মনসার চিঠি
লেখক: মহাশ্বেতা
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
ফণী রে,
এমন ঘুম জন্মে ঘুমাইনি। উঠে দেখি ভেজা সাফ, হোয়াইট বোর্ডের থেকেও সাদা। এমন ঘুমও ঘুমোনো যায়! চোখ খুলে দেখি কয়লার মতো কালো লিকলিকে হাত-পা এদিক ওদিক ছড়িয়ে মাদুরের ওপর শুয়ে আছি। মাথার ওপর ঝুলে থাকা সিলিং ফ্যানটা দেখি ইতিমধ্যে মাকড়শা হয়ে গেছে। স্পষ্ট দেখলাম মাঝখানে গোল চাকতিটার গায়ে তিন-চারটে চোখ গজিয়ে গেছে। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। সবে জন্মেছে বলে কথা, রাক্ষুসে মাকড়-ছানার পেটে গনগনে খিদে। লিচুর মতো চোখ দিয়ে তাই তাকিয়ে আছে শিকারের দিকে। মায়া হল। বাচ্চা মানুষ। অন্ধকার ঘরে ঝুলে আছে কীরকম।ওর বাপ-মা আছে কি নেই তারও ঠিকঠিকানা নেই। অনেক শিকারী মাকড়শা ডিম পেড়ে নিজেই বসে থাকে খাবার হয়ে। ছানারা শ”য়ে শ”য়ে বেরিয়ে বেবিফুড ভেবে কতকত করে খেয়ে ফেলে মায়ের পেট, মাথা, ঠ্যাং; শুধু পুষ্টিই নয়, মায়ের শরীর জাগিয়ে তোলে তাদের শিকারী সত্বাও। তারপর বেরিয়ে পরে তারা দলে দলে, নতুন অভিযানে, নতুন শিকারের খোঁজে। আহা, মাকড়শা আমি বড়ো ভালোবাসি! অন্য কোনো প্রাণী ভেবে বের করতে পারবে বলো তো শিশুশিক্ষার এরকম একটা এফিশিয়েন্ট উপায়? পারবে গৌমাতা ছেলেমেয়েদের জন্য স্বেচ্ছায় এরকম একটা স্যাক্রিফাইস করতে? এই দেশের নেতাদের হাত-পা বেঁধে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক দেখানো উচিৎ, বুঝলি? তাহলেই এদের বুদ্ধি খুলবে। দেশের উন্নতি হবে। ঝুলের দোলনা থেকে জুলজুল করে তাকিয়ে থাকে আমার ফ্যান-মাকড়শা, মনে হয় সেও একমত। হাত বাড়িয়ে ঝুলঝাড়ুটা বাগিয়ে নিয়ে আমি অন্ধ করে দিই মালটাকে, চিঁচিঁ করে চীৎকার করে তাতে, কাতরাতে থাকে তার লোহার শরীর। নাঃ বাবা, আইডিয়ালিজম মাড়াতে গিয়ে এই পৈত্রিক প্রাণটা চলে যাবে, একদম ঠিক নয়। রাক্ষুসে মাকড়-ছানার লোহা ও নাড়িভুঁড়ি মিশ্রিত শরীরটা থেঁতলে গেছে এতক্ষণে, ছড়িয়ে পড়েছে ঘরের কোণায় কোণায়। আমার শরীরে অ্যাড্রিনালিনের স্রোত বইছে। অন্ধকারে আমি, আমার ঘরের স্যাঁতসেঁতে নোনা ধরা চার দেওয়াল আর একটা মৃত মাকড়শা; আর পাঁচটা বাঙালির মতো যদি হতাম, লিখে ফেলতাম একটা হাইকু। কিন্তু আমি সেরকম নই, আমি যে কীরকম তা আমি এক দুপুরের ঘুমে ভুলে গেছি।
বিচ্ছিরি গন্ধ বেরোচ্ছে এখন মাকড়শাটার মৃতদেহ থেকে। জানালা খুলতে হবে। ঘষা কাচের ওপর হাতগুলো রাখতেই দাঁড়িয়ে পড়লাম। রক্তমাংসের মানুষের হাত এ-দুটো হতে পারে না, বড়োজোর চারকোলে আঁকা মানুষের হাতের স্কেচ হতে পারে। বা চিত্তপ্রসাদের উডকাটের সাদা-কালো কোনো চেহারা। ভারী মজা হল বুঝলি ভাই ফণী? আমিও বোধহয় ছবির মানুষ। আকাডেমির কোনো বস্তাপচা এগজিবিশান থেকে পালিয়ে এই অন্ধকার ঘরে একটু হাফ ছেঁড়ে বসেছি। কার ভালো লাগে বল তো উৎকট আলোয় দিনের পর দিন ফ্রেম বন্দি হয়ে বসে থাকতে? দুপুরের গরমে তিষ্টোতে না পেরে একটু এয়ারকন্ডিশনিং-এর লোভে হাজির হয় বিভিন্ন রকমের লোফার, বেকার ইত্যাদি নানা জাতের শেডি ব্যক্তি। আর্টের আর কদর রইল না! বাবার কথা শুনলে পারতাম, এতদিনে সিলিকন ভ্যালিতে ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বি এম ডাব্লু চালাতাম, আমার জন্মদাতা আর্টিস্ট কিছু দূরে দাঁড়িয়ে থুতনি ঘষতে ঘষতে ভাবেন। আর আমি ফ্রেমের ভিতরে আর্তনাদ করি। তারপর একদিন রাত্রে, বা সকালেই হয়তো, ফ্রেম থেকে কাঠিকাঠি হাত-পা বের করে হঠাৎ দেখি বাঃ আমি তো এখান থেকে দিব্যি চলে যেতে পারি! তারপর… আর জানি না, কিছু মনে নেই।
ভাবতে ভাবতে জানালা খুলে দিলাম। চোখের সামনে ফ্ল্যাটবাড়ির পিছনের দিকটা, দুটো বন্ধ জানালা, একটা অন্ত্রের মতো পাকানো পাইপ উপর থেকে নীচে নেমে যাচ্ছে। তার শুরু নেই, শেষ নেই, শুধু আছে ধারাবাহিকতা আর নোংরা, ছলাৎ ছলাৎ শব্দ করে প্রাগৈতিহাসিক নালার মত বয়ে চলা অনাদি, অনন্ত, তরল হাউজহোল্ড ওয়েস্ট। বাইরে থেকে এক গাদা চেনা গন্ধের বন্যা চলে এল আমার ঘরের ভিতরে, গলিখুঁজিতে পচতে থাকে নোংরার গন্ধ, রাস্তা থেকে চুপিসারে আসা গাড়ির ধোঁয়ার গন্ধ, ট্যানারি থেকে চামড়া শোকানোর ভয়াবহ চিমসেপানা গন্ধ, ফুটপাথের স্টলে সদ্য ভাজা প্যান ফ্রায়েড মোমোর গন্ধ, পাইপের গায়ে গজিয়ে ওঠা মিউট্যান্ট শ্যাওলার গন্ধ, চোখ সয়ে গেলে দেখি সেগুলো অন্ধকারে মনিমাণিক্যের মত জ্বলছে। মহাকাশের একটা ছেঁড়া টুকরো যেন আটকে রয়েছে ফ্ল্যাটবাড়ির দেওয়ালে। কি অসাধারণ সুন্দর। ভণভণ করে মশা ঢুকে আসছিল খোলা জানালা দিয়ে। কানের কাছে শুনলাম বেশ বৃন্দাবনী সারং বাজিয়ে গেল তাদের একজন। আমার মশাতে আপত্তি নেই, যার রক্তমাংসের শরীর নেই, তাকে মশাও কামড়াবে না।
পাশের ফ্ল্যাট থেকে ভেসে আসছে টিভি সিরিয়ালের আওয়াজ। রম্ভার রাঁধা পায়েসে বিষ মিশিয়ে তার স্বামীকে খুন করার চেষ্টা করছে তাদের পোষা যন্ত্র-ধোপা, সুমন ৩৩১। রম্ভাকে ভালোবেসে ফেলেছে সে। কান পেতে কিছুক্ষণ শুনলাম। এই খবর পেয়ে রম্ভার শ্বশুরের হার্টফেল হবে হবে করছে তখনই টিভিটা বন্ধ করে দিল। ধ্যাত্তেরি, ভালোই লাগছিল গল্পটা, তোরও ভালো লাগত ভাই, চেনা ঠেকত হয়তো। তারপর আমার কান চলে গেল আরেক দিকে। এখানে রান্নার শো হচ্ছে, “স্যালাডের জন্য ফালিফালি করে ড্র্যাগনফ্রুট কেটে রাখুন, এরপর হলুদ, লঙ্কার গুঁড়ো, রেডিয়ো অ্যাকটিভ ব্র্যান্ডের নারকেল তেল, আর নুন দিয়ে ঘাসফড়িংগুলো নাড়িয়ে নিন কড়াইয়ে, এতে আরো ক্রাঞ্চি ক্রাঞ্চি হবে বড়াগুলো…” ঠেলাঠেলি করে আসে ঝগড়ার আওয়াজ, কেউ একজন প্লেট ভাঙছে, কোথাও হার্মোনিয়াম বাজিয়ে কিশোরী গান গাইছে, “মোহে রঙ্গ না ডারো…” ক্রিকেট ম্যাচের কমেন্টারি, রেডিয়োতে ভূতের গল্প, ফোনে বিজনেস ডিল, নিউজে গম্ভীর গলায় বলছে, “রহস্যময় অসুখের কারণ অনুসন্ধানে নতুন ভাইরাসের খোঁজ পেল পেরুর বৈজ্ঞানিক দল। এর সংস্পর্শে এলে মানুষ সালোকসংশ্লেষ করা শুরু করছে। এই কি তবে খাদ্যসংকটের শেষ? কি বলছেন নোবেল লরিয়েট অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়?” টুকরো টুকরো শব্দ জুড়ে একটা বিরাট ছবি তৈরি করছিলাম আমি মনের ভেতর। হঠাৎ মনে হল ভাই যে আমি বোধহয় ছবি নই, আমিই ছবি বানাই, আমি আসলে শিল্পী। মশাগুলোও ফাটিয়ে রক্ত খাচ্ছিল আমার ততক্ষণে। তবে আমার তাতে ভ্রুক্ষেপ নেই। মনে মনে আলোর গতিতে ছবি বানাচ্ছিলাম তখন, ইঁট-কাঠ-কাচের ডালপালা জড়ানো বিরাট বটগাছ এই অনামা শহর, তাতে থোকা থোকা তেজস্ক্রিয় ফলের মতন ঝুলে থাকে ফ্ল্যাটবাড়ির দল, আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকা অনেক, অনেক প্রাণ, ম্যাকবুক মাকড়শা আপেল শ্যাওলা ফ্রিজ বিড়াল ঘড়ি দাদু মানিপ্ল্যান্ট। অন্ধকারে লন্ঠনের মতজ্বলে, দপদপ করে নাড়ির মতো, ধুকধুক করে হৃৎপিণ্ডের মতো। বেঁচে থাকে। কত শব্দ, কত গন্ধ, কত আলো-আঁধারির খেলা। তার জোয়ারে আমার উচ্চিংড়ের মতো শরীর, আমার সব ক-টা ইন্দ্রিয় জেগে উঠছিল। বুঝতে পারছিলাম আমি জন্ম নিচ্ছি, বা আমার ঘিলুর ভিতর নতুন কিছু একটা জন্ম নিচ্ছে, ঠিক ওই ফ্যান মাকড়শাটার মতো।
বলতেই মনে পড়ে গেল। পিছন ফিরে দেখি পালিয়েছে। আসলে অর্ধেক লোহার তো, মারা সহজ নয়। যাক, গেছে গেছে, ভালো হয়েছে। আমারই কাজ কমল। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম একটা। এবার একটা বিড়ি ধরানো যাক। অন্ধকারে হাতরাতে লাগলাম। শালা নিজের নামটা পর্যন্ত মনে নেই, কিন্তু বিড়ির প্যাকেটটা যেন চোখের সামনে ভাসছে। লামার্টিনিয়ার বিড়ি। ছোট্ট প্লাস্টিকের প্যাকেট, উপরে একটা মশালের ছবি। কনভেন্ট স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের ভোকেশনাল অ্যাক্টিভিটি ক্লাসে বানানো বিড়ি। সেগুলোকে তারপর স্কুল কর্তৃপক্ষ অগ্নিমূল্যে রপ্তানি করে বিদেশে। ইউএসএ-তে শুনেছি এই “আর্টিজানাল” বিড়ির বড়ো কদর। যে সে বিড়ি নয়, এগুলোয় তামাকের সঙ্গে কেমিস্ট্রি ল্যাব থেকে নেওয়া বিভিন্ন কেমিক্যাল মেশানো থাকে, তাতে নাকি এমন নেশা হয় যে চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসে, নখ খুলে পড়ে, বনগায় বর্ন অ্যান্ড ব্রট আপ বাবুসোনা চোস্ত আজেরবাইজানি উচ্চারণে রাশিয়ান বলে ফেলে। এরকম বিড়ি অনেক পাওয়া যায় এখন, কার্মেল, লোরেটো, ডনবস্কোর মত হরেক ব্র্যান্ড। কিন্তু এল.এম. বিড়ি জিন্দাবাদ! ভাই ফণী, বড়ো কষ্ট করে জুটিয়েছিলাম, এ জিনিস সহজে পাওয়া যায় না। কোথায় গেল! স্কুল ছুটির পর বাচ্চাকে খুঁজে না পেলে গার্জেন যেমন হন্যে হয়ে ঘোরে, আমিও তেমনি অন্ধকার ঘরে ঘুরপাক খাচ্ছিলাম। হঠাৎ কীসে একটা হাত পড়ল, ঠান্ডা মসৃণ শক্ত একটা জিনিস, ছুঁতেই আলো জ্বলে উঠল তাতে। একে আমি চিনি। আমার ল্যাপটপ। হঠাৎ কয়েকটা খবরের হেডলাইন মনে পড়ে গেল, একটা প্যান্ডেমিক। না, অনেকগুলো হয়েছিল, ঘরের মধ্যে বন্দি সবাই, রাস্তায় শুধু পুলিশ আর কুকুর। একসঙ্গে থাকতে থাকতে তারাও মিউটেট করে করে ভয়াল রূপ নিয়েছিল কয়েকবছরের মধ্যেই, আনন্দবাজারে তাদের নাম দেওয়া হয়েছিল “কুলিস” কিন্তু বর্তমান বলত, “পুকুর”। কিন্তু দুই প্রতিষ্ঠানই একটা বিষয়ে সহমত হয়েছিল যে এটি বড়ো ফেরোশাস প্রজাতির একটি মিউট্যান্ট, মানুষ দেখলেই সাবাড় করে ফেলবে। তা ছাড়া বাতাসে ভেসে বেরাচ্ছে জুনটিক ভাইরাসের এক মারণ ককটেল। শহর যেন জঙ্গল হয়ে গেছিল, জঙ্গলের নিয়মই চলত তখন রাস্তায়। রাত্রিবেলা তাদের অপার্থিব চীৎকার শুনতাম আমি এই ঘরে বসে, ল্যাপটপে কাজ করতাম। কী কাজ আমার মনে পড়ে না। কিন্তু মনে আছে দিনের পর দিন কাজ করতাম। ওয়ার্ক ফ্রম হোম, ফণী, এ কাজের শেষ নেই, দিনরাত, শীতবসন্ত, ভূত ভবিষ্যত সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। সময়ের আর কোনো মানে থাকে না। এসব তুই জানিস, তুই সবই দেখেছিস। আমার থেকে ভালোই হয়তো জানিস। সব চলে যায়, কিন্তু যন্ত্র থাকে। আরেকটাও বোধহয় ছিল…কিন্তু আমার মনে পড়ছে না এখন। ল্যাপটপে ভর্তি প্রচুর পাইরেটেড সিনেমা আর ভিআর গেম, এই পুরোনো মডেলে কীভাবে চালাতাম কে জানে? একটু খোঁজাখুঁজি করে সিভিটা পেলাম। মনে হল এইবার আমি কে, কী করতাম এই সব রহস্যের সমাধান করতে পারব। কিন্তু খুলতে গিয়ে দেখি ও হরি, ফাইল করাপ্টেড, চোখের সামনে ছবি, বুলেটপয়েন্ট সহ পুরো বায়োডেটা উড়ে গেল। নতুন করে স্মৃতিভ্রষ্ট হওয়ার আগে শুধু এতটুকুই দেখতে পেলাম, যে আমার নাম মনসা, আর আমার বেশ লম্বা, কালো চুল ছিল একসময়। তাতে বিনুনি হত। এখন অবশ্য আমার ঘাসের মতো খোঁচা খোঁচা চুল মাথায়, হাত বোলালেই বোঝা যায়। আমার মুখটাও দেখতে পেলাম না। এই হয়, ল্যাপটপ ভর্তি পিলপিল করছে ম্যালওয়্যার ও ভাইরাস। কাজের জিনিস থাকবে কী করে? সব চলে যায়, ফণী, সব চলে যায়।
বিরক্ত হয়ে উঠে গেলাম। ঘরের কোনে আতুশি বিড়ালের মতো গড়গড় করছিল সেকেলে ফ্রিজ। খুলে দেখলাম লাল নীল সবুজ হলুদ, রামধনুর রঙের ছাতা পড়ে গেছে ফ্রিজ জুড়ে। খাবার বলতে শুধু একটা পচা কলা আর এক বাটি অজানা কোনো তরকারি। তার ভিতরে মনে হল দানা দানা চোখ উঠেছে বেশ কয়েকটা। একটু হলেই তাকাবে আমার দিকে। ধড়াম করে ফ্রিজ বন্ধ করে দিলাম। নিজের ওপর রাগ হচ্ছিল। মাকড়সা-ফ্যান, ভাইরাস ভর্তি ল্যাপটপ, ফাঁকা ফ্রিজ, বিড়ির নাম গন্ধ নেই। কী ধরনের খেলো একটা জীবন কাটাচ্ছি আমি। এমন কি স্মৃতিটুকুও রহস্যময় ভাবে হারিয়ে ফেললাম ঘুমোতে গিয়ে। এভাবে থাকা যায় না। এমন সময় হঠাৎ একটা শব্দ কানে এল। মৃদু খড়খড় একটা শব্দ। কিছু একটা আসছে। আচ্ছা, মাকড়শাটা পালিয়ে কোথায় গেল? ঝুলঝাড়ু হাতে বাথরুমে গেলাম। এখানে লুকিয়ে থাকলে পুরোপুরি মেরে ফেলব ব্যাটাকে। বাথরুমের আলো জ্বালাতেই চোখ ধাঁধিয়ে গেল। একটানা অন্ধকারে ছিলাম তো। হাত দিয়ে চোখ চাপা দিয়ে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। এদিকে খড়খড় শব্দটা আস্তে আস্তে বাড়ছে। অস্বস্তি হচ্ছিল এবার আমার। একেই চোখে দেখতে পারছিলাম না, তার ওপরে ভয়। চোখ সয়ে আসতে সময় লাগল। গোলাপি বাথরুম, অনেকদিন পরিষ্কার হয়নি বোঝা যাচ্ছিল। প্রত্যেকটা কলে জং, মেঝের কোনে স্যাঁতলা, ছাদে ঝুল, জানালার কাচটা ভাঙা। তাতে বোধহয় একসময় একটা খবরের কাগজ লাগানো ছিল, কিন্তু সেটাও ছিঁড়েখুড়ে দিয়েছে কে যেন। বুঝতে পারলাম মাকড়শাটা ওইখান দিয়েই পালিয়েছে। তার কাছেই কমোড, ঢাকনা খুলে দেখি উজ্জ্বল সবুজ রঙের কি একটা যেন। বগবগ করছে, তার থেকে ধোঁয়াও উঠছে। দড়াম করে বন্ধ করে দিলাম। কাজ নেই বাবা এই বাথরুমে গিয়ে। একটু একটু বুঝতে পারছিলাম মাকড়শার ব্যাপারটা এবার। এই বাড়িতে আসলে সবকিছুই জ্যান্ত, মানে কোনো কারণে অতি সহজে এখানে সব কিছুর মধ্যে প্রাণ সঞ্চার হয়ে যাচ্ছে। ফ্রিজে তরকারি থেকে আরম্ভ করে কমোড পর্যন্ত। উষ্ণায়ণেরই ফল বোধহয়।খুব সহজেই প্রাণসঞ্চার হয়ে যাচ্ছে সবেতে, জীবন্ত, মৃত, যন্ত্র ও উদ্ভিদ হরবখত মিলেমিশে যাচ্ছে এই বিষাক্ত পরিবেশে। নতুন প্রাণ তৈরি হচ্ছে চোখের সামনে। এইজন্যই সপ্তাহে একদিন বাড়ি স্টেরিলাইজ করতে নির্দেশ দেয় সরকার থেকে। অটোর মাথায় লাউডস্পিকার লাগিয়ে মাঝে মাঝে ঘোষণা করতে করতে যায় মেন রাস্তা দিয়ে হঠাৎ মনে পড়ল, কিন্তু আমি তো পাত্তা দিই না। আর দীর্ঘদিন পরিষ্কার না করে করে আমার বাড়িটাই হয়ে গেছে এই নতুন জীবেদের আড়ত। কবে দেখব দেওয়ালের সত্যি সত্যি কান গজিয়েছে।
খড়খড় শব্দটাও যেন এগিয়ে আসছিল ধীরে ধীরে, কী ওটা? তখনই হঠাৎ একটা কথা মনে হল। আমার সিলিং ফ্যান মাকড়শা হয়ে গেছে আজ দুপুরবেলা। গরমের দেশ, এখানে তো প্রত্যেক বাড়িতে সিলিং ফ্যান, আর আমার মত অনেকেই ল্যাদ খেয়ে যায় লকডাউনের মধ্যে, তার ওপর ওই “অল লাইভস ম্যাটার” দলগুলোও তো আছে, যারা নিছক নৈতিক কারণে বাড়ি স্টেরিলাইজ করে না (অনেক সময় শোনা যায় তাদের গোটা বাড়িটাই জীবিত হয়ে গেছে কোনো এক রাত্রে ও ঘুমের মধ্যেই হজম হয়ে গেছে তারা)। তাহলে কি… না পালাতে হবে। কিন্তু হঠাৎ বুকের ভেতর একটা মোচড় দিয়ে উঠল। কী করে যাব? কিছু একটা ফেলে যাচ্ছি, খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা জিনিস, কিন্তু কিছুতেই মনে পড়ছে না। এদিকে খড়খড় শব্দটাও ক্রমশ এগিয়ে আসছে। সময় নেই, ফণী, সময় নেই। নেওয়ার মতও কিছু নেই, শুধু ল্যাপটপ। দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়ালাম। এইবার আওয়াজটা আরো স্পষ্টভাবে শুনতে পাচ্ছিলাম, হাজার খানেক লম্বা লম্বা পা-এর শব্দ। বুঝতে পারলাম মাকড়-ছানা পালিয়ে গিয়ে কোথায় গেছিল। এখন অগুন্তি বন্ধু-বান্ধব নিয়ে সে ফিরে আসছে, আমাকে দিয়ে মুখেভাত হবে তার আজ। কোথায় যাব? সিড়ির ধার ধরে নীচে উঁকি মেরে দেখলাম অতল অন্ধকার। সাহস হল না। মনে পড়ল আমার এই কাকতাড়ুয়ার মতো এক ঠেঙে ফ্ল্যাটবাড়িটার সবচেয়ে ছোটো, সবচেয়ে গরম ঘরটা আমার, কারণ সেটা ছাদের ঠিক নীচে, দৌঁড়ে উঠে গেলাম সিঁড়ি বেয়ে।
ছাদের দরজা কোন কালে ভেঙে গেছে। বেরিয়ে দেখি আকাশে লালচে আলোকিত মেঘ ভেসে যাচ্ছে, যেন তিমি মাছ। ব্যাঙের ছাতার মতো ডিশ অ্যান্টেনা গজিয়ে উঠেছে চারিদিকে ছাদ জুড়ে, যেন এক জাদুকরের জং ধরা বাগান। ইঁটের পাঁজরা দেখানো কঙ্কালবাড়ি, গায়ে অন্ধকারের আলখাল্লা, তাতে মাঝে মধ্যে লাল, কমলা, হলুদ আলোর তাপ্পি। দেখে ভাই চোখ জুড়িয়ে গেল, ফণী। বুঝতে পারছিলাম সময় নেই, শত্রু এগিয়ে আসছে, কিন্তু দাঁড়িয়ে পড়লাম। আমি বোধহয় আদতে একজন দার্শনিক। একবার ভাবনার বিষয় পেয়ে গেলে আর অন্য কোনো খেয়াল থাকে না। আচ্ছা, মাকড়শাটা তো কোনো অন্যায় করেনি। আমার গরম ফ্ল্যাটের ওমে জন্মে ফেলেছে সে। এবার তাকে বাঁচতে হবে, তাই শিকারও করতে হবে। আমিই বরং ভয় পেয়ে গিয়ে তার সঙ্গে খুব হিংস্র আচরণ করেছি, পিটিয়ে মেরে ফেলার চেষ্টা করেছি। তাহলে? ফ্ল্যাটে ফিরে গিয়ে বসে থাকব? ওরা এলে নাহয় ধরা দিয়ে দেব, আমার দোষের উচিৎ শাস্তি হবে। এইটাই সুবিচার, তাই না? দাঁতের বদলে দাঁত। কিন্তু আমার মনের মধ্যে দ্বিতীয় একটা কণ্ঠস্বর যেন বলে উঠল, “মিথ্যে কথা বলে নিজেকে কলা দেখাচ্ছ, মনসা, আসল কারণটা ভাব। মনে কর।” চোখের সামনে একটা চেহারা ভেসে উঠল, ছোট্ট তামার মুখ, সবজেটে চোখের তারা, বুকের ওপর একটা ঢাকনা খুললে ন্যাভিগেশন প্যানেল। বিদ্যুতের একটা ঝিলিকের মতো স্মৃতিগুলো ফিরে এল একসঙ্গে। হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমার শৈশবের সাথী, ছোটোবেলা থেকে একের পর এক লকডাউনের একাকিত্বে পাগল হয়ে যাওয়ার হাত থেকে যে আমায় বারংবার বাঁচিয়েছে, আমার বন্ধু, আমার ডায়েরি, আমার পোষ্য, তামার ছোট্ট যন্ত্র, হাসতে পারে, কাঁদতে পারে, গল্প বলতে পারে, অঙ্ক কষতে পারে, আমার সঙ্গে গেম খেলতে পারে, নক্ষত্রপুঞ্জের বিভিন্ন ছবি দেওয়ালে প্রোজেক্ট করে দেখাতে পারে। এখন বুঝতে পারছি অভিমানও করতে পারে। একদম প্রথম দিককার আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, আমার সাত বছর বয়েস থেকে আমার সঙ্গে আছে। গত বেশ কয়েক বছর ভুলেই গেছিলাম তাকে, আরো কত নতুন যন্ত্র এসে গেছিল বাজারে, তারা আরো কত কিছু করতে পারত। তা ছাড়া বড়োও হয়ে গেছিলাম। তার সঙ্গে খেলার সময় ছিল না আমার। কাজ, অন্যান্য বহু ব্যস্ততা চলে এসেছিল জীবনে। সেও অভিমান করে আমার জীবন্ত ফ্ল্যাটের কোন একটা ফাঁক দিয়ে গলে কোথায় হারিয়ে গেল। তখনই টনক নড়ল আমার। মাসের পর মাস তন্নতন্ন করে খুঁজেও তাকে বের করতে পারিনি। এখনো বোধহয় এই বিপজ্জনক বাড়িটা ছেড়ে যেতে পারিনি এই আশায় যে রাগ কমে গেলে সে একদিন ফিরে আসবে। তাকে ছেঁড়ে কীভাবে পালাব, সে আমার… আর ওফ! কী অসহ্য এই খড় খড় আওয়াজ, এখন কানের কাছে গুমগুম করছে। তাকিয়ে দেখলাম চারপাশটা কীরকম পালটে গেছে। দিগন্ত বিস্তৃত একটা সাদা রেখা, ক্রমশ এগিয়ে আসছে আমার বাড়ির দিকে। একটু ঠাহর করতে বুঝতে পারলাম ওগুলো আসলে লাখ লাখ ফ্যান-মাকড়শা, তিরবেগে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। তাদের একজনকে আমি জখম করেছি, এবার তারা প্রতিশোধ নেবে। এতদিন কোথায় ছিল, হঠাৎ কেনই বা একসঙ্গে আক্রমণ করতে এল, এসব প্রশ্ন করার সময় আমার আর ছিল না। দরকার হলে ছাদ থেকে অন্য ছাদে লাফিয়ে লাফিয়ে কেটে পড়তে হবে। কিন্তু শেষে গিয়ে তো সেই মাকড়শা-সুনামির গায়েই ধাক্কা খাব। ছাদের ঘরের লোকগুলোও বা কোথায়? অন্য সময় এলেই তো ছায়া ছায়া সাদা কাপড় গায়ে কত মানুষজন দেখতে পাই। অবশ্য সেটা হয়তো এল.এম. বিড়ির প্রভাব। আদতে ছাদে কেউ থাকে না। নাঃ এবার এ বাড়ি ছাড়তেই হচ্ছে।
এতশত ভাবছি আর ঠকঠক করে কাঁপছি, এমন সময় হঠাৎ কী মনে হল, উপর দিকে তাকালাম। দেখি আকাশটা পুকুর হয়ে গেছে। প্রথমে মনে হল নেশার ঘোরে যা তা কল্পনা করছি, কিন্তু না, সত্যিই তো, বেশ তিরতিরে ঢেউ উঠছে, পানাও পড়েছে কয়েকটা জায়গায়, যেন ধানের ক্ষেতে রৌদ্র ছায়ায় লুকোচুরি খেলা রে ভাই লুকোচুরি খেলা। আসলে চারিদিকে এত উঁচু উঁচু বাড়ি, সহজে আকাশ দেখা যায় না। সুতরাং গত কয়েক মাসে যদি আকাশ মিউটেট করে পুকুরও হয়ে গিয়ে থাকে তাহলে আমার না জানাটাই স্বাভাবিক। মিডিয়াও গত কয়েকমাস সুপারস্টার রায়ান রিভানের পোষা টিয়া পাখির পুনর্জন্ম নিয়ে ব্যস্ত ছিল, অতএব এসব নিয়ে চর্চা করার সময় বা ইচ্ছা কারুরই ছিল না। এর মধ্যেই আকাশটা জল হয়ে গেছে। দিব্যি দেখলাম সাদা সাদা মেঘগুলোর চোখ ফুটেছে, পিঠ থেকে জলের ফোয়ারা বেরোচ্ছে। দারুণ তো! আরো কত মাছ, সি-হর্স, জেলিফিশ, প্রবাল, একই সঙ্গে এরোপ্লেন, হট এয়ার বেলুন, সাবমেরিন, কৃত্রিম, প্রাকৃতিক ও অতিপ্রাকৃতিক উপগ্রহ, ইউএফও, ও ফানুস, আকাশ আর জল সব মিলেমিশে গেছে যেন, রাতের অন্ধকার ফুটো করে ঠিকরে আসছে মহাজাগতিক আলো! মুগ্ধ হয়ে সেইদিকেই তাকিয়ে আছি এমন সময় দেখতে পেলাম ডিঙিনৌকো বেয়ে সাঁইসাঁই করে কে একটা আকাশ বেয়ে এগিয়ে আসছে। জেলিফিশের আলোয় দেখতে পেলাম আমার হারিয়ে যাওয়া বন্ধু, ফণী ২০১৮, ফার্স্ট জেনারেশন। আমার বিপদ টের পেয়ে ঠিক চলে এসেছে নৌকো বাইতে বাইতে (এটাও ঠিক, ফণীর ইন্সট্রাকশন ম্যানুয়ালে লেখা ছিল বটে যে ছোটোখাটো রান্না, বাগানের কাজ ইত্যাদি বাদেও ফণীর এই মডেলটি নৌকো বানাতে ও বাইতে পারদর্শী। তখন নিছকই অর্থহীন মনে হয়েছিল তার এই অদ্ভুত ফিচারখানা। কিন্তু ভাগ্যিস!) কোনো কথা না বলে ডিঙিটা আমার মাথার ঠিক ওপর দাঁড় করিয়ে একটা ছিপ ফেলে দিল, আমি শক্ত করে পাকড়ে ধরলাম, আমায় টেনে নিয়ে তুলে নিল ডিঙির ওপর। তারপর কোনো কথা না বলে হাতে একখানা দাঁড় ধরিয়ে দিল। নীচে দেখি ততক্ষণে সাদা লোহার মাকড়শায় শহর ঢেকে গেছে, যেন ইঁট-কাঠ-পাথরের একটা বিশাল ঢিপি গায়ে সাদা, লোমশ ও ধাতব একটা চাদর পরেছে। একযোগে কোটি কোটি চোখ তখন আমার ভাসমান ডিঙির দিকে জুলজুল করছে। উফফ সে এক দৃশ্য বটে, ভাবলেই গা হিম হয়ে যায়! কিন্তু ততক্ষণে আমরা অনেক উঁচুতে উঠে গেছি, ওদের নাগালের বাইরে।
এখন আমরা চলেছি কোনো এক দিকে, মাকড়শা-বিহীন কোনো আকাশ-দ্বীপের খোঁজে। নেহাত লেখা শুরু করে শেষ না করলে খুব খচখচ করে, তাই চিঠিটা এখনো লিখছি। ফণী ফেরত চলে এসেছে, আমার স্মৃতিও সব ফিরে আসছে ধীরে ধীরে। এল.এম. ওভার্ডোজ বড়ো সাংঘাতিক জিনিস, এখনো কিছু সময় লাগবে। কিছু দিনের মধ্যে হয়তো ফ্যান-মাকড়শার দলও আকাশ-জলে সাঁতরাতে শিখে যাবে, কিন্তু সেই চিন্তা এখন করব না, এখন ফণীর অ্যাডভেঞ্চারের গল্প শুনব। সুতরাং এখানেই চিঠি শেষ করি।
ইতি
মনসা
Tags: গল্প, মহাশ্বেতা, সপ্তম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা