শক্তপোক্ত এক মহিলা উঁচু হিলের জুতো পরে গটমট করে ঢুকে পড়লেন ওয়েটিং রুমে। তার জুতো, মোজা, ট্রেঞ্চ কোট, হাতের ব্যাগ আর টুপি— সবই লালচে-বেগুনি রঙের। চিত্রশিল্পীর ভাষায় শেষ বিচারের দিন আঙুরের রং যেমনটি হবে ঠিক তেমনই টুকটুকে বেগুনি এই রং। ব্যাগে আটকানো ইগলের চিহ্ন দেওয়া পদক দেখে বোঝা যায় মহিলা জাতীয় নিকাশ দপ্তরের কোন এক কেউকেটা হবেন।

“এক্সকিউজ মি, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না আমি ঠিক জায়গায় এসেছি কি না।” চিত্রশিল্পীর উদ্দেশ্যে বললেন মহিলা। মহিলার মুখের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল ঠোঁটের উপর স্পষ্ট গোঁফের রেখা। গ্যাসচেম্বারে কাজ করার এই এক বিড়ম্বনা, আপনি যতই সুন্দরী ও নারীত্বের চিহ্নে ভরপুর চেহারা নিয়ে চাকরিতে ঢুকুন না কেন, পাঁচ বছর যেতে না যেতেই আপনার মুখে সুস্পষ্ট গোঁফের রেখা দেখা দেবে।

“সেটা নির্ভর করছে আপনি কি কাজে এসেছেন তার ওপর”, আঁকার দিক থেকে চোখ না সরিয়ে শিল্পী বললেন, “আপনি ডেলিভারির জন্য আসেননি তো?”

“নট অ্যাট অল, আমাকে বলা হয়েছে একটা ছবির জন্য এসে পোজ দিতে।”

শিল্পী এবার ঘুরে ভালো করে তাকালেন মহিলার দিকে।

মহিলা বললেন, “মাই নেম ইজ লিওরা ডানকান”।

“অ্যান্ড ইউ ডাংক পিপল?”

“সরি?”

“লিভ ইট।”

“আই মাস্ট সে, দিস পিকচার ইস ট্রুলি বিউটিফুল। মনে হচ্ছে যেন হেভেন একদম।”

“ডানকান… ডানকান…” বলতে বলতে শিল্পী তার ঢোলা পোশাকের পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে কি যেন খুঁজতে লাগলেন। “…হ্যাঁ এই তো ডানকান! আপনাকেও এই মিউরালে অমরত্ব প্রদান করার পরিকল্পনা করেছে কর্তৃপক্ষ। আপনি বলুন কোন বডিটা আপনার পছন্দ?”

“সরি?”

“দেখুন দেওয়ালে কয়েকটা মানুষের শুধু বডি আঁকা আছে, মুখ বসান নেই। আপনি বলুন কোন বডিটায় আপনার মুখ বসালে আপনি খুশি হবেন। যদিও খুব বেশি আর বাকি নেই।”

“ওয়াও!” উৎফুল্ল হয়ে ছবিটা নিরীক্ষণ করে বললেন, “কিন্তু আমার কাছে সবই সেম লাগছে। আমি আর্টের কিছুই বুঝি না।”

“আরে এতে আর্ট বোঝার কি আছে। বডি তো জাস্ট বডি। যাই হোক, চারুকলার একজন অভিজ্ঞ শিল্পী হিসেবে আমি আপনাকে সাজেস্ট করব, হুমম… এই যে এই বডিটা।” বলে শিল্পী চোখ-মুখ-নাক-হীন একটি অবয়বের দিকে আঙুল দেখালেন যেটি ছবিতে শুকনো ডালপালা হাতে নিয়ে জঞ্জাল পোড়ানোর চুল্লির দিকে নিয়ে যাচ্ছিল।

“ওয়েল,” লিওরা একটু চিন্তা করে বলল, “দেখে মনে হচ্ছে বডিটা ডিসপোজালের কাজ করছে। আমি কিন্তু বডি-টডি সরাই না। আমি মূলত সমস্ত সার্ভিস ঠিকঠাক চলছে কি না সেটা দেখাশোনা করি।”

“অসাধারণ!” বলে একটু মেকি আনন্দ দেখিয়ে হাততালি দিয়ে উঠলেন শিল্পী। “এই যে বললেন আপনি আর্টের কিছুই বোঝেন না! পরের মুহূর্তেই প্রমাণ করে দিলেন আপনি আমার থেকে কোনো অংশে কম বোঝেন না। সত্যিই তো আপনার মতো সেবিকার ছবি পাতাকুড়ানির শরীরে দেওয়াটা অন্যায়। আচ্ছা এই বডিটা দেখুন, এই আপেলগাছের একটা মরা ডাল সেলাই করছে, এটা আপনার পছন্দ? এটা আপনার কাজের সঙ্গে মানাচ্ছে?”

“ওহ মাই গড” লজ্জায় আরক্ত হয়ে উঠল লিওরার মুখ, “একেবারে ড. হিৎজের পাশে যে…”

“আপনার পছন্দ নয়?

“ওমা সে কি!” উল্লসিত দেখাল মহিলাকে, “একেবারে ওঁর পাশে জায়গা পাওয়াটা বিশাল সম্মানের ব্যাপার।”

“ও হরি! আপনি দেখি বিশাল ভক্ত।” বিদ্রুপাত্মক ঢঙে বললেন শিল্পী।

“কে নয় বলুন?” দেখে মনে হল মনে মনে প্রায় পুজো করতে লেগেছে ড. হিৎজের ছবিটাকে।

ঈষৎ তামাটে গায়ের রং আর সাদা চুলের প্রতিকৃতিটা গ্রীকদেবতা জিউসের আদলে আঁকা।

“কে তাঁর ভক্ত নয় বলুন? শিকাগো শহরের প্রথম গ্যাসচেম্বার তো উনিই প্রথম চালু করেছিলেন!”

“তাহলে আপনাকে ড. হিৎজের পাশের স্থানটা দিতে পারলেই আমি সবচেয়ে খুশি হব। এই যে একটি গাছের শুশ্রূষা করা হচ্ছে, একটি অঙ্গকে সেলাই করে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে— এই ছবিটা আপনার কাজকে সঠিকভাবে তুলে ধরতে পারছে কি?”

“একদম,” উচ্ছসিত হয়ে মহিলা বললেন, “আমি এই ধরনের কাজই করতে পছন্দ করি।”

মহিলা হয়তো একটু অতিরিক্ত বিনয়ী ছিলেন। তাঁর মূল কাজ ছিল গ্যাসচেম্বারে মানুষ মারার সময় মৃত্যুর সময়টা একটু সুখকর করে তোলা।

***

লিওরা ডানকান যখন ছবির জন্য পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তখনই ওয়েটিং রুমে ঢুকে পড়লেন স্বয়ং ড. হিৎজ। সাতফুট লম্বা চেহারা, মর্যাদা, সাফল্য আর গর্বের সঙ্গে বেঁচে থাকার আনন্দের আভায় উদ্ভাসিত মুখ তাঁর।

“আরে কি কাণ্ড! মিস ডানকান!” ড. হিৎজ একটু মজা করার সুযোগ ছাড়তে চাইলেন না। “মিস ডানকান, আপনি এখানে কেন? এটা তো আপনার জায়গা নয়! এখানে তো মানুষ পৃথিবীতে আসে, পৃথিবী থেকে বিদায় নেয় না!”

“আপনার সঙ্গে আমিও এই ছবিতে থাকছি!” লাজুকভাবে বললেন লিওরা।

“দারুণ ব্যাপার! আর ছবিটা দেখেছেন? অসাধারণ না?”

“আই অ্যাম অনার্ড স্যার!”

“আর আমিও অনার্ড মিস ডানকান, আপনার মতো নারী না থাকলে আমরা যে চমৎকার পৃথিবীতে বাস করছি সেটা অধরাই থেকে যেত। আপনার সঙ্গে এক ছবিতে থাকতে পেরে আমি সম্মানিত ও গর্বিত।” বলে স্যালুট করলেন ড. হিৎজ এবং হাঁটা লাগালেন ডেলিভারি সেকশনের দিকটায়।

“আজ কি কেস এসেছে জানেন মিস ডানকান?” হঠাৎ দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন ড. হিৎজ।

“না, কি কেস?”

“ট্রিপলেট!”

“কি? তিনটে বাচ্চা?” ট্রিপলেট হওয়ার পরিণাম চিন্তা করে লিওনা হয়তো একটু উত্তেজিত হয়ে উঠলেন।

নিয়ম হল যদি কোনো ব্যাক্তি পাওয়া যায় যিনি স্বেচ্ছায় মরতে ইচ্ছুক, তবেই তার জীবনের বদলে একটি শিশুকে বাঁচতে দেওয়া হবে। তিনটি বাচ্চাকে বাঁচাতে হলে এমন তিনজনকে জোগাড় করতে হবে যারা নিকাশ পর্ষদে যোগাযোগ করে নিজেদের মৃত্যুর স্লট বুকিং করবে।

“বাচ্চাদের ফ্যামিলি কি তিনজনকে জোগাড় করতে পেরেছে?” লিওরা উৎসুক কণ্ঠে জানতে চাইলেন।

“শেষ খবর যা পেয়েছি, একজনকে ওরা জোগাড় করেছেন। বাকি দু-জনকে জোগাড় করার চেষ্টা করা হচ্ছে।”

“মনে হয় না জোগাড় হয়েছে বলে, কারণ একসঙ্গে তিনটের কোনো বুকিং আমি দেখিনি— এক যদি না আমি অফিস থেকে বেরিয়ে আসার পর কেউ ফোন করে থাকে।” লিওনা বললেন। “কী নাম আছে জানেন?”

“ওয়েলিং, ম্যাডাম” আওয়াজটা এল পেছন থেকে বাচ্চার বাবার কাছ থেকে। “এডওয়ার্ড কে. ওয়েলিং জুনিয়র, পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী ব্যক্তি যে বাবা হতে চলেছে আজ…” দেখা গেল ওয়েলিং চোখ বেশ লাল হয়ে রয়েছে, “আপনার সামনে হাজির।” ডান হাত তুলে স্কুলে উপস্থিত বলার ভঙ্গি করলেন ওয়েলিং।

“ওহো মিস্টার ওয়েলিং,” ড. হিৎজ বললেন, “মাফ করবেন আপনাকে দেখতে পাইনি।”

“ইনভিজিবল ম্যান, কি বলেন?” ওয়েলিং হাসার চেষ্টা করলেন।

“কনগ্র‍্যাচুলেশন মিস্টার ওয়েলিং, আপনি তিন সন্তানের বাবা হয়েছেন। এইমাত্র আমাকে ফোন করে জানিয়েছে নার্সরা।” ড. হিৎজ জানালেন। “বাচ্চারা এবং মা— সবাই সুস্থ আছে। আমি তাদেরকেই দেখতে যাচ্ছি।”

“হুররে, দারুণ ব্যাপার।” ওয়েলিং শুষ্ক মুখে আনন্দ আনার চেষ্টা করলেন, কিন্তু পারলেন না।

“কিন্তু আপনাকে দেখে তো বিন্দুমাত্র আনন্দিত বলে মনে হচ্ছে না।”

“আমার পরিস্থিতিতে পড়লে কেউ আনন্দিত না হয়ে থাকতে পারে?” ওয়েলিং হাতের মুদ্রায় নির্ঝঞ্ঝাট পরিস্থিতির ইশারা করে দেখালেন। “এখন শুধু করণীয় হল তিনটি বাচ্চার মধ্যে কোনটিকে বাঁচাতে চাই সেটা বেছে নেওয়া, আমার মায়ের বৃদ্ধ বাবাকে হ্যাপি হুলিগানে রেখে আসা, আর বুকিং এর রসীদ এখানে দেখানো— ব্যাস!”

***

ড. হিৎজের মুখটা কঠিন হয়ে গেল। ওয়েলিং-এর সামনে পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, “তাহলে আপনি জনসংখ্যা-নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থায় আস্থা রাখেন না?”

“আস্থা রাখব না কেন? দারুণ ব্যবস্থা!” দাঁতে দাঁত চেপে বললেন ওয়েলিং।

“আপনি কি সেই ঐতিহাসিক যুগে ফিরে যেতে চান মিস্টার ওয়েলিং, যখন পৃথিবীতে জনসংখ্যা কুড়ি বিলিয়ন থেকে চল্লিশ বিলিয়ন, চল্লিশ থেকে আশি বিলিয়ন কয়েক বছরের মধ্যেই হয়ে যেত? দেখতে না দেখতেই জনসংখ্যা আবার একশো ষাট বিলিয়ন। ড্রুপলেট কি জানেন?”

“ট্রিপলেট জানি। ড্রুপলেট কি জানি না।”

“কালো জামের ভিতরটা দেখেছেন, অসংখ্য ছোটো ছোটো শাঁসালো দানা দিয়ে ভর্তি। এই একেকটি দানাকে ড্রুপলেট বলে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ না করে হলে মানুষ আজ এই বৃদ্ধ গ্রহের বুকে লাখো লাখো ড্রুপলেটের মতো বেঁচে থাকত। ভেবে দেখুন।”

ওয়েলিং দেওয়ালের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল।

ড. হিৎজ বলে চললেন, “দু হাজার সালে যখন বিজ্ঞানীরা এই নিয়ম প্রচলন করতে বাধ্য হয়েছিল তখন জানেন কি পরিস্থিতি ছিল পৃথিবীর? বেশির ভাগ লোকের কাছে খাবার মতো পানীয় জল যথেষ্ট পরিমাণ ছিল না! সমুদ্রের আগাছা খেয়ে কোনোরকমে খিদে মেটাত তারা! অথচ তবুও তারা বলে চলত তাদের অধিকার আছে যত ইচ্ছা সন্তানের জন্ম দেওয়ার আর অনন্তকাল বেঁচে থাকার!”

“তাও আমি আমার তিনটে বাচ্চাই চাই” শান্ত গলায় বললেন ওয়েলিং। “কাউকেই আমি হারাতে চাইনা।”

“খুবই স্বাভাবিক, এটাই তো সব মানুষ চায়।”

“দাদুকেও মরতে দিতে চাই না।”

“কেউই চায় না কোন নিকট আত্মীয়কে ক্যাটবক্সে রেখে আসতে।” ড. হিৎজ বেশ সহানুভূতির সঙ্গে বললেন।

“এখানে আমার একটা আপত্তি আছে,” লিওরা ডানকান হঠাৎ বলে উঠল। “এইভাবে ক্যাটবক্স বলা ঠিক না। মানুষের কাছে ভুল বার্তা পৌঁছায়।”

“ঠিক। আমারই ভুল। মাফ করবেন মিস ডানকান,” ড. হিৎজ বললেন, “আমার বলা উচিৎ ছিল এথিকাল সুইসাইড স্টুডিও। এটাই তো অফিসিয়াল নাম।”

“ইয়েস, নাও ইট সাউন্ডস মাচ বেটার” লিওরা হাসিমুখে সম্মতি জানাল।

“মিস্টার ওয়েলিং, আপনি আপনার বাচ্চাদের মধ্যে যাকেই রাখুন না কেন সে এমন একটা পৃথিবী পাবে যেখানে খাদ্যের কোনো অভাব থাকবে না, থাকার জায়গার অভাব হবে না, রোগব্যাধি থেকে ভয় থাকবে না। স্বাস্থ্যকর, প্রশস্ত, সমৃদ্ধ, আনন্দময় এক পৃথিবী তার জন্য অপেক্ষা করে আছে, একদম এই মিউরালে আঁকা বাগানের মতো। আর এর প্রধান কারিগর হল জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ আইন।”

একটু থেমে ড. হিৎজ আবার বলা শুরু করল, “দুশো বছর আগে, আমি যখন একদম বাচ্চা ছিলাম, তখন অবস্থা এমন ছিল যে আর কুড়ি বছরও মানুষ টিকতে পারবে কি না সন্দেহ ছিল। এখন আমাদের সামনে অনন্তকাল পড়ে রয়েছে সুখ আর সমৃদ্ধি ভোগ করার জন্য।”

ড. হিৎজের কথা শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও উজ্বল একটা চওড়া হাসি মুখে লেগেছিল।

পরক্ষণেই সেই হাসি মিলিয়ে গেল তাঁর। ওয়েলিং হঠাৎই কোথা থেকে একটা বন্দুক বের করেছেন।

কোনো কথা না বলে সোজা মাথা লক্ষ্য করে গুলি চালালেন ওয়েলিং, ড. হিৎজের দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

“একজনের জায়গা রেডি। বিশাল জায়গা পাওয়া যাবে এই একজনের থেকে।” অনুচ্চস্বরে আওড়ালেন ওয়েলিং৷

“ডোন্ট মাইন্ড ম্যাডাম, ইটস অনলি এ ডেথ— নাথিং মাচ” বলে বন্দুক ঘুরিয়ে লিওরা ডানকানকে সোজা গুলি করলেন। “দু-জনের ব্যবস্থা মোটামুটি পাকা।”

তারপর নিজের থুতনিতে বন্দুক লাগিয়ে ট্রিগার টেনে দিলেন।

তিনটে বাচ্চারই বেঁচে থাকতে আর কোনো বাধা রইল না।

বন্দুকের আওয়াজ শুনে কেউই ছুটে এল না। একমাত্র শিল্পী ভদ্রলোক মইয়ের উপর থেকে ফ্যালফ্যাল করে তিনটে মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

***

মানুষের জীবন কি অদ্ভুত! তাকে জন্মাতে হবে, জন্মানোর পর জীবনে সাফল্য পেতে হবে, তাকে বংশবিস্তার করতে হবে, যতদিন সম্ভব তাকে বেঁচে থাকতে হবে— এই সবকিছুই তাকে করতে হবে এই ছোট্ট গ্রহটির মধ্যে, এই গ্রহটিকেও আবার অনন্তকাল টিকে থাকতে হবে। কীভাবে এই দড়িটানাটানির খেলায় ভারসাম্য থাকবে এই চিন্তায় কিছুক্ষণের জন্য হারিয়ে গেলেন শিল্পী। তাঁর কল্পনায় নৃশংস কিছু দৃশ্যের অবতারণা হল। সেগুলো ক্যাটবক্স, হ্যাপি হুলিগান, অমর্ত্যবাহনের থেকেও নির্মম ছিল— যুদ্ধ, মহামারী, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি।

এই ঘটনা প্রত্যক্ষ করার পর আর তাঁর দ্বারা আঁকা সম্ভব নয় ভেবে তিনি হাত থেকে তুলি ফেলে দিলেন। তুলিটা নীচের সাদা কাপড়ে এসে পড়ল আর বেশ খানিকটা রং ছিটকে কাপড়ে পড়ল। তারপর নিজেও ধীরে ধীরে মই থেকে নীচে নেমে এলেন। তাঁর মনে হল পৃথিবীর এই আনন্দের বাগানে যথেষ্ট দিন কাটান হয়েছে, আর নয়।

ওয়েলিং-এর অনড় হাত থেকে পিস্তলটা খুলে নিলেন। নিজের মাথায় ঠেকিয়ে ট্রিগার টিপতে গেলেন।

কিন্তু আঙুল সরল না।

তাঁর চোখ গেল ঘরের কোনায় রাখা টেলিফোনের দিকে। নম্বর তো ভোলার নয়। ডায়াল করলেন: 2… B…R…0…2…B।

“নমস্কার, জাতীয় নিকাশ দপ্তরে ফোন করার জন্য ধন্যবাদ। বলুন কীভাবে আপনার সাহায্য করতে পারি?” এক সুমিষ্ট কণ্ঠ ভেসে এল ফোনের ওপার থেকে।

“আমার এখনই একটা বুকিং চাই, কত তাড়াতাড়ি সেটা সম্ভব বলুন।” খুব ভেবেচিন্তে বললেন শিল্পী।

“বিকেলের আগে তো হবে না স্যার। বিকেল চারটে নাগাদ আপনার স্লট বুক করতে পারি,” সেই সেবিকা জানাল, “তবে কেউ যদি বুকিং ক্যান্সেল করে তাহলে তার আগেও হয়ে যেতে পারে।”

“ঠিক আছে, আমার নাম লিখুন তাহলে।” বলে শিল্পী তার নাম বললেন বানান করে করে।

“ধন্যবাদ স্যার,” সেবিকার আন্তরিক কণ্ঠস্বর শোনা যেতে লাগল ফোনের মধ্য থেকে, “এই শহর আপনার কাছে কৃতজ্ঞ, এই দেশ আপনার কাছে কৃতজ্ঞ, এই পৃথিবী আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। আর আপনার কাছে সবচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞ আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম।”

Tags: অনুবাদ গল্প, কার্ট ভোনেগাট, রাকেশকুমার দাস, সপ্তম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা

Leave a Reply

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!