গুঞ্জন
লেখক: ঋজু গাঙ্গুলী
শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব
তিন মাস আগে, সুরুলগাছা পুলিস স্টেশন
“আমার কমপ্লেইনটা নিন, স্যার।”
“সে নিচ্ছি। কিন্তু আপনার টোটো তো স্টেশনের কাছেই পাওয়া গেছে। এদিকে লোকটার নাম-ধাম কিছুই আপনি বলতে পারছেন না। যা বর্ণনা দিচ্ছেন, তার ভিত্তিতে লুক-আউট নোটিসও তো জারি করতে পারব না। কোনও বিশেষত্বই নেই যার চেহারায়, তাকে কীভাবে…। আচ্ছা, ভদ্রলোক হঠাৎ আপনার ওপর খেপলেন কেন?”
আই.সি বলরাম মণ্ডলের কথা শুনে দুঃখিত ভঙ্গিতে বরফ-জড়ানো কাপড়ের পুঁটলিটা চোখের নীচের কালশিটেয় চেপে ধরলেন প্রদীপ মালাকার। পাশে বসা তাঁর স্ত্রীই বললেন, “সেটা ও কী করে বলবে, স্যার? আপনাকে তো বলল, লোকটাকে ও শুধু বলেছিল, এইভাবে একটাই জায়গায় টোটো নিয়ে বসে থাকা ওর পোষাচ্ছিল না। ও অন্য কাস্টমার নিয়ে কাজ-টাজ সেরে ওখানেই ফিরে আসছে। তাতেই লোকটা ওকে মারধোর করে ওই টোটো নিয়ে চলে গেল। এবার আপনি বলুন, এই বদমায়েশকে আপনারা ধরবেন কি না?”
প্রদীপের স্ত্রী রমা বেশ ডাকসাইটে মহিলা। থানার দুজন কনস্টেবল অবধি তিনি ঘরে ঢোকার পর থেকে অ্যাটেনশন হয়ে ছিল একেবারে। বলরাম বুঝলেন, কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। তাঁর নির্দেশে এস.আই তথাগত খশখশ করে ডায়েরির বাকি জিনিসগুলো নোট করতে লাগলেন।
অঙ্গনওয়াড়ি-র নতুন সুপারভাইজার সুলতা থানায় এসেছিলেন কয়েকটা ফর্ম নিয়ে। তিনি কৌতূহলী হয়ে রমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “দিদি, প্রদীপদাকে কোথায় বসিয়ে রেখেছিল লোকটা?”
অল্পবয়সি সুশ্রী মহিলাদের রমা স্বভাবতই একটু সন্দেহের চোখে দেখেন। তবে সেই মুহূর্তে সহানুভূতিশীল গলা শুনে তিনি উত্তর দিলেন, “আরে ওই পোড়া ঠাকুরের ঢিবির বাইরে!”
“পোড়া ঠাকুরের ঢিবি!” সুলতা আরও অবাক হয়ে এবার বলরামের দিকে ঘুরলেন, “সেটা কোন জায়গা?”
বলরাম হেসে বললেন, “ওটা এমন কিছু দ্রষ্টব্য জায়গা নয়। সরস্বতীর মজা খাতের ধারে যে জায়গাটা উঁচু হয়ে আছে, তার কিছুটা অংশকে পোড়া ঠাকুরের ঢিবি বলে এই অঞ্চলের মানুষ। যা শুনেছি, ওখানে কোনও একসময় একটা উল্কা বা তার টুকরো এসে পড়েছিল। লোকে অবশ্য বলে, ওখানে নাকি একটা ওলটানো মন্দির আছে। সেটা নাকি জ্বলতে-জ্বলতেই আকাশ থেকে পড়েছিল। এখন ওখানে মাটির অনেকটা নীচে কালো-কালো কিছু পাথর দেখা যায় শুধু।”
“জ্বলন্ত মন্দির? মানে রকেট টাইপের কিছু?”
সুলতার প্রশ্নকে নস্যাৎ করে দিয়ে হো-হো করে হেসে উঠলেন বলরাম। এমনকি রমাও বলে উঠলেন, “না গো। ও-সব নেই ওখানে। কম খোঁজাখুঁজি হয়েছে নাকি? তবে জায়গাটা দৈবী।”
রমা তো বটেই, থানার আরও কজন দুহাত যুক্ত করে নমস্কার করলেন। সুলতা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন দেখে তথাগতই বলে উঠলেন, “আসলে ওখানে যারাই যায়, তাদেরই মধ্যে একটা অদ্ভুত ভাব দেখা যায়। কেউ সংসার ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। কারও আবার মাথায় গোলমাল হয়। সেজন্য লোকে ভয়ে আর ভক্তিতে জায়গাটা এড়িয়েই চলে।”
“আর সেইখানে গিয়ে কিনা লোকটা খেপে গেল!” প্রদীপ কাতরে উঠলেন, “অত সুন্দর গলা। অত সুন্দর কথা বলার ভঙ্গি। আমাকে বলল, ‘ওই ঢিবির কাছে আমায় নিয়ে চলুন। আপনার সারা দিনের পেমেন্ট করে দেব।’ অর্ধেক পেমেন্ট করেও দিল। কিন্তু ওখানে গিয়ে লোকটার যে কী হল!”
“লোকটা কি ওখানে গিয়েই খেপে গেল?” বলরাম জানতে চাইলেন, “আপনাকে মারার আগে আর কোনও অস্বাভাবিক আচরণ দেখেছিলেন?”
“ওখানে গিয়ে লোকটা প্রথমে একেবারে স্থির হয়ে গেল, বুঝলেন!” একঘর মনোযোগী শ্রোতা পেয়ে প্রদীপের চোয়ালের যন্ত্রণা বোধহয় কমে গেছিল। তিনি সোৎসাহে বলে চললেন, “ভাবলাম, কী হল রে ভাই? স্ট্রোক-টোক হয়নি তো? ‘ও দাদা! কী হল?’ এ-সব বলে অনেক ডাকাডাকি করলাম। কোনও সাড়াই দিচ্ছিল না লোকটা। তারপর বুঝলাম, লোকটার বুকে মোবাইল আর কানে হেডফোন। সেইজন্য আমার কথা শুনতে পাচ্ছে না। লোকটা আমার দিকে তাকালও না। বসে পড়ল ঢিবির উপর, আর বসেই রইল যতক্ষণ না…”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে গেলেন প্রদীপ।
২
এক মাস আগে, বাস-স্টপ, আদৃতা
“একটা জিনিস দেখবেন?”
অসহ্য লাগছিল পরিবেশটা। কতক্ষণে বাস আসবে তার ঠিক নেই। ক্রমাগত বৃষ্টি হয়ে চলেছিল বলে শেডের এই নোংরা আর প্রায়ান্ধকার বেঞ্চেই বসতে হয়েছিল। নেটওয়ার্ক নেই বলে মোবাইলে খুট-খাট করে যে সময় কাটাব— তারও উপায় ছিল না। এদিকে আজকের ঝড় বৃষ্টিতে এলাকা নির্ঘাত অন্ধকার হয়ে রয়েছে। লাইট না থাকলে চার্জ দেব কীভাবে, এই ভয়ে মোবাইলটা শেষ অবধি পকেটেই রেখে দিয়েছিলাম। এরই মধ্যে লোকটা হঠাৎ কথা বলে উঠল।
হ্যাঁ, ‘লোকটা’— এ-ছাড়া তার সম্বন্ধে বলার মতো কিছু পাইনি। একেবারে ছাপোষা কেরানি-গোছের চেহারা। তেমনই সাদামাটা পোশাক, জুতো, চশমা, ছোটো ব্যাগ। যেকোনো স্টেশনে, বাস-স্টপে, হাটে-মাঠে এমন চেহারা অজস্র দেখা যায়। তাই তাদের মনে রাখার কোনও কারণ থাকে না। বিশেষ কিছু না ঘটলে তাদের প্রায় দেখাও যায় না বলা চলে। এও তেমনই এক প্রায়-অদৃশ্য চরিত্র— যে গত পনেরো মিনিট ধরে এই শেডের এক কোণে চুপচাপ বসে ছিল।
সেই মুহূর্তে লোকটার কথা শুনে মনে হল, এ আবার উল্টো-পাল্টা কিছু করবে না তো? কতরকম সাইকোটিক লোকজন চারপাশে ঘুরে বেড়ায় আজকাল। কার মনে যে কী থাকে, বোঝাও তা যায় না। হয়তো লোকটা জামা-কাপড় খুলে আমায় নিজের… বা বিশেষ কিছু-ঠাসা পেন-ড্রাইভ বেচতে চাইল।
ও-সব ভাবনা মুখে ফোটানো মানেই দুর্বলতা দেখানো। তাই মুখে নব্বই শতাংশ বিরক্তি আর দশ শতাংশ মামুলি ভদ্রতা ফুটিয়ে পালটা প্রশ্ন করলাম, “আমায় কিছু বলছেন?”
“হ্যাঁ, আপনাকেই বলছি।” এবার খেয়াল হল, লোকটার গলার স্বর বেশ সুন্দর। কোনও ফ্যাঁসফ্যাঁসে বা ঘষটানো ভাবে নেই তাতে। বরং পেশাদার, রেডিও বা অডিও চ্যানেলে যারা গল্প-টল্প পড়ে, অনেকটা সেইরকম গলা— ভদ্র, সামান্য ওঠানামায় প্রাণবন্ত, পরিশীলিত। ওই গলার স্বর শুনেই ঠিক করে ফেলেছিলাম, দেখা যাক লোকটা কী করে।
“এখানে আপনি কী জিনিস দেখাবেন? নাচ, না ম্যাজিক?” ইচ্ছে করেই ব্যঙ্গ ভরে বললাম এবার। খোঁচালে কাজ হয় দেখেছি।
“একটা ক্যাটালগ।”
লোকটা নিজের ছোট্ট ব্যাগটা খুলল। মুহূর্তের জন্য প্রতিবর্ত ক্রিয়ার বশে মনে হয়েছিল, ওখান থেকে হয়তো একটা রিভলভার, বা ছুরি, নয়তো অ্যাসিডের শিশি বেরিয়ে আসবে। মেয়ে হয়ে জন্মানো যে কী অভিশাপ তা যদি বুঝতেন! যাইহোক, সে-সব কিছু বেরোল না। বরং সত্যি-সত্যিই লোকটা একটা লিফলেট বের করে বাড়িয়ে ধরল।
অল্প আলোতেও লিফলেটটা চকচক করে উঠল। গ্লসি কাগজে রঙিন লেখাগুলো বেশ আকর্ষণীয় মনে হল। কিছুটা অনিচ্ছাসত্ত্বেও জিনিসটা হাতে নিলাম।
“দয়া করে না দেখেই ফেলে দেবেন না।” লোকটা আবার তার সুন্দর গলায় বলে উঠল, “আমরা একটা নতুন অডিও চ্যানেল লঞ্চ করেছি। তাতে কী-কী গল্প, নাটক, গান আছে— তার ছোট্ট একটা অংশের বিবরণ ওই ক্যাটালগে পাবেন। সাইটে গেলে কিছু ফ্রি স্যাম্পল শুনতে পাবেন। তবে অধিকাংশই পেইড কনটেন্ট। যদি শুনতে চান তাহলে পেমেন্ট করলে আপনার কাছে লিংক চলে আসবে।”
“এর জন্য পয়সা দেব কেন?” মুখে তাচ্ছিল্যের ভাব ফোটালাম, “ইউ-টিউবে তো বিনা পয়সাতেই এ-সব শোনা যায়।”
“আমরা যা পরিবেশন করি তা ইউ-টিউবে পাওয়া যায় না।” সিরিয়াস মুখে বলল লোকটা। কম আলোয় তাকে দেখে ক্লাসে থেকে যাওয়া বেশি বয়সের ছাত্র ছাড়া কিছু মনে হচ্ছিল না সেই মুহূর্তে। সেভাবেই সে বলছিল, “একবার শুনে দেখবেন নমুনাগুলো। ভালো লাগলে না হয়…”
লোকটাকে দেখে ঠিক সেলস রিপ্রেজেন্টেটিভ বলে মনে হচ্ছিল না। তবে সেই মুহূর্তে আমাকে সে যথাসম্ভব আন্তরিকতার সঙ্গেই আইডিয়াটা বেচতে চাইছিল।
“এটা কি আপনার চ্যানেল?” কী মনে হতে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম।
লোকটা হাসল। সহজ হাসি, তবে তার মধ্যে কী যেন একটা ছিল। একটা অদ্ভুত কষ্ট, বা একাকীত্ব! কিছু না বলে সে ক্যাটালগটা আরও একটু এগিয়ে ধরল।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাগজটা হাতে নিতেই হল।
“ওতে বেশ কয়েকটা প্রোগ্রাম আমার করা।” লোকটা সুন্দর কণ্ঠে, ঈষৎ ক্লিষ্ট ভঙ্গিতে বলল। মনে হচ্ছিল, তার যেন রেডিওতে ধ্রুপদী সঙ্গীত বা ওইরকম আঁতে… মানে উঁচু দরের কিছু পরিবেশন করার কথা ছিল। কিন্তু ভাগ্যচক্রে তাকে এইসব কাজ করতে হচ্ছে।
ভাগ্যের হাতে মার খাওয়া লোকেদের প্রতি আমার একটু করুণাই হয়। বললাম, “ঠিক আছে। ফ্রি স্যাম্পল শুনে দেখব। ভালো লাগলে তখন না হয় দেখা যাবে।” একটু থেমে জ্ঞান দেওয়ার ভঙ্গিতে বলেই ফেললাম, “কিন্তু আপনি সেলসের কাজই যদি করেন, তাহলে আরেকটু মন দিয়ে করুন। এমন চুপচাপ এক কোণে বসে থাকলে হবে? নিজের কাজ, বা নিজেকে আরেকটু উঁচু পর্দায় তুলে না ধরলে লোকে জানবে কী করে?”
লোকটার মুখে ভারি সুন্দর একটা হাসি ছড়িয়ে পড়ল এবার। ঘাড় হেলিয়ে সে বলল, “আসলে কী জানেন? সত্যিকারের ভালো শিল্পীর সন্ধান সমঝদারেরা পেয়েই যান। তাঁদের প্রচার করতে হয় না। সেই ভরসাতেই চেঁচামেচি না করে কাজটা করে যাওয়ার চেষ্টা করি।”
একরাশ কাদাগোলা জল আর ডিজেলের গন্ধ ছড়িয়ে একটা লোকাল বাস তখনই এসে দাঁড়াল। কন্ডাক্টর কোনোমতে একজনকে নামিয়ে দিয়েই পালানোর পক্ষপাতী ছিল। কিন্তু আমি ছাতাটা এক ঝটকায় খুলে, প্রায় লাফ দিয়ে বাসের পাশে পৌঁছে বডিতে দুমাদ্দুম আওয়াজ তুলে বললাম, “কদমতলা যাবে?”
ভেতরটা একেবারে কাঁঠাল বোঝাই হয়ে ছিল। সেখান থেকেই ক’জন যাত্রী চেঁচালেন, “যাবে!”
ছাতাটা ভাঁজ করতে-করতে একেবারে চুপচুপে ভিজে গেলাম। উঠতে গিয়ে কী মনে হল, পা-দানিতে এক পা রেখেও শেডের দিকে ঘুরে বললাম, “আপনার নামটা জানা হল না।”
লোকটা উঠে, এক পা এগিয়ে এসে, সেই সুন্দর গলায় বলল, “চ্যানেলের নামেই আমার পরিচয়।”
লিফলেটের দিকে চোখ গেল। দেখলাম তাতে লেখা আছে- গুঞ্জন।
অদ্ভুত নিবেদিতপ্রাণ মানসিকতা, বলতেই হচ্ছে! বাসে উঠে, বদমাইশদের কনুই দিয়ে গুঁতিয়ে, ভদ্রদের পায়ে আলতো করে মাড়িয়ে ভেতরে ঢুকতে লাগলাম। টলতে-টলতে বাসটা চলতে শুরু করল। তখনই বিদ্যুৎচমকে জায়গাটা একেবারে সাদা হয়ে গেল।কান-ফাটানো আওয়াজ আসার আগে পেছনের ধোঁয়াটে জানালা দিয়ে দেখলাম, শেডে দাঁড়িয়ে বাসের দিকে তাকিয়ে আছে লোকটা— গুঞ্জন।
৩
তিন সপ্তাহ আগে— দিনে, আদৃতা
“চিফ কমপ্লেন: পেশেন্ট প্রেজেন্টেড উইথ সিগিনিফিক্যান্ট মাসল ট্রেমর, কনস্ট্যান্ট হেডেকস্, এক্সেসিভ নার্ভাসনেস, পুওর কনসেন্ট্রেশন, অ্যান্ড পুওর এবিলিটি টু ফোকাস। হিজ কনফিডেন্স অ্যান্ড সেলফ-এস্টিম আর সিগনিফিক্যান্টলি লো। হি স্টেটেড…”
অনুনাসিক ভঙ্গিতে বলা কথাগুলো হেডফোনের মধ্য দিয়ে কানে ধাক্কা মারছিল। আমার আঙুলগুলো ছুটে চলছিল কি-বোর্ডের উপর দিয়ে। কোম্পানির নিজস্ব সফটওয়্যার আপন খেয়ালে হাইলাইট বা আন্ডারলাইন করছিল কিছু-কিছু শব্দকে— পরে সেগুলো হয় শোধরাতে, নয় ব্যাখ্যা করতে হবে বলে। অন্য সবকিছু ভুলে শুধু নিজের কাজটা মন দিয়ে করার চেষ্টা করছিলাম। তবে কিছু-কিছু অভ্যাস কিছুতেই যায় না। স্ক্রিনের পাশে রাখা চকচকে ফ্লাস্কে একটা প্রতিবিম্বকে ক্রমশ এগিয়ে আসতে দেখে আপনা থেকেই মাথাটা ঘুরে গেল সেদিকে।
“বস তোকে ডেকেছে।” যাজ্ঞসেনী মুখটা নিঃস্পৃহ রাখতে চাইলেও ওর চোখের তলা থেকে উঁকি দেওয়া বিজয়গর্ব আমার নজর এড়াল না, “ইভ্যালুয়েশন রিপোর্ট এসেছে। তোর কাজটা ভালো হয়নি, আদি। তবে সিনিয়র হিসেবে একটা পরামর্শ দিই। মাথা গরম করলে কাজটা একেবারেই থাকবে না। বরং আর একটা সুযোগ চেয়ে নিস।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালাম। সিনিয়র-ই বটে! আমার চেয়ে বয়সে অন্তত এক দশক ছোটো, কাজের ক্ষেত্রে এই অফিসের মধ্যে সবচেয়ে কম দক্ষতাসম্পন্ন এই মেয়েটি যে কীভাবে এই পদে বসে আছে— তা আমি এই ছ’ মাসের মধ্যেই জেনে গেছি। কিন্তু এই নিয়ে অফিসের মধ্যে ঝামেলা করে লাভ নেই। ইনফ্যাক্ট অফিসের বাইরে ঝামেলা করেও লাভ নেই। হেডফোন সরিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ালাম আমি।
আয়ুষ নামের নতুন ছেলেটি কী-সব বাস্তু-টাস্তু মেনে কাজ করে। ওর ওয়ার্ক-স্টেশনের একপাশে একটা ছোট্ট আয়না ঝোলে। যাজ্ঞসেনী’র খাটো শার্ট আর টাইট জিনস্ দেখার পর আপনা থেকেই চোখ গেল সেদিকে। ত্রিশের শেষদিকে থাকা, নিতান্ত সাধারণ টি-শার্ট আর ঢিলে ট্র্যাকস পরে থাকা, নিতান্ত সাধারণ মুখ ও চেহারার, জীবন যুদ্ধে ক্লান্ত এক মহিলাকে দেখতে পেলাম ওই আয়নায়।
মাথা নেড়ে ভাবলাম, যতই খাটি না কেন, আমার কাজ আর ‘ভালো’ হবে কী করে?
বস— মানে প্রণয় শর্মা’র চেম্বারে গিয়ে সসম্ভ্রমে বললাম, “স্যার, আসব?”
এই ফ্লোরের অন্যান্য ট্র্যান্সক্রিপশনিস্টদের সঙ্গে প্রণয়ের ব্যবহার একটু চরমপন্থী। যারা তার অশ্বমেধের ঘোড়া হতে পারে, তাদের সে সযত্নে লালন করে। অন্যদের বদলে যাওয়ার হার দেখে আঁতকে উঠতে হয়। হয়তো আমার বয়স আর নিতান্ত সাধারণ চেহারার জন্যই আমাকে সে এতদিন খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। তবে এবার…
“আসুন, মিস…” শব্দটার উপর অনাবশ্যক গুরুত্ব দিয়ে প্রণয় কী বোঝাতে চাইল, তা সেই জানে। সিংগল মাদার হিসেবে আমি এ-সবে অভ্যস্ত, তাই চুপ করেই রইলাম।
“আদৃতা, রাইট? আচ্ছা, শব্দটার অর্থ কী?”
“স্বতন্ত্র। সবার প্রিয়। এই দুটো অর্থই প্রচলিত।”
“আ…চ্ছা। অবশ্য নামে কী আসে যায়, তাই না? কথাটা কে বলেছিলেন বলুন তো?”
“আসল সংলাপটা ছিল, ‘হোয়াটস্ ইন আ নেম?’ রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট-এ শেকসপিয়র জুলিয়েটকে দিয়ে বলিয়েছিলেন।”
এতক্ষণে প্রণয় শর্মা একটু নড়ে-চড়ে বসল। উল্টোদিকের ফাঁকা চেয়ারটা আমায় দেখিয়ে সে বসতে ইঙ্গিত করল। চুপচাপ বসে পড়লাম।
“আপনি এই অফিসে কাজ করছেন ছ’মাস ধরে, রাইট?”
সামনের কাগজে সবই লেখা আছে। তারপরেও লোকে যখন এমন প্রশ্ন করে, তখন তার একটাই উত্তর হয়। আমিও সেটাই বললাম, “এই ছ’মাস আমার কর্মজীবনের অন্যতম সেরা সময়, স্যার।”
চশমার পেছনে প্রণয়ের ভ্রুকুটিগুলো একটু নরম হল। সে মাথা নেড়ে বলল, “শুনে ভালো লাগল। কিন্তু আপনার কাজটা তো ঠিক ‘সেরা’ লেভেলে ওঠেনি, আদৃতা। কেন এমন হল?”
যে কাজ করতে আমার একটুও ভালো লাগে না, সেই কাজে নিজের ‘সেরা’-টা দেওয়া কি আদৌ সম্ভব? কিন্তু এই কথা লোকটাকে বোঝানো সম্ভব নয়।
এই বয়সে এসে নিজের যাবতীয় পূর্ব-অভিজ্ঞতা ত্যাগ করে নতুন একটা জীবন শুরু করতে হয়েছে আমাকে। বদলেছে পরিচয়, বাসস্থান, জীবনযাত্রার ধরন। স্বাধীনভাবে ছেলেকে নিয়ে বাঁচার জন্য আমার যা-হোক একটা কাজের দরকার ছিল। মরিয়া হয়ে একটা কোর্স করেছিলাম। তার জোরে এই কাজটা করার সুযোগ পেয়েছি কোনোক্রমে। তাতে একটু-একটু করে অনেকটাই শিখেছি, কিন্তু ‘সেরা’… নাহ্, অন্তত মেডিকেল ট্র্যান্সক্রিপশনের ক্ষেত্রে সে জায়গায় কোনোদিন পৌঁছোতে পারব বলে মনে হয় না।
“আমি এই কাজটা আগে করিনি, স্যার।” যথাসম্ভব সততার সঙ্গে বললাম, “এখন নিজের ছেলেকে নিয়ে একা বাঁচতে চেষ্টা করছি বলেই এই পেশায় আসা। আমি বেশি কিছু পারতাম না, এখনও পারি না। তবে আপনারা সুযোগ দিয়েছেন বলে অন্তত আমাদের দু’জনের জীবনধারণের উপায়টুকু হয়েছে।”
প্রণয় আমার আপাদমস্তক দেখছিল। লোকটাকে প্রতি মাসে, হয়তো প্রতি সপ্তাহেই ইভ্যালুয়েশনের ভিত্তিতে একবার বা বারবার এই কথাগুলো শুনতে হয়। তারপর সে কী করে বা কী বলে তা অনুমেয়। তবে উল্টো-পাল্টা কিছু সে এই চেম্বারে বসে বলবে না। আজকাল এইচ.আর এ-সব ব্যাপারে মারাত্মক নজরদারি চালায়।
“একটা কথা আপনাকে স্পষ্টভাবে বলি, আদৃতা।” প্রণয় থেমে-থেমে বলল, “আমাদের কোম্পানি পারফর্ম্যান্স ছাড়া অন্য কিচ্ছুর ভিত্তিতে চলে না। পারফর্ম, অর পেরিশ— এই হল আমাদের মূলমন্ত্র। আপনাদের জায়গা নেওয়ার জন্য লক্ষ-লক্ষ যুবক-যুবতী সাগ্রহে অপেক্ষায় আছে। মানছি, আপনার উপর অনেক দায়-দায়িত্ব এসে পড়েছে এই বয়সে। কিন্তু নতুন প্রজন্মকে কাজের সুযোগ করে দেওয়ার দায় তো আমাদেরও। তাই আপনি…”
“আমাকে দয়া করে ছাঁটাই করবেন না।” ক্লান্ত ভঙ্গিতে বললাম। তাতে অসহায়তা ছিল না বলেই বোধহয় প্রণয় থমকে গেল। তার টেবিলের উপর রাখা নরম হলদেটে পেপারওয়েট আর ল্যাপটপের উপর চোখ রেখে বলে চললাম, “আমাকে আরও ছ’টা মাস কাজের সুযোগ দিন। যদি তার মধ্যে কাজে উন্নতি না করতে পারি, তাহলে নিজেই চলে যাব এখান থেকে।”
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল প্রণয়। তারপর সে কেটে-কেটে বলল, “সেক্ষেত্রে আপনার মাইনে বাড়বে না। ছ’মাস আপনি এই প্রোবেশন পে-তেই কাজ করবেন। রাজি?”
মাথা নেড়ে সায় দিলাম। প্রণয়ও মাথা নেড়ে বলল, “অ্যাকাউন্টস্ আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করে নেবে। এখন আপনি আসতে পারেন।”
দরজা খুলে বেরিয়ে এলাম। মনে হল, একটু আগে যে রেকর্ডটা ট্র্যান্সক্রিপ্ট করছিলাম, তাতে উল্লিখিত রোগীর মতো আমারও মেজর ডিপ্রেসিভ ডিজর্ডার দেখা দেবে ক’দিনেই। হঠাৎ চোখ পড়ল যাজ্ঞসেনী’র দিকে। নিঃস্পৃহ মুখে আমাকে আবার নিজের ওয়ার্ক-স্টেশনে গিয়ে বসতে দেখে মেয়েটির ভ্রু কুঁচকে গেছিল। আপনা থেকেই একটা ক্লান্ত হাসি ফুটে উঠল আমার মুখে।
এইসব ছোটো-খাটো জয় দিয়েই আপাতত ডিপ্রেশন-নামক শত্রুটিকে ঠেকিয়ে রাখতে হবে আমায়।
৪
এক মাস আগে, ক্লাব
“তারপর?” কাশফুলের মতো একমাথা চুলে ভরা মাথা তুলে প্রশ্ন করলেন শীর্ণকায় বৃদ্ধ।
“ব্যাপারটা কনফার্মড, স্যার।” হাতের ফোল্ডারটা টেবিলে রেখে পিউ নামের মেয়েটি সোজা হয়ে দাঁড়াল। সাদা শার্ট, টাইট জিন্স, পনিটেইল, রিডিং গ্লাসের আড়ালে কটা চোখ— এ-সবে মেয়েটিকে আর পাঁচটি কেজো তরুণীর মতোই দেখাচ্ছিল। তবে যাঁরা এই সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন, তাঁরা জানেন মেয়েটি কে এবং সে কী করতে পারে।
“ডেটামাইন্স কর্পোরেশন এক বিদেশি ক্লায়েন্টের দাবিতে একটা অ্যাপ তৈরি করছিল।” বলে চলল পিউ, “সেটার প্রোটোটাইপ নিয়ে কাজ করছিল ওই সংস্থারই এক কর্মচারী। সে নাকি পেশাদার ভয়েজ আর্টিস্টদের থেকেও ভালো ভয়েজ মডিউলেশন করতে পারে। তিন মাস আগে সে উধাও হয়ে যায়। অদ্ভুত ব্যাপার হল, সেই বিদেশি ক্লায়েন্টটি অ্যাপের ডেভেলপমেন্ট ফি দিয়ে ডেটামাইন্স-এর সঙ্গে যোগাযোগ রাখা বন্ধ করে দেয়। এই মুহূর্তে ওই অ্যাপ বা তার ব্যবহার নিয়ে ডেটামাইন্স কিছু জানেই না।”
“কথাটা কি বিশ্বাসযোগ্য?” মুখ তুললেন ‘স্যার’ নামে সবার কাছে পরিচিত ব্যক্তিটি। খুব কম মানুষই তাঁর প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে আসেন। ফলে তাঁকে দেখতে যে ঠিক কেমন, সেটা নিয়ে অনেক সংশয় আছে অনেকের মনে।
“পুরোপুরি নয়, স্যার। বিদেশি ক্লায়েন্ট মানে একটা শেল— যার পেছনে, অনেক লেয়ার পেরিয়ে, আসলে কে আছে তা আমরা জানি। পেমেন্ট পাওয়ার পর যেভাবে ডেটামাইন্স একেবারে চুপ করে গেছে তাতে একটা ব্যাপার স্পষ্ট। শুধু অর্থ নয়, হুমকিও পেয়েছিল ওরা। কর্মচারীটির ব্যাপারে তারা কেন খোঁজ নেয়নি— এরও কোনও সন্তোষ দায়ক ব্যাখ্যা দিতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। মনে হয়, ওরা কিছু জানে।”
“অর্থাৎ প্রোটোটাইপ আর ওই বেপাত্তা কর্মচারীটিকে কাজে লাগিয়ে কেউ কাজটা শুরু করে দিয়েছে ইতিমধ্যেই।”
“কিন্তু অ্যাপটার বিশেষত্ব কী, স্যার?” একটু অধৈর্য ভঙ্গিতে বলে উঠল পিয়া, “দেশের হাজার-হাজার স্টার্ট-আপ এইরকম কত অ্যাপ ডেভেলপ করছে রোজ। তার সঙ্গে এটার কী পার্থক্য?”
‘স্যার’ চুপ করে তার দিকে তাকিয়ে আছেন দেখে পিউয়ের পেটের ভেতরটা খালি হয়ে গেল। তার মনে হল, সে কি একটু বেশিই সাহস দেখিয়ে ফেলল? এই মানুষটি ক্রুদ্ধ হলে তার জীবনের মূল্য…
“বোসো।”
সংক্ষিপ্ত আদেশ পালন করল পিউ। তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন ‘স্যার।’ তারপর ধীরে-ধীরে বললেন, “বেশ কয়েক বছর আগে দিল্লির কাছে বুরারি বলে একটা জায়গায় চুন্দাওয়াত পরিবারের এগারোজন সদস্য আত্মহত্যা করেছিলেন— মনে আছে?”
মাথা নেড়ে সায় দিল পিউ। নিচু গলায় বলে চললেন ‘স্যার।’
“ওটা নিয়ে অনেক থিওরি আছে। কোনওটা মিডিয়া ছড়িয়েছে। কোনওটা ছড়িয়েছে অন্য কোনও ইন্টারেস্টেড পার্টি। অধিকাংশ মনস্তাত্ত্বিক রায় দিয়েছেন, একটা শেয়ার্ড সাইকোসিস, বা শেয়ার্ড ডিল্যুশনাল ডিজর্ডার ঘটেছিল ওই পরিবারের সদস্যদের। সমাজের অন্যদের থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা একাধিক ব্যক্তির মধ্যে প্রথমে একজন সাইকোসিসের ফলে দৃষ্টি ও শব্দের একটা ভ্রমের শিকার হন। আসলে অবসন্ন, ক্লান্ত, বিষণ্ণ মানুষটির অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি তার দেহে কর্টিসল হরমোনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। তার ধাক্কায় মস্তিষ্কে ডোপামিনের মাত্রা বাড়ে। এই প্রথম বা প্রাইমারি ব্যক্তিটি যদি অন্যদের তুলনায় ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হন, তাহলে অন্যরাও তাঁর দ্বারা প্রভাবিত বা ইনডিউসড হতে পারেন। পরে সেই বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিদের মধ্যে অন্য কোনও ব্যক্তিও সেই ভ্রম দেখতে-শুনতে শুরু করলে এই ডিজর্ডারটা হয়। এমন হলে সেই প্রাইমারি বা প্রিন্সিপালের কোনও ধর্মীয় বা আত্মিক ভাবনা থাকলে অন্যরাও তার বশে এসে অনেক কিছু করতে পারে— যার মধ্যে আত্মহত্যাও পড়ে। বুরারিতে তেমনই কিছু হয়েছিল বলে দাবি করা হয়। ওই পরিবারের ললিত নামের এক সদস্য তাঁর প্রয়াত বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করার সাইকোসিসে ভুগে অন্যদেরও সেইরকম কিছু বোঝান, যার ফলে সবাই আত্মহত্যা করে— এমনই মনে করেন বহু বিশেষজ্ঞ।”
“কিন্তু?”
বৃদ্ধের ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি খেলে গেল, “রাইট ইউ আর! নইলে এই ‘হুইস্পার্স’ নামক অ্যাপ-এর প্রসঙ্গে এ-সব কথা উঠবে কেন?”
কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন মানুষটি। তারপর ধীরে-ধীরে বললেন, “গত শতাব্দীর ছয়ের দশকের শেষেই ‘বি.জেড’ নামের একটি রাসায়নিক নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে গিয়ে সেনাবাহিনী একটা জিনিস আবিষ্কার করেছিল। লক্ষ-লক্ষ ডলার খরচ করেও সি.আই.এ তাদের ‘এম.কে আল্ট্রা’ দিয়ে মনের উপর নিয়ন্ত্রণ স্থাপনের ব্যাপারটাতে সফল হয়নি। কিন্তু ওই রাসায়নিকের প্রভাবে শেয়ার্ড ডিল্যুশনাল ডিজর্ডারের লক্ষণ দেখা গিয়েছিল গোটা ইউনিট জুড়ে! তারপর থেকে সেটা নিয়ে বিস্তর নাড়াচাড়া হয়। শুধু রাসায়নিকের উপর নির্ভর না করে সঙ্গে ছোটো-ছোটো কিছু ট্রিগার জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়। বুরারি-তেও সেগুলো হয়েছিল। চুন্দাওয়াত পরিবারের লোকজন অন্যদের সঙ্গে মিশত-টিশত না; তবে দুনিয়ার সঙ্গে তাদের যোগসূত্র ছিল খবরের কাগজ। তাতে ছোট্ট-ছোট্ট নকশা এঁকে সবার মাথায় কিছু ভাবনা গেঁথে দেওয়া হচ্ছিল। আর এ-সবেরই ফলে…”
“কাজটা কে করিয়েছিল, স্যার?”
বৃদ্ধ হাসলেন, “তোমার চোখদুটো দেখে কেউ তোমায় কখনও বেড়ালের সঙ্গে তুলনা করেছে?”
ঢোঁক গিলে মাথা নাড়ল পিউ। ‘স্যার’ বুঝলেন, তাঁর বক্তব্য পিউয়ের মগজস্থ হয়েছে। তিনি ফোল্ডার তুলে তার পাতা ওল্টাতে-ওল্টাতে শান্তভাবেই বললেন, “এই অ্যাপটা বুরারি এবং আরও বেশ কিছু জায়গা থেকে পাওয়া নো-হাউ-এর ভিত্তিতে বানানো হচ্ছিল। রাসায়নিকের বদলে এখানে শুধুই শব্দতরঙ্গের ব্যবহার করার চেষ্টা হচ্ছিল। সেজন্যই অমন নাম। তবে মাইন্ড কন্ট্রোল ইত্যাদির কথা তো আর বলা হয়নি। কাগজে-কলমে বলা হয়েছিল, এটাকে অন্য অ্যাপের সঙ্গে ইন্টিগ্রেট করে বিজ্ঞাপনের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করা হবে। তাহলে শ্রোতাদের ওপর প্রভাব হবে গভীর এবং দীর্ঘস্থায়ী।”
“এটা তো খুব একটা দোষের কিছু নয়।” পিউয়ের ভ্রু কুঁচকে রইল, “কোন ছন্দ, সুর, এমনকি কতটা জোরে কথা বললে বিজ্ঞাপনের প্রভাব বেশি হবে— এই নিয়ে তো বহু স্টাডি আছে।”
“সেজন্যই তো কাজটা শুরু করা গেছিল। তার পেছনের আসল উদ্দেশ্যটা ডেটামাইন্স হয় বোঝেনি; নয় বুঝেও চুপ করে ছিল।”
“তারপর হঠাৎ কী হল? অ্যাপটার ওই প্রোটোটাইপ ভার্শন নিয়ে সেই কর্মচারী কোথায় গেল?”
অন্য একটা ফোল্ডার এগিয়ে দিলেন ‘স্যার।’ সেটা খুলে পিউয়ের চোখ বিস্ফারিত হল।
“কোথায় গেল, কীভাবে সে এতটা শক্তিধর হয়ে উঠল, এখন সে কোথায় আছে— এগুলো খুঁজে বের করার কন্ট্র্যাক্ট আমরা পেয়েছি, পিউ।” ঠাণ্ডা গলায় বললেন ‘স্যার’, “বাছাই-করা কয়েকজন এজেন্টকে এটার দায়িত্ব দিতে হবে। তাদের ব্রিফ করো। ক্লাব থার্টিন হ্যাজ গট আ জব।”
৫
তিন সপ্তাহ আগে— রাতে, আদৃতা
“রিকু আজকেও খায়নি, দিদি।”
বাসন্তী’র কথাটা শুনে মাথা গরম হয়ে গেল। একটা দশ বছর বয়সি ছেলেকে যদি বুঝিয়ে-সুঝিয়ে খাওয়ানোটুকুও না পারে কেউ, তাহলে তাকে রাখা কেন? ঝাঁঝিয়ে উঠতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলাম। সামনে দাঁড়ানো মহিলার ভাঙাচোরা মুখ, শিরা-ওঠা হাত, চোখের তলায় জমা কালি, এই বয়সেই বুড়িয়ে যাওয়া চেহারা— এগুলো আমায় বাসন্তী’র পূর্ব-ইতিহাস মনে করিয়ে দিল। এও মনে হল, মেয়েটির দিনটা বোধহয় আমার চেয়েও খারাপ কেটেছে। গলাটা চেষ্টা করে নরম করলাম, “তুমি কিছু খেয়েছ?”
ঠোঁট কামড়ে মাথা নাড়ল বাসন্তীদি। তারপর হু-হু করে কেঁদে ফেলে বলল, “ছেলেটার কী কষ্ট গো দিদি! আমি বুঝি, কিন্তু ও আমার কথা বোঝে না। তোমার সঙ্গে কথা বলতে না পারলে কিছুতেই খায় না। তাই আমিও…”
কী জ্বালা বলুন দেখি! স্পেশাল চাইল্ডের মা হিসেবে আমি এটুকু মেনেই নিয়েছি যে এই জীবনে অনেক কিছুই আমি পাব না বা পারব না। এও জানি যে আমায় অনেক কিছু পারতে হবে যা অন্যদের পক্ষে ধারণা করা কঠিন। কিন্তু বাসন্তী’র দায়িত্বও কি আমার পক্ষে নেওয়া সম্ভব?
কথা না বাড়িয়ে আগে রিকু’র কাছে গেলাম। অনেক চেষ্টা করে তার মানভঞ্জন করা গেল। ছেলেটার আপাত অবোধ চোখের তলায় যে বুদ্ধির দীপ্তি ঝলমল করে, সেটাই আমার ভরসা। সেই ভরসাতেই তাকে বোঝাতে চাইলাম, বাসন্তীও আজ খায়নি। অল্প কিছু খাইয়ে রিকুকে কয়েকটা ব্যায়াম করাতে হল। ওর সঙ্গেই আমিও কিছুক্ষণ ব্যায়াম করলাম। একদিক দিয়ে ভালোই হল। সারাদিন ধরে ওই বিরক্তিকর কাজ করে মাথার মধ্যে জমে ওঠা অবসাদ কিছুটা হলেও কেটে গেল ওগুলোর মধ্য দিয়ে।
তিনজন মিলে ঝটপট রাতের খাওয়া সেরে নিলাম এরপর। ততক্ষণে রিকু আর বাসন্তী’র মধ্যে একটা অনাক্রমণ চুক্তি গোছের ভাব হয়ে গেছিল। ওদের ‘নিজেদের মতো’ থাকতে দিয়ে নিজের ছোট্ট ‘কাজের’ ঘরে এসে গান শুনবার কথা ভাবলাম। তখনই গুঞ্জন-এর কথা মনে পড়ল।
সাত দিন আগে লিফলেট-টা হাতে পেয়ে ব্যাগের বাইরের চেইন খুলে ঢুকিয়ে রেখেছিলাম। মাঝে এই ক’দিন স্পটিফাই আর ইউটিউব চালালেও এই বিশেষ চ্যানেলটা শোনার চেষ্টা করা হয়নি। ঠিক করলাম, আগেভাগেই সাবস্ক্রাইব করতে বললে গল্প ওখানেই শেষ। কিছু আনপেইড ভালো কনটেন্ট থাকলে তবেই দেখা যাবে।
আইপি অ্যাড্রেস-টা টাইপ করার সঙ্গে-সঙ্গে একটা অদ্ভুত প্রম্পট এল। বলা হল, স্ক্রিনটা নিজের মতো করে নেওয়ার জন্য আগে পটভূমি বাছতে হবে। এমনিতে আমার মোবাইল থেকে ল্যাপটপ— সর্বত্র ডার্ক মোড থাকে। সেই মুহূর্তে কী মনে হল, একটা কালচে ধূসর পটভূমি বেছে নিলাম। আসলে বছরখানেক আগে এই ‘জীবন বদলানোর’ সিদ্ধান্তটা নেওয়ার পর থেকে, নিজেকে যতই বোঝাই না কেন, আমার জীবনের রঙ ওইরকমই হয়ে গেছে। তার জন্য কে দায়ী, তা ভাবতে বসলেই বড়ো ক্লান্ত লাগে। বড়ো একা লাগে। তাই ভাবলাম, অন্তত গান বা কথা শোনার সময় নিজের কাছে সৎ থাকা যাক।
এরপর এল ভাষা আর অন্য নানা বিষয়ে বাছাইয়ের প্রসঙ্গ। আমার পছন্দ-অপছন্দের ভিত্তিতে সাইট সাজানো হবে জেনে বেশ ভালো লাগল। এও মনে হল, হোমিওপ্যাথরা যেমন চিকিৎসা শুরুর আগে প্রচুর প্রশ্ন করেন, এও শেষে তেমনই কিছু হবে না তো? মিনিটখানেকের মধ্যেই অবশ্য সে-সব ল্যাঠা চুকল।
একটা নরম, কালচে ধূসর পটভূমির ওপর বেশ কিছু চিহ্ন একটু-একটু করে ফুটে উঠল। দেখলাম, চিহ্নগুলো আসলে এক-একটা প্লে-লিস্ট— যাতে আগে থেকেই কিছু-কিছু গান, সিনেমার ডায়লগ, স্কিটের অংশ সাজানো রয়েছে। ফ্রি-স্যাম্পল হিসেবে থাকা একটাকে বেছে নিলাম। হেডফোন কানে গুঁজে, ঘরের অধিকাংশ আলো নিভিয়ে, ডুব দিলাম পুরনো আর নতুন নানা গান আর সংলাপের মধ্যে।
ঠিক কখন, বা ক’টা প্লে-লিস্ট শোনার পর ঘুমটা এসেছিল, মনে নেই। বাসন্তী আলতো করে না ঝাঁকালে চেয়ারে আরও কতক্ষণ বসে থাকতাম, জানি না। চোখ মেলে আবিষ্কার করলাম, ততক্ষণে কম্পিউটার ঘুমিয়ে পড়েছে। অথচ মনে হচ্ছিল, হেডফোনে আমি যেন কারও কথা শুনছিলাম ঘুম থেকে ওঠার আগের মুহূর্ত অবধিও!
ঘাড়ে আর গলায় ব্যথা হয়ে গেছিল একদিকে কাত হয়ে থাকার ফলে। উঠে, হাত-মুখ ধুয়ে, বাসন্তীকে দিয়ে কাঁধ আর পিঠ একদফা মেসেজ করিয়ে রিকু’র কাছে গিয়ে দেখলাম, ততক্ষণে ছেলে তার নিজস্ব লেখাপড়া, আঁকাআঁকি সব সেরে ঘুমিয়ে কাদা। মেঝেতে পাতা শক্ত গদিটা টেনে ধপাস্ করে তাতে শুয়ে পড়লাম। কিন্তু চট করে ঘুম এল না। তার কারণ একটাই।
গুঞ্জন!
চোখ বন্ধ করে শব্দ শোনাটা আমার পেশা। এই ডাক্তারি টার্মের ব্যাপারগুলো নতুন হলেও কথা আর গান, এমনকি হোয়াইট নয়েজের মতো আপাত অর্থহীন জিনিসের সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। কিন্তু এইক’টা গান আর সংলাপ শুনতে গিয়ে ঘুম— এ-জিনিস আমার কাছে নতুনই বটে। তাছাড়া ঘুমটাও ঠিক… বাসে বা ট্রেনের ঝাঁকুনিতে আসা আধো ঘুমের মতো ছিল না। মনে হচ্ছিল…
যেন শোনা কথা আর শব্দের গভীরেও আমার সঙ্গে কেউ কথা বলছিল!
চমকে উঠে বসলাম। দারুণ ইচ্ছে হচ্ছিল তখনই গিয়ে আরেকবার সাইট-টাতে ঢুকি। কিন্তু ওই ছোটো ঘরে বাসন্তী ঘুমোয়। ওখানে গিয়ে বসলে ওর ঘুমটা যাবে। কাল মেয়েটাকে সকালে বেরিয়ে দু’বাড়িতে খাটতে হবে। আমি দুপুরে কাজে বেরোনোর আগে ও আবার এই ফ্ল্যাটে আসবে আর রিকু’র দেখাশোনা করবে। তার আগে বাসন্তীকে বিরক্ত করা উচিত হবে না।
অন্ধকার ঘরেই মোবাইল থেকেই সাইট-টা খুঁজে বের করলাম। কিন্তু ঢুকতে গিয়ে অবাক হতে হল। দেখাচ্ছিল, সাইট আন্ডার মেইনটেইন্যান্স!
চুপচাপ শুয়ে মনে করার চেষ্টা করলাম, ঠিক কী শুনেছিলাম আজ ওই চ্যানেলে। ‘পুঁছো না ক্যায়সে ম্যায় ইয়ে’ দিয়ে শুরু হয়েছিল লিস্টটা। তারপর ছিল কিশোরের কণ্ঠে ‘অনেক জমানো ব্যথা-বেদনা’। এমন আরও কিছু এভারগ্রিন ক্লাসিকের পর এসেছিল ‘আনন্দ’-এর সেই সংলাপ~ “হম সব তো রঙ্গমঞ্চ কি কঠপুতলিয়াঁ হ্যায়।” তারপর ছিল…
তারপরের গান আর সংলাপগুলো কিছুতেই মনে করতে পারলাম না। অথচ তারপরেও যে কিছু ছিল, সে-বিষয়ে আমি নিশ্চিত। আকাশ-পাতাল ভাবতে গিয়ে হঠাৎ বুকের ভেতরটা ধক্ করে উঠল।
‘আনন্দ্’-এর ওই সংলাপটা রাজেশ খান্না’র কণ্ঠে আদৌ পরিবেশিত হয়নি। হয়তো কপিরাইটের জন্যই ওটা, প্রায় ওইভাবেই, অন্য কেউ বলেছিল। সেই কণ্ঠের অধিকারীকে আমি চিনতে পেরেছি।
গুঞ্জন— মানে বাস-স্টপের সেই লোকটা!
হ্যাঁ, সেই সুন্দর কণ্ঠে লোকটা কথাগুলো ভারি সুন্দরভাবে, শুদ্ধ উচ্চারণে বলেছিল। আর সেটা শোনার পর থেকেই আমি লিস্টের অন্য গান বা কথাগুলো শুনতে পাইনি। তার বদলে আমি অন্য কিছু শুনেছিলাম, শুনেই চলেছিলাম— এমনকি কম্পিউটার শাট-ডাউন হয়ে যাওয়ার পরেও!
কী শুনছিলাম আমি তখন?
কোনও একটা প্রিয় সংলাপ শুনছিলাম ওই গুঞ্জনের গলায়। তারই মধ্যে ভারি অদ্ভুত কয়েকটা অদ্ভুত শব্দ ছিল। কী যেন… আহ্কাইগফৎ, গ্বাশোই, গথা, ফৎগন… এমনই কিছু ধ্বনি ছিল তাতে। শব্দগুলোর মানে এখন বুঝতে পারছি না। কিন্তু তখন সব বুঝেছিলাম। মনে হচ্ছিল, যেন ঘন কালো এই পৃথিবী অদ্ভুত রঙ আর দৃশ্যে ভরা একটা অন্য জগৎ হয়ে গেছে শব্দগুলোর মধ্য দিয়ে।
আর কী বলেছিল গুঞ্জন?
মনে পড়েছে! বাংলা আর ইংরেজি মিশিয়ে ফিসফিস করার মতো করে সে বলছিল, “এই পৃথিবী বড়ো কষ্টের জায়গা। অথচ একবার জীবনের এই জীর্ণ সুতোটা ছিন্ন হয়ে গেলেই পাওয়া যায় অপার আনন্দ। পাওয়া যায় মুক্তি।”
মুক্তি! আপনা থেকেই আমার চোখ থেকে একফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল। এই একটা ছোট্ট শব্দের মধ্যে যে কোন স্বর্গ লুকিয়ে আছে, তা আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে?
৬
এক সপ্তাহ আগে, আদৃতা
অফিস থেকে বেরোতেই বৃষ্টি নামল আবার।
হাতে ছাতা ছিল, কিন্তু সেটা খুলতে ইচ্ছে করছিল না। মনে হচ্ছিল, অবসাদ আর অপমানে যে মোটামুটি ডুবেই আছে, আকাশ থেকে নেমে আসা ওই জলের দানাগুলো আর তার কী করবে?
আজকেও অফিসে একপ্রস্ত কথা শুনতে হয়েছে প্রণয়ের কাছে। শুধু আমি নই, ফ্লোরের সবাইকেই বিস্তর শাসন ও পরামর্শ হজম করতে হয়েছে কাজ ‘ভালো’ না হওয়ার জন্য। সঙ্গে এসেছে প্রায় বাধ্যতামূলক শাসানি। ছ’মাস নয়, হয়তো এই মাসটাই আমাদের অনেকের কাছে এই সংস্থায় টিকে থাকার মতো শেষ অক্সিজেনটুকু হতে চলেছে।
অন্যরা হয়তো এখান থেকে বেরিয়েও চলে যেতে পারবে অন্য কোথাও— আর কোনোখানে। কিন্তু আমি?
“এই আদি!” দেবলীনার চিৎকার শুনে হুঁশ হল। বাস-স্টপ অবধি নিয়ে যাওয়ার শাটলটা পেরিয়ে আমি রাস্তা ধরে হাঁটা লাগিয়েছিলাম। কিন্তু কোনদিকে যাচ্ছিলাম আমি? ওদিকে তো একটা খাল ছাড়া কিচ্ছু নেই!
কাষ্ঠহাসি মুখে রেখে গাড়িতে বসলাম। অন্যরা নিজেদের মধ্যে বকবক করে চলল। আমি ভাবতে লাগলাম নিজের এই অদ্ভুত বর্তমান আর ধোঁয়াটে ভবিষ্যৎ নিয়ে।
বর্তমান… নাহ্, সেটাও কাচের ওপর ওয়াইপারের আঘাতে ঠিকমতো জমে ওঠার আগেই বারবার মুছে যাচ্ছে। এই কাজটা খুব সম্ভবত এ-মাসের পর আর থাকবে না। তাহলে আমার ভবিষ্যৎই বা কী? আমি কি আবার সর্বত্র সিভি পাঠাব? কিন্তু কল-সেন্টার বা মেডিকেল ট্র্যান্সক্রিপশনের কাজ কি আমি আদৌ করতে পারব এরপরেও? ক’মাসেই এত ক্লান্তি জমে উঠেছে আমার মধ্যে! তাহলে কী করব?
আমাকে কি কিছু করতেই হবে?
কথাটা গত কয়েক রাতে গান আর গুঞ্জনের কথা শুনতে গিয়ে বারবার মনে হয়েছে। কী যেন বলেছিল সে? এখন কথাগুলো আমার মনে থাকে। সেগুলো ঘুরপাক খায় সচেতন শব্দ আর বাক্যদের মধ্যে। প্রেসক্রিপশন আর পরামর্শের গম্ভীর ক্লাসের মধ্যে অবাধ্য শিশুর ছোড়া কাগজি প্লেনের মতো সেগুলো উড়ে বেড়ায়। তাদের অনুসরণ করে আমি হারিয়ে যেতে থাকি অদেখা রঙ আর বিচিত্র জ্যামিতির এক আশ্চর্য দুনিয়ায়।
আপনা থেকেই অস্ফুটে বলে উঠলাম, “গহ্খ্যোই য়হখ্যই ফ্হখু।”
“কী বিড়বিড় করছিস?” রিও জিজ্ঞেস করল, “দুঃখই সখ্য… এইরকম কিছু বলছিস নাকি?”
“সব্বম দুঃখময়হ্ বলছিস নাকি?” চান্দ্রেয়ী হাসল। এই মেয়েটার পড়াশোনা আছে। অবসরে নিজের মোবাইলে ফেসবুক না করে একে আর্টিকল পড়তে দেখেছি বহুবার।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিটে হেলান দিয়ে চোখ বুজলাম। আবার মনে পড়ল গুঞ্জনের কথাগুলো।
গান, গল্প, সুর, বিচিত্র ছন্দে ঘণ্টাধ্বনি আর ঢেউয়ের মতো সুরে কাদের যেন কণ্ঠের উত্থান-পতন— এমন নানা জিনিস দিয়ে আমার ওই সময়টুকু ভরিয়ে রাখে লোকটা। আজকাল আর সিনেমার বা অন্য গান শুনতে ইচ্ছেই করে না। বরং যেকোনো একটা প্লে-লিস্ট বেছে নিয়ে অপেক্ষায় থাকি, কখন আসবে সে আর তার ওই কথামালা। সেগুলো যেন শুধু আমার জন্যই বলা; আর কারও নয় সেইসব কথা। তাই কাউকে বলতে পারি না এই নিয়ে। শুধু ভেসে যাই ওই রঙ আর কোণে, ঘন ছায়া আর বিচিত্র আকাশে।
ওইরকম অদ্ভুত কোনও জায়গা কি কোথাও আছে আদৌ? নেটে সার্চ করলে হয়তো… কিন্তু কী দিয়ে সার্চ করব? নন-ইউক্লিডীয় জ্যামিতির শহর? বেনীআসহকলা-র বাইরের রং যা চোখে দেখা যায়?
গতরাতে কী যেন বলছিল গুঞ্জন?
না; ভাষাটা বাংলা, হিন্দি, বা ইংরেজি ছিল না। তবু কথাগুলো আমি বুঝতে পেরেছিলাম। গুঞ্জন বলছিল, চারপাশের কেউ আমাদের কদর না করলেও একজন আমাদের গুরুত্ব বোঝেন। তিনি খুব জ্ঞানী। অর্কাদিশতু তেগথ চ বহথু ফহাই! তাঁর ডাকে সাড়া দিলেই মুক্তি পাব। মুক্তি!
কথাগুলো শুনতে গিয়ে মনে হচ্ছিল, যেন আমার আশপাশের এই দুনিয়াটা কোথায় মিলিয়ে গেছে। অন্ধকার আর তাল-তাল অবর্ণনীয় রঙের ঢেউয়ে চাপা পড়ে গেছে সবকিছু। মনে হচ্ছিল, যেন মুক্তি পেয়েছি আমি।
আচ্ছা, এই যে গুঞ্জনের কণ্ঠের জন্য আমার অপেক্ষা, এ-ও কি একধরনের নেশা? নাকি আমার আসল টানটা ওর গলায় উচ্চারিত ওই শব্দগুলো আর ব্যাকগ্রাউন্ডের ওই অদ্ভুত ধ্বনিপ্রবাহের জন্য? এখনও যে চেনা আওয়াজ আর আবহ থেকে আমি পালিয়ে যেতে চাইছি ওই শব্দতরঙ্গের মধ্যে— এটা কি সেই নেশার উইথড্রয়াল সিম্পটম?
কেমন হবে, যদি আমি শুধুই ওটার মধ্যে হারিয়ে যেতে পারি— চিরতরে?
“নে, নাম্ এবার!” দেবলীনার কথা শুনে খেয়াল হল, বাস-স্টপ এসে গেছে। গাড়ি থেকে নেমে একদৌড়ে শেডের নীচে আশ্রয় নিলাম। তারপর বাকিরা যে যার মতো টোটো বা বাসের জন্য দাঁড়াল। আমিও দাঁড়ালাম কদমতলার বাসের জন্য।
এই বাসটাও যাচ্ছেতাই। পনেরো মিনিটে একটা আসার কথা; এক ঘণ্টায় একটা পেলেও জীবন ধন্য হয়। ভিড় থাকে মারাত্মক। বসার সিট পেতে-পেতে নতুন বাজার। তারপর ঝাঁকুনি খেতে-খেতে গন্তব্যে পৌঁছনো। এর বদলে আমার অতীতের জীবনটা কত অন্যরকম ছিল! কত গতি, কত রোমাঞ্চ, কত বিপদ ছিল তাতে! সেই তুলনায় আমার বর্তমান দিনযাপন অনেক নিশ্চিন্ত আর নিরুপদ্রব। কিন্তু আমি কি এমন কিছুই চেয়েছিলাম?
আপনা থেকেই হাতের মুঠো দুটো শক্ত হয়ে উঠল। ওই পথে আর হাঁটব না বলেই তো এত কিছু সহ্য করা। জীর্ণ বসনের মতো নিজের সবকিছু ত্যাগ করে, ছেলের হাত ধরে এই বদলে যাওয়া পিতৃভূমিতে ফিরে আসা— সব তো স্রেফ ওই পথ থেকে দূরে থাকার জন্যই। কিন্তু…
যত দিন যাচ্ছে, মনে হচ্ছে, এইভাবে বেঁচে থেকে কোনও লাভ নেই। রোজ এইভাবে অন্যের মুখঝামটা বা অনুনাসিক কণ্ঠ শুনে কটা টাকা রোজগার, বাড়ি ফিরে এক ক্লান্তিকর রুটিনের মধ্যে ঢোকা, তারপর ঘুমের জন্য অপেক্ষা— যাতে পরদিন আবার এই রুটিনই মানা যায়। এভাবে আর কতদিন?
একটার পর একটা বাস আর টোটো চলে যাচ্ছিল। জল আর কাদা ছিটকিয়ে ফাঁকা হয়ে যাচ্ছিল শেড। হঠাৎ মনে হল, গুঞ্জনের সঙ্গে কি আবার দেখা হবে এই বাস-স্টপে?
দেখা হলে কী বলব আমি? আমি কি…
“কদমতলা!” শেড থেকে একটু দূরে দাঁড়াল বাসটা। অন্ধের মতো সেটার দিকে দৌড়োতে গিয়ে সদ্য স্টার্ট নেওয়া একটা অটো-র সামনেই পড়ছিলাম আর একটু হলে। অটোচালক আর যাত্রীদের গালাগাল শুনে বাসে ওঠার পর হঠাৎ মনে হল, আমার কিছু হলে রিকুর কী হবে?
এই একটা সুতোর জন্যই তো বেঁচে থাকার এই অন্তহীন দৌড়ে আটকে আছি আমি। নইলে মুক্তির সন্ধানে তো অন্য কিছু করাই যেত। আচ্ছা, আমি কি রিকুকেও গুঞ্জনের কথা শোনাব? হয়তো… হয়তো ও-ও একটা পথের সন্ধান পাবে ওই কথাগুলোতে। হয়তো শান্তি পাবে ছেলেটা। শোনাব?
কথাটা ভাবতেই বুকের ভেতরটা এমন ছ্যাঁৎ করে উঠল কেন, কে জানে। মায়েদের নাকি অনেক কিছু বোঝার ক্ষমতা থাকে। আমি কি খারাপ কিছু ভাবছি? কিন্তু গুঞ্জনের কথায় খারাপ কী আছে?
খারাপ তো এই দুনিয়াটা— যে তার নোংরা আঙুলগুলো দিয়ে আমাদের আঁকড়ে ধরে রাখতে চায় বর্তমানে। তার হাত থেকে মুক্তি পেতে চাইলে ক্ষতি কী?
৭
তিন দিন আগে, আদৃতা
মাথাটা ভার হয়ে ছিল। রিকুর বকবকানি, বাসন্তীর ইনিয়ে-বিনিয়ে বলা নানা কথা— সব অসহ্য লাগছিল। মাথার মধ্যে শুরু ঘুরছিল একটাই প্রশ্ন~ জীবনের ওই জীর্ণ সুতোটা ছিন্ন করে দেওয়ার মতো হাতের জোর আর উপকরণ কি আমার কাছে আছে?
অবশ্যই আছে। আর তাকে ব্যবহার করার মতো মনের জোর আমি এই সপ্তাহতিনেকে পেয়ে গেছি। আমার এই ব্যাংক-অ্যাকাউন্টে যা আছে, তা সামান্য। কিন্তু পুরনো অ্যাকাউন্টে যা আছে তা দিয়ে রিকুর একটা ব্যবস্থা আমি করে যেতে পারবই। এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করে সে-সব সেরে ফেলি। তারপর, এই অর্থহীন, গ্লানিময় জীবনকে টেনে চলার আর কোনও কারণ…
“কলকাতায় কি নতুন কোনও সিরিয়াল কিলারের আবির্ভাব ঘটেছে?”
নিউজ চ্যানেলে এই বাচ্চা-বাচ্চা মেয়েগুলোর চিৎকার আমার একেবারে অসহ্য লাগে। অবশ্য ‘দ্য নেশন ওয়ান্টস টু নো’ টাইপের রাসভগর্জনের তুলনায় ওগুলো মন্দের ভালো। তাছাড়া সাদা টেক্সট বক্সে লাল আর কালোর যথেচ্ছ প্রয়োগে লেখা প্রশ্নটা দেখে মাথার মধ্যে চলা একঘেয়ে ভাবনাগুলো কিছুক্ষণের জন্য একপাশে সরে গেল। ভলিউম অল্প বাড়িয়ে শুনতে চেষ্টা করলাম কথাগুলো।
“পুলিশ কর্তৃপক্ষ এই নিয়ে কিছু বলতে অস্বীকার করেছেন। বরং একরকম হুমকি দিয়েই আমাদের ‘গুজব ছড়াতে’ বারণ করা হয়েছে।” মেয়েটি এই ভ্যাপসা গরমেও কোট আর গলার ব্যাজ সামলাতে-সামলাতে চেঁচাচ্ছিল। এরা এগুলো পরে থাকে কী করে?
“স্টুডিও থেকে আমরা কয়েকজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। অধিকাংশই তথ্যের ঘাটতি বা তদন্ত চলছে— এইসব কারণ দেখিয়ে কিছু বলতে অস্বীকার করেছেন। এবার, এগুলো যদি আত্মহত্যাই হয়, তাহলে নতুন করে কী ধরনের তদন্ত চালানো হচ্ছে তাই নিয়ে? এই প্রশ্নের উত্তর তাঁরা দেননি। তবে প্রখ্যাত ক্রিমিনাল ল-ইয়ার বরেন্দ্র সান্যাল আমাদের কয়েকটি প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। সেই অংশটি তুলে ধরছি আপনাদের সামনে।”
বরেন্দ্র সান্যাল! আপনা থেকেই আমার রক্তচলাচল দ্রুততর হয়ে উঠল। বহুদিন আগে, পুরনো পেশার একটা কাজে এই মানুষটিকে কাছ থেকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। কেমন আছেন ভদ্রলোক এখন?
লাল ইঁটের মস্ত বড়ো বাড়িটার পটভূমিতে সান্যাল ক্যামেরার মুখোমুখি হলেন। তাঁর পাক-ধরা কাঁচাপাকা চুলগুলো অবশেষে কপাল থেকে পিছু হটতে শুরু করেছিল। কিন্তু মানুষটির চোখের দীপ্তি এখনও আগের মতোই ধারালো ছিল। টিভির মধ্য দিয়ে চোখজোড়ার দিকে একবার তাকিয়ে আমার মেরুদণ্ড দিয়ে মুহূর্তের জন্য একটা ঠাণ্ডা স্রোত নেমে গেল। পরক্ষণেই মনে হল, মেডিকেল ট্র্যান্সক্রিপশনের কাজ করা এক মধ্যবয়সি সিংগল মাদার এখন সান্যালের জগত থেকে আলোকবর্ষ দূরে চলে গেছে। বেকার এ-সব ভাবছি কেন?
স্ক্রিনে সান্যাল থেমে-থেমে, স্পষ্ট ভঙ্গিতে, শব্দগুলোতে একটু অতিরিক্ত জোর দিয়ে কথা বলছিলেন।
“আপাতদৃষ্টিতে যাকে আত্মহত্যা বলে মনে হয়, সেটাই পরে হত্যা বলে মনে হতে পারে নানা কারণে। তার ফিরিস্তি আমি দেব না, কারণ সেগুলো তদন্ত প্রক্রিয়ার অঙ্গ। তবে একটা কথা হয়তো আপনারাও জানেন। ভারতে সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে মহারাষ্ট্র ও তামিলনাড়ুতে। পশ্চিমবঙ্গ বা কলকাতায় আত্মহত্যার ঘটনা জনসংখ্যার অনুপাতে অত্যন্ত কম। অথচ গত দু’মাসে এই শহরে মোট আটটি আত্মহত্যার ঘটনা পুলিশের নজরে এসেছে— যা অত্যন্ত অস্বাভাবিক। এর জন্য সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক নানা কারণকে দায়ী করা চলে। আবার…”
“আবার?”
“আবার এ-ও মনে করা চলে কেউ এই মানুষগুলোকে কোনোভাবে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করেছিল। সেটা একরকম খুনেরই শামিল।”
আমার মাথার মধ্যে হঠাৎ একটা খুব চেনা, খুব ভয়ের অ্যালার্ম বাজতে শুরু করল। আটটা আত্মহত্যা ঘটে গেছে এই শহরে ইতিমধ্যেই! আমি তো খেয়ালও করিনি। আর তাতে প্ররোচনা…
মেয়েটি বলে চলেছিল, “কিন্তু খুনগুলোকে আত্মহত্যা বলে চালানো হচ্ছে না— এ-ব্যাপারে আপনি কীভাবে নিশ্চিত হচ্ছেন?”
সান্যালের মুখে ঈষৎ ব্যঙ্গের ভাব দেখা দিল, “নিশ্চিত হচ্ছি আপনাদের, মানে মিডিয়ারই সৌজন্যে। আপনাদের প্রচারের ফলে সি.এম নিজে এই বিষয়ে পুলিশকে অনুসন্ধান চালানোর জন্য আদেশ দিয়েছিলেন। তাতে যা জানা গেছে তার সবটাই আপনাদের কাছে তুলে ধরা হয়েছে নানা সময়ে। প্রতিটি মৃত্যুর সময় যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বন্ধ ঘরে একাই ছিলেন, তা প্রমাণিত হয়েছে। যাঁরা আত্মহত্যা করেছেন, তাঁদের ফোন থেকে শুরু করে ব্যক্তিগত জীবন— সব ঘেঁটেও পুলিশ কোনও কমন লিংক পায়নি। সবচেয়ে বড়ো কথা, এঁরা প্রত্যেকেই যে শারীরিক ও মানসিকভাবে একেবারে বিপর্যস্ত ছিলেন, কয়েকজন যে সুইসাইডাল ডিপ্রেশনে ভুগছিলেন— এ-সবই দেখা গেছে।”
“কিন্তু সবার কানে…”
“এক মিনিট!” ঈষৎ কড়া গলায় একটা আঙুল তুলে সান্যাল সবাইকে চুপ করিয়ে দিলেন, “হ্যাঁ, এ-কথা ঠিক যে মৃত্যুর মুহূর্তেও প্রত্যেকেরই কানে ছিল হেডফোন। কিন্তু পুলিশ কোনও মোবাইলেই এমন কিছু পায়নি যার সঙ্গে এই মৃত্যুগুলোর কোনও যোগসূত্র থাকে। তবু, সাবধানতার খাতিরে সবাইকে আবার অনুরোধ করব, বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য সূত্র ছাড়া অন্য কোনও সূত্র থেকে কোনও অ্যাপ ডাউনলোড করবেন না। যেকোনো লিংক এলেই খুলবেন না। পেজ বা সাইটের সিকিউরিটি সার্টিফিকেট না দেখে তার কনটেন্টে ক্লিক করবেন না, প্লিজ!”
একটা বড়ো শ্বাস নিয়ে সান্যাল আবার বললেন, “এই দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুগুলোকে দয়া করে সিরিয়াল কিলিং ইত্যাদি বলে সবার মনে অনর্থক আতঙ্ক করবেন না। বরং শোকসন্তপ্ত পরিবারের পাশে থাকুন। তাঁরা যাতে এই আঘাত কাটিয়ে উঠতে পারে, সেজন্য তাঁদের সাহায্য করুন।”
চ্যানেলের মেয়েটি এর উত্তরে কী বলবে বুঝতে পারছিল না। তখনই এক পথচারী হঠাৎ বলে উঠলেন, “আচ্ছা স্যার, এটা যদি ক্রাইম না-ই হয়, তাহলে আপনি এই কেসে আপনি যুক্ত হলেন কীভাবে?”
সবকটা ক্যামেরা আর মাইক বক্তার দিকে ঘুরে গেল। আশেপাশের সাদা পোশাকের পুলিশ আর সার্জেন্টরাও উঁকিঝুঁকি দিলেন তাকে দেখার জন্য। হঠাৎ করে এভাবে ‘লাইম-লাইটে’ আসার কথা বোধহয় মধ্যবয়স্ক, টাকমাথা, হাওয়াই শার্ট আর ট্রাউজার্স ও চটিতে মার্কামারা কেরানি-গোছের ভদ্রলোক ভাবতে পারেননি। অতজনের দৃষ্টির কেন্দ্রে এসে তিনি একটু হকচকিয়েই গেলেন।
ক্যামেরাগুলো আবার বোঁ করে সান্যালের দিকে ঘুরে গেল। কটমটিয়ে পথচারীর দিকে তাকিয়ে সান্যাল নিজেকে সামলে নিলেন। তারপর অপেক্ষাকৃত, নরম কণ্ঠে তিনি বললেন, “একটি মৃত্যুর ক্ষেত্রে… আমি নাম বলছি না… আত্মহত্যার পদ্ধতি দেখে পুলিশ মনে করেছিল, সেটা হত্যা। মৃতের পাশের ঘরে থাকা তাঁর ভাইকে গ্রেফতার করা হয়েছিল সেই সন্দেহের বশে। অভিযুক্ত আমাকে নিয়োগ করেন। পরবর্তী অনুসন্ধানে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছিল যে ওটা আত্মহত্যাই ছিল। তবে তার পরেও স্পেশাল ব্রাঞ্চ তাদের তদন্ত প্রক্রিয়াতে আমার কাছ থেকে মতামত চেয়েছিল। আমি যথাসাধ্য সাহায্যও করেছিলাম।”
“ঠিক কেন পুলিশ ওই আত্মহত্যাকে হত্যা বলে মনে করেছিল?”
“মৃত ব্যক্তি একটি ছুরি দিয়ে নিজের হাতের শিরা কেটেছিলেন।” নিচু গলায় বললেন সান্যাল, “ফল কাটার ছুরি দিয়ে আত্মহত্যা করতে গেলেও যেকোনো লোক আগে এক-আধবার চামড়ায় অপেক্ষাকৃত কম চাপ দিয়ে দেখবে, প্রাথমিক যন্ত্রণার ধাক্কাটা সে সহ্য করতে পারছে কি না। তারপরেও ছুরিটা প্রথমে অপেক্ষাকৃত কম গভীরতায় ঢুকবে। আস্তে-আস্তে তার গভীরতা বাড়বে। তারপর একটা প্রায় অন্ধের মতো করে টানা আঘাতে শিরাটা কেটে যাবে। কিন্তু পোস্ট-মর্টেমে দেখা যায় যে ওই ক্ষেত্রে ছুরিটা প্রথম থেকেই গভীরভাবে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তারপর একইরকম জোর দিয়ে টেনে আনা হয়েছিল কবজির প্রান্ত অবধি। এটা দেখে সন্দেহ হওয়াই উচিত।”
বুকের ভেতরটা হঠাৎ ফাঁকা হয়ে গেল। চোখের সামনেটা ঝাপসা হয়ে এল। তার মধ্যেও শুনলাম, টিভি-তে মেয়েটি জানতে চাইছে, “তারপর?”
“হাতের ছাপ থেকে শুরু করে আশ-পাশ— সবকিছু দেখেই বোঝা গেছিল, মৃত ব্যক্তি ওই মুহূর্তে সম্পূর্ণ একাই ছিলেন। এটা অন্য সাতটি ক্ষেত্রেও দেখা গেছে। তাই…”
আবার বড়ো একটা শ্বাস নিয়ে সোজা ক্যামেরার দিকে তাকালেন সান্যাল, “এগুলোর প্রতিটিই পরিষ্কার আত্মহত্যা। তাই দয়া করে সিরিয়াল কিলিং ইত্যাদির কথা বলে সবাইকে প্যানিকড করে দেবেন না। বরং মানসিক স্বাস্থ্যের সঙ্গে জড়িত হেল্পলাইন নম্বরগুলো প্রচার করুন। বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলুন। সবাইকে বোঝান, জীবন অমূল্য!”
টিভিটা অফ করে দিলাম আমি। উঠে রিকুর ঘরে গেলাম। এই সময় আমি অফিসে বেরোনোর জন্য তাড়ায় থাকি, তাই হঠাৎ আমাকে দেখে রিকু কিছুটা অবাক, আর অনেকটা খুশি হল। কখন যে আমার ছেলেটাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করেছি, নিজের খেয়ালও ছিল না।
“দিদি, তুমি অফিসে যাবে না?” কুণ্ঠিত গলায় বাসন্তী আমাকে ডাকতে হুঁশ হল। রিকুকে আরও কয়েকটা চুমু খেয়ে, খেলনা আর খাতা-পেন্সিল হাতের কাছে গুছিয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। চোখের জল শুকিয়ে গেছিল ততক্ষণে। তার বদলে বুকের গভীরে একটা আগুন জ্বলতে শুরু করেছিল।
মোবাইল টেনে দেবলীনাকে মেসেজ পাঠালাম একটা।
আমি এখন বেরোব, তবে অন্য একটা অফিসের উদ্দেশে— যার সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমার অতীত। জীর্ণ বসনের মতো তাকে ত্যাগ করতে চেয়েছিলাম এতদিন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, মুক্তি ঠিক ওইভাবে পাওয়া যায় না। বরং কর্তব্য-পালনের মধ্য দিয়েই মুক্তি আসে।
এক সন্তানের কাছ থেকে তার মা-কে মুক্তির লোভ দেখিয়ে যে কেড়ে নিতে চায়, তাকে শাস্তি দেওয়াটা কর্তব্যই বটে।
৮
তিন দিন আগে— শেষ সকাল, ক্লাব
“আমাদের এক পুরনো এজেন্ট একটু আগে রিপোর্ট করেছে, স্যার।”
পিউয়ের কথা শুনে সামনে রাখা কাগজগুলো থেকে চোখ তুললেন বৃদ্ধ। তাঁর নির্বাক মুখের দিকে তাকিয়ে পিউ আবার ঢোঁক গিলল, “সে আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়।”
“ক্লাব থার্টিন খোলা মাঠ নয় যে সেখান থেকে ইচ্ছেমতো ঢোকা আর বেরোনো যায়। মেয়েটি যদি পুরনো পেশায় ফিরতে চায়, তার ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করে রিহ্যাবে পাঠাও।”
ঠাণ্ডা গলায় কথাগুলো বলে বৃদ্ধ আবার কাগজে মগ্ন হলেন। পিউ তা সত্ত্বেও দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকালেন মানুষটি।
“ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করাই আছে, স্যার। এজেন্টের প্রতিটি মুভমেন্টই ট্র্যাকড হয়েছে— যেমন হয়। শি ইজ ক্লিন। তাছাড়া…”
পিউকে ইতস্তত করতে দেখে বৃদ্ধের কুঁচকে থাকা ভ্রুজোড়া আবার সোজা হয়ে গেল। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, “আই.সি।”
“ইয়েস, স্যার।” পিউ মাথা নিচু করল, “শি ওয়াজ মাই মেন্টর। আপনি বুঝতে পারছেন… আমি কার কথা বলছি?”
“অ্যাডার!” মাথা নাড়লেন ‘স্যার।’ হ্যাঁ, ক্লাব থার্টিনের সবচেয়ে দক্ষ অ্যাসাসিনদের একজন হিসেবে ওই নামটাই মেয়েটির পক্ষে উপযুক্ত মনে হয়েছিল বরাবর। কিন্তু সে তো বছরখানেক আগে একটা মিসহ্যাপের পর স্বেচ্ছায় এই জীবন ত্যাগ করেছিল। স্পেশাল চাইল্ডের মা হিসেবে নানা দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিজের এই পেশাটির প্রতি সম্পূর্ণভাবে দায়বদ্ধ হতে পারছে না সে— এই কথা বলেই সংগঠন ছেড়ে যেতে চেয়েছিল সে। সব দিক বিচার করে তাকে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। অবশ্য যে ঘটনাটার পর সে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তার গুরুত্ব অস্বীকার করা কারও পক্ষেই সম্ভব ছিল না।
একাধিক মহিলাকে হনি ট্র্যাপের মাধ্যমে ফাঁদে ফেলে কর্পোরেট এস্পিওনাজ চালাচ্ছিল এক পুরুষ। সেই মহিলাদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করলেও ক্ষতিগ্রস্ত কোম্পানির মহিলা সি.ই.ও প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিলেন। ‘মেয়েদের জন্যই মেয়েরা আছে’ ট্যাগলাইন মেনে চলা এই ‘ক্লাব’-এর উপরেই সেই পুরুষটিকে সরিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব ন্যস্ত হয়েছিল। কাজটা অ্যাডার মসৃণভাবেই করেছিল। ব্যাপারটাকে দুর্ঘটনা ছাড়া কিছু ভাবার উপায়ই ছিল না।
শুধু ক্লাব থার্টিন আর অ্যাডারেরই জানা ছিল একটি তথ্য— টার্গেট তথা নিহত পুরুষটি ছিল অ্যাডারের স্বামী!
ঘটনাগুলো বৃদ্ধের মনে খুব দ্রুত চালিয়ে দেওয়া ক্যামেরা রোলের মতো পরপর খেলা করে গেল। একটু পরেই পিউ নিয়ে এল এজেন্টটিকে। কোনও কথা না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল সে। পিউ একটুক্ষণ ইতস্তত করে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
বৃদ্ধ তার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক নরম গলায় বললেন, “বোসো, আদৃতা।”
চুপচাপ বসে পড়ল আদৃতা। এই ঘর, এই কাঠের টেবিল, এই টিউব, মৃদু শব্দ তোলা এ.সি, উল্টোদিকের চেয়ারে বসা ওই একমাথা সাদা চুলের বৃদ্ধ— সবই তার বড়ো পরিচিত। শুধু নিজেকেই তার বড়ো অচেনা লাগছিল।
“মেডিকেল ট্র্যান্সক্রিপশন ভালো লাগছে না? তাহলে অন্য কিছু করো। কিন্তু এই পেশায় ফিরতে চাইছ কেন?”
মাথা নিচু করে বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল আদৃতা। সে মুখ তুললে বৃদ্ধ একটু অবাকই হলেন। তাঁর ‘অ্যাডার’-এর চোখে জল নয়, বরং আগুন জ্বলজ্বল করছিল।
“আমি একটা খুনিকে শায়েস্তা করতে চাই, স্যার।” খুব নিচু, খুব বিপজ্জনক গলায় বলল সে, “সেই কাজটা আমার এখনকার পেশায় সম্ভব নয়। আমি জানি যে এখানে একবার ফিরে এলে আর কোনোমতেই বেরোনো যায় না। সেই শর্তে আমি রাজি আছি। আমি জানি যে সাধারণত ব্যক্তিগত কাজের জন্য এই পেশাকে ব্যবহার করা যায় না। যদি বলেন, তাহলে আমি প্রফেশনালি ক্লাব-কে এনগেজ করতে চাইব— যাতে অন্য কেউ কাজটা করে।”
আদৃতার দিকে তাকিয়ে ‘স্যার’ বুঝতে পারলেন, প্রকাশ না পেলেও তার গভীরে ঝড় চলছে। এই সংস্থার হয়ে করা তার শেষ কাজটা যে ‘ব্যক্তিগত’-ই হয়ে গেছিল, সেটা সে আমৃত্যু ভুলতে পারবে না।
“খুনিটিকে কি আমরা চিনি?”
টেবিলের একপাশে রাখা খবরের কাগজটা টেনে নিয়ে প্রথম পাতায় বড়ো-বড়ো করে ছাপা খবরটা দেখিয়ে দিল আদৃতা। ‘স্যার’ একটু-একটু করে সোজা হয়ে বসলেন। নিচু গলায় তিনি বললেন, “কনট্যাক্ট?”
“আমি নিজে।”
“কবে থেকে?”
“তিন সপ্তাহ।”
“টার্গেট?”
কথা না বলে শুধু মাথা ওপর-নীচ করল আদৃতা।
‘স্যার’ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন তার দিকে। মেয়েটির মনের জোর, না মাতৃত্বের টান— কোনটা তাকে তিন সপ্তাহ ধরে এই প্রাণঘাতী জিনিসটি সহ্য করার ক্ষমতা জুগিয়েছে, তা তিনি জানেন না। তবে অ্যাসেট চিনতে, বা নতুন করে চিনতে তাঁর কোনোদিনই ভুল হয় না।
বাঁ হাত বাড়িয়ে ইন্টারকমের বোতামটা টিপে ‘স্যার’ বললেন, “হুইস্পার্স টিমের সবাইকে কনট্যাক্ট করো। বলো, উই হ্যাভ আ লিড।”
আদৃতার চোখে চোখ রেখে তিনি বললেন, “তোমার স্মৃতিশক্তি যথেষ্ট ভালো। একটা ডি-ব্রিফিং সেশন হবে এবার। যা-যা মনে আছে, সব বোলো। কোথায় দেখা হয়েছিল, কী বলেছিল, ইউজার এক্সপেরিয়েন্স… সব।”
একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “বুঝতেই পারছ, তোমাকে আমাদের এনগেজ করতে হবে না। কাজটা আমরা ইতিমধ্যেই শুরু করেছি। এবার তুমিও টিমে এলে।”
“রাইট।” ঢোঁক গিলল আদৃতা। তার মনের মধ্যে যে একটা যুদ্ধ চলছিল, সেটা বোঝাই যাচ্ছিল। একটা বড়ো শ্বাস নিয়ে সে বলল, “আমার মোবাইলের হিস্ট্রিতে আই.পি অ্যাড্রেসটা আছে। খুব সাবধানে ওটাকে স্টাডি করবেন। রাতে শুতে যাওয়ার আগে ছাড়া ওটা প্রায় সবসময়ই ‘সাইট আন্ডার মেইনটেন্যান্স’ দেখিয়ে বন্ধ থাকে।”
“অ্যাপ নয় তাহলে!”
“হুঁ, এমনকি মোবাইল ভার্শনও নয়। বরং একেবারে ডেস্কটপ ভার্শনে দেখার মতো সাইটটা। তবে শুনতে গেলে…”
“দাঁড়াও-দাঁড়াও! আমাকে আর কিছু বোলো না। টিমকেই বোলো সব। পরভিন টিম লিড করবে। আই হোপ ইউ আর ওকে উইথ দ্যাট?”
“অ্যাবসলুটলি, স্যার।” একটা বড়ো শ্বাস ফেলল আদৃতা, “রিকুর সঙ্গে একটু কথা বলে নেব শুধু। আর অফিসে— মানে যেখানে চাকরি করি— রেজিগনেশন লেটারটা পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে।”
৯
দুদিন আগে— রাত, ক্লাব
“ফ্তোই ন্তাগা নাখাই ররথনা। আখো শোগ।”
“এর মানে? কোন ভাষা এটা?”
“এটা আমাদের চেনাজানা ভাষা নয়।” পিউয়ের কথার উত্তরে গম্ভীর গলায় বলল পরভিন, “সত্যি বলতে কি, বাংলা বা ইংরেজি-বলা মুখে এই ভাষা উচ্চারণ করা তো দূরের কথা, লেখাও সম্ভব নয়। তবে এরও এক্সপার্ট আছে। তাদেরই একজন এর মোটামুটি অর্থ বুঝেছেন। এই কথাগুলোর মাধ্যমে কেউ বলছে, সে এখন স্বপ্ন দেখছে। উৎসর্গের আগে তাকে যেন জাগানো না হয়।”
“কী এমন মধুর স্বপন দেখছে সে যে তাকে ঘুম থেকে জাগানো যাবে না?” লিজা ঠাণ্ডা গলায় জানতে চাইল, “আর উৎসর্গ মানে কি সেটাই, যার কথা আমরা ভাবছি?”
“কথাটা কোথায় পাওয়া গেল?” আদৃতা জিজ্ঞেস করল। এই একদিনেই তার মুখে ফিরে এসেছিল পুরনো আত্মবিশ্বাস। চলনে এসেছিল ক্ষিপ্রতা। চোখের পেছনে ধিকিধিকি জ্বলছিল সেই কালো আগুন— যা ক্লাব থার্টিন-এর প্রতিটি এজেন্টকে ধারালো রাখে।
“টার্গেট-এর বাসস্থান থেকে।” হাসল বৃন্দা, “লোকটার ঘরে বিশেষ কিছুই পাওয়া যায়নি। তবে ডাস্টবিনে ছেঁড়া অবস্থায় এ-ফোর সাইজের কিছু কাগজ পাওয়া গেছে। তাতে অদ্ভুতদর্শন একগাদা আঁকিবুঁকি ছিল। প্রচুর কথা লিখেও কেটে দেওয়া হয়েছিল। এই কথাটা কিন্তু খুব স্পষ্টভাবে লেখা ছিল— অ্যাজ ইফ, সামওয়ান ওয়াজ গিভিং অ্যান অর্ডার।”
“বাড়িটা খুঁজে পেলে কীভাবে?”
“তোমার থেকে পাওয়া ইনপুটের ভিত্তিতে অন্য সবকজন ভিক্টিমের ব্যাকগ্রাউন্ডে একটা খুব সুনির্দিষ্ট খোঁজ নিই আমরা।” পরভিন বলছিল, “পুলিশি অনুসন্ধানে এটা ধরা পড়েনি; কারণ তারা এমন কিছুর কথা ভাবতেই পারেনি। কিন্তু আমরা খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি, এই আটজনই কখনও না কখনও ওই বাস-স্টপটার কাছে গেছিল। তার কারণ সম্পূর্ণ আলাদা ছিল। কেউ গেছিল ইন্টারভিউ দিতে। কেউ রাজারহাট থেকে কাজ সেরে ফিরবার পথে বাস বদলাচ্ছিল। কেউ ওখান থেকে একটু দূরে একটা স্কুলে পরীক্ষার সিট পড়েছে বলে জায়গাটা দেখে আসতে গেছিল। কারও আবার বন্ধুর বাড়ি ওদিকেই বলে সে দেখা করতে গেছিল। এগুলো সবই ঘটেছে গত মাসদুয়েকের মধ্যে। সবার বাড়িতে ভালোভাবে খোঁজও নেওয়া হয়েছে। আমাদের রিসোর্স পুলিশের তুলনায় একটু… অন্যরকম বলেই পাঁচটা ক্ষেত্রে ওই চকচকে ফ্লায়ার উদ্ধার হয়েছে— যা তুমিও পেয়েছিলে। আমরা মোটামুটি কনফার্ম হয়ে যাই যে ওই স্টপটাকেই ব্যবহার করা হচ্ছে টার্গেটদের নাগাল পাওয়ার জন্য। তারপর তো নেটওয়ার্ক আর ফলো-আপ। ডেটামাইন্স-এর সেই কর্মচারীর ফটো দেখিয়ে খুঁজতে-খুঁজতে ওই বাড়ির একটা ঘর অবধি তাকে ট্র্যাক করি।”
“লোকটা?”
“মিসিং।” পরভিনের মুখে একটা হালকা হাসি ফুটে উঠল, “গল্পের ভিলেইনদের মতো এ-ও হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। বাড়িওয়ালা আগেই তিন মাসের ভাড়া নিয়ে রেখেছিল। লোকটার প্রতিবেশীরাও ‘হ্যাঁ-হ্যাঁ। দেখেছি কয়েকবার। চুপচাপ থাকতেন।’ ছাড়া কিছু বলতে পারছে না। তাই ওই বাড়ি থেকে কোনও ট্রেইল পাচ্ছি না।”
“ঘরে ওই সাইট চালানোর জন্য হার্ডওয়্যার বা সফটওয়্যার জাতীয় কিছু পাওয়া গেছে?”
“নাহ্। ওটা মাস্কিং করে আর ডিপ ওয়েব কাজে লাগিয়ে হোস্ট করা হয়েছিল। তার জন্য যা দরকার, তা ওই ঘরে হয়তো কখনোই ছিল না।”
“সাইট-টা গতরাতে অ্যাডারের মোবাইল থেকেই খোলার চেষ্টা করেছি আমরা।” লিজা মাথা নাড়ল, “এখন তাতে জেনেরিক জিনিস ছাড়া আর কিচ্ছু নেই। বাকি সব যেন… পার্জ করে দেওয়া হয়েছে।”
“তাহলে কি ওরা কাজটা থামিয়ে দিল?”
“উঁহু।” এতক্ষণ চুপ করে থাকার পর বলে উঠল মিরা— যে এই দলে অ্যানালিস্ট হিসেবে কাজ করছে। গাঢ় গলায় সে বলল, “কাজটা আসলে হয়ে গেছে।”
“কী-রকম?”
“দুটো আলাদা প্রোজেক্ট কনভার্জ করেছিল এই… গুঞ্জন বানানোয়। এক দিকে ছিল একটি বিদেশি এন্টিটি— যারা ডেটামাইন্স-কে দিয়ে ‘হুইস্পার্স’ নামের অ্যাপটা বানাতে চেয়েছিল। সেটার জন্য টেকনলজি অবশ্যই দরকার ছিল। কিন্তু যতটুকু বুঝেছি, ও-জিনিস প্রয়োগ করার জন্য দরকার ছিল খুব ভালো একজন ভয়েজ-আর্টিস্টের। কনফিডেনশিয়ালিটির কথা মাথায় রেখে ডেটামাইন্স সুপ্রকাশ নামে ওই সংস্থার এক কর্মচারীকে এই কাজে ব্যবহার করে। এই লোকটিই গুঞ্জন নামে অ্যাডারের সঙ্গে আলাপ করেছিল।”
“সুপ্রকাশ সম্বন্ধে আমরা কী জেনেছি?”
“সে দক্ষিণ বঙ্গের একটি অনাথ আশ্রমে আশৈশব পালিত হয়েছিল। চেহারা থেকে পড়াশোনা— কিছুতেই তার কোনও বিশেষত্ব ছিল না। তবে লোকটির কণ্ঠের ব্যবহারে লোকটির অসাধারণ নৈপুণ্য ছিল। ডেটামাইন্স-এ একটা মামুলি কাজের পাশাপাশি বিজ্ঞাপন আর জিংগলে কণ্ঠের ব্যবহার করেই লোকটির দিন-গুজরান হত। পরিবার বলে কিছু ছিল না বলে ডেটামাইন্স-এর তরফ থেকেই একে ডেভেলপমেন্ট সেন্টারে রাখা হয়। একটা বিশেষ মোবাইল সুপ্রকাশকে দেওয়া হয় নিজের ভয়েজ রেকর্ড করা আর সাবসনিক ফ্রিকোয়েন্সি তাতে কতটা মিশছে তা শোনার জন্য।”
“সাবসনিক ফ্রিকোয়েন্সি?” পিউ বলে ওঠে, “মানে সমবেত প্রার্থনা আর ঘুমের সময় বুরারি-তে যে জিনিস অ্যাপ্লাই করা হয়েছিল বলে সাসপেক্ট করা হয়েছে?”
“ঠিক তাই। কথা আর সুরের সঙ্গে ও-জিনিসটা মেশানোই ছিল ‘হুইস্পার্স’ অ্যাপের ঘোষিত উদ্দেশ্য। তাই দিয়ে ওই বিদেশি এন্টিটি একটা খুব বড়ো কিছু ঘটাতে চাইছিল নিঃসন্দেহে। কিন্তু মাসতিনেক আগে, ট্রায়ালের এক পর্যায়ে লোকটি কোথায় যেন ‘বেড়াতে যাচ্ছি’ বলে গিয়ে, তারপর উধাও হয়ে যায়। ডেটামাইন্স তখনই আবিষ্কার করে যে মোবাইল আর তাতে থাকা যাবতীয় প্রযুক্তি-ও সুপ্রকাশের সঙ্গে গায়েব হয়ে গেছে। কীভাবে নিরাপত্তার এতরকম কড়াকড়ির মধ্যেও ওই স্তরের একটা জিনিস নিয়ে একটা লোক চলে গেল— তা ডেটামাইন্স এখনও বুঝতে পারেনি। বলা ভালো, তাদের চুপ থাকতে বলা হয়েছিল। এখন ওই এন্টিটি হাত ঝেড়ে ফেলছে বলেই আমরা অনেক কিছু বের করতে পারছি।”
“ওই এন্টিটি কি তাহলে সরাসরি সুপ্রকাশকে দিয়ে কাজ করাচ্ছিল?” আদৃতা প্রশ্ন করল এবার। সুপ্রকাশের ফটো দেখে সে নিশ্চিত হয়েছিল, এই লোকটার সঙ্গেই তার দেখা হয়েছিল বাস-স্টপে। ফটোতে অবশ্য লোকটাকে কী অদ্ভুতরকম নিরীহ মনে হচ্ছিল। অথচ সেদিন স্টপে তার প্রতিটি চলনের মধ্যে বিপদের সম্ভাবনা দেখেছিল সে। তারপরেও নিজের ইনস্টিংক্টকে কেন অবজ্ঞা করল আদৃতা?
“সেটাই তারা করতে চেয়েছিল একসময়।” মিরা বলল, “কিন্তু বাস্তবে ব্যাপারটা তেমন হয়নি। ডেটামাইন্স-এর এনকোয়্যারি থেকে ব্যাপারটা ভালোভাবেই বোঝা গেছে। সুপ্রকাশের একাধিক সহকর্মী, এমনকি ওখানের সিকিউরিটি এজেন্সির লোকেরা লক্ষ করেছিল, সে প্রায় সবসময়— এমনকি ঘুমের মধ্যেও— হেডফোন কানে দিয়ে আপনমনে কারও সঙ্গে বিড়বিড় করে। মনে হয়, ওই অ্যাপ হোয়াইট নয়েজে মিশে থাকা এমন কোনও সাবসনিক ফ্রিকোয়েন্সি সুপ্রকাশের কানে পৌঁছে দিয়েছিল, যেটা তাকে বদলে দিচ্ছিল। সে এমন কিছুর সংস্পর্শে এসেছিল, যা ওই বিদেশি এন্টিটি-র থেকেও বেশি প্রভাবশালী। সেই কথাটা ওই বিদেশি এন্টিটি যখন বুঝতে পেরেছিল, তখন অনেকটা দেরি হয়ে গেছে।”
বৃন্দা একটা ফাইল সবার মোবাইলে হোয়াটসঅ্যাপ করে বলল, “সুপ্রকাশ সম্বন্ধে যা-কিছু জানা গেছে, তার সবটাই পাঠিয়ে দিলাম।”
“কিন্তু আমাদের সামনে উত্তরের বদলে এখনও অবধি শুধু প্রশ্নই আছে।” লিজা বলল, “সুপ্রকাশকে ব্যবহার করে এজেন্ডা পুশ করার জন্য বানানো ওই ‘গুঞ্জন’ সাইট সে কীভাবে নিজের দখলে নিয়েছিল? ডেটামাইন্স-এর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার পর কাজ চালানোর মতো হার্ডওয়্যার বা সফটওয়্যার সে কোত্থেকে পেয়েছিল?”
“সুপ্রকাশ সম্পূর্ণ নতুন এক পরিকল্পনা নিয়ে এই শহরে ফিরে এসেছিল, সেটা বোঝাই যাচ্ছে।” আদৃতা মিরার দিকে ঘুরে জানতে চাইল, “কাজটা হয়ে গেছে মানে? ঠিক কোন কাজ নিয়ে এসেছিল সে?”
“গতকাল সকালে আরও একটি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে কলকাতায়। সেটাকে দুর্ঘটনা বলে আপাতত চালানো হলেও আমি খোঁজখবর নিয়ে এ-ব্যাপারে নিশ্চিত হয়েছি। সেখানেও আমার টিম ওই লিফলেট পেয়েছে। সেটা পুলিশের রেকর্ড থেকে সরিয়েও ফেলা হয়েছে।”
“কিন্তু তাতে…”
“আত্মহত্যার সংখ্যাটা আসলে দশ। আগে আরও একটা কেস লক্ষ করেনি মিডিয়া। আমাদের সেই বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন, যে বিশেষ ভাবনায় এই মৃত্যুগুলো উৎসর্গের কাজ করছে, তাতে দশ একটা অপ্টিমাল নাম্বার। অর্থাৎ কাজটা শেষ হয়ে গেছে।”
বৃন্দার মুখে একটা কাষ্ঠহাসি দেখা দিল, “কিন্তু সুপ্রকাশ কীভাবে এতটা শক্তিধর হয়ে উঠল, আর এখন সে কোথায় আছে— এগুলো খুঁজে বের করতে না পারলে তো কনট্র্যাক্ট ফুলফিল্ড হবে না।”
“আসলে এই দুটো বিষয়কে একটা প্রশ্ন হিসেবে দেখাই ভালো।” পরভিনের চোয়াল শক্ত হল, “মাসতিনেক আগে ঠিক কোথায় গেছিল সুপ্রকাশ? আমি নিশ্চিত, এখনও সে সেখানেই গেছে। কিন্তু যা হওয়ার ছিল, তা কি হয়ে গেছে?”
“নাহ্।” ক্যালেন্ডারটা স্ক্রিনে তুলে ধরল মিরা, “যা হওয়ার সবই হবে পরশু। এই ধরনের কাল্টগুলোর কাছে দশমী খুব গুরুত্বপূর্ণ। পরশু শুক্লা দশমী। সেদিনই যা হওয়ার হবে।”
“তার আগে জায়গাটা খুঁজে বের করতে হবে আমাদের।” পরভিন পিউয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমাদের সমস্ত অপারেটিভ, কনসালটেন্ট, এমনকি কনট্রাক্টরদের কাছে সুপ্রকাশের ফটোটা পাঠানো হোক। লোকটাকে ট্রেস করতেই হবে। সে যে তিন মাস আগের ওই জায়গাতেই গেছে— এ-বিষয়ে আমি নিশ্চিত।”
১০
আজ— রাত, সুরুলগাছা, আদৃতা
স্টেশনে পৌঁছনোর পর বেশিক্ষণ সময় কাটাইনি। ক্লান্ত মুখে, অন্যদের মতোই ভিড়ের সঙ্গে মিশে বেরিয়ে এসেছিলাম বাইরে।
মেঘের গুরুগুরু আকাশ ভাঙার ইঙ্গিত দিচ্ছিল বেশ কিছুক্ষণ ধরেই। এবার বৃষ্টিটা নামল। সবাই দৌড়ল রিকশা, অটো, টোটো— এ-সবের দিকে। আগে থেকেই ঠিক করে রাখা একটা টোটোতে একাই চেপে বসলাম আমিও। ক্লাব-এর স্থানীয় এক রিসোর্সই ব্যবস্থাটা করে রেখেছিল।
পরভিন আলাদাভাবে বেরিয়েছিল স্টেশন থেকে। একটা বাইকে তাকে তুলে নিয়ে গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা হয়েছিল আমাদের রিসোর্স। একসঙ্গে দুজন বহিরাগতকে একটা টোটোয় চেপে কোথাও যেতে দেখলে লোকের নজরে পড়ার সম্ভাবনা ছিল।
একটু পরেই একেবারে সরু— পাশাপাশি দুটো সাইকেল যেতে পারে বড়োজোর এমন— রাস্তা ধরল টোটো। দুপাশে কখনও পড়তে লাগল বড়ো গাছ, কখনও আবার বৃষ্টিতে সাদা হয়ে যাওয়া ধানখেত। ঝাঁকুনি খেতে-খেতেও ব্যাকপ্যাক থেকে বোতল বের করে জল খেয়ে নিলাম।
চারদিক সাদা করে দিয়ে একটা বাজ পড়ল। সেই আলোতে মনে হল, মুহূর্তের জন্য দূরে একটা উঁচু পারের মতো জায়গা দেখতে পাচ্ছি। ভয়ংকর শব্দটা এল একটু পরেই।
“ওইখানেই ঢিবি।” আঙুল তুলে একটা জায়গা দেখিয়ে সংক্ষেপে বলল আধবুড়ো টোটোচালক, “সুলতা দিদিমণি বললেন আপনাকে ওইখান থেকে একটু দূরে নামিয়ে দিতে।”
“নামানোর পর তুমি ওখানে থাকবে না?”
“না গো।” একমুখ হাসি নিয়ে চালক বলল, “ওখানে আমরা বেশিক্ষণ থাকতে পারি না। তবে আমি এই মাঠপারেই থাকব। আপনাকে তো রাতেভিতে এই মাঠে ছেড়ে দিতে পারি না।”
অন্য সময় কথাটা শুনতে কেমন লাগত জানি না। অন্তত আমার আর পরভিনের কোনও লোকাল গার্জিয়ানের প্রয়োজন হয় না, হবেও না। তবে ওই আকাশভাঙা বৃষ্টির রাতে এক অচেনা মানুষের গলায় ওই স্নেহময় ভাবটা শুনতে ভারি ভালো লাগল।
“আমার নম্বর আছে তো দিদির কাছে? নইলে আপনার নম্বরটা বলুন। আমি একটা মিসড কল দিই। ওতে ফোন করে বলে দিলেই আমি চলে আসব আবার— সে যত রাত্তিরই হোক।”
এখানে আশার আগেই নেওয়া সিমের নম্বরটা বললাম। চালকের ‘মিস কল’ রিসিভ করতে গিয়ে মোবাইলের ঘড়ির দিকে নজর গেল। বুঝলাম, শহুরে হিসেবে না হলেও এই তল্লাটের নিরিখে সত্যিই অনেক রাত হয়ে গেছে এখন। তার ওপর যা ঝড়-জল চলছে। কাজটা সারতে কতক্ষণ লাগবে, কে জানে।
কিন্তু আমরা যাকে খুঁজতে-খুঁজতে এতদূর এসেছি, সেই সুপ্রকাশকে এখানে পাব তো?
দেড় দিন ধরে অজস্র বার্তা এসে পৌঁছেছিল ক্লাব-এর কাছে। সেগুলো বিশ্লেষিত হয়েছিল নানাভাবে। শেষ অবধি মিরা আর তার টিম এই সুরুলগাছা-কেই পিনপয়েন্ট করেছিল মাত্র একটা ইন্সিডেন্ট রিপোর্টের ভিত্তিতে। তারপর শুরু হয়েছিল আমাদের দুজনকে এখানে পৌঁছে দেওয়ার জন্য দৌড়।
“ঢিবিতে কী আছে, কাকা?” ইন্সিডেন্ট রিপোর্টের ভিত্তিতে করা মিরার তি-কনস্ট্রাকশনটা পড়লেও সেটা বিশ্বাস হতে চাইছিল না। তাই প্রশ্নটা করেই ফেললাম।
“ওমা! কিছু না জেনেই যাচ্ছেই অমন জায়গায়? তাও এত রাতে?” দারুণ ঝাঁকুনির মধ্যেও টোটো-টাকে স্টেডি রাখার চেষ্টা করতে-করতে বলল চালক।
উত্তর দিলাম না। কাকা বিড়বিড় করার মতো বলতে লাগল, “লোকে বলে, ওটা পোড়া ঠাকুরের ঢিবি। কিন্তু ঠাকুর ওখানে নেই গো। আছে খালি হা-হা ফাঁকা একটা জায়গা, আর একটা অদ্ভুত শব্দ। আমরা সেটা শুনতে পাই না এমনিতে। কিন্তু পশুপাখি শোনে, বোঝে। তারা সবাই ওই জায়গাটা এড়িয়ে চলে। গুণ্ডা-বদমাশ, চালান-পার্টি… কত লোকই ওখানে গেছে কিছু-না-কিছু কামাবে বলে। কেউ টেকে না। পাগল হয়ে যায় কেউ। আবার আমার ভাইটার মতো কেউ হলে গায়েবই হয়ে যায়!”
“কী হয়েছিল তোমার ভাইয়ের?”
মাথা নাড়ল কাকা। দুদিক খোলা টোটো-তে বসে ভিজতে-ভিজতেও দেখলাম, কাকা আলগোছের হাতের পেছনটা দিয়ে একবার নিজের চোখ মুছে নিল।
“এমনি দিনে জায়গাটা শুধু থম্ মেরে থাকে। কিন্তু কোনও-কোনও দিন…”
ঠিক তখনই আবার বিদ্যুৎ চমকাল আকাশ জুড়ে। ধবধবে সাদা হয়ে যাওয়া চরাচরে স্পষ্টভাবে আমার চোখে ধরা দিল ঢিবিটা। মনে হল, আশেপাশের মাটির সঙ্গে প্রায় এক উচ্চতায় থেকেও সেটা যেন অন্যরকম হয়ে আছে। মাটির নীচে ওখানে শুধু কয়েকটা পোড়া পাথর নেই; বরং আছে একটা লম্বা সুড়ঙ্গ।
কী… বা কে আছে তার ওপাশে?
জল-কাদায় ভরা একটা আলপথের ধারে টোটো থামিয়ে দিল কাকা। আমার দিকে ঘুরে সে বলল, “যখনই মনে হবে, ফোন করে দিয়ে এইখানে চলে আসবেন। আমি থাকব ওইখানে।”
আঙুল দিয়ে বেশ কিছুটা দূরের একটা জায়গা দেখাল সে। কয়েকটা টিনের চাল, কলাগাছ, ঝোপঝাড়, একটা ছেঁড়া পতাকা— এ-সব দেখে বুঝলাম, ওখানে জনবসতি আছে। চোখের সামনেই সেদিকে যাওয়ার রাস্তাটা বৃষ্টির জলে ডুবে যাচ্ছিল। আমাকে নামিয়ে দিয়েই টোটো সেদিকে চলে গেল।
এইসময় সাপ বেরোয় কি না— সে-ব্যাপারে নিশ্চিত না হলেও টোটো-তে বসেই পায়ে হাঁটু অবধি ঢাকা টাইট রবারের জুতো পরে নিয়েছিলাম। মাথা আর ঊর্ধ্বাঙ্গ ঢেকে নিয়েছিলাম ওয়াটারপ্রুফে। নাইট-ভিশন গগলস্ ছিল চোখে, তাই মোটামুটি সবই দেখতে পাচ্ছিলাম। সঙ্গে অস্ত্রও ছিল। তবু সম্পূর্ণ খোলা প্রান্তরে নিজেকে বড়ো অরক্ষিত মনে হচ্ছিল। আশেপাশে আর কাউকে দেখতে না পেলেও দৌড় মারলাম ঢিবির দিকে।
আলের শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়ে পড়লাম। ততক্ষণে মাটিতে প্রায় গা মিশিয়ে থাকা পরভিনের দিকে নজর পড়েছিল। সে-ই হাত তুলে আমাকে থামতে বলেছিল। প্রথমে কারণটা বুঝতে না পারলেও এবার ব্যাপারটা খেয়াল হল।
বৃষ্টির শব্দ শুনতে পাচ্ছি না আমি। নিজের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ, এমনকি বিদ্যুৎ ঝলসানোর একটু পর আসা কান-ফাটানো আওয়াজ— এগুলোর কিচ্ছু আমার কানে ঢুকছে না আর। বরং…
“গেলা ভৎ য়াহ ফহমআ!”
কথাটা যেন কানে নয়, বরং আমার চেতনায় প্রবেশ করল। গলা নয়, যেন অন্য কোনও অঙ্গ দিয়ে শব্দগুলো বলছিল… গুঞ্জন— মানে সুপ্রকাশ! আমৃত্যু এই গলা, বা তার অতীত কিছু দিয়ে বাতাসে ভাসিয়ে দেওয়া তরঙ্গের উৎসকে মনে রাখব আমি। অস্ত্রটা আমার হাতে উঠে এল।
পরভিন ইশারায় বোঝাল, ঢিবির যেদিকটাতে আমরা আছি, তার অন্য পাশে রয়েছে সুপ্রকাশ। ওদিকটাতেই সরস্বতী-র মজা খাত। ওখান থেকে কিছুটা দূর অবধিও টোটো আসে— তবে অন্য পথে। পরভিনকে নিয়ে বাইকটার সেই পথেই আসার কথা ছিল। তাহলে কি আমাদের উপস্থিতি টের পেয়েছে সুপ্রকাশ?
ওই কথা… বা মন্ত্রোচ্চারণের ফলে একটা অদ্ভুত বুদ্বুদের মতো পরিবেশ ঘিরে ফেলেছিল জায়গাটাকে। তার মধ্যে নিজের গলা, এমনকি নিজেকেও পুরোপুরি ভরসা করতে পারছিলাম না। ইশারায় জানতে চাইলাম, ঢিবি বেয়ে উপরে ওঠার চেষ্টা করব কি না। পরভিন মাথা নেড়ে ‘না’ বুঝিয়ে আবার ঢিবির দিকে দেখাল।
গগলসের মধ্য দিয়ে ভালোভাবে তাকিয়ে একটা অবিশ্বাস্য দৃশ্য দেখলাম। মনে হচ্ছিল, নির্ঘাত আমি ভুল দেখছি। তা না হলে বৃষ্টির জল ঢিবির এই দিকটা দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে না কেন? বরং এদিকের ঘাস, এমনকি পাথর যেন কিলবিল করে উঠে যেতে চাইছে অন্যদিকে— যেখানে কিছু একটার মুখ খুলছে ওই ওঠা-নামা করা দুর্বোধ্য শব্দগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে!
আমরা দুজনেই মাটিতে গা মিশিয়ে, ঢিবি থেকে দূরত্ব বজায় রেখে জায়গাটাকে চক্রাকারে পাক খেতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পরেই দেখতে পেলাম, হাঁটু মুড়ে বসে, আকাশের দিকে দু হাত তুলে, দুলে-দুলে ওই অদ্ভুত কথাগুলো বলছে একটা মানুষ।
আবার চারদিক সাদা করে দিল একটা বিদ্যুতের ঝলক। সেই প্রথম দিনের মতো বৃষ্টির ধোঁয়াটে আড়ালের মধ্য দিয়ে আমি দেখলাম লোকটাকে— সুপ্রকাশ… না, গুঞ্জন!
“স্টপ!” নিজের গ্লক-উনিশ উঁচিয়ে ধরল পরভিন, “আপনি নেমে আসুন, সুপ্রকাশ!”
লোকটা আমাদের দিকে ঘুরে উঠে দাঁড়াল। আমি…
হঠাৎ মনে হল, আমি কি মরে গেছি? নিজের স্বামীকে মেরেছি বলেই কি আমার নরকবাস হয়েছে?
সামনে যে দ্বিপদ, দ্বিবাহু, একমুণ্ড চেহারাটা দাঁড়িয়ে ছিল, তার আদলটা মানুষেরই। কিন্তু তার দুটো চোখ আর নেই। সেই দুটো কোটরে খেলা করছিল এক আশ্চর্য রঙের ঝিলিমিলি— যে রঙের হদিশ আমায় দিয়েছিল আধোঘুমে, আধো-জাগরণে শোনা সেই শব্দগুলো।
তার মুখও আর ছিল না। শুঁড়ের মতো করে জিভটা নড়ছিল একটা গহ্বরের মধ্যে। সেই গর্তের মধ্যেও সর্বনাশা পরাগরেণুর মতো খেলে বেড়াচ্ছিল সেই রঙের ফুলকি।
দারুণ ভয়ে আমার হাত কাঁপতে শুরু করেছিল। বিশ্বস্ত গ্লক-উনিশ আঁকড়ে ধরে নিজেকে বোঝাতে চাইলাম, এখনও এখানেই আছি। আমি এখনও বেঁচে আছি!
“ধপ্! ধপ্!” দুবার ধমকে উঠল পরভিনের সাইলেন্সর-পরানো অস্ত্র। অত কাছ থেকে গুলি ফসকানোর প্রশ্নই ওঠে না। গুঞ্জনের শরীরও কেঁপে উঠল দুবার, তবু সে পড়ে গেল না। বরং সেভাবেই সে ঘুরে গেল ঢিবির একটা অংশের দিকে— যেখানে একটা গর্তের মুখ ক্রমশ বড়ো হয়ে আসছিল। ক্রমশই তীব্র হয়ে উঠছিল সেই গর্ত থেকে বেরিয়ে আসা অদ্ভুত আলোর দীপ্তি।
গর্তটা বড়ো হচ্ছিল কীভাবে? বৃষ্টির তোড়ে মাটি সরে যাচ্ছে বলে? টের পেলাম, পায়ের নীচে মাটিও কাঁপছে! নীচে তাকিয়ে দেখলাম, ঘাস, মাটি, পাথর— সবকিছু যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। পুরনো আমলের ক্যাসেটের ফিতের মতো যেন পেঁচিয়ে যাচ্ছে সবকিছু।
কিছু একটা, বা কেউ কী আসছে ওই পথে?
“কী হচ্ছে এখানে?” পরভিন আমার দিকে তাকাল। গগলসের আড়ালেও বুঝলাম, ওর দুচোখে ভয় জমেছে। ভয়— কারণ, অবস্থাটা আমাদের বোধবুদ্ধির বাইরে চলে যাচ্ছে খুব দ্রুতগতিতে।
আমাদের কি আরও লোকজন নিয়ে আসা উচিত ছিল? কিন্তু তারা কী করতে পারত? আমরা…
অস্ত্র সরিয়ে রাখলাম। চোখ থেকে খুলে ফেললাম নাইট-ভিশন গগলস্। মাথা থেকে সরিয়ে দিলাম আবরণ। তারপর লোকটাকে ডাকলাম, “গুঞ্জন?”
উচ্চারণ না থামিয়েই আমার দিকে মুখ ফেরাল লোকটা। তার চোখে আর মুখে ওইটুকু সময়ের মধ্যেই যেন আরও প্রবল হয়ে উঠেছিল অন্য কোনও জগতের, হয়তো বা নরকের প্রভাব। সেদিকে তাকিয়েই হঠাৎ অন্য একটা কথা মনে পড়ে গেল।
তিন দিন আগে ঘুম থেকে ওঠার মুহূর্তেও আমার মাথায়, ওই সুন্দর গলায় বলা কয়েকটা শব্দ… বা ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছিল। সেই কথাটা সত্যি করার জন্য, চিরকালের জন্য এক রঙিন সুরেলা দুনিয়ায় হারিয়ে যাওয়ার জন্য সেদিন সকালেই ছুরিটা দিয়ে আমি…
“এ দ্মা নগ্।” বৃষ্টির জলের সঙ্গে মিশে গেল আমার সব হতাশা, সব কষ্ট। দু হাত বাড়িয়ে বলে উঠলাম, “অক্খ্যই সিয়াহাহ!”
সুপ্রকাশ… না, গুঞ্জনের মুখে একটা অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠল। আমার দিকে একটা হাত বাড়িয়ে ধরল সে। আর… বিশ্বাস করুন, মুহূর্তের জন্য মনে হল, সবকিছু ছেড়ে ওই হাতটা ধরি! হারিয়ে যাই ওই রঙ আর অশ্রুত ধ্বনির জগতে।
“ক্লিক!” একটা ধাতব শব্দ পেয়ে আচ্ছন্ন ভাবটা কেটে গেল মুহূর্তের জন্য। ডানদিকে তাকিয়ে দেখলাম, সিডি-র মতো পাতলা একটা ধাতব জিনিসকে অব্যর্থ লক্ষ্যে গর্তটার মধ্যে ছুড়ে দিল পরভিন। তারপরেই আমার একটা হাত ধরে সে ছুটতে শুরু করল আলের দিকে।
মনে হল, পায়ের তলায় পৃথিবী যেন ফুঁসে উঠল হঠাৎ! আছড়ে পড়ে গেলাম আমরা দুজনেই। পরভিন হাঁটুতে ভর দিয়েই এগোতে চাইছিল। আমাকে প্রাণপণে দূরে টেনে নিয়ে যেতে চাইছিল সে। কেন যেন সব অসাড় লাগছিল সব। মনে হচ্ছিল, আমার শরীরটা এখানে থাকলেও মন, চেতনা, অস্তিত্বের সারাৎসার যেন বয়ে যাচ্ছে ওই গর্তের দিকে— যার পাশে দাঁড়িয়ে আছে গুঞ্জন।
তখনই বাজ পড়ল ওই ঢিবির উপর— ঠিক ওই গর্তটার মধ্যে! পরক্ষণেই একটা সাদা আগুনের স্তম্ভ যেন তুবড়ির মতো উঠে এল ওই গর্ত থেকে। সেটা ধেয়ে গেল উপরে, আরও উপরে, একেবারে আকাশের ওপারে।
লুপ্ত হয়ে গেল আমার চেতনাও।
১১
বেশ কিছুদিন পরে, অন্য কোথাও
“রিপোর্ট?”
“নেগেটিভ, স্যার।”
“সেই লোকটির সন্ধান পেলে?”
“না, স্যার। সফটওয়্যার আর ওই এন্টিটির ইন্টারফেস হিসেবে কাজ করা লোকটি একদম উবে গেছে।”
“আর জায়গাটা?”
“স্যাটেলাইট আর পার্টিকল-ডিটেক্টর অনুযায়ী ওখানে একটা পোর্টাল খোলা হয়েছিল। কিন্তু সেখানে অনুসন্ধান চালিয়েও কিছু পাইনি আমরা। বাজ পড়ে পুরো জায়গাটা একেবারে জ্বলে গেছে। ইনফ্যাক্ট জায়গাটা ধ্বসে, পাশে নদীর মজাখাতে পড়ে গেছে। ওই সময় ক্লাউড বার্স্টের ফলে তৈরি হওয়া ফ্ল্যাশ ফ্লাড ওই মজা খাত দিয়ে বয়েছিল। ফলে কিছুই আর পাওয়ার সম্ভাবনা নেই।”
“আর ওখানে যারা এই নিয়ে খোঁজাখুঁজি করছিল?”
“পুলিশ বা মিলিটারি নয়, স্যার। ‘ক্লাব থার্টিন’ নামের একটি সংস্থা কাজটা করছিল। কে তাদের বরাত দিয়েছিল, বলা মুশকিল। তবে যে ধরনের নেটওয়ার্ক আর রিসোর্স এরা ব্যবহার করেছে, তাতে ব্যাপারটার পেছনে ভারত সরকারের কোনও এজেন্সির হাত থাকা স্বাভাবিক। স্পটে একটা বিশেষ ডিভাইস ব্যবহার করা হয়েছিল— যেটা একসঙ্গে বেশ কয়েকটা বাজ-কে নেমে আসতে বাধ্য করেছিল ওই একটা বিন্দুতে। মুহূর্তের জন্য ওই গর্তের মধ্যে সূর্যের সার্ফেসের চেয়েও বেশি তাপমাত্রা তৈরি হয়েছিল। আমি জানি না ওই এন্টিটি-কে ধ্বংস করা সম্ভব কি না। তবে তাকে ফেরত পাঠানোর জন্য ওই ডিভাইসটা যথেষ্ট ছিল। ওই জিনিস পৃথিবীতে মাত্র কয়েকটি দেশের কাছে আছে। কাজেই…”
“আর হুইস্পার্স?”
“ডেটামাইন্সের পুরো কাজটাই মিলিটারি নিয়ে নিয়েছে। ওখান থেকে আমাদের পক্ষে আর কিছু আদায় করা কঠিন।”
চুপ করে সামনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে রইলেন প্রৌঢ় খর্বকায় পুরুষটি। তারপর মৃদু হাসলেন তিনি।
হ্যাঁ, একটা সম্ভাবনা বিনষ্ট হয়েছে ঠিকই; কিন্তু তারই সূত্র ধরে উন্মুক্ত হয়েছে এক নতুন দিগন্ত। ডিপ্রেশনের শিকার ও মোবাইলে আসক্ত ভারতীয়দের খাদে ঠেলে দেওয়ার জন্য বানানো একটা প্রযুক্তি তাঁদের সামনে খুলে দিয়েছে এক অজানা-অবিশ্বাস্য ভুবনের দ্বার। এমন আরও দরজা নিশ্চয় আছে নানা জায়গায়। কান পাতলে কি তাদের সন্ধান পাওয়া যাবে না?
আর একবার ওইরকম কোনও এন্টিটির সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করতে পারলে…
“যেখানে পোর্টাল খুলেছিল, সেই জায়গাটার কী নাম ছিল?”
“পোড়া ঠাকুরের ঢিবি।”
“খোঁজো, এমন আর কোন-কোন জায়গা আছে এই অঞ্চলে। সবাইকে কাজে লাগাও। তেমন কিছু শুনলেই আমাকে শোনাও তার গুঞ্জন। উই হ্যাভ আ মিশন টু ফুলফিল! আর হ্যাঁ, ওই এজেন্সিটির সম্বন্ধে খোঁজ নিতে শুরু করো। আবার যদি ওরা আমাদের পথের কাঁটা হয়, তাহলে আমাদেরও ব্যবস্থা নিতেই হবে— তাই না?”
-*-
- আহ্কাইগফৎ (ahkaigft): মনে রেখো;
- গ্বাশোই (gbashoi): বহন করো;
- গথা (gotha): চাও;
- ফ্তাগন (fhtagn): ঘুম;
- গহ্খ্যোই য়হখ্যই ফ্হখু (g’ukhyoi y’okhyoi fhokhu): তোমার হল সারা, আমার হল শুরু;
- অর্কাদিশতু তেগথ চ বহথু ফহাই (orkadishtu tegoth c’ b’hthu fh’ai): সেই জ্ঞানী ব্যক্তি আমাদের ডাকছেন তাঁর কাছে যাওয়ার জন্য;
- ফ্তোই ন্তাগা নাখাই ররথনা (ftoi ntaga nakhai rrrthnaa): উৎসর্গের আগে আমায় জাগিও না;
- আখো শোগ (akho shogg): স্বপ্ন দেখছি আমি;
- গেলা ভৎ য়াহ ফহমআ (gela vt’ yah fhma’a): আমার মধ্যেই খুলবে সেই দ্বার;
- এ দ্মা নগ্ (e dma nog ): সে আসুক।
- অক্খ্যই (okhyoi syaha’h): চিরকালের জন্য আসুক।
[কৃতজ্ঞতা স্বীকার: Aklo Language database~ https://docs.google.com/document/d/1NseDwMGLa1pZbeLe90IcCBYzDyEf5lkBY0P0JBbnPU8/edit]
*বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: চুন্দাওয়ত পরিবারের ঘটনার ব্যাখ্যা থেকে শুরু করে এই কাহিনির সমস্ত স্থান ও চরিত্র কাল্পনিক। কারও বিশ্বাসে আঘাত দিয়ে থাকলে অত্যন্ত দুঃখিত ও ক্ষমাপ্রার্থী।
Tags: অষ্টম বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা, ঋজু গাঙ্গুলী, কল্পবিজ্ঞান
লাভক্রফটিয়ান হরর, মাতৃত্ব, এবং দমিত সুর দিয়ে তৈরি এক শব্দ ঝড়ের সম্মুখীন হলাম ঋজুদার লেখায়। অপূর্ব।
অসংখ্য ধন্যবাদ, ভায়া।
তরতরিয়ে শেষ করলাম। দারুণ গল্প।
অসাধারণ, শ্রদ্ধাস্পদেষু, আমি তো অনেক দেরি করে পড়লাম এখুনি। আমার শব্দ ভান্ডারে আপনার জন্য উপযুক্ত কোন কিছু এই ৬৫+ সেরিব্রামে আসছে না। পরে যে মাধ্যমে আপনার সঙ্গে আমার যোগাযোগ, সেখানে জানাবো। সম্বলপুরে? ভালো থাকবেন নিরন্তর।
বিনম্র নমস্কারান্তে,
অদ্ভুত, অসাধারণ। বুরারির সঙ্গে লাভক্র্যাফট= আহা! খুব ভালো লাগলো।