অ্যালিথিয়া
লেখক: সায়ংতরী ঘোষ
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
ড্রইংরুমে ঢুকেই শ্যাওলা রঙের চওড়া সোফায় নিজেকে এলিয়ে দিলেন ড. সেন। ওঁর উপস্থিতির সাড়া পেয়ে নরম সোনালি আলো আলতো করে ফুটে উঠল ঘর জুড়ে। আর প্রকাণ্ড ড্রয়িং রুমের একপাশের দেওয়াল ঘেঁষে রাখা বিশালাকৃতি টিভি অন হয়ে গেল নিজের থেকেই, ভলিউম যদিও একেবারে কম করে রাখা।
ক্লান্তিতে সারা শরীর টন্টন্ করছে। আজ সারাদিন যা কাজ গেছে, ওঁর এই ছাপ্পান্ন বছর বয়েসে এত ধকল, সত্যি বলতে কি আর সয় না। ভোর ছ-টা থেকে শুরু হয়েছে আজ। পরপর শুভেচ্ছা বার্তা। সকলকে একটা মামুলি “থ্যাঙ্কস” বলতেই সকালটা কেটে গেল। দু-চারটে পত্রিকা আর নিউজ চ্যানেলের সঙ্গে মুখরক্ষার জন্যে কিছু হালকা কথাবার্তা। তারপর একটা সিরিয়াস অনলাইন ইন্টারভিউ দিলেন বিবিসি-তে, সেটা চলল প্রায় আধ ঘণ্টা। তারপর প্রেস কনফারেন্স। দুপুরে প্রধানমন্ত্রীর পাঠানো প্রাইভেট জেটে উড়ে গেলেন দিল্লী। তারপর বিকেল থেকে পরপর সব মেগা ইভেন্ট। একে একে সব হাইপ্রোফাইল শিল্পপতিদের সঙ্গে মিটিং-এর পর প্রেসিডেন্টের সঙ্গে পার্সোনাল ডিনার দিয়ে আজকের উৎসব শেষ হল এই ঘণ্টা তিনেক আগে। রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে বেরিয়ে লালবাতি গাড়িতে দিল্লীর ব্যস্ত রাস্তার যানজট এড়িয়ে আবার প্রাইভেট প্লেনে ইম্ফল ফিরে শহরের প্রান্তে তাঁর এই বাংলোতে ঢুকেছেন সবে দশ মিনিট আগে।
এই ব্যস্ততার আতিশয্য অবশ্য ড. সেনের দৈনন্দিন জীবনে আদপেই দেখা যায় না এমনিতে। তাই হয়তো আরো বেশি করে ক্লান্ত লাগছে। উনি বয়স্ক মানুষ, বিপত্নীক। একা থাকেন সবুজ আর ফুলের রাজ্য মণিপুরের ইম্ফল শহরে। শহরের একটু বাইরে বিঘা-খানেক জায়গা জুড়ে তাঁর বাগান-ঘেরা বাংলো বাড়ি। একটি মালি, একটি রান্নার লোক, একজন লোক অন্যান্য কাজের জন্যে আর একটি নাইটগার্ড, এই চার জন ছাড়া অধিকাংশ দিনে আর কোনো মানুষের মুখদর্শন করতে হয় না তাঁকে। উনি বাগানের গোলাপগুলোর পরিচর্যা করেন, বাইরের বারান্দায় ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দেন, ল্যাবরেটরিতে কাটিয়ে দেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ইম্ফলের লোকে ওঁকে ডাক্তারবাবু বলে সমীহ করে। যদিও এই ডাক্তার ওষুধপত্র নিয়ে কারবার করেন না, তাও তারা জানে। এই যে প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি, দেশের বাঘা-বাঘা ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট আর বিজনেস টাইকুনদের সঙ্গে মিটিং ওঁকে করতে হল, সে নেহাত আজকেরই ব্যাপার। খানিক বাধ্য হয়েই। সকলের পীড়াপীড়িতে।
অ্যালিথিয়া টিভি আজ দশ বছরে পা দিল। অ্যালিথিয়া, যে ওয়েব প্ল্যাটফর্ম আজ এন্টারটেইনমেন্টের সঙ্গে প্রায় সমার্থক হয়ে গেছে। শুধু ভারতবর্ষে নয়, গোটা পৃথিবীতে। ভারতের একটা কোম্পানি যে এই ভাবে সারা পৃথিবীর টিভি সিরিয়ালের সমস্ত প্রাইম-টাইম দখল করে নিতে পারে, সে দশ বছর আগে কেউ ভাবতেও পারত না। আর সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন যে মানুষটি, তাঁকে আজকে, অ্যালিথিয়ার জন্মদিনে লোকচক্ষুর আড়ালে থাকতে দেবে কেন মিডিয়া? অ্যালিথিয়ার শেয়ারের দাম আজ আকাশ ছুঁয়েছে। সেই দিক থেকে দেখতে গেলে ড. সেন এই মুহূর্তে পৃথিবীর সেরা ধনকুবেরদের মধ্যে একজন। তবে সে ব্যাপারটা কিন্তু ওঁর আপাত আড়ম্বরহীন জীবনযাত্রা দেখে এখানকার সাধারণ লোকজন সচরাচর বুঝতে পারে না। শহরের আর পাঁচ জন ডাক্তার, ব্যাঙ্ক ম্যানেজার, সম্মৃদ্ধ ব্যবসায়ীর সঙ্গে ওঁর তফাৎ করা যায় না। উনি নিজেও দানধ্যান করেন অনেক। রোজগারের হিসেব রাখেন না সেভাবে।
কিন্তু বিশ্বদুনিয়া তা মানবে কেন? তাই আজকের এই উৎসব। টানাটানি, ডাকাডাকি, মিটিং, ডিনার। আর সে ডাকে নিজে ছুটে না গিয়ে উপায়ও নেই ড. সেনের। অ্যালিথিয়া মানেই তিনি। না, বাড়াবাড়ি না। কথাটা এক্কেবারে খাঁটি। অ্যালিথিয়া টিভিতে কোনো কর্মচারী, কোনো শিল্পী, কোনো মানুষ নেই! এ হলও সম্পূর্ণ ভাবে ড. সেনের ব্রেইন চাইল্ড। আজই তো বিবিসি”তে লাইভ ইন্টারভিউয়ে ওঁর পরিচয় দিতে গিয়ে সঞ্চালক বললেন, “অ্যা সায়েন্টিস্ট হু টুক আর্টিফিসিয়াল ইন্টালিজেন্স টু নেক্সট লেভেল… টু দ্য লেভেল টু টাচ আওয়ার হার্টস! হৃদয়ের কাছাকাছি।”
মর্মস্পর্শী বিজ্ঞান! হ্যাঁ, ফলাও করে সে কথা লেখা থাকে বৈকি অ্যালিথিয়ার হোম পেজে। ড. সেন যদিও চোখ বুজে নিজেকে বিছিয়ে দিয়েছেন সোফার নরম আশ্রয়ে, তবু তাঁর কানে যাচ্ছিল টিভির চাপা স্বর। এইসব কথাগুলোই সেখানে বলে চলেছেন এক সংবাদ-পাঠিকা। উত্তেজিত গলায় মেয়েটি বর্ণনা করছে অ্যালিথিয়ার স্বপ্ন-উড়ান।
“… আজ, এই মুহূর্তে অ্যালিথিয়া টিভির ওয়েবসাইটে আপনি পেয়ে যাবেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পটভূমিকায় তৈরি বিভিন্ন ভাষার প্রায় পাঁচ কোটি ধারাবাহিক। আজ্ঞে, হ্যাঁ, সংখ্যাটা এরকমই বিশাল! এবং তার সঙ্গে অসাধারণ সাজেশন সিস্টেম। অ্যালিথিয়ায় আপনাকে হাতড়ে বেড়াতে হয় না, ওই কোটি কোটি গল্পের ভিড় থেকে অ্যালিথিয়ার ইন্টেলিজেন্ট লার্নিং তুলে আনে পাঁচটি গল্প, যার মধ্যে অন্তত একটি আপনার ভালো লাগবেই। আমাদের মধ্যে হয়তো কেউ নেই যে টিভি দেখে, আর অ্যালিথিয়া দেখে না! বিশেষত সোপ অপেরা দর্শকদের তো সারাদিন কেটে যায় এই প্ল্যাটফর্মেই…”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছুক্ষণ টিভির স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকলেন ড. সেন। তারপর আস্তে আস্তে উঠে গিয়ে ফ্রিজ থেকে এক বোতল জল বের করে গলায় ঢাললেন। একটা একা মানুষ, একটা কোম্পানি, বিশ্বজয়। ভাবতে গেলে স্বপ্নের মতো লাগে বৈকি! অথচ কোথা থেকে যে এর শুরু হয়েছিল, তা বলার মতো একটা লোক নেই আজ ওঁর পাশে। বাড়ির ভেতরে এখন উনি একা। রান্নার লোক আতিয়া খাবার করে ঢাকা দিয়ে রেখে গেছে ডাইনিং টেবিলে। বাইরে নাইটগার্ড চুংলেন আছে। উনি বাড়ি ঢোকার সময় হাসিমুখে বিশাল একটা স্যালুট ঠুকেছিল সে অভ্যেসমতো। কিন্তু তার সঙ্গে বসে গল্প করা যায় না, অন্তত আজকের দিনে তো নয়ই। গুমোট একটা একাকীত্ব আস্তে আস্তে চেপে ধরছিল ড. সেন-কে!
বেডরুমে গিয়ে একটা ধবধবে সাদা টাওয়েল নিয়ে স্নানে গেলেন ড. সেন। টিভি চলতে লাগল ড্রইং রুমে। সেই মেয়েটি একটা স্ক্রিন-জোড়া ফ্লো-চার্ট দেখিয়ে তখন বলছে, “…অনেকেই হয়তো জানেন, যে এই সব কাহিনি, যা আমরা অ্যালিথিয়ায় দেখছি এবং গোগ্রাসে গিলছি, তা সম্পূর্ণভাবে তৈরি করেছে বুদ্ধিমান অ্যাল্গোরিদম। কিন্তু কীভাবে তৈরি হয় এই ধারাবাহিকগুলো? আসুন আপনাকে আজ নিয়ে যাই ড. সেনের ল্যাবরেটরির অন্দরে। ধারাবাহিকের কাজ শুরু হয় গল্প লেখা, চিত্রনাট্য তৈরি দিয়ে। অবশ্যই সেটা হল প্রথম ধাপ। সে কাজ কিন্তু কোনো মানুষ করে না, করে অ্যাল্গোরিদম। আর তার সঙ্গেই সে গল্পের সঙ্গে মানানসই একটা লোকেশন আর সেটের সিমুলেশন করা হয়। তারপর পটভূমিকা তৈরি হয়ে গেলে একে একে সেই ছবিটাকে সাজিয়ে দেওয়া মানুষের উপস্থিতি দিয়ে। তাদের কেমন দেখতে, কত হাইট, কেমন গায়ের রং, কেমন চোখ, কেমন ঠোঁট… জেনেরেটিভ অ্যাল্গোরিদমে একটু একটু করে আঁকা হয় চরিত্রগুলোর অবয়ব। তারপর অডিয়ো জেনারেশন। ঠিক হয় কেমন হবে চরিত্রদের গলার আওয়াজ, কেমন হবে থিম মিউজিক। এডিটিং, অ্যানিমেশন, স্পেশাল এফেক্টস… সব যোগ হয় একে একে। ব্যাস, জলজ্যান্ত হাতেগরম একটা নতুন ধারাবাহিক চলে এলো আপনার অ্যালিথিয়া প্রোফাইলে। হয়তো এমন একটি ধারাবাহিক যা থেকে আপনি চোখ সরাতে পারবেন না আগামী কয়েকটা মাস…”
মেয়েটি আবেগমথিত হয়ে বলেই চলেছে।
ইতিমধ্যে স্নান সেরে বেরিয়ে এসে একটা সাদা পোর্সেলিনের ছড়ানো পাত্রে খানিকটা সুপ ঢালছিলেন ড. সেন। দুটো টোস্ট আর একটু সুপ নিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসলেন তিনি। সন্ধে সাড়ে সাতটায় প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ডিনারে কথা ছিল বেশি আর খিদে ছিল এক্কেবারে কম। টিভির কথাগুলো কানে যাচ্ছে তাঁর। একটা আলতো অবজ্ঞার হাসি খেলে যাচ্ছিল তাঁর ঠোঁটের কোণে। “মর্মস্পর্শী বিজ্ঞান” কথাটা আবার তাঁর মনের মধ্যে ভেসে এল। মেয়েটি এমনভাবে বলছে যেন কাজটা জলের মতো সোজা! ইন্টেলিজেন্ট অ্যাল্গোরিদম-কে দিয়ে এমন গল্প লেখানো, এমন স্বাভাবিক অভিনয় করানো সিমুলেশনে তৈরি পুতুলদের দিয়ে যা মানুষের মন ছুঁয়ে যাবে… যেন করলেই হয়, এত্ত সোজা!
কিন্তু কই? অ্যালিথিয়ার কম্পিটিশন কই? তিনি তো দশ বছর আগে এই প্ল্যাটফর্ম শুরু করেছেন। এই যা এখন মেয়েটি টিভিতে বলছে, এইসব তাঁর কোম্পানির, যাকে বলে, ওপেন সিক্রেট! সকলে যেন জেনে বসেই আছে ওঁর ট্রেড সিক্রেট। কিন্তু আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স তো আজকের জিনিস নয়। জেনেরাটিভ অ্যাল্গোরিদম দিয়ে পদ্য লেখা, গান বাঁধা, সত্যিকারে অস্তিত্বহীন মানুষের অবয়ব আঁকা, থ্রি-ডায়মেনশনে এসব মানুষদের ভীষণ বিশ্বাসযোগ্য সিমুলেশন তৈরি করা, এসব হত ২০২০-২০৩০ সালে। সে প্রায় আজ থেকে পঁচিশ বছর আগেকার কথা। পঁচিশ বছর কম্পিউটার সায়েন্সের মতন বিষয়ের জন্যে পারতপক্ষে একটা যুগ। বিজ্ঞান অনেক এগিয়েছে। কিন্তু কই? গত দশ বছরে তো কেউ উঠে দাঁড়াতে পারেনি অ্যালিথিয়ার যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে। আর বাকি সব বাদ দেওয়া যাক! কোনো ইন্টালিজেন্ট অ্যাল্গোরিদম পেরেছে পাঠকের মনছোঁয়া কয়েকখানা নভেল লিখতে?
অথচ তাঁর কাছে প্রতিদিন আসা রাশি-রাশি দর্শকদের চিঠি বলে যে তিনি সত্যিই তাঁদের মন-মতো গল্প, প্রিয় চরিত্র তাঁদের উপহার দিচ্ছেন রোজ। কেউ কেউ লিখেছেন যে একই বাড়ির সব সদস্যেরা প্রত্যেকে একই সময়ে আলাদা-আলাদা সিরিয়াল দেখেন রোজ। একদিন দেখা না হলে মন খারাপ লাগে তাঁদের। কেউ লিখেছেন যেন তাঁরা নিজেদের চিনতে পারেন সিরিয়ালের গল্পে। আটকা পড়ে যান চরিত্রদের সঙ্গে ভালোবাসার বাঁধনে। এসব শুনে অবাক হন না ড. সেন। অ্যালিথিয়ার ভেতরের গূঢ় সত্যিটা তিনি জানেন বলেই, তিনি বোঝেন যে এসব ভীষণ স্বাভাবিকভাবেই হচ্ছে।
অথচ তাঁর তথাকথিত কম্পিটিটরদের কাছে পুরো ব্যাপারটা একটা দাঁতভাঙা অঙ্কের মতোই জটিল মনে হয়। ব্যাপারটা এক এক সময় হাস্যকরই হয়ে দাঁড়ায়! আজকের মতন আরো এক-আধখানা মিটিং, যাতে এর আগে এরকমই দায়ে পড়ে কখনো কখনো যেতে হয়েছে ড. সেন-কে, সেখানে অনেক পোড়খাওয়া সফটওয়ার টেকনোলজি কোম্পানির সিইও বা মালিকেরা ফিস্ফিস্ করে কানের কাছে মুখ এনে ওঁর কাছে স্বীকার করেছেন ওদের কোটি কোটি টাকা কীভাবে জলে গেছে এইরকম একটা প্ল্যাটফর্ম বানানোর চেষ্টায়। পার্টনারশিপ করার জন্যে হাতে-পায়ে ধরেছেন কতজন। আর অ্যালিথিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে নেমে ওয়েবটেক-জায়ান্ট “টিউপল” কীভাবে মুখ থুবড়ে পড়েছে, সে তো তলায় তলায় সক্কলের জানা। “টিউপল”-এর মালিক স্ট্যান ব্রেমফোর্ড-এর তো পথে-বসার উপক্রম হয়েছিল! অথচ ওঁর মতো ইনভেস্টমেন্ট, ওঁর মতো হাজার হাজার ব্রিলিয়ান্ট কম্পিউটার সায়েন্টিস্ট আর কার আছে? ফলে দু-বছর আগে এই ঘটনার পর সকলে নড়ে-চড়ে বসেছে, এবং কার্যত ড. সেনের এই ওয়ান-ম্যান-আর্মির কাছে হার স্বীকার করে নিয়েছে সবাই। আর তলে তলে মাথা চাপড়েছে যে কীভাবে এই অসম্ভব সম্ভব করছেন ড. সেন?
শিক্ষাগত দিক থেকে দেখতে গেলে ভাবনাটা আরো অপমানজনক হয় কম্পিউটার সায়েন্টিস্টদের কাছে। কারণ স্কুল-কলেজের সার্টিফিকেট বলছে যে ড. সেন একজন পদার্থবিজ্ঞানী। দূর্ধর্ষ ছাত্র ছিলেন ছেলেবেলা থেকেই, তা ঠিক। খুব কম বয়েসে পিএইচডি করেছেন কোয়ান্টাম ফিজিক্স-এর ওপর অসাধারণ কিছু গবেষণা করে। বাইশ বছর আগে তিনি ছিলেন তরুণ অধ্যাপক, ফিজিক্স পড়াতেন আমেরিকার একটি নামজাদা বিশ্বাবিদ্যালয়ে। তারপর হঠাৎ একদিন সেখান থেকে উধাও হয়ে গেলেন। ভারতীয় এক পদার্থবিজ্ঞানী সাত দিনের নোটিশে ডলারে মাইনের চাকরি ছেড়ে দিয়ে কেন আমেরিকা ছাড়লেন, সে নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় সে অবস্থায় সত্যিই কারো ছিল না। আর তারপর… বারো বছর পর হঠাৎ আত্মপ্রকাশ! এই ইম্ফলের বাড়ি থেকেই সে সময় অ্যালিথিয়া শুরু করেন ড. সেন। আর তারপরটা তো ইতিহাস! ফলত আর্টিফিশিয়াল ইন্টালিজেন্সের এই একচেটিয়া একাধিপত্বের দুনিয়ায় একজন পদার্থবিজ্ঞানীর উড়ে-এসে-জুড়ে-বসাটা সকলের একটা অস্বস্তির কারণ হয় বই কি!
সুপ আর টোস্ট নিয়ে ড. সেন আবার এসে বসলেন সোফায়। টিভিতে তাঁকেই দেখাচ্ছে। রাষ্ট্রপতির পাশে দাঁড়িয়ে। স্ক্রিনে নিজেকে দেখে কেমন যেন বিধ্বস্ত মনে হচ্ছিল ড. সেনের, হাসিটা কি সাঙ্ঘাতিক রকম নকল! তাঁর গম্ভীর শান্ত কণ্ঠে তিনি আলতো করে বললেন, “চেঞ্জ চ্যানেল, সেট অ্যালিথিয়া!”
মুহূর্তে মুছে গেল উত্তেজিতা সংবাদ-পাঠিকার কণ্ঠস্বর আর জ্বলজ্বল করে উঠল অ্যালিথিয়ার হোম পেজ। যান্ত্রিক মহিলাকণ্ঠ বলে উঠল, “ওয়েলকাম ড. সেন। কী দেখবেন, স্যার? অন্য কিছু ট্রাই করবেন, না কি ইউসুয়াল?”
অন্য। অন্য কী আর? অন্য কি আর বাকি আছে ড. সেনের জীবনে? অথচ কি ছিল না তাঁর কাছে! ছাত্রজীবনে দারুণ সাফল্য, সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যত… আর মিত্রা…! তাঁর অর্ধাঙ্গিনী, তাঁর প্রাণ। সুমিত্রা। কলকাতায় কলেজ স্ট্রিটের অলিগলি থেকে মিশিগানের আনাচ-কানাচের পাহাড়-জঙ্গলে-ঘেরা রাস্তাগুলো দিয়ে জীবনের সবচেয়ে সুন্দর কয়েকটা বছর যেন পাখির মতন উড়ে বেড়িয়ে কাটিয়েছেন ওঁরা দু-জন। তখন ওঁকে ড. সেন বলে ডাকত অনেক কম লোকে, আর নবারুণ বলে ডাকার মানুষ ছিল অনেক বেশি এই পৃথিবীতে।
স্মৃতিতে হঠাৎ যেন জর্জরিত হয়ে পড়েন ড. সেন। এক মুহূর্তে কবেকার সেই প্রেসিডেন্সি কলেজের বারান্দায় বেণীদোলানো শ্যামলা কিশোরী সুমিত্রার কালো ফ্রেমের চশমাপড়া বইমুখো বয়ফ্রেন্ড নবু হয়ে যেতে ইচ্ছে হল তাঁর। কত হাসি মুক্তোর মতো ছড়িয়ে ছিল ওঁদের জীবন জুড়ে। পড়াশোনায় মেডেল-পাওয়া ছাত্র ছিলেন নবারুণ। সুমিত্রা সেদিক থেকে ছিল মাঝারি। কিন্তু নবারুণের প্রতিটা স্বপ্নের জন্য সে ছিল দাবীতে সরব, উৎসাহে অটল। পড়াশোনা শেষ হল। বিয়েটাও হয়ে গেল আমেরিকা যাওয়ার আগের বছর ডিসেম্বর মাসে। কি ভীষণ শীত ছিল সেদিন! ছয়-টয়! মফস্বল হলেও বোলপুরে এতটা শীত পড়ে না এমনিতে! ফিনফিনে ধুতি পরে কি শীত লাগছিল নবারুণের। আর ওর মনে হচ্ছিল লাল বেনারসীতে, ফুলের সাজে, সোনার গয়নায় সুমিত্রা যেন ঝলমল করছে একটা সুপারনোভার মতো! সিমলায় মধুচন্দ্রিমায় গিয়ে সে কথা বলতে কি হেসেছিল মিত্রা! সে হাসির শব্দ আজও কানে বাজে নবারুণের, বৃষ্টির ঝিরিঝিরি শব্দের মতো।
এত কিছু, এত্ত কিছু মুছে যেতে কি লাগে? শুধু একটা দুর্ঘটনা মাত্র! আর কি অদ্ভুত দুর্ঘটনা! মেঝেতে ছড়িয়ে-পড়ে-থাকা একটা এক্সটেনশন তারে হোঁচট খেয়ে পড়েছিল মিত্রা। চোট লেগেছিল গোড়ালিতে। তখন ওরা মিশিগানে। কি ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেছিল নবারুণ, আর অভ্যেসমত খিলখিলিয়ে হেসেছিল মিত্রা। ডাক্তার দেখানো হল, এক্স-রে হল, কোথাও ভাঙেনি কিছু। পা তখনও ফোলা। ডাক্তার ওষুধ দিলেন। ব্যথার ওষুধ। পাঁচ দিন পেরোলো। সেই ফোলা কিন্তু কমল না। তখনও চিন্তা করছিল নবারুণ, আর তখনও হাসছিল মিত্রা। রাত্তিরে হাসিমুখে ঘুমাতে গিয়ে হঠাৎ পরদিন সকালে একেবারে নিঃসাড় হয়ে গেল সে তারপর। দেরি করেনি নবারুণ। উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে মিত্রাকে নিয়ে গিয়েছিল হাসপাতালে। ডাক্তার বললেন, “কোমা”। আকাশ থেকে পড়েছিল নবারুণ। কোমা? কী করে? এই তো হাসছিল! এই তো ঘুমাতে গেল কাল রাত্রে! ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিস, পালমোনারি এম্বোলিসম, ক্লট স্টাক ইন হার্ট… কত কি অচেনা কঠিন কঠিন কথা বলছিলেন ডাক্তার। কিছু মাথায় ঢুকছিল না ওর মাথায়। ওই শেষ। তারপর আর বেশি সময় দেয়নি মিত্রা কাউকে। বত্রিশ বছর বয়েসে হাসতে হাসতে হারিয়ে গেল মিত্রা।
“ড. সেন, শুড আই রান দ্য ইউসুয়াল সিরিজ?” অ্যালিথিয়ার যান্ত্রিক কণ্ঠে হুড়মুড় করে মিশিগানের হাসপাতালের হতভম্ব সদ্য-একা-হয়ে-যাওয়া নবারুণ এসে পড়ে বাস্তবে। এখন, এখানে, নবারুণ হারিয়ে গেছে, আছেন শুধু ড. সেন। আর আছে ওঁর আবিষ্কার। ওঁর বারো বছরের সাধনা। না, উনি যা চেয়েছিলেন, তা বানাতে পারেননি তিনি। চেয়েছিলেন, মরিয়া হয়ে চেয়েছিলেন, দিন-রাত-রাত-দিন এক করে চেয়েছিলেন সুমিত্রাকে ফিরিয়ে আনতে। যে ঈশ্বরকে কোনোদিন মানতে চাননি, তাঁর কাছে প্রার্থনা করেছেন এক মনে। না, তিনি পাগল হয়ে যাননি। তিনি জানতেন তাঁর এই পৃথিবীর সুমিত্রা হারিয়ে গেছে, আর কোনোদিন ফিরবে না বলে। কিন্তু মহাবিশ্বের ওপারে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা কোটি লক্ষ অযুত নিযুত প্যারালাল ইউনিভার্সের কোনো একটিকে যদি ছোঁয়া যায়? কোয়ান্টাম ফিজিক্স বলে প্রতি মুহূর্তে অসংখ্য দুনিয়া গড়ছে আর ভাঙছে বুদবুদের মতো। স্বপ্ন নয়, কল্পনা নয়, এ নিখাদ সত্যি। যা হয়েছে, তা আমরা দেখছি। কিন্তু যা হতে পারত, তা যে একেবারে সম্ভাবনাহীন তা নয়। সেসব হচ্ছে, আমরা শুধু তা দেখতে পারছি না।
মিশিগান ছাড়ার পর দুনিয়ার সকল চেনা মুখের থেকে নিজেকে আড়াল করে ড. সেন শুধু এই একটাই চেষ্টা করে গেছেন অবিরাম। এমনই একটা দুনিয়া থেকে তাঁর মিত্রাকে চুরি করে আনার চেষ্টা। সেই দুনিয়াটা যেখানে এক্সটেনশন তারটা যত্ন করে তুলে রেখেছেন তিনি নিজে। অথবা সেই দুনিয়াটা যেখানে ইস্ত্রি লাগানোর একটা প্লাগ পয়েন্ট করানোর কথাটা ক-দিন আগে মনে হওয়া সত্ত্বেও উড়িয়ে দেয়নি মিত্রা। অথবা শত শত সেইসব দুনিয়া, যেখানে তার পায়ের ফোলাটা কমে গেল আস্তে আস্তে দিন পাঁচেক পর!
পারেননি। সে অভেদ্য প্রাচীর ভেদ করে কাউকে চুরি করে আনা অত সহজ নয়। তবে যা পেরেছেন তাই বা কম কি? পদার্থবিজ্ঞানী ড. নবারুণ সেন পেরেছেন এইসব দুনিয়ার ছবিটুকু চুরি করে আনতে। একটা নয়। তিনশো চৌত্রিশটি সমান্তরাল পৃথিবীকে তিনি দেখতে পান। দেখাতে পারেন। তার জন্যে ইম্ফল জায়গাটাও খুঁজে বের করতে হয়েছে তাকে। এ পৃথিবীর হাতেগোনা কয়েকটি মাত্র জায়গা থেকে তৈরি করা যায় এই যোগসূত্র। কম্পিউটার সায়েন্টিস্টদের হিংসে হওয়া স্বাভাবিক বই কি! কারণ তাঁরা যা ভাবছেন অ্যালিথিয়া তা আদপেও নয়! মানুষের মন-ছোঁয়া গল্প লেখা সত্যিই কোনো অ্যাল্গোরিদমের কম্ম নয়। অন্তত এখনও সে বহু দূরের ব্যাপার বলেই মনে হয়। বেচারি স্ট্যান ব্রেমফোর্ড-এর চেষ্টায় সত্যিই কোনো খামতি ছিল না। কারণ অ্যালিথিয়ায় কম্পিউটারের কাজ ততটুকুই, যতটুকু ড. সেনের ক্ষমতার মধ্যে পড়েছে। প্রতিটি কাস্টমারের জন্যে ওই তিনশো চৌত্রিশটি দুনিয়া থেকে তিনি বেছে নেন সেই মানুষটির নিজের জীবনেরই পাঁচটি সেরা ছবি। সেই সব কাহিনি, যেখানে তার না-পাওয়া, অধরা স্বপ্নগুলো তার নাগালের মধ্যে চলে এসেছিল কোনোভাবে। সিরিয়ালের মোড়ক দেওয়ার কাজটা করে একটা সাদামাটা রিয়ালিটি ফিল্টার… যাতে ভিন দুনিয়ার ছবির মানুষ, বাড়ি, রাস্তাঘাট, দোকানবাজার সবের চেহারা থাকে মোটামুটি সত্যির কাছাকাছি, কিন্তু আদল বদলে যায় খানিকটা। ফলে নিজের গল্প দেখলেও নিজেকে চিনতে পারেন না কেউ। নিজের কাছাকাছি দেখতে অন্য কারো গল্প বলে মনে হয়। তাই জন্যেই যে মানুষ এভাবে জড়িয়ে পড়েন অ্যালিথিয়ার সঙ্গে, তা দিব্যি বুঝতে পারেন ড. সেন। মজার ব্যাপার এই রিয়ালিটি ফিল্টার জিনিসটা ওই স্ট্যান ব্রেমফোর্ড-এর কোম্পানীরই এক ছোকরা-বিজ্ঞানী বানিয়েছিল বহু বছর আগে। কিন্তু সে জিনিসের কোনো বাস্তব ব্যবহার ছিল না বলে বস্তুত পুরো জিনিসটাই ফেলা গেছিল। “টিউপলে” সার্চ করলে এমনিই পাওয়া যায় সেটা। ফলে এই কোডটুকুও তাই ড. সেনকে ভেবেচিন্তে লিখতে হয়নি কষ্ট করে।
“ড. সেন, শুড আই রান দ্য…”
“সুপার অ্যাডমিনিস্ট্রেটর অ্যাকসেস প্লিজ”, যান্ত্রিক মহিলার কথা শেষ হওয়ার আগেই এবার বলে উঠলেন ড. সেন। তক্ষুণি একটা ছোট্ট প্যানেল খুলে গেল স্ক্রিনের এক কোণে।
“সুইচ অফ দ্য রিয়ালিটি ফিল্টার” থেমে থেমে বললেন ড. সেন, “রান ইউসুয়াল, সিজন এইট্টিন এপিসোড ফাইভ…”
কয়েক সেকেন্ডের নীরবতার পরে ধীরে ধীরে পর্দায় ফুটে উঠল মিত্রার হাসিমুখ। জানলার ধারে বসে আছে সে, তার ধূসর এলোমেলো চুল উড়ে পড়ছে মুখের ওপর। এই সিজনটাতে ও হাসলে চোখের পাশে ছোট্ট দুটো পাখির পায়ের ছাপের মতো দাগ ফুটে ওঠে। আলতো বলিরেখার আঁকিবুঁকিগুলো খেলা করে ঠোঁটের দু-পাশে, সারা জীবনের হাজারো হাসির পথ বেয়ে। দিব্যি লাগে।
টিভির স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আবার সোফায় গা এলিয়ে দিলেন ড. সেন। সারাদিন অপরিচিত মানুষের ভিড়ে একা হয়ে থাকা বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীর ক্লান্ত চোখদুটো উজ্জ্বল হয়ে উঠতে লাগল মুহূর্তে মুহূর্তে।
Tags: গল্প, সপ্তম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, সায়ংতরী ঘোষ