পৃথিবীর শেষ পায়রা
লেখক: মোহাম্মদ সাইফূল ইসলাম
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
[অধ্যায় এক]
টেবিলের উপর ঠকাস করে ট্রেটা রাখেন মিসেস আনোয়ার। ঝড়ের পূর্বাভাস বুঝতে পেরে, নজর আরো তীক্ষ্ণ করে ল্যাপটপের স্ক্রিনের দিকে ঝুঁকতে থাকেন প্রফেসর কামাল আনোয়ার। সম্ভব হলে পুরো সন্ধ্যা স্ক্রিনের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকবেন, তবুও কোনোভাবেই স্ত্রীর সঙ্গে এই মুহূর্তে বাকবিতন্ডায় জড়াবেন না। সূর্য ডুবতে শুরু করেছে। পশ্চিম আকাশ রক্তিম বর্ণ ধারণ করে রাতের আগমনী বার্তা দিচ্ছে। খানিকটা দূরে, লনেরই আরেক কোণে কবুতরের খোপগুলো একে একে বন্ধ করছে শ্রেয়াস। সন্ধ্যা মুহূর্তে বাড়ির পেছনের লনের খোলা জায়গায় বসে অলস সময় কাটাচ্ছেন অভিবাসি এই পরিবারটি।
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে নিজেই বলে উঠেন মিসেস আনোয়ার, “তুমি কি ল্যাপটপেই ডুবে থাকার ভান করবে? আমারও তো কিছু বলার থাকতে পারে, না কী? এমনিতেই তো সারাদিন দুইজনে অফিস নিয়ে ব্যস্ত থাকি, সন্ধ্যার এই সময়টা কি সংসারের টুকিটাকি সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা করার যায় না?”
রিত্তিকা যতই বলুক সংসারের টুকিটাকি আলোচনা, শেষ পর্যন্ত এ আলোচনা যে একতরফা ঝগড়ায় রূপ নেবে তা নিয়ে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই প্রফেসর কামালের। তাই যতটা সম্ভব নির্লিপ্ত ভাব ধরে উপেক্ষা করার চেষ্টা করছেন। ল্যাপটপের উপর নজর রেখেই আলতো করে চায়ের কাপের দিকে বাঁ হাত বাড়িয়ে ধরেন তিনি।
রাগে গজগজ করতে করতে হাতে ধরে থাকা ম্যাগাজিনটা দিয়ে কামালের বাড়িয়ে দেওয়া হাতের উপর একটা বাড় দিয়ে বলে, “খবরদার! কথা না শুনে চা-এর দিকে এক বিন্দু হাত বাড়াতে পারবে না।” রিত্তিকা পুরো প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে, আজকে একটা দফারফা করেই ছাড়বে সে আজ।
ঘাড় ঘুরিয়ে স্ত্রীর দিকে চোখ তুলে তাকিয়েই কামাল বলেন, “কী ব্যাপার! সুন্দর চাঁদ মুখখানা এমন রাগি রাগি করে রেখেছ কেন? এমন খাপ্পা চেহারা তোমাকে ঠিক মানায় না, কেমন যেন চাঁদের কলঙ্কের মতো লাগে।” কাষ্ঠ হাসিতে পরিস্থিতি কিছুটা তরল করার চেষ্টা করেন প্রফেসর সাহেব।
মনে মনে ফিক করে হেসে উঠে রিত্তিকা। কামাল যখন রোমান্টিক হওয়ার চেষ্টা করে তখন তার মাথা থেকে এমন বেখাপ্পা কথাই বের হয়। যাই হোক এখন হাসিতে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা যাবে না। মাঝে মধ্যে রাগ না দেখালে প্রফেসর সাহেব লাইনে থাকেন না। চায়ের কাপটা বাড়িয়ে ধরে মুখে কৃত্তিম রাগ বজায় রেখে রিত্তিকা বলে, “তুমি কি জানো শ্রেয়াসের সামারের ছুটি শুরু হয়েছে?”
যাক বাঁচা গেল, মনে মনে ভাবেন প্রফেসর কামাল। বোকাবোকা প্রশংসা শুনে রিত্তিকার মন থেকে ক্রোধের কালো মেঘ কিছুটা হালকা হয়েছে। দাম্পত্য জীবনে মাঝে মধ্যে এমন জরুরি অবস্থার মুখোমুখি হলে তিনি এই কৌশল প্রয়োগ করেন। কখনো কখনো বেশ ভালো কাজ দেয়। প্রতিপক্ষের কাছে নিজেকে বোকা সাব্যস্ত করতে পারলে অনেক বড়ো অপরাধও হালকা হয়ে যায়।
“না তো! কবে থেকে?” কিছুটা অবাক হয়ে সামনে দিকে ঝুঁকে আসেন প্রফেসর কামাল। রিত্তিকাকে দেখাচ্ছেন তার কথাকে বেশ গুরুত্ব নিয়ে শুনছেন।
“চার দিন আগে! অথচ তোমার ছেলে আমাদের এ ব্যাপারে কিছুই জানায়নি। গত চার দিন সে স্কুলের নাম করে সারাদিন বাইরে ছিল! কোথায় ছিল, আমি জানি না।” রাগ চেপে রেখে প্রায় ফিসফিস করে কামালের মুখের কাছাকাছি মুখ এনে বলে রিত্তিকা। রাগে রিত্তিকার নাকের অগ্রভাগ ঘেমে উঠেছে। সন্ধ্যার রক্তিম আলোয় হিরের নাকফুলটা মাঝে মধ্যে ঝিলিক দিয়ে উঠছে। কী যে অপরূপ লাগছে রিত্তিকাকে! এই মেয়েটাকে যত দেখি ততই নতুন করে প্রেমে পড়ি, মনে মনে ভাবেন কামাল।
“আরে ব্যাপারটাকে এত ভয়ানক হিসাবে কেনও দেখছ? হয়তো বাইরে কোনো কাজ ছিল। ছেলেকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেই তো হয়। সব কিছুতেই তোমার অতিরিক্ত নাটকীয়তা” বলেই হাত উঁচিয়ে চিৎকার করে ওঠেন কামাল “এই শ্রেয়াস? শ্রেয়াস? এদিকে আয় তো বাবা।”
বাড়ির পেছনে প্রাচীর ঘেরা খোলা লনের এককোণে কবুতরের খোপ নিয়ে ব্যস্ত শ্রেয়াস; বাবার ডাকের জবাবে বলে, “একটু পর আসছি বাবা, একটা কবুতর এখনো ফিরেনি। ওইটা ঢুকলেই, খোপের দরজা আটকিয়ে আসছি।”
“দেখলে? দেখলে কেমন বেয়াদপ হয়েছে তোমার ছেলে? সারাদিন এই কবুতর নিয়ে পড়ে আছে। লেখাপড়া গোল্লায় গেছে। তার উপর আজকাল মিথ্যা কথাও বলছে!” রাগে গজগজ করতে করতে উঠে দাঁড়িয়ে ছেলের দিকে দ্রুত পা ফেলে এগিয়ে যায় রিত্তিকা।
প্রায় তিন মিটার উঁচু একটি খুঁটির উপর কাঠের বাক্সের চারটি ছোটো ছোটো খোপ। খুঁটিতে হেলান দিয়ে লাগানো একটি মই। মইয়ের শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে খোপের ভেতর উঁকি দিয়ে আছে শ্রেয়াস। খুঁটির কাছে পৌঁছেই চেঁচিয়ে ওঠে রিত্তিকা, “বেয়াদপ ছেলে! এক্ষুনি নেমে আয় বলছি মই থেকে!”
মায়ের রুদ্রমূর্তি দেখে কিঞ্চিৎ ভয় পেয়ে যায় শ্রেয়াস। কথা না বাড়িয়ে মুখ ভার করে দ্রুত নীচে নেমে আসে। খপ করে তার হাত ধরে টানতে টানতে এগিয়ে যায় রিত্তিকা। “আজ কী হয়েছে মায়ের? এত রেগে আছে কেন?” ভেবেই পাচ্ছে না শ্রেয়াস।
“বাবা, একটা কবুতর এখনো ঘরে ফেরেনি। কখনো তো এমন হয় না। মনে হয় পথ হারিয়ে ফেলেছে!” দু-হাত কোমরের উপর রেখে মুখভার করে বলে শ্রেয়াস।
চায়ের কাপে মৃদু চুমুক দিয়ে কামাল বলেন, “কবুতর কখনো পথ হারায় না বাবা। তারা কোয়ান্টাম এ্যানটেঙ্গেলম্যান্টের মাধ্যমে পথ চিনে ঠিক জায়গায় চলে আসে। সেন্সরি বায়োলজির একটা নতুন পরীক্ষায় দেখা গেছে কবুতরের চোখে কোয়ান্টাম মেকানিক্স অনুযায়ী রেডিক্যাল পেয়ার তৈরি হয়। এই রেডিক্যাল পেয়ার আর্থ ম্যাগনেটিক ফিল্ডের সঙ্গে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া করে। এটাই তাদের পথ চেনার আসল মেকানিক্স।”
অবাক হয়ে বাপ ছেলের আলাপচারিতা শুনছে রিত্তিকা; তাকে রীতিমতো উপেক্ষা করছে যেন দু-জনেই। না হলে হঠাৎ এমন অপ্রাসঙ্গিক আলোচনা করার কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে? তেড়েফুঁড়ে কিছু একটা বলতে নিতেই প্রফেসর কামাল ইঙ্গিতে রিত্তিকাকে শান্ত হতে বলে ছেলের কথায় মনোযোগ দেন।
“কিন্তু বাবা একটা বিষয় বুঝতে পারছি না। আর্থ ম্যাগনেটের মাধ্যমে না হয় দিক ঠিক করল; কিন্তু সঠিক জায়গাটা চিনতে পারে কী করে?” কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে জিজ্ঞেস করে শ্রেয়াস। কথা বলতে বলতে তার জন্যে রাখা ছোটো প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে পড়ে সে।
“তোমার প্রশ্নটা বুঝিনি। আবার সহজ করে জিজ্ঞেস কর তো।”
মনে মনে আনন্দে লাফিয়ে উঠে শ্রেয়াস। বাবার সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞান নিয়ে গল্প করতে তার খুব ভালো লাগে। নিজে নিজে ইন্টারনেট ঘেঁটে স্কুলের পড়ার বাইরেও অনেক কিছু শিখেছে সে। “যেমন ধর, আমার হাতে যদি একটি কম্পাস থাকে, সেটা দিয়ে কি আমি এই টেক্সাসে বসে ঢাকার দাদুর বাসা খুঁজে বের করতে পারব? না, পারব না। কারণ আমাকে আগে জানতে হবে ঠিক কত ডিগ্রি এঙ্গেলে কত দূর গেলে সেখানে পৌঁছাব। এখানে বসে কোনটা কোন দিক শুধু এইটুকু দিয়ে কী কোনো ঠিকানা বের করা সম্ভব?”
বাহ! ছেলে তো বেশ ক্রিটিক্যাল চিন্তা করতে শিখে গেছে! কোন ক্লাসে যেন পড়ে? সিক্সে না সেভেনে? এই মুহূর্তে ঠিক মনে পড়ছে না। কিন্তু এই কথা জিজ্ঞেসও করা যাবে না। মহাপ্রলয় নেমে আসবে! রিত্তিকার রীতিমতো মনে মনে ফুঁসছে। মূল প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে তারা এখন কবুতর নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় ব্যস্ত! সবই বাহানা! ইচ্ছা করেই করছে তার বাক্যবাণের হাত থেকে বাঁচার জন্যে।
প্রফেসর কামাল কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন; তাকে মাঝপথে থামিয়ে রিত্তিকা চোখমুখ শক্ত করে শ্রেয়াসের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কবুতর নিয়ে আপাতত না ভাবলেও চলবে। এখন বল গত চার দিন স্কুলের কথা বলে কোথায় টো টো করে ঘুরেছিস?”
এতক্ষণে বুঝতে পারে শ্রেয়াস মা কেন এত রেগে আছে! মা কী করে জানল? নিশ্চয় স্কুলে ফোন করেছিল! আমতা আমতা করে বলে, “মাইকদের বাসায় গিয়েছিলাম। তাদের বাসার লনে ওয়ার্কশপে কবুতরের জন্যে নতুন খোপ বানাচ্ছি।”
“তোর যে স্কুলে সামার ভেকেশন শুরু হয়েছে সেটা বলিসনি কেন?”
একটা বিস্কুটে কামড় দিয়ে শ্রেয়াস বলে, “সেটা তো জিজ্ঞেস করোনি! ভেবেছিলাম আজকেই জানাবো!”
“হয়েছে, হয়েছে আর মিথ্যা বলতে হবে না। সারাদিন কেবল কবুতর আর কবুতর। কাল থেকে বাসায় একা একা থাকতে হবে না; তোর বাবার সঙ্গে অফিসে যাবি।” ধমকে উঠে রিত্তিকা।
চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে প্রফেসর কামাল বলেন, “আমার অফিসে যাবে মানে?”
“বলছি আগামী কয়েকদিন তোমার সঙ্গে যাক; ছেলেটার সময়টা ভালো কাটবে আর আমিও নিশ্চিন্তে থাকতে পারব। বসায় বসে বসে কবুতরের খোপ নিয়ে পড়ে না থেকে তোমার গবেষণাগারে ঘুরলেও যদি নতুন কিছু শিখতে পারে মন্দ কী? নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে শিখবে। বাচ্চাদের মাঝেমধ্যে বড়ো স্বপ্ন দেখাতে হয়। এটাকে একটা স্টাডি-ট্যুর হিসাবেও দেখতে পারো।” একদমে কথাগুলো বলে মৃদু হাসে রিত্তিকা।
“আমি এখন আর বাচ্চা নই মা, ক্লাস সেভেনে পড়ি আর কয়দিন পরই এইটে উঠছি!” মৃদু প্রতিবাদের স্বরে বলে শ্রেয়াস।
তাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে কিছুক্ষণ চুপচাপ ভাবেন প্রফেসর কামাল। কিছুক্ষণ পর নিরবতা ভেঙে বলেন, “হ্যাঁ, ব্যাপারটা মন্দ হয় না। শ্রেয়াস, তুমি কি জানো ল্যাবে আমরা এখন কী নিয়ে কাজ করছি?”
জানে না মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দেয় শ্রেয়াস।
“কোয়ান্টাম বায়োলজির অত্যন্ত জটিল একটা বিষয়। আপাতত আর কিছু বলছি না, তোমার জন্যে একটা সারপ্রাইজ হবে নিশ্চিত; কাল গেলেই অনেক কিছু নিজের চোখে দেখতে পারবে।” বলেই মুচকি হেসে আবার ল্যাপটপের স্ক্রিনের উপর নজর নিবন্ধ করেন প্রফেসর কামাল। ঠিক তখনই টুং শব্দে একটি ইমেইল আসে। পাঠিয়েছে PETA-এর আইনজীবী। ওহ নো! বদমাইশগুলো নতুন করে আবার ঝামেলা পাকাচ্ছে! কয়েক সপ্তাহ ধরে হুমকি ধামকির কোনো জবাব না পেয়ে এখন আইনের ভয় দেখাচ্ছে! কোথায় সরকারি গবেষণাগারকে হুমকি দেওয়ার অপরাধে নিজেরাই আইনি ঝামেলার মধ্যে থাকবে! তা না; উলটে সিনাজুরি করছে। যত্তসব উটকো ঝামেলা! দুঃশ্চিন্তার কালো মেঘ এসে আচ্ছন্ন করে প্রফেসর কামালের মন।
মনে মনে স্বস্তির একটা নিশ্বাস ফেলে রিত্তিকা। আগামী তিন দিন ছুটি নিয়েছে সে। বাপ ছেলেকে বের করে দিয়ে বাসায় নিশ্চিন্ত মনে নিজের পরিকল্পনা বাস্তবায়ীত করতে পারবে। ভাগ্য ভালো কামালও কোনো সন্দেহ করেনি। ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি ঝুলিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিতে থাকে রিত্তিকা।
[অধ্যায় দুই]
আজ প্রথম বাবার ল্যাবরেটরিতে যাবে; খুশিতে টগবগ করছে শ্রেয়াস। ভোরবেলাতেই ঘুম থেকে উঠে কবুতরগুলোকে ছেড়ে দিয়ে জামাকাপড় পরে তৈরি হয়ে আছে। গাড়িতে উঠেই একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছে বাবাকে।
“কোনো কিছুতে হাত দেবে না। কিছু রুম আছে রেস্ট্রিকটেড, সেগুলোতে ঢুকবে না। অবশ্য ঢুকতে পারবেও না। বলতে চাইছি, সেগুলোর নিকটেও যাবে না, ঠিক আছে? অনেক ধরনের কেমিক্যাল আছে, দামি দামি যন্ত্রপাতি আছে, কম্পিউটার আছে সেগুলো দেখতে পার; কিন্তু ধরা যাবে না। ঠিক আছে?” শ্রেয়াসকে ভালো করে বুঝিয়ে দিচ্ছেন ল্যাবরেটরির নিয়মকানুন। বাধ্য ছেলের মতো মাথা নেড়ে সায় দিয়ে যাচ্ছে সে।
“জানো বাবা, আজ দেখলাম তিনটা খোপে মোট ছয়টা কবুতরের ডিম।” চোখ বড়োবড়ো করে বলে শ্রেয়াস।
“বাহ! তাই না কি? কবুতর খুব দ্রুত বংশবৃদ্ধি করে। ভালো করে যত্ন নিও কিন্তু।” বলতে বলতেই মূল ফটকের কিছুটা আগে সিকিউরিটির ইঙ্গিতে গাড়ি ব্রেক করেন প্রফেসর কামাল।
আইডি পরীক্ষা করে মৃদু হেসে স্যালুট দেয় উর্দি পরা সিকিউরিটি। তারপর গাড়ির ভেতর উঁকি মেরে শ্রেয়াসকে দেখে চোখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।
“আমার ছেলে। স্কুলের সামার ভেকেশন চলছে, তাই আমার সঙ্গে নিয়ে এসেছি।”
মাথা নেড়ে ইঙ্গিতে কিছু বলতেই সামনের লোহার ফটক ধীরে ধীরে খুলে যায়। কালক্ষেপণ না করে এক্সিলারেটরে চাপ দিয়ে দ্রুতগতিতে তাদের গাড়ি বিশাল এলাকা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত ল্যাবরেটরি অঞ্চলে প্রবেশ করে। অবাক দৃষ্টিতে চারপাশে নজর বুলাচ্ছে শ্রেয়াস। উত্তেজনার পারদ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে তার। সবগুলো ভবন তিন তলা; প্রতিটিই অত্যাধুনিক; দৃষ্টিনন্দন স্থাপত্যের উজ্জ্বল নিদর্শন যেন। অদূরে একটি হ্যাঙ্গারের মতো বিশাল আকারের একটি স্টিলের ভবন। সম্পূর্ণ কালো রং করা। এটাই ল্যাবরেটরির মূল ভবন বুঝতে পারে শ্রেয়াস।
গাড়ি পার্কিং-এ রেখে পায়ে হেঁটে হ্যাঙ্গার সদৃশ ভবনের সামনে পৌঁছে তারা। পকেট থেকে আইডি কার্ড পাঞ্চ করতেই দরজা খুলে যায়। ভেতরটা বেশ ঠান্ডা! অনেক উঁচু। বিশাল বিশাল খাঁচার ভেতর শত শত কবুতর উড়ছে দিকবেদিক। বিষ্ময়ে মুখ হাঁ হয়ে যায় শ্রেয়াসের।
“এত কবুতর! কেন বাবা?”
“আমরা কবুতরে উপর এক্সপেরিমেন্ট করছি। আস্তে ধীরে অনেক কিছু জানতে পারবে। আগামী তিন দিন সময় আছে তোমার হাতে। ঘুরে ঘুরে দেখতে থাক। কোনো প্রশ্ন থাকলে এখানে অনেক গবেষক আছে তাদের জিজ্ঞেস করতে পার। আর আমি তো আছি তোমার আগ্রহ নিবারণের জন্যে। কথা বলতে বলতে দ্রুত সামনে দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন প্রফেসর কামাল। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে শ্রেয়াসের। কিছুক্ষণ পরপর পিছিয়ে পড়তেই দৌড়ে বাবার পাশাপাশি থাকার চেষ্টা করছে সে।
“গুড মর্নিং স্যার।” কয়েকজন তরুন প্রফেসরকে দেখে মৃদু হেসে সম্ভাষণ জানায়।
ফিরতি গুড মর্নিং বলে প্রফেসর কামাল ইঙ্গিতে শ্রেয়াসকে দেখিয়ে বলেন, “আমার ছেলে, দেখতে এসেছে তার বাবা কী এমন দেশ উদ্ধার করছে।” বলেই হো হো করে হেসে উঠেন। “শ্রেয়াসেরও কিন্তু কবুতর নিয়ে অনেক আগ্রহ; বাসায় একঝাঁক পোষ মানিয়েছে। নতুন ডিমও দিয়েছে অনেকগুলো।”
মৃদু প্রতিবাদের স্বরে শ্রেয়াস বলে, “অনেক না বাবা; কেবল চার জোড়া; আর তিন জোড়া ডিম পেড়েছে কেবল।”
কয়েকজন এগিয়ে এসে শ্রেয়াসের সঙ্গে হাত মেলায়, এক তরুণী আগ বাড়িয়ে তার মাথার চুলে হাত চালিয়ে এলোমেলো করে বলে “ইস! কী কিউট বাচ্চা!”
শ্রেয়াসের ঠিক পছন্দ হয় না তরুণীর এই আচরণ। চোখমুখ শক্ত করে জবাব দেয়, “আমি এখন ক্লাস সেভেনে পড়ি!”
তরুণী মুচকি হেসে শ্রেয়াসের গালটা একটু টেনে আহ্লাদী কণ্ঠে বলে, “তাই না কী! কী সুইট! কুটুকুটু।”
রাগে গা জ্বলে যায় শ্রেয়াসের; তরুণীকে পাশ কাটিয়ে সামনের দিকে চলে যায় সে। বাবাকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। হয়তো তার কেবিনে ঢুকে কাজে ব্যস্ত হয়ে গেছে। নিজের মতো ল্যাবের বিভিন্ন অংশে ঘুরে বেড়াচ্ছে শ্রেয়াস। নানান জাতের শতশত কবুতর। এত ভিন্ন জাতের কবুতর একসঙ্গে আগে কখনো দেখেনি শ্রেয়াস।
হেঁটে হেঁটে আরেকটি বিশাল আকারের ঘরে ঢুকতেই চোখ বড়োবড়ো হয়ে যায় শ্রেয়াসের। তাকের উপর রাখা জোড়ায় জোড়ায় হাজার হাজার ডিম। নিশ্চয় কবুতরের ডিম হবে। ঘরটা কিছুটা উষ্ণ, উপর থেকে ছোটো ছোটো শতশত লাইট ডিমগুলোর উপর আলো ছড়াচ্ছে। খানিকটা এগিয়ে একটা ডিমের উপর হাত দিতেই পেছন থেকে প্রফেসর কামালের কণ্ঠ উচ্চস্বরে ধমকে উঠেন, “শ্রেয়াস, তোমাকে না বলেছি ল্যাবের কোনো কিছুতে হাত দেওয়া যাবে না?”
“হাত দিচ্ছি না তো, এমনি কাছ থেকে দেখছি। এগুলো কী কবুতরের ডিম?”
“হ্যাঁ। জেনেটিক্যালি মডিফাই করা। শতশত প্রজন্ম ধরে ধীরে ধীরে মডিফাই করা হচ্ছে।”
উচ্ছসিত কণ্ঠে চিৎকার করে উঠে শ্রেয়াস; “জেনেটিক্যালি মডিফাইড? কী ধরনের মডিফিকেশন হচ্ছে বাবা? এদের কী কোনো সুপার পাওয়ার আছে?”
হা হা করে হেসে উঠেন প্রফেসর কামাল। কর্মক্ষেত্রে তিনি সাধারণত এভাবে উচ্চস্বরে হাসেন না; না কি বদ্ধ ঘরে মৃদু হাসিই শ্রেয়াসের কানে অট্টহাসির মতো শোনাচ্ছে? হাসতে হাসতে বলেন, “প্রতিটি প্রাণীরই কোনো না কোনো সুপার পাওয়ার আছে। সার্ভাইবাল অফ দ্য ফিটেস্ট থিয়োরি মতে কোটি কোটি বছর প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে কেবল সুপার পাওয়ার-ওয়ালা প্রাণীরাই টিকে আছে। এখন বলো মানুষ হিসাবে কী আমাদের সুপার পাওয়ার?”
“আমাদের ব্রেন? মানুষের ব্রেন অন্য প্রাণীদের চেয়ে অনেক বড়ো।”
“না। আমাদের চেয়েও বড়ো ব্রেনওয়ালা প্রাণী আছে। তিমি মাছের ব্রেনের ওজন প্রায় আট কেজি; তারপর হাতির ব্রেন পাঁচ কেজি। বটলনোজ প্রজাতির ডলফিনের ব্রেনও মানুষের চেয়ে বড়ো। প্রাগৈতিহাসিক যুগে ডাইনোসরদের ব্রেনও অনেকে বড়ো ছিল। তারা কোটি কোটি বছর টিকে ছিল কিন্তু তারা কোনো সভ্যতার গোড়াপত্তন করতে পারেনি।”
“তাহলে?”
“মানুষের সুপারপাওয়ার হচ্ছে ভাষা। এই ভাষার উদ্ভবের কারণেই মানুষ সভ্যতার সূচনা করতে পেরেছে। ভাষার মাধ্যমে যোগাযোগ করতে পারার কারণেই প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে জ্ঞানের প্রবাহ চলমান ছিল। কমিউনিকেশন! বুঝলে কমিউনিকেশন! এই কমিউনিকেশনের ক্ষমতাই হচ্ছে মানুষের সুপার-পাওয়ার।” বেশ নাটকীয় ভঙ্গিতে বলেন প্রফেসর কামাল।
মনোযোগ দিয়ে বাবার কথা শুনছিল শ্রেয়াস। চিন্তিত ভঙ্গিতে নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরে কিছুক্ষণ চিন্তা করে তারপর জিজ্ঞেস করে, “কিন্তু বাবা, গতকাল তুমি বলেছিলে কবুতরও না কী কোয়ান্টাম মেকানিক্স পদ্ধতিতে যোগাযোগ করে?”
“হ্যাঁ; এই বিষয়টা অত্যন্ত জটিল। কবুতর ও কিছু প্রজাতির পাখি ম্যাগনিটো সেন্সিং-এর মাধ্যমে দিক নির্ণয় করে। কোয়ান্টাম এনটেঙ্গেলম্যান্টের মাধ্যমে একে অপরের কাছে সিগনাল পাঠায়। আমাদের এই ল্যাবরেটরিতে কবুতরের ব্রেনে কৃত্রিমভাবে ক্রিপ্টোক্রম মলিকিউল তৈরি করে তারা কীভাবে যোগাযোগ করে সেটা নিয়ে গবেষণা হচ্ছে।”
বাপ বেটা হাঁটতে হাঁটতে কথা বলতে বলতে একটি বড়ো হলরুমের মতো ঘরে প্রবেশ করে। শতশত কাচের বক্স; প্রতিটিতে একটা করে কবুতর। কবুতরগুলোর মাথায় ছোট্ট করে হেলমেটের মতো একটা যন্ত্র লাগানো। সবগুলো ঝিম মেরে বসে আছে; কেমন যেন নেশাগ্রস্তের মতো লাগছে পায়রাগুলোকে। গা শিউরে ওঠে শ্রেয়াসের। অস্ফুট কণ্ঠে বলে, “এখানে কী হচ্ছে বাবা?”
“এগুলোর ব্রেনে মাইক্রো-সার্জারি করে কিছু বিশেষ ধরনের প্রোটিন ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই প্রোটিন আর্থ ম্যাগনেটের প্রভাবে কোয়ান্টাম লেভেলে রাসায়নিক বিক্রিয়া করে ইলেক্ট্রনের রেডিক্যাল পেয়ার তৈরি করে।” আরো কিছু জটিল দুর্বোধ্য নাম বলে যান প্রফেসর কামাল সেগুলোর কিছুই শ্রেয়াসের বোধগম্য হয় না।
হাঁটতে হাঁটতে হলরুমের শেষের দিকে চলে আসে তারা। মৃদু চিৎকার দিয়ে উঠে শ্রেয়াস! “বাবা, দেখ এই বাক্সগুলোর ভেতরের কবুতরগুলো মরে পড়ে আছে!”
“হ্যাঁ। এটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার, প্রতিদিনই কয়েক ডজন করে রিপ্লেস করতে হয়। সার্জারি করার পর কবুতরগুলো বেশি দিন বাঁচে না। জেনেটিক মোডিফিকেশনের মাধ্যমে এগুলোর শরীরের অন্যান্য অঙ্গপ্রতঙ্গ নিষ্ক্রিয় করে কেবল ব্রেনের কার্যকারিতা বাড়ানো হয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি এদের আয়ু আরো বাড়াতে।”
আচমকা স্পিকারে একটি কণ্ঠ ভেসে আসে। “প্রফেসর কামাল, আপনার স্ত্রী ফোন করেছে।”
অবাক হয়ে শ্রেয়াস জিজ্ঞেস করে, “মা মোবাইলে কল না দিয়ে ল্যান্ডফোনে কল দিয়েছে কেন? তোমার মোবাইল সঙ্গে নেই বাবা?”
“ল্যাবরেটরির এই অংশটা ফ্যারাডে কেইজ দিয়ে সম্পূর্ণ ব্লক করা। এখান থেকে কোনো সিগনাল বাইরে যায় না আবার বাইরে থেকেও কোনো সিগনাল ভেতরে আসে না। মনে করতে পারো এই অংশটা মহাবিশ্বের একটা ব্ল্যাক স্পট।” বলতে বলতে টেলিফোন বুথের দিকে দ্রুত পা বাড়ান প্রফেসর কামাল;
বাবার অনেক কথায় বুঝতে পারেন না শ্রেয়াস। হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে। হঠাৎ খেয়াল হতেই বাবার পেছন পেছন দৌড় লাগায়।
“হ্যালো, তোমরা অফিসে পৌঁছেছ?”
“হ্যাঁ। হঠাৎ ফোন করলে কী কারণে? জরুরি কিছু?”
“না; এমনি। শ্রেয়াসের খবর নেওয়ার জন্যে। কী করছে সে? নিশ্চয় প্রশ্ন করে করে তোমার মাথা খারাপ করে দিচ্ছে?”
হেসে উঠেন প্রফেসর কামাল। “আরে নাহ! এখনো ঘুরে দেখাই শেষ হয়নি। তবে তার চোখেমুখে বিষ্ময় দেখতে পাচ্ছি স্পষ্ট।”
“আচ্ছা, আজকে দেরি না করে একটু জলদি চলে এসো। ছেলেটি এই প্রথম তোমার অফিসে গেল; বেশি চাপ দিও না। আচ্ছা রাখি। বাই।”
প্রফেসর কামালের সঙ্গে কথা বলেই দ্রুত আরেকটি নাম্বারে ফোন করে রিত্তিকা। “হ্যালো; হ্যাঁ সবকিছু পরিকল্পনা মাফিকই আগাচ্ছে। তোমরা যন্ত্রপাতি নিয়ে জলদি চলে এসো।”
বাবা কোথায় যেন গায়েব হয়ে গেছে! মন খারাপ করে বাবার অফিসের ডেস্কের এক কোণে বসে আছে শ্রেয়াস। নিরীহ কবুতরগুলোর উপর এমন নিষ্ঠুর পরীক্ষানিরীক্ষা করছে বাবা ও তার দল! কিছুক্ষণ পরই অস্থির হয়ে ওঠে শ্রেয়াস; সময় যেন কাটছেই না তার! ব্যাগ খুলে ল্যাপটপ বের করে পড়তে বসে যায় সে।
***
খোলা মাঠ! চারদিক যতদূর চোখ যায় কোনো প্রাণের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। ভয়ে অন্তরাত্মা শুকিয়ে গেছে শ্রেয়াসে। মনে হচ্ছে সে হারিয়ে গেছে। জোরে চিৎকার করে ডেকে উঠে, “বাবা? বাবা? মা? তোমরা কোথায়?” আচমকা অনেকগুলো বিকলাঙ্গ কবুতর ঝাঁকেঝাঁকে তার দিকে তেড়ে আসে, আর বলতে থাকে, তোমার বাবাকে তো আমরাও খুঁজছি! আমরাও খুঁজছি। আমরাও খুঁজছি! আচমকা চারদিক অন্ধকার হয়ে উঠে। অনেক দূর থেকে একটা কণ্ঠস্বর ভেসে আসে “শ্রেয়াস! শ্রেয়াস!” বাবার কণ্ঠ না? হ্যাঁ! বাবাই তো!
“বাবা আমি এখানে!” বলে চিৎকার করে উঠে শ্রেয়াস। ধড়মড়িয়ে ঘুম থেকে জেগে উঠে! পড়তে পড়তে টেবিলে মাথা এলিয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে টেরই পায়নি সে। মাথায় বাবা হাত বুলাচ্ছে আর তার নাম ধরে ডাকছে!
মুচকি হেসে প্রফেসর কামাল বলেন, “স্বপ্ন দেখছিলে না কী?”
ঠোঁটের কোণে শুকনো হাসি ঝুলিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে শ্রেয়াস। স্বপ্ন দেখে ভয় পাওয়ার বয়স সে পার করে এসেছে। এখন কোনোভাবেই এই ভয়ের স্বপ্নের কথা বাবাকে বলা যাবে না। মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে সে। এখন ধীরেসুস্থে পরিকল্পনাটা ভালো মতো সাজাতে হবে।
[অধ্যায় তিন]
আলতো করে প্যান্টের উপর দিয়ে পকেটে হাত বোলায় শ্রেয়াস। বুক ঢিপ ঢিপ করছে তার। বাবা যদি টের পেয়ে যায় তাহলে কী হবে? চোখমুখ শক্ত করে পাশের সিটে বসে আছে সে, প্রফেসর কামাল ড্রাইভ করছেন। আজ সিকিউরিটি শ্রেয়াসের দিকে তাকিয়ে হেসে মৃদু সম্ভাষণ জানায়, সিকিউরিটিকে দেখেই বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ড লাফিয়ে ওঠে শ্রেয়াসের; দ্বিতীয় দিনের জন্যে ল্যাবরেটরিতে যাচ্ছে সে।
আজ ল্যাবে পৌঁছেই প্রফেসর কামাল কম্পিউটার নিয়ে বসে পড়েন। চোখের সামনে তিনটি বিশাল আকারের স্ক্রিনের কিছু ডাটা ও গ্রাফ জ্বলজ্বল করছে; তাঁকে বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছে। কপালে ভাঁজ পড়েছে; মাথার দু-পাশে দুটো শিরা দপদপ করছে। আশপাশে আর কোনো কিছুতেই আর তাঁর মনোযোগ নেই।
ল্যাপটপের স্ক্রিনটা নামিয়ে অতিসন্তর্পনে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায় শ্রেয়াস। ডান পকেটে হাত ঢুকিয়ে রেখেছে সে। দ্রুত গতিতে বুক উঠানামা করছে তার। ভয় পাচ্ছে, বাবা না আবার হৃৎপিণ্ডের কম্পন শুনে ফেলে। আড়চোখে বাবার দিকে একবার নজর বুলিয়ে পা টিপেটিপে রুম থেকে বের হয়ে আসে সে। পেছনে দরজাটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে লেগে যায়, নিঃশব্দে। হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয় শ্রেয়াস। চকিতে চারদিকে একবার নজর বুলিয়ে নেয়। বেশ কয়েকজন গবেষক নিজের মনে কাজ করছে, কেউই তেমন গুরুত্ব সহকারে তার দিকে তাকাচ্ছে না।
হাঁটতে হাঁটতে একটি বন্ধ দরজার সামনে এসে দাঁড়ায় শ্রেয়াস। আশপাশে আরেকবার নজর বুলিয়েই দরজা খোলার জন্যে হাতল চেপে ধরে। দরজা লক করা। বা পকেট থেকে প্রফেসর কামালের আইডিকার্ডটা বের করে দরজার হাতলের ঠিক উপরে কালো রঙের প্যাডের উপর বুলিয়ে আরেকবার চাপ দেয়। ক্লিক শব্দ করে খুলে যায় দরজাটা। বুকের ভেতর যেন হাপরের শব্দ হচ্ছে।
রুমটা স্বাভাবিকের চেয়ে কিছুটা উষ্ণ। বোটকা একটা গন্ধ এসে নাকে লাগে শ্রেয়াসের। শতশত তাকের উপর সারিসারি ডিম জোড়ায় জোড়ায় সাজানো। কালক্ষেপণ না করে চোখের পলকে তাকের উপর থেকে দুটি ডিম তুলে পকেট থেকে রুমাল বের করে তাতে মুড়িয়ে বা পকেটে চালান করে দেয়। ডান পকেট থেকে কাপড়ে মোড়ানো আরেক জোড়া ডিম বের করে আগের জায়গায় রেখে দেয়। ডিম প্রতিস্থাপিত করতে মোটে কয়েক সেকেন্ড সময় লেগেছে তার। ঘুরে দাঁড়িয়ে দ্রুত গতিতে দরজার দিকে পা বাড়ায় শ্রেয়াস। যাক কেউ দেখেনি। বিনা বাধায় তার কাজ সম্পন্ন হয়েছে।
বাবার রুমে ঢুকে দেখে, প্রফেসর এখনো চিন্তিত ভঙ্গিতে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছেন। আটকে থাকা দমটা ধীরে ধীরে ছাড়ে শ্রেয়াস। পা টিপে টিপে বাবার পেছনে ঝুলিয়ে রাখা কোটের পকেটে আইডিকার্ডটা রেখে নিজের চেয়ারে ফিরে আসে সে। এবার পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে স্কুলের পড়া নিয়ে বসে যায় শ্রেয়াস।
সারাদিন প্রফেসর কামাল ভীষণ ব্যস্ত ছিলেন। দুপুরের লাঞ্চও সময় মতো করেননি। বাসায় ফিরে শাওয়ার নিয়ে, সোজা নিজের স্টাডিরুমের দরজার আটকে পুনরায় কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যান। শ্রেয়াস বাসায় পৌঁছেই লনের কবুতরের খোপের দিকে এগিয়ে যায়। পকেট থেকে ডিমদুটো বের করে যে খোপের ডিমদুটো ল্যাবে রেখে এসেছে সেই খোপে খড়ের উপর রেখে দেয়। তার মিশন সম্পন্ন হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে এখন তিন থেকে চার সপ্তাহ লাগবে এই ডিম থেকে জেনেটিক্যালি মোডিফাইড কবুতরের বাচ্চা ফুটতে। খুশিতে চোখ চকচক করছে তার।
অফিসের কাপড় পরে একেবারে তৈরি হয়েই নাস্তার টেবিলে এসেছেন প্রফেসর কামাল। ঘড়িতে নজর বুলিয়েই জিজ্ঞেস করেন, “শ্রেয়াস কোথায়? আজ সে যাবে না?”
“যাবে না মানে? ছেলেটার রুটিনের কোনো ঠিক ঠিকানা নেই! কাল সারারাত না ঘুমিয়ে কম্পিউটার নিয়ে পড়েছিল। মনে হয় নতুন কোনো গেম নিয়ে মেতেছে আবার। এখনো ঘুমাচ্ছে! দাঁড়াও, ডেকে দিচ্ছি।” কফির মেশিনটা চালু করেই শ্রেয়াসের রুমে দিকে এগিয়ে যায় রিত্তিকা।
রিত্তিকা রুমে ঢুকেই দেখে শ্রেয়াস জামাকাপড় পরে চুল আঁচড়াচ্ছে। “জলদি তৈরি হয়ে আয়। বাবা নাস্তার টেবিলে বসে গেছে কিন্তু।”
ডাইনিং রুমে ফিরে রিত্তিকা দেখে কামাল গভীর মনোযোগের সঙ্গে মুখ হা করে টিভির দিকে তাকিয়ে আছে। হাতে একটা আধখাওয়া স্যান্ডুইচ।
“কী ব্যাপার! এত মনোযোগ দিয়ে কী দেখছ যে খাওয়াই ভুলে গেছো?”
ঠোঁটের উপর তর্জনি এনে ইঙ্গিতে রিত্তিকাকে চুপ করতে বলেন প্রফেসর কামাল। দ্রুততার সঙ্গে টিভির রিমোট হাতে নিয়ে সাউন্ড আরো বাড়িয়ে দেন।
ব্রেকিং নিউজ দেখাচ্ছে সিএনএন চ্যানেলে। একজন উপস্থাপিকা বেশ নাটকীয় ভঙ্গিতে এবং উত্তেজিত হয়ে হাত নেড়ে নেড়ে কী যেন বলছে। তাচ্ছিল্যে সঙ্গে হাওয়ায় হাত চালিয়ে মুখে ধ্যাৎ শব্দ করে কফির মেশিনের দিকে এগিয়ে যায় রিত্তিকা। কিছুক্ষণ পর কফির দুটি মগ হাতে করে নিয়ে এগিয়ে এসে সোফায় বসে পড়ে প্রফেসর কামালের গা ঘেঁষে।
টিভিতে কিছুক্ষণ পরপর একই ভিডিয়ো ফুটেজ দেখাচ্ছে; অনেকগুলো কবুতরের মৃতদেহ আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে কোনো এক ল্যাবে। কিছু কবুতরের মাথায় ছোটো স্টিলের টুপি পরানো; টুপিটি থেকে একটি তার বের হয়ে অদ্ভুত দর্শন যন্ত্রের ভেতর ঢুকেছে। আর কিছুক্ষণ পরপর ইলেকট্রিক শক দেওয়া হচ্ছে; কবুতরগুলো ভীষণভাবে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে নিস্তেজ হয়ে পরছে।
ততক্ষণে সিএনএন-এর উপস্থাপিকা স্ক্রিনে PETA-এর ডিরেক্টর, UN-এর প্রাণীবিষয়ক বিশেষজ্ঞ, কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের প্রফেসর, আরেকজন ডাক্তারকে অনলাইনে যুক্ত করে তুমুল আলোচনা শুরু করে দিয়েছে। প্রফেসর কামাল সবকিছু ভুলে এক দৃষ্টিতে টিভির দিকে তাকিয়ে আছেন।
উপস্থাপিকার অস্থিরতা রিত্তিকাকেও প্রভাবিত করে। “কী ব্যাপার! মনে হচ্ছে ভয়ংকর কিছু ঘটে গেছে! কী হয়েছে?” তর সইতে না পেরে জিজ্ঞেস করে প্রফেসর কামালকে।
চোখেমুখে চরম বিরক্তি ভাব ফুটিয়ে তুলে প্রফেসর কামাল মৃদুস্বরে বলেন, “কেন তুমি কী ইংরেজি বোঝ না? বিরক্ত না করে কী বলছে চুপচাপ শুনতে থাক; না হলে যাও এখন থেকে!”
কামালকে কখনো এতটা রাগ করতে দেখেনি রিত্তিকা। কথা না বাড়িয়ে পাশের খালি সোফাটিতে বসে টিভির ব্রেকিং নিউজের উপর মনোনিবেশ করে।
শ্রেয়াস তৈরি হয়ে খাবার টেবিল থেকে একটা স্যান্ডুইচ তুলে ড্রয়িং রুমের দিকে উঁকি মেরে দেখে বাবা মা গভীর মনোযোগের সঙ্গে টিভি দেখছে। এই সুযোগে এক দৌড়ে লনে গিয়ে মই লাগিয়ে কবুতরের খোপের দরজার খুলে সে। মুহূর্তেই চার জোড়া কবুতর ডানা ঝাপটে উড়াল দেয়। খোপের ভেতর উঁকি মেরে দেখে জেনেটিক্যালি মোডিফাইড ডিমদুটো জায়গা মতোই আছে।
***
গম্ভীর হয়ে গাড়ি চালাচ্ছেন প্রফেসর কামাল। ভয়ে ভয়ে তার পাশে বসে আছে শ্রেয়াস। “কী হয়েছে বাবার? কোনোভাবে কি তার ডিম চুরির বিষয়টা জেনে গেছে? কিন্তু কেউ তো তাকে দেখেনি! তাহলে কি ল্যাবে সিসিক্যামেরা লাগানো আছে? ওহ নো! বিষয়টা একেবারেই মাথা আসেনি তার। এত বড়ো বোকার মতো কাজ সে কী করে করল! এখন বাবাকে কী জবাব দেবে?” মনে মনে ভীষণ চিন্তিত হয়ে ওঠে শ্রেয়াস। কপালে ঘাম জমছে মৃদুমৃদু।
“কী ব্যাপার শ্রেয়াস? তুমি ঘামছ কেন? গরম লাগছে? জানালার কাচ নামিয়ে দাও।” বলেই শ্রেয়াসের দিকে চকিতে নজর বুলিয়ে নেন প্রফেসর কামাল।
নিরবে জানালার কাচ নামিয়ে বাইরের দিকে মুখ করে তাকিয়ে থাকে শ্রেয়াস। ভুলেও বাবার চোখের দিকে তাকানো যাবে না এখন; যদি কিছু টের পেয়ে যায়!
“শ্রেয়াস?”
“জি বাবা?”
“সামনে হয়তো খুব ভয়ংকর কিছু ঘটতে চলছে। আজ সকালে টিভির খবরে ব্রেকিং নিউজ দেখাচ্ছিল। যদিও বিশেষজ্ঞদের অনেকে মতামত দিয়েছে খুব বেশি খারাপ কিছু করা হয়নি, তবে আমার কেন যেন মনে হচ্ছে ব্যাপারটা শেষমেষ বড়োসড়ো বিপর্যয়ে গিয়ে ঠেকবে। সরকার আমাদের ল্যাব বন্ধও করে দিতে পারে। নিজের পিঠ বাঁচানোর জন্যে সরকার তখন প্রধান বিজ্ঞানী হিসাবে আমাকেই বলির পাঁঠা বানাবে। তোমাকে এসব বলছি কারণ তুমি এখন দায়িত্ব নেওয়ার মতো যথেষ্ট বড়ো হয়েছ। যদি আমার কিছু হয়ে যায়, তাহলে মাকে নিয়ে সোজা দেশে ফিরে যাবে। দাদা দাদি চাচা চাচিদের সঙ্গে একত্রে থাকার চেষ্টা করবে। মনে রাখবে, যে কোনো বিপদে সবচেয়ে সব শক্তি হচ্ছে পরিবার।”
বাবার কথার মর্ম সম্পূর্ণ হৃদয়ঙ্গম না হলেও অজানা আশঙ্কায় বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠে শ্রেয়াসের। কিন্তু বাবার কিছু হবে কেন? কীসের ভয় পাচ্ছে বাবা? কাঁপাকাঁপা কণ্ঠে বলে, “তোমার কী হবে বাবা?”
“আমার চাকরি চলে যেতে পারে। এক্সপেরিমেন্টের নামে পাশবিক পরীক্ষা চালানো বিজ্ঞানী মিডিয়ার কাছেও হটকেক। এখন জোরেসোরে চলবে উইচহান্ট। পুলিশ কেইস-রেইড চালাবে; বিচারে শাস্তিও হয়ে যেতে পারে। তবে সরকার ও আমাদের পক্ষ থেকে সমঝোতার চেষ্টা চালানো হবে। সেক্ষেত্রেও আমি সহ কয়েকজনের ক্যারিয়ার এখানেই শেষ! এখন বল, আমার কথা কী ঠিকমতো বুঝতে পেরেছ?” মূর্তির মতো সামনের দিকে তাকিয়ে একমনে গাড়ি চালাতে চালাতে কথাগুলো বলেন প্রফেসর কামাল।
তেমন কিছু না বুঝলেও ঘাড় কাৎ করে সায় দেয় শ্রেয়াস। তার খুব খারাপ লাগছে বাবার জন্যে। কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না তার বাবার মতো এত ভালো মানুষকে কেন শাস্তি পেতে হবে!
নিজের অফিস রুমে পা দিয়েই প্রফেসর কামাল বুঝতে পারেন সহকর্মীদের ভেতর ভয়ানক অস্থিরতা কাজ করছে। কয়েকজন দৌড়ে তার দিকে এগিয়ে এসে একযোগে কিছু একটা বলতে গিয়ে হৈচৈ বাঁধিয়ে ফেলেছে। অবশ্য তারা কী বলতে চাইছে সেটা অনুমান করতে বেগ পেতে হয় না প্রফেসর কামালের। হাত উঁচিয়ে সবাইকে স্থির হওয়ার ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, “হ্যাঁ আমি সব জানি। বাসা থেকে খবর শুনেই বের হয়েছি। বিষয়টি যেহেতু আমাদের এক্সপার্টিজের ভেতর পড়ে না, আমাদের নিয়ন্ত্রণেও নেই; তাই আপাতত উচিত এটা নিয়ে সময় নষ্ট না করা। আমরা আমাদের মতো কাজ করে যাবো। আমাদের লিগ্যাল ডিপার্টমেন্ট তাদের মতো করে বিষয়টি হ্যান্ডেল করবে।”
এতক্ষণ ধরে প্রফেসর কামাল অধীনস্থ সহকর্মীদের যা যা বলেছেন সেগুলোকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে শ্রেয়াসের সেই গাল টানা তরুণীটি অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করে, “আচ্ছা স্যার, পুরো ব্যাপারটা কী কোনোভাবে হোক্স হতে পারে? মানে কোনো দেশ বা আমাদের প্রতিদ্ধন্দ্বী কেউ হয়তো ব্ল্যাকমেইল করার চেষ্টা করেছে?”
কপালে চিন্তার ভাঁজ ফুটিয়ে প্রফেসর কামাল বলেন, “এমনটা হওয়ার সম্ভাবনা কম। কয়েকদিন ধরেই PETA থেকে আমাকে অতিসত্তর এই প্রজেক্ট বন্ধ করার জন্যে হুমকি দিচ্ছিল। গতকাল লিগ্যাল নোটিশও পাঠিয়েছে। আমাদের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে এখন মিডিয়ার আশ্রয় নিয়েছে। আর যাই হোক এটা কোনো হোক্স না।”
শ্রেয়াস আলোচনার তেমন কিছু বুঝতে না পারলেও এটা বুঝতে পেরেছে ভয়ংকর কিছু একটা ঘটে চলছে বাবার এই ল্যাবে। আজকে আর তেমন কোনো আগ্রহ পাচ্ছে না; ল্যাবের লোকজনও কেমন যেন মন খারাপ করে আছে তার দিকে কারও তেমন কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
“কী ঘটতে যাচ্ছে? কখন ঘটবে?” ভাবনাগুলো মনে মনে আউড়ে মুখ ভার করে ল্যাবের এদিকে সেদিক ঘুরতে থাকে শ্রেয়াস।
[অধ্যায় চার]
ভিয়েরা; বাইশ বছরের ছটফটে এক তরুণী। গতমাসে এই ল্যাবের সহকারী হিসাবে নিয়োগ পেয়েছে অতিমেধাবী মেয়েটি, চাকরির পাশাপাশি মাস্টার্স করছে। এখনো পুচ্ছ হতে তারুণ্যের ফুল ঝরে পড়েনি; প্রায়ই সিনিয়র সায়েন্সটিস্টদের সঙ্গে বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়ে। বয়স কম, তার উপর সুন্দরী বলে সবাই খানিকটা সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখে তার যত সীমা লঙ্ঘন। এস্ট্রোনমি নিয়ে দারুণ আগ্রহ তার। নাসার সব ধরনের ফ্যান বেইজড কার্যক্রমে সবার আগে ঝাঁপিয়ে পড়ে এই পুঁচকে মেয়ে। প্রায়ই আড্ডায়-গল্পে-আলোচনায় হাত পা নেড়ে; চোখ বড়ো বড়ো করে এভাবে নাসাকে নিয়ে কথা বলে যেন সে নিজেই নাসার কোনো হর্তাকর্তা। আজ সে এখনো অফিসে আসেনি।
ল্যাবরেটরির মূল ভবনে কে যেন চিৎকার করে সকলকে ডাকতে থাকে। কিছুক্ষণ আগে ইমেজ স্পেশালিস্টদের সঙ্গে মিটিং শেষ করে এখন নিজের রুমে গভীর মনোযোগের সঙ্গে PETA-এর ইমেইলগুলো পড়ছিলেন আর ফাঁকে ফাঁকে নোট নিচ্ছিলেন প্রফেসর কামাল; আগামীকাল লিগ্যাল ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে মিটিং সেট হয়েছে। বাইরে হৈচৈ শুনে তড়িৎগতিতে বের হয়ে দেখেন, সবাই জটলা পাকিয়ে চিৎকার করছে আর মূল হোতা হচ্ছে ভিয়েরা। নির্ঘাত আজকে আসতে দেরি হয়ে যাওয়ায় বাহানাস্বরূপ কিছু একটা ঘোট পাকাচ্ছে।
“কী ব্যাপার ভিয়েরা? মনে হচ্ছে ভয়ংকর কিছু একটা ঘটে গেছে?” দুঃশ্চিন্তা গিলে খানিকটা হেসে বলেন প্রফেসর কামাল।
দুই হাঁটুর কাছে ছেড়া জিন্স ও ফুলতোলা হাওয়াই গেঞ্জি গায়ে দেওয়া এক সিনিয়র গবেষক উচ্ছসিত কণ্ঠে বলে উঠে, “এখানে তো টিভিও নেই বাইরের কোনো সিগনালও আসে না। তাই আমরা জানতে পারিনি। ভিয়েরা কেবল এসেছে বাইরে থেকে। নাসা নাকি ঘোষণা দিয়েছ এই প্রথম কোনো ভিনগ্রহীর পাঠানো মেসেজ ধরতে পেরেছে। বেশ কয়েকটি অনলাইন পত্রিকায় ও সোস্যাল মিডিয়ায় খরটা ভাইরাল হয়ে গেছে।”
“তো এ আর নতুন কী? যখনই ফান্ডের টান পড়ে, তখনই তারা বাসযোগ্য কোনো গ্রহ কিংবা মহাবিশ্বে প্রাণের অস্তিত্ব, কখনো কখনো এক্সট্রাটেরিস্টিয়াল সিগনাল পেয়ে থাকে।” তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে শূন্যে হাত ঘুরিয়ে বলেন প্রফসর কামাল।
ঘোঁৎ করে ওঠে ভিয়েরা। কণ্ঠে নাটকীয় ভাব ফুটিয়ে বলে “না স্যার! এবার সত্যি খবর ভয়াবহ! নাসা সিগনাল ডিকোড করেছে। সিগনালটা হচ্ছে, “দুঃশ্চিন্তা করো না, আমরা আসছি!” একমুহূর্তের জন্যে বিরতি নিয়ে পরক্ষণেই আবার যুক্ত করে, “আর এবার শুধু নাসা নয়; রোসকোসমোস, ইসা, সেনসা, ইসরো মোট পাঁচটি প্রধান স্পেস এজেন্সির সবগুলো এই মেসেজ পেয়েছে বলে নিশ্চিত করেছে”
ভ্রু কুঞ্চিত করে প্রফেসর কামাল মুহূর্তক্ষণ ভেবে বলেন, “মেসেজ শুনে তো মনে হচ্ছে বন্ধুভাবাপন্ন কোনো বুদ্ধিমান স্বত্তার সঙ্গে আমার প্রথম যোগাযোগ হতে যাচ্ছে! তুমি এটাকে ভয়ংকর বলছ কেন?”
“কী জানি? হঠাৎ মনে হল তাই!” ঘাড় কাৎ করে নিজের অপারগতার কথা বুঝিয়ে দেয় ভিয়েরা। “কিন্তু স্যার, মেসেজ শুনে তো মনে হচ্ছে তারা পৃথিবী থেকে সাহায্য চেয়ে পাঠানো কোনো মেসেজের জাবাব দিচ্ছে! তাদের মেসেজটা আবার শুনে দেখুন! কেমন যেন শীতল একটা হুমকির মতো শোনাচ্ছে না! “দুঃশ্চিন্তা করো না, আমরা আসছি!”
অজানা আশঙ্কায় বুকটা কেঁপে উঠে প্রফেসর কামালের। ঘড়িতে নজর বুলাতেই চোখ কপালে উঠে যায় সদা ব্যস্ত প্রফেসরের; লাঞ্চের সময় পার হয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগেই! হঠাৎ করেই বাড়ি যাওয়ার জন্যে মনটা আকুপাকু করে উঠে। একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে টেবিলের উপর স্তূপাকারে রাখা শত শত জার্নাল ও বইয়ের দিকে দৃষ্টি যেতেই রাজ্যের ক্লান্তি এসে ভর করে তাঁর মনে। আজ আর কাজ করতে ভালো লাগছে না।
“শ্রেয়াস? শ্রেয়াস? কোথায় তুমি?”
“জি বাবা?” কোণার কোনো একটি রুম থেকে হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে আসে শ্রেয়াস।
“দুপুরের খাবার খেয়েছ?”
ঘাড় নাড়ে শ্রেয়াস।
“চলো বাসায় যাই; বাপ-বেটা মিলে দুপুরের খাবার তৈরি করে মা কে একটা সারপ্রাইজ দিই গিয়ে। নাকি যাওয়ার পথে কোনো রেস্তোরা থেকে প্যাকেট নিয়ে যাবো?”
খুশিয়ে লাফিয়ে উঠে শ্রেয়াস বলে, “আমার মনে হয় নিজেরা রান্না করলেই বেশ মজা হবে। কিন্তু বাবা, তুমি তো রান্না করতে পারো না! তবে সমস্যা নেই, আমি পারি। স্কুলে বেশ কিছু আইটেমের রান্না শিখিয়েছে; বেকিংও পারি!” চোখেমুখে অকৃত্রিম উচ্ছাস তার।
“তাই না কি? তাহলে তো আর দেরি করা উচিত হবে না।”
ধীরেসুস্থে গাড়ি চালাচ্ছেন প্রফেসর কামাল। মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই মাথার ভেতর বয়ে চলছে চিন্তার ঝড়। বাড়ির পার্কিং-এ ঢুকতেই খানিকটা খটকা লাগে প্রফেসরের মনে। কিছু একটা অস্বাভাবিকতা আছে আশপাশে। শ্রেয়াসকে গাড়ি থেকে নামতে নিষেধ করে কামাল দরজার কাছে পৌঁছে দেখেন সেটা কেবল হালকা করে ভেজানো, ধাক্কা দিতেই খুলে যায়।
কী ব্যাপার! ঘরে চোরটোর ঢোকেনি তো আবার? কিঞ্চিত ভ্রু কুঁচকে পা টিপে টিপে ঘরে প্রবেশ করেন প্রফেসর কামাল।
বেসমেন্ট হতে কয়েক জনের কণ্ঠ ভেসে আসে। নিশ্চিত চোর! সন্তর্পনে নিজের বেডরুমের দিকে এগিয়ে যান কামাল। নীচু হয়ে খাটের নীচ থেকে শটগান বের করে দেখে নেন গুলি লোড করা আছে কি না। অতঃপর বাঁ হাতে শাটল টেনে চেম্বারে গুলি এনে শটগানটি সামনে দিকে বাড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে এগিয়ে যান। বেসমেন্ট থেকে এখনো কয়েকজনের মৃদু হাসি ও গলার স্বর ভেসে আসছে। একজন মেয়ের কণ্ঠও আছে তাদের মধ্যে!
বেসমেন্টের সিড়িতে পা দিতেই প্রফেসর কামাল দেখেন নীচ থেকে রিত্তিকা দুইহাতে একটি বড়ো সাউন্ড সিস্টেম ধরে উপরের দিকে উঠে আসছে। সিড়ির ঠিক উপরে কামালকে বাড়িয়ে ধরা শটগানসহ দেখে মুখ কাগজের মতো সাদা হয়ে যায় রিত্তিকার। মূর্তির মতো স্থানু হয়ে দাঁড়িয়ে আমতা আমতা করে বলে, “কামাল! তুমি এই অসময়ে?”
“রিত্তিকা! তোমার না এই সময়ে অফিসে থাকার কথা? আমি তো ভেবেছি বাসায় চোর এসেছে!” অনভ্যস্ত হাতে ধরে থাকা শটগান মৃদুমৃদু কাঁপছে! যে কোনো সময় ট্রিগারে চাপ লেগে একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
চিৎকার করে রিত্তিকা বলে, “বন্দুক নামাও! গুলি বের হয়ে যাবে তো!”
শটগানটি পাশে রেখে সিঁড়ির উপরেই বসে পড়েন প্রফেসর কামাল। রীতিমতো হাঁপাচ্ছেন তিনি। চোখেমুখে এখনো বিষ্ময়ভাব কাটেনি। বেশ কয়েকটা লম্বা দম নিয়ে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে জিজ্ঞেস করেন, “কী হচ্ছে?”
“ধ্যাৎ! সব আয়োজন জলে গেল!” চোখেমুখে স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ রিত্তিকার। “এ মাসের শেষ সপ্তাহে শ্রেয়াসের জন্মদিন। তাই অফিস থেকে পাঁচ দিনে ছুটি নিয়ে বেইজমেন্টে থ্রিডি-হলোগ্রাফিক লেজার সিস্টেম বসাচ্ছি। মার্কেটে একদম নতুন। শ্রেয়াসের সব রেকর্ড করা ভিডিয়োকে হলোগ্রাফে কনভার্ট করে একটা শো-এর ব্যবস্থা হচ্ছিল। ভেবেছিলাম চৌদ্দতম জন্মদিন বিশেষভাবে আয়োজন করে তাকে চমকে দেব। দিলে তো সব ভন্ডুল করে।”
চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ ভাবেন প্রফেসর কামাল। চোখ খুলে মুচকি হেসে বলেন, “এখনো কিছুই ভন্ডুল হয়নি। শ্রেয়াস এখনো গাড়িতে বসে আছে, আমি তাকে নিয়ে বাইরে খেতে চলে যাচ্ছি। তুমি আজকে একটু জলদি কাজ শেষ করে টেকনিশিয়ানদের বিদায় করে দিও।” বলেই কথা না বাড়িয়ে, উঠে দাঁড়িয়ে প্যান্ট ঝেড়ে দ্রুত গ্যারেজের দিকে এগিয়ে যান প্রফেসর কামাল।
বাবার কী হয়েছে কিছুই বুঝতে পারল না শ্রেয়াস। অফিস থেকে জলদি বের হয়ে এলো; এখন বাসায় ফিরেও বলছে কাজ পড়ে গেছে তাই বাইরেই খেয়ে নেবে। বাবার মতো বিজ্ঞানীরা হয়তো এমনই হয়; কিছুটা খেয়ালিপনা থাকে। অবশ্য এর আগে বাবাকে এত কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়নি তার।
গাড়ি প্রধান সড়কে উঠতেই রেডিয়ো চালিয়ে দেন প্রফেসর কামাল। খবরের সবগুলো চ্যানেল নাসার মেসেজের খবরে ছয়লাপ। একটাই বাক্য ক্রমাগত চিৎকার করে কানের পোকা খাচ্ছে, “দুঃশ্চিন্তা করো না, আমরা আসছি!” “দুঃশ্চিন্তা করো না, আমরা আসছি!”
এলিয়েনরা কি আর কোনো মেসেজ পাঠাতে পারছে না? মনে হচ্ছে আগামী বেশ কয়েকদিন এই এক মেসেজ বেজে যাবে। বিরক্ত হয়ে রেডিয়ো বন্ধ করার জন্যে হাত বাড়াতেই মূর্তির মতো স্থির হয়ে যান প্রফেসর কামাল। নাসার “সার্চ ফর এক্সট্রাটারেস্টিয়া লাইফ” ডিপার্টমেন্টের ডিরেক্টর লাইভ বক্তব্য দিচ্ছেন। দ্রুত ব্রেক কষে রাস্তার পাশেই গাড়ি থামিয়ে ডিরেক্টরের বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শুনতে থাকেন তিনি,
“আমরা অত্যন্ত দুঃখিত। আসলে ভিনগ্রহের প্রাণীর কোনো মেসেজ আমরা পাইনি। হ্যাঁ একটি সিগনাল আমরা পেয়েছি যেখানে বার বার বলা হচ্ছে যে “দুঃশ্চিন্তা করো না, আমরা আসছি!”। প্রকৃতপক্ষে রাশিয়ার স্পেসস্টেশন থেকে সাহায্য চেয়ে এসওএস বার্তা পাঠানো হয়েছিল। তাদের অক্সিজেনের রিজার্ভ উল্কার আঘাতে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে, এই মুহূর্তে তারা ইমার্জেন্সি রিজার্ভ অক্সিজেনের উপর নির্ভর করে বেঁচে আছে। কিন্তু পৃথিবী থেকে সাহায্য পাঠানো অনেক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই ইন্টারন্যাশনাল স্পেসস্টেশনকে সাহায্যের জন্যে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। এসওএস-এর জবাবে ইন্টারনেশনাল স্পেশস্টেশন থেকে “দুঃশ্চিন্তা করো না, আমরা আসছি!” মেসেজ পাঠানো হয়। কিন্তু প্রটোকল হচ্ছে স্পেশস্টেশন থেকে যে কোনো মেসেজ নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সিতে নির্দিষ্ট এনকোডিং-এর মাধ্যমে পাঠাতে হবে। কিন্তু তাড়াহুড়োর মধ্যে ভুল করে তারা এই মেসেজ পাবলিক চ্যানেলে পাঠিয়ে দেয়। ফলে এই মেসেজ পৃথিবীতে বসানো শক্তিশালী রিসিভার যাদের আছে তারাই পেয়ে গেছে। এই কারণে নাসাসহ বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ চারটি মহাকাশ গবেষণাসংস্থা এই মেসেজ পেয়েছে, আর এ থেকেই সকল ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি। আশা করি এখন সব ধরনের অষ্পষ্টতা দূর হয়েছে।”
গাড়ি স্টার্ট দিয়ে আবার রাস্তায় নামিয়ে আনেন প্রফেসর কামাল। রেডিয়োতে তখনও চলছে নাসার ডিরেক্টরের সঙ্গে উপস্থাপিকার আলাপচারিতা। প্রফেসর কামালের কেন যেন বারবার মনে হচ্ছে সম্পূর্ণ বিষয়টিতে বড়ো ধরনের ঘাপলা আছে। নিজের অজান্তেই ভয়ের ঠান্ডা একটা ধারা শিরদাঁড়া বেয়ে পায়ের পাতা পর্যন্ত নেমে যায় তার।
ম্যাকডোনাল্ডসে বার্গার আর ডিংক্স অর্ডার করে কোণের একটা নিরিবিলি জায়গা দেখে বসেছেন প্রফেসর কামাল। এমনিতেই লোকজন স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কম মনে হচ্ছে; যারা আছে তারাও অদূরেই বড়ো খোলা জায়গায় বসানো স্ক্রিনের সামনে জটলা পাকিয়ে কিছু একটা দেখছে। নিশ্চয় কিছুক্ষণ আগে নাসার ভিনগ্রহীদের সিগনালের ভুল খবর নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা উপভোগ করছে।
সাড়ে চারটা বাজে কেবল। ওইদিকে বাসায় রিত্তিকা কতটুকু গুছিয়ে উঠতে পেরেছে কে জানে? কমপক্ষে দেড় ঘণ্টা বাইরে কাটিয়ে তবেই ঘরে ফিরতে হবে। বারদুয়েক মোচড় দিয়ে পেট বেচারা জানান দিয়ে গেছে যে বেশ ভালোই খিদে লেগেছে। চিন্তিত ভঙ্গিতে অপেক্ষার করছেন প্রফেসর কামাল। শ্রেয়াস মুখোমুখি চেয়ারে বসে একমনে মোবাইলে গেইম খেলছে।
মোবাইলটা হঠাৎ করেই কেঁপে উঠে, মেসেজ এসেছে। দ্রুততার সঙ্গে প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে মেসেজ বক্স চেক করেন প্রফেসর কামাল। মোবাইল অপারেটর থেকে মেসেজ করেছে। “প্রেসিডেন্ট দেশব্যাপি জরুরি পরিস্থিতি ঘোষণা দিয়েছেন। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত আজ সন্ধ্যা ছয়টার পর থেকে কার্ফিউ জারি করেছে সরকার। জরুরি প্রয়োজন ব্যতীত জনসাধারণকে ঘরের বাইরে বের না হওয়ার জন্যে বিশেষ অনুরোধ করা হচ্ছে।”
ভয়ে মুখ চোখ শুকিয়ে আসে প্রফেসর কামালের। সবকিছু কেমন যেন খুব দ্রতগতিতে ঘটে চলছে! আজ সকালেই PETA তাদের ল্যাবের গোপন ভিডিয়ো প্রকাশ করে। তারপর নাসার দাবী ভিনগ্রহদের কাছ থেকে প্রথম মেসেজ পেয়েছে পৃথিবীবাসি। দুপুরের পরপরই নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে নাসারই একজন বিজ্ঞানী টিভিতে সাক্ষৎকার দিয়েছেন। তারপর হঠাৎ করে এখন জরুরি পরিস্থিতি! কার্ফিউ! মনে হচ্ছে পর্দার অন্তরালে মহা গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটনা ঘটে চলছে যেটা সাধারণ জনগণকে সরকার জানতে দিতে চাইছে না।
মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে প্রফেসর কামালের। রিত্তিকাকে ফোন দিয়ে দেখি তার কী অবস্থা, ভাবেন তিনি। ফোন দেওয়ার জন্যে মোবাইল তুলতেই একটি কল আসে। ওহ্! রিত্তিকা নিজেই ফোন করেছে। রিসিভ করতেই রিত্তিকার উৎকণ্ঠা মিশ্রিত কণ্ঠস্বর ভেসে আসে।
“কোথায় তোমরা? কিছুক্ষণ পর কার্ফিউ শুরু হচ্ছে। জলদি বাসায় চলে এসো।”
“হ্যাঁ, এই মাত্রই মোবাইলে মেসেজ এসেছে।”
“টিভিতে দেখাচ্ছে দশটা দেশের তেরোটা জায়গায় একযোগে বোমা বিষ্ফোরিত হয়েছে। অনেকে বলছে এগুলো ছোটো আকারের পারমাণবিক বোমা!”
বসা থেকে লাফিয়ে দাঁড়িয়ে যান প্রফেসর কামাল। নিচুস্বরে চিৎকার করে বলে উঠেন, “মাই গড! আমি এক্ষুনি আসছি।”
“টেকনিশিয়ানদের আজকের মতো বিদার করে দিয়েছি। আপাতত জন্মদিনে পরিকল্পনা বাতিল। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পরে দেখা যাবে; শ্রেয়াসের জন্মদিন এখনো তিন সপ্তাহ বাকি। তুমি সময় নষ্ট না করে জলদি বাসায় চলে আস। আমার খুব ভয় করছে!”
অর্ডার দেওয়া খাবার প্যাকেট হাত নিয়ে প্রায় উড়ে গাড়ির দিকে এগিয়ে যান প্রফেসর কামাল। ভীষণ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত দেখাচ্ছে তাকে। মাথায় কেবল একটি কথাই ঘুরছে, পর্দার অন্তরালে কী ঘটে চলছে?
[অধ্যায় পাঁচ]
দরজায় জোরে করাঘাতের শব্দে চমকে ঘুম থেকে উঠেন প্রফেসর কামাল। বিছানা থেকে নেমে দ্রুত পদক্ষেপে দরজার কাছে পৌঁছতেই আরো দুয়েকবার দরজায় আঘাতের শব্দ। ঘড়িতে বাজে রাত তিনটা! এত রাতে কে এলো?
“প্রফেসর কামাল আনোয়ার, জলদি দরজা খুলুন।”
গায়ে একটি জামা জড়াতে জড়াতে দরজার কাছে পৌঁছেই জিজ্ঞেস করেন, “কে?”
“স্যার, আমরা লোকাল পুলিশ ডিপার্টমেন্ট থেকে এসেছি। আপনাকে জরুরি দরকার। দরজা খুলুন স্যার; জলদি।” অস্থির হয়ে দরজায় আরেকবার আঘাত করছে কেউ একজন।
চমকে উঠেন প্রফেসর কামাল। পুলিশের লোক তার খোঁজে কেন আসবে? PETA এত দ্রুত একশনে নেমে পড়েছে? পরমুহূর্তেই মনে পড়ে পারমাণবিক বোমা হামলার কথা। কিন্তু এর সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক? দরজা খুলতেই দুইজন পুলিশ অফিসার ভেতরে প্রবেশ করে। সাদা সার্টের উপর কালো কোট চাপানো, আয়নার মতো চকচকে বুট, কানের হেডফোন আর কোমরে আগ্নেয়াস্ত্র।
হাতের ধরে রাখা ব্যাজটি সামনে বাড়িয়ে ধরে একজন বলে, “ডিটেকটিভ এরিক, এই আমার পার্টনার মার্ভিন। স্যার, আপনাকে একটু আমাদের সঙ্গে আসতে হবে।”
“কোথায়? কেন?”
“দুই ঘণ্টা আগে পৃথিবীর এগারোটি জায়গায় একযোগে হামলা হয়েছে। সম্ভবত পারমাণবিক বোমা। আপনার পরিচালিত বায়োকোম ল্যাবও এর মধ্যে একটা। ব্যাপারটা এখন জাতীয় নিরাপত্তা ইস্যু হয়ে গেছে। আপনার মতো বিশ্বসেরা বিশেষজ্ঞদের সাহায্য এখন খুব প্রয়োজন কোনো একটি সংস্থার। আমাদের উপর নির্দেশ এসেছে আপনাকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়ে তাদের হাতে তুলে দেওয়ার। এর বেশি আর বলার সুযোগ নেই এই মুহূর্তে। আপনি কি দশ মিনিটের ভেতর তৈরি হতে পারবেন?”
এলোমেলো পা ফেলে একটা চেয়ার হাতড়ে ধপ করে সেটাতে বসে পড়েন প্রফেসর কামাল। মাথা ভনভন করছে তার। তার ল্যাবে পারমাণবিক বোমা হামলা হয়েছে! ওহ গড!
“স্যার?”
হাত তুলে এজেন্ট এরিককে আস্বস্ত করে প্রফেসর কামাল বলেন, “পাঁচ মিনিটের ভেতর তৈরি হয়ে আসছি।”
মোড়ে মোড়ে পুলিশের চেকপোষ্ট বসানো হয়েছে। চারদিকে ভূতুড়ে নিরবতা বিরাজ করছে; কার্ফিউ বেশ ভালো মতোই কার্যকর করা হয়েছে। রাতের রাস্তায় সাইরেন বাজিয়ে ঝড়ের বেগে ছুটে চলছে কালো কাচের একটি পাজেরো। বিশ মিনিটের মধ্যে প্রফেসর কামালকে নিয়ে গাড়িটি শহর ছাড়িয়ে বাইরে চলে আসে। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই উঁচু পাচিল দিয়ে ঘেরা একটি এলাকার মূল ফটকে এসে পৌঁছে তাদের পাজেরো। গেটে প্রফেসর কামালকে আরেকজনের কাছে সপর্দ করে গাড়ি ঘুরিয়ে চলে যায় এরিক ও তার পার্টনার। সম্ভবত তাদের এখানে প্রবেশাধিকার নেই। এই গভীর রাতেও ভেতরে দিনের আলোর মতো ঝলমল করছে।
গাড়ি থেকে নেমেই দ্রুত পা ফেলে প্রফেসর একটি বড়ো হলরুমে প্রবেশ করেন। ডজনখানেক লোক একটি বড়ো স্ক্রিনের সামনের গোল হয়ে বসানো চেয়ারে বসে আছে। সবার সামনে একটি করে ছোটো কম্পিউটার স্ক্রিন; পাশেই মুখ সমান উচ্চতায় একটি করে মাইক্রোফোন দাঁড়িয়ে।
তালগাছের মতো লম্বা একজন সহাস্যমুখে এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলেন, “আমি স্টিফেন, ডাইরেক্টর স্পেশাল অপারেশন, এনএসএ। এত রাতে আপনাকে বিরক্ত করার জন্যে আন্তরিকভাবে দুঃখিত মিস্টার কামাল।” মুখে দুঃখিত বললেও ডিরেক্টরের আকর্ণ হাসি দেখে মনে হবে খুব মজার কিছু ঘটতে চলছে।
প্রফেসরকে বসতে বলে পাশের চেয়ারে নিজে বসতে বসতে তালগাছ বলেন, “অ্যান্টি-ম্যাটার এর ব্যাপারে কতটুকু জানেন, প্রফেসর?”
আচমকা স্টিফেনে এমন প্রশ্নে খানিকটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে যান প্রফেসর কামাল। পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, “বিশেষ কিছু জানি না; তবে হাইস্কুল লেভেলের ফিজিক্সের কল্যাণে প্রাথমিক জ্ঞান আছে বলতে পারেন।”
সত্যি বলতে আমরাও যে অনেক কিছু জেনে ফেলেছি তা বলব না; ঘটনাটা সকলের জন্যেই একেবারে অনভিপ্রেত। এপর্যন্ত আমরা যা জেনেছি সম্পূর্ণ আপনাকে বিস্তারিত ব্রিফ করছি। আগেই জানিয়ে রাখছি আমি পদার্থবিজ্ঞানের কিছুই বুঝি না; এই বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ জানতে হলে আমাদের পদার্থবিদের সঙ্গে আলোচনার করতে হবে।”
কোনো কথা না বলে গভীর মনোযোগের সঙ্গে ডিরেক্টরের কথা শুনছেন প্রফেসর কামাল। ডিরেক্টরের মুখে এখনো আগের মতো হাসি লেগে আছে। সম্ভবত লোকটার মুখের গঠনই এমন যে মনে হয় সর্বদা হাসছে। কেবল চোখের দৃষ্টিতে একটি নিষ্ঠুরভাব ফুটে আছে। মুখের হাসির সঙ্গে চোখের খুনে দৃষ্টি; অন্তরাত্মা কেঁপে উঠে প্রফেসর কামালের।
“আমাদের এনএসএ-এর এই বিশেষ শাখাটি গঠন করা হয়েছে সম্ভাব্য ভিনগ্রহবাসি হুমকি মোকাবিলা করার জন্যে। অনেক বছর ধরেই আমরা গোপনে কাজ করে যাচ্ছি। তবে বর্তমান সংকটের ব্যাপারে আমাদের আগে থেকে কোনো ধরনের ক্লু ছিল না। ঘটনার আকষ্মিকতায় আমরা সকলে হতবিহ্বল হয়ে গিয়েছি।” হঠাৎ এই পর্যায়ে এসে ডিরেক্টর স্টিফেন মুখ গম্ভীর করে বলেন, “কফি খাবেন?”
মাথা নেড়ে খাবেন না বুঝিয়ে দেন প্রফেসর কামাল। মনের মধ্যে চিন্তার ঝড় বইছে তার। অ্যান্টি-ম্যাটার প্রযুক্তি থেকে এখন এলিয়েনের গল্পে কেন চলে গেলেন স্টিফেন তার কিছুই বুঝতে পারছেন না প্রফেসর কামাল।
“ঘটনার সূত্রপাত এগারো তারিখ রাত বারটায়। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে একটা শক্তিশালী সিগনাল একযোগে রিসিভ হতে থাকে। নাসা সহ বিভিন্ন দেশের স্পেস এজেন্সিগুলোও একই সময়ে সেই সিগনাল পায়। ট্রায়ঙ্গুলেশন পদ্ধতিতে যে কোনো সিগনালের উৎস সহজেই বের করা সম্ভব। ভিন্নভিন্ন দুটি জায়গায় ডাইরেকশনাল এন্টেনার মাধ্যমে একই সিগনাল রিসিভ করে এর কৌণিক মান বের করা হয়। অতঃপর দুইটা কোণের ছেদবিন্দুই হচ্ছে ওই সিগনালের উৎস।”
তালগাছকে থামিয়ে প্রফেসর কামাল বলেন, “ট্রায়ঙ্গুলেশন পদ্ধতি কীভাবে কাজ করে আমার জানা আছে।”
“বাহ! তাহলে তো ভালোই হল। যাই হোক, অবাক বিষয় হচ্ছে ট্রায়ঙ্গুলেশন পদ্ধতিতে কোনোভাবেই সিগনালের উৎস বের করা সম্ভব হচ্ছিল না। কারণ আমরা যতগুলো কোণ পাচ্ছিলাম প্রতিটির মান নব্বই ডিগ্রি; ফলে কোনো ছেদ বিন্দুই পাওয়া যাচ্ছিল না। আমাদের নিজস্ব বেইজ স্টেশন এবং বিভিন্ন সোর্স থেকে আমরা এই ব্যাপারে নিশ্চিত হই যে প্রতিটি দেশের স্পেস এজেন্সি একই সমস্যায় পড়ে। তারপর “সিগনাল স্ট্রেন্থ” পদ্ধতিতে উৎস বের করা হয়। এখানেই লুকিয়ে আছে মহাবিষ্ময়। উৎস বের করার পরই আমরা নিশ্চিত হই এটা ভিনগ্রহবাসিদের পাঠানো সিগনাল।”
ভ্রু কুচকে চোখে প্রশ্ন ফুটিয়ে ডিরেক্টরের দিকে তাকান প্রফেসর কামাল। সবকিছু কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে গেছে। প্রথমে নাসার এলিয়ন সিগনাল পাওয়ার কথা প্রচার করা তারপরই আবার অস্বীকার করা নাসার; আর এখন সারা পৃথিবীজুড়ে পারমাণবিক বোমা হামলা হচ্ছে; স্টিফেন আবার অ্যান্টি-ম্যাটারের কথা বলছে!
“সিগনালগুলো সব জেনারেট হচ্ছিল প্রতিটি রিসিভারের লম্ব বরাবর ভূমি থেকে এগারো কিলোমিটার উপরে ইলেক্ট্রোস্পেয়ার লেয়ার থেকে। পৃথিবীর এই বায়ুমণ্ডলের এই অঞ্চলে মুক্ত ইলেক্ট্রনের ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি। ভিনগ্রহবাসিরা এই ইলেক্ট্রনগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে এখানেই সিগনাল সৃষ্টি করেছে। কোয়ান্টাম পদার্থবিদ লিসা রেন্ড্যালের মতে কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গেলম্যান্টের মাধ্যমে এটা করা যেতে পারে। যদিও এটা কেবল থিয়োরির পর্যায়েই আছে, আমাদের কাছে এই প্রযুক্তি পৌঁছাতে এখনো অনেক দেরি। বায়ুমণ্ডলের এই ইলেক্ট্রোস্পেয়ার লেয়ারের ইলেক্ট্রন এনট্যাঙ্গেলম্যান্টের সিগনাল রিসিভ করার জন্যে যে অতিসূক্ষ্ণ যন্ত্রপাতি দরকার সেগুলো কেবল পাঁচটি দেশের স্পেস এজেন্সির কাছে আছে। এই কারণে পাঁচটি দেশের সরকার ব্যতিত এই এলিয়েন সিগনাল আর কেউ ডিকোড করতে পারেনি।”
চোখ বড়ো বড়ো করে প্রফেসর কামাল বলেম, “ড. লিসা রেন্ড্যালও এখানে আছেন?”
মুখের হাসি একবিন্দু পরিবর্তন না করে ডিরেক্টর বলেন, “অবশ্যই! ওই তো উনি ওখানে বসে আছেন। তাঁকেও এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। গতকাল থেকে তিনি আমাদের সঙ্গে কাজ করছেন।”
“আচ্ছা একটা বিষয় আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না! আপনি বলতে চাইছেন এলিয়েন সিগনাল সত্যি সত্যিই পেয়েছি আমরা, তাহলে নাসা আবার পরে অস্বীকার করল কেন? পারমাণবিক বোমা হামলার পেছনেও তাহলে এই এলিয়েনদেরই হাত আছে?” একদমে কয়েকটি প্রশ্ন করে ফেলেন প্রফেসর কামাল।
প্রফেসর কামালের দিকে পূর্ণদৃষ্টি হেনে স্টিফেন বলেন, “প্রথমত হামলাগুলো দেখতে পারমাণবিক বোমার মতো মনে হলেও রেডিয়েশন পরীক্ষার করে আমাদের এক্সপার্টরা নিশ্চিত হয়েছে যে এগুলো মূলত অ্যান্টি-ম্যাটার বোমা। আর নাসা অতি উৎসাহী হয়ে প্রথমে সিগনালের কথা ফাঁস করে দিয়েছিল; তাদের ভয় ছিল হয়তো নাসার আগে অন্য দেশে সংস্থাগুলো ঘোষণা দিয়ে দিবে। কিন্তু পরে জনগণের উপর এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব ও হুমকির কথা বিবেচনা করে আবার পুরো ব্যাপারটা অন্যদিকে মোড় দিয়ে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছে।”
এবার অনেক কিছুই পরিষ্কার হয়ে যায় প্রফেসর কামালের কাছে। তবে কিছুতেই ভেবে পাচ্ছেন না এত রথি-মহারথি থাকতে এই বিপর্যয়ের সময় তাকে কেন এখানে আনা হয়েছে?
প্রফেসরের মনের কথা ধরতে পেরে মুখে পূর্বের মতো হাসি ধরে রেখে ডিরেক্টর বলেন, “আজ রাত দুইটায় পৃথিবীর সবচেয়ে গোপন ও সুরক্ষিত এগারোটি জায়গায় হামলা হয়েছে এর মধ্যে একটি আপনার বায়োকম ল্যাব। এর বারো ঘণ্টা আগে একইভাবে তেরোটি জায়গায় হামলা হয়েছে। আমাদের জানা তথ্য অনুযায়ী বায়োকমে প্রাণী জগতের কোয়ান্টাম কমিউনিকেশন নিয়ে গবেষণা করা হয়। এটি একটি নন-মিলিটারি রিসার্চ সেন্টার; বাদবাকি যে তেইশটি জাগায় হামলা হয়েছে সেগুলো বিভিন্ন দেশের মিলিটারি রিসার্চ সেন্টার অথবা গোপন কোনো মিলিটারি বেস। তাহলে বায়োকম ল্যাবে বিশেষ কী আছে যে হামলার শিকার হল? আর আপনি বর্তমান বিশ্বে প্রথম সারির কয়েকজন বায়ো-কোয়ান্টাম বিজ্ঞানীদের মধ্যে একজন। আপনার অভিজ্ঞতা ও উপদেশ আমাদের এখন খুব কাজে আসবে।”
সকলের উদ্দেশে উচ্চস্বরে বলেন ডিরেক্টর, “ওকে, আমাদের মাঝে এখন উপস্থিত হয়েছেন প্রফেসর কামাল; বায়ো-কোয়ান্টাম জগতের আইনস্টাইন। এখন থেকে উনি আমাদের টিমের একজন সদস্য হয়ে কাজ করবেন।” তারপর খানিকটা বিরতি নিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে শূন্যে প্রশ্ন ছুড়ে দেন, “বয়েজ, নতুন কোনো মেসেজ? কোনো আপডেট?”
মুখ হাসি হাসি করে অধীনস্তদের ধমকাচ্ছেন; বড়ো হলরুমের এক কোণ থেকে আরেক কোণে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, ক্ষণে ক্ষণে কারও পিঠ চাপড়ে দিচ্ছেন আবার কখনো কখনো টেবিলের উপর গায়ের জোরে চাপড় মারছেন দেখতে তালগাছের মতো লম্বা কিন্তু আচরণে বটবৃক্ষের মতো এই সেন্টারের প্রধান ব্যক্তি, ডিরেক্টর স্টিফেন।
হঠাৎ করেই রিত্তিকার কথা মনে পড়ে প্রফেসর কামালের। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় বলেছিল ঠিকঠাক মতো পৌঁছে যেন কল করে জানায়। পকেট থেকে মোবাইল বের করে দেখেন নেটওয়ার্কে নেই! সম্ভবত সিগনাল ব্লক করা। হতাশ হয়ে মোবাইলটি পুনরায় পকেটে পুরে ফেলেন। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ অপেক্ষা করে অতঃপর পায়ে পায়ে পদার্থবিদ লিসা রেন্ড্যালের দিকে এগিয়ে যান প্রফেসর কামাল।
ড. লিসা রেন্ড্যাল; বর্তমান সময়ের সেরা কোয়ান্টাম পদার্থবিদদের মধ্যে একজন। হালকা প্রসাধনির সঙ্গে পরিপাটি পোশাক; সোনালি সিল্কি চুল; নীল চোখ সব মিলিয়ে অভিজাত্য ফুঁড়ে বের হচ্ছে যেন। ষাটোর্ধ এই পদার্থবিদকে গভীর রাতের এই টানটান চাপা উত্তেজনাময় পরিবেশেও বেশ সতেজ ও ঝরঝরে লাগছে।
নিজের পরিচয় দিয়ে প্রফেসর কামাল জিজ্ঞেস করেন, “সম্পূর্ণ ব্যাপারটা খুব দ্রুত ঘটছে, তাই না?”
ঠোঁটদুটো ভাঁজ করে মুখের ভেতর কিঞ্চিত ঢুকিয়ে দাঁত দিয়ে কামড়ে নিয়ে নিরবে মাথা নাড়েন ড. লিসা।
“পুরো ব্যাপারটা কি হোক্স হতে পারে? হয়তো কোনো দেশ গোপনে প্রযুক্তিগত কিছু অগ্রগতি অর্জন করে পুরো বিশ্বকে খেলা দেখাচ্ছে?”
কপালের উপর চলে আসা এক গাছি সিল্কি চুল সরিয়ে গম্ভীর ভঙ্গিতে ড. লিসা বলেন, “প্রথমে আমরা এমনটাই ভেবেছিলাম। কিন্তু সিগনালের উৎস বের করার পর কিছুটা নিশ্চিত হয়েছি। আর হামলার ধরণ দেখে শতভাগ নিশ্চিত হয়েছি। প্রথমত, সিগনালগুলো আমাদের রিসিভারের ঠিক উলম্ব বরাবর তৈরি হচ্ছে। সমগ্র পৃথিবীতে একই সময়ে একই ভাবে ঘটছে, তার মানে এটা ওয়েভ ফাংশন হিসাবে সৃষ্টি হচ্ছে; এবং যখনই আমরা ডিটেক্ট করতে যাচ্ছি তখনই ওয়েভ ফাংশন কলাপ্স করে আমাদের রিসিভারে রিসিভ হচ্ছে। আমাদের হাতে এই ধরনের সিগনাল তৈরি করার প্রযুক্তি এখনো এসে পৌঁছাইনি। দ্বিতীয়ত, যে হামলাগুলো হয়েছে সেখানে মাইক্রো-অ্যান্টিম্যাটার ব্যবহার হয়েছে। এই অ্যান্টিম্যাটার বোমা হামলাগুলো এত সূক্ষ্মভাবে করা হয়েছে যে ভাবাই যায় না!” চোখেমুখে সশ্রদ্ধ উচ্ছাস ড. লিসার।
“প্রতিটি হামলা করা হয়েছে ঠিক সীমানা প্রাচীর ঘেষে অথবা খোলা ময়দানে। হামলার স্থানে প্রায় এগারো মিটার ব্যাসের একটি করে গর্ত তৈরি হয়েছে। মনে হচ্ছে হামলাগুলো ছিল অনেকটা ওয়ার্নিং, কোনো মানুষ হত্যা করা হয়নি, কোনো ভবন ধ্বংস হয়নি। ভাবা যায়? এখন নিশ্চিত করেই বলা যায় এত বছর পর এই প্রথম আমরা এলিয়েনের খোঁজ পেয়েছি। তবে হামলাগুলো কোথা থেকে করা হচ্ছে কিংবা স্পেসশিপ বা কোনো ভেসেলের খোঁজ এখনো আমরা পাইনি।”
“আচ্ছা, যে এগারোটি ও তার আগে তেরোটি জায়গায় হামলা করা হয়েছে এদের মধ্যে কোনো প্যাটার্ন কি পাওয়া গেছে?” দুইদিন শেভ না করা খোঁচা খোঁচা দাড়ি চুলকে নিয়ে জিজ্ঞেস করেন প্রফেসর কামাল।
“কেবল একটি ব্যতিত সবগুলোই বিভিন্ন দেশের গোপন মিলিটারি রিসার্চ সেন্টার। এই বিষয়টিও বেশ অবাক করার মতো। এলিয়েন সিগনাল আমরা পেয়েছি কেবল দুই দিন হল; কিন্তু এত কম সময়ে তারা কীভাবে এই সেন্টারগুলো খুঁজে পেল!”
কিছু একটা বিষয় মনে মধ্যে খচখচ করছে। খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি ক্লু তার চোখ এড়িয়ে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে প্রফেসর কামালের।
আচমকা সামনের সারির একজন চিৎকার করে বলে উঠে “আবারও কয়েকটি জায়গায় হামলা হয়েছে! বিস্তারিত সার্ভারে আপলোড করা হচ্ছে!”
দ্রুত নিজের চেয়ারে ফিরে এসে সার্ভারে লগইন করে সদ্য হামলার বিষয়ে বিস্তারিত তথ্যগুলোতে চোখ বুলাতে থাকেন। প্রতি মুহূর্তে নতুন তথ্য ও নতুন জায়গার নাম যুক্ত হচ্ছে। আধ ঘণ্টার মধ্যে সব আপডেট শেষ হলে দেখেন এবার সতেরোটি স্থানে হামলা হয়েছে। এবারও প্রতিটি গোপন সামরিক ঘাঁটি, এর মাঝে আগের হামলাকৃত কিছু জায়গাও আছে। কিন্তু এলিয়েনরা বেছে বেছে সামরিক স্থানগুলোতে হামলা করছে কেন? তারা কি পৃথিবীকে অস্ত্রমুক্ত করতে চাচ্ছে? আর এগুলোকে খুঁজেই বা পাচ্ছে কী করে? তাদের কাছে তো আর ইন্টেলিজেন্স তথ্য নেই! প্রতিটি জায়গার ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য তারা পাচ্ছে কী করে?
ক্লান্তিতে শরীর ভেঙে আসছে প্রফেসর কামালের; ডান হাতে ভ্রু এর উপর কিছুক্ষণ মালিশ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেন। আপনাতেই আবেশে চোখ দুটি বন্ধ হয়ে আসে তার। তন্দ্রার মতো কিছুক্ষণ আধো ঘুম আধো জাগরনের জগতে বিচরণ করেন। আচমকা চোখ খুলে লাফিয়ে দাঁড়িয়ে যান প্রফেসর কামাল। এইমাত্র তিনি বুঝতে পেরেছেন কী করে হামলার স্থানগুলোকে বাছাই করছে এলিয়েনরা। ভয়ের একটা শীতল ধারা বিদ্যুতের মতো খেলে যায় তার শরীরে; কেবল অনুধাবন করেছে যে যে কোনো সময় এই স্থানেও হামলা হতে পারে!
[অধ্যায় ছয়]
অস্থির হয়ে ডিরেক্টর স্টিফেনের খোঁজ করতে থাকেন প্রফেসর কামাল। বিশাল বড়ো হলরুমের এক কোণে সাড়ে ছয় ফুটের উচ্চতার ডিরেক্টর হাসি মুখে পাঁচ ফুটি একজনকে ধমকাচ্ছিলেন। প্রায় উড়ে তার কাছে পৌঁছান প্রফেসর কামাল।
মাথার পেছনের অদৃশ্য চোখ দিয়ে যেন প্রফেসর কামালকে তার কাছে আসতে দেখেন স্টিফেন। ঘুরেই জিজ্ঞেস করেন, “আপনি কী কিছু বলবেন?”
“আমি ধরতে পেরেছি এলিয়েনরা কীভাবে হামলার লক্ষবস্তু চিহ্নিত করছে।”
শীতল দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ প্রফেসর কামালের চোখে চোখে তাকিয়ে থাকেন স্টিফেন। অতঃপর নীচুস্বরে করে বলেন, “চলুন, আপনার ডেস্কের দিকে যেতে যেতে শোনা যাক।”
“আমার বায়োকম ল্যাবে বিশেষ ফ্যারাডে-কেইজ সেটাপ করা আছে। সেই অংশে কোনো ধরনের রেডিয়ো সিগনাল কিংবা ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক সিগনাল বাইরে যেতে পারে না; বাইরে থেকে আসতেও পারে না। এখন মহাশূন্য থেকে যদি কোনো সিগনাল পাঠিয়ে স্ক্যান করা হয়, তাহলে এই অংশটি থেকে কোনো সিগন্যাল প্রতিফলিত হবে না; সেক্ষেত্রে এগুলো শূন্য দেখাবে। অনেকটা আমাদের চোখে দেখার সঙ্গে তুলনা করলে অন্ধকার গহ্বরের মতো দেখাবে। এলিয়েনরা এই সব অন্ধকার অঞ্চল বের করে করে হামলা চালাচ্ছে। তাদের কী উদ্দেশ্য সেটা এখনো জানি না, কিন্তু মনে হয় না আমাদের ধ্বংস করে দেওয়ার জন্যে তারা এসেছে! তারা কেবল ফাঁকা স্থানে হামলা করছে। আমার ধারণা এই ঘাঁটিটিও ফ্যারাডে-কেইজ দিয়ে সুরক্ষিত। যে কোনো সময় এই জায়গার আশপাশে হামলা হবে।” একটানে সম্পূর্ণ বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন প্রফেসর কামাল।
এক মুহূর্ত দেরি না করে ডিরেক্টর ফোন তুলে দ্রুত কিছু নির্দেশ দেন। ফোন রেখে প্রফেসর কামালের দিকে তাকিয়ে বলেন, “সিগনাল ব্লকিং সিস্টেম অফ করে দেওয়া হচ্ছে। আর কিছু বলবেন?”
“এলিয়েনদের সঙ্গে যোগাযোগ করার কোনো উপায় কি বের করা গেছে?”
“তারা ইচ্ছামতো আমাদের অ্যাটমোসফিয়ার ব্যবহার করে ইলেক্ট্রো-ম্যাগনেটিক সিগনাল পাঠাচ্ছে। আমরা কিছু এনকোডেড সিগনাল পাঠিয়েছি, কিন্তু কোনো জবাব পাচ্ছি না। সম্ভবত তারা আমাদের সিগনাল ডিকোড করতে পারেনি। তাদের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়ে কাজ করছেন ড. লিসা রেন্ড্যাল।”
চুপ করে কিছু একটা ভাবেন প্রফেসর কামাল। গলা শুকিয়ে এসেছে, টেবিলের উপর রাখা বোতল হতে দুই ঢোক পানি গলায় ঢেলে বলেন, “এনকোডিং না করে সাধারণ মেসেজ পাঠালেই তো হয়!”
“তখন পৃথিবীর সবাই একযোগে আমাদের মেসেজ শুনতে পাবে; সেক্ষেত্রে সব জায়গায় বিশৃঙ্খলা দেখা দিবে। এ বিষয়ে বিস্তারিত খুঁটিনাটি ড. লিসা রেন্ড্যালের সঙ্গে আলাপ করে জানতে পারেন। আপনার কোনো উপদেশ থাকলেও জানাতে ভুলবেন না।” লম্বা দম নিয়ে যোগ করেন, “যাক, অন্তত আপনার ল্যাবে কেন হামলা হয়েছে সেটা তো পরিষ্কার হল। ওয়েল ডান প্রফেসর।” বলেই সামনের দিকে চলে যান ডিরেক্টর।
স্টিফেন চলে যেতেই প্রফেসর কামাল ড. লিসা রেন্ড্যালের দিয়ে এগিয়ে যান। ড. লিসা পাঁচজনের একটি ছোটো দল নিয়ে কম্পিউটারে কিছু একটা কাজ করছিলেন। প্রফেসর কামালকে দেখেই হাসি দিয়ে বলে উঠেন, “প্রফেসর কামাল, স্টিফেনের কাছে শুনলাম আপনি এলিয়েনদের হামলার লক্ষ্যবস্তু বাছাইয়ের পদ্ধতি বের করে ফেলেছেন। এত দ্রুত এই প্যাটার্নটি ধরে ফেলেছেন ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।”
প্রশংসায় গলে না গিয়ে প্রফেসর কামাল জিজ্ঞেস করেন, “ড. লিসা, এলিয়েনদের সঙ্গে যোগাযোগের কোনো উপায় কি বের করা গেছে?”
টানা কয়েকদিন ভীষণ মানসিক চাপে থাকার কারণে ড. লিসাকে কিছুটা বিধ্বস্ত দেখাচ্ছে। চোখেমুখে কিছুটা হতাশার ভাব ফুটিয়ে তুলে বলেন, “বেশ কিছু জটিল সমস্যা ও প্রশ্নের দেখা দিয়েছে। এইগুলো সমাধান না করা পর্যন্ত নিশ্চিত করে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যাচ্ছে না। এলিয়েনরা আমাদের চেয়ে প্রযুক্তিতে অনেক অনেক অগ্রসরমান। এদেরকে সাবধানে হ্যান্ডেল করতে হবে।”
“যেহেতু তারা আমাদের খুঁজে বের করে এখান পর্যন্ত পৌঁছে গেছে সেক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে ধরেই নেওয়া যায় তারা আমাদের চেয়ে প্রযুক্তিতে এগিয়ে আছে। তবে প্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকা মানেই কিন্তু বুদ্ধিমত্তায় উপরের স্তরে, সেটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। প্রাণীজগতে অনেক প্রাণী আছে যাদের মস্তিষ্ক মানুষের চেয়ে বড়ো, নিউরনের সংখ্যাও অনেক গুণ বেশি। আবার তাদের এমন কিছু সক্ষমতা আছে যা আমরা কল্পনাও করতে পারি না। কিন্তু তবুও মানুষই এই গ্রহে সভ্যতার গোড়াপত্তন করতে পেরেছে, কারণ প্রতিপক্ষের দুর্বলতা বের করে সেখানে মোক্ষম আঘাত হানতে পারার সক্ষমতা। প্রত্যেক প্রাণীরই কিছুর দুর্বলতা আছে। এখন এই এলিয়েনদের দুর্বলতা খুঁজে বের করতে পারলেই আমরা তাদের উপর কতৃত্ব করতে পারব।”
“সেটা না হয় বুঝলাম; কিন্তু তার আগে তো এদের খুঁজে বের করতে হবে। এখন পর্যন্ত কোনো স্পেসশিপের দেখা পাওয়া যায়নি। আমরা প্রতিটি দেশের স্পেস এজেন্সির সঙ্গে প্রতিমুহূর্তে যোগযোগ রাখছি। সত্যি বলতে যে হামলাগুলো হয়েছে সেগুলো কীভাবে করেছে সে ব্যাপারেও আমরা এখনো অন্ধকারে। কেবল রেডিয়েশনের মাত্রা পরীক্ষা করে বের করা গেছে যে এগুলো অ্যান্টিম্যাটার বোমা। এ থেকে ধারণা করা যাচ্ছে যে যুদ্ধাস্ত্র ও ধ্বংসাত্মক প্রযুক্তিতেও তারা অনেক এগিয়ে। তার উপর একটা বিষয় খেয়াল করেন, আমরা প্রথম সিগনাল পেয়েছি দুইদিন আগে। তখন এর কোনো অর্থ বের করা সম্ভব হয়নি। ঠিক বার ঘণ্টা পর আরেকটা মেসেজ আসে ঠিক আমাদের ভাষায়। তার মানে এই অল্প সময়ের ভেতর তারা আমাদের ভাষা আয়ত্ত করে ফেলেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, যে অঞ্চল থেকে সিগনালটা রিসিভ করা হচ্ছে ঠিক সেই এলাকার ভাষাতেই সিগনালটা শোনা যাচ্ছে। ব্যাপারটা এমন যে, তারা সব ভাষায় ট্রান্সমিট করছে কিন্তু রিসিভারে এসে একটি ভাষায় কেবল রিসিভ হচ্ছে। সম্ভবত সবগুলো ভাষা সুপারপজিশনে আছে, অনেকটা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ওয়েভ ফাংশন ভেঙে গিয়ে একটি পার্টিক্যাল ডিটেক্ট হওয়ার মতো।”
“খুবই ভয়ংকর বিষয়!” ভ্রু কুচকে মাথা নাড়েন প্রফেসর কামাল। “তবে কী তাদের সঙ্গে যোগাযোগের কোনো পন্থাই নেই?”
“আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। যদি শেষ পর্যন্ত কোনো পদ্ধতি বের করা সম্ভব না হয় তবে অ্যাটমোস্ফিয়ারে সাধারণ রেডিয়ো সিগনালের মাধ্যমে কিছু মেসেজ পাঠিয়ে দেব।”
“একটা বিষয় খেয়াল করেছেন নিশ্চয়?”
চোখ প্রশ্নবোধক ভাব ফুটিয়ে প্রফেসর কামালের দিকে তাকিয়ে থাকেন ড. লিসা।
“তারা প্রথমে আমাদের কাছে কাউকে একটা উদ্ধারের বার্তা জানিয়েছে, তারপর হামলা করছে। কিন্তু কোনো মানুষকে হত্যা করেনি, কোনো অস্ত্রশস্ত্র ধ্বংস করেনি, এমনকি কোনো স্যাটেলাইটও ফেলে দেয়নি। আমাদের যোগাযোগ ব্যাবস্থা যাতে বাধাপ্রাপ্ত না হয় সেই কারণে ইলেক্ট্রোস্পেয়ার লেয়ারের ইলেক্ট্রনের মাধ্যমে বার্তা পাঠাচ্ছে। এসব দেখে মনে হচ্ছে তাদের উদ্দেশ্য নেহাত খারাপ কিছু নয়। হয়তো তাদের বার্তা আমরা বুঝতে পারছি না, ভাবের আদান প্রদানের ক্ষেত্রে প্রজাতিগত পার্থক্য অনেক বিশাল কিছু। আমরা কী এত বছরেও অন্য কোনো প্রাণীর ভাষা আয়ত্ব করতে পেরেছি? এবার বুঝুন! বিষয়টা কতটা জটিল!”
“ঠিক বলেছেন। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারলে সুবিধা হত। কিন্তু!”
“আমার মনে হয় পৃথিবীর যতগুলো সেন্টারে সিগনাল ব্লকিং ব্যবস্থা করা আছে সেগুলোকে নিষ্ক্রিয় করে দিলে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ সহজ হয়ে যাবে। এমনও তো হতে পারে তারা সমগ্র পৃথিবীকে স্ক্যান করে শুধু এই অন্ধকার অঞ্চলগুলোর ব্যাপারে কোনো তথ্য পায়নি বলে এগুলোকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে করছে। যদি এই অঞ্চলগুলোকেও উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়, সেক্ষেত্রে তারা যদি দেখে ভয়ের কিছু নেই; তখন হয়তো তাদের দেখা পাওয়া যাবে। হয়তো তারা খুব কাছাকাছি কোথাও লুকিয়ে আছে। নিরাপদ মনে করলেই কেবল পৃথিবীতে নেমে আসবে। বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে আত্মরক্ষার প্রবণতা হচ্ছে একেবারে প্রাথমিক বিষয়।”
কপালে চিন্তার ভাঁজ, দ্রুত গতিতে চিন্তা চলছে ড. লিসার মাথায়। কিছুক্ষণ ভেবে বলেন, “আপনার যুক্তি অকাট্ট, কিন্তু নিরাপত্তা নিয়ে প্রায় সব দেশের এজেন্সিগুলো সাইকোপ্যাথের মতো আচরণ করে। সবাইকে মনে করে প্রতিপক্ষ এবং সম্ভব্য চক্রান্তকারী। তাদের আস্থা অর্জন করে গোপন মিলিটারি বেস কিংবা গবেষণাগারের অবস্থান উম্মুক্ত করা সম্ভব হবে কী না জানি না। আর একটা সমস্যা আছে, হঠাৎ করে সিগনাল আদান-প্রদান চালু করে দিলে সেসব সেন্টার থেকে গোপন তথ্য, গবেষণার ফলাফল পাচার হয়ে যেতে পারে। তবে আমি স্টিফেনকে আপনার উপদেশের কথা জানাচ্ছি। স্টিফেন প্রতিমুহূর্তে ডিফেন্স সেক্রেটারির এবং জাতিসঙ্ঘের মহাসচিবের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে। আমার ধারণা সব দেশের প্রেসিডেন্ট এবং সিকিউরিটি কাউন্সিলও একইভাবে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় আছে।”
বেশ কিছুক্ষণ অতিবাহিত হয়ে গেছে স্টিফেন পাশের রুমে অনলাইনে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করছেন। বাইরে অস্থির হয়ে অপেক্ষা করছেন প্রফেসর কামাল; পাশেই বসে আছেন ড. লিসা রেন্ড্যাল।
“আপনার কী মনে হয় প্রেসিডেন্ট বাকি সবাইকে রাজি করাতে পারবেন?” নিরবতা ভেঙের জিজ্ঞেস করেন প্রফেসর কামাল।
“জানি না। জাতিসঙ্ঘের সিকিউরিটি কাউন্সিলের জরুরি সভা চলছে; সেখানে আমাদের অভিমত তুলে ধরেছেন ডিফেন্স সেক্রেটারি। তাকে আড়াল থেকে সহযোগীতা করেছেন স্টিফেন। দেখা যাক বিশ্বনেতৃত্বের শুভবুদ্ধির উদয় হয় কী না!” একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন ড. লিসা।
“আপনার কী সত্যি মনে হয়ে এই এলিয়েনরা আমাদের চেয়ে বুদ্ধিমান?”
তড়িৎ ঘাড় ঘুরিয়ে প্রফেসর কামালের দিকে তাকান ড. লিসা। তার দৃষ্টিতে অকৃত্রিম বিষ্ময়। “এখনো আপনার মনে হচ্ছে না যে তারা আমাদের চেয়ে বুদ্ধিমত্তায় যোজন যোজন এগিয়ে?”
ঠোঁটের কোণে শুকনো একটা হাসি ফুটিয়ে প্রফেসর কামাল বলেন, “আমার মতে বুদ্ধিমত্তা কোনো সরলরৈখিক স্কেল দিয়ে মাপা সম্ভব নয়। আমার মতে এটি একটি গাছের মতো, নানান দিকে এর ডালপালা-পত্র-মূল বিস্তৃত। শিকড় মাটির নীচে থাকলেও শীর্ষ পত্র কিংবা কাণ্ডের চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।”
“হ্যাঁ, আপনার কথা মেনে নিচ্ছি; কিন্তু মাত্র কয়েক ঘণ্টার ভেতর আমাদের সবগুলো ভাষাকে আয়ত্বে নিয়ে আসা। তারপর সমগ্র পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ব্যাবহার করে ইলেক্ট্রোস্পেয়ার লেয়ারের ইলেক্ট্রন এনট্যাঙ্গেলম্যান্ট-এর মাধ্যমে সিগনাল পাঠানো এবং সবশেষে নিজেদের এখন পর্যন্ত সফলতার সঙ্গে লুকিয়ে রাখতে পারা; এসব বিবেচনায় নিলে কী মনে হয় না তারা অনেক অনেক অগ্রসরমান?”
বলার কিছু না পেয়ে চুপ করে থাকেন প্রফেসর কামাল।
কিছুক্ষণ পর ড. লিসা বলেন, “অন্তত কোয়ান্টাম প্রযুক্তিতে তারা অনেক অনেক দূর এগিয়েছে। আমাদের কাছে যে বিষয়গুলো এখন পর্যন্ত থিয়োরি পর্যায়ে আছে তারা সেগুলোকে বেশ ভালোভাবেই প্রয়োগ করছে। সবচেয়ে ভয়ের কথা হচ্ছে, কোয়ান্টাম ম্যাকানিক্স প্রযুক্তি কাজ করে মৌলিক ক্ষুদ্রতম কণাগুলোর ক্ষেত্রে। খানিকটা বড়ো কোনো বস্তুর ক্ষেত্রে আমরা এখনো নিউটনিয় ক্লাসিক্যাল মেকানিক্স ব্যবহার করি। কিন্তু মনে হচ্ছে তারা যে কোনো লেভেলেই এই কোয়ান্টাম মেকানিক্সের প্রয়োগ করতে পারছে। এটাই সবচেয়ে ভয়ের কারণ।”
“কেন?”
“সেক্ষেত্রে দেখা যাবে; আমরা যদি তাদের স্পেসশিপের অবস্থান খুঁজে বের করতে পারি তবুও নির্দিষ্ট করে হামলা করতে পারব না। হয়তো সুপারপজিশনের কারণে একই স্পেসশিপ একই সময়ে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় থাকবে। আমার তো মনে হচ্ছে তারা এতদূর পথ পাড়ি দিয়ে এখানে আসেইনি, তাদের গ্রহ থেকে ওয়েভ ফাংশনের মতো প্রপাগেট করে এখানে একটা ইফেক্ট নিয়ে হাজির হয়েছে!”
ভয়ের শরীরে কাঁটা দিয়ে ওঠে প্রফেসর কামালের। এতক্ষণ তো মনে হচ্ছিলো শত্রুপক্ষ অনেক শক্তিশালী; এখন দেখা যাচ্ছে শুধু শক্তিশালীই নয়; অদৃশ্যও!
[অধ্যায় সাত]
হাসতে হাসতে দরজা দিয়ে বের হয়ে আসেন স্টিফেন। তার হাসিমুখ দেখে বুকটা ধক করে কেঁপে উঠে ড. লিসার। পরিস্থিতি যত বেশি শোচনীয় হয় স্টিফেনের মুখের হাসি ততই বিস্তৃত হয়। তবে কী কোনো ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারেনি বিশ্ব নেতৃত্ব?
“আপনাদের রেকমেন্ডশন মিটিং-এ তুলে ধরেছি। সিকিউরিটি কাউন্সিলভুক্ত দেশগুলোর অ্যাম্বাসেডরগণ সবাই ছিলেন মিটিং-এ। তবে যেমনটি অনুমান করেছিলাম, বেশ কয়েকটি দেশ জাতীয় নিরাপত্তার ধুয়ো তুলে বিরোধীতা করার চেষ্টা করেছে।”
উদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে ড. লিসা জিজ্ঞেস করেন, “ফাইনালি কী হল?”
“সবশেষে আমি বলেছি, দেখুন আপনারা স্ব স্ব গবেষণাগার কিংবা সামরিক বেসের সিগনাল ব্লকিং বন্ধ করে দিতে পারেন, নাও পারেন; পুরোটাই আপনার ইচ্ছাধীন। তবে আমি এটা নিশ্চিত করে বলতে পারি পরবর্তী হামলার লক্ষ্যবস্তু হিসাবে ওই গোপন জায়গাগুলোর নাম লিস্টে ঢুকিয়ে নিতে পারেন। আর এখন পর্যন্ত কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। এলিয়েনরা খুব সতর্কতার সঙ্গে কেবল আশপাশে হামলা করছে। কিন্তু বেশির ভাগ গোপন সেন্টার উন্মুক্ত হয়ে যাওয়ার পর বাকি যে কয়টা থাকবে, সেগুলোকে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে তারা আরো বড়ো ধরনের হামলা চালাতে পারে। সেক্ষেত্রে গোপন বেস আর গোপন তো থাকবেই না, মাঝখান দিয়ে মার খেলেন; এই আর কী! এখন আপনারা ভেবে দেখেন।” বলেই হো হো করে হেসে উঠেন স্টিফেন। হাসি থামিয়ে পরমুহূর্তে বলেন, “কয়েকজনের চেহারা যা হয়েছিল না! মনে হচ্ছিল প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলেছে। হা হা হা।”
স্টিফেনের রসিকতাকে পুরো উপেক্ষা করে প্রফেসর কামাল বলেন, “ফাইনালি কি তারা রাজি হয়েছে?”
“না। এখনো হয়নি। ঘণ্টা খানেক সময় চেয়েছে। ছয় ঘণ্টা পর আবার মিটিং বসবে।”
“নতুন মেসেজ এসেছে! নতুন মেসেজ এসেছে!” একজন অপারেটরের চিৎকারে চমকে উঠে সকলে। দ্রুত স্পিকারে মেসেজটি চালানোর নির্দেশ দিয়ে সেদিকে কান খাড়া করে অপেক্ষা করতে থাকেন স্টিফেন।
“নির্দেশ না মানলে সবগুলো কয়েদখানায় একযোগে হামলা করা হবে।”
“মনে হচ্ছে এলিয়েন হারামজাদাগুলো হামলা চালানোর জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে।” যথারীতি হাসি হাসি মুখ করে বলেন স্টিফেন।
“কিন্তু তারা বারবার কয়েদীদের মুক্তির কথা বলছে কেন? আমার তো এখন মনে হচ্ছে তাদের পাঠানো বার্তা নিয়ে আমাদের বেশি করে মাথা ঘামানো উচিত!”
“আমাদের এই ডিভিশনের দায়িত্ব কেবল ভিনগ্রহীদের হামলার মোকাবেলা করা। তবুও আমরা ড. লিসার টিমের মাধ্যমে যোগাযোগের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তবে তাদের পাঠানো বার্তে নিয়ে সরকারের একাধিক সংস্থা কাজ করছে; এর মধ্যে নাসাও আছে। সংস্থাগুলোর মধ্যেও পারস্পরিক প্রতিযোগিতার পাশাপাশি ইঁদুর-বিড়াল খেলাও চলে। সত্যি বলতে এ-পর্যন্ত যা যা করতে পেরেছি সবই আমার ব্যক্তিগত প্রভাব প্রতিপত্তি এবং ডিফেন্স সেক্রেটারির সঙ্গে ব্যক্তিগত সুসম্পর্কের কারণে।” কণ্ঠে কিছুটা ক্ষোভের আভাস স্পষ্ট হয়ে ওঠে স্টিফেনের।
“কিন্তু তারা বারবার কয়েদি বলতে কাদের বোঝাচ্ছে? এ ব্যাপারে আমার মনে একটা সন্দেহ উঁকি দিচ্ছে!”
চকিতে প্রফেসর কামালের দিকে ফিরে চোখে প্রশ্নবোধক ভাব ফুটিয়ে তাকিয়ে থাকেন।
“আচ্ছা, এই ডিভিশনের চোখ ফাঁকি দিয়ে আরো আগে কি এলিয়েনদের সঙ্গে যোগাযোগের কোনো ঘটনা ঘটে থাকতে পারে?”
প্রফেসরের করা প্রশ্নটি পুরোপুরি উপলব্ধি করতে কিছুটা সময় নেন স্টিফেন। মনে মনে চমকে ওঠেন তিনি। “সম্ভাবনা কম। এই ডিভিশনকে ফাঁকি দিয়ে এই আমেরিকার মাটিতে অন্য কেউ এলিয়েন ইন্টারেকশন নিয়ে কাজ করবে সেটা সম্ভব নয়। অন্য দেশের মাটিতে গোপন কোনো সংস্থার দ্বারা সম্ভব হলেও হতে পারে।” কণ্ঠে আত্মবিশ্বাসের কিছুটা ফাটল লুকানোর কোনো চেষ্টা করেননি স্টিফেন।
“আমার মনে হচ্ছে আগেও পৃথিবীতে এলিয়েন এসেছিল এবং তাদেরকে কোনো গোপন স্থানে আটকে রাখা হয়েছে। সম্ভবত এদেরকে ছাড়িয়ে নিতেই তারা এই হুমকি দিচ্ছে। তারা যেসব জায়গায় হামলা করছে হয়তো মনে করছে সেখানেই তাদের আটকে রাখা হয়েছে। এই কারণেই তারা সরাসরি ভবনে হামলা না করে আশপাশে হামলা করছে; কোথাও হতাহতের খবরও পাওয়া যাচ্ছে না। তারা আমাদের না, নিজের রক্ষা করছে!” ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে পেরে মুহূর্তেই রক্ত সরে গিয়ে সাদা হয়ে যায় প্রফেসর কামালের মুখমন্ডল।
প্রফেসর কামালের মুখন্ডলের আকষ্মিক পরিবর্তন চোখ এড়ায়নি স্টিফেনের। তড়িৎ জিজ্ঞেস করেন, “আপনি কি ভয়ংকর কোনো কিছুর আশংকা করছেন?”
চিন্তিত ভঙ্গিতে প্রফেসর কামাল বলেন, “তারা টার্গেটগুলোতে সরাসরি হামলা করছে না কারণ নিজেদের রক্ষা করার জন্যে; কিন্তু যদি সব গোপন সেন্টার থেকে সিগনাল জ্যামিং তুলে দেওয়া হয় তখন তারা হয়তো সহজেই বুঝতে পারবে কোথায় এলিয়েনদের আটকে রাখা হয়েছে, তখন হয়তো বাকি কেন্দ্রগুলোতে অথবা অন্যান্য সামরিক স্থাপনায় সর্বাত্মক হামলা চালাতে পারে!”
“হ্যাঁ! এই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে আপনার এই যুক্তির মূলে রয়েছে এক বা একাধিক এলিয়েনকে পৃথিবীর কোথাও আটকে রাখা হয়ছে এই পয়েন্টকে সত্য ধরে নিয়ে, কিন্তু এমনটা তো নাও হতে পারে।” মুহূর্ত দেরি না করে বলেন স্টিফেন।
নিশ্চিত করে কিছুই বলা যাচ্ছে না। এরিয়ার-৫১ নিয়ে অনেক ধরনের কন্সপিরেসি থিয়োরি জনমনে প্রচলিত আছে। সেগুলোকেও কিন্তু এখন একেবারে ফেলে দেওয়া যাচ্ছে না। আমি পরীক্ষা করে দেখেছি এরিয়া-৫১ অঞ্চলে এখন পর্যন্ত হামলা হয়নি। আমার জানা মতে সেখানে কিছু ল্যাব আছে যেখানে সিগনাল জ্যামিং সিস্টেম কার্যকর। যদি আমাদের পরামর্শ না মেনে এখনো সিগনাল জ্যামিং তুলে না নেয় আর সেখানে হামলা হয় তাহলে আমার ধারণার পক্ষে একটি শক্ত যুক্তি দাঁড়াবে।”
পিনপতন নিঃস্তদ্ধতা রুম জুড়ে, কেবল উপস্থিত শ’খানেক বিজ্ঞানী-টেকনিশিয়ান-এজেন্টদের শ্বাসের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। সকলে চুপচাপ অপেক্ষা করছে স্টিফেনের পরবর্তি নির্দেশের।
সহসা নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে স্টিফেনের। কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। হঠাৎ করে নিরবতা ভেঙে একজন অপারেটরের কণ্ঠস্বর বজ্রপাতের মতো ধ্বনিত হয়ে উঠে। “স্যার, নাসা থেকে আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে।”
মুখ ভেঙচে প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে স্টিফেন বলেন, “শুরু হয়ে গেছে ইন্টার-ডিপার্টমেন্ট নোংরা খেলা। শালারা এখন ফালতু দড়ি টানাটানি করবে অথবা অযৌক্তিক কিছু দাবী করে বসবে!” দ্রুত পা বাড়িয়ে পাশেই চিফের জন্যে বিশেষ করে বানানো কাচের কিউবের দিকে চলে যান তিনি।
কিউবের বাইরে থেকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে স্টিফেনকে পর্যবেক্ষণ করতে থাকেন প্রফেসর কামাল ও ড. লিসা। টেলিফোন ধরে কিছুক্ষণ নিরবে ওপরপাশের কথা শুনেন স্টিফেন। তারপর দ্রুত গতিতে মাথা নাড়তে থাকেন। কিছুক্ষণ পর গায়ের জোরে টেবিলের উপর ঘুসি মারেন।
ড. লিসা ও প্রফেসর কামাল একে অপরের দিকে তাকায়; দু-জনের দৃষ্টিতেই অনিশ্চয়তা। হঠাৎ করে স্টিফেন এতটা রেগে গেল কেন, বুঝতে পারছেন না তারা। তুমুল গতিতে ঘাড়ের দুপাশে মাথা নাড়া; সেইসঙ্গে হাতের উঠানামা চলছে স্টিফেনের। আচমকা ধরাম করে টেলিফোনটা রেখে হাত উঁচিয়ে ইঙ্গিতে প্রফেসর কামালকে ডাকেন স্টিফেন।
অনাকাঙ্খিত কিছু একটা ঘটে গেছে বুঝতে বেগ পেতে হয়ে না প্রফেসর কামালের। কিউবের ভেতর ঢুকতেই পেছনের দরজাটা সয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যায়। দাঁড়ানো অবস্থা হতে ধপ করে চেয়ারে বসে পড়েন স্টিফেন। “নাসার ভিনগ্রহ বুদ্ধিমত্তা রিসার্চ ডিভিশনের চিফের কল ছিল। ভিনগ্রহী নিয়ে আমাদের সকল কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে আর বলেছে আপনাকে এই মুহূর্তে নাসার কাছে হস্তান্তর করতে। কোনো ধরনের কারণও ব্যাখ্যা তারা দিচ্ছে না। এই মুহূর্তে একটি জেট রওনা দিয়েছে, দুই ঘণ্টার মধ্যে এসে পৌঁছাবে। হাতে অল্প সময় আছে প্রস্তুত হওয়ার। আপনার কি কোনো ধারণা আছে কেন এ ব্যাপারে নাসা এত গুরুত্ব দিচ্ছে?” তীক্ষ্ণ চোখে প্রফেসর কামালের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন স্টিফেন যেন একটি পেশির নড়াচড়াও দৃষ্টি না এড়ায়।
দ্রুত চিন্তা চলছে প্রফেসরের মস্তিষ্কে; এখন প্রায় ভোর হতে চলছে। নাসার হেডকোয়ার্টার এখান থেকে প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার দূরে! জেট এসে পৌঁছাতে দুই ঘণ্টা; তার মানে নাসার পৌঁছাতে কমপক্ষে পাঁচ ঘণ্টার মতো লাগবে। নিশ্চিত মনে একাকী চিন্তা করার জন্যে যথেষ্ট সময়। কিন্তু তার আগে জানতে হবে কেন তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে নাসা।
স্টিফেনের তীক্ষ্ণ দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে প্রফেসর কামাল বলেন, “বললেই হল! আমার ফ্যামিলি এখানে আর আমি কাউকে কিছু না জানিয়ে তিন হাজার কিলোমিটার দূরে উড়াল দেব? তাদের জিজ্ঞেস করুন কেন আমাকে দরকার। উপযুক্ত জবাব না পেলে আমার এক পা-ও এখান থেকে নড়বে না। আমাকে নিশ্চয় অ্যারেস্ট করে নিয়ে যাবে না, তাই না?”
ঠোঁটের কোণে একটি বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে স্টিফেন বলেন, “প্রেসিডেন্ট ইমার্জেন্সি ঘোষণা করেছেন। সে হিসাবে নাসা সরাসরি না পারলেও অন্য কোনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীর মাধ্যমে যে কোনো নাগরিককে আটক করতে পারে।”
“কিন্তু নাসার একজন বিজ্ঞানী কি আপনাকে এভাবে কাজ বন্ধ করা বা আমাকে তাদের হাতে তুলে দেওয়ার নির্দেশ দিতে পারে? আমি যতটুকু জেনেছি আপনি ও আপনার ডিপার্টমেন্ট সরাসরি সেক্রেটারি অফ ডিফেন্স-এর কাছে রিপোর্ট করেন!”
“নাসার ডিরেক্টর শেষের দিকে এসে সরাসরি প্রেসিডেন্টকে লাইনে যুক্ত করেছিলেন। মানে সে বুঝিয়ে দিয়েছে এগুলো তার নির্দেশ না বরং স্বয়ং প্রেসিডেন্টের নির্দেশ। তবে আমি আবার কল করছি, নিশ্চয় জানার অধিকার আছে কেন আপনাকে এই মুহূর্তেই নাসায় যেতে হচ্ছে। আমি তো আর আপনার উপর জোর খাটাতে পারি না, তাই না?” মুখের হাসিটি আরো বিস্তৃত হয় স্টিফেনের।
পাঁচ সেকেন্ডের মধ্যে পুনরায় ডিরেক্টরকে যুক্ত করেন স্টিফেন। সম্ভবত অপর পাশে ডিরেক্টর তাদের দ্বিতীয়বার কলের অপেক্ষাতেই ছিলেন তিনি।
“মিস্টার কামাল, আপনাকে এই মুহূর্তে আমাদের এখানে খুবই প্রয়োজন। বিস্তারিত আপাতত জানানো যাচ্ছে না, এখানে আসলেই সব বুঝতে পারবেন। আপনি দ্রুত তৈরি হয়ে নিন। সম্ভবত লম্বা সময়ের জন্যে এখানে অবস্থান করতে হতে পারে।”
“অন্তত কেন যেতে হচ্ছে এ ব্যাপারে কিছুটা ইঙ্গিত তো দেওয়া সম্ভব। এটা বুঝতে পারছি ব্যাপারটা বায়োকম ল্যাবের সংশ্লিষ্ট; সেক্ষেত্রে ল্যাব থেকে কিছু নিয়ে আসা বা কোনো তথ্যেরও প্রয়োজন হতে পারে।”
খানিকটা নিরবতা ফোনের অপর প্রান্ত থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ভেসে আসে। “এলিয়েনদের সঙ্গে আমাদের কমিউনিকেশন ডিপার্টমেন্ট দ্বিপাক্ষিক আলাপ চালিয়েছে। তাদের একমাত্র দাবী আপনার ল্যাবের কবুতরগুলোকে মুক্তি দিতে হবে। আগের মেসেজে কয়েদী বলতে এদেরকেই বুঝিয়েছে এলিয়েনরা। সেক্ষেত্রে বায়োকম ল্যাবে কী নিয়ে গবেষণা হয়েছে বা হচ্ছে সে বিষয়ে আমাদের বিস্তারিত জানা নেই। তাই আপনার সঙ্গে কথা না বলে এলিয়েনদের সঙ্গে কোনো নেগোসিয়েশনে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। আপাতত আমরা বারো ঘণ্টার সময় চেয়েছি। আর ব্যাপারটা সামরিক বাহিনীর হাত থেকে সরিয়ে ডিপ্লোম্যাটদের হাতে সপর্দ করা হয়েছে। এই লক্ষে আমরা দ্রুত বিশ্বের সেরা ডিপ্লোম্যাটদের নিয়ে একটি কমিটি করতে যাচ্ছি। এই কারণেই মিস্টার স্টিফেন ও তার ডিপার্টমেন্টকে স্ট্যান্ড ডাউন করা হয়েছে।” একদমে কথাগুলো বলেন চিফ।
ঠান্ডার মধ্যেও ঘেমে উঠেছেন প্রফেসর কামাল। তার মানে ভিনগ্রহের এই বুদ্ধিমান প্রাণীদের পৃথিবীতে আগমন, হুমকি দেওয়া, হামলা করা সবকিছুর মূলে তার ল্যাব! ব্যাপারটার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পেরে মনে হচ্ছে ভীষণ ভারী একটি বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে তার পিঠে। ধপ করে চেয়ারে বসে পড়েন প্রফেসর কামাল।
[অধ্যায় আট]
চারদিক ঝকঝক তকতক করছে। নাসার মূল ফটক পার হয়ে গাড়ি ঢুকতেই মেজর পদের একজন অফিসার প্রফেসর কামালকে সাদরে অভ্যর্থনা জানিয়ে তাকে অনুসরন করতে বলেন। চোখের সামনে নাসার সাদা রঙের বিশাল বাক্স আকৃতির ভবনটির দিকে বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকেন প্রফেসর। এক পাশে আমেরিকার পতাকা আরেক পাশে নাসার সেই বিশ্বখ্যাত মনোগ্রাম। এতদিন কেবল ছবি বা ভিডিয়োতেই দেখেছেন এখন সরাসরি দেখছেন।
ভবনের ভেতর অনেকগুলো উইং ফুলের পাপড়ির মতো ছড়িয়ে আছে। মেঝে কাচের মতো স্বচ্ছ বিশাল বড়ো বড়ো টাইলসে ঢাকা। একটা প্যাটার্ন আছে মনে হচ্ছে; অনেক উপর থেকে দেখলে দৃশ্যমান হতে পারে। লিফট থেকে বের হয়ে লম্বা করিডোর ধরে কিছুদূর এগিয়ে ডান দিকে ঘুরতেই একটি স্টিলের দরজা; বড়ো করে লেখা “অথরাইজড পার্সোনাল ওনলি।” গলার ঝুলানো ভিজিটর আইডিকার্ড ছোঁয়াতেই আলতো করে দরজাটা খুলে যায়।
ঢুকেই কিছুটা আশাহত দৃষ্টিতে নজর বোলান প্রফেসর কামাল। কল্পনা করেছিলেন দেখবেন বিশাল বড়ো হলরুমের ভেতর শতশত লোকের মৌমাছির মতো দৌড়ঝাঁপ করছে, চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবে বিশাল বিশাল স্কিন আর মনিটর, শতশত ইঞ্জিনিয়ার উদ্বিগ্নমুখে কম্পিউটারের দিকে তাকিয়ে থাকবে। কিন্তু এখন দেখছেন মাঝারি আকারের একটি মিটিং রুমের ভেতর বড়ো ওভাল আকৃতির টেবিল ঘিরে পঁচিশ-ত্রিশজনের মতো চুলদাড়ি পাকা পৌঢ়-বৃদ্ধ মুখ গম্ভীর করে বসে আছে। কয়েকজনের মাথায় বড়োসড়ো টাক চকচক করছে। চারজনের পরনে সামরিক বাহিনীর পোশাক। প্রত্যেকের কাঁধের উপর দুটো করে পিতলের তারকা জ্বলজ্বল করছে। বিমান অথবা সেনাবাহিনীর জেনারেল পদবির সকলে। কয়েকজনের চেহারায় শিক্ষকসুলভ স্পষ্ট ভাব দেখে বোঝা যাচ্ছে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর। বাকিরা হয় নাসার বিজ্ঞানী অথবা প্রশাসনে কেউকেটা গোছের কেউ হবে। মাত্র তিন জন নারী।
ঘরে ঢুকতেই একজন এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে বলেন, “স্নোভারিচ, ডিরেক্টর ইটিএল।”
বাড়িয়ে দেওয়ার হাত মুঠিতে ধরে দুইবার মৃদু ঝাঁকি দিয়ে প্রফেসর কামাল হাসিমুখে বলেন, “আপনার সঙ্গেই তাহলে ফোনে কথা হয়েছিল?”
জবাবে কেবল মৃদু মাথা নাড়েন স্নোভারিচ। কালক্ষেপণ না করে দ্রুত ঘুরে রুমে উপস্থিত সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, “আপনাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি, প্রফেসর কামাল আনোয়ার। চিফ সায়েন্সটিস্ট বায়োকম ল্যাব; কোয়ান্টাম বায়োলজির টপ এক্সপার্টদের একজন। বায়োলজির আইন্সটাইন হিসাবেই তিনি বেশি পরিচিত।”
নির্দিষ্ট করে রাখা আসনটিতে বসেই ধীরস্থিরভাবে সকলের উপর একবার দৃষ্টি বুলিয়ে আনেন প্রফেসর কামাল। টেবিলের ঠিক মাঝখানে ভাসছে একটি হলোগ্রাম; সম্পূর্ণ পৃথিবীর ত্রিমাত্রিক মানচিত্র। অনেকগুলো জায়গায় লাল রঙের তারকাচিহ্ন জ্বলজ্বল করছে। সম্ভবত যে সব জায়গায় হামলা হয়েছে সেগুলোকে গ্লোবে দেখাচ্ছে। এটিই মনে হয় এলিয়নের সঙ্গে যোগাযোগের কনট্রোলরুম। মনেমনে প্রচণ্ড অস্থিরতায় ভুগলেও বাহির থেকে বোঝার কোনো উপায় নেই। প্রফেসর কামাল অধীর হয়ে অপেক্ষার করছেন কেউ একজন তাকে সর্বশেষ খবর জানাবেন। উপস্থিত সকলের পরিচয় আপাতত না জানলেও চলবে।
নিজের আসনে কিছুটা তীর্যকভবে বসে আছেন লালচে মুখের স্নোভারিচ। মুখ গম্ভীর করে বলেন, “আপনারা অলরেডি জেনেছেন যে; যে কয়টা জায়গায় প্রথম হামলা হয়েছে সেগুলোর মধ্যে বায়োকম ল্যাব একটি। কিন্তু মিস্টার কামাল এখানে এসেছেন মূলত হামলা হওয়ার কারণে নয়, তিনি এসেছেন আমাদের কাছে ব্যাখ্যা করতে তার ল্যাবের কবুতরগুলো কেন এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ এই অজানা অচেনা ভিনগ্রহবাসীদের কাছে। কারণ তাদের একটাই দাবী; কালবিলম্ব না করে যেন সব কবুতরকে মুক্তি দেওয়া হয়। মিস্টার কামাল, প্লিজ; আপনার বক্তব্য শুরু করুন।”
সকলের দৃষ্টি মুহূর্তেই ঘুরে যায় প্রফেসর কামালের দিকে; সেই দৃষ্টিতে ব্যাপক কৌতুহল।
মৃদু গলা খাঁকাড়ি দিয়ে প্রফেসর কামাল বলেন, “আমাদের বায়োকম ল্যাবের গবেষণার মূল বিষয় হচ্ছে উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতে সদস্যরা কোয়ান্টাম ম্যাকানিক্সের মাধ্যে কীভাবে যোগাযোগ করে সেই রহস্য উদ্ঘাটন করা। অনেকগুলো শাখা-প্রশাখা আছে এই ল্যাবে; আমার উইয়িং এ এই মুহূর্তে কবুতরের যোগাযোগের পদ্ধতি নিয়ে কাজ হচ্ছে। এর সঙ্গে জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এরও মিশ্রণ ঘটানো হয়েছে। আমার নিজেরও ভেবে পাচ্ছি না কেন এলিয়েনরা এই কবুতরগুলোকে নিয়ে এত আগ্রহী!”
একজন জেনারেল কিছুটা সামনের দিকে ঝুঁকে এসে বলেন, “আপনারা গোপনে অভিনব প্রযুক্তির কোনো মারণাস্ত্র তৈরি করছেন না তো?” তার কণ্ঠে তীব্র সন্দেহের আভা ফুটে উঠেছে। কিছুটা কুচকে রেখেছেন চোখদুটো, সাপের মতো শীতল দৃষ্টি সেখানে। সম্ভবত শীতলচক্ষু এই জেনারেল সারা জীবন কাটিয়েছেন সন্দেহ-গোলাবারুদ-যুদ্ধ-মৃত্যু নিয়ে। তার অভিধানে এর বাইরে কোনো শব্দ নেই।
জেনারেলের শীতল দৃষ্টির সামনে কিছুটা জড়সড় হয়ে যান প্রফেসর কামাল। তড়িৎ একবার স্নোভারিচের দিকে তাকিয়ে আমতা আমরা করতে থাকেন। ব্যাপারটা আঁচ করতে পেরে স্নোভারিচ বলেন, “মিস্টার কামাল, আমাদের ডিপার্টমেন্ট এখন সর্বক্ষমতার অধিকারী। সয়ং প্রেসিডেন্ট সর্বক্ষণ সারাসরি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। এলিয়েন সংক্রান্ত সবধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এখন ভাইস-প্রেসিডেন্ট ম্যাডাম লিলিয়া জনাথানের।” বলেই উপস্থিত ম্যাডাম ভাইস-প্রেসিডেন্টের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসেন স্নোভারিচ।
চমকে উঠেন প্রফেসর কামাল! এই জন্যেই তাঁকে কেমন চেনা চেনা মনে হচ্ছিল। খানিকটা লজ্জিত বোধ করেন প্রফেসর কামাল। ম্যাডাম ভাইস-প্রেসিডেন্টকেই ঠিকমতন চিনতে পারেননি!
“অবশ্যই আমাদের এই ছোটো ঘরের ভেতর অবস্থিত সবার উপদেশ মোতাবেক আমি সিদ্ধান্ত নেব। এখানে উপস্থিত আপনাকে সহ তেত্রিশজন স্ব স্ব ফিল্ডে প্রবাদপুরুষ তুল্য। বুঝতেই পারছেন এখান থেকেই আগামী পৃথিবীর ভাগ্য নিয়ন্ত্রিত হবে। কোনো কিছু গোপন না করে খোলামেলা সব কিছু বলে ফেলুন। আর আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি; আপনাদের গোপন তথ্য কিংবা গবেষণার আইডিয়া ও ডাটা কোনোভাবেই এই ঘরের বাইরে যাবে না।”
সাময়িক বিহ্বলতা কাটিয়ে পুনরায় আত্মবিশ্বাস ফিরে পান প্রফেসর কামাল। স্বভাবসূলভ মৃদু হাসি দিয়ে বলেন, “না গোপন কোনো মারণাস্ত্র নিয়ে গবেষণা হচ্ছে না আমার ল্যাবে। তবে ফান্ডিং এর বড়ো একটা অংশ সামরিক বাজেট থেকে আসে। বিনিময়ে প্রতি সপ্তাহে গবেষণার অগ্রগতি নিয়ে ইন্টিলিজেন্স ব্রাঞ্চে একটি রিপোর্ট পাঠাতে হয়। আর নতুন কোনো আবিষ্কার হলে প্রথম তাদের জানাতে হয়। গবেষণার পেপার পাবলিশ করা নিয়ে কিছু বিধিনিষেধ আছে। দশ বছর আগে বায়োকম ল্যাব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এখনো পর্যন্ত এটি বেশ কিছু গ্রাউন্ড ব্রেকিং আবিষ্কার উপহার দিয়েছে; মূলত যোগাযোগের ক্ষেত্রে। কিন্তু এগুলো কোনটাই বিধ্বংসী মারণাস্ত্র হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে না।”
নিরবতা গ্রাস করে রুমের ভেতর। সকলে আরো চমকপ্রদ কোনো বক্তব্য প্রত্যাশা করেছিল। নিরবতা ভেঙে কিছুক্ষণ পর প্রফেসর কামাল পুনরায় বলেন, “আমার মনে হয়ে তাদের সঙ্গে পুরোদমে কথা চালাচালি করা উচিত। এই বার্তা আদান প্রদানের মধ্যে দিয়েই অনেক তথ্য বের হয়ে আসবে। তখন হয়তো বোঝা যাবে প্রকৃতপক্ষে তারা কী চায়! কেন চায়?
প্রফেসর কামালের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে একজন জেনারেলের বলে উঠেন, “মিস্টার কামাল ঠিক বলেছেন। তাদের অপেক্ষার না থেকে আমাদের কথা চালিয়ে যাওয়ার উচিত।” তার ভরাট কণ্ঠ বদ্ধ ঘরের মধ্যে গমগম করে উঠে। “এভাবেই তাদের দুর্বলতাও হয়তো খুঁজে পাবো; তখন আমাদের পক্ষে পালটা আঘাত হানাও সম্ভব হয়ে উঠতে পারে। এভাবে বসে বসে অ্যান্টিম্যাটার বোমা খাওয়ার কোনো মানে হয় না।”
ঘুরে জেনারেলের দিকে তাকান প্রফেসর কামাল। পর্বতের মতো বিশাল দেহে ঘাড়ের লেশমাত্র নেই। মাথাটা যেন ফুটবলের মতো কাধের উপর বসে আছে। সেই গোল মাথায় কেবল ঘুরছে দুর্বলতা-যুদ্ধ-আঘাত-ধ্বংস। জেনারেলের কথাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে প্রফেসর বলেন, “বুদ্ধিমান ভিনগ্রহীর সঙ্গে এটা আমাদের প্রথম যোগাযোগ; অভূতপূর্ব ঘটনা। নিঃসন্দেহে এটা মানব ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর একটা। তাই আমি বলি কী, শুরুতেই তাদের সঙ্গে সংঘাতের পথে না হেঁটে আমাদের উচিত…।”
প্রফেসরকে থামিয়ে দিয়ে স্নোভারিচ বলেন, “কিন্তু সংঘাতের পথে তো তারাই এগিয়েছে। প্রথমে হামলা করে বন্ধুত্ব স্থাপনের দ্বার তারা শুরুতেই রুদ্ধ করে দিয়েছে! আর প্রযুক্তিগতভাবে তারা যে পরিমাণ অগ্রসর, এই ব্যবধানের মধ্যে বন্ধুত্ব হয় না। তারা যদি আমাদের প্রতি দয়াও করে সেটাও হবে পোষা প্রাণীর মতো। আমরা যেমন কুকুর বেড়াল গোরু ছাগল ঘোড়া লালন পালন করি, কোলে তুলে নেই, মাঝেমধ্যে আদর করি; অনেকটা তেমন।”
“আপনি ধরেই নিয়েছেন ভিনগ্রহীরা আমাদের চেয়ে বুদ্ধিমত্তায় অনেক এগিয়ে, আমাদের সঙ্গে তারা কুকুর বেড়ালের মতো ব্যবহার করবে। কিন্তু বাস্তবে এমনটা নাও হতে পারে। কারণ, বুদ্ধিমত্তার স্কেলটি সরলরৈখিক নয়। তবে আমার মনে হয় এত দুঃশ্চিন্তা না করে তাদের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাওয়া উচিত।”
প্রফেসরেরে কণ্ঠে কিছুটা তাড়া ছিল ব্যাপারটা দৃষ্টি এড়ায় না স্নোভারিচের। একটি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তিনি বলেন, “আমরা এমন কিছু নিশ্চিত প্রমাণ পেয়েছি যে তারা যে আমাদের চেয়ে অনেক অনেক এগিয়ে সে ব্যাপারে আর কোনো সন্দেহ নেই। মানুষ মহাবিশ্বের শ্রেষ্ঠ প্রাণী নয়; আমাদের চেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী আমাদের আগে আমাদের খুঁজে বের করে ফেলেছে! মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎ এখন হুমকির মুখে।” বিষণ্ণমনে কথাগুলো বলেন স্নোভারিচ।
আমতা আমতা করে প্রফেসর কামাল জিজ্ঞেস করেন, “কী কী প্রমাণ পেয়েছেন?” তার কণ্ঠে আগের সেই আত্মবিশ্বাসের ছোঁয়া অনুপস্থিত।
“প্রথমত অল্পসময়ের ভেতর তারা আমাদের প্রায় সবগুলো ভাষা আয়ত্ব করে আমাদের সঙ্গে আমাদের ভাষাতেই যোগাযোগ করছে। তারউপর একযোগে পৃথিবীর ভীন্ন ভীন্ন জায়গায় অ্যান্টিম্যাটার হামলা হয়েছে তিন তিনবার। কীভাবে করেছে? কোথা থেকে এই হামলা পরিচালিত হয়েছে এসবই আমাদের অজানা। হামলাগুলোকে বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে প্রতিটি হামলায় ২ মাইক্রোগ্রাম পরিমাণ অ্যান্টিম্যাটার ব্যবহৃত হয়েছে। তার মানে এই এলিয়েনরা অ্যান্টিম্যাটার প্রযুক্তিতে আমাদের চেয়ে অনেক অনেক এগিয়ে।”
“আরেকটা বিষয় হচ্ছে, আমাদের সৌরজগতের কাছাকাছি দশ হাজার আলোকবর্ষ পর্যন্ত প্রতিটি গ্রহ-নক্ষত্র আমাদের ম্যাপে চিহ্নিত করা আছে। এর মধ্যে যেগুলোতে প্রাণের আবির্ভাব হতে পারে সেগুলোকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে। এই এলিয়েন গোষ্ঠি আরো দূরের কোনো সিস্টেম অথবা অন্য কোনো গ্যালাক্সি থেকে হাজির হয়েছে। এবার ভাবুন, এমন বিশাল দূরত্ব অল্প সময়ে অতিক্রম করার প্রযুক্তি তারা আয়ত্ব করেছে। মহাবিশ্বে আলোর বেগই হচ্ছে পরম, কিন্তু তারা লক্ষ লক্ষ হয়তো বা কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরত্ব অল্প সময়ে কীভাবে অতিক্রম করছে? তবে কি তারা ওয়ার্মহোল প্রযুক্তি ব্যবহার করছে? একটি স্টেবল ওয়ার্মহোল তৈরি করে তার ভেতর দিয়ে ভ্রমণ করা! আমি তো ভাবতেই পারছি না!”
“তার পরে প্রশ্ন হচ্ছে, এত বিশাল এই মহাবিশ্বে তারা আমাদেরকে কীভাবে খুঁজে পেল? র্যান্ডমলি খুঁজে বেড়ালেও তো কোটি কোটি বছর লেগে যেত! সম্ভাবনার সূত্র মোতাবেক প্রায় অসম্ভব একটি ব্যাপার! সবচেয়ে বড়ো কথা, আমরা তাদের অবস্থানই এখনো নিশ্চিত করে বের করতে পারিনি। আপনি তো এ ব্যাপারে বিস্তারিত আগেই জেনেছেন, তাই না?”
সহসাই প্রফেসর কামাল অনুধাবন করেন কীভাবে এলিয়েনরা পৃথিবীকে খুঁজে পেয়েছে! কীভাবে সিগনাল পাঠাচ্ছে! সমগ্র শরীর তীব্র আতংকে কেঁপে উঠে তার! নিজের আসনে মূর্তির মতো স্থাণু হয়ে যান সময়ের শ্রেষ্ঠ কোয়ান্টাম বায়োলজির বিশেষজ্ঞ, প্রফেসর কামাল আনোয়ার।
[অধ্যায় নয়]
“থার্মোডাইনামিক্সের প্রথম ও দ্বিতীয় সূত্র অনুযায়ী শতভাগ দক্ষতা সম্পন্ন কোনো ইঞ্জিন বা সিস্টেম বানানো সম্ভব নয়। যত সূক্ষ্ম ইঞ্জিনই বানানো হোক না কেন শক্তির কিছু অপচয় হবেই। ফিজিক্সের জগতে এটি একটি ফান্ডামেন্টাল বিষয়। কিন্তু অবাক করা বিষয় হচ্ছে উদ্ভিদ জগতে একটি ইঞ্জিন আছে যেটি প্রায় শতভাগ কর্মদক্ষতা নিয়ে কাজ করে। প্রায় অসম্ভব এই সিস্টেমটি বহুবছর ধরে উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের মাথা খারাপ করে রেখেছিল। এই সিস্টেমটি হচ্ছে উদ্ভিদের ফোটোসিনথেসিস প্রসেস। এই প্রসেসের মাধ্যমে কার্বনডাই-অক্সাইডের সঙ্গে পানি ও আলোকশক্তির মাধ্যমে উদ্ভিদ গ্লুকোজ ও শক্তি উৎপন্ন করে।” উপস্থিত সকলে বেশ মনোযোগ সহকারে প্রফেসর কামালের লেকচার শুনে যাচ্ছেন। কেউ কেউ বিস্তারিত না বুঝলেও আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন মনোযোগ ধরে রাখতে।
এলিয়েন সংকট মোকাবেলার করার জন্যে নাসার প্রাণকেন্দ্রে ভাইস-প্রেসিডেন্টের নেতৃত্বে তড়িঘড়ি করে এই কন্ট্রোল রুমটি সেটাপ করা হয়েছে। এই মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ব্যক্তিবর্গ হচ্ছে এই রুমের উপস্থিতগণ। পৃথিবীর নেতৃস্থানীয় দেশগুলোর সর্বোচ্চ সংস্থার সঙ্গে সর্বক্ষণ যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে এই কন্ট্রোলরুমের আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স।
নিজের চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে যান প্রফেসর কামাল। ছোটো ছোটো পদক্ষেপে হাঁটা শুরু করেন। “হ্যাঁ, যা বলছিলাম; উদ্ভিদের পাতার ক্লোরোপ্লাষ্ট একটি কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মতো কাজ করে। প্রথম যখন উদ্ভিদবিজ্ঞানীরা এই তত্ত্বের ব্যাপারে মুখ খোলেন পদার্থবিজ্ঞানীদের জগতে হাসির রোল উঠে। তারা বলতে শুরু করে কোয়ান্টাম কম্পিউটার প্রায় পরম শূন্য তাপমাত্রায় বিশেষ আইসোলেটেড অবস্থায় কাজ করে। কারণ একটু ব্যতিক্রম হলেই ইলেক্ট্রনের ডিকোহিরেন্স ঘটবে। আর কোনো তৃণভোজী বিজ্ঞানী নাকি বলছে গাছের পাতায় পাতায় কোয়ান্টাম-কম্পিউটার!” মুহূর্তক্ষণ বিরতি দিয়ে সকলের দিকে চকিতে দৃষ্টি ঘুরিয়ে এনে প্রফেসর কামাল বলেন, “উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের ভেতর যারা কোয়ান্টাম মেকানিক্স নিয়ে কাজ করছে তাদেরকে পদার্থবিজ্ঞানীরা মজা করে তৃণভোজী বিজ্ঞনী বলে সম্বোধন করে। শুনতে খারাপ লাগলেও প্রফেশনাল জগতে এসব খুবই সাধারণ ঘটনা। বিজ্ঞানীরা কোনো সাধুসন্ন্যাসী মহাপুরুষ নন। বরং প্রফেশনাল জেলাসি এদের মধ্যেই বেশি দেখা যায়। সে হিসাবে আমিও তৃণভোজী কোয়ান্টাম স্পেশালিষ্ট।”
বন্ধ ঘরের মধ্যে হালকা করে হাসির একটা ঢেউ খেলে যায়। মুহূর্তেই দমবন্ধ অবস্থা খানিকটা কেটে গিয়ে কিছুটা স্বস্তির ফুটে উঠে কয়েকজনে চোখে মুখে।
হাসি থামিয়ে প্রফেসর কামাল বলেন, “যা বলছিলাম, ফোটোসিনথ্যাসিসের পুরো প্রক্রিয়াটি ঘটে উদ্ভিদের পাতার ক্লোরোপ্লাস্টের ভেতর। ক্লোরোপ্লাস্টের ভেতর স্তরে স্তরে সাজানো থাকে থাইলোকয়েড। এই থাইলোকয়েডের ভেতর থাকে ছোটো ছোটো বিন্দুর মতো অসংখ্য ক্লোরোফিল। এখন ফোটোসিনথ্যাসিস প্রসেসটি বুঝতে হলে ক্লোরোফিলের রাসায়নিক গঠন ও কার্যপ্রণালী বুঝতে হবে। ক্লোরোফিল অণু মূলত লম্বা কার্বন এবং অক্সিজেনের শিকল, আর এদের ফাউন্ডেশন হিসাবে একটি একক ম্যাগনেশিয়াম পরমানুকে ঘিরে থাকে কার্বন-নাইট্রোজেন পরমানুর গ্রিড। এখন আমরা সবাই জানি যে ম্যাগনেশিয়ামের বাইরের অর্বিটে একটি মাত্র ইলেক্ট্রন থাকে।”
কিছুটা অস্থির হয়ে স্নোভারিচ বলেন, “মিস্টার কামাল, আপনি টেকনিক্যাল ডিটেইলে না গিয়ে সংক্ষেপে প্রসেসটা ব্যাখ্যা করলে সকলের সহজে বুঝতে পারবে।”
লাজুক হেসে প্রফেসর কামাল বলেন, “ওহ! স্যরি। আসলে লেকচার মুডে চলে গিয়েছিলাম। সংক্ষেপে বলতে গেলে, একটি আলোক কণার আঘাতে উদ্ভিদের ক্লোরোপ্লাস্টের ভেতর একটি এক্সাইটন তৈরি হয়। এখন শক্তি উৎপাদনের জন্যে এই এক্সাইটনকে ক্লোরোফিলের জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে থাকা একটি রিএকশন সেন্টারে যেতে হবে। অসংখ্যা ক্লোরোফিলের মধ্যে একটি রিএকশন-সেন্টারকে খুঁজে বের করাটাই হচ্ছে সবচেয়ে কঠিন কাজ। প্রথমে বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন এক্সাইটন র্যান্ডমলি একটি একটি করে ক্লোরোফিলের ভেতর অভিযান চালিয়ে রিএকশন-সেন্টারের খোঁজ করে। কিন্তু এক্ষেত্রে অনেক এক্সাইটন হারিয়ে যাওয়া স্বাভাবিক এবং ইফেসিয়েন্সি অনেক কমে যাওয়ার কথা। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হল, বাস্তবে একটি এক্সাইটনও হারায় না। তার মানে এটিকে আমরা একটি শতভাগ কর্মদক্ষতা সম্পন্ন ইঞ্জিনের সঙ্গে তুলনা করতে পারি। যুগের পর যুগ ধরে উদ্ভিদবিজ্ঞানীদের পাগল করে রেখেছিল প্রায় অবাস্তব এই কর্মদক্ষতার ধাঁধাঁ।”
কণ্ঠে কিছুটা নাটকীয়তা এনে প্রফেসর কামাল বলেন, “অবশেষে! অবশেষে দুই দশক আগে…” উভয় হাত উপরে তুলে দুই আঙুলের সাহায্যে কোটেশনে চিহ্ন দেখিয়ে বলেন, ““একজন তৃণভোজী বিজ্ঞানী” প্রথম কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মাধ্যমে এই সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ার ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, “এক্সাইটন রেন্ডমলি একেকটি ক্লোরোফিলের ভেতর দিয়ে যা গিয়ে কোয়ান্টাম সুপারপজিশনের মাধ্যমে সম্ভব্য সবগুলো পথের ভেতর দিয়ে চালিত হয়ে রিএকশন-সেন্টারে পৌঁছায়।”
উপস্থিত বেশ কয়েকজন সম্মতিসূচক মাথা নাড়ে, বাকিরা অনুভূতিহীন দৃষ্টিতে প্রফেসর কামালের দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রফেসর অনুধাবন করতে পারেন নাসার বিজ্ঞানীরা ব্যতিত উপস্থিত জেনারেল, সেক্রেটারি ও ভাইস প্রেসিডেন্ট তার বক্তব্যের কিছুই বুঝতে পারছেন না। লেকচার থামিয়ে হেঁটে দেওয়ালের ঝুলানো একটি বোর্ডের সামনে গিয়ে থামেন প্রফেসর। ব্যস্ত হাতে মার্কার তুলে কয়েকটি রেখা একে বলেন, “কোয়ান্টাম সুপারপজিশন হচ্ছে একই সময়ে একটি কণার ভিন্ন ভিন্ন স্থানে অবস্থানের পদ্ধতি। যেমন ধরুন একটি আমি…” বোর্ডে আঁকা চিত্রের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, “এই অবস্থানে আছি। এখান থেকে পথটি দুইভাগে বিভক্ত হয়ে সামনে এগিয়েছে। এখন আমি যে কোনো একটি পথে না গিয়ে নিজের আরেকটি অস্তিত্ব তৈরি করে একই সঙ্গে দুটি পথে এগিয়ে গেলাম। এই পদ্ধতিকে বলে সুপার পজিশন। আরো সামনে গিয়ে দেখলাম প্রতিটি পথ আরো দুটি পথে বিভক্ত হয়ে গেছে। তখন আবার একই পদ্ধতিতে নিজের আরেকটা অস্তিত্ব তৈরি করে চারটি পথেই এগিয়ে গেলাম। ঠিক এই পদ্ধতিতে এক্সাইটনগুলো একই সময়ে অনেকগুলো ক্লোরোফিলের ভেতর দিয়ে যুগপৎ এগিয়ে চলে অবশেষে ক্ষুদ্রতম সময়ের ভেতর রিএকশন সেন্টারে পৌঁছে। এই কারণে এই সালোকসংশ্লেষ পদ্ধতি এতটা এফিসিয়েন্ট এবং একটি এক্সাইটনও হারিয়ে যায় না।”
চোখ বড়ো বড়ো করে স্নোভারিচ বলেন, “আমি ধরতে পেরেছি আপনি কী বলতে চাচ্ছেন! মাই গড! এত সহজ ব্যাপারটা কেন আগে আমাদের মাথায় আসেনি!”
ভ্রু কুঁচকে পর্বত সদৃশ জেনারেল বলেন, “মিস্টার স্নোভারিচ, উদ্ভিদের পাতার ইঞ্জিনের সঙ্গে এলিয়েন হারামজাদাদের হামলার কী সম্পর্ক? বিষয়টা সহজ ভাষায় দ্রুত ব্যাখ্যা করুন প্লিজ!” জেনারেলের কণ্ঠ সামরিক কমান্ডের ভঙ্গিতে গমগম করে উঠে।
স্নোভারিচ নিজের আসন ছেড়ে ঝড়ের বেগে প্রফেসর কামালের দিকে এগিয়ে যান। তার পাশে দাঁড়িয়ে সকলে উদ্দেশ্যে বলেন, “অবজার্ভেবল ইউনিভার্সে গ্যালাক্সির পরিমাণ প্রায় দুশো বিলিয়ন আর কেবল আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতেই আছে প্রায় একশো বিলিয়ন নক্ষত্র। আশা করি আপনাদের একটি প্রাথমিক ধারণা হয়েছে আমাদের এই মহাবিশ্ব কতটা বিশাল। আরো সহজে বলতে গেলে পৃথিবীর বুকে যত সংখ্যাক ধুলো কণা আছে মহাবিশ্বে তার চেয়ে বেশি নক্ষত্র আছে। এখান কারও পক্ষে র্যান্ডমলি আমাদের সূর্যকে বা নির্দিষ্ট করে পৃথিবীকে খুঁজে বের করা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু যদি কোয়ান্টাম সুপার পজিশন অনুযায়ী কোনো সুপার সিগনাল প্রপাগেট করা হয় তাহলে অনেক কম সময়ের ভেতর একটি নির্দিষ্ট গ্রহ বা নক্ষত্র খুঁজে পাওয়া সম্ভব। ঠিক এই কারণেই আমরা সিগনালের উৎস খুঁজে পাচ্ছি না। যেই মুহূর্তে আমরা সিগনাল রিসিভ করছি ঠিক তখনই কোয়ান্টাম সুপার পজিশন ডিকহিরেন্ট হয়ে যাচ্ছে। মানে, সুপার পজিশন ভেঙে যাচ্ছে। তার মানে এলিয়েনদেরকে স্বশরীরে আমাদের আসার প্রয়োজন নেই; কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূর হতেও এই সিগনালগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।”
স্নোভারিচের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে প্রফেসর কামাল বলেন, “কিন্তু এখানে বেশ কয়েকটা বড়ো বড়ো অসামঞ্জস্যতা রয়ে গেছে।”
“কী ধরনের?”
“এলিয়েন সম্প্রদায় র্যান্ডমলি সিগনাল ওয়েভ আকারে কোয়ান্টাম সুপার পজিশনের মাধ্যমে পাঠালেও এটা নিশ্চয় আলোর গতির চেয়ে বেশি গতিতে প্রপাগেট করবে না। সেক্ষেত্রে এত কম সময়ে কীভাবে তথ্য আদান প্রদান হচ্ছে যদি না তারা স্বশরীরে আমাদের কাছাকাছি এসে হাজির হয়ে থাকে? আরেকটা সমস্যা হচ্ছে, শুধু সিগনাল সেন্ড করেই আমাদের খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়, সিগনালের জবাব দেওয়াও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ যে গ্রহ থেকে তারা জবাব পাবে; ধরে নেবে সেই গ্রহেই বুদ্ধিমান স্বত্তার উদ্ভব হয়েছে। তার মানে হয় কেউ আমাদের অগোচরে তাদের সিগনালের জবাব দিয়েছে অথবা শুরুতেই আমাদের কেউ আগ বাড়িয়ে সিগনাল পাঠিয়েছে; আর এলিয়েন গোষ্ঠি কেবল সেই সিগনালের জবাবে পৃথিবীকে খুঁজে পেয়েছে। শেষ ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আমাদের কাছাকাছি স্বশরীরে হাজির না হয়ে থাকলে কীভাবে অ্যান্টিম্যাটার দিয়ে হামলা করতে পারল?” নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে কথাগুলো বলে নিজের আসনের দিকে এগিয়ে যান প্রফেসর কামাল। অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকেন স্নোভারিচ।
কিছুক্ষণ ভেবে স্নোভচির বলেন, “এলিয়েন সম্প্রদায় নিঃসন্দেহে পৃথিবীর চেয়ে প্রযুক্তিতে অনেকে অনেক এগিয়ে। সেক্ষেত্রে ধরে নিতে পারি তারা অ্যাডভান্স কোয়ান্টাম মেকানিক্স, ওয়ার্মহোল এবং অ্যান্টিম্যাটার এসব বিষয়ে আমাদের চেয়ে অনেক বেশি জ্ঞান রাখে।”
দানবাকৃতির জেনারেল টেবিলের উপর মৃদু ঘুসি মেরে কিছুটা উত্তেজিত ভঙ্গিতে বলেন, “আমার মনে হয়ে এসব থিয়োরি না কপচিয়ে কীভাবে এলিয়েন হারামজাদাদের পাছায় একটা নিউক মিসাইল ঢুকিয়ে দিতে পারি সেটা নিয়ে আমাদের ভাবা উচিত।”
আচমকা সবাইকে চমকে দিয়ে উপস্থিত একজন বিজ্ঞানী লাফিয়ে উঠে বলেন, “কমিউনিকেশন ডিপার্টমেন্ট সরাসরি এলিয়েনদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে। তাদের আলোচনার একটা স্ট্রিম এই কন্ট্রোল-রুমেও শেয়ার করছি।”
ঘরের একপাশের একটি দেওয়ালের উপর প্রজেক্টারের মতো করে আলোর একটি স্ক্রিন ভেসে উঠে। আর চারকোণে সেট করা স্পিকারে ভেসে আসে অদ্ভুত সতর্কবার্তা,
“এই মুহূর্তে সবগুলো কয়েদখানা থেকে সকল কবুতরগুলোকে মুক্তি দাও।”
[অধ্যায় দশ]
“তারা ক্রমাগত হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। তাদের আচরণের সঙ্গে উচ্চ বুদ্ধিমত্তার বিষয়টা ঠিক ঠিক খাপ খাচ্ছে না।” কপালে কিঞ্চিৎ চিন্তার ভাঁজ ফেলে নীচু স্বরে বিড়বিড় করে উঠেন প্রফেসর কামাল।
পাশের আসনে বসে থাকা স্নোভারিচের কানে প্রফেসরের কথাটি প্রবেশ করতেই তিনি তার দিকে খানিকটা ঝুঁকে বলেন, “আপনি কী মনে করছেন তারা এতটা বুদ্ধিমান নয়? কোথাও কোনো ফাঁকি ঝুঁকি নেই তো? ধোঁকা খাচ্ছি না তো আমরা?”
বাঁ হাতে টেবিলের উপর আঙুল ঠুকে তবলা বাজাতে বাজাতে কিছুক্ষণ ভাবেন প্রফেসর কামাল। মনে মনে যুক্তিগুলোকে গুছিয়ে নিয়ে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মুখ খুলেন। “বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে সভ্যতার বিকাশের একটি সরাসরি সংযোগ আছে; পাশাপাশি এর সঙ্গে উৎপ্রতভাবে জড়িয়ে আছে অনুভূতি। যে প্রাণী বুদ্ধিমত্তার স্কেলে যত উপরে, তার আবেগ-অনুভূতি তত উচ্চ সূরে বাধা থাকে। আর অনূভূতি যত তীক্ষ্ণ হবে, সেই সভ্যতা ততবেশি স্থিতিশীল হবে; মানে সেই সভ্যতার এন্ট্রোপি তত নিয়ন্ত্রণে থাকবে।”
হঠাৎ ডান হাত উঁচিয়ে বক্ত্যবের মাঝে বাধা দিয়ে স্নোভারিচ বলে উঠেন, “থামুন, থামুন! মিস্টার কামাল! থার্মোডাইনামিক্সের সূত্র মতে এন্ট্রোপি হচ্ছে আণবিক পর্যায়ের বিশৃঙ্খলার মাত্রা; কিন্তু আপনি এটাকে সমাজবিজ্ঞানে নিয়ে এসেছে!”
“আসলে আমি সভ্যতার এন্ট্রোপি বলতে কেবল বিশৃঙ্খলার কথা বলছি।” অস্থির স্নোভারিচের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলেন প্রফেসর কামাল, “সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে যদি এট্রোপি নিয়ন্ত্রণে না থাকে তবে সেই সভ্যতা নিজেই নিজেকে ধ্বংস করে দিবে। যেমন ধরুন, আমাদের সভ্যতা যত এগিয়েছে ততই সহিংসতার হার কমে এসেছে। যখনই প্রযুক্তিত নতুন নতুন বিপ্লব এসেছে; মানুষ তত সভ্য ও সহনশীল হয়েছে। পারমাণবিক প্রযুক্তি আমাদের হাতে আসার পর শীতল যুদ্ধের যুগ এবং তার পরের যুগে মানুষের ভেতর যুদ্ধের বিরোধীতা অনেক বেড়েছে। এখন যদি আমাদের হাতে অ্যান্টিম্যাটার বোমার প্রযুক্তি চলে আসে তাহলে দেখবেন সোশাল এন্ট্রোপি বা সভ্যতার বিশৃঙ্খলা আরো কমে এসেছে। কারণ যদি এন্ট্রোপি না কমে তাহলে সভ্যতার এই অগ্রগতিই আমাদের নিশ্চিহ্ন করে দেবে। আগ্রগতির এই ধারায় যদি পরম বিধ্বংসী মারণাস্ত্র আমাদের হাতে চলে আসে তাহলে সমাজের সকল বিশৃঙ্খলা স্তিমিত হয়ে চরম স্থবিরতা চলে আসবে।”
স্নোভারিচকে উদ্দেশ্য করে বললেও প্রফেসর কামালের কথা রুমের উপস্থিত সকলেই মনোযোগ সহকারে শুনছেন। চিন্তিত কণ্ঠে স্নোভারিচ বলেন, “তার মানে আপনি বলতে চাচ্ছেন, যে আপাতদৃষ্টিতে এই যে মনে হচ্ছে এলিয়েন সভ্যতা আমাদের চেয়ে অনেক অগ্রসরমান, তাই অনুভূতির দিকে দিয়েও তারা আমাদের চেয়ে অনেক এগিয়ে থাকবে? মানে তারা আমাদের জন্যে হুমকি নয়?”
“এ ব্যাপারে এখনো নিশ্চিত হয়ে কিছু বলতে পারছি না। অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর এখনো অজানা।” অবচেতনভাবে আঙুলের ছোয়ায় নাকের ডগায় চলে আসা চশমাটি আগের জায়গায় পাঠিয়ে স্থির দৃষ্টিতে স্নোভারিচের দিকে তাকিয়ে থাকেন প্রফেসর কামাল।
জেনারেলের ভরাট কণ্ঠ গমগম করে উঠে। “তাহলে এখন আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে যাচ্ছে?” স্নোভারিচের দিকে তাকিয়ে বললেও তার প্রশ্নটি উপস্থিত সবাইকে উদ্দেশ্য করে করা।
কিছুটা হতবিহ্বল ভঙ্গিতে প্রফেসর কামালের দিকে তাকিয়ে থাকেন স্নোভারিচ। অপেক্ষা করছেন তার দিক থেকে কোনো উপদেশের।
চেয়ারে পিঠ এলিয়ে দিয়ে প্রফেসর কামাল বলেন, “এলিয়েনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে কীভাবে?”
“অত্যন্ত উচ্চপর্যায়ের একটি টিম এই কাজে নিয়োজিত আছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিভিন্ন শাখায় পৃথিবীর সেরাদের সঙ্গে ভাষাবীদ, সামরিক কর্মকর্তা ও বিশ্বের সেরা ডিপ্লোমেটদের নিয়ে এই ডিপ্লোমেটিক নেগোশিয়েশন টিমটি গঠন করা হয়েছে। অত্যন্ত গোপন ও সুরক্ষিত স্থানে অবস্থান করছে তারা; এই টিমের উপর নির্ভর করা যায়। এলিয়েনরা যে সিগনাল পাঠাচ্ছে সেগুলোকে ডিকোড করে তাৎক্ষণিকভাবে টেক্সট এর মাধ্যমে আমাদের এখানে পাঠিয়ে দিচ্ছে। আমাদের এখানে টেক্সট থেকে ভয়েসে কনভার্ট করে স্পিকারে প্রচার করা হচ্ছে। তার মানে আমরা এ ভয়েস শুনছি এগুলো এলিয়েনের ভয়েস নয়; বরং আমাদের আর্টিফিশিয়াল ইন্টলিজেন্সের মাধ্যমে তৈরি করা।” সংক্ষেপে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলেন স্নোভারিচ।
“কিন্তু তাহলে আমাদের এখানে কী কাজ?” কিছুটা বিভ্রান্ত মনে হচ্ছে প্রফেসর কামালকে।
তাকে আস্বস্ত করে স্নোভারিচ বলেন, “আমরা আসলে বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত ভিন্ন ভিন্ন সংস্থা ও বিভিন্ন দেশের ভেতর সমন্বয় সাধন করছি। এই সংকটকে এক জায়গা থেকে সমাধানের চেষ্টা না করে বরং ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এটা প্রতিরক্ষার একটি ধাপ বলতে পারেন। তবে আমাদের এই কমিটির হাতে সর্বময় ক্ষমতা; আমাদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে।”
ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মৃদু মাথা নেড়ে প্রফেসর কামাল বলেন, “এখন পর্যন্ত কী আমাদের পক্ষ থেকে কোনো বার্তা পাঠানো হয়েছে?”
দ্রুত মাথা নেড়ে না সূচক জবাব দেন স্নোভারিচ।
প্রফেসর কামাল কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন তাকে থামিয়ে দিয়ে পাশ থেকে ছোটোখাটো কঙ্কালসার এক তরুণ বলে উঠেন, “স্যার, আমার মনে হয় ডিপ্লোমেটিক নেগোশিয়েশন টিমটির নিরপত্তা হুমকির মুখে আছে। তারা এলিয়েনদের উদ্দেশ্যে কোনো বার্তা পাঠানোর আগে দ্রুত তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা উচিত।”
স্নোভারিচ খানিকটা ঘাবড়ে গেছেন বলে মনে হয়। “কী ধরনের নিরাপত্তার হুমকি?”
গালভাঙা কঙ্কালসার তরুণ সঙ্গেসঙ্গে জবাব দেয়, “এখনো যেহেতু ওই ডিপ্লোমেটিক নেগোশিয়েশন টিমের পক্ষ থেকে কোনো মেসেজ পাঠানো হয়নি, তাই তাদের অবস্থান এলিয়েনদের কাছে এখনো অজানা। কিন্তু কোনো মেসেজ পাঠালে সিগনাল পিনপয়েন্টিং করে তাদের অবস্থান মুহূর্তের ভেতর বের করে ফেলা সম্ভব। এখন আমরা জানি না ওই এলিয়েনরা কতটা আগ্রাসী। অলরেডি তারা অনেকগুলো জায়গায় হামলা চালিয়েছে। তারা কী ডিপ্লোমেসির ভাষা বোঝে? যদি কথা বলতে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হামলা করে বসে? এমনিতেই আমরা ব্যাকফুটে আছি, প্রথম ধাক্কাতেই যদি এত এত দক্ষ লোকবল হারিয়ে ফেলি তাহলে আর উঠে দাঁড়াতে হবে না।”
অবচেতনভাবে টাই-এর নট খানিকটা নেড়েচেড়ে মাথা ঝাঁকিয়ে স্নোভাচির বলেন, “তাহলে তুমি কী করতে বলো?”
“নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যে দুইটা পদ্ধতির যে কোনো একটা আমরা ব্যবহার করতে পারি। প্রথমটা হচ্ছে প্রক্সি প্রোটোকল ব্যবহার করে আমাদের সিগনালটা একটা ভার্চ্যুয়াল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কয়েক লক্ষ সার্ভারে ছড়িয়ে দিতে পারে। সেক্ষেত্রে এতগুলো সার্ভারের ভেতর আমাদের ডিপ্লোমেটিক নেগোশিয়েশন টিমের অবস্থান সহজে বের করতে পারবে না। এই পদ্ধতির যোগাযোগ কিছুটা দ্রুতগতি সম্পন্ন হবে। কিন্তু একটাই সমস্যা; এলিয়েনরা একযোগে সবগুলো উৎসে হামলা করে বসতে পারে। আর দ্বিতীয় উপায় হচ্ছে, আমাদের সিগনাল সরাসরি না পাঠিয়ে মাঝে একটি স্যাটেলাইটকে এঙ্করিং মডিউল হিসাবে ব্যবহার করতে পারি। নাসার স্যাটেলাইটকে একাজে ব্যবহার করা যেতে পারে। প্রথমে আমাদের মেসেজটিকে প্যাকেট করে একটি সিকিওর্ড চ্যানেলের মাধ্যমে স্যাটেলাইটে আপলোড করে পৃথিবীর সঙ্গে চ্যানেল বিচ্ছিন্ন করে দেব। তারপর স্যাটেলাইটের বাফারে রাখা মেসেজটি এলিয়েনদের উদ্দেশ্যে সেন্ড করব। এই পদ্ধতি খানিকটা স্লো হবে কিন্তু এলিয়েনরা ভূমিতে আমাদের ডিপ্লোমেটিক নেগোশিয়েশন টিমের অবস্থান চিহ্নিত করতে পারবে না।” আঙ্গুলে মাঝে একটি কলম ঘুরাতে ঘুরাতে চেয়ারে হেলান দিয়ে রুমের সকলের দিকে দৃষ্টিপাত করে তরুণ বিজ্ঞানী।
প্রফেসর কামাল বুঝতে পারেন বয়স কম হলেও এই ছেলে নাসার গুরুত্বপূর্ণ পদে আছে। সম্ভবত স্যাটেলাইট সিগনাল স্পেশালিষ্ট। সকলের মতো প্রফেসর কামালও স্নোভারিচের দিকে তাকিয়ে অপেক্ষা করতে থাকেন যোগাযোগের জন্যে তিনি কোন পদ্ধতি বেছে নেন। মনে মনে খানিকটা তাড়া অনুভব করেন প্রফেসর, যথাসম্ভব দ্রুততার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এলিয়েনরা ঠিক কী চাইছে এখনো পরিষ্কার না। সবচেয়ে ভয়ের বিষয় হচ্ছে যে কোনো সময় পৃথিবীজুড়ে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা শুরু হয়ে যেতে পারে।
স্নোভারিচ ভ্রু কুঁচকে গভীর মনোযোগ সহকারে কিছু একটা ভাবছেন। কয়েকটি মুহূর্ত কেবল, তারপরেই স্নোভারিচের কণ্ঠ গমগম করে ওঠে। মনে হচ্ছে আচমকা অদৃশ্য কোনো শক্তি এসে যেন ভর করেছে তার উপর। “রস্বোম, স্যাটেলাইট বাফারিং-এর মাধ্যমে যোগাযোগের প্রটোকল সেটাপ করতে কতক্ষণ সময় লাগবে?”
“পাঁচ মিনিট। আমি এখুনি শুরু করছি।” বলেই ল্যাপটপের কি-বোর্ডে ঝড় তুলে রস্বোম।
একেকটি মুহূর্ত কেটে যাচ্ছে আর রুমের ভেতর পরিবেশ ক্রমশ গুমোট আকার ধারণ করছে। সকলে অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে কিছু একটা ঘটার। স্নোভারিচ অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে চেয়ার ছেড়ে উঠে রুমের ভেতর পায়চারি শুরু করেন। প্রফেসর কামাল কিছুক্ষণ পরপর মৃদু শব্দ করে নাক টানছেন, তার মনে হচ্ছে নাকের দুই ফোটা বন্ধ হয়ে দম আটকে যাবে। ভুঁড়িওয়ালা জেনারেল চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখমুখ কুচকে রুমের সকলের উপর সন্দেহের দৃষ্টি বুলাচ্ছেন। কেবল ভাইস প্রেসিডেন্ট অনুভূতিহীন নির্বাক পিঠ টানটান করে বসে আছেন, তার চোখের তারায় মৃদু হাসি। রাজনীতিবীদ হিসাবে কোটি কোটি লোকের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমনি খেলার প্রায় ঐশ্বরিক ক্ষমতাসহ অনেক প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবেলা করার অভিজ্ঞতা থেকে হয়তো তার আত্মনিয়ন্ত্রণ।
ল্যাপটপের কি-বোর্ডের উপর যেন প্রজাপতির পাখার মতো ছটফট করছে রস্বোমের দশটি আঙুল। একেকটি সেকেন্ড অতিবাহিত হচ্ছে যেন একেকটি দিন, একেকটি সপ্তাহ কেটে যাচ্ছে। অনেক যুগ পর ডান হাতে কি-বোর্ডের একটি বাটন জোরে চেপে ধরে চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে রস্বোম বলে, “হয়ে গেছে। এখন আমাদের সঙ্গে ডিপ্লোমেটিক নেগোশিয়েশন টিমের একটি ডেডিকেটেট সিকিউর্ড চ্যানেল সেটাপ করা হয়েছে আর ডিপ্লোমেটিক নেগোশিয়েশন টিম থেকে স্যাটেলাইটের লিংক-আপও হয়ে গেছে।” উঁকি মেরে সময় দেখেই আকর্ণ বিস্তৃত হাসি দিয়ে বলে, “চার মিনিট পঞ্চাশ সেকেন্ড লেগেছে।” গর্বে রস্বোমের চোখেমুখ জ্বলজ্বল করে উঠে মুহূর্তেই।
তড়িৎ লম্বা কয়েকটি কদম ফেলে নিজ আসনে ফিরে আসেন স্নোভারিচ। আত্মবিশ্বাসে ভরপূর কণ্ঠে সকলের উদ্দেশ্যে বলেন, “তাহলে চলুন এলিয়েনের সঙ্গে আলাপচারিতা শুরু করা যাক।” বলেই মাইক্রোফোনের কাছে মুখ নিয়ে মৃদু স্বরে বলেন, “ডিপ্লোমেটিক ইউনিট, আপনাদের সঙ্গে আমরা সরাসরি যুক্ত আছি। এখন এলিয়েনদের সঙ্গে বার্তা আদানপ্রদান শুরু করতে পারেন। আপনাদের পাঠানো প্রতিটি বার্তার আমরা এখান থেকে নিশ্চিত করে তারপর আপলোড করব। তো এখন শুরু হোক বাক্যুদ্ধ।”
দম বন্ধ করে বসে আছে রুমে ভেতর সকলে। কিছুক্ষণের মধ্যে ডিপ্লোমেটিক ইউনিটের পক্ষ থেকে প্রথম বার্তাটি এসে পৌঁছে নাসার এই কন্ট্রোলরুমে,
“অজানা সভ্যতার আগন্তুক, পৃথিবীর কোটি কোটি বুদ্ধিমান প্রজাতির প্রাণীর প্রতিনিধি হিসাবে সভ্যতার নেতৃত্ব দানকারী বুদ্ধিমান মানুষের পক্ষ থেকে তোমাদেরকে স্বাগতম। বুদ্ধিমত্তার প্রথম লক্ষণ, অজানাকে জানার আগ্রহ আমাদের অফুরন্ত। আমরা তোমাদের মতো উন্নত সভ্যতার ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে আগ্রহী।
তোমরা যদি শান্তির লক্ষে পৃথিবীতে এসে থাক, তাহলে আমাদের পক্ষ থেকেও তোমাদের শান্তির সর্বোচ্চ নিশ্চয়তার দেওয়া হচ্ছে।”
খুব মনোযোগ সহকারে বার্তাটি রুমের উপস্থির সকলে দুইবার করে শুনে। কারও কোনো আপত্তি বা মন্তব্য না থাকায় স্নোভারিচ মাথা খানিকটা ঝাঁকিয়ে রস্বোমকে ইঙ্গিতে অনুমোদন প্রদান করেন। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে বার্তাটি পাঠিয়ে দুই হাত উপরে তুলে রস্বোম বলে, “পাঠিয়ে দিয়েছি!”
পিনপত্তন নিরবতা নেমে আসে রুমের ভেতর। যে কোনো সময় এলিয়নের পক্ষ থেকে জবাব আসতে পারে। বুক ঢিব ঢিব করছে অনেকের। আশা আর আশংকায় দুলছে সকলের মনের ভেলা, যদি তারা এখন হামলা করে বসে? পৃথিবীর তো কোনো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাই নেই তাদের বিরুদ্ধে!
বেশ কিছুক্ষণ পর নীচু ভলিউমে টিং করে একটি শব্দ হয়, মনে হয় বদ্ধ ঘরে বোমা ফেটেছে যেন। জবাব এসেছে তাদের পক্ষ থেকে! এলিয়েনরা বার্তার জবাব পাঠিয়েছে!
[অধ্যায় এগারো]
স্তব্ধ হয়ে বসে আছে রুমের সকলে। এইমাত্র শোনা এলিয়েনদের পাঠানো বার্তাটি আত্মস্ত করতে খানিকটা কষ্ট হচ্ছে তাদের। কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ ফেলে ভাইস-প্রেসিডেন্ট লিলিয়া দুই তারকা জেনারেলের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “তারা কি হুমকি দিল? না কী সতর্ক করল?”
মুহূর্তেই জড়তা ভেঙে সরগরম হয়ে উঠে রুমের সকলে। সবারই কিছু না কিছু বলার আছে এমন ভাব নিয়ে প্রত্যেকে নিজ নিজ আসনে নড়েচড়ে বসে। কাউকে সুযোগ না দিয়ে স্নোভারিচ বলেন, “আপাতদৃষ্টিতে তাদের কথা শুনে মনে হচ্ছে আমাদের হুমকি দিচ্ছে কিন্তু এটাকে এত সরলভাবে ইন্টারপ্রেট করলে চলবে না। মনে রাখতে হবে, তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি সভ্যতা। তাদের সঙ্গে আমাদের মনোভাব-চিন্তা-চেতনা-উপলব্ধির কোনো মিল নেই। এমনও হতে পারে তারা তাদের দৃষ্টিতে বন্ধুত্বের কথা বলছে, কিন্তু আমরা ভুল বুঝছি। আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে আমরা কিন্তু তাদের মুখের ভাষা শুনতে পাচ্ছি না। তারা আমাদের কাছে সিগনালের মাধ্যমে কিছু লিখিত বার্তা পাঠাচ্ছে। মুখের ভাষা হলে আরো অনেক বেশি তথ্য উদ্ধার করা যেত।”
দুই তারকা এক জেনারেল স্নোভারিচের দিকে অগ্নিদৃষ্টি হেনে বলেন, “আপনার কেন মনে হচ্ছে তারা হুমকি দিচ্ছে না? আমি তো স্পষ্ট বুঝতে পারছি তারা পরবর্তী হামলার চালানোর জন্যে উন্মুখ হয়ে আছে!” তার পরপরই তড়িৎ গতিতে ভাইস প্রেসিডেন্টের দিকে ঘুরে খানিকটা উচ্চস্বরে বলেন, “আমাদের এখনি সব বাহিনীতে রেড এলার্ট জারি করতে হবে। পৃথিবীজুড়ে সবাইকে নিজ নিজ ঘরে বা নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার নির্দেশ দিতে হবে। আমার ধারণা পৃথিবীর সবদেশ একযোগে এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলে তাদের আমরা পরাজিত করতে পারব।”
এতক্ষণ নিরবে সকলের কথা শুনছিলেন প্রফেসর কামাল। অবাক হয়ে জেনারেলের দিকে তাকিয়ে ভাবেন “যে শত্রুকে এখন পর্যন্ত চিহ্নিতই করা সম্ভব হয়নি সেই শত্রুকে কীভাবে পরাজিত করবে? না কী আমাদের হাতে কোনো গোপন প্রযুক্তি আছে? আর যুদ্ধ ছাড়া এই জেনারেলরা অন্য কিছু ভাবতে পারে না কেন?” পরমুহূর্তেই নিজেকে প্রবোধ দেন এই ভেবে যে সামরিক বাহিনীকে গড়ে তোলাই হয় যুদ্ধের জন্যে। এই কারণে ডিপ্লোমেসির কাজ তাদের দ্বারা হয় না।
লম্বা একটা দম নিয়ে প্রফেসর কামাল সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, “আমার মনে হয় বিচলিত না হয়ে ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতি সামাল দেওয়া দরকার। আরো কয়েকবার তাদের বার্তা মনোযোগ দিয়ে শুনি; তারপর না হয় আমরা জবাব পাঠাই। এমন তো নয় যে এক্ষুনি জবাব পাঠাতে হবে, তাই না?” সমর্থনের আশায় উপস্থিত কয়েকজনের উপর দৃষ্টি ঘুরিয়ে আনেন প্রফেসর কামাল।
বিলম্ব না করে ছোঁ মেরে মাইক্রোফোন তুলে ভাইস-প্রেসিডেন্ট বলেন, “ডিপ্লোমেটিক টিম, আপনারা নিজের মতো প্রস্তুতি নিতে থাকুন, আমাদের অভিমত কিছুক্ষণ পরে জানাচ্ছি।” তারপর ইঙ্গিতে রস্বোমকে মেসেজটি পুনরায় চালাতে বলেন।
“তোমরা শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে কবুতর প্রজাতির উপর ভয়ংকর নিষ্ঠুর আচরণ করছ। এই মুহূর্তে বন্দি সকল কবুতরকে মুক্তি দাও অন্যথায় ভয়ংকর পরিণতির জন্যে প্রস্তুত হও।”
রুদ্ধশ্বাসে রুমে উপস্থিত সকলে মেসেজটি তিন বার শুনে। প্রতিটি অক্ষর প্রতিটি শব্দ যেন মগজে গেঁথে নিচ্ছে সবাই। প্রথম থেকেই চুপ করে থাকা একজন জেনারেল, বসে আছেন ঠিক ভাইস-প্রেসিডেন্টের পাশের আসনে। চোখমুখে বুদ্ধির ঝিলিক; ম্যাডাম ভাইস প্রেসিডেন্টের দিকে মুখ এগিয়ে দিয়ে নীচুস্বরে কিছু একটা বলেন। ম্যাডাম ভাইস-প্রসিডেন্ট দ্রুতগতিতে মাথা নেড়ে জেনারেলে কথাটাকে নাকচ করে দেন।
গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে যান প্রফেসর কামাল। কারা এই ভিনগ্রহী? হঠাৎ করে পৃথিবীর কবুতরের জন্যে তারা কেন এতটা কনসার্ন হয়ে উঠল? গৃহপালিত কবুতরের প্রচলন সেই দশ হাজার বছর আগে থেকে আর তখন থেকেই কবুতর মানুষের খাদ্যের একটি উত্তম উৎস। হাজার বছর ধরে দূর দূরান্তে বার্তাবাহক হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে গৃহপালিত পায়রা। তাহলে কী এমন ঘটে গেল একেবারে ভিনগ্রহী এসে হাজির তাদের রক্ষা করতে? একটা অদ্ভুত আশংকা প্রফেসর কামালের মনে উঁকি মারে; মুহূর্তেই চিন্তাটিকে ধামা চাপা দিয়ে দেন তিনি। নিশ্চিত না হয়ে এই ব্যাপারে কিছু বলা ঠিক হবে না। এখন যথাসম্ভব তাদের কাছ থেকে তথ্য আদায় করতে হবে।
ঘাড়ে গর্দানে সমান, বিমানবাহিনীর জেনারেল কর্কশ কণ্ঠে উচ্চস্বরে বলেন, “আমাদের এখন উচিত তাদের সঙ্গে ক্রমাগত কথা চালাচালি করে যাওয়া। এতে তাদের প্রকৃতি সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যাবে। এর ভেতর দিয়ে তাদের দুর্বলতাও আমরা জানতে পারব।”
সকলে একমত হয় তার সঙ্গে। বিশেষ করে উপস্থিত বাকি জেনারেলরা বেশি উৎসাহী হয়ে উঠেন। স্ট্যাটেজি-দ্বন্ধ-সংঘাতের গন্ধ পেয়ে চোখ চকচক করে উঠে তাদের। যে কোনো পরিস্থিতিতে যুদ্ধই একমাত্র গন্তব্য এই বিষয়টা বছরের পর বছর প্রশিক্ষণের ভেতর দিয়ে গড়ে ওঠা যুদ্ধবাজ জেনারেলদের মস্তিষ্কে যেন খোদায় করে লেখা হয় যায়।
ডিপ্লোম্যাটিক দলের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে অল্প সময়ের ভেতর একটি জবাব প্রস্তুত হয়ে যায়।
“ভিনগ্রহী অতিথি; তোমাদের কোথাও ভুল হচ্ছে অথবা তোমদেরকে কেউ ভুল তথ্য পাঠিয়েছে। আমরা মানুষেরা পৃথিবীর বুকে অভূতপূর্ব এক সভ্যতার গোড়াপত্তন করেছি। বুদ্ধিমত্তায় এই গ্রহের সকল প্রজাতির শীর্ষে অধিষ্ঠিত হলেও প্রতিটি প্রজাতির প্রতি রয়েছে আমাদের অকৃত্তিম সহানুভূতি। প্রাণীদের প্রতি যে কোনো ধরনের নিষ্ঠুর আচরণ প্রতিহত করার জন্যে জাতিসঙ্ঘের UNCAHP সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। জাতিসঙ্ঘের অধিনে সকল রাষ্ট্র UNCAHP-এর ঘোষণা মেনে চলতে বাধ্য।”
বার্তাটি ইনপুট দিয়ে আড়চোখে একবার স্নোভারিচের দিকে তাকায় রস্বোম। স্নোভারিচ মাথা খানিকটা ঝুকিয়ে হ্যাঁ সূচক ইঙ্গিত দিতেই বার্তাটি পাঠিয়ে দেয় রস্বোম। এবার অপেক্ষার পালা। বন্ধ পানির টেপের মাথা চুঁয়ে চুঁয়ে ফোটা ফোটা পানি পড়ার মতো করে কেটে যাচ্ছে একেকটি মুহূর্ত।
কতগুলো মুহূর্ত অতিবাহিত হয়েছে সেদিকে কারও ভ্রুক্ষেপ নেই। নিঃস্তব্ধতায় নিমজ্জিত পরিবেশে ডিং করে মৃদু শব্দই যেন বোমা ফাটার মতো প্রতিক্রিয়া হয় ঘর জুড়ে। জবাব পাঠিয়েছে এলিয়েন,
“আমাদের কাছে প্রমাণ আছে তোমরা গোপনে কিছু ল্যাবরেটরিতে কবুতরের প্রজাতির উপর যত ধরনের নিষ্ঠুর আচরণ করা সম্ভব সবই করে থাকো। সেই ল্যাবগুলো সঙ্গে বাইরের বিশ্বের কোনো যোগাযোগ নেই। এই মুহূর্তে এই ধরনের সব ল্যাবরেটরি বন্ধ করে কবুতরগুলোকে মুক্তি দাও।”
এবার মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যান প্রফেসর কামাল। এতক্ষণ মনের কোণে যে অস্বস্তিটা খচখচ করছিল সেটা এখন প্রকাশের সময় হয়েছে বুঝতে পারেন তিনি। অন্য কেউ কিছু বলার আগে চটজলদি দাঁড়িয়ে প্রফেসর কামাল বলেন, “আমি সম্ভবত ধরতে পেরেছি এর পেছনে কারা জড়িত। ভিনগ্রহীরা নির্দিষ্ট করে কিছু গবেষণাগারের কথা উল্লেখ করেছে যেখানে কবুতর নিয়ে গবেষণা করা হয়। এরা এর আগে আমার ল্যাবের কথাও বলেছে। আমার ল্যাবের মূল অংশ, যেখানে কবুতরগুলোকে রাখা হয়, সেই অংশটা ফ্যারাডেকেইজ দিয়ে বাইরের জগতের সঙ্গে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছে।”
এ পর্যায়ে এসে গলা শুকিয়ে আসে প্রফেসর কামালের। প্লাস্টিকের বোতল থেকে কয়েক ঢোক পানি ঢেলে পুনরায় বলা শুরু করেন, “তিন সপ্তাহ আগে পিটা তাদের ওয়েবসাইটে আমাদের ল্যাবের বিরুদ্ধে কিছু অভিযোগ করে। কয়েকদিন আগে ইমেইলে আমাদের জানায় অবিলম্বে এই ল্যাব বন্ধ না করলে তাদের হাতে যে প্রমাণ আছে সেগুলো মিডিয়াতে প্রকাশ করে দিবে। আমাদের পক্ষ থেকে কোনো জবাব না পেয়ে দুইদিন আগে তারা একটি ভিডিয়ো প্রকাশ করে। গোপন ক্যামেরার মাধ্যমে ল্যাবের মূল অংশের কিছু স্পর্শকাতর এক্সপেরিমেন্টের ভিডিয়ো করে তারা। সেদিন দুপুরের আগেই আমাদের নিজস্ব এক্সপার্টদের সাহায্যে ভিডিয়ো এনালিসিস করে বুঝতে পারি এই ভিডিয়ো করা হয়েছে বুক সমান উচ্চতায় শার্টের বোতামের মতো কোনো এক প্রকারের মিনি ক্যামেরা দিয়ে।”
প্রফেসর কামালকে থামিয়ে দিয়ে স্নোভারিচ বলেন, “পেটা বলতে, P-E-T-A?”
“হ্যাঁ”
“ড্যাম! আগে জানতাম পেটার এজেন্টরা গোপনে বিভিন্ন পশুফার্মে চাকরি নিয়ে বছরের পর বছর ধরে ভেতরের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে, তথ্য সংগ্রহ করে তারপর সুযোগ বুঝে মামলা করে; এখন দেখছি গবেষণাগারগুলোতেও এই হারামজাদাদের নজর পড়েছে!” রাগে ফোসফোস করে উঠেন স্নোভারিচ।
“ঠিক বলেছেন। আমরা PETA-এর সেই এজেন্টকে আইডেন্টিফাই করতে পেরেছি, আমাদের একজন সিনিয়র গবেষক। ল্যাবের সকল কর্মীকে নন-ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট সাইন করতে হয়। এখন আমরা ওই গবেষকের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছি। আর পেটার বিরুদ্ধেও মামলা করা হবে।”
এতক্ষণ চুপ করে তাদের আলাপচারিতা শুনছিলেন ভাইস-প্রেসিডেন্ট। হঠাৎ করেই তিনি বলে উঠেন, “তার মানে আপনারা UNCAHP, PETA ইত্যাদি সংস্থা যারা প্রাণী অধিকার নিয়ে কাজ করছে তাদের গাইডলাইন সঠিকভাবে মানছেন না, ঠিক?”
জবাবে প্রফেসর কামাল কিছু একটা বলতে চাচ্ছিলেন, তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে স্নোভারিচ আগবাড়িয়ে বলেন, “ম্যাডাম ভাইস-প্রেসিডেন্ট, অনেক সময় ইচ্ছা থাকলেও নিয়ম নীতি শতভাগ মেনে চলা সম্ভব হয় না। আর যেখানে পশুপাখিকে কেটেকুটে পরীক্ষা করা হচ্ছে, ইলেকট্রিক শক দিয়ে ডাটা নেওয়া হচ্ছে, জেনেটিক্যালি মোডিফাই করে প্রজন্মের পর প্রজন্ম নানান ধরনের এক্সপেরিমেন্ট করা হচ্ছে; সেখানে কি এই সব প্রাণীর প্রতি দয়া করে কিছু হাসিল হবে? ঠিক কীভাবে এই এক্সপেরিমেন্টগুলো দয়া দেখিয়ে করা সম্ভব? ব্যাপারটা এমন যে আমি আপনাকে মেরে ফেলার জন্যে আগে জিজ্ঞেস করছি ঠিক কীভাবে মারলে আপনার প্রতি দয়া দেখানো হবে!”
উদাহরণটা যুতসই হয়নি বুঝতে পেরে খানিকটা হেসে বলেন, “দুনিয়ায় অনেক পাগল প্রকৃতির লোক আছে। জীবনের রূঢ় বাস্তবতার সঙ্গে যাদের বিন্দুমাত্র পরিচয় নেই। আমরা গবেষকরা শত শত বছর ধরে একটু একটু করে মানব সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি আর এই সব রোমান্টিসিজমে ভোগা তরুণ-তরুণীরা এসে বলছে “এভাবে করা যাবে না; ওভাবে করা যাবে না!” এখনো নিজের ডায়াপার নিজে বদলাতে পারে না সেই দুইদিনের পাকনা এসে বলছে, “প্রাণী উপর এই এক্সপেরিমেন্ট করা যাবে না।” আরো কত কী! তাহলে তো সভ্যতার অগ্রগতিই ধীর হয়ে যাবে! একেকটি প্রাণীর উপর যে পরীক্ষা করা হয় তার উপর নির্ভর করে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন বাঁচাচ্ছে গবেষকরা।” মুখে হাসি ধরে রাখলেও মনের জমানো দীর্ঘদিনের সব ক্ষোভ একেবারে ঢেলে দিয়েছেন নাসার এই ডিরেক্টর।
কপাল কুঁচকে ভাইস-প্রেসিডেন্ট প্রশ্ন করেন, “তার মানে আপনারা বলতে চাচ্ছেন এই এলিয়েনদের কাছে তথ্য পাঠিয়েছে PETA-এর কোনো এজেন্ট?”
দ্রুত সম্মতিসূচক মাথা নেড়ে প্রফেসর কামাল বলেন, “কে? কীভাবে পাঠিয়েছে কিংবা এলিয়েনরা এত সঠিক তথ্য কোথা থেকে পেল সেই ব্যাপারে শতভাগ নিশ্চিত হয়ে কিছু বলা সম্ভব নয়। তবে এলিয়েনরা আমাদের ভেতর থেকেই কারো মাধ্যমে তথ্য জোগাড় করেছে এতুটুকু বোঝা যাচ্ছে। আমাদের ল্যাবের ওই ঘটনা ও PETA-এর সংশ্লিষ্টতা আর ঠিক এই সময়ে এলিয়েনেদের আবির্ভাব এবং নির্দিষ্ট করে আমাদের ল্যাবের কার্যপদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তোলা; সব মিলিয়ে ধরে নেওয়া যায় এর পেছনে PETA-এর হাত আছে।”
“বুঝতে পেরেছি।” নিষ্ঠুর একটা ভাব ফুটে উঠে ভাইস-প্রেসিডেন্টের চোখেমুখে। কালক্ষেপণ না করে সিকিউরিটি সচিবকে নির্দেশ দেন যেন এই মুহূর্তে PETA-এর হেডকোয়াটারে অভিযান চালানো হয়।
অবশেষে একটি আশার আলো দেখতে পাওয়া গেছে ভেবে খানিকটা স্বস্তির ভাব ফুটে উঠে উপস্থিত সকলের আচরণে। কিন্তু একটি ব্যাপার আগের চেয়ে বড়ো দুঃশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে সবাইকে, “PETA কীভাবে, কোন প্রযুক্তির বলে এমন অসাধ্য সাধন করল?”
[অধ্যায় বারো]
“আমাদের পৃথিবী অনেকগুলো দেশ ও জাতিতে বিভক্ত। সবাইকে একটি নির্দিষ্ট নির্দেশ মানতে বাধ্য করা একক কারও পক্ষে সম্ভব নয়। আমাদের অধিকারে যে ল্যাবগুলো আছে সেগুলো থেকে না হয় সব কবুতরগুলোকে মুক্তি দিয়ে দিলাম, কিন্তু বাকিদের কী হবে? তোমরা বরং আমাদের বিস্তারিত জানাও কেন হঠাৎ করে কবুতরের জন্যে তোমরা এতটা উতলা হয়ে উঠেছ? যুক্তি যদি খুব ভালো ও জোড়ালো হয় তবে সবাইকে কনভিন্স কর সম্ভব হলেও হতে পারে।”
“তোমাদের কেউ দুর্ঘটনা বা বিপদে পড়লে যেমন বার্তা পাঠালে উদ্ধার কাজে ছুটে চলা তোমাদের প্রাথমিক দায়িত্ব, ঠিক তেমনই আমাদের কাছে সাহায্য চেয়ে কেউ বার্তা পাঠালে এর যথাযথ প্রতিক্রিয়া দেখানো আমাদের দায়িত্ব। প্রাণের প্রাথমিক লক্ষণ হচ্ছে টিকে থাকা, এই কারণে বিবর্তনে ধারায় উপযুক্ত ও শক্তিশালী প্রজাতি টিকে যায়। কিন্তু শুধু টিকে থাকাটাই যথেষ্ট নয়। একটি টেকসই সভ্যতা নির্মাণ করা তখনই সম্ভব হবে যখন অন্য প্রজাতির প্রতি সহানুভূতি ও সমবেদনা প্রদর্শন করবে। প্রাণের লক্ষণ হচ্ছে টিকে থাকা আর বুদ্ধিমত্তার লক্ষণ হচ্ছে অন্যকে টিকতে সাহায্য করা। সহানুভূতি ও সমবেদনা হচ্ছে সভ্যতার গোড়াপত্তনের প্রথম শর্ত।”
“মানব সভ্যতা অন্য প্রাণীদের উপর যথেষ্ট দায়শীল। পৃথিবীর প্রতিটি দেশের আইনে পশুপাখিদের প্রতি নিষ্ঠুরতা নিয়ন্ত্রণের জন্যে আইন আছে। পশু-অধিকার নিয়ে কাজ করার জন্যে UNCAHP নামে জাতিসংঘের আলাদা একটি বিভাগই খোলা হয়েছে। পৃথিবীর প্রায় ছয় বিলিয়ন মানুষ কোনো না কোনো ধর্মের অনুসারী; প্রতিটি ধর্মেই প্রাণীদের প্রতি সর্বোচ্চ সদয় হওয়ার নির্দেশ দেওয়ার হয়েছে এবং ধার্মিকরা এটা মেনে চলে কারণ তাদের বিশ্বাস এতে তারা অনন্ত সুখের জীবন লাভ করবে। যারা কোনো ধর্মেই বিশ্বাস করে না, তারাও “কোনো প্রাণের প্রতি নিষ্ঠুরতা নয়” এই নীতি মেনে চলে। আর PETA – এর ব্যাপারে তো তোমরা আগেই জেনেছ, তাই না?”
এলিয়েনদের পক্ষ থেকে কি প্রতিক্রিয়া আসে দেখার জন্যে বুদ্ধি করে PETA–এর নামটা সবার শেষে যুক্ত করে দিয়েছেন স্নোভারিচ। ইতিমধ্যে কয়েকদফা মেসেজ আদানপ্রদানে ঘণ্টাখানেক সময় অতিবাহিত হয়ে গেছে। সবাই অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে এফবিআই-এর পক্ষ থেকে কোনো খবরের অপেক্ষায়। আরো পনেরো মিনিট সময় পার হয়ে যায়। আচমকা এলিয়েনদের বার্তা এসে পৌঁছানোর ডিং শব্দ এবং একটি লাল রঙের টেলিফোন একসঙ্গে বেজে উঠে। ছোঁ মেরে ভাইস-প্রেসিডেন্ট ফোনটি তুলেই তীব্র কণ্ঠে বলেন, “জি, আপডেট বলুন!”
ঝাড়া দুই মিনিট আঠারো সেকেন্ড চুপ করে ফোনের অপর পাশের ব্যক্তিটির কথা চুপচাপ শুনেন ভাইস-প্রেসিডেন্ট ম্যাডাম লিলিয়া। তারপর আলতো করে ফোনটি রেখে সকলের উদ্দেশ্যে গলা উঁচু করে বলেন, “PETA–এর প্রধানকে ধরে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, তাদের যাবতীয় কম্পিউটারের বাইটে বাইটে ঘুরে বেড়াচ্ছে ডজনখানেক কম্পিউটার বিশেষজ্ঞ। তবে এখন পর্যন্ত এলিয়েন আগ্রাসনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা আছে এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। এফবিআই এর ডিরেক্টরের ধারণা PETA-এর প্রধান সত্য কথাই বলছে, এই ঘটনায় তাদের কোনো হাত নেই।”
আবার সেই অন্ধকার তিমিরে নিমজ্জিত হয় পড়ে উপস্থিত সবাই। কোনো ধরনের ক্লু নেই, প্রতিরোধের কোনো ব্যবস্থা নেই, এলিয়েনদের অবস্থানও নির্নয় করা সম্ভব হয়নি, অ্যান্টিম্যাটার বোমার কাছে খেলনা বন্দুক মনে হচ্ছে নিজেদের পারমাণবিক বোমার প্রযুক্তিকে; নিদারুন অসহায়ত্বের অনুভূতি অনুভব করছে সকলের। কেবল বুঝতে পারছে পৃথিবীর সকল কবুতরের উপর ভিনগ্রহীদের যাবতীয় দরদ উথলে উঠছে; এদের বাঁচানোর জন্যে দরকার হলে মানুষকেও পৃথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিবে তারা।
থমথমে নিরবতা; কিছুক্ষণ আগে যে পাঠানো মেসেজের জবাব এসেছে সেটা বেমালুম ভুলে গেছে যেন সকলে। রস্বোম গলা খাকাড়ি দিয়ে বলে, “স্যার, মাত্র পাওয়া মেসেজটা চালু করব?”
“ওহ! হ্যাঁ, জলদি চালু কর।” অবচেতন মনেই বলে উঠেন স্নোভারিচ।
“আমাদের প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী গড়ে প্রতিদিন ১৬৫ টা করে প্রজাতি পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যাচ্ছে; বছরে প্রায় ৬০,০০০! অন্য প্রাণীদের প্রতি তোমাদের যদি এতই সহানুভূতি থেকে থাকে তাহলে প্রতি বছর এত প্রাণী কীভাবে বিলুপ্ত হয়ে যায়? সুতরাং বুদ্ধিমান সভ্যতা হিসাবে তোমরা এখনো অনেক নীচু স্তরেই রয়ে গেছ এবং তোমরা দ্রুত বিলুপ্তির দিকে এগিয়ে যাবে। সেটা নিয়ে আমরা চিন্তিত নই, তোমাদের নিয়তি তোমরা নির্ধারণ করবে। আমরা কেবল চাই কবুতর প্রজাতির নিঃশর্ত মুক্তি।”
একে অপরের দিকে অর্থহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে! কী বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না। নিরবতা ভেঙে প্রফেসর কামাল বলেন, “তারা কবুতর নিয়ে কেন এতটা উতলা? আমরা ধারণা এই বুদ্ধিমান এলিয়েনটি কবুতর বা এদের কাছাকাছি কোনো প্রজাতির হবে। বিলিয়ন বিলিয়ন ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন গ্রহের মহাবিশ্বের কোনো এক অংশে এমন কি হতে পারে না যে কবুতর সভ্যতার আবির্ভাব ঘটেছে। আমরা কিন্তু এখন জানি কবুতর কোয়ান্টাম মেকানিক্সের মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। হয়তো কোনো একটি বিবর্তিত উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন কবুতর মহাবিশ্বের প্রতিটি কোনায় SOS মেসেজ পাঠিয়ে সাহায্য চেয়েছে।”
ভ্রু কুঁচকে প্রফেসর কামালের দিকে তাকান স্নোভারচি। মগজের ভেতর দ্রুতগতিতে চলছে চিন্তার ঝড়। “পৃথিবী থেকে SOS পাঠালেই এভাবে এলিয়েনরা বিলিয়ন বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূর হতে ছুটে আসবে উদ্ধারে? আলোর বেগে চললেও সময় কত লাগবে বুঝতে পারছেন?”
আমি কেবল একটি হাইপোথিসিসের কথা বললাম। অন্য অনেক কিছুও হতে পারে। তবে সমুদ্রে কোনো জাহাজ বিপদে পড়লে SOS পাঠায়, আর এই বিশেষ মর্সকোড পেয়ে থাকলে সাহয্যের জন্যে এগিয়ে আসা বাধ্যতামূলক। হয়তো এক্ষেত্রে এমন কিছুই ঘটেছে। আর তারা সম্ভবত বিলিয়ন বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরত্ব অতিক্রম করে এখানে আসেনি। হয়তো তাদের গ্রহ থেকে আমাদের পৃথিবী পর্যন্ত একটি পোর্টাল খুলেছে কেবল, যেখান দিয়ে মুহূর্তেই বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে বার্তা পাঠানো যায়। ঠিক এই কারণেই তাদের অবস্থানও আমরা ধরতে পারছি না। কোয়ান্টাম মেকানিক্স সময় সময় ভূতুড়ে আচরণ করে। এই বিদ্যাটা আমরা এখনো পুরোপুরি আয়ত্ব করে উঠতে পারিনি।”
ভাইস-প্রেসিডেন্টের চোখমুখ অন্ধকার হয়ে আসে। মনে হচ্ছে খানিকটা ভয় পেয়েছেন তিনি। আপন মনে ভাবেন যদি সত্যি সত্যি এরা কবুতর প্রজাতির হয়ে থাকে তাহলে তো ভয়ের কথা। এতদূর এসে তারা কিছুতেই পৃথিবীর কবুতরদের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত পিছু হটবে না। বিমানবাহিনীর জেনারেলের দিকে তাকিয়ে কাঁপাকাঁপা কণ্ঠে বলেন, “আমাদের প্রতিরক্ষা কতটুকু প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে বলে আপনার মনে হয়?”
“এখন পর্যন্ত শূন্য। তারা অসীম দূরে থেকে কোয়ান্টাম পোর্টাল খুলে নিজেদের সম্পূর্ণ লুকিয়ে রেখে মিলিগ্রাম পরিমাণের অ্যান্টিম্যাটার বোমা হামলা করেছে! এ থেকে তাদের সামরিক প্রযুক্তির ব্যাপারে প্রাথমিক ধারণা পাওয়া যায়। দুঃখিত ম্যাডাম, কোনো আশার কথা শুনাতে পারছি না।”
কিছুক্ষণের মধ্যে পরবর্তী বার্তা তৈরি হয়ে যায়। পাঠানোর আগে শেষ বারের মতো সবাইকে একবার শুনানোর উদ্দেশ্যে চালু করে রস্বোম।
“পৃথিবীর ইতিহাসে এ পর্যন্ত ছয়বার গণবিলুপ্তি ঘটেছে। এগুলোর পেছনে মানব সভ্যতার বিন্দুমাত্র হাত নেই। এখন যে প্রতিদিন এত এত প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এটাতেও মানুষের হাত নেই। এটা ঘটছে বিবর্তনের স্বাভাবিক গতিপ্রকৃতি অনুযায়ীই। যেখানে আমাদের কিছু করার আছে সেখানে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালানো হয়ে তাদের রক্ষা কররার জন্যে। আর কবুতর প্রজাতি মোটেও বিলুপ্তির ঝুঁকিতেই নেই। আমাদের এই গ্রহে প্রাণের অবির্ভাব হয়েছে এবং টিকে আছে খাদ্যচক্রের একটি অনুক্রমের উপর নির্ভর করে। কবুতর প্রজাতি যেমন পোকামাকড় খেয়ে বেঁচে থাকে ঠিক তেমনই অন্য অনেক প্রাণী ও পাখীও কবুতর খেয়ে বেঁচে আছে। এখন তোমরা ঠিক কীভাবে কবুতরকে রক্ষা করতে চাও সেটা আমাদের কাছে পরিষ্কার হচ্ছে না।”
লম্বা বিরতির পর এবারের জবাব আসে। আগের কোনো বার্তা পেতে এতটা অপেক্ষা করতে হয়নি।
“খাদ্যচক্র নিয়ে আমাদের আপত্তি নেই। আমরা চাই কোনো কবুতরকে পরীক্ষাগারে নির্মম নির্যাতন না করা হোক। কোনো কবুতরকে বন্দি করে না রাখা হোক। প্রাকৃতিকভাবে অন্য হিংস্র ও বন্য প্রাণীদের শিকারে পরিণত হোক সমস্যা নেই, কিন্তু এই গ্রহের সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণীর বাসনাবিলাসের কারণ না হোক। জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পরীক্ষানিরিক্ষা চালানো বন্ধ হোক। এখন বলো, কবুতরের মুক্তির ব্যাপারে কতদূর অগ্রগতি হল?”
অনেক সময় নিয়ে আলোচনার করার পর সীদ্ধান্ত হয় তাদের প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণের নিমিত্তে এবার খানিকটা কঠিন ভাষায় জবাব দেওয়া হবে।
“কিন্তু মানুষ প্রচণ্ড স্বাধীনচেতা বুদ্ধিমান প্রাণী। কোনো প্রকার চাপের কাছে নত হয়ে আমরা কোনো সিদ্ধান্ত নিই না। প্রায় সাত বিলিয়ন মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করাও সম্ভব নয়। তার উপর আমাদের গবেষণাগুলো চালানো হয় বিজ্ঞানের অগ্রগতি মাধ্যমে সভ্যতার উন্নতি সাধনের উদ্দেশ্যে। এর সঙ্গে আমাদের জ্ঞানার্জনের মতো মৌলিক অধিকার জড়িত। আর তোমরাও নিশ্চয় সর্বক্ষণ আমাদের উপর নজরদারী বজায় রাখতে পারবে না। আর যদি আমাদের হুমকির মাধ্যমে সাময়ীকভাবে কবুতরদের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে পার, তবুও এটা টেকসই হবে না। আমরা কোনো এক সময় তোমাদের দৃষ্টিকে ফাঁকি দিতে পারে এমন প্রযুক্তি উদ্ভব করে ফেলব। তখন আরো বিভৎস হয়ে কবুতর প্রজাতির উপর নির্যাতন নেমে আসবে। যেহেতু তোমাদের মতো বুদ্ধিমান প্রাণের সন্ধান আমরা পেয়েছি কবুতর প্রজাতির মাধ্যমে, সেহেতু আজকের পর থেকে আমাদের বিজ্ঞানীরা এই বিষয়ে আগের চেয়ে শতগুণ বেশি গুরুত্ব নিয়ে কাজ করবে। আমাদের সভ্যতার ইতিহাস খুঁজে দেখ, যখনই বাধা এসেছে বিজ্ঞান অথবা কোনো মতবাদ ততই শক্তিশালী হয়েছে। এখন তোমরা দুটি কাজ করতে পারো,
এখন যেমন চলছে সবকিছু তেমনই থাকুক। আমরা দুটি সভ্যতা পরষ্পরের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াবো, তথ্য, ভাব ও প্রযুক্তি আদান-প্রদান করব, একে অপরকে বুঝতে চেষ্টা করব।
অথবা
তোমরা পৃথিবীর সব কবুতরকে তোমাদের গ্রহে নিয়ে যাও। তাহলে আজকের পর থেকে এদের নিয়ে আর তোমাদের ভাবতে হবে না। তোমরা ও আমরা স্ব স্ব পথে চলে যাবো।”
মুচকি হেসে স্নোভারিচ বলেন, “ভালো একটা টোপ দেওয়া হয়েছে। যদি পৃথিবীর সকল কবুতরকে তাদের গ্রহে নিয়ে যায় তাহলে তারাই মহাবিপদে পড়বে। যতই নিজেদের প্রজাতির প্রতি দরদ উথলে উঠুক না কেন, পঞ্চাশ-ষাট কোটি কবুতরকে জায়গা দেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। এতে নিশ্চয় তাদের বিশ্বের পরিবেশের ভারসাম্য মারাত্মকভাবে ব্যহত হবে। আর যদি সব কবুতরকে গ্রহণ করতে রাজি না হয় তবে আমাদের ব্যাপারে আর নাক না গলানোই হবে সবচেয়ে যৌক্তিক, কী বলেন? নাক গলানো হবে না কী ঠোঁট গলানো?” নিজের রসিকতায় নিজেই হো হো করে হেসে উঠেন যদিও আর কেউ তার হাসির সঙ্গে তাল মেলায়নি।
অনেকক্ষণ হয়ে গেছে ভিনগ্রহীদের পক্ষ থেকে কোনো জবাব নেই। তারা কী পিছু হটল? না কী ইতিহাস ঘেঁটে আমাদের পাঠানো বার্তার সত্যতা বিচার করার জন্যে সময় নিচ্ছে? যতই সময় যাচ্ছে ততই মুখের হাসি ধীরে ধীরে মলিন হয়ে যাচ্ছে স্নোভারিচের। আপন মনে বিড়বিড় করছেন আর কিছুক্ষণ পরপর ঢকঢক করে গলায় জল ঢালছেন।
আচমকা রস্বোম চিৎকার করে উঠে। রুমসুদ্ধ লোকজন উৎকন্ঠিত ভঙ্গিতে তার দিকে তাকাতেই সে বলে, “জবাব এসেছে!” বলেই আর সময়ক্ষেপণ না করে চালু করে দেয় মেসেজটি।
“আমাদের গ্রহে তোমাদের এখান থেকে একটি কবুতরও নেওয়া সম্ভব নয়, নিয়ে গেলে সেটি ধ্বংস হয়ে যাবে। তোমাদের ইতিহাস ঘেঁটে দেখেছি, কেবল যুদ্ধ আর হত্যার ইতিহাস। তোমরা নিজেদের উপর যে পরিমাণ হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছ, সে হিসাবে অন্য প্রজাতির উপর তোমরা কেমন আচরণ করবে সেটা সহজেই বোধগম্য। একটি কার্যকরী সভ্যতা হিসাবে যে এখনো টিকে আছ, এটাই বিস্ময়কর মনে হচ্ছে আমাদের কাছে। তোমাদের হাতে কবুতর প্রজাতির ভবিষ্যৎ কিছুতেই ছেড়ে দেওয়া যায় না। আর এখন আমাদের মতো ভিন্ন একটি বুদ্ধিমান সভ্যতার সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের পর কবুতর প্রজাতি আরো ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেল! আমরা সমাধানের ভিন্ন কোনো উপায় খুঁজে দেখি। তার আগে আমাদের নির্দেশ মোতাবেক, সকল বন্দি কবুতরকে মুক্ত কর।”
এতক্ষণ ড. লিসা কোনো কথা বলার সুযোগ পাননি। এবার অত্যন্ত ধীর স্থির ভঙ্গিতে নীচু ও স্পষ্ট স্বরে তিনি বলেন, “আমার ধারণা এই এলিয়েনদের জগৎ অ্যান্টিম্যাটার দিয়ে তৈরি। কারণ তারা এই মাত্র বলেছে আমাদের এখান থেকে একটিও কবুতর যদি তাদের গ্রহে নিয়ে যায় তাহলে সেটি ধ্বংস হয়ে যাবে। এটা সম্ভব ম্যাটার-অ্যান্টিম্যাটার পরস্পর সংস্পর্শে আসলে। আর দেখুন, এ পর্যন্ত তারা যতগুলো হামলা চালিয়েছে সেগুলো অ্যান্টিম্যাটার বোমা। তার মানে এই বোমাগুলো তাদের কাছে কেবল একটি ছোটো নুড়ি বা ধুলোকণার মতো বস্তু। এ থেকে অন্তত এটা বোঝা যাচ্ছে, সামরিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে তারা তেমন একটা অগ্রসর হয়নি। আমার ধারণা তারা কেবল যোগাযোগ ও সিগনালিং এবং কোয়ান্টাম ফিজিক্সের কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেশ এগিয়ে গেছে। ইনফ্যাক্ট, আমাদের পৃথিবীর কবুতরও কিন্তু কোয়ান্টাম প্রযুক্তি ব্যবহার করে স্বতস্ফুর্তভাবে।”
চোখেমুখে খানিকটা স্বস্তিভাব ফুটিয়ে ভাইস-প্রেসিডেন্ট বলেন, “যাক অবশেষে অন্তত একটা সুখবর পাওয়া গেল।”
স্নোভারিচ যথারীতি মুখে কঠোর ভাব বজায় রেখে বলেন, “তবুও তারা আমাদের চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। তাদের ধুলোবালির মতো অ্যান্টিম্যাটারও কিন্তু আমাদের পৃথিবীতে একটি বড়োসড়ো ভবন ধ্বংস করে দিতে পারে। আর এর জন্যে তাদের এক পাও ফেলতে হচ্ছে না। বিপরীতে, আমরা এখনো তাদের অবস্থান পর্যন্ত নির্নয় করতে পারিনি।”
সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে প্রফেসর কামাল বলেন, “তাদের অবস্থান নির্ণয় করতে পারিনি কারণ তারা এখানে আসেইনি; সম্ভবত ওয়ার্মহোল তৈরি করে কোয়ান্টাম সিগনাল পাঠাচ্ছে। সে যাইহোক, তারা বারবার তাগাদা দিচ্ছে সব কবুতর মুক্ত করে দিতে। এর জবাবে কী করা যায় সেটা নিয়ে আমাদের ভাবা উচিত।”
অনেকক্ষণ ধরে আলোচনা চলছে কিন্তু কোনো সন্তুষ্টিজনক সমাধান পাচ্ছে না এতগুলো মেধাবী ও গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। কোথাকার কোন এক কবুতর সভ্যতার কাছে আজ নিজেদের খুব অসহায় লাগছে। এতদিন নিজেদের মহাবিশ্বের একমাত্র বুদ্ধিমান প্রাণী হিসাবে জেনে তৈরি করা আত্মঅহমিকা ও গর্বের প্রাচীর কেমন যেন বালুর বাধের মতো ঝরঝর করে ঝরে পড়েছে। সবচেয়ে কষ্টের ব্যাপার হচ্ছে পরাজয়ের এই ব্যথাটা সমগ্র বিশ্ববাসীর কাছে প্রকাশও করতে পারছে না তারা। মানব সভ্যতার পরাজয়ের এই অসীম বেদনা কেবল গুটিকয়েক ব্যাক্তি বহন করে যাবে আমৃত্যু, পুরো বিশ্বের বোঝা বইবে মাত্র কয়েকজন! খুব আফসোস হচ্ছে, চরম আত্মতুষ্টিতে ভুগতে থাকা মানব সভ্যতা যদি শতশত দেশ জাতিতে বিভক্ত না হয়ে শুরু থেকেই একযোগে বিজ্ঞানকে বুকে জড়িয়ে এগিয়ে যেত তাহলে আজ হয়তো মহাবিশ্বে মানুষের একছত্র আধিপত্য বজায় থাকত।
সবাইকে অবাক করে দিয়ে আরেকটি বার্তা এসে পৌঁছায় আবদ্ধ ঘরটিতে। মেসেজটি শুনে সকলে স্থানুর মতো স্থির হয়ে যায়! এ ও সম্ভব? কী করবে এখন তারা? কীভাবে পুরো ব্যাপারটা গোপন করে পরিচালনা করবে? যদি পৃথিবীর মানুষ কোনোভাবে টের পেয়ে যায়? সাধারণ মানুষকে না হয় কোনো কিছু একটা বলে নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে, কিন্তু শিক্ষিত গবেষক শ্রেণীটাকে কীভাবে আয়ত্বে নিয়ে আসবে? যদি মানুষজন সবকিছু জেনে যায় তবে কী এই সভ্যতা একইভাবে একই গতিতে এগিয়ে যাবে? না কি মুখ থুবড়ে পাথুড়ে পথে আছড়ে পড়বে? তবে কী সভ্যতা তার অন্তিম মুহূর্তে এসে উপনীত হয়েছে? মেসেজটা শুনার পর থেকে ঝড়ের গতিতে মাথার ভেতর একের পর এক প্রশ্নের উদয় হতে থাকে ভাইস-প্রেসিডেন্ট এর মাথার ভেতর। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরে থেকেও নিজের চেয়ারে বসেই ঘামতে শুরু করেন তিনি। এই প্রথম তাকে নার্ভাস মনে হচ্ছে।
[অধ্যায় তেরো]
বদ্ধ ঘরের ভেতর তুমুল আলোচনা চলছে। সবাই যার যার অভিমত তুলে ধরছে কেবল ভাইস-প্রেসিডেন্ট নিরবে শুনে যাচ্ছেন।
সবার বলা শেষ হলে প্রফেসর কামাল বলেন, “রাজনৈতিক চাপ কীভাবে সামলাবেন সেটা আপনাদের ব্যাপার। তবে এই প্রথম আমরা সত্যিকারের বুদ্ধিমান ভিনগ্রহের প্রাণের সন্ধান পেয়েছি, তাই আমার অভিমত হল, জনগণকে সব কিছু খুলে বলা। হ্যাঁ, হয়তো সাময়িক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে; কিন্তু সত্যটা জানার অধিকার তাদের আছে।”
উচ্চস্বরে হেসে উঠেন স্নোভারিচ। হাসির দমকে তার নিশ্বাস আটকে আসে। হেঁচকি তুলে কাশতে কাশতে দুই হাত উঁচিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। খানিকপর কিছুটা আস্বস্ত হয়ে গলা খাঁকাড়ি দিয়ে বলেন, “দুঃখিত, মিস্টার কামাল আপনার কথার সঙ্গে একমত নই। নাসায় অনেক বছর কাজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি পৃথিবীর বেশির ভাগ মানুষ বোকা এবং ধর্মীয় ও রাজনৈতিকভাবে অন্ধ-গোড়া। যদি কাল জানতে পারে মানুষ মহাবিশ্বের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি নয়। এই আহম্মকগুলো তখন এমন পরিস্থিতির তৈরি করবে যে মনে হবে এর চেয়ে নরক ঢের ভালো। একটা বড়ো অংশ ষড়যন্ত্র তত্ত্বের গন্ধ খুঁজবে, আরেকটা অংশ সম্পূর্ণ বিষয়টিকে অতিরঞ্জিত করে চরম হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়বে। ধর্মগুলোর স্তম্ভ ধ্বসে পড়বে। প্রতিটি মহল্লায় মহল্লায় দাঙ্গা হাঙ্গামা শুরু হয়ে যাবে। দ্রুতগতিতে খুনোখুনী আত্মহত্যা ছিনতাই ডাকাতি, অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।”
মাথা ঝাঁকিয়ে প্রফেসর কামাল স্নোভারিচের কথায় সায় দিয়ে বলেন, “আপনার কথায় যুক্তি আছে, তবে এত বড়ো ঘটনা ধামাচাপা দিয়ে রাখা সম্ভব নয়। একটি দুটি জায়গায় আর্বিভাব হলে না হয় কিছু একটা বলে সান্তনা দেওয়া যেত, কিন্তু পৃথিবীজুড়ে যে তান্ডব ঘটে গেছে সেটাকে কীভাবে লুকানো যাবে?”
আরো কয়েকবার ভিনগ্রহীদের সঙ্গে বার্তা আদান প্রদান করা হয়। অতঃপর এক ঘণ্টার জন্যে দুপুরের খাওয়ার বিরতি নিয়ে আবার এই বদ্ধ ঘরে একত্রিত হয়েছেন সকলে। আরো অনেকক্ষণ ধরে পক্ষে বিপক্ষে নানান যুক্তি তর্ক চলতে থাকে। অবশেষ ভাইস-প্রেসিডেন্ট দাঁড়িয়ে বলেন, “বিষয়টা এখন আর আমার একার হাতে নেই, সত্যি বলতে প্রেসিডেন্টের হাতেও নেই; এটা এখন নিশ্চিতভাবেই বৈশ্বিক আকার ধারণ করেছে। আমি আপনাদের কথা সব শুনলাম; এখন আমি একা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলব। ওঁকে সবকিছু খুলে বলার পর উনি নিশ্চয় বিশ্বনেতাদের সঙ্গে আলোচনা করবেন। আপাতত এলিয়েনদের মেসেজ পাঠিয়ে জানিয়ে দিন সম্পূর্ণ বিষয়টি অত্যন্ত জটিল; তাই সফলভাবে এক্সিকিউট করতে হলে একযোগে বিশ্বের সবগুলো দেশকে যুগপৎ অংশগ্রহণ করতে হবে। হয়তো তাদের সাহায্যও আমাদের প্রয়োজন হতে পারে।” বলেই পিঠ টানটান রেখে হনহন করে হেঁটে ঘর থেকে বের হয়ে যান ম্যাডাম ভাইস-প্রেসিডেন্ট লিলিয়া জনাথন।
নির্জন একটি ঘরে প্রবেশ করেন ভাইস-প্রেসিডেন্ট। এই ঘরটি থেকে পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তের সঙ্গে মুহূর্তেই নিরাপদে যোগাযোগ স্থাপন করা যায়। ফোনটা একবার রিং হতেই অপরপাশে একজন রিসিভ করে। মুচকি হেসে অভিবাদন জানিয়ে ভাইস-প্রসিডেন্ট জিজ্ঞেস করেন, “স্যার, আপনার সঙ্গে আর কেউ নেই তো?”
“না, আমাদের আলাপ আর কেউ শুনছে না; তুমি নিশ্চিন্তে কথা বলতে পারো।”
“স্যার, ভিনগ্রহীদের একমাত্র দাবী কবুতরের উপর সবধরনের পরীক্ষা বন্ধ করতে হবে। কবুতর হত্যা করা, তাদের খাওয়া, বন্দি করা ইত্যাদি সব নির্যাতন পরিত্যাগ করে তাদের মুক্তি দিতে হব। আমরা প্রস্তাব দিয়েছিলাম যেন আমাদের সব কবুতরকে তাদের গ্রহে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু তারা এই প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছে। নাসার এক্সপার্টদের ধারণা এলিয়েনদের বিশ্ব অ্যান্টি-ম্যাটারের তৈরি, তাই তাদের গ্রহে আমাদের কবুতরদেরকে আশ্রয় দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু তাদের শেষ বার্তায় আমাদের জানিয়েছে আমাদের গ্রহের অনুরূপ একটি গ্রহ তারা খুঁজে পেয়েছে যেখানে পৃথিবীর সব কবুতরকে আশ্রয় দেওয়া সম্ভব। তাই তারা সব কবুতরকে একটি নির্দিষ্ট তারিখে মুক্ত করতে বলছে, সেই দিন সমগ্র পৃথিবীর আকাশের একদিকে একযোগে তারা একটি পোর্টাল খুলবে। সব কবুতর তার ভেতর দিয়ে উড়ে সেই গ্রহে পাড়ি জমাতে পারবে।”
চুপ করে ভাইস-প্রেসিডেন্টের কথা শুনছেন প্রেইডেন্ট। তার কপালে চিন্তার ভাঁজ। মৃদু স্বরে বলেন, “তুমি কী ভাবছ বুঝতে পারছি। বিশ্ববাসীর কাছে ব্যাপারটা গোপন রেখে কীভাবে কার্য হাসিল করা যায়, তাই তো?”
“জি স্যার। অনেক কবুতর গৃহপালিত। সেক্ষেত্রে যারা এই কবুতর পুষছে তারা আমাদের নির্দেশ যদি আমলে না নেয় তাহলে সমস্যা হয়ে যাবে। তার উপর পৃথিবীর সব দেশকে এই বিষয়ে একমত হতে হবে।”
“সব দেশকে প্রয়োজনে রাজি করানো যাবে। সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকা ল্যাবের সব কবুতরকে মুক্তও করা যাবে; কিন্তু এত বিশাল জনগণকে একসঙ্গে রাজি করানোটাই আসল চ্যালেঞ্জ। কিন্তু এখানে অন্য কোনো সমস্যা হবে না তো? মানে একসঙ্গে পৃথিবীর সকল কবুতর গায়েব হয়ে গেলে পরিবেশগত কোনো প্রভাব পড়বে না তো?” প্রেসিডেন্টের কণ্ঠে অকৃত্বিম অনিশ্চয়তা স্পষ্ট হয়ে উঠে।
লম্বাদম নিয়ে ভাইস-প্রেসিডেন্ট বলেন, “এই বিষয়ে আমি এক্সপার্টদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। ইতিহাসে কেবল একবারই কাছাকাছি ঘটনার সাক্ষী হয়েছিল বিশ্ববাসী। আপনার নিশ্চয় চায়নার “গ্রেট স্মেশ স্প্রেরো ক্যাম্পেইন” এর ব্যাপারে জানা আছে?”
“শুনেছি কিন্তু বিস্তারিত জানা নেই।”
“চড়ুই পাখি জমির শষ্য ও ফলমূল খেয়ে ফেলত। কৃষকবান্ধব চাইনিজ সরকার এই সমস্যা সমাধানে ১৯৫৮ সালে সমগ্র দেশব্যাপী একযোগে চড়ুই পাখি নিধন শুরু করে। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬০ এই দুই বছরে চীনে দেড় কোটি চড়ুই হত্যা করা হয়। যদিও এই সংখ্যাটা সরকারি ভাষ্যমতে কিন্তু বিশ্লেষকদের ধারণা পাঁচ থেকে সাত কোটি চড়ুই হত্যা করা হয়েছিল।”
“এত পাখি একসঙ্গে কীভাবে হত্যা করা সম্ভব হয়? তারা কি কোনো রাসায়নিক মারণাস্ত্র ব্যবহার করছিল?”
“না কোনো গতানুগতিক অস্ত্রই ব্যবহৃত হয়নি। সমগ্র দেশবাসি একযোগে ঢোল-করতাল-থালা-বাটি বাজিয়ে চড়ুইকে টানা আকাশে উড়তে বাধ্য করে। এভাবে উড়তে উড়তেই ক্লান্ত হয়ে সব চড়ুই মারা পড়ে।”
“ওহ নো! কী মর্মান্তিক!” অস্ফুট আর্তনাদ বের হয়ে আসে প্রেসিডেন্টের কণ্ঠ চিড়ে।
“অল্প সময়ের ভেতর দেশের প্রায় সব চড়ুই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার ফলাফল কিন্তু মারাত্মক হয়েছিল। প্রকৃতির ক্রুদ্ধরূপ হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল চায়নাবাসী। চড়ুই পাখি যতটুকু শস্য খায় তার চেয়ে বেশি রক্ষা করে ফসলের জন্যে ক্ষতিকর পোকামাকড় বিশেষ করে পঙ্গপাল খেয়ে। ভুল বুঝতে পেরে চিন সরকার দ্রুত রাশিয়া থেকে প্রায় আড়াই লাখ চড়ুই আমদানি করে। কিন্তু যা ক্ষতি হওয়ার ততদিনে হয়ে গেছে। চিনের ইতিহাসে ভয়ংকরতম দুর্ভীক্ষ হানা দেয়; ১৯৫৯ থেকে ১৯৬১ এই দুই বছরে চিনের প্রায় সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষ না খেয়ে মরা পড়ে। প্রকৃতি কী নির্মম সমতা সাধন করেছে! হত্যাকৃত চড়ুই আর মারা পড়া মানুষের সংখ্যা প্রায় সমান!”
“তাহলে পৃথিবী হতে সব কবুতর নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেও কি একই প্রভাব পড়তে পারে?” নির্লিপ্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করেন প্রেসিডেন্ট।
“আমি এক্সপার্টদের সঙ্গে আলোচনা করে যা বুঝতে পেরেছি, পরিবেশগত তেমন বড়ো কোনো বিপর্যয় ঘটার সম্ভাবনা কম। আর এখন যেহেতু ব্যাপারটা আগে থেকেই আমরা জানি, চিনের ঘটনার মতো একটা উদাহরণও আমাদের হাতে আছে, সুতরাং আগে থেকে সতর্ক থাকতে পারব; সেইসঙ্গে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। তবে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এক্ষেত্রে অন্তত ঈশ্বরবিরোধী কোনো কাজ হচ্ছে না তাই প্রকৃতির ক্রুদ্ধ মূর্তির মুখোমুখিও হতে হবে না!”
“তোমার এই প্রকৃতি-ঈশ্বর বিশ্বাস তোমার মনেই রাখ, প্রকাশ করেতে যেও না।” কট্ট্রর বাস্তববাদী প্রেসিডেন্টের কণ্ঠে খানিকটা তিরষ্কারের ছোয়া। “এখন আসল সমস্যা তো হচ্ছে জনগণকে কীভাবে সামলানো যায়, তাই তো? সে ব্যাপারে কিছু ভেবেছ?”
“একশন কমিটির সঙ্গে আলোচনা করে একটা প্রাথমিক পরিকল্পনা করা হয়েছে, তবে এতে আপনার সায় ও সহযোগীতা লাগবে।” বলেই চুপ করে যান ভাইস-প্রেসিডেন্ট।
“খুলে বলো।”
“প্রথমে প্রচার করা হবে সব প্রজাতির কবুতরের মধ্যে নতুন একধরনের অক্সিজেন তৈরিকারি প্লাঙ্কটনের সংক্রামণ হয়েছে। এই প্লাঙ্কটন হচ্ছে একটি রূপান্তরিত ভাইরাস। সমুদ্রের প্লাঙ্কটন পৃথিবীর অর্ধেকের বেশি অক্সিজেন সরবারহ করে। কিন্তু এই প্লাঙ্কটন কবুতরের দেহে মাইক্রোস্কোপিক অ্যান্টিম্যাটার অক্সিজেন তৈরি করে। ফলে কবুতরগুলো হয়ে উঠছে একেকটি অ্যান্টিম্যাটার বোমা। তাই আগামী শনিবার পৃথিবীর অর্বিটে অবস্থিত স্যাটেলাইটের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট ফ্রিকোয়েন্সির সিগনাল ট্রান্সমিট করা হবে। সব কবুতর সেই সিগনাল লক্ষ করে আকাশে উড়বে আর সেখানেই বিষ্ফোরিত হয়ে যাবে। সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হবে কেউ যেন কোনো কবুতর আটকে না রাখে। যদি কেউ এই নির্দেশ অমান্য করে তবে পরিণতির জন্যে সে নিজে দায়ী হবে এবং নিজের ও আশপাশের পরিবারকে ঝুঁকিতে ফেলার জন্যে তাদের বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল অফেন্সের কেস করা হবে।”
গভীর মনোযোগ সহকারে ভাইস-প্রেসিডেন্টের বক্তব্য শুনলেন প্রেসিডেন্ট। নিরবে কিছুক্ষণ ভাবলেন সম্পূর্ণ প্রস্তাবটি নিয়ে। অবশেষে বলেন, “কিন্তু অ্যান্টিম্যাটার বোমার বিষয়টা কি বিশ্বাসযোগ্য মনে হবে?”
“এটা নিয়ে ভিনগ্রহীদের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। তারা এখন পর্যন্ত চল্লিশটির বেশি জায়গায় অ্যান্টিম্যাটার হামলা করেছে। তাদের অনুরোধ করেছি আরো কিছু জনশূন্য জায়গায় এমন আত্মঘাতী কবুতর হামলা চালাতে পারবে কী না। প্রথমে রাজি হয়নি, কিন্তু পরে পুরো বিষয়টার গুরুত্ব উপলব্ধি করে এই প্রস্তাবে সম্মত হয়েছে। কিছু অতি বৃদ্ধ কবুতর যাদেরকে টেলিপোর্ট করে ওই গ্রহে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয় তাদেরকে অ্যান্টিম্যাটার বোমারু হিসাবে ব্যবহার করা হবে। আর আগামী শনিবার কবুতরগুলো আকাশের যেদিক লক্ষ করে উড়ে যাবে সে জায়গার ঠিক উপরে বায়ুমণ্ডলের বাইরে ছোটোখাটো অ্যান্টিম্যাটার বিস্ফোরণ করার অনুরোধ জানিয়েছি।” খানিক বিরতি নিয়ে নীচুস্বরে ভাইস-প্রেসিডেন্ট পুনরায় বলেন, “মোটামুটি ফুলপ্রুফ পরিকল্পনা কিন্তু কতদিন এই ঘটনা ধামাচাপা দিয়ে রাখা যাবে সেটাই হচ্ছে প্রশ্ন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই বিভিন্ন ফিল্ডের গবেষকেরা তথ্য ও ডাটা এনালাইসিস করে নানান ধরনের থিয়োরি নিয়ে হাজির হবে।”
গম্ভীর কণ্ঠে প্রেসিডেন্ট বলেন, “সেটা তখন দেখা যাবে। আপাতত বেশ ভালো পরিকল্পনা হয়েছে। আগামী শনিবার? হুম! তার মানে হাতে সময় আছে পাঁচ দিন! সময় নষ্ট না করে কাজে লেগে যাও। যদিও আমাকে কয়েকজন উপদেষ্টা ও রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে আলাপ করতে হবে; তবুও তোমরা চালিয়ে যাও। আমার পক্ষ থেকে প্রাথমিক অনুমতি দেওয়া হল। গুড লাক।”
ফোনটা রেখেই চেয়ারে গা এলিয়ে দেন ভাইস-প্রেসিডেন্ট। ঘাড়ের পেছনের রগ টনটন করছে। হাত দিয়ে চেপে ধরে কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে রাখেন; মাথায় দ্রুতবেগে চিন্তার ঝড় বয়ে চলছে। আগামী চার-পাঁচটা দিন পৃথিবীর জন্যে মহাগুরুত্বপূর্ণ।
[অধ্যায় চৌদ্দ]
শনিবার ভোর, ঘড়িতে প্রায় ছয়টা বাজে। পূব আকাশে সূর্য সবে উঁকি দিচ্ছে। বারো ঘণ্টা আগে থেকে পৃথিবীর সকল ফ্লাইট বাতিল করা হয়েছে। ভূমিস্থ করে রাখা হয়েছে সকল ড্রোন, হেলিকাপ্টার, বেলুন। বাতিল করা হয়েছে সকল প্রকার রকেটের উৎক্ষেপণ। পৃথিবীর আকাশ, পৃথিবীর বায়ু আজ কেবল কবুতরের জন্যে উন্মুক্ত। পৃথিবীবাসি সকল কবুতর মুক্ত করে দুরুদুরু বক্ষে অপেক্ষা করছে কিছু একটা ঘটার। চব্বিশ ঘণ্টার জন্যে প্রাইভেট কোম্পানির সকল স্যাটেলাইটের নিয়ন্ত্রণ নিজ নিজ দেশের সরকার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে। এই চব্বিশ ঘণ্টায় মহাকাশ হতে কোনো প্রকার ছবি, ভিডিয়ো-এর রেকর্ড থাকবে না কোথাও।
ওয়াশিংটন স্থানীয় সময় ছয়টা বাজতেই পৃথিবীর প্রতিটি শহরের, প্রতিটি গ্রামের, পাহাড়ে-বাদারের কবুতর ঝাঁকে ঝাঁকে আকাশের একটি নির্দিষ্ট দিকে একযোগে উড়তে থাকে। অবাক বিস্মিত বিশ্ববাসী সাক্ষী হয়ে থাকে অভাবনীয় এক ঘটনার! হাজার হাজার লাখ লাখ কবুতর, জংলি কবুতর, পোষা কবুতর, রঙিন কবুতর, বাচ্চা কবুতর, গবেষণাগারের কবুতরে আকাশ অন্ধকার হয়ে আসে। কিছু কবুতর মুখে করে ডিম নিয়ে উড়ছে, আবার কিছু কবুতর দল বেঁধে মুখে করে বাসার মধ্যে সদ্য ফোটা বাচ্চাসহ উড়ছে।
বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে পৃথিবীবাসি। কেউ কেউ স্মার্টফোন বের করে ভিডিয়ো করছে, কেউ কেউ ছবি তুলে রাখছে। খোলা মাঠে, বাড়ির ছাদে, আঙিনায় একত্রিত হয়ে আবালবৃদ্ধাবনিতা অবলোকন করছে পৃথিবী থেকে দলে দলে হারিয়ে যাওয়া কবুতর। অনেকগুলো কবুতর জমা হলেই চোখ ধাধানো বিষ্ফোরণের মুহূর্তেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে কবুতরের দল। ছলোছলো নয়নে পৃথিবীবাসি দেখছে কীভাবে লাখে লাখে কবুতর বিষ্ফোরিত হয়ে যাচ্ছে; কষ্টে তাদের হৃদয় ভেঙে খানখান হয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ উচ্চস্বরে কেঁদে উঠে, কেউ কেউ হারিয়ে ফেলে চেতনা। অথচ পৃথিবীবাসি বুঝতেই পারছে না তাদের এই কান্নার কোনো মূল্য নেই, তাদের এই অনুভূতির প্রকাশ ভুল জাগায় ভুল সময়ে প্রয়োগ হচ্ছে। আকাশের উড়ে উড়ে চোখের আড়াল হতেই পোর্টালের ভেতর পতিত হয়ে সব কবুতর টেলিপোর্ট করে চলে যাচ্ছে বহুদূরের অজানা এক গ্রহে, যেখানে তাদের আর মানুষের কাছ থেকে পালিয়ে বাঁচতে হবে না। সেখানে তাদের উপর হবে না কোনো প্রকারের নির্যাতন, অত্যাচার। তারা মানুষের নৃশংসতার হাত থেকে বেঁচে যাচ্ছে চিরদিনের তরে।
***
আজ সাতদিন হল বাসায় ফিরেছেন প্রফেসর কামাল। মাঝে কেবল একদিনের জন্যে ল্যাবে গিয়েছিলেন কিছু দরকারি জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে আসার জন্যে, এছাড়া সারাদিন বাসাতেই শুয়ে বসে অলস সময় কাটাচ্ছেন। তাকে এবং তার ল্যাব নিয়ে কী করা হবে এখনো সরকার সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি। সম্ভবত তাকে আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় ফিরে যেতে হবে।
আজ শ্রেয়াসের জন্মদিন। রিত্তিকা ছুটি নিয়ে সকাল থেকেই বেইজমেন্টের দরজা আটকে হলোগ্রাফিক লেজার শো এর রিহার্সেল করছে। কামালের উপর দায়িত্ব পড়েছে শ্রেয়াসকে যেই করেই হোক ব্যস্ত রেখে বেসমেন্ট থেকে দূরে রাখার। কী সব সারপ্রাইজ-টারপ্রাইজ! রিত্তিকাটা এখনো এত ছেলেমানুষি করে না! প্রফেসর কামাল সকাল থেকে বাগানের চেয়ারটাতে বসে উদ্দেশ্যহীন-খাপছাড়া দুনিয়াদারির নানান চিন্তা করে যাচ্ছেন একের পর এক।
শ্রেয়াসও বুঝতে পেরেছে মা বেসমেন্টে তাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্যে কিছু একটা নিয়ে কাছ করছে, মনে মনে তীব্র আগ্রহবোধ খোঁচালেও আপাতত সেদিকে যাওয়া যাবে না। কিন্তু বাবা যদি কবুতরের খোপের কাছে যায় তাহলেই সেরেছে! তার সব অপকর্মের কথা ফাঁস হয়ে যাবে! ভরসার কথা হচ্ছে কবুতরের খোপগুলো বাগানের আরেকদিকে, বাবা সেদিকে খুব একটা যায় না।
বাড়ির বিড়ালটা হঠাৎ করে একটি খোপের দিকে মুখ করে জোরে জোরে চিৎকার করে উঠে। ভয়ে মুখ শুকিয়ে যায় শ্রেয়াসের। অদ্ভুত তো! এর আগে তো হার্কিউলিস কোনো দিন কবুতরের প্রতি এমন আচরণ করেনি। সে কী বুঝতে পেরেছে এখানে জেনেটিক্যালি ভিন্ন ধরনের কবুতর আছে? হার্কিউলিস লাফিয়ে পাইপ বেয়ে খোপের উপর উঠতে চাচ্ছে, প্রতিবারই পিছলে পড়ে যাচ্ছে। ক্রমাগত রাগ বেড়ে যাচ্ছে তার। এখন উপরে দিকে তাকিয়ে বিকট শব্দে ঘোৎ ঘোৎ করছে।
প্রফেসর কামাল ঘুরে সেদিকে তাকিয়ে বলেন, “হার্কিউলিসের কী হয়েছে, শ্রেয়াস?”
“কী জানি বাবা! আমি দেখছি।” বলেই প্রায় দৌড়ে কবুতরে খোপের দিকে এগিয়ে যায় শ্রেয়াস। তার পেছন পেছন প্রফেসর কামালও গিয়ে হাজির হন।
শ্রেয়াস হার্কিউলিসকে কোলে করে ঘুরতেই বাবাকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠে। কাঁপাকাঁপা গলায় বলে, “তুমি উঠে আসলে কেন? আমিই তো হার্কিউলিসকে নিয়ে আসছিলাম!”
শ্রেয়াসের কোলে উঠেও চোখ বড়োবড়ো করে কবুতরের খোপের দিকে তাকিয়ে আছে হার্কিউলিস; ল্যাজ শক্ত করে কিছুক্ষণ পরপর আছড়ে মারছে। খুবই আক্রমণাত্মক আচরণ। খানিকটা অবাক হন প্রফেসর কামাল। পৃথিবী এখন পায়রা শূন্য। বাচ্চা পায়রা, এমনকি সকল ডিম পর্যন্ত তুলে নিয়ে তারা ভিনগ্রহে পাড়ি জমিয়েছে। তাহলে হার্কিউলিস কীসের গন্ধ পেয়েছে কবুতরের খোপে? কোনো সাপ এসে আশ্রয় নেয়নি তো?
দ্রুত একটি মই এনে খুব সাবধানে বাসার কাছে মুখ নিয়ে প্রতিটি খোপের ভেতর টর্চ মেরে দেখতে থাকেন প্রফেসর কামাল। হঠাৎ একটি খোপের ভেতর দুটি বাচ্চা কবুতর দেখে ভীষণ চমকে উঠেন তিনি! আরেকটু হলে মই থেকে পড়েই যাচ্ছিলেন! তড়িৎ হাত বাড়িয়ে পাইপের সাপোর্ট নিয়ে পতন ঠেকান তিনি।
খোপের ভেতর হাত ঢুকিয়ে একটি বাচ্চা বের করে আনেন প্রফেসর কামাল। খুব যত্ন সহকারে ধীরে ধীরে কবুতরটির দেহের প্রতিটি অংশ পর্যবেক্ষণ করেন তিনি। বাচ্চাটিকে ভেতরে ঢুকিয়ে অপরটিকে বের করে এনে একইভাবে পরীক্ষা করেন। নিশ্চিত তার ল্যাবেরই জেনেটিক্যালি মডিফাইড কবুতর এ দুইটা! তারা এখানে এলো কী করে? দেখে মনে হচ্ছে দুই-তিন দিনের বাচ্চা এরা। আর এই বাসার সব কবুতর যখন চলে যায় তখন এই ডিমদুটো ফেলে রেখে যাওয়ার কারণ কী? একের পর এক প্রশ্ন এসে ভর করে তার মনে। শ্রেয়াসের বড়ো ভূমিকা আছে এইসবে প্রায় নিশ্চিন্ত। তাকে জিজ্ঞেস করতে হবে।
ধরা পড়ে গেছে বুঝতে পেরে মাথা নীচু করে বাবার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে শ্রেয়াস। ভয়ে মুখ শুকিয়ে গেছে তার।
“তুমি কি আমার ল্যাব থেকে জেনেটিক্যালি মডিফাইড কবুতরের দুটি ডিম চুরি করেছিলে?”
মাথা নীচু রেখেই খানিকটা ঝুঁকিয়ে সত্য স্বীকার করে শ্রেয়াস।
“কবে? একদম সঠিক তারিখ বলো।” অনেক ধরনের চিন্তা এসে ভর করছে প্রফেসর কামালের মনে। তার অবচেতন মন বলছে; এলিয়েনদের কাছে বার্তা পাঠানো, পৃথিবীতে এসে তাদের হামলা সবশেষে পৃথিবীকে কবুতর শূন্য করা— এই সবকিছু শুরু শ্রেয়াসের এই চুরি করা ডিম থেকে সূত্রপাত।
কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে শ্রেয়াস বলে “যেদিন প্রথম ল্যাবে গিয়েছিলাম তার পরদিনই। আমার এখানের দুটো ডিম দিয়ে রিপ্লেস করে ল্যাব থেকে দুটি ডিম নিয়ে আসি।” খানিকটা বিরতি নিয়ে কাঁদোকাঁদো ভঙ্গিতে আবার বলে, “বাবা, আমি কী ভীষণ অন্যায় কিছু করেছি? তোমার কী অনেক বড়ো ক্ষতি হয়ে গেছে?”
ছেলের প্রশ্ন যেন শুনতেই পাননি প্রফেসর কামাল। তার মাথায় চলছে চিন্তার ঝড়। তার মানে এলিয়েনরা পৃথিবীতে হামলা চালানোর দুইদিন আগে শ্রেয়াস ডিমদুটো ল্যাব থেকে এখানে নিয়ে আসে। ল্যাবে যেহেতু ফ্যারাডে-কেইজের মাধ্যমে সব ধরনের সিগনাল ব্লক করা আছে তাই সেখান থেকে কোনো কবুতরের পক্ষে এসওএস সিগনাল পাঠানো সম্ভব হয়নি। সুতরাং যেই মাত্র ল্যাব থেকে বাইরে বের হয়েছে সঙ্গে সঙ্গে সিগনাল পাঠিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তখনও তো এই কবুতর দুটো ডিম ফুটে বের হয়নি! তাহলে? আর এই দুটোকে রেখেই বা কেন সবাই চলে গেল? নাহ! কিছু একটা গড়মিল আছে; হিসাব মিলছে না। মাথা গরম হয়ে উঠে প্রফেসর কামালের; কান দিয়ে যেন গরম বাতাস হচ্ছে।
ভয়ে ভয়ে বাবার মুখের দিকে তাকায় শ্রেয়াস। সেখানে কোনো ভাবান্তর নেই, যেন পাথরে খোদাই করা মুখমণ্ডল। এই জগতে নেই যেন প্রফেসর কামাল। হঠাৎ করেই রিত্তিকার চিৎকারে ঘোর ভাঙে তার। ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে হাত উঁচিয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ডাকছে শ্রেয়াসে বাবা বলে।
উজ্জ্বল হাসি দিয়ে রিত্তিকা বলে, “সব কিছু সেট করা হয়ে গেছে। চল, বেসমেন্টে গেলেই দেখতে পাবে।”
বেসমেন্টে স্টেজটি সাজিয়েছে দারুন! চমৎকার লাইটিং ও ডেকোরেশন করা হয়েছে। সব লাইট বন্ধ করে অন্ধকার করতেই চালু হয়ে যায় থ্রিডাইমেনশনাল হলোগ্রাফিক শো। ছোট্ট শ্রেয়াসের জন্মের পর থেকে যত ভিডিয়ো ধারণ করা হয়েছে সেগুলোকে থ্রিডাইমেনশনাল হলোগ্রাফে রূপান্তরিত করা হয়েছে মনে হচ্ছে স্টেজের উপর সত্যিকারে শ্রেয়াস। দুধ খাচ্ছে, ঘুমাচ্ছে, দুই পা আকাশের দিকে তুলে দ্রুতগতিতে নাচাচ্ছে, কখনো কখনো শব্দ করে কেঁদে উঠছে। হামাগুড়ি দিয়ে সারা ঘরময় ঘুরে বেড়াচ্ছে, পেছনে রিত্তিকা দৌড়েও ছেলেকে ধরতে পারছে না। প্রথম দেওয়াল ধরে উঠে দাঁড়ানো, প্রথম কদমে মায়ের দিকে হেঁটে শেষ মুহূর্তে কোলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়া— সবকিছু এত জীবন্ত যেন মনে হচ্ছে হাত বাড়ালেই ছুঁয়ে দেখা যাবে।
শ্রেয়াস অবাক হয়ে নিজের অতীত পর্যবেক্ষণ করছে। রিত্তিকার চোখমুখ আনন্দে ঝলমল করছে। তন্ময় হয়ে শ্রেয়াসের অতীত দেখছেন প্রফেসর কামাল। হঠাৎ একটি সম্ভাবনা উঁকি দেয় তার মাথায়। বসা থেকে তড়াক করে দাঁড়িয়ে যান তিনি। কোনো কিছুই মাথায় ঢুকছে না তার; চিন্তা-চেতনা-সময় যেন স্থির হয়ে গেছে। তবে কী! তবে কী কোয়ান্টাম ম্যাকানিক্সের সেই রহস্যময় রেট্রো কজোয়ালিটি এর দেখা পেয়েছেন তিনি?
“তোমরা দেখ, আমি কিছুক্ষণ পর আসছি।” কোনো রকমে এই কথাটুকু বলেই দ্রুত বেসমেন্ট থেকে বের হয়ে কবুতরের খোপের দিকে এগিয়ে যান প্রফেসর কামাল। কবুতরের বাচ্চা দুটিকে ধরে ধীরে ধীরে টেবিলের উপর রাখেন। দৃষ্টি না সরিয়ে চেয়ারে বসত বসতে আপন মনে বলেন, “তোমরা এখন ক্রমাগত এসওএস বার্তা পাঠাচ্ছ, আর সেই বার্তা সময়ের বাধা ভেঙে রেট্রো কজোয়ালিটি তৈরি করে তিন সপ্তাহ অতীতে গিয়ে কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরের গ্রহে সেই এলিয়েনদের কাছে পৌঁছাচ্ছে। আর এই কারণেই কি তোমাদেরকে ফেলে গেছে তারা? তা না হলে এই রেট্রো কজোয়ালিটি শুরুই হত না।”
ভীতসন্ত্রস্থ বাচ্চা দুটি মাথা নীচু করে ঠোঁট নাড়িয়ে নাড়িয়ে নির্দিষ্ট ছন্দে একটা শব্দ করে যাচ্ছে। কিংকর্তব্যবিমূঢ হয়ে বসে আছেন প্রফেসর কামাল। পৃথিবীর শেষ পায়রা এই দুটো! কী করবেন এদের নিয়ে? এরা জেনেটিক্যালি মডিফাইড কবুতর! উচ্চ বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন। আচমকা আরেকটি সম্ভাবনা তার মাথায় উঁকি দিতেই প্রফেসরের সর্বাঙ্গ কেঁপে উঠে।
এমন কী হতে পারে না জেনেটিক্যালি মোডিফাইড এই বুদ্ধিমান কবুতরেরাই হচ্ছে কিছুদিন আগে হামলা করা এলিয়েন? তারা হয়তো সুদূর কোনো গ্রহ হতে আসেনি বরং কোটি কোটি বছর ভবিষ্যৎ হতে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে! হয়তো মানুষ বিলুপ্ত হয়ে গেছে আর তার জায়গায় এই কবুতরেরা সভ্যতা গঠন করেছে। কিন্তু তারা তো বলেছিল পৃথিবীর কবুতরকে তাদের গ্রহে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তারা কী বুঝিয়েছে তাদের সময়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়? হুম! হতে পারে। সম্ভবত কোটি কোটি বছরে এই বুদ্ধিমান কবুতরেরা এত বেশি বিবর্তিত হয়ে গেছে যে তাদের ওখানে গিয়ে এরা টিকে থাকতে পারবে না। হয়তো পরিবেশই সহনশীল হবে না। হয়তো যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জ্বলে পুড়ে যাবে!
তাহলে পৃথিবীর সব কবুতরকে তারা কোথায় নিয়ে গেছে? সম্ভবত মাঝামাঝি কোনো এক সময়ে, যেখানে মানুষ বিলুপ্ত হয়ে গেছে আর কবুতরেরা কেবল নতুন সভ্যতার সূচনা করছে। কিন্তু সেক্ষেত্রে এইদুটোকে ফেলে গেল কেন? এমন কী হতে পারে এদের পাঠানো এসওএস কোটি বছর ভবিষ্যতে গিয়ে পৌঁছায় আর সেখান হতে ঠিক এই সময়ে পোর্টাল খুলতে গিয়ে দুই সপ্তাহ আগের সময়ে খোলা হয়ে গেছে। তাই আর এই দুটোকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। নিয়ে গেলে সিগনাল পাঠাবে কে?
চিন্তার ঝড় চলছে প্রফেসরের মাথায়। এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন টেবিলের উপর বসে ঝিমুতে থাকা দুর্বল দুটি কবুতরের বাচ্চার দিকে। কোথায় বার্তা পাঠাচ্ছ তোমরা? কোটি কোটি বছর ভবিষ্যতে? না কী কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরের কোনো গ্রহে? যেটাই হোক, তোমরা হচ্ছে পৃথিবীর শেষ কবুতর যুগল! ভবিষ্যত পায়রা প্রজাতির আদি মাতা আদি পিতা!
Tags: উপন্যাস, মোহাম্মদ সাইফূল ইসলাম, সপ্তম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা