আদিম
লেখক: সংযুক্তা চ্যাটার্জী
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
সভা
সামনে বিস্তীর্ণ জলাভূমি। দূষণহীন বাতাস পেরিয়ে তীক্ষ্ণ সূর্যের আলো উত্তাপ ছড়াচ্ছে মনের আনন্দে। যত দূর চোখ যায় চিকচিক করছে জলাভূমি। জলাভূমির মাঝখানে আছে এক সুবিশাল গভীর সরোবর। ওই সরোবরে দেবী পেরপিউরুনা, দুটি শুঁড়ের মাথার ওপরের বসানো চোখ দুটো বন্ধ করে বিশ্রাম নিচ্ছেন। কে জানে কত সময় ধরে। এখানকার জল ও জমি দুই লালচে কালো; কারণ অতিরিক্ত ৎশৃঙ্র (রান্না করা খাবার খাওয়া জিভ এ শব্দ উচ্চারণ করতে পারবে না ) জমা হয়েছে। মাঝে মাঝে লম্বা ঘাসের জমি কচ্ছপের পিঠের মতো উঁচু হয়ে আছে। মানচিত্রে জায়গাটা উত্তর গোলার্ধের নীচের দিকে। কাছেই একশো ঘর হান্টার-গ্যাদারার টিলামুদের বাস। বর্তমানে তারা কুয়োর ব্যাঙের মতো সামনের জলাভূমি, মাঝখানে নিজেদের গ্রাম আর পিছনে সুবিশাল তৃণভূমির মধ্যে সুখে শান্তিতে বসবাস করছে। নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে, হান্টার-গ্যাদারার খায় শিকার করে বা জঙ্গল থেকে ফল-পাকুর কুড়িয়ে। এক জায়গায় খাবার ফুরিয়ে গেলে বউ-বাচ্চা বগলদাবা করে অন্য জঙ্গলে হাঁটা দেওয়া এদের নিয়ম। অথচ বিশাল তৃণভূমির উর্বরতা টিলামুদের চাঁটি-বাটি গুটিয়ে ঘুরে বেড়াবার প্রবণতাকে ভুলিয়ে দিয়েছে। এখন যা দেখা যাচ্ছে, এই সুখ শান্তি আর বেশিদিন নয়। হয়েছে কি, গত তিন বছর ধরে দেবী পেরপিউরুনা বড্ডো রেগে আছেন। একফোঁটা জল আসছে না আকাশ থেকে। মেঘের দেবতা দোদোলারও দেখা মিলছে না। তৃণভূমির ফুটিফাটা মাটি থেকে পাক দিয়ে উঠে আসছে গরম বাতাস। শুকনো ঘাসের কুণ্ডলী ভূতুড়ে গোলার মতো দৌড়ে বেড়াচ্ছে এদিক ওদিক। গাই বখরিদের খাবারে টান পড়ছে।
গ্রামের খাবার জলের একমাত্র জোগান ওই জলাভূমি। সেটাও শুকিয়ে আসছে অর্থাৎ দেবী নিজের ঘর পালটাবেন। গ্রাম ছেড়ে চলে যাবেন অন্য কোথাও। তখন কি হবে টিলামুদের? ওরা জল কোথায় পাবে? আর কোথায়ই বা পাবে ৎশৃঙ্র? জলীয় মাটি ছেকে জল তুলে নেওয়ার পরই তো ওরা কাঁচা ৎশৃঙ্র পায়। সিমিগা আগা ওই দিয়ে অনেক কিছু তৈরি করে। সেসব জিনিসে টিলামুদের রোজকার জীবনে ভারী সুবিধা হয়। তৃণভূমি পেরিয়ে সিসিল (ভাল্লুক) বা ইতনা (চিতা) গ্রামে চলে আসে। তাদের সঙ্গে প্রায়ই মারপিট লেগে থাকে। টিলামুদের ওদের মতো দাঁত বা নখ নেই। এই নিয়ে ওদের মনে ভারী দুঃখ। ওদের অস্ত্রগুলো বেশিদিন টেঁকে না। ভেঙে যায় সহজেই। আজ গ্রামের মাঠের মণ্ডপে সভা বসেছে। গ্রাম প্রধান গিলিমান্দা আর পেরপিউরুনার পুরোহিত ইউড়ান হলেন গ্রামের মাতব্বর। তারা আজ ঠিক করবেন ভবিষ্যতে কি করা হবে।
টিলামু গ্রামের মাঝখানে বিশাল নিলুনা বৃক্ষ। জলাভাবে সব পাতা ঝরে এখন ডালপালা সমেত একটা কঙ্কাল। তার নীচে ছোটো চারপায়াতে গিলিমান্দা বসে আছেন। মাথার ওপর থেকে একটা সিসিলের মুণ্ডু কপাল ঢেকে রেখেছে। বাকি ছাল পিঠের উপর ছড়িয়ে আছে। তাকে অতিকায় ভাল্লুকের মতোই দেখতে লাগছে। যৌবনে খালি হাতে সিসিলটাকে মেরে গ্রামপ্রধানের জায়গা দখল করেছিলেন। সারা শরীরে অসংখ্য যুদ্ধের ক্ষত। সেসব বহুদিনের কথা। আজ সাহস থাকলেও শক্তি নেই।
পুরোহিত ইউড়ান মোষের শিং বাজালেন। সভা শুরু হল। গ্রামের যারা এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল, তারা জড়ো হল গাছতলায়। ইউড়ান তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। বড়ো তীব্র সে দৃষ্টি। অন্তর ভেদ করে বুকের ভিতর অবধি দেখতে পাচ্ছেন। সকলে মাথা নামিয়ে নিল। টিলামু-রা জানে, তারা বৃদ্ধ পুরোহিতের কথা শুনছে না। তাঁর কথা অমান্য করেছে। হয়তো শাস্তি পেতে হবে। সকলে ভয়ে জড়োসড়ো। ইউড়ান মেপে নিচ্ছে গোটা সভা। কেউ থেবড়ে বসে আছে। কেউ দু-পায়ে ভর দিয়ে উবু হয়ে বসে আছে। মেয়েদের অনেকের পিঠে বাচ্চা ঝুলে আছে, মায়ের বুক খামচে ধরে। পোশাক আশাকের বালাই নেই, তবে স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের কোমর থেকে ঘাসের দড়ির ঘাগড়া ঝুলছে। লজ্জা নিবারণের জন্য নয়। এ হল দলের চিহ্ন। শুধু দলপতি গিলিমান্দার ওসব বালাই নেই। তার বিশাল পুরুষাঙ্গ সিসিলের চামড়ায় ঢাকা পড়েনি। অবশ্য পুরোহিত ইউড়ানের পোশাকে অন্য বিশেষত্ব। দেবী পেরপিউরুনা-র মৃত সঙ্গীসাথীদের খোলস দিয়ে বানানো তাঁর কোমরবন্ধন।
“তাহলে তোমরা এই জায়গা ছেড়ে যেতে চাইছ না?” ব্যঙ্গের স্বরে বললেন ইউড়ান।
“টিলামু জাতির নিয়ম সবাই জানো আশা করি। তাও আমি একবার মনে করিয়ে দিচ্ছি। জলাভূমির মাঝখানে যে গভীর জলাশয় আছে, সেখানে দেবী পেরপিউরুনা ঘুমোচ্ছেন। দোদোলা-দেব যখন মাটিতে জল পাঠাতে ভুলে যান, তখন দেবীর পিঠ জলের উপর উঠে আসে। পিঠ দেখা গেলেই, সেই জায়গা থেকে অনেক দূরে চলে যেতে হয়। জল আরো কমে গেলে দেবী পেরপিউরুনা জল ছেড়ে ডাঙায় উঠে আসেন। আর তখনই হয় সর্বনাশ। ঘুম ভাঙার পর খিদে পায় দেবীর। ভয়ঙ্কর খিদে। তখন অনেক অনেক বলি লাগে দেবীর পেট ভরাতে।”
“আপনি কী করে জানলেন এত কথা?” সামনের ভিড় থেকে শোনা গেল একটি নারীকণ্ঠ। পুরোহিত নিজের মনে কথা বলে যাচ্ছিলেন। সচকিত হয়ে ঠিক ঠাওর করতে পারলেন না, প্রশ্নটা কে করল।
“কে?” ভীষণ বিরক্ত হলেন। তাঁর মুখের ওপর কথা বলার মতো সাহস হল কোন মেয়ের? হাতের সাপের মতো বেঁকানো লাঠিটা মাটিতে ঢুকলেন কয়েকবার। শুকনো মাটির ঢেলা ভেঙে ধুলো উড়ল। ওই লাঠি সাধারণ নয়। উনি ছাড়া অন্য কেউ ওটা স্পর্শ করলে, তার মরণ অবশ্যম্ভাবী। সামনের লোকগুলো আরো গুটিয়ে গেল। কিন্তু বিদ্রোহী কণ্ঠস্বরের মালিককে ছিনিয়ে দিল না কেউ। ওহ, আমাকে তাহলে এবার এদের সামনে প্রমাণ দিতে হবে? আমাকে? ঈশ্বরের সন্তানকে এই পোকামাকড়ের দলের সামনে প্রমাণ দিতে হবে? ভাবতে ভাবতে কোমর বাঁধন থেকে একটা খোলস ছাড়িয়ে নিলেন। মুখে লাগিয়ে সুরুৎ টেনে নিলেন ভিতরের মাল। মাটিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসা টিলামুরা কেঁপে উঠল। গিলিমান্দা বসে বসে ঢুলছিলেন। এবার ছোটোখাটো পাহাড়ের মতো নড়ে চড়ে বসে বললেন, “এই বাচ্চারা! যাবি না তো, খাবি কি?” বলে আবার চোখ বুজে ঢুলতে লাগলেন। বিরক্ত দৃষ্টিতে ইউড়ান ওঁকে দেখলেন। লাঠির ইশারায় ডেকে নিলেন এক সা-জোয়ান টিলামুকে। ইউড়ানের নির্দেশে সে নিয়ে এলো একটা ভারী মনোলিথ। গিলিমান্দাও চমকে উঠল ছেলেটার শক্তি দেখে। মনোলিথ সকলের সামনে নামিয়ে রাখল সে। ইউড়ানের লাঠির ইশারায় সকলের নজরে এলো ব্যাপারটা। বিশালাকায় পাথরটা এ অঞ্চলের নয়। ইউড়ান কোথায় লুকিয়ে রেখেছিল কে জানে। সবুজ শ্যাওলায় ঢেকে গেছে তার এক পিঠ। অন্য দিকে চকচক করছে অপটু হাতে আঁকা এক প্রাগৈতিহাসিক পাথুরে নিদর্শন।
“এ পাথর আমার অতিবৃদ্ধ পূর্বপুরুষের সম্পপ্তি। তিনি বহু চাঁদ আগে দোদোলা দেবের কাছে চলে গেছেন। এখন এদিকে তাকাও সবাই।” তার মেঘমন্দ্র স্বরে সকলে চুপ করে তাকিয়ে রইল। মনোলিথের ওপর আঁকা একটি অদ্ভুত প্রাণীর দিকে ইঙ্গিত করলেন তিনি। সেটা একটা বিশাল পাহাড়। সেই পাহাড়ের একদিকে দুটো শুঁড়। প্রত্যেকটা শুঁড়ের ওপর একটা করে বড়ো বড়ো লাল চোখ। তার সামনের মানুষগুলোকে খরগোশ বা মেঠো ইঁদুরের মতো ছোটো ছোটো লাগছে। পর পর ফ্রেমে দেখা যাচ্ছে, সেই চোখওয়ালা পাহাড়ের সঙ্গে যুদ্ধে হেরে যাচ্ছে ছোট্ট মানুষগুলো। একটার পর একটা মানুষকে নিজের শরীরের মধ্যে আত্মস্মাৎ করে নিচ্ছে সেই ভয়ঙ্কর দানব।
“এই হলেন দেবী পেরপিউরুনা। শেষ বার যখন দেবীর ঘুম ভেঙে ছিল, তখনকার ইতিহাস আঁকা হয়েছে এই পবিত্র পাথরে। আবার হ্রদের জল কমে আসছে। দেবীর জাগরণের সময় এগিয়ে আসছে। আবার দেবী মাথা তুলবেন। চোখ খুলবেন। আবার তাঁর খিদে পাবে। অপরিসীম খিদে। তখন সামনে যা পাবেন তিনি, তাই নিজের দেহে জুড়ে নিয়ে খিদে মেটাবেন। সিসিল, ম্যামথিয়া, ইতনা, কেউ তার থেকে রেহাই পাবে না। কিন্তু তারা তো কেউ এখানে নেই। তখন কী হবে? তার সামনে থাকবে শুধুমাত্র তোমরা। টিলামু জাতি। আমাদের হাতে সময় খুব কম। পালাতে হবে। পালাতে হবে অনেক দূরে। না হলে তোরা সবাই মরবি। মরবি। মরবি।”
পুরোহিত ইউড়ানের কথায় গুঞ্জন শুরু হল সামনের জটলায়। গিলিমান্দাও নড়ে চড়ে বসেছেন। এ ইতিহাস তাঁরও অজানা। পুরোহিত ইউড়ানকে সমঝে ছিলেন তিনি। অনেক কালাজাদু জানেন ইউড়ান। তাঁর হাতের লাঠির একটি ঘা। ব্যাস। চোখ কপালে তুলে, মুখে গ্যাঁজলা উঠে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মরে গেছে কত শক্ত সমর্থ টিলামু। চোখের সামনে তাদের শরীর গড়িয়ে পড়ে যেতে দেখেছেন মাটিতে। আবার কত অসুস্থ মানুষকে সারিয়ে তুলতেও দেখেছেন। গিলিমান্দা নিজের চোখে দেখেছেন, এক অতিকায় ম্যামথিয়া শুঁড় ঝুঁকিয়ে প্রণাম করে ইউড়ানকে। রাতের বেলা নিজের পিঠে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় জলা জঙ্গলের আনাচে কানাচে। নাহ পুরোহিতের বিপক্ষে যাওয়া ঠিক হবে না। গিলিমান্দা উঠে দাঁড়ালেন। সিসিলের চামড়াটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে, মাথার ওপর সিসিলের মাথার মুকুট ঠিক করে নিয়ে, বললেন,
“আকাশদেব দোদোলা যে রাতের অন্ধকারে মাথার ওপর গোল সাদা আলো জ্বালিয়ে আমাদের রাস্তা দেখাবেন, সে রাত্রে সকলে দেবতার পুণ্য আলোর রাস্তায় এগিয়ে যাবো। পরদিন সকালে টিলামু জাতির একজনকেও আর এখানে দেখা যাবে না।” আবার গুঞ্জন উঠল। এখনকার জীবিত টিলামুদের অনেকেই এখানে জন্মেছে। বড়ো হয়েছে। জলা জঙ্গলের বাইরে কী আছে, তারা জানে না। অজানার।প্রতি ভয় চেপে বসছে তাদের মনে। গোল থালার মতো চাঁদ অর্থাৎ পরবর্তী পূর্ণিমা আসতে আরো দশ দিন বাকি। বৃদ্ধ ইউড়ান মাথা নাড়ালেন। গিলিমান্দা অনেক দেরি করে ফেললেন। দেবী আরো দশ দিন সময় দেবেন তো? তাঁর ঘুম যদি আরো আগে ভেঙে যায়। কিন্তু দলপতির কথাই টিলামুদের কাছে শেষ কথা। এই গ্রামের বেশির ভাগ টিলামু গিলিমান্দা-র ছেলে, মেয়ে অথবা নাতি, পুতি। শিঙা বাজিয়ে সভা শেষ হল।
পরদিন সকাল। গিলিমান্দা দলের একটি মেয়েকে ডেকে নিয়েছেন নিজের ঘরে। ঘর নামেই। পাতা আর ডালপালা দিয়ে একটু মাথা গোঁজার জায়গা। ফাঁকফোকর দিয়ে পরিষ্কার দেখা যায় ঘরের অভ্যন্তর। ঘরে পা ছড়িয়ে শুয়ে আছেন গিলিমান্দা। টুসুর হাতে ছোটো নারকেলের মালা। সদ্য জন্মানো বাছুরের মায়ের দুধ থেকে তৈরি ঘি-র মধ্যে নানারকমের জরিবুটি মেশানো তেল ওটার মধ্যে। টুসুর হাত খেলা করে বেড়াচ্ছে গিলিমান্দার নগ্ন শরীরে, পুরোনো নতুন নানা চিহ্নে। চোখ বন্ধ করে ঘর্ঘর শব্দে আরামের জানান দিচ্ছেন দলপতি। হঠাৎ একলাফে মেঝের ওপর উঠে বসলেন। টুসুকে ঝটকা মেরে শুইয়ে উপগত হলেন। দুই নারী পুরুষের শীৎকারে চারপাশে গুঞ্জরিত হল। দৈনন্দিন ঘটনা। কেউ ফিরেও তাকাল না। টুসু সম্পর্কে তার নিজের নাতনি। তবে মেয়েটাকে বড্ডো ভালোবাসেন দলপতি। ভালোবাসার ফলে টুসুর গর্ভের ছ-টা বাচ্চার মধ্যে দুটি গিলিমান্দার সন্তান। বিয়ে-সংসার-একগামীতা টিলামুদের মাথায় এখনো ঢোকেনি। হয়তো কালের নিয়মে পরে কখনো শুরু হবে। এমন সময়ে পাতার বেড়া সরিয়ে ইউড়ান ঢুকলেন। কপালে তাঁর চিন্তার ছাপ। ম্যামথিয়ার নৈশভ্রমণে যেসব তথ্য তিনি আহরণ করেছেন, সেসব বড়োই চিন্তার। “হে মহান দলপতি। আপনার সঙ্গে কিছু কথা আছে। কারুর সামনে সেকথা বলতে আপত্তি আছে আমার।” বলে ইউড়ান টুসুর দিকে তাকালো। টুসু স্খলিত পায়ে গিলিমান্দার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। মেঝেতে গিলিমান্দার পাশে বসলেন ইউড়ান।
“বলো পুরোহিত।” মোক্ষম সময়ে ইউড়ানের আগমনে গিলিমান্দা একটু বিরক্ত। ইউড়ান সেসব পাত্তা না দিয়ে বলতে শুরু করলেন।
“সময় নেই, হে দলপতি। সময় নেই। আর একদম সময় নেই। দেবীর ঘুম ভেঙে গেছে।”
“তুমি কী করে জানলে?” ইউড়ানের কথার মধ্যেই প্রশ্ন করে উঠলেন দলপতি।
শুরু করলেন ইউড়ান “কাল রাতে…”
***
রাতের অন্ধকারে
শন শন হাওয়ার মধ্যে দিয়ে দুটি প্রাণী চুপিসারে এগোচ্ছে। মাথার ওপর নখের মতো এক টুকরো চাঁদ। তার অপুষ্ট আলোয় ঘাস জঙ্গল, জলাজমিতে ছায়া ছায়া পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। দূরে কোথাও ইতনা গর্জন করছে। ওদের মিলনের সময় এখন। পুরুষ ইতনা একা ঘুরছে নারী ইতনার সন্ধানে। শব্দটা জলাভূমির সরোবরের আশপাশে ঘুরছে। মেয়ে ইতনার কোনো আওয়াজ নেই। ওখানে কি মেয়েটার গন্ধ পেয়েছে পুরুষ ইতনা? প্রাণী দুটো সন্তর্পণে এগিয়ে চলেছে ওইদিকেই। দু-পেয়ে প্রাণীটার হাতে শক্ত লাঠি। মাথায় সুঁচালো পাথর বেঁধে অস্ত্রটা মারাত্মক। চার পেয়েটার ওসবের দরকার নেই। শুঁড় আর বড়ো বড়ো দুটো বাঁকানো দাঁতই যথেষ্ট। তার পায়ের চাপে কেঁপে কেঁপে উঠছে রাতের অন্ধকারে মাটি। সরসর করে সরে যাচ্ছে মাটিতে লুকিয়ে থাকা বিষাক্ত সরীসৃপের দল। তৃণভূমির শুকনো ঘাসের মধ্যে মাঝে মাঝে হারিয়ে যাচ্ছে দু-পেয়ে প্রাণীটা। ঘাসের ওপরে চার-পেয়েটার মাথা উঁচিয়ে আছে। এই চার-পেয়ে প্রাণীটাকে ভয় পায় না, এমন প্রাণী এ অঞ্চলে বিরল। অথচ তার বিরাট শুঁড় তুলে বাতাসে কী যেন শুঁকছে সে। বাতাসের বয়ে আনা গন্ধে কী যেন আছে। অদ্ভুত কিছুর গন্ধ পাচ্ছে সে। এ গন্ধ তার অজানা। তবু প্রাচীনকাল থেকে শরীরে বয়ে চলা জীন তাকে সতর্ক করে দিচ্ছে, এ গন্ধ সাধারণ নয়। এ গন্ধের জন্মদাতা ভয়ঙ্কর। তোমার সঙ্গে লড়াই হলে, তোমার মৃত্যু নিশ্চিত। পালাও পালাও। এই চেতনা বারবার রুদ্ধ করছে তার পথ চলা। তবু আজন্মের বন্ধু, দু-পেয়েটাকে সে ছেড়ে যেতে পারছে না। শুঁড় দিয়ে বারবার ইশারা করছে, এখন থেকে চলে যেতে। কিন্তু বন্ধু যে শুনছে না। এভাবেই তারা পৌঁছে গেল সরোবরের কাছে। সঙ্গিনীকে ডেকে ডেকে ক্লান্ত ইতনার জল পিপাসা পেয়ে গেল। সরোবরের দিকে এগিয়ে গেল দ্রুত পায়ে। জিভের সঞ্চারণে জলের মধ্যে সৃষ্টি হল হালকা কম্পন। তার একটা অংশ আরো মৃদু কম্পাঙ্ক রূপে পৌঁছে গেল জলের তলায়। খুব ধীরে জলের উপরিতল ফুলে উঠল। যেন একটা বড়ো ঢেউ উঠেছে সরোবরে। জলের মাঝখানে সৃষ্ট ঢেউটা এগিয়ে এলো ঠিক যেখানে ইতনা জলে মাথা নামিয়ে জল খাচ্ছে। হঠাৎ চোখ মুখ আঁধারে ঢেকে গেল। একটা পিচ্ছিল বিশালাকায় পিণ্ড জলের ওপরে উঠে এসে ঢেকে দিল ইতনার মাথা। আঁকুপাঁকু করলেও মাথাটা ছাড়াতে পারল না সে। চাঁদের হালকা আলো ঠিকরে গেল কুচকুচে কালো পিণ্ড থেকে। ইতনা আর চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছে না। বাতাসের অভাবে শুকিয়ে আসছে তার ফুসফুসের বায়ু। নিস্ফল আক্রোশে সে থাবা চালাল আততায়ীর ওপর। ফালা ফালা হয়ে গেল কালো ভয়ংকরের শরীরের অংশ। তাতে কিছুই হেলদোল হল না আততায়ীর। শরীরের আরো কিছুটা অংশ বিস্তার করে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল ইতনার সারা শরীর। ইতনার গর্জন এখন মৃত্যু কান্নায় বদলে গেছে। ধীরে ধীরে তার শরীরটা জলের নীচে টেনে নিল জলের দানব। সমস্ত ঘটনার সাক্ষী রইল আকাশের নির্জীব চাঁদ আর দুটি জীবিত প্রাণী। ইউড়ানের মুঠি আলগা হয়ে কখন বল্লম হাত থেকে খসে পড়েছে সে নিজেও জানে না। ম্যামথিয়া জলের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখে পিছিয়ে যাচ্ছে একটু একটু করে।
ইউড়ান বুঝেছে, জেগে উঠেছেন দেবী।
জেগে উঠেছে দেবী পেরপিউরুনা। তার অসীম খিদে নিয়ে।
নারী ইতনা দিয়ে তার খাদ্যগ্রহণ শুরু হয়ে গেছে আগেই। পুরুষ ইতনা তার দ্বিতীয় শিকার।
***
কায়াকা
“কাল রাতে নিজের চোখে দেখে এসেছি। আপনি দেখতে চান তো আসুন আমার সঙ্গে। এক্ষুনি। “ইউড়ানের কণ্ঠস্বরে এমন কিছুর ইঙ্গিত আছে, গিলিমান্দা উঠে পড়লেন। দরজার ওপরে টাঙানো সিসিলের চামড়াটা গায়ে চাপিয়ে তৈরি হয়ে নিলেন। ইউড়ানের হাতে এখনো বাঁকানো লাঠির ওপর পাথর বাঁধা, বল্লমের মতো অস্ত্র। এরপর দুই পুরুষ হাঁটা লাগালেন গ্রামের বাইরের দিকে। জলাভূমির দিকে। তারা দু-জন চলে যাওয়ার পর কায়াকা বেরিয়ে এলো পাতার ছাউনি পিছন থেকে। তার পিঠে গাছের বাকল দিয়ে একটা থলি বাঁধা। তার থেকে ক্যাঙ্গারুর ছানার মতো বেরিয়ে আছে তার ছেলে, ঈশাকের মুখ। কায়াকা এতক্ষণ লুকিয়ে ছিল গিলিমান্দার ঘরের পিছনে। কয়েকদিন ধরে সে খেয়াল রাখছে পুরো ঘটনার দিকে। সভাতে সেই প্রশ্ন করেছিল ইউড়ানকে। কায়াকা আসলে হিসারি গ্রামের পুরোহিতের মেয়ে। গিলিমান্দা যখন হিসারি গ্রামের সঙ্গে লড়াই করে তাদের ধনসম্পত্তি দখল করে, তখন কায়াকাকে উঠিয়ে নিয়ে আসে নিজের সঙ্গে। গিলিমান্দা কিছুদিন ভোগ করার পর তাকে মুক্তি দেন। কিন্তু কায়াকার পক্ষে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে একা একা হিসারি গ্রামে ফিরে যাওয়া সম্ভব হয় না। সেসব অনেক দিনের কথা। কায়াকা তখন সদ্য যুবতী। এখন যৌবন তার অস্তাচলে। অথচ দেহের শক্তি প্রবল। নানারকম গোপন জরিবুটির সেবনে সে উঠেছে অনন্য। আজ সে টিলামুদের একজন। নানা কারণে গ্রামের মেয়েরা এবং কিছু কিছু পুরুষও তার কথা মেনে চলে।
কায়াকা এসে দাঁড়াল টিলামু গ্রামের মাঝখানে, সেই বিশাল নিলুনা বৃক্ষর নীচে। দু-হাত মুখের সামনে জড়ো করে দীর্ঘ, গম্ভীর অথচ অনুচ্চ শব্দে হাঁক দিল। তার ডাকে পিল পিল করে পাতার ছাউনি থেকে বেরিয়ে এলো নারী পুরুষ টিলামুর দল। কিন্তু তার থেকে মাত্র পাঁচ-ছয় জন গাছের নীচে এসে দাঁড়াল কায়াকাকে ঘিরে।
“তোমরা তবে যাবে আমার সঙ্গে?”
“যাবো। দলপতি আর পুরোহিত, নিজেরাই ভয় পাচ্ছে দেবী পেরপিউরুনাকে। তবে তারা আর আমাদের বাঁচাবে কী করে?” কাঁখের বাচ্চাটাকে সামলাতে সামলাতে বলল টুসু।
“তা ছাড়া আমি একটা কথা বুঝতে পারছি না। দেবী পেরপিউরুনা যদি আমাদের ভগবান হন, তাহলে তিনি আমাদের ক্ষতি করবেন কেন? তিনি তো আমাদের রক্ষা করবেন।” এবার প্রশ্ন করল গ্রামের যুবক উৎপা।
খলখল করে হেসে উঠল কায়াকা। কোমরের থলি থেকে এক টুকরো হাড় বের করে মুখে ফেলল। কে জানে, কোন প্রাণীর হাড় ওটা। কিছুক্ষণ চিবুলো কচরমচর করে। হাড় ভাঙ্গার শব্দের অভিঘাতে বাকি সবাই চুপ।
“বলতো, তোরা পুরোহিতকে এত মেনে চলিস কেন?” প্রশ্ন করে কায়াকা। কেউ উত্তর দিচ্ছে না। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে আবার প্রশ্ন করে “কি রে বল!”
উৎপা এবারও মুখ খোলে “ওর কথা না শুনলে, ও যে মেরে ফেলবে আমাদের। ওর ঝুলিতে অনেক জাদু আছে।”
“সে তো আমারও আছে। ওর সামনে তো আমাকে তোরা পাত্তাও দিস না।”
“তুমি তো ভালো। তুমি তো মেরে ফেলবে না।” এবার অন্য একজন উত্তর দেয়।
“এই। এই হল কথা। জাদুটা বড়ো কথা নয়। তোরা যাকে সবচেয়ে বেশি ভয় পাস, তাকেই মেনে চলিস। তাকে সন্তুষ্ট করতে, তাকেই তোরা পুজো করিস। অর্থাৎ যাকে তোরা ভয় পাস, তিনি তোদের ভগবান। তার সামনে তোরা আত্মসমর্পণ করিস।
“এবার বুঝতে পারছিস, দেবী কেন তোদের ভগবান।”
***
কেয়োসত ঝোপের নীচে, গর্তের পাশে, সামনের দু-পা দিয়ে গর্ত খুঁড়ছিল একটি ছোটো প্রাণী। গর্তের বাসাতে তার তিনটি ছানা আছে। ছানারা বড়ো হয়ছে, ফলে আজকাল বড়ো স্থানাভাব। পাশে গর্ত খুঁড়ে আরো একটা বাসা বানাচ্ছে সে। পরে মাঝখানে সুড়ঙ্গ কেটে দুটো বাড়ি জুড়ে দেবে। হঠাৎ প্রাণীটা কাজ থামিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াল। কতগুলো দু-পেয়ের গন্ধ। তারা তো এদিকে আসে না। আজ কী হল! দু-পেয়েরা খুব একটা সুবিধার প্রাণী নয়। সে তার শরীরের সমস্ত কাঁটা ফুলিয়ে আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে সোজা হয়ে দাঁড়াল। প্রাণীটা ছোটো হলেও, এ তল্লাটের সমস্ত প্রাণী তাকে বেশ ভয় পায়। সিসিল, ইতানা, টিমিরা কেউ ওর দিকে এগোয় না। কারণ তার শরীর জুড়ে প্রায় দশ-বারো ইঞ্চি লম্বা লম্বা অসংখ্য কাঁটা। সে কাঁটা একবার বিঁধে গেলে, শরীরে বিষিয়ে পচন ধরবে। তারপর অতি যন্ত্রণাময় ধীর মৃত্যু নিশ্চিত। প্রাণীটা বারবার গন্ধ শুঁকছে। দু-পেয়েগুলোর মধ্যে একটা গন্ধ চেনা। প্রাণীটার বাচ্চা হওয়ার আগে, যখন নড়তে চড়তে পারত না, তখন এই দু-পেয়েটা এসে ওকে ঘাসের বীজ দিত খেতে। এ গন্ধ তার অতি প্রিয় খাদ্য দাতার গন্ধ। ততক্ষণে কায়াকা এগিয়ে এসেছে ঘাসের বীজ হাতে। ছড়িয়ে দিল প্রাণীটার সামনে। কাঁটা নামিয়ে খুশি প্রকাশ করল প্রাণীটা। একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে আরো তিনি পুরুষ ও তিনটি নারী। খাওয়ার শেষে গা ঝাড়া দিল প্রাণীটা। গা থেকে ঝরে পড়ল কয়েকটা পুরোনো শক্ত কাঁটা। কায়াকা যত্ন করে তুলে নিল কাঁটাগুলো। রেখে দিল কাধেঁর চামড়ার ভিস্তির মধ্যে। তারা সবাই দল বেঁধে প্রাণীটার বাসা ছড়িয়ে এগিয়ে চলল। যেদিকে চোখ যাচ্ছে, ফুটিফাটা শুখা প্রান্তর। এদিক ওদিক লম্বা লম্বা ধূসর ঘাসের ঝোঁপ। বৃষ্টির অভাবে শুকনো, মৃত। দু-একটা ক্যাকটাস প্রজাতি এখনো সবুজের চিহ্ন বহন করছে অদূর অতীতের শ্যামলা তৃণভূমির। সামনে ছোটো টিলা ওদের লক্ষ্য। কায়াকা ছাড়া এদিকে কেউ কখনো আসেনি। তারা এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছে সতর্ক ভঙ্গিতে। কায়াকা নিশ্চিন্ত পদক্ষেপে এগিয়ে চলেছে। টিলার পিছনে আছে তার অভীষ্ট।
সময়ের সঙ্গে সূর্য মাথার ওপর উঠছে। টুসু কোলের বাচ্চাটাকে বড়ো মেয়ের কাছে রেখে, ঝাড়া হাত-পা হয়ে এসেছে। যুবক উৎপা আর তরুণী অনি জুটি বেঁধেছে। ওরা দু-জন ছাড়া দলে আছে যুবতী তুলি এবং বয়স্কা নারী সুসি। এছাড়া আরো দুটি পুরুষ হিরু এবং বাঞ্চা। কায়াকার পিছন পিছন টিলার অপর পাশে এসে থমকে দাঁড়ালো সবাই। বয়স্কা সুসি মাটিতে হাঁটু মুড়ে বসে নিজের তালুতে চুমু খেতে থাকে। এটাই টিলামুদের প্রণাম। বাকিরা হতভম্ব, ভীত। কারণ ওদের চোখের সামনে টিলার ভিতর গুহায় আলো জ্বলছে। একি অদ্ভুত, প্রাকৃতিক ঘটনা। ওরা জানে, গুহার ভিতর সর্বদা অন্ধকার থাকে। কখনো সখনো এক চিলতে রোদ্দুর ঢোকে। কিন্তু এরকম ধিকি ধিকি করে আলো জ্বলছে কোনো জাদু কাণ্ডে। কায়াকা স্মিত হেসে গুহার মধ্যে ঢুকে যায়। হাতের ইশারায় বাকিদের অভয় দেয়। ভিতরে শুকনো ঘাসের গাদা দড়ির মতো পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে সারা গুহায় ছড়িয়ে রাখা। তাতেই জ্বলছে আলো। কায়াকা তার জন্মভূমি, হিসারি থেকে এই জাদু উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে। আকাশ থেকে নেমে আসা বিদ্যুৎ থেকে শুকনো ঘাসে আলো জ্বালিয়ে রাখার বিদ্যা সে অর্জন করেছে ছোটোবেলায়। সকলের অজান্তে এই আলোটুকু সে জ্বালিয়ে রেখেছে বছরের পর বছর। এটুকু সে একাই পারে। কিন্তু দেবী পেরপিউরুনার বিপক্ষে সে একা পারবে না। এবার সাথী চাই। বিশ্বাসযোগ্য, ভরসা করার মতো সঙ্গী সাথী।
অনেকদিন ধরে সরোবরের জল ছেঁচে সে জমা করছে অনেকখানি লালচে বাদামি ৎশৃঙ্র। ছোটোখাটো নানা জিনিসের একটার সঙ্গে অন্যটা মিশিয়ে খেলা করার অভ্যাস তার বহুদিনের। একদিন সকাল। আগেরদিন গ্রামে ফিরতে তার ইচ্ছা করেনি। গুহাতেই থেকে গেছে। ৎশৃঙ্র নিয়ে খেলা করেছে। গুহার ভিতর সর্বক্ষণ জ্বলছে ঘাসের আলো। এখানে এসে প্রায়ই ৎশৃঙ্র দিয়ে শৃঙ্গার করে সে। গুঁড়ো গুঁড়ো ৎশৃঙ্র নিয়ে মুখে মাখতে বড্ডো ভালো লাগে কায়াকার। কালো মুখটা লালচে রঙের হয় যায়। জলে রঙিন মুখের ছায়া দেখে নিজেকে নতুন করে ভালোবেসে ফেলে। নিজের সৌন্দর্য দেখে নিজের প্রেমে পড়ে যায়। সেদিনও নিজেকে সাজাতে সাজাতে ঘাসের আলোতে বেশ খানিকটা গুঁড়ো ফেলে দেয়। কেবলমাত্র কী হয় দেখার কৌতূহলে। বেশ খানিকটা শুকনো ঘাস গুঁজে দেয় তার চারপাশে। দ্বিগুণ উৎসাহে জ্বলে ওঠে আলো। তার লকলকে শিখা গুহার মাথা ছুঁয়ে ফেলে। গরম ভাপে ঘেমে ওঠে সে। অনেকক্ষণ বাদে আলোর দ্যুতি কমে আসে। গুহার কোণে প্রতিবারের মতো একটুখানি আলোকে টিকিয়ে রাখে কায়াকা। যখনই গুহায় আসে কয়েকদিনের জন্য আলো জ্বলার ব্যবস্থা করে যায়। সেদিন ওই বিশেষ জায়গার আলোর শিখা নিভে যাওয়ার পর, সে দেখে আকাশের বজ্রের মতো নীল শিখায় কালো পিণ্ড জ্বলছে আরো অনেকক্ষণ। সেটা ঠান্ডা হতে হতে পরদিন সকাল। সকালে পিণ্ডটা হাতে নিতে কায়াকা প্রথমবার এক অন্যরকম স্পর্শ অনুভব করে। ভীষণ ঠান্ডা অথচ কি শক্ত। সে জানতেও পারে না, নিজের অজান্তে আকরিক থেকে তৈরি করে ফেলল ব্যবহারিক ধাতু। উত্তরকালে তার এই আবিষ্কার মানব সভ্যতাকে নিয়ে যাবে ক্ষমতার চরম উৎকর্ষে। বার বার ঘাসের আলো বড়ো করে জ্বালিয়ে, তাতে ৎশৃঙ্র ফেলে পরীক্ষা করে সে। ঠান্ডা হলে, মণ্ডের মতো দলা পাকিয়ে যায়। সে বোঝে, তার তৈরি এই মণ্ড ভীষণ শক্ত। সহজে ভাঙা যায় না। এ তার পূর্বপুরুষের দান নয়। তার নিজের আবিষ্কার। এই মণ্ড ছুড়ে একবার একটা টিমিরাকে (সিংহ) আহত করে তাড়িয়েছে। গতকাল সভায় পুরোহিতের কথা শুনতে শুনতে তার উর্বর মস্তিষ্কে খেলে যায় এক অভূতপূর্ব পরিকল্পনা। দেবী পেরপিউরুনার বিরুদ্ধে লড়াই করতে নামবে সে। হিসারি গ্রাম বাধ্য হয়ে ছেড়েছে সে। আজ টিলামু গ্রাম তার ঘরবাড়ি। এখানে সে বসত করতে চায় মৃত্যু অবধি। বার বার গৃহহারা হতে সে রাজি নয়। সুতরাং দেবীর বিরুদ্ধে সংগ্রামে নামবে সে। পুরো গ্রামের সবাই মিলেও খালি হাতে বা পাথরের বল্লম দিয়ে দেবীর সঙ্গে যুদ্ধ করা অসম্ভব। কায়াকা সেটা ভালোই জানে। ৎশৃঙ্র-র মণ্ড দিয়ে অস্ত্র বানাতে হবে। একা পারবে না। তাই এত তিনটি নারী, তিনটি পুরুষকে নিয়ে দল পাকিয়েছে। এবার অস্ত্র-র রিভোলিউসন।
***
রক্ষাকর্তা
কায়াকাকে অনুসরণ করে সকলে গুহায় প্রবেশ করল। নিভন্ত ঘাসের আলোয় আরো কিছুটা শুকনো ঘাস গুঁজে দিতেই পট পট শব্দে জ্বলে উঠল। গুহার ভিতর আলো ছায়ার মায়াবী পরিবেশ ঘুচে গিয়ে, দিনের আলোর মতো উদ্ভাসিত হয় উঠল। আলো কায়াকার আজ্ঞাবহ দাস। টুসু খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠল। আকাশের আলোর জন্য আর অপেক্ষা করতে হবে না। আঁধার রাতের বিভীষিকা এবার তবে কমে যাবে। উৎপা আর অনি আনন্দে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরল। সুসি যদিও ভয়ে ভয়ে এসে গুহার মাটিতে বসে পড়ল। এত পরিশ্রম তার সহ্য হবে কেন? কায়াকা ধীরে সুস্থে সকলকে বোঝাল কী করতে হবে। নিজেই হাতেকলমে দেখাতে কিছুটা ৎশৃঙ্র ঢেলে দিল ঘাসের আলোয়। কিছু পর আলো নিভতে নীল শিখায় জ্বলন্ত ধাতব পিণ্ড দেখে আঁতকে উঠল সবাই। হিরু মুখে হাত চাপা দিয়ে আটকালো উদ্গত চিৎকার। এরকম নীল আলো আকাশে দেখা যায়। মাটির পৃথিবীতে নীল আলো! এ যে অসম্ভব! কমতে লাগল নীল শিখায় দ্যুতি।
“জানিস, হিরু নীল আলো যতক্ষণ জ্বলতে থাকে, ততক্ষণ পাথরটা ভীষণ গরম থাকে। হাত ছোঁয়াতে গেলে এত জোর কামড়ে দেয়, যে হাত কালো হয়ে যায়। কিন্তু ঠান্ডা হয়ে গেলে খুব শক্ত হয়ে যায়। কিছুতেই পাথরের মতো সূঁচালো করতে পারছি না। তাহলে এ জিনিস দিয়ে আর অস্ত্র হবে কী করে?”
কায়াকার কথায় শুনে, হিরু প্রশ্ন করে, কেমন অস্ত্র তৈরি করতে চাইছ তুমি?”
ইউরানের হাতের বল্লমটা দেখেছিস? ওই রকম তীক্ষ্ণ হবে ডগাটা। বাকিটা হবে খুব শক্ত। তবেই তো দেবীকে আঘাত করা যাবে। এই ভোঁতা পাথর দিয়ে কী হবে? ছুড়ে ছুড়ে কতটুকু ক্ষতি করা যাবে ওর? অস্ত্র না তৈরি হলে দেবী জেগে ওঠার আগে চলে যেতে হবে। মনে হচ্ছে, ইউরানের কথামতো এ জায়গা থেকে চলে যেতে হবে।” হতাশ গলায় বলে কায়াকা। হিরু চুপ করে কায়াকার পাশে দাঁড়িয়ে নীল আলোর পাথরের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মনে নানা রকম চিন্তা ঘুরছে। টুসু এখনো মণ্ড পাকানো আগুনের দিকে তাকিয়ে হাততালি দিয়ে দুলে দুলে হাসছে। তার বয়স কম, আনন্দ আর বিস্ময় বেশি। এদিকে সুসি তখন অন্য কাজে ব্যস্ত। গুহার মেঝেতে পড়ে থাকা কায়াকার ভিস্তি হাটকে পাটকে দেখছে। ভিতরে কত অদ্ভুত জিনিসের সমাহার। নানারকম জরিবুটি। কতরকম হাড়গোড়। অনেক অজানা গাছের বীজ। কয়েকটা শুকনো ফুল। ভিতরে আরো একটা ছোটো থলিতে অনেকটা গুঁড়ো গুঁড়ো ৎশৃঙ্র। থলির মধ্যে হাত ঘোরাতে ঘোরাতে হঠাৎ একটু আগে সংগ্রহীত কাঁটা ফুটে যায় সুসির হাতে।
“উফ। কি সব জড়ো করো, কায়াকা। হাত থেকে লাল জল বেরোচ্ছে। “আঙুল মুখে ভরে রক্ত বন্ধ করতে চেষ্টা করে। কায়াকা দৌড়ে এসে হাতের তালুর মোক্ষম চাপড় মারে সুসীর গালে। সুসি ঘুরে মেঝেতে পড়ে কাতরাতে থাকে। ওর বুকে একটা পা চাপিয়ে পিষতে থাকে কায়াকা। ওর গোপন থলিতে হাত দেওয়ার শাস্তি। রাগে গলা দিয়ে বন্য গড়গড় শব্দ বের হতে থাকে। আদিম পৃথিবীর নারী, আজকের নারীর মতো স্নেহশীল নয়। উৎপা ছুটে এসে কায়াকাকে সরাতে চেষ্টা করে। টুসুর হাসি থেমে গেছে। হিরু কিন্তু তাকিয়ে আছে, মেঝেতে ছড়িয়ে পড়া কাঁটাগুলোর দিকে। দৃষ্টি তার শূন্য। চিন্তা ঘুরছে অন্য কোনো দুনিয়ায়। হঠাৎ বিশাল জোরে ঘুরে ঘুরে লাফাতে থাকে। এক হাতের তালু দিয়ে অন্য হাতের তালুতে চাপড় মারতে থাকে। চটাস চটাস শব্দে মুখরিত হতে থাকে গুহার ছাদ। কায়াকা অবাক হয়ে সুসিকে শাস্তি দিতে ভুলে যায়।
“কি রে হিরু, কি হল তোর?” প্রশ্ন করে বাঞ্চা।
“পেয়ে গেছি। উপায় পেয়ে গেছি।” হিরু স্থির হয় দাঁড়িয়ে বলে।
“কায়াকা, তোমার ঝুলি থেকে কয়েকটা জিনিস লাগবে।”
“কী?”
“ওই তীক্ষ্ণ কাঁটাগুলো।” হিরু উত্তর দেয়। চোখ তার জ্বলজ্বল করছে। কায়াকা হিরুর দৃষ্টিতে নির্ভরযোগ্য সঙ্গীর সন্ধান পায়। বিনা বাক্যে তার হাতে তুলে দেয় কাঁটা। ততক্ষণে দু-একটা মণ্ডের নীল আলো নিভে এসেছে। একটা কাঁটা আলগোছে ঢুকিয়ে দেয় দলা পাকানো পিণ্ডের মধ্যে। নিমেষে কাঁটা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে হিরু। আরো ঠান্ডা হয় পিণ্ড। আবার চেষ্টা করে হিরু। এবার কাজ হয়। কাঁটা আমূল গেঁথে যায় পিণ্ডের ভিতর। সঙ্গে সঙ্গে আরো দুটো কাঁটা ঢুকিয়ে দেয় পাশাপাশি। আগেকার শক্ত হয় যাওয়া পিণ্ড দিয়ে সজোরে মারতে থাকে নির্দিষ্ট পিণ্ডটার ওপর সেটা চেপটে গিয়ে পিছন দিকে লাঠির মতো আকার ধারণ করে, যে লাঠির আগায় জেগে আছে তিনটি সূঁচালো কাঁটা।
“কায়াকা, ঠান্ডা হলে এবার কাঁটার মাথায় মাখিয়ে দাও তোমার গোপন বিষ।”
এরপর যুদ্ধকালীন তৎপরতায় বানানো হল অনেকগুলো বিষাক্ত ত্রিশূল। কায়াকা আর হিরুর মিলিত প্রচেষ্টায় তৈরি হল পৃথিবীর প্রথম বায়ো-মেটালিক উইপন “রক্ষাকর্তা”।
শেষ সংগ্রাম
অযুত বছর ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন গভীর জলাশয়ে হাইবারনেশনে ঘুমিয়ে থাকে এক একটি বিশালাকার আদিম জীবিত সত্ত্বা। জল কমে এলে তার ঘুম ভাঙার সময় হয়। সমস্ত শারীরবৃত্তীয় কাজ নতুন করে শুরু করার জন্য তার তখন দরকার হয় প্রচুর এনার্জির অর্থাৎ প্রচুর খাবার। তার হাঁ-মুখ বলে কিছু নেই। যে কোনো জীবন্ত প্রাণীকে সারা শরীর দিয়ে পেঁচিয়ে নিজের ভিতর পুরে নেয় সে। তারপর হতভাগ্য প্রাণীটাকে একটু একটু করে জীবন্ত পরিপাক করে, আত্তিকরণ করে নেয় তার সমস্ত দেহ-মজ্জা-রস।
টিলামু গ্রামের তিন বছরের খরার পর ঘুম ভেঙেছে প্রাচীন সত্ত্বার। শুকিয়ে আসা সরোবরের মাছ এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর আর অস্তিত্ব নেই। দেবী পেরপিউরুনা-র শরীরে লীন হয় গেছে তারা। মোলাস্কা গোত্রের উভচর প্রাণী সে। এবার এনার্জি সংগ্রহের জন্য জল ছেড়ে শুকনো মাটিতে উঠতে হবে। এর মধ্যে দুটো ইতনা সে আত্তিকরণ করে ফেলেছে। জল ছাড়িয়ে মাটির ওপর কম্পন অনুভব করছে সে। মৃদু কম্পন। ধীরে ধীরে কম্পনের মাত্রা বাড়ছে। এগিয়ে আসছে। এনার্জির ডালি সাজিয়ে কারা যেন এগিয়ে আসছে সাক্ষাৎ মৃত্যুর দিকে। এনার্জির অনুভূতিতে কেঁপে উঠল সে।
ইউরান আর গিলিমান্দা তখন এগিয়ে চলেছে সরোবরের দিকে। আর কতটা সময় তারা হাতে পাবে? ইউড়ানের ইচ্ছা সরোবরের দিকে না গিয়ে এখান থেকেই পালিয়ে যাওয়া। পিছনে পড়ে থাকুক একগুঁয়ে অবাধ্য টিলামু-র দল। নতুন দল বানিয়ে নিলেই হবে। দলপতি রাজি নয়। এই বয়সে তার পক্ষে আর নতুন দল বানানো সম্ভব নয়। অন্য দলে, অন্যের পায়ের তলায় থাকতে পারবে না। এই সব কথাবার্তা বলতে বলতে এগোচ্ছে তারা। ততক্ষণে সরোবরের জল ফুলে উঠছে। মাঝখান থেকে একটা বড়ো ঢেউ জল কেটে এগিয়ে আসছে পাড়ের দিকে। জলের ওপর ভেসে উঠল দুটি বড়ো বড়ো চোখ। তিনশো ষাঠ ডিগ্রি ঘুরিয়ে খুঁজতে লাগল এনার্জির উৎস। তখন গিলিমান্দা, ইউরান বেশি দূরে নয়। ইউড়ানের সতর্ক দৃষ্টি কিন্তু জরিপ করে নিয়েছে পরিস্থিতি। শুঁকে নিয়েছে বিপদের গন্ধ।
অতি ধীরে জলের ওপর জেগে ওঠে লম্বা দুটি শুঁড়। তার ওপর ড্যাবড্যাব করে দেখছে বুদ্ধিহীন চোখ। আদিম কালের জীবন হিসাবে সে শুধু চেনে বেঁচে থাকার জন্য শক্তির উৎস। বাকি কার্য সমাধা করে তার বিশালাকায় শরীর এবং মাত্রারিক্ত সক্রিয় পাচক উৎসেচক ও পরিপাক ক্রিয়া। হাতের বল্লম শক্ত করে গিলিমান্দা সোজা হয় দাঁড়ায়। সে খেয়াল করে না এক পা দু পা করে পিছিয়ে যাচ্ছে তার সঙ্গী। জলে বিশাল ঢেউ তুলে শ্লথ গতিতে মাংসপিণ্ড সংকোচন প্রসারণ করে এগিয়ে আসছে দেবী পেরপিউরুনা। কিছুটা অংশ জল থেকে উঠে আসতেই আশপাশের মাটি কালো হয় যেতে থাকে। কাছেই এনার্জির সন্ধান পেয়ে সক্রিয় হয় উঠেছে তার পরিপাকতন্ত্র। ছড়িয়ে দিচ্ছে পাচনরস। তার ফলে বদলে যাচ্ছে মাটির রং। নিজের অতীত যুদ্ধের অভিজ্ঞতায় বল্লম ভরসা করে এগিয়ে যায় গিলিমান্দা। দৌড়ে গিয়ে দেবী পেরপিউরুনা-র শরীরে বল্লম চালাতে লাগল এলোপাথাড়ি। কিছুই ক্ষতি হচ্ছে না দেবীর। সে উঠে আসছে জল ছেড়ে। যত সে উঠে আসে, তত পিছিয়ে যাচ্ছে দলপতি। গিলিমান্দা ক্রমশ বুঝতে পারছে লড়াইয়ে প্রতিপক্ষের সঙ্গে যেটা অসম্ভব। হঠাৎ দেবীর শরীর থেকে বেরিয়ে এলো একটা বিরাট উপাংশ। হাত ওঠানোর মতো উঠে, সেটা এসে পড়ল গিলিমান্দার দেহের উপর। থ্যাপাক করে একটা শব্দ। নিমেষে চিড়ে চ্যাপটা হয়ে গেল প্রভাবশালী টিলামু দলনেতা। বল্লম সমেত তাকে নিজের শরীরের ভিতরে আত্মসাৎ করে নিল আদিম জীব। আহ। কি আরাম। এক থোকা এনার্জি। আরো চাই। আরো। ওই তো কম্পিত হচ্ছে মাটি। বড়ো একটা এনার্জির উৎস অনুভব করল সে। অথচ সে উৎস দ্রুত দূরে চলে যাচ্ছে। গতি বাড়ালো সে। ধরতে হবে। অনেক শক্তি দরকার। সে অনুভব করছে জল আরো কমবে। আরো কষ্টকর হবে জলহীন পরিবেশে বেঁচে থাকা। সাধারন শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়ায় এবার সক্রিয় হবে তার জননতন্ত্র। বিভাজন প্রক্রিয়ায় তার শরীর থেকে জন্ম নেবে তার মতো আরো জীব। সেই জন্য এখন শক্তির প্রয়োজন। সে গতি বাড়াচ্ছে। না জেনেই সে ছুটে যাচ্ছে ইউরানের পিছনে। ম্যামথিয়া তার প্রাণের বন্ধুকে পিঠে নিয়ে ছুটে চলেছে অন্য কোনো ভূখণ্ডের দিকে।
হঠাৎ স্থির হয় যায় দেবী। ঠিক বিপরীত দিক থেকে কেঁপে কেঁপে উঠছে মাটি। ভিন্ন ভিন্ন কম্পন ধাক্কা মারছে তার অনুভূতিতে। বড়ো তীব্র ধাক্কা। কারা যেন দল বেঁধে এগিয়ে আসছে। অভিমুখ বদলে সে এগিয়ে যায় সেইদিকে যেদিক থেকে কায়াকার দল “রক্ষাকর্তা” নিয়ে। গ্রাম থেকে সে অনেক টিলামু জোগাড় করেছে। সকলের হাতে একটি করে নতুন প্রজন্মের বিষাক্ত অস্ত্র। তারা লাফিয়ে লাফিয়ে এগিয়ে আসে। পাগল হয় ওঠে আদিম জীব। উফ! এনার্জি। এনার্জি। কত এনার্জি ঢেউয়ের মতো এগিয়ে আসছে। সকলকে আত্মসাৎ করে নিলে, দু টুকরো হওয়ার মতো শক্তি তার জোগাড় হয়ে যাবে। তারপর আরো আরো বিভাজন। আবার দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়বে তার প্রত্যেক টুকরো। কোনো না কোনো একটা টুকরো ঠিক খুঁজে নেবে নতুন জলাশয়। পৃথিবীর অন্য কোনো কোণে বেঁচে থাকবে তার প্রজাতি।
কায়াকার দল পৌঁছে যায়। কায়াকা দৌড়ে গিয়ে দেবী পেরপিউরুনা-র শরীরে “রক্ষাকর্তা” চালিয়ে পিছিয়ে চলে এলো আগের জায়গায়। পরের বার দৌড়ে যায় হিরু। তারপর টুসু। তারপর আরো অন্য কেউ। হয়তো আবার কায়াকা। গেরিলা লড়াইয়ের ধরনে এগিয়ে পিছিয়ে বারবার সবাই মিলে চালাতে লাগল অতর্কিত হানা। ফালা ফালা হয়ে যাচ্ছে দেবীর শরীর। অভ্যন্তর থেকে বেরিয়ে আসছে সান্দ্র তরল। কখনো থকথকে সাদা, কখনো ঈষদ নীলচে। প্রথমদিকে তার বিশাল শরীরে আঘাতগুলো ছিল বড়োই নগন্য। তার অপরিণত স্নায়ুতন্ত্র আঘাতগুলি অনুভব করতে অপারগ। এর মধ্যে সে কয়েকজনকে জড়িয়ে নিয়েছে তার মাংসল শরীরের মধ্যে। বিশাল মাংসপিণ্ডের ভিতর থেকে শোনা যাচ্ছে মৃত্যু পথযাত্রী টিলামুদের শেষ চিৎকার। কায়াকার চোয়াল আরো শক্ত হয়ে যাচ্ছে। বার বার দেবী পেরপিউরুনার শরীরে আঘাত হানছে তারা। তাকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে টিলামুরা। শরীরের নানা অংশ থেকে বেরিয়ে আসছে তরল। অকস্মাৎ কেঁপে ওঠে আদিম দানব। তার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে জ্বালাময়ী অনুভূতি।
“রক্ষাকর্তা”র কাজ শুরু হয়ে গেছে। বিষ ছড়িয়ে পড়ছে দেবীর স্নায়ু তন্ত্রের আনাচে কানাচে। নড়ে নড়ে উঠছে সে। এই ধরনের আগুনে পোড়ার মত অভিজ্ঞতা তার অচেনা। সে পিছিয়ে আবার সরোবরে ফিরে যেতে চায়। সরোবর এবং দেবীর মাঝে দাঁড়িয়ে ছিল উৎপা সহ আরো কয়েকজন। পুরো শরীর নিয়ে ধেয়ে যায় দেবী। বিশাল শরীরের তলায় নিমেষে প্রাণ হারায় তারা। বাকিরা দ্বিগুণ উৎসাহে ছুটে যায়। জলে তাকে ফিরে যেতে দেওয়া হবে না। মরণপণ লড়াই চলতে থাকে। বিষ ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত। কাহিল হয় ধীরে ধীরে থেমে যাচ্ছে দেবীর গতি। লালচে বিশাল চোখ দুটো ঝিমিয়ে আসছে নিভে যাচ্ছে জীবনের দ্যুতি। টুসুর কাঁধের ওপর চেপে লাফিয়ে ওঠে কায়াকা। “রক্ষাকর্তা” এক ধাক্কায় ঢুকিয়ে দেয় ডান দিকের চোখে। সেই ছিল শেষ আঘাত। দেবীর চোখ কেটে পড়ে যায় মাটিতে। কায়াকাও একই সঙ্গে মাটিতে পড়ে যায়। পতনের অভিঘাতে তার হাতের অস্ত্র ঢুকে যায় তার নিজের হাতে। সঙ্গে সঙ্গে “রক্ষাকর্তা”র বিষ ছড়িয়ে পড়ে আবিষ্কারকের শরীরে। পাশাপাশি পড়ে থাকে বিজিত আর বিজেতার দেহ।
পরের দিন সকালে দেখা যায় সরোবরের পাশে উড়ছে অসংখ্য শকুন। তারা চক্রাকারে নেমে আসছে বিশাল মৃত মাংসপিণ্ডের ওপরে। অন্যদিকে চোখের জলে কায়াকার শরীর তারা গুহার নীলচে আলোয় সমর্পন করছে। ধীরে ধীরে সে আলো গ্রাস করছে কায়াকার পার্থিব শরীর। কিন্তু তার আবিষ্কার বেঁচে থাকবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে।
হয়তো এভাবেই বদলে গেছিল আদিম ইতিহাস। হয়তো নয়। অন্য কোনোভাবে লেখা হয়েছিল। ভাবতে ভালো লাগে হয়তো কায়াকা নামে এক আদিম নারী সত্যি বেঁচে ছিল অন্য কোনো সময়কালে। যে তৈরি করেছিল “রক্ষাকর্তা”। পৃথিবীর প্রথম বায়ো-মেটালিক উইপন।
Tags: বড় গল্প, সপ্তম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, সংযুক্তা চ্যাটার্জী