হয়তো আবার
লেখক: মোহনা দেবরায়
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
রাস্তা দিয়ে আনমনে হাঁটছিল নীহারিকা। না, ঠিক আনমনে নয়, মাঝে মাঝে হাতের উলটো পিঠটা ঘষছিল গালে। না ঘষে অবশ্য উপায় ছিল না। এই ভর দুপুরবেলা শহরের ব্যস্ত রাস্তায় একটা অল্পবয়সি মেয়েকে মরা মাছের মতো খোলা চোখে কাঁদতে কাঁদতে হাঁটতে দেখতে পেলেই সবাই ঘুরে ঘুরে তাকাবে। চশমাতেও বিশেষ সুবিধে করতে পারবে না। নেহাত মানুষের অত সময় বা গরজ নেই তাই!
কিন্তু কেন কাঁদছে নীহারিকা? কারণটা তার নিজের কাছেও খুব স্পষ্ট নয়। হ্যাঁ আজ কলেজে একজন প্রফেসর ওকে অপমান করেছে। বেশ ভালোরকম। প্র্যাকটিকাল ল্যাবে। এক ল্যাব ছেলেমেয়ের মাঝখানে। কেন করেছে, ঠিক কী করেছিল নীহারিকা… এই স্মৃতিগুলো কেমন ঝাপসা হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। শুধু মনে আছে একটা অনুভূতি… যেন ষষ্ঠেন্দ্রিয় জানান দিচ্ছিল, লোকটা অকারণে অপমান করছে ওকে। শুধু করতে মজা লাগছে বলেই করছে।
খুব ইচ্ছে করছিল কোথাও একটু বসতে। একটু ছায়া দেখে। ফোনটা বাজছিল। সুলগ্নর ফোন। ধরতে ইচ্ছে করছে না। হঠাৎ জ্বলন্ত স্ক্রিনটার দিকে তাকিয়ে বেশ অবাক লাগল নীহারিকার। আচ্ছা সুলগ্ন তো ওর পার্টনার। অথচ ফোনটা ধরে কান্না ভাঙা গলায় তাকে পুরো ঘটনাটা জানানোর কথা ভাবতেও পারছে না কেন নীহারিকা? কেন পারছে না? সুলগ্ন ঠাট্টা করবে? বিরক্ত হবে? ওকে ছিঁচকাঁদুনে বলবে? বলবে, ‘বকল কেন? কী করেছিলি? কী দরকার ছিল মুখে মুখে কথা বলার?’ এই মানুষটাকে ভবিষ্যতে বিয়ে করবে নীহারিকা? এর সঙ্গে শেয়ার করবে বাকি জীবনের ভালো আর খারাপ থাকাগুলো? যার একটা জাজমেন্টের ভয়ে ফোন ধরছে না? অথচ এরকম তো ছিল না ব্যাপারটা! আগে একটা কাঁচা নখ ছিঁড়ে গেলেও সেটা বলতে হত সুলগ্নকে। কবে এরকম হয়ে গেল?
ফোনটা কেটে যেতে কনট্যাক্ট লিস্টটা ঘেঁটে ফেলল নীহা। এমন কেউ… কেউ একজন যাকে অকারণে কল বা মেসেজ করে সবটা উগড়ে দেওয়া যায়? নাহ্! সাড়ে তিনশো কনট্যাক্ট। সকলের কাছ থেকেই জাজমেন্ট আসবে। মা-বাবার নম্বর দুটো স্পিড ডায়ালে। সঙ্গে সুলগ্ন বাদে আর হৈমন্তীর। কিন্তু ওর সামনেই হয়েছে আজকের ঘটনা। সান্ত্বনা দিতে কী যেন বলছিল মেয়েটা। নীহা শোনেনি। কারো সঙ্গে কথা না বলেই বেরিয়ে এসেছে কলেজ থেকে। হৈমন্তীর চোখের আহত চাউনিটা তাও দৃষ্টি এড়ায়নি। এটা নীহার আরেকটা স্বভাব। কষ্ট পেলেই সকলকে দূরে ঠেলে দেওয়া। সহানুভূতি তো দূরের কথা, সহমর্মিতা পর্যন্ত গ্রহণ করতে পারে না ও। সবটাকেই করুণা বলে মনে হয়। কেউ এই নিয়মের বাইরে নয়। রাস্তাটা দেখছিল নীহারিকা। আজ বারবার লোকজনের মুখগুলো এক এক ঝলক দেখে চেনা লাগছে। যেন মনে হচ্ছে দেখেছে সকলকে এর আগে। চেনা চেনা আদলের মানুষগুলো হেঁটে যাচ্ছে আশপাশ দিয়ে। অনেক দূরে দূরে সরে যাচ্ছে। প্রতি মুহূর্তে একটু বেশি করে একা হাঁটছে নীহারিকা।
ওই কলেজে আবার পরশু যেতে হবে। তার পরদিন। তার পরদিনও। ওই লোকটাকে দিয়েই বছরের শেষে সই করাতে হবে প্র্যাকটিকাল খাতা। মায়ের মুখটা মনে পড়ল হঠাৎ। ইদানিংয়ের মা নয়, সেই অনেক ছোটোবেলার মা। যে মা বলেছিল, ‘কারো ওপর রাগ হলে আমাকে এসে বকিস।’ যে মা সারা বিকেল পড়িয়ে, সন্ধেবেলা রান্না করতে যাওয়ার আগে লুকোচুরি খেলত ওর সঙ্গে, নীহারিকার কোনো খেলার সঙ্গী ছিল না বলে। যে মা গান গেয়ে ঘুম পাড়াত ওকে। সেই মায়ের সামনে মাথা নীচু করে দাঁড়িয়েছিল নীহারিকা। বিড়বিড় করে বলছিল, “আমি আর পারছি না, মা। প্লিজ কিছু একটা করো।” মা উত্তর দিচ্ছিল না। হাসছিল। হাজারটা সান্ত্বনাবাক্য সেই হাসির কাছে ম্লান। সেই হাসি নিঃশব্দে বলছিল, “আমি আছি! ভয় কেন মা করো!” ছোটোবেলায় অসংখ্যবার বীরপুরুষ পাঠ করে শুনিয়েছে মা। খোকার মুখটা অবিকল মায়ের মতো লাগত। আর নীহারিকা বসে থাকত পালকির ভিতরে। মা কোথায় গেল? দিঘির ধার থেকে আলোর বিন্দুগুলো এগিয়ে আসছে মিটমিট করে। কিন্তু পালকি নামানো মাঠের মাঝে। চারপাশে কেউ নেই। একটা ঘোড়ার খুরের শব্দ মিলিয়ে যাচ্ছে বহুদূরে… দূউউউউ–রে!
সংবিৎ ফিরল। এরকম আত্মবিস্মৃত হয়ে কলকাতার রাস্তায় বেশিক্ষণ হাঁটা যায় না। তবে সংবিৎ ফেরার কারণটা যেন একটু আলাদা রকম। একটা আওয়াজ। খুব হালকা। কোনো একটা বাদ্যযন্ত্রের। বাঁশি হতে পারে, বেহালা হতে পারে, আবার চেলোও হতে পারে। একেকবার একেক রকম লাগছে। খুব জোর নয়। কিন্তু কানে লাগছে। আশপাশের কারও কোনো ভাবান্তর হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। নীহার নিজের কানে কি কিছু হল? কিন্তু এটাকে ঠিক কানের ভেতরের শব্দ বলে যেন মনে হচ্ছে না! বাইরে থেকেই আসছে।
বাড়ি পর্যন্ত শব্দটা পিছু ছাড়ল না। তীব্রতাটা বাড়তে-কমতে লাগল ইচ্ছেমতো।
দরজাটা খুলে দিল বাবা। আজ শনিবার। বাবা বাড়ি আছে। মা বেরিয়েছে। ছোটোবেলায় শনি-রবিবার রোদটা পড়লেই বাবার সঙ্গে সাইকেল চেপে পাড়া বেড়াতে বেরোত। বেরোনোর আগে গাল টিপে ধরে চুল আঁচড়ে দিত বাবা। তখন ছোটো ছোটো করে কাটা চুল। বাবা চিরকালই মায়ের থেকে ভালো চুল আঁচড়াত। শেষ কবে যেন…
ঘরে ঢুকে নিজের ঘরে চলে গেল নীহারিকা। বাবা বলল না, “রোদ্দুর থেকে এসে এক্ষুনি জল খাস না।” জিজ্ঞেস করল না নীহারিকা কিছু খেয়েছে কিনা। কোনোদিন এগুলো নিয়ে মাথা ঘামায় না নীহারিকা। বরং স্বাধীন লাগে, নিশ্চিন্ত লাগে। আজ কী যেন হয়েছে… শব্দটা এখনও বেজে যাচ্ছে ঝিনঝিন করে। একটা সুর। একঘেঁয়ে সুর। যেন একই কর্ড ঘুরে ফিরে বাজাচ্ছে কেউ। মিউজিক নিয়ে অতটা জ্ঞানগম্যি নেই নীহার। তাই এর থেকে বেশি কিছু বোঝা সম্ভব হল না।
ফ্রেশ হয়ে ফোনটা হতে নিল। রিলস্ স্ক্রল করতে লাগল আনমনে। এই সময়টায় মনে হয় যেন চাইলেই গোটা দুনিয়াটাকে হাতের মুঠোয় ধরে রাখতে পারে ও। কত মানুষ কাছে এসে যায় পলকের মধ্যে! কমেন্ট সেকশনে অচেনা লোকেদের সঙ্গে ঝগড়া করার যে মজাটা… আহা, সামনাসামনি আজ অবধি ক-জনের সঙ্গে ঝগড়া করেছে, হাতে গুনে বলতে পারবে নীহারিকা। কিন্তু অনলাইনে? দিনে অন্তত গড়ে তিনটে। আর প্রত্যেকটা ঝগড়ার পরেই মনে হয় জীবনে কিছু একটা করা গেল। ক্লান্ত লাগে ঠিকই, তবে একটা অদ্ভুত শান্তিও আসে।
নীহারিকার নিজের ফলোয়ারের সংখ্যাও বেশ ঈর্ষণীয়। রেগুলার কনটেন্ট পোস্ট করে ও। তাতে যখন লোকজন লাইক কমেন্ট করে, একটা বিজাতীয় আত্মতৃপ্তিতে ভরে যায় মনটা। স্টোরি পোস্ট করার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ফলোয়ারদের ডিএমে যখন ইনবক্স উপচে পড়ে, কেমন যেন বাতাসে ভেসে থাকার অনুভূতি হয়। আজ হঠাৎই একটা অচেনা অ্যাকাউন্ট থেকে ট্যাগ করা হয়েছে দেখে নোটিফিকেশনটা খুলল নীহারিকা। ওর নাম আর ছবি। বায়োতে লেখা আছে ফ্যান অ্যাকাউন্ট। মনে হল এক টুকরো সূর্য গিলে ফেলেছে ও। কেমন হালকা লাগল নিজেকে। এই ছোট্ট ঘরটার মধ্যেই অনেক মানুষের মাঝে নিজেকে কল্পনা করতে পারছিল নীহা। একটা বিশাল বড়ো স্টেজে পারফর্ম করছে ও। সামনে কালো কালো মাথার আস্ত একটা সমুদ্র। এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল নীহা। কোনো চেনা মুখ চোখে পড়ছে না কেন?
আবার খেয়াল হল শব্দটা। ঘ্যানঘ্যানে সুরে বেজে চলেছে।
***
সকালের ক্লাস। এমনিই এই সময় একটা চোরা ঘুম পায়, তার ওপর অসম্ভব বোরিং থিয়োরির ক্লাস। আর চেরি অন টপ সেই সুরটা তো আছেই। পরশু থেকে একবারের জন্যও থামেনি। ঘুম হয়নি দু-রাত। অবশ্য সেটা শেষ কবেই বা ভালো হয়েছে! নীহারিকা এখন জানে, শব্দটা সে নিজে ছাড়া আর কেউ শুনছে না, কিন্তু তবু সে নিয়ে কাউকে কিছু বলতে ইচ্ছে হয়নি। আজকাল লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছেই হয় খুব কম। এখন কেমন যেন চেরা চেরা, ফাটা ফাটা লাগছে সুরটাকে। তীব্রতাটা আগের চেয়ে খানিকটা বেড়েছে, তাই বোঝা যাচ্ছে এই ব্যাপারটা। শুনলেই মাথার ভিতরটা ঝনঝন করে। একটানা বেজে যাচ্ছে। বিরতি নেই, ক্লান্তি নেই। ক্লাসে মন দিতে পারছিল না নীহারিকা। প্রফেসর ওদিকে বোর্ডে নিজের ইচ্ছমতো আঁকিবুঁকি কেটে চলেছেন। নিশ্চয়ই খুব গম্ভীর কিছুই বোঝাচ্ছেন। সুরটা যে এখনও খুব জোরে বাজছে, তা নয়। তবে খুব ধারালো। যেন কেটে কেটে বসছে মাথার ভিতর। অন্য কোনোদিকে মনটা সরানো যাচ্ছে না। আশ্চর্য! পরশু থেকে সমানে এই অলৌকিক ঘটনাটা নিয়ে এত কম ভাবনা হচ্ছে কেন নীহারিকার? তার তো প্যানিক করা উচিত ছিল এর মধ্যে! যে-কোনো সুস্থ মানুষ তাই-ই করত। শুধু মনোযোগটা কোথাও সরাতে পারছে না—সমস্যা বলতে এইটুকুই। এক সময় আর না পেরে দু-হাতে মাথার দু-পাশটা টিপে ধরল ও।
আজও পাশে হৈমন্তীই বসেছিল, রোজের মতোই। ওর দিকে তাকিয়ে চাপা উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করল, “কী হল?”
“কিছু না… মাথাটা একটু… ”
“শরীর ঠিক আছে তোর?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ। আরে কিছু না তেমন।”
“তাহলে এরম করছিস কেন?”
“কী ব্যাপার নীহারিকা? হৈমন্তী? কী হচ্ছে ওখানে? কী সমস্যা?” প্রফেসরের বাজখাঁই গলা বেজে উঠেছে ততক্ষণে।
ওরা দুজনেই চুপ করে গেল। কিন্তু ততক্ষণে যা সর্বনাশ হওয়ার হয়ে গেছে। ম্যাম পায়ে পায়ে এগিয়ে এসেছেন ওদের বেঞ্চের দিকে। ঠিক স্কুল টিচারের মতো কঠিন গলায় বলেছেন, “উঠে দাঁড়াও!” ওদেরকে মনে হয় এখনও স্কুলের পড়ুয়াই ভাবে এখানকার বেশির ভাগ ফ্যাকাল্টি।
দুজনে উঠে দাঁড়াল। হৈমন্তীর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন ম্যাম, “কী বলছিলে ওকে? প্লিজ শেয়ার উইথ দ্য ক্লাস!”
হৈমন্তী কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, সম্ভবত নীহার অসুস্থতার কথাই। কিন্তু তার আগেই নীহা ফস করে বলে উঠল, “ও আমাকে কিছু বলেনি ম্যাম। আমিই ওকে একটা কথা বলছিলাম।”
ম্যাম হাসলেন। বিড়াল যদি হাসতে পারত, তবে কলে পড়া ইঁদুর দেখে এরকমই হাসত। কিন্তু নীহারিকার ওসব দেখার মতো অবস্থা ছিল না। তার শরীরে প্রচণ্ড একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। আচমকাই দু-হাত মুখের ওপর চেপে একবার ‘ওয়াক!’ করল সে। তারপর চোখের সামনেটা অন্ধকার হয়ে গেল।
জ্ঞান ফিরল অসহ্য মাথা যন্ত্রণায়। চোখদুটো একবারে খুলতে পারল না নীহারিকা। কী ভারী! যেন কয়েক কেজি ওজন একেকটা পাতার। অন্যান্য ইন্দ্রিয়গুলো দিয়ে চারপাশটা অনুভব করার চেষ্টা করল ও। কানে কিছু আসছে না। মৃত নৈঃশব্দ্য। দেহটাও যেন অসাড়। শুয়ে আছে, বসে আছে, না দাঁড়িয়ে আছে—বুঝতে পারছে না নীহা। জোরে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করল একটা। কিন্তু অনুভূতি ঠিকঠাক কাজ না করায়, কোনো বাতাস ফুসফুসে ঢুকল কিনা, বোঝা গেল না ঠিক। নাকে কোনো গন্ধ ঝাপটা মারল না। বাকি রইল জিব। তাতেও কিছু অনুভব করতে পারছে না। জিবটা নাড়ানোর চেষ্টা করল। বৃথা চেষ্টা।
হঠাৎ একটা কথা বুঝতে পেরে প্রচণ্ড অবাক লাগল নীহারিকার। তার পাঁচটা ইন্দ্রিয়ের একটাও ঠিকঠাক কাজ করছে না। তাহলে নিজের অস্তিত্ব বুঝতে পারছে কী করে ও? পাঁচটা ইন্দ্রিয় কাজ না করার মানে তো… কোমা! তাহলে কি কোমায় আছে নীহারিকা? কিন্তু মাথাটা তো পরিষ্কার! কেবল… হ্যাঁ যন্ত্রণাটা! ওটাই হিসেব গুলিয়ে দিচ্ছে।
“না! কোমা নয়।” কেউ একজন বলে উঠল। কিন্তু কথাটা শুনতে পেল না নীহা। ঠিক যেন তার মাথার ভেতর থেকে বলল কেউ। যেভাবে চিন্তা করে, অনেকটা সেরকম।
কথা বলার জন্য ঠোঁটদুটো নাড়ানোর চেষ্টা করল নীহারিকা। কিন্তু কোনো লাভ নেই। তবু স্পষ্ট অনুভব করল, কথা বলছে! কী করে? বোঝা অসম্ভব! তবে ও জিজ্ঞেস করছে, “আমি কোথায়?”
“তুমি কোথায় থাকতে চাও বলো!”
“আমি কি মারা গেছি? আপনি কি ভগবান?”
“দুঃখের সঙ্গে জানাই বাছা, এই দুটো প্রশ্নের একটারও সহজ উত্তর আমার কাছে নেই।”
“আমি ক্লাসে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম।”
“হ্যাঁ। কেন?”
“জানি না। একটা কীসের জানি শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম… উফফ!”
“তুমি ছাড়া আর কেউ শুনতে পাচ্ছিল সেই শব্দ?”
“না… ”
“ভুল কথা! সবাই ওই শব্দটা শুনতে পায়। জন্মের মুহূর্ত থেকে মৃত্যু অবধি। শুধু কেউ খেয়াল করে না।”
“মানে?”
“মানে ওই শব্দ থামানোর কোনো উপায় নেই। সেই জন্যই মানুষের কান আর মাথা ওকে কোনো গুরুত্ব দেয় না।”
“মানে? কীসের শব্দ ওটা?”
“ওটা সময়ের শব্দ।”
“কী-ই?”
“ঠিক ওটাই।”
একটু চুপ করে থেকে নীহারিকা বলল, “তা কেউ যদি শুনতে না পায় তাহলে আমি কেন পেলাম?”
“কারণ তুমি শুনতে চেয়েছিলে। তুমি নিজেকে জানাতে পেরেছিলে, প্রকৃতির নিয়মকে ইচ্ছের জোরে পালটাতে পারো তুমি। তোমার হাতে উপায় ছিল ওই আওয়াজটা থামানোর।”
“কই না তো!”
“তুমি চাওনি সময়কে নিজের ইচ্ছেমতো পথে চালাতে?”
“না… মানে… হ্যাঁ হয়তো! কিন্তু ওভাবে ঠিক—”
“ওটাই! ওইটুকুই যথেষ্ট।”
“কিন্তু এই জায়গাটা কোথায়?”
“সেই একই কথা বলব। তুমি কোন জায়গা করতে চাও এটাকে?”
“এ কেমন প্রশ্ন!”
“তুমিই বলো!”
“না সত্যিই… আমি না কিছু বুঝতে পারছি না। হঠাৎ একটা শব্দ শুনতে পেতে শুরু করলাম, তারপর ক্লাসে অজ্ঞান হয়ে গেলাম, আর এখন… কী হচ্ছে এসব!?”
“খুব কি জানা দরকার?”
“হ্যাঁ দরকার! খুব বেশি করে দরকার! আপনি কে? আমি কোথায়? এসব কী?”
“এগুলো জেনে কী করবে তুমি?”
“কিছুই করব না। আমি শুধু বাড়ি ফিরব। যদি না মরে গিয়ে থাকি।”
“আবার… আবার হেরে যাচ্ছি আমি। উফফ এ কী অসহ্য হার আমার!”
“মানে? কী বলতে চাইছেন?”
“নীহারিকা, একটা কথা বোঝার চেষ্টা করো। সেটা বুঝতে পারলেই আর কিছু বুঝতে বাকি থাকবে না। এই অন্ধকার, এই শূন্যতা, এটা ব্রহ্মাণ্ডের প্রাক-সৃষ্টি পর্যায়। তুমি এখান থেকে সব কিছু শুরু করতে পারো! নতুন করে! নিজের ইচ্ছেমতো!”
“মানে? কেন? আমি কেন? এত মানুষ থাকতে আমি কেন? আমি তো… ”
“তুমি চাও না কিছু পরিবর্তন করতে? কোথাও এমন কিছু নেই, যা তুমি অন্যরকমভাবে দেখতে চাও? সেই সবকিছু পরিবর্তন করার ক্ষমতা তোমার হাতে, নীহারিকা। তুমি চাইলে তবেই শুরু হবে সময়।”
“আপনি বলতে চান, কোনো একটা অলৌকিক উপায়ে, টাইম ট্রাভেল করে, আমি বিগ ব্যাং-এর আগে পৌঁছে গেছি?”
“হ্যাঁ। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, ঠিক তাই।”
“কিন্তু কেন? কীভাবে?”
“দুটোই অবান্তর প্রশ্ন। এখন একমাত্র ভ্যালিড প্রশ্ন হল, তুমি কীভাবে আবার সবকিছু শুরু করতে চাও?”
“আমি চাইলে আবার ইউনিভার্সকে প্রথম থেকে শুরু করতে পারি?”
“‘আবার’ বলতে… যাই হোক, সেটা তোমার না বুঝলেও চলবে। হ্যাঁ। ব্যাপারটা খানিকটা সেটাই।”
“কিন্তু আমি এসব কিচ্ছু চাই না, বিশ্বাস করুন!”
“তাহলে কী চাও তুমি?”
“আমি শুধু আমার নিজের লোকগুলোর কাছে ফিরতে চাই।”
“নীহা, তুমি বুঝতে পারছ না কত বড়ো সুযোগ তুমি হেলায় হারাচ্ছ!”
“না, হারাচ্ছি না তো! একদম হেলায় হারাচ্ছি না। আমি ওদের কাছে ফিরতে চাই। এটাই আমার একমাত্র চাওয়া। আমার মা, বাবা, বন্ধুবান্ধব, প্রেম… সবার থেকে আমি বিগত বছরগুলোয় অনেকটা দূরে চলে এসেছি, জানেন! আমি দূরত্বটা কমাতে চাই! আর একটা সুযোগ পেলে… ”
“নীহা! তুমি চাইলে এমন একটা মহাবিশ্ব বানাতে পারো, যেখানে দূরত্ব, নিকটতা—এই ধারণাগুলোই এভাবে থাকবে না। হাজার, লক্ষ, কোটি কোটি সম্ভাবনা আছে। তবু তুমি, প্রত্যেকবারের মতোই… ওই দুটো ধারণাতেই আটকে যাচ্ছ। দূর আর নিকট। আবার! কেউই… কেউই… এই দুটোর দ্বন্দ্বের বাইরে গিয়ে আর কিছু ভাবতে পারেনি। বারবার সেই এক জিনিস। আর আমার এক্সপেরিমেন্টও ব্যর্থ হয়েছে বারবার!”
“আপনি কী এক্সপেরিমেন্ট করছিলেন আমি জানি না, তবে এতগুলো রেজাল্ট যখন বারবার একই সিদ্ধান্ত ফিরিয়ে দিচ্ছে, তখন আপনার উপপাদ্যে কিছু ভুল নেই, একথা কি একেবারে নিশ্চিত?”
“ভুল কেন থাকবে! ভুল থাকবে কেন? যদি থাকেও বা, সেটা কোথায়? তোমার সঙ্গে এই কথোপকথন হচ্ছে, এটা অসীম সংখ্যক বার হয়েছে। প্রত্যেকবার একই সিদ্ধান্ত! দূর, নিকট! দূর, নিকট! এর বাইরে কিছু ভাবতে পারো না কেন তোমরা?”
“কারণ এই একটা জিনিসই আমরা জানি। এনট্রপি!”
“হ্যাঁ! এনট্রপি। শৃঙ্খলা থেকে বিশৃঙ্খলার দিকে অনন্ত গমন। পুঞ্জিভবন থেকে ছড়িয়ে যাওয়া। কাছের থেকে দূরে যাওয়া।”
“দূরে যাওয়াটা স্বতঃসিদ্ধ। কিন্তু তার উলটোদিকে মহাকর্ষ। একটা বিরুদ্ধ শক্তি।”
“হ্যাঁ। বিরুদ্ধ শক্তি। কিন্তু এনট্রপি ঠেকিয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট নয়।”
“নয়ই তো। এই ক্রমবর্ধমান এনট্রপিকে সফলভাবে অন্তত কিছুটা সময় ঠেকিয়ে রাখার জন্য গোটা মহাবিশ্বে একটাই শক্তির আবির্ভাব হয়েছে আজ অবধি, যে কেওস থেকে অর্ডার তুলে এনেছে। চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়তে থাকা ধ্বংসের মধ্যে সেল্ফ সাস্টেইনিং সিস্টেম তৈরি করতে পেরেছে।”
“জীবন।”
“দূরে সরে যাওয়া আটকানোর একমাত্র ফুলপ্রুফ উপায়। আমার সাধ্য কী এই সাইকেল ছেড়ে বেরোনোর, স্যার! আপনি বেছেইছেন একটা ফল্টি স্লটের মাল। কখনও মানুষ ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে ট্রাই করবেন। হয়তো সফল হলেও হতে পারেন। মানুষগুলো সব এক।”
“তুমি জানলে কী করে?”
“কোনটা?”
“যে মানুষ সব আসলে এক?”
“আমি তো আলংকারিক অর্থে বলেছিলাম। অলংকার বোঝেন তো?”
“মানুষ শুধু নয়। সব সজীব বস্তু মিলিয়েই আসলে একটাই অস্তিত্ব। সেই জন্যই তো একে-অপরের কাছে আসার জন্য এত আকুলি বিকুলি।”
“তাহলে আর কি! পরের বার অন্য কিছু ট্রাই করবেন! বেস্ট অফ লাক ইন অ্যাডভান্স!”
“তুমি সত্যিই আমায় ভগবান ঠাউরে বসে আছ, তাই না?” তৃতীয় শব্দটার ওপর একটু বেশি জোর।
“নন আপনি?”
“কী মনে হয় তোমার?”
উত্তর দিল না নীহারিকা। চোখে ঘুম নামছিল বহুদিন পর। শান্তির ঘুম।
সময় শুরু হল। আরও একবার।
Tags: অষ্টম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, মোহনা দেবরায়