মুখোমুখি – রাজকুমার রায়চৌধুরী
লেখক: সাক্ষাৎকারে অনুষ্টুপ শেঠ
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
[পরিচিতি – রাজকুমার রায়চৌধুরীর জন্ম উত্তর কলকাতায়, বেথুন কলেজের বিপরীতে অবস্থিত গলি শিবু বিশ্বাস লেনের এক বাড়িতে। পড়াশুনো সেন্ট্রাল কলেজিয়েট স্কুলে৷ আই এস সি পাশ করেন সেন্ট্রাল ক্যালকাটা কলেজ (বর্তমান নাম মৌলানা আজাদ কলেজ) থেকে৷ বি এস সি প্রেসিডেন্সি কলেজ (গণিতে অনার্স) থেকে৷ এম এস সি করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত গণিত বিভাগ থেকে৷ পি এইচ ডি করেছেন ইংলান্ডের ডারহাম ইউনিভার্সিটি থেকে, বিষয় Particle Physics।
১৯৭০ সালে দেশে ফিরে ছ-বছর কলেজে অধ্যাপনা করার পর Indian Statistical institute(ISI)-এর পদার্থ বিদ্যা ও ফলিত গণিত ইউনিটে(PAMU) যোগদান করেন। ২০০৬ সালে আই এস আই থেকে রিটায়ার করে CSIR এর Emeritus Scientist হয়ে আরও তিন বছর আই এস আই এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন৷]
আগে থেকেই বলা ছিল, আসব। কেন আসব, তা-ও। জ্যাম উজিয়ে বেশ কিছুটা দেরি হল পৌঁছতে। প্রাথমিক কুশল বিনিময়ের পর সরাসরি প্রশ্নোত্তরে চলে যাওয়া হল তাই।
অ—আপনি সুপরিচিত কল্পবিজ্ঞান লেখক, বহুদিন ধরে কল্পবিজ্ঞানের গল্প লিখছেন। কবে থেকে এই কল্পবিজ্ঞানের গল্প লেখার সূত্রপাত?
রা – (একটু ভেবে) গল্প আমি বরাবরই লিখতে ভালোবাসতাম। স্কুলে ক্লাস সেভেনে গল্প লেখার হাতেখড়ি। এর পর যতদিন স্কুলে ছিলাম আমার লেখা স্কুল ম্যাগাজিনে নিয়মিত ছাপা হত। এর মধ্যে দু-একটি কাঁচা হাতের রহস্য গল্পও ছিল৷ কলেজ জীবনেও সাহিত্য চর্চা করতাম, তবে মূলত নাটক। একটি নাটকের দলের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। কল্পবিজ্ঞানের গল্প লিখতে শুরু করি ১৯৭২ সালে।
অ – সেই সময়ে কী কী কাজ হচ্ছে কল্পবিজ্ঞান নিয়ে?
রা – তখন ‘আশ্চর্য!’ শেষ পর্যায়ে, আর ‘বিস্ময়!’ সবে শুরু হয়েছে। ‘বিস্ময়!’ পত্রিকায় আমি নিয়মিত লিখেছি। ‘আশ্চর্য!’ পত্রিকাতেও লিখেছি। পত্রপত্রিকা ছাড়াও লেখালেখি করতাম। একটা বইয়ের কথা বলি, আমরা তিন বন্ধু মিলে একটা বই প্রকাশ করেছিলাম। এটা কোনো পত্রিকায় লেখার আগে, বা কল্পবিজ্ঞান লেখার জগতের কারো সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হওয়ারও আগের কথা বলছি। তখন আমি সদ্য ইংল্যান্ড থেকে ফিরেছি, তা আমরা তিন বন্ধু, ইন্দ্রজিৎ গুপ্ত, সুনির্মল রায় আর আমি একবার আড্ডা মারতে মারতে ঠিক করলাম কল্পবিজ্ঞানের গল্প লিখব। সেইমতো তিনজনে তিনটে গল্প লিখে তা দিয়ে একটা বই-ই বার করে ফেললাম, বইটার নাম ‘তিনটি বিজ্ঞাননির্ভর গল্প’। আমার গল্পটা ছিল ট্যাকিওন কণার উপর, ইন্দ্রজিৎ লিখেছিল ‘ম্যাক্সওয়েল’স ইকোয়েশন’ নিয়ে… সুনির্মলের গল্পের বিষয়টা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না, বইটাও হাতের কাছে নেই। বয়স হচ্ছে তো, মনে থাকে না সব… (হাসি) তবে এটা মনে আছে ইন্দ্রজিতের গল্পটা পরে রেডিয়ো নাটক হয়েছিল।
সম্ভবত এই ট্যাকিওনের উপর লেখা গল্পটা পড়েই সুজিত ধর আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন। আমরা তখন আড্ডা মারতাম গ্রে স্ট্রিটের একটা চায়ের দোকানে, উনি কীভাবে যেন খোঁজ করে সেখানে এসে হাজির হলেন, এসে বললেন আপনাকে ‘বিস্ময়!’ পত্রিকায় লিখতে হবে। সেই থেকে আমার ‘বিস্ময়!’ পত্রিকায় লেখা শুরু হল।
এছাড়াও, আই এস আই-তে যতদিন ছিলাম, ততদিন ওখানের ক্নাব ম্যাগাজিন ‘লেখন’ পত্রিকায় নিয়মিত লিখেছি যার মধ্যে বেশ কিছু লেখাকে সায়েন্স ফিকশন বা ফ্যান্টাসি বলা যেতে পারে৷ এমনকি রিটায়ার করার পরেও, ২০১৮ সাল অবধি ওখানে নিয়মিত লিখেছি।
পরে আমার আরও দুটো বই প্রকাশিত হয়েছে, প্রথমটি ‘শূন্যের জন্ম’ ও দ্বিতীয়টি হল ‘নক্ষত্রের আয়ু’ ৷ প্রথমটিতে ‘তাপ’ ও পরের বই এর ‘নক্ষত্রের আয়ু’ গল্প দুটি সায়েন্স ফিকশন, “শূন্যের জন্ম” গল্পটিকে সংখ্যাভিত্তিক ফ্যান্টাসি বলা যেতে পারে। প্রথমটির পাবলিশারের নাম ভুলে গেছি। দ্বিতীয় বইটির প্রকাশক B.M Publishers (এরা আমার গণিতের কতকগুলি টেক্সট বই ছেপেছে)। ২০১৩ সালে আমার আর একটি বই ছাপা হয়েছে৷ হিগস বোসনের উপর লেখা এই বইটির নাম ‘ঈশ্বরকণা ছাড়িয়ে’, এটিকে মূলত পদার্থবিজ্ঞানের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বলা যেতে পারে৷
কল্পবিশ্ব যখন শুরু হয়, তখন দীপ ঘোষ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। তখন ‘নয়নবাবুর আয়না’ বলে একটা গল্প লিখেছিলাম কল্পবিশ্বের প্রথম সংখ্যার জন্য, মনে আছে। সেটা ছিল ফ্র্যাক্টাল নিয়ে, মানে অঙ্কের ফিকশন বলতে পারো।
আর, এছাড়া… দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য-র সঙ্গে আলাপ আই এস আই-তেই, তখন দুজনের বাড়িও সল্টলেকে কাছাকাছি ছিল। দুজনেরই পড়ার আগ্রহ ও বিষয় মিলত অনেকটা— সেই নিয়েই আলাপ হয়েছিল, প্রচুর গল্প হত বইপত্র নিয়ে, বই আদান-প্রদানও হত। ওঁর কথায় ‘জয়ঢাক’-এও অনেকগুলো গল্প লিখেছি।
প্রশ্ন – এই যে এতদিন ধরে লিখছেন, স্বাভাবিকভাবেই অনেক বিশিষ্ট লেখক/সম্পাদকের সঙ্গে নিশ্চয় আপনার আলাপ হয়েছিল। সেসব স্মৃতি যদি কিছু বলেন পাঠকদের জন্য।
রা – বেশ কিছু নাম তো বললামই এর আগে। আরেকজনের কথা বলি, অনীশ দেবের সঙ্গে ভালোই আলাপ হয়েছিল। রণেন ঘোষের সঙ্গে আলাপ করার ইচ্ছে ছিল, কিন্তু সেটা হয়ে ওঠেনি। সুজিত ধরের সঙ্গে বেশ ভালো আলাপ ছিল আমার, ওঁর সঙ্গেই মূলত সব পত্রিকা সংক্রান্ত কথাবার্তা হত। অদ্রীশ বর্ধনের সঙ্গে একবারই সাক্ষাৎ হয়েছিল, একটা বইয়ের জন্য গল্প দিতে গেছিলাম। বইটার নাম শুনেছ কিনা জানি না, ‘দানিকেন ও মহাবিশ্ব’; একটা গল্প সংকলন, বিভিন্ন লেখক লিখেছিলেন, অদ্রীশ ছিলেন সম্পাদক। জানো, সেই গল্পটার জন্য ৪২/- টাকা পেয়েছিলাম! সেই আমার প্রথম গল্প লিখে উপার্জন। তবে যে সময়ের কথা, তখন ৪২/- টাকার কিন্তু এখনকার চেয়ে অনেক বেশি দাম! মোটামুটি ৮০ দিয়ে গুণ করতে হবে এখনকার হিসাবে আনতে গেলে। কাজেই খারাপ মোটেই বলা যাবে না! (হাসি) ‘বিস্ময়!’-এর আর একজনের সঙ্গে খুব ভালো আলাপ ছিল, অমিতানন্দ দাস। ওদের বাড়িতেও গেছিলাম মনে আছে। প্রসাদরঞ্জন রায়ের সঙ্গেও আলাপ ছিল। উনি আমার লেখা পড়তে খুব পছন্দ করতেন, বলতেন ‘বিস্ময়!’ পড়েন আমার লেখার জন্য ৷ পরবর্তীকালে যশোধরা রায়চৌধুরীর সঙ্গে আলাপ হয়েছে। বলতে বলতে মনে পড়ল, মনোজ মিত্রের মেয়ে ময়ূরী মিত্র ইউটিউবে আমার লেখা চারটি গল্প পাঠ করেছিলেন। ওঁর সবচেয়ে পছন্দের ছিল ‘রুমমেট’ নামে একটা গল্প।
প্রশ্ন – আচ্ছা, আপনি বলছেন ফ্যান্টাসি বা সায়েন্স ফিকশন, অর্থাৎ এ দুটি ধারা স্পষ্টভাবে আলাদা। এই যে ফ্যান্টাসি আর সায়েন্স ফিকশনের মধ্যের পার্থক্যটা, এটা আপনার মতে ঠিক কী কী?
রা – হ্যাঁ, আমি মনে করি দুটোর মধ্যে পার্থক্য আছে। ফ্যান্টাসি হল এমন লেখা, যার মধ্যে বিজ্ঞান জাস্ট লাফ দিয়ে এমনভাবে এগিয়ে গেছে যার কোনো ব্যাখ্যা নেই, যা এখনও অবধি জানা বৈজ্ঞানিক সূত্রের নিরিখে পুরোপুরি অসম্ভব মনে হচ্ছে। সায়েন্স ফিকশনও অবশ্যই কল্পনায় ভর করে এগোয়, কিন্তু সেটা বিজ্ঞান মেনে, বিজ্ঞানের জানা সূত্র-প্রমাণের রাস্তা বেয়ে। যেমন ধরো, প্রোফেসর শঙ্কু এমন ওষুধ বার করে ফেললেন যাতে সবরকম অসুখ সেরে যায়, বা অস্ত্র দিয়ে সবকিছু পুরো শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে এবং এগুলো আবার ভবিষ্যতেও নয়, এই বর্তমান সময়েই হচ্ছে— যা আমরা জানি যে সম্ভব নয়, অথচ গল্পে হচ্ছে এবং কী করে হচ্ছে বা কীভাবে সম্ভব তার কোনও ব্যাখ্যা নেই— এজন্য গল্পগুলো (খুবই ভালো গল্প, সন্দেহ নেই) সায়েন্স ফিকশন নয়, ফ্যান্টাসি। এজন্য দেখবে, ফ্যান্টাসি লেখা তুলনায় সহজ। কোনো রেস্ট্রিকশন নেই, ইচ্ছেমতো কল্পনা খেলানো যায়। কিন্তু সায়েন্স ফিকশন লিখতে হলে, যথেষ্ট ভেবেচিন্তে এবং পড়ে লিখতে হয়। মনে রেখো কল্পনা এখানেও কাজে লাগানো যায়, কিন্তু তাকে বিজ্ঞানের সূত্র অমান্য করতে দেওয়া যায় না। যেমন ধরো, আমি ‘হাত’ বলে একটা গল্প লিখেছিলাম যাতে একজনের অ্যাক্সিডেন্টে একটা হাত কাটা পড়েছে, তাতে হাত ব্যাঙ্ক থেকে অন্য একজনের হাত নিয়ে লাগানো হয়েছে। এটা ১৯৭৩-এ দাঁড়িয়ে সায়েন্স ফিকশন, কারণ তখনও অবধি অর্গ্যান ট্রান্সপ্ল্যান্ট করা সম্ভব ছিল না; কিন্তু করা যে যেতে পারে, সেটা বিজ্ঞান ভাবা শুরু করেছিল। এখন কিন্তু এরকম অপারেশন হয়, হচ্ছে। আবার বহু ক্ষেত্রে দেখবে, সায়েন্স ফিকশন আর ফ্যান্টাসি মিশে যায় গল্পে। ধরো স্টার ট্রেক। এর বেশ কিছু অংশ আমি সায়েন্স ফিকশনই মনে করি, যেমন ধরো ‘বিম ডাউন’ বলে যা হয় – সেটা আমার ধারণা ভবিষ্যতে কখনও বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মাধ্যমেই করা সম্ভব হবে। এ নিয়ে কাজ হচ্ছে, কোয়ান্টাম মেকানিক্সের এন্ট্যাঙ্গলমেন্টটা যদি এই পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়… – এখানে সে নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার পরিসর নেই, কিন্তু হচ্ছে, কাজ হচ্ছে এ নিয়ে! দুঃখের কথা বলি একটা – আমাদের দেশে এত কথা হয়, এতরকমের কিছু লেখালেখি হয়, কিন্তু এত ইন্টারেস্টিং সব ডেভেলপমেন্টগুলো নিয়ে কোথাও কোনো আলোচনা হয় না। সাধারণ মানুষের কাছে বিজ্ঞানকে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টাও যেমন দেখি না, তেমনই অধিকাংশ লোকের মধ্যেই বিজ্ঞানের নিত্যনতুন অগ্রগতি নিয়ে জানার আগ্রহও দেখি না।
প্রশ্ন – আপনি নিশ্চয় চেষ্টা করেছেন এ নিয়ে?
রা – করেছি বইকি। ‘আলোচনাচক্র’ বলে একটা পত্রিকা আছে, সিরিয়াস প্রবন্ধ আলোচনা থাকত তাতে। আমি বিজ্ঞানের লোক হিসাবে সেখানে ডারউইনের থিয়োরি ইত্যাদি নিয়ে লেখাপত্র দিতাম। তাতে আমার একটা সার্ভে প্রকাশ হয়েছিল বলি শোনো, ইন্টারেস্টিং জিনিস – সার্ভেটা ছিল, দু-মাস ধরে আমি স্টেটসম্যান আর আনন্দবাজার চেক করেছিলাম। তখন এ দুটোই সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকা ছিল। আমার দেখার বিষয় ছিল, মোট যতগুলো আর্টিকল আছে, তার মধ্যে কতগুলোয় সায়েন্স বা সায়েন্সের অন্তত কিছু টাচ আছে এমন লেখা আছে। দু-মাস ধরে ডাটা কলেক্ট করার পর ফল এসেছিল ৫%-এরও কম। ব্যাপার হল, বিজ্ঞানের কাজকর্ম, রিসার্চ ইত্যাদি, বিশেষ করে ফিজিক্সের, এখন যে পর্যায়ে চলে গেছে, তাতে সেসব নিয়ে লিখতে গেলে যথেষ্ট খেটে বিষয়টা বুঝতে হবে। এই যে বললাম কোয়্যান্টাম এন্টাঙ্গলমেন্ট, সেটা তো খুব সহজবোধ্য ব্যাপার নয়। অথচ এ নিয়ে এমনকি কলকাতায়, আই এস আই তেই কাজ হচ্ছে। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স নিয়ে গবেষণার কাজ এখন শুধুই আর যন্ত্রে, বা রোবটে সীমাবদ্ধ নেই, আরও এগিয়ে গেছে। এগুলো নিয়ে লিখতে হলে, সেইমতো পড়াশুনোও করতে হবে, নইলে কী করে হবে!
প্রশ্ন – আপনার মতে এখনকার কোন কাল্পনিক সম্ভাবনাগুলো ভবিষ্যতে খুবই সম্ভব হয়ে উঠবে?
রা – ভার্চুয়াল রিয়ালিটি নিয়ে যা কাজ চলছে, আমার তো মনে হয় ভার্চুয়াল রিয়ালিটিতে এমন এক দিন আসবে যখন কেউ মারা যাবার পরও তার উপস্থিতি ভার্চুয়ালি থাকবে – মৃত ব্যক্তি ফিরে আসবে না, সে কখনও আসতে পারে না – কিন্তু আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এমন জায়গায় যাবে যে সেই ব্যক্তির সব সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া, উত্তর, কথা বলা ইত্যাদি সব কোনো যন্ত্রের আয়ত্তে আসবে, সেই যন্ত্রের সঙ্গে কথোপকথন করা যাবে, যেমন আগে ব্যক্তিটির সঙ্গে তার বন্ধুরা বা পরিবারবর্গ করত। আমি হয়তো সেই দিন দেখা অবধি বেঁচে থাকব না, তবে তোমরা দেখতেই পারো। (হাসি)
প্রশ্ন – কী মুশকিল! নাঃ, প্রসঙ্গ পালটে ফেলাই ভালো এবার। আচ্ছা, কল্পবিজ্ঞান নিয়ে গল্প লেখা কি অন্যান্য গল্প লেখার চেয়ে কঠিন বলে আপনার মনে হয়?
রা – এই রে! এ প্রশ্নের জবাব দেওয়া খুব শক্ত!
অ – মানে প্রশ্নটাই কঠিন হয়ে গেল?
রা – (হাসি) বেজায় কঠিন। দেখো, আমি কখনো নরেন্দ্রনাথ মিত্রের মতো গল্প লিখতে পারতাম না। অমন মানব মনের জটিলতা নিয়ে লিখতে আলাদা ক্ষমতা লাগে। বা অত্যন্ত সহজ ভাষায় বিভূতিভূষণের মতো লেখারও আমার ক্ষমতা নেই। অনেকেই পারবে না। কিন্তু অন্যদিকে সায়েন্স ফিকশন লেখাও খুব একটা সহজ কাজ নয়। প্রথমত, সায়েন্স ফিকশনকে, সব কিছুর আগে একটা গল্প হয়ে উঠতে হবে। এমন গল্প যা লোকের কাছে মনোগ্রাহী হবে। গল্প লেখার জন্য যা যা প্রয়োজন – ভাষার উপর দখল, এক্সপ্রেস করার ক্ষমতা, সিচুয়েশন তৈরি করার, ঘটনার গতি বজায় রাখার ক্ষমতা – সমস্ত তো থাকতেই হবে সায়েন্স ফিকশন লেখায়। তারপর তার মধ্যে বিজ্ঞান থাকতে হবে, এবং সেই বিজ্ঞান বুঝে, তার সব প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বকে মান্যতা দিয়ে গল্পটা গড়ে তুলতে হবে। এই বাড়তি যত্নটা লাগে সায়েন্স ফিকশনের ক্ষেত্রে।
অ – মানে, সায়েন্স ফিকশন লিখতে হলে সায়েন্স নিয়ে ফর্মালি না পড়ে থাকলেও হয়তো চলে, কিন্তু সায়েন্স জানা এবং বোঝাটা জরুরি?
রা – হ্যাঁ, একদমই তাই। জরুরি। তবে ব্যাপারটা যেন ওই জ্ঞান জাহির করা না হয়ে যায়। গল্পটা যেন আদতে একটা গল্পই থাকে। আমি এটা জানি, ওটা বুঝি, সেটা পড়েছি – এসব দেখাতে থাকলে আর সায়েন্স ফিকশন হবে না। এখানে ফিকশন পার্টটাই প্রধান, সায়েন্সটা ফিকশনের ব্যাকবোন বলতে পারো। এই ব্যালান্সটা ঠিক করে বজায় রাখাটাও আরেকটা চ্যালেঞ্জ সায়েন্স ফিকশন লেখার ক্ষেত্রে।
অ – তাহলে উলটো দিক থেকেও আরেকটা প্রশ্ন করি। বিজ্ঞানে বিশেষ আগ্রহ না থাকলেও কি সায়েন্স ফিকশন লেখা যায়? সম্ভব?
রা – ফ্যান্টাসি সাংঘাতিক ভালো লেখা যেতে পারে। ব্র্যাডবেরি লিখেছেন। সাংঘাতিক, সাংঘাতিক গল্প। গ্রেট রাইটারের গল্প। কিন্তু সায়েন্স ফিকশন আমি বলব, না। সম্ভব না।
অ – মানে, বিজ্ঞানের খবরাখবর অন্তত রাখতে হবে। বিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ার দরকার নেই, কিন্তু বিজ্ঞানমনস্কতা দরকার।
রা – এক্সাক্টলি। কিছুটা তো বুঝতে হবেই। কী কী কাজ হয়েছে, কী কী হচ্ছে, তার উপর ভিত্তি করে আরও কী কী হতে পারে – এই বোধটা থাকা জরুরি। তবে তার মানে এও নয় যে আমি আজ রিলেটিভিটি নিয়ে গল্প লিখব ভাবলে আইনস্টাইনের ইকোয়েশন ডিরাইভ করতে হবে! (হাসি) সারা জীবন কেটে যাবে অত বুঝে তবে লিখব ভাবতে গেলে। সেসবের মোটেই দরকার নেই। কিন্তু বেসিকটুকু অন্তত পড়ে, বা যিনি জানেন তার কাছে বুঝে নেওয়াটা খুবই দরকার। বিজ্ঞানমনস্কতাটা থাকা দরকার। হিস্ট্রি অফ সায়েন্সও জানা থাকা দরকার। কীভাবে কত কিছু পেরিয়ে বিজ্ঞান আজ এই জায়গায় পৌঁছেছে, সেটা না জানলে ভবিষ্যৎ নিয়ে আইডিয়া ঠিকভাবে করা কঠিন।
আর এগুলো তো ভীষণই ইন্টারেস্টিং বিষয়…!
অ – পড়াশুনো করাটা যে খুবই দরকার সেটা স্পষ্ট। সে পড়াশোনা যে আপনি এখনও চালিয়ে যাচ্ছেন তাও এইসব ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বইপত্র দেখে বুঝতে পারছি। জানতে চাইব, কল্পবিজ্ঞান লেখক হিসাবে, আপনি কার কার লেখা পড়ে অনুপ্রাণিত হয়েছেন? দেশ ও বিদেশ সব মিলিয়েই?
রা – সবার আগে যাঁর লেখা পড়ে উদ্বুদ্ধ হয়েছি, তিনি জুল ভার্ন। তারপর আসিমভ আর আর্থার সি ক্লার্ক। এই দুজনই বেশ মনে দাগ কেটেছিলেন। অদ্রীশ বর্ধনের কিছু গল্প বেশ ভালো লেগেছিল। অনীশ দেবের লেখা ভালো লেগেছে। অমিতানন্দ দাসেরও বেশ ভালো ভালো আইডিয়া ছিল।
ওঃ, ভুলেই যাচ্ছিলাম, প্রেমেন্দ্র মিত্র! অবশ্যই। আমি ওঁকে পথিকৃৎ মনে করি। এটা মনে রাখতে হবে, উনি যখন লিখছেন, তখন গুগল ছিল না। অথচ প্রত্যেকটা বর্ণনা, সে সায়েন্স হোক, ভূগোল হোক – নিখুঁত। কতখানি পরিশ্রম আর ডেডিকেশন, ভাবা যায়?! আমার আরেকটা ধারণার কথা বলি, worm hole theory যদি সত্যি হয় তবে স্পেস ট্রাভেলের নতুন দিক খুলে যাবে। নিমেষের মধ্যে এক বিশ্বে যাওয়া যাবে আইনস্টাইনের থিয়োরি মেনেই । প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘ফুটো’ গল্পটি এরকম একটি worm hole তত্ব হিসেবে ধরা যেতে পারে ৷
আর আর্থার কোনান ডয়েল। প্রোফেসর চ্যালেঞ্জার, দ্য লস্ট ওয়ার্ল্ড থেকেই পেয়েছি জুরাসিক পার্ক৷
আমার আরেকজন খুব প্রিয় লেখক মাইকেল ক্রিকটন। Prey তো অসাধারণ সায়েন্স ফিকশন –পড়লে গায়ে কাঁটা দেয়। সবার পড়া উচিত।
আরেকজনের কথা বলি, লীলা মজুমদার। একদম নিজস্ব লেখার ধরণ, সায়েন্স ফিকশন মানেই যেখানে সিরিয়াস ঘটনা লেখা হয়, সেখানে একদম অন্যরকম মন ভালো করে দেওয়া গল্প, সহজ কথায় এত সুন্দর করে লিখেছেন।
অ – হ্যাঁ, ‘বাতাস বাড়ি’ বা ‘মাকু’ সত্যিই অন্যরকম। সায়েন্স ফিকশনই – কারণ মাকুর মতো রোবট, বা অমন মানুষ আকাশে বাস করবে, জলের নিচে বাস করবে ইত্যাদি ধারণা এখনকার দিনে নেহাৎ অবাস্তব কল্পনাও নয়।
রা – ঠিক। আরেকজন হলেন শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়।
অ – বনি, পটাশগড়ের জঙ্গলে…
রা – একদম। এই লেখাগুলি কিন্তু প্রপার সায়েন্স ফিকশনই, যদিও যদ্দূর জানি উনি অফিশিয়ালি সায়েন্সের ছাত্র নন। আসলে আগ্রহটা থাকলেই ভালো করে বুঝে নিয়ে লেখা সম্ভব। কিন্তু ওঁর লেখা খুবই ভালো লাগে।
আর নাম তো এই মুহূর্তে কিছু মনে পড়ছে না… আসলে এই ধারায় লেখাই তো বেশ কম হয়…
অ – হ্যাঁ। কল্পবিজ্ঞানের লেখক ও পাঠক দুই-ই অপ্রতুল। আপনার কী মনে হয়, এরকম কেন?
রা – বাংলা ভাষায় কল্পবিজ্ঞান অনেকটাই ব্রাত্য, মূলধারার লেখা যেন নয়। তবে তার কারণ হিসাবে যাঁরা লেখেন, মি ইনক্লুডেড, তাঁদের দুর্বলতাকেই প্রধান মনে করি। তাঁরা পাঠকদের মন সেইভাবে আকৃষ্ট করতে পারেননি। পারলে এই ধারাও জনপ্রিয়ই হত।
অ – তাহলে এই জঁরের কী ভবিষ্যৎ আপনার মতে?
রা – দেখো, বিদেশে কিন্তু ব্যাপারটা এমন নয়। বিদেশে প্রচুর ভালো ভালো কাজ হচ্ছে কল্পবিজ্ঞানে, জাপানে, কোরিয়ায় – সর্বত্র কী ভালো ভালো কাজ হচ্ছে দেখি…
অ – হ্যাঁ, আফ্রিকান কল্পবিজ্ঞান পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে সদ্য, কী দুর্দান্ত গল্প লেখা হচ্ছে!
রা – দেখব তো! আসলে এই বয়সে বই আনিয়ে পড়া একটু অসুবিধা হয়, আজকাল গুগল ইবুকে পড়ার চেষ্টা করি যা যা পাই।
আমাদের এখানে যে কল্পবিজ্ঞান ধারা সেভাবে মূলস্রোতে আসতে পারেনি তার একটা কারণ হল, এখানে সাহিত্য সম্বন্ধে একটা ফিক্সড ধারণা রয়েছে, আর সেখানে বিজ্ঞানের স্থান নেই। এমনিতেই, এখানে মানুষ যত অন্য কিছুর চর্চা করে, বিজ্ঞানের চর্চা তো সেভাবে করে না! সায়েন্স ফিকশন পরের কথা, সায়েন্সই তো সেই অর্থে বাংলা সাহিত্যে কখনও কল্কে পায়নি! ‘সায়েন্টিফিক আমেরিকান’এর মতো কোনও পত্রিকা কি এখানে বার করার কথা ভাবা যায়, যার প্রচুর নিয়মিত গ্রাহক থাকবে? সত্যেন বোসের ‘জ্ঞান বিজ্ঞান’ বা ‘কিশোর জ্ঞান বিজ্ঞান’-এর কথা তো জানোই। মানুষের চর্চার আগ্রহ থাকলে কি সেগুলো টিকে থাকত না? আবার আজকের দিনের প্রযুক্তিও একটা কথা – গুগল করেই যখন উত্তর পাওয়া যাচ্ছে তখন লোকে অনেক বেশি পড়ে কোনওকিছু শিখতে চাইবে কেন! যদিও আমি গুগলে একটা প্রশ্নের উত্তর করলে দেখি তিনটে তিন রকমের উত্তর আসে (হাসি)… দেখো, আমার তো অনেক বয়স হয়ে গেছে, নতুন যাঁরা লিখছেন তাঁদের এখনকার পাঠকদের মন কী করে আকর্ষণ করা যায় সেটা নিয়ে ভাবতে হবে। আরে, বই ছাড়ো। ধরো, আজকালকার হলিউডের রমরম করে চলা মুভিগুলোর কত বড়ো অংশ সায়েন্স ফিকশন বেস করে বলো তো? বা ফ্যান্টাসি? মেন ইন ব্ল্যাক… অ্যালিয়েন…?
অ – ঠিক। এমনকী নেটফ্লিক্স ইত্যাদিতে আনকোরা কত সিরিজও আসছে সাই-ফাই জঁরে। এগুলোর জন্যই আলাদা করে গল্প লেখা হচ্ছে।
রা – সেইখানেই তো প্রশ্ন! এই জঁর এত বক্স-অফিস সফল হতে পারে সে তো দেখাই যাচ্ছে, অথচ বাংলায় সে চেষ্টাই বা হল না কেন এতদিন ধরে? ‘ই-টি’ সেই কোনকালে বানানো, অথচ আজও বাংলায় সেই অর্থে কিছু নেই কেন? বই নাহয় না-ই পড়ল লোকে, সিনেমা কি দেখত না?
আসল কথা, মানুষের বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ না বাড়লে, বই, পত্রিকা, সিনেমা কোনও কিছুই একটা গণ্ডির বাইরে উঠে আসতে পারবে না।
অ – আচ্ছা, আমাদের সময় ফুরিয়ে গেছে, একটা শেষ প্রশ্ন— নতুন যারা লিখতে আসছেন কল্পবিজ্ঞান ঘরানায়, তাদের কী পরামর্শ দেবেন?
রা – পরামর্শ? ও বাবা! না, না, আমি অঙ্ক ছাড়া অন্য কোনও বিষয়ে কাউকে কিছু শেখানোর মতো মনে করি না নিজেকে। তবে কয়েকটা সাজেশন দিতে পারি, প্রথমত, আমরা যে সব বইগুলো পড়ে নিজেদের তৈরি করেছি… আচ্ছা, সেগুলো বোধহয় তোমাদের কাছে আদ্যিকালের বই মনে হবে, না?
অ – একেবারেই না। আমিও ছোটোবেলায় আসিমভ বা জুল ভার্ন পড়েছি, মুগ্ধ হয়েছি!
রা – হ্যাঁ, তাহলে নতুন সবাইকে বলব এই সমস্ত ক্লাসিক লেখাগুলো মন দিয়ে পড়া দরকার। সেইসঙ্গে বাংলা সাহিত্যটা ভালো করে পড়া। বাংলা গল্প কী ভীষণ সমৃদ্ধ! আমি তো মনে করি বাংলা ছোটোগল্প বিশ্বের শ্রেষ্ঠ হওয়ার দাবিদার। চার বাঁড়ুজ্যে তো বটেই, তা ছাড়াও নরেন্দ্রনাথ মিত্র, জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী, বিভূতিভূষণ… বাংলা সাহিত্য পড়া খুব দরকার নিজেকে তৈরি করতে চাইলে। গল্প কী করে লিখতে হয়, এই স্মরণীয় লেখকদের থেকে সেটা শিখতে হবে। তারপর বিজ্ঞান আসবে। বিজ্ঞান জানতে, বুঝতে হবে, গল্পকে বিজ্ঞানের কাঠামোয় ফেলতে হবে। সে পরের কথা। কিন্তু সবার আগে গল্প লিখতে শেখাটা সবচেয়ে জরুরি। এর চেয়ে বেশি কিছু বলার মতো জ্ঞানও আমার নেই, ধৃষ্টতাও নেই।
অ – অনেক ধন্যবাদ আমাদের সময় দেওয়ার জন্য। অনেক কিছু জানতে পারলাম আমরা।
রা – আমার কথা শোনার জন্য আগ্রহ দেখানোর জন্য তোমাদেরও ধন্যবাদ। কল্পবিজ্ঞান চর্চায় কল্পবিশ্ব একটা বিশাল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে, তাদের জন্য অকুণ্ঠ শুভেচ্ছা রইল।
Tags: অনুষ্টুপ শেঠ, রাজকুমার রায়চৌধুরী, সপ্তম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, সাক্ষাৎকার