Wednesday, November 13, 2024
ধারাবাহিক উপন্যাস

জেমস পটার অ্যান্ড দ্য হল অফ এল্ডারস ক্রসিং – পার্ট ৯

লেখক: জি নরম্যান লিপার্ট, ভাষান্তরঃ প্রতিম দাস

শিল্পী: মূল প্রচ্ছদ, সুদীপ দেব

নবম পরিচ্ছেদ

বিতর্কসভায় বিশ্বাসঘাতকতা

প্রতিদিনের রুটিনের সঙ্গে জেমস যতই নিজেকে মানিয়ে নিচ্ছিল, দিনগুলোও যেন ততটাই টকটক করে চলে যাচ্ছিল। ওদিকে জ্যান উত্তরোত্তর উন্নতি করছিল কুইডিচ খেলায়। আর সেই ওই সাফল্য লক্ষ্য করে জেমস এক অদ্ভুত রকমের ভালোলাগা না লাগার দ্বন্দ্বে ভুগছিল। একটা অসূয়াবোধ ওকে ক্ষত বিক্ষত করতো যখন শুনতে পেত জ্যানের দক্ষতা দেখে দর্শকেরা উচ্ছসিত প্রশংসা করছে। আবার মনের একটা কোণা আনন্দও পেত এটা দেখে যে ছেলেটা খেলাটাকে কি পরিমাণ ভালবেসে ফেলেছে। প্রতিম্যাচে ও দলের হয়ে জানপ্রাণ লড়িয়ে দিচ্ছে। জেমসেরও অবশ্য উড়ুক্কু ঝাড়ু ব্যবহারে দক্ষতা অনেকটাই বেড়েছে। জ্যানের সঙ্গেই ও কুইডিচ মাঠে অনুশীলন করে। দরকার মতো জ্যানের কাছে থেকে বুঝে নেয় কখন কি করতে হবে। জ্যানও ওর তরফ থেকে বিন্দুমাত্র অনীহা দেখায় না। উৎসাহের সঙ্গে সব কিছু বুঝিয়ে দেয় এবং বারবার বলে আগামী বছর গ্রিফিন্ডোর দলে জেমস সুযোগ পাবেই।

‘তাহলে অবশ্য তখন আর তোর সঙ্গে অনুশীলন করা হবে না আমার, বুঝতেই পারছিস,’ জেমসের পাশে ঊড়তে উড়তে বললো জ্যান। ‘আর যাই হোক শত্রু দলের খেলোয়াড় বলে কথা।’ জেমস কোন উত্তর দিলোনা কারণ ও জানেনা এটা জ্যান ইয়ারকি মারছে নাকি সত্যি বলছে।

 ওড়ার ক্ষেত্রে অনেক বেশী আত্মবিশ্বাসী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই জেমস এটাও বুঝতে পারছিল যত দিন যাচ্ছে ও ফুটবল খেলাটাকেও একটু বেশীই ভালোবেসে ফেলছে। টিনা কারি তার ক্লাসের শিক্ষার্থীদের বেশ কিছু দলে ভাগ করে দিয়ে একে ওপরের সঙ্গে ম্যাচ খেলাচ্ছেন প্রায়শই। অনেক শিক্ষার্থীই খেলার মূল ধাঁচটাকে আয়ত্ত করে নিয়েছে। এই ম্যাচগুলোও আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে একটা প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব থাকায়। মাঝে মধ্যে এক আধজন ভুলে যাচ্ছে এই খেলাটাতে জাদুর ব্যবহার করা যাবে না। তাদের হাত চলে যাচ্ছে জাদুদন্ড রাখার জায়গায়। আবার কেউ কেউ খালি হাতেই বলে উঠছে “অ্যাসসিও ফুটবল!” একবারতো হাফলপাফের এক ছাত্রী সাধারণ নিয়ম ভুলে গিয়ে দুহাতে বলটা ধরে সজোরে ছুড়ে দিলো, যেন রাগবি খেলছে। জেমস বুঝতে পেরেছে প্রফেঃ কারির ওর ফুটবল খেলা বিষয়ে করা অনুমানটা একেবারে সঠিক ছিল। সত্যিই ওর মধ্যে সহজাত ক্ষমতা আছে। কেবলমাত্র কিছু নির্দেশ শুনেই ও বলটাকে ইচ্ছে মত পায়ে খেলাতে পারে। ওর বল নিয়ন্ত্রনের দক্ষতা যে কোন নতুন খেলোয়াড়ের তুলনায় অনেক উন্নত মানের। গোল করার সংখ্যায় ও আপাতত দ্বিতীয় স্থানে আছে। এক নম্বরে আছে পঞ্চম বর্ষের ছাত্রী সাব্রিনা হিল্ডেগারড। যে আবার জ্যানের মতই মাগলজাত সন্তান এবং ছোটবেলায় মাগলদের ফুটবল লিগে খেলেওছে।

জেমস আর র‍্যালফের মধ্যে ইদানীং কথা হয়না বললেই চলে। জেমসের তাৎক্ষণিক রাগের প্রকাশটা দুজনের মাঝে একটা অনমনীয়তায় দেওয়াল বানিয়ে দিয়েছে। ওর নিজেরই যে র‍্যালফকে ক্ষমা করে দেওয়া উচিত সেটা জেমস ভালোই বোঝে। বা সঠিক ভাবে বললে জেমসেরই উচিত সেদিন গ্রেট হলে চেঁচিয়ে ওঠার জন্য ক্ষমা চেয়ে নেওয়া। তবে র‍্যালফ যদি মাথা ঠান্ডা করে বোঝার চেষ্টা করতো বুঝতে পারতো ওর স্লিদারিন হাউসমেটরা আসলে ভুলই করছে। সেটা না করে র‍্যালফ স্লিদারিনদের এবং প্রোগ্রেসিভ এলিমেন্ট এর প্রতি নিজের আনুগত্য জাহির করলো। যদিও সেই উৎসাহজনক আনুগত্য মোটেই খুব জোরালো ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে নেই এটাও জেমস অনুভব করেছে। কিন্তু কিছুতেই রাগটা যাচ্ছেনা। ইদানীং র‍্যালফ ওই নীল ব্যাজটা পড়তে শুরু করেছে। লাইব্রেরীতে উপস্থিত থাকছে বিতর্ক সভার আলোচনায়। এসবই মেনে নেওয়া যায় কিন্তু হাবভাব এমন দেখাচ্ছে যা মোটেই ভালো কোনো ইঙ্গিত দিচ্ছে না। এমন কি কোন স্লিদারিন সদস্য ওকে কিছু জিজ্ঞেস করলে সেটার উত্তর দিচ্ছে উদ্ধত ভঙ্গীতে। যা বলছে সেটা এতো ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলছে যে উত্তর শোনার আগ্রহ হারিয়ে যাচ্ছে। এসব দেখে জেমসের খারাপ লাগলেও নিজেকে র‍্যালফমুখী করার কোন উৎসাহ ও পাচ্ছে না।

রাতে ঘরের মধ্যে বা লাইব্রেরীর এক কোনায় গিয়ে জ্যান আর ও, লুক্কায়িত দ্বীপের গেটে যে লেখাগুলো পড়েছিল সেটা নিয়ে আলোচনা করে। জ্যানের সাহায্য নিয়ে মনে করে করে লেখাগুলো লিখে ফেলেছে। ওরা নিশ্চিত যে এই লেখায় কোন ভুল নেই। যদিও ওটা থেকে বিশেষ কিছু তথ্য বার করতে ওরা পারেনি। তবে প্রথম দুটো লাইনের মানে বোঝা গেছে। পূর্ণিমার রাত ছাড়া এই লুক্কায়িত দ্বীপ রহস্য কারও দৃষ্টিগোচর হয় না। বাকি অংশ এখনো ধাঁধা হয়েই আছে। “ভাঙবে কি তার সেই ঘুম” এই লাইনটা জেমসের মনে গেঁথে বসে গেছে। এর সঙ্গে মারলিনের কিছু একটা সুত্র আছেই। কিন্তু মারলিন তো ঘুমিয়ে নেই… নাকি সত্যিই ঘুমিয়ে আছেন?’

এরমধ্যেই জ্যান একদিন লাইব্রেরীতে বললো, ‘জানিস, ওই লাইনটা না আমায় রিপ ভ্যান উইঙ্কলের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। হঠাৎ করে এক জায়গায় ঘুমিয়ে পড়ার পর ঘুম ভাঙলো কোন এক গাছের তলায়। তাও আবার ১০০ বছর পর। জ্যান জেমসকে গল্পটা শোনালো। জেমসের মনে পড়লো ওর বাবার সঙ্গে অন্য অরোরদের আলোচনায় ও শুনেছিল মাগলদের অনেক পৌরাণিক কাহিনী নাকি আসলে পুরাকালে উইচ আর উইজার্ডদের সঙ্গে সংঘর্ষ থেকে তৈরী হয়েছে। জাদু জগতের ছড়া গল্প মাগলদের রূপকথাতে পরিণত হয়েছে। ঘটেছে বেশ কিছু রদবদল বা পরিমার্জন। কালে কালে সেগুলো পরিণত হয়েছে লিজেন্ড আর মিথে। জেমসের মনে হচ্ছে জ্যান যে গল্পটা বললো এটা আসলে মারলিনেরই গল্পর রূপান্তরিত কল্পকাহিনী। কিন্তু ওরা কেউই কোনো ধারনা করতে পারছে না কিভাবে মারলিন শত শত বছর পেরিয়ে আবার ফিরে আসবেন। বা কারা এই বিরাট মাপের ষড়যন্ত্রটার সঙ্গে এখন জড়িত।

রাতে বিছানায় ঘুমের জগতে তলিয়ে যাওয়ার সময় জেমসের মনে ভেসে উঠলো সেভেরাস স্নেপের পোরট্রেটের সঙ্গে হওয়া কথোপকথন। উনি বলেছেন উনি সব সময় জেমসের গতিবিধির দিকে নজর রাখছেন। কিভাবে সেটা সম্ভব এটা মাথায় ঢুকছে না। গোটা স্কুলে একটাই মাত্র ছবি আছে স্নেপের। সেটা ওই ম্যাকগনাগলের অফিসের পোর্ট্রেট। তাহলে কি করে উনি জেমসকে দেখছেন? ড্যাড আর মামের কথা অনুসারে স্নেপ একজন শক্তিশালী জাদুকর এবং জাদুতরলের বিশেষজ্ঞ। কিন্তু এই দুটো শক্তি কি ভাবে ওনাকে সাহায্য করতে পারে গোটা দুর্গের প্রতি অংশে নজর রাখায়? তবে স্নেপ বলেছেন যখন, তখন জেমস বিশ্বাস করে উনি সেটা করতে সক্ষম। এব্যাপারে দ্বিধা করে লাভ নেই। যেভাবেই হোক উনি কাজটা করছেন। দুসপ্তাহ হয়ে গেছে কথা বলার অথচ প্রায় কিছুই ভোলেনি জেমস। ও যে একেবারে ওর বাবার মতো, এটা একটা চালু কথা জাদু জগতে। জেমস জানে। স্নেপও তাই বললেন। কিছুটা বিরক্তির সঙ্গেই, “যেমন পটার তেমনই তার ছেলে।” মুস্কিল হলো, এরকমভাবে আর কেউ না ভাবলেও স্নেপ যে এই ভাবে ভাবছেন এটাই অস্বস্তিকর ব্যাপার।

নিষিদ্ধ অরণ্যের গাছের পাতা শরতের আগমনে প্রথমে বাদামী তারপর হলুদ রঙ এ বদলে যেতে শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই প্রোগ্রেসিভ এলিমেন্টের নীল ছাপ পড়তে শুরু করলো “অল স্কুল ডিবেট” এর পোস্টার ও ব্যানারে। র‍্যালফের যেমন বলেছিল সেই মতোই বিষয় নির্বাচিত হল “অতীতে নেওয়া সিদ্ধান্ত – সত্য বা মিথ্যে গুলির নব মূল্যায়ন।” শুধু মাত্র লেখা দিয়ে যদি মানুষকে আকর্ষণ না করা যায় তাই প্রতি ব্যানার ও পোস্টারের ডান দিকে একটা বিদ্যুৎ ঝলকের চিহ্ন কয়েক সেকেন্ড বাদে বাদেই বদলে যাচ্ছে একটা জিজ্ঞাসা চিহ্নে। প্রকারান্তরে হ্যারি পটারকেই যে প্রশ্ন চিহ্নের মুখে দাঁড় করানো হচ্ছে এটা তারই প্রতীক। জ্যান, জেমস কে জানিয়েছে বিতর্কের এই বিষয় নির্বাচন নিয়ে নাকি স্কুল ডিবেট কমিটি সারা রাত আলোচনা করে তবে এই বিষয়টাকে বেছে নিয়েছে। টাবিথা করসিকা ডিবেট কমিটির আলোচনা সভায় না থাকলেও ওর অনুগত ফিলিয়া গয়েল ওখানে উপস্থিত ছিল প্রধান রুপে।

জ্যানের উৎসাহ আরো বেড়ে গেছে কারণ যার বিষয়ে স্বয়ং পেট্রা বলেছে ও নাকি ডিবেটটা বেশ ভালই করতে পারে।

ব্যানারগুলো দেখে জেমসের রাগে গায়ের রক্ত গরম হয়ে যাচ্ছিল, বিশেষ করে ওই বিদ্যুতের ঝলকের চিহ্ন ওকে স্থির থাকতে দিচ্ছিল না। টেকনোম্যান্সি ক্লাসের দরজার বাইরে মই এ চড়ে র‍্যালফকে ব্যানার টাঙ্গাতে দেখে রাগটা শতগুনে বেড়ে গেল জেমসের।

‘আই ব্বাস!! র‍্যালফ তুই অত দূরে উঠতে পেরেছিস দেখছি,’ জেমস বললো একরাশ রাগ শব্দগুলোতে মাখিয়ে। ‘টাবিথা করসিকার হাত নিশ্চয় তোর পশ্চাৎদ্দেশটা ঠেলে তুলে দিয়েছে।’

জেমসের পাশে পাশেই হাঁটতে থাকা জ্যান অবস্থা গুরুতর দেখে মাথা নিচু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দ্রুত ক্লাসরুমে ঢুকে গেল। কথাটা বলার আগে পর্যন্ত র‍্যালফ জেমসকে দেখেইনি। নিচের দিকে তাকালো, মুখে একই সঙ্গে বিস্ময় ও কষ্টের ছাপ। ‘এসব কথার মানেটা কি ?’ জানতে চাইলো।

‘না মানে, বলতে চাইছি যে আমার মনে হচ্ছে তোর খুব কষ্টই হচ্ছে করসিকার হাতের খেলার পুতুলে পরিণত হয়ে।’ একটু আগে বলা কথাগুলো বলাটা যে ঠিক হয়নি এটা বুঝতে পেরেই জেমস এটা বললো। র‍্যালফের মুখের ভাব দেখে ওর নিজেরি লজ্জা লাগছে।

র‍্যালফ কিন্তু চুপ করে না থেকে ঘুরিয়ে জবাব দিলো। ‘তোদের দলের লোকেরাই তো পুতুল খেলার আসল পাপেট মাষ্টার। আতঙ্কের একটা মিথ্যে গল্প ছড়িয়ে দিয়ে দুর্বলদের কব্জা করে যত রাজ্যের অনৈতিক এবং অযৌক্তিক কাজ চালিয়ে যাছিস।’ যদিও সেরকম কোন আত্মবিশ্বাস ছিল না বলার মধ্যে। জেমস আর কথা না বাড়িয়ে ঢুকে পড়লো ক্লাস রুমে।

ডেস্কে চিরপরিচিত স্থানে প্রফেঃ জ্যাক্সন কে দেখা গেল না। সামনের বেঞ্চে জ্যানের পাশেই বসলো জেমস। তার পরই কাছে বসে থাকা গ্রিফিন্ডোরদের জোকস বলে হাসানোর চেষ্টা শুরু করলো। ও করেই জানে যে র‍্যালফ নিশ্চিত ভাবে ওর গতিবিধি লক্ষ্য করছে দরজা দিয়ে। এই নিচু মানসিকতার খেলাটা খেলে জেমসের কোন লাভ হচ্ছিল না তবু বিকৃত একটা আনন্দ ও পাচ্ছিল এটা করে।

সহসাই ক্লাসের গুঞ্জন থেমে গেল। জেমস তাকিয়ে দেখল প্রফেসর জ্যাক্সন ঢুকছেন। বগলের তলায় চেপে কিছু একটা ধরে আছেন। জিনিষটা বেশ বড়, চ্যাপ্টা এবং কাপড় দিয়ে মোড়ানো।

‘গুড মর্নিং, ক্লাস,’ নিজস্ব উদ্ধত ভঙ্গিতেই বললেন। ‘তোমাদের লেখা গত সপ্তাহের নিবন্ধগুলির মূল্যায়ন করা হয়ে গেছে। ওগুলো এই মুহূর্তে আমার সামনে ডেস্কে রাখা আছে। মিঃ মারডক একটু কষ্ট করে ওগুলো যার যার তাকে দিয়ে দিতে পারবে? সব মিলিয়ে আমি খুব একটা হতাশ হইনি এটা বলতে পারি। যদিও আমার মনে হয় তোমরা স্বস্তি পেতে পারো এটা ভেবে যে হগওয়ারটসে সাধারণত একটু ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে লেখার ওপর সে ভাবে গুরুত্ব দিয়ে মূল্যায়ন করা হয় না।’

এবার জ্যাক্সন বগলের কাছে ধরে থাকা জিনিষটাকে সাবধানে ডেস্কের ওপর রাখলেন। মোড়ানো কাপড়টা খুললেন। জেমস দেখতে পেল তিনটে ছোট মাপের পেইন্টিং। সহসাই সেভেরাস স্নেপের পোরট্রেটের কথা মনে পড়ে যেতেই ও টানটান হয়ে বসলো।

জ্যাক্সন গম্ভীরভাবে বললেন, ‘মনে আছে নিশ্চয় আজ নোটস নেওয়ার দিন। অতএব রেডি হয়ে যাও।’ পেইন্টিং তিনটেকে উনি চক বোর্ডের সঙ্গে থাকা সেলফে পর পর রাখলেন। প্রথম ছবিটা একজন রোগা টাকওলা মানুষের। যার চোখে প্যাঁচার চোখের মতো চশমা। ক্লাসের দিকে তাকিয়ে উনি চোখ পিটপিট করলেন। আচরনে উদ্বিগ্নতার ছাপ। মনে হচ্ছে যে কোন মুহূর্তে এসে পড়তে পারে এবং ওকে চমকে দিতে পারে এরকম কারোর প্রতীক্ষা করছেন। পরের ছবিটায় কেউ নেই শুধু প্রেক্ষাপটে অরণ্যেরআভাস। শেষ ছবিটায় সাদা রঙ মাখা মুখের এক জোকার যার হাসিটা আঁকা হয়েছে বিরাট করে লাল রঙ দিয়ে। জোকারটা মাঝে মাঝে ক্লাসের দিকে তাকাচ্ছে আর ছোট্ট একটা বেতের লাঠির ডগায় একটা বলকে নাচাচ্ছে। জেমস চমকে উঠলো এটা দেখে যে বলটা আসলে জোকারটার নিজের মাথারই ক্ষুদ্র রুপ।

মারডক ক্লাসের সবাইকে যার যার নিবন্ধ লেখা কাগজ বিলিয়ে দিয়ে নিজের আসনে গিয়ে বসলো। জেমস নিজের নিবন্ধটার দিকে তাকালো। প্রথমেই প্রফেঃ জ্যাক্সনের সামান্য বাঁদিকে কাত হওয়া হস্তাক্ষরে লেখা, “উৎসাহব্যঞ্জক নয় কিন্তু সামগ্রিক ভাবে ভাবনাটা বেশ শক্তিশালী। গ্রামারের দিকটা নিয়ে ভাবতে হবে।”

‘নিয়ম অনুসারে, মূল্যায়ন বিষয়ে কোন প্রশ্ন থাকলে আমায় লিখিত ভাবে জানাতে হবে। আর তার থেকে বেশি কোন আলোচনার দরকার হলে স্কুল চলাকালীন সময়ে আমার সঙ্গে দেখা করবে। আশা করি আমার অফিসটা কোথায় তোমরা জানো। এবার চলো শুরু করা যাক নতুন পাঠ।’জ্যাক্সন ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন ছবি তিনটের দিকে। ‘তোমাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো মনে আছে। ’ জ্যানের দিকে শুঁয়োপোকারমতো ভুরুর নিচের চোখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে বললেন, ‘প্রথম দিনের ক্লাসে, একটা ছোট্ট আলোচনা করেছিলাম মিঃ ওয়াকারের সৌজন্যে। ম্যাজিক্যাল আর্টের চরিত্র বিষয়ে। বলেছিলাম আর্টিস্টের ইচ্ছাকৃত মনোযোগ থাকে ছবিতে এক বিশেষ মাত্রার গতি ও ভাব ফুটিয়ে তোলার জন্য। এর জন্য দরকার হয় ম্যাজিক্যাল সাইকো-কাইনেটিক পদ্ধতির সহযোগিতা। যা ক্যানভাসে শিল্পীর ইচ্ছাকে রুপ দিতে পারে। ঠিকঠাক সে কাজ করতে পারলেই আঁকাটি নড়াচড়া করে এবং নকল করে জীবনের ছন্দ। অবশ্যই আর্টিস্টের ইচ্ছানুসারে। আজ আমরা এক সম্পূর্ণ অন্য ধরনের অঙ্কন কলার সঙ্গে পরিচিত হবো, যা জীবনকে এক অন্যরকমের মাত্রায় পরিবেশিত করে।’

গোটা ক্লাস দ্রূত গতিতে নোট নেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছিল জ্যাক্সনের এক তরফা বক্তব্যর সঙ্গে তাল মিলিয়ে। প্রফেসর যথারীতি তার পাইচারি চালিয়ে যাচ্ছিলেন বিষয়টা বোঝাতে বোঝাতে।

‘ম্যাজিক্যাল পেইন্টিং এর দুধরনের রুপ দেখা যায়। যার প্রথমটা, আমি সেদিন ক্লাসে যা দেখিয়েছিলাম তারই উন্নতরুপ। যেখানে আর্টিস্টের কল্পনাশক্তি দিয়ে সৃষ্ট আঁকার ওপর কিছু ম্যাজিক প্রয়োগ করা হয়। যার ফলে সেই আঁকাগুলো নড়াচড়া করতে পারে। মাগলদের আঁকার সঙ্গে কেবলমাত্র এটাই পার্থক্য। এই যে ম্যাজিক্যাল এফেক্ট নির্ভর করে উইচ বা উইজার্ডের ইচ্ছের ওপর। নির্দিষ্ট কিছু বাঁধা ধরা নিয়ম বা সীমাবদ্ধতা থাকে সেখানে। আমাদের বন্ধু মিঃ বিগল এখানে উদাহরণ রুপে আছেন।’ জ্যাক্সন জোকারের ছবিটার দিকে ইশারা করলেন। ‘মিঃ বিগল বিষয়ে আমাদের স্বস্তির কারণ এই যে ঊনাকে আঁকা হয়েছে কল্পনা থেকে। অর্থাৎ বাস্তব জগতে ওর অস্তিত্ব কোনোদিন ছিল না।’ জোকারটা শিক্ষার্থীদের দিকে তাকিয়ে একবার লাফালো। সাদা গ্লাভস পড়া একটা হাতের আঙ্গুলগুলো এবং অন্যহাতের বেতের লাঠিটাকে নাড়ালো। ছোট্ট জোকারের মাথাটা জিভ ভেংচালো এবং চোখ পিটপিট করলো। জ্যাক্সন কিছুক্ষনের জন্য থেমে ওগুলো দেখলেন এবং পুনরায় পাইচারী শুরু করলেন।

‘দ্বিতীয় ধরনের ম্যাজিক্যাল পেইন্টিং আরো বেশি আকর্ষণীয়। এর সৃষ্টি নির্ভর করে উন্নত মন্ত্রবিদ্যা আর জাদুতরল মেশানো রঙ এর ওপর। এখানে আঁকা হয় কোন জীবিত মানুষ বা প্রানীর ছবি। এই ধরনের পেইন্টিংকে টেকনোম্যান্সির ভাষায় বলা হয় ইমাজো এইতাস্পেকুলাম, যার মানে হলো …… কারোর জানা আছে?’

পেট্রা হাত তুললো, জ্যাক্সন ইশারা করলেন বলার। ‘স্যার এর অর্থ, আমার মনে হয়, আয়নায় জীবন্ত প্রতিচ্ছবি, তাই না?’

জ্যাক্সন এর উত্তরটা পছন্দ হয়েছে বলেই মনে হলো। ‘অর্ধেকটা ঠিক বলা যেতেই পারে। গ্রিফিন্ডোরের জন্য পাঁচ পয়েন্ট। ঠিকঠাকভাবে বললে এর সংজ্ঞা এরকম, “এক ধরনের ম্যাজিক্যাল পেইন্টিং যা কোন এক জীবিত কিছুর প্রতিরুপকে নির্মাণ করে। বিশিষ্ট এইটাস বা সময়সারনীর বাধা মেনে নিয়ে। আর সেই সময়টা নির্দিষ্ট থাকে যাকে আঁকা হচ্ছে তার জীবনকালের ভিত্তিতে।” এর ফলে যে পেইন্টিংটা সৃষ্টি হয় সেটা মূল চরিত্রটির জীবিত থাকার প্রমান দিতে না পারলেও, ওই চরিত্রটির সমস্ত বুদ্ধিমত্তা এবং চারিত্রিক গুণাবলী তুলে ধরতে সক্ষম হয়। এমন কি ইমোশন পর্যন্ত। যার ফলে ওই ছবির চরিত্রটির নতুন কিছু শিখতে পারে না বা নিজেকে উন্নত করতে পারে না তার মৃত্যু পরবর্তী সময়ে ঘটতে থাকা ঘটনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে। কিন্তু জীবদ্দশায় সে যেমনটা ছিল মরনের পরেও তার ছবি সেই আচরণ করতে বা সেই ধরনের কথাবার্তা বলতে সক্ষম হয়। এখানে আমাদের কাছে আজ উদাহরণ স্বরুপ আছেন মিঃ করনেলিয়াস ইয়ারো।’

জ্যাক্সন এবার ইঙ্গিত করলেন রোগা উদবিগ্ন মানুষটার ছবির দিকে। ইয়ারো জ্যাক্সনের ইশারা করা দেখে কিছুটা থতমত খেয়ে গেছেন। ওদিকে মিঃ বিগলস তার ফ্রেমের মধ্যে নাচানাচি শুরু করে দিয়েছেন মনোযোগটা নিজের দিকে ফেরানোর জন্য।

মিঃ ইয়ারোর কন্ঠস্বর ওনার শরীরের মতই মৃদু, কিন্তু একইসঙ্গে উচ্চমাত্রার আনুনাসিক। ‘বিশে সেপ্টেম্বর উনিশশো উনপঞ্চাশ। আমার বয়স সাতষট্টি বছর তিনমাস, আটষট্টিই বলা যায়।’

‘বেশ – আমি যদি জানতে চাই –আপনার পেশা কি ছিল?’

‘আমি হগওয়ারটস এর স্কুল কোষাধক্ষ্য ছিলাম বত্রিশ বছর ধরে,’ মানুষটি উত্তর দিলেন নাক সিটকে।

জ্যাক্সন এবার ছবিটার দিকে ঘুরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আর এখন আপনি কি করেন?’

ছবির মানুষটি চোখ পিটপিট করে বললেন, ‘এক্সকিউজ মি?’

‘মানে বলতে চাইছি যে এখন তো অঢেল সময় আপনার হাতে। উনিশশো উনপঞ্চাশ তো অনেক দিন আগের ব্যাপার। আপনি সময় কাটান কিভাবে মিঃ ইয়ারো? আপনার কি বিশেষ কোন শখ আছে?’

ইয়ারো প্রশ্নটা শুনে থমকে গিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরলেন। ‘আমি… শখ? সে অর্থে আ… আমার কোন বিশেষ শখ নেই। তবে আমি …আমি সংখ্যাদের খুব পছন্দ করি। আমি আমার কাজ নিয়ে ভাবতে ভালো বাসি। যখনই আমি হিসাবপত্রের সংস্পর্শে না থাকি তখনই আমি ওদের নিয়ে ভাবি। আমি বাজেট নিয়ে ভাবি, ওতে থাকা সংখ্যা নিয়ে ভাবি। আর সে সবই করি আমার মাথার মধ্যে।’

জ্যাক্সন চরিত্রটির দিকে একভাবে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘আপনি এখনো সংখ্যাদের কথা ভাবেন? আপনি আপনার সময় ব্যয় করেন স্কুল বাজেটের জন্য হিসাবনিকাশে? কারণ টা আশা করি বুঝতে পারছো তোমরা। ওনার সময়টা আটকে আছে উনিশশো উনপঞ্চাশে। ’

ইয়ারোর দৃষ্টি গোটা ক্লাসটাকে একবার দেখে নিলো। মনে হচ্ছে উনি বুঝতে পারছেন উনি কোথাও একটা আটকে গেছেন। ‘ইয়ে। হ্যাঁ। হ্যাঁ, আমি সেটাই করি। আশা করি বুঝতে পারছেন আমি কেবলমাত্র ওটাই করি। যেটা আমি সবসময় করে এসেছি। কোন কারণতো দেখছি না ওটাকে বন্ধ করার। আমি কোষাধক্ষ্য বললামই তো। মানে একসময় ছিলাম তো। কোষাধক্ষ্য।’

‘অনেক অনেক ধন্যবাদ মাননীয় মিঃ ইয়ারো। আমি আমার বক্তব্যের অনেক কিছুই খোলসা করে দিয়েছেন,’ জ্যাক্সন বললেন, পুনরায় ক্লাসের দিকে মনোযোগ ফিরিয়ে।

ইয়ার কিছুটা কাঠকাঠ ভাবে বললেন, ‘ধন্যবাদ, খুশী মনে সবসময় আছি সাহায্য করার জন্য।’

জ্যাক্সন এবার ক্লাসের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘মিঃ ইয়ারোর এই ছবি তোমরা সম্ভবত জানো হেড মিস্ট্রেসের ঘরের বাইরের অংশে আরো অনেক স্কুল শিক্ষক অশিক্ষক কর্মচারীদের ছবির সঙ্গে ঝোলানো থাকে। বিশেষ চেষ্টায় আজ আমি পেয়েছি নিয়ে আসতে পেরেছি মিঃ ইয়ারোর বাড়িতে থাকা আরো একটি পোর্ট্রেট। আর সেটা হ্যাঁ তোমাদের অনুমান সঠিক ওই মধ্যে টাঙানো ছবিটাই সেটা। ‘মিঃ ইয়ারো আপনি যদি দয়া করে একটু?’ জ্যাক্সন ফাঁকা ছবিটার দিকে ইশারা করলেন।

ইয়ারো ভ্রু উঁচু করলেন। ‘হুম? ওহ। হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই।’ উনি নড়লেন, থমকে দাঁড়ালেন, গা থেকে কিছু অদৃশ্য নোংরা ঝেড়ে ফেললেন তারপর ফ্রেম ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। কিছু সেকেন্ডের জন্য দুটো ছবি ফাঁকা থাকলো, তারপরেই মিঃ ইয়ারোকে দেখা গেল মধ্যের ফ্রেমটার ভেতর। এবার উনার পরনে সামান্য আলাদা রকমের পোষাক। উনি বসলেন ওখানকার একটা চেয়ারে। এমনভাবে যাতে ওকে প্রোফাইলে বা পাশ থেকে দেখা যায়।

‘আর একবার ধন্যবাদ মিঃ ইয়ারো।’জ্যাক্সন বললেন, ডেস্কে হেলান দিয়ে বুকের কাছে হাত দুটো জড়ো করে। ‘যদিও কিছু ব্যতিক্রম আছে, তবে সাধারণত, এধরণের একটি ছবি সক্রিয় হয় তখনই যখন মূল চরিত্র এ জগত থেকে বিদায় নেন বা মারা যান। টেকনোম্যান্সি এর কোন ব্যাখ্যা আমাদের দেয় না, শুধু জানায় এটির কারণ ল অফ কন্সারভেশন অফ পারসোনালিটিজ। অন্যভাবে বললে, একজন মিঃ কর্নেলিয়াস ইয়ারো যে কোন সময়ে, ইউনিভারসালি, তার যেকোনো …’ একটা চাপা হাসি গোটা ঘরে শোনা গেল। ইয়ারো ভ্রু কুঁচকে তাকালেন। জ্যাক্সন বলে চললেন, ‘যেকোনো ছবির ভেতর যেতে পারেন। আর এটাই একটা ম্যাজিক্যাল ব্যাপার। যা বিশেষ কার্যকরী ভুমিকা নেয় পোর্ট্রেটগুলির মধ্যে সম্পর্ক গঠনে। যদি কখনো কোন একটি চরিত্রের একাধিক ছবি আঁকা হয় এই বিশেষ পদ্ধতিতে তাহলে ছবিগুলি একে ওপরের সঙ্গে বিশেষ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যায়, যাদের একটিই মাত্র মূল চরিত্র থাকে। যার ফলে কোন একটি ছবির মূল চরিত্র তার নিজ ইচ্ছানুসারে যখন যে কোন ছবির মধ্যে যেতে পারে। যেমনটা এখানে ঘটলো, মিঃ ইয়ারো আমাদের সঙ্গে হগওয়ারটসে দেখা করে ওনার নিজের ইচ্ছা প্রয়োগ করে বাড়ির ছবিটার মধ্যে চলে গেলেন।’

জ্যাক্সনের বলা সমস্ত বক্তব্য লিখতে জেমসের বেশ সমস্যাই হচ্ছিল। কিন্তু করার কিছু নেই এগুলো নোট না করতে পারলে টেস্ট পরীক্ষার সময় আর বড় সমস্যা হবে। কারণ জ্যাক্সন তার বলা বক্তব্য থেকেই প্রশ্ন সেট করেন। জেমসের ভাবনা বিক্ষিপ্ত হলো পুনরায় সেভেরাস স্নেপের পোর্ট্রেটের কথা ওর মনে এসে যেতেই। জেমস হাত তুললো, এছাড়া করারও কিছু নেই ওর কাছে।

জ্যাক্সন সেটা দেখে ভ্রু কপালে তুলে বললেন, ‘প্রশ্ন করতে চাও মিঃ পটার?’

‘হ্যাঁ স্যার। কোনো একটি পোরট্রেটের চরিত্র কি তার নিজের ফ্রেম ছেড়ে যেতে পারে? মানে অন্য কারো ছবির ফ্রেমে?’

ভ্রু কপালে উঁচিয়ে রেখেই জ্যাক্সন কিছুক্ষন জেমসকে দেখলেন। ‘দারুন একটা প্রশ্ন, মিঃ পটার। দেখাই যাক সেটা সম্ভব কিনা ? মিঃ ইয়ারো আর একটিবার আমরা আপনার সাহায্য চাই, করবেন কি?’

ইয়ারো দ্বিতীয় পোরট্রেটের বিশেষ বসার ভঙ্গীটা, যেটা দেখে ওনাকে চিন্তাশীল এবং পাঠক বলে মনে হচ্ছে, বজায় রেখে একটু মাথা ঘোরালেন। চোখের দৃষ্টি ঘুরলো জ্যাক্সনের দিকে। ‘মনে হয় আমি করতে পারবো। কি ধরনের সাহায্য দরকার?’

‘আপনি কি লক্ষ্য করেছেন আপনার বাম দিকে একটি ছবি টাঙানো আছে? মিঃ বিগলসের।’

মিঃ বিগলস নিজের নামটা শুনতে পেয়ে দারুন ভাবে চমকে যাওয়ার ভাবভঙ্গী করে উঠলেন। এক হাত দিয়ে চোখ মুখ চেপে ধরে চোখ বিস্ফারিত করলেন উনি। আর লাঠির মাথায় থাকা পুঁচকে জোকারের মাথা হেসে উঠে মুখ থেকে ভর ভর করে র‍্যাস্পবেরির দানা বার করে চার দিকে ছিটিয়ে দিলো। ইয়ারো একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘হ্যাঁ আমি ওটা দেখেছি।’

‘স্যার, অনুগ্রহ করে কিছুটা সময়ের জন্য আপনি কি ওই পেইন্টিংটার মধ্যে যেতে পারবেন?’

ইয়ারো জ্যাক্সনের দিকে বড়বড় চোখ করে তাকালেন চশমার পেছন থেকে, বললেন, ‘যদিও বা সেটা সম্ভব হয় তবু আমার বিশ্বাস হয় না আমি ওই ব্যক্তিটির সঙ্গে একত্র থাকতে পারবো। আমায় ক্ষমা করবেন।’

জ্যাক্সন সামান্য মাথা ঝুঁকিয়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে চোখ মুদলেন। ‘ধন্যবাদ। না আমি আপনাকে দোষ দেব না, মিঃ ইয়ারো। তাহলে আমরা দেখলাম একটা আরো শক্তিশালী ম্যাজিকের দরকার ইমাজো এইতাস্পেকুলামের জন্য। এটা সেইভাবে ডিজাইন করা হয়নি যাতে একটি প্রকৃত মানুষের পোর্ট্রেট এর চরিত্র অন্য একটি কাল্পনিক বিষয়ের ছবিতে প্রবেশ করতে পারে। বলতে পারো এটা অনেকটা সেইরকম যেখানে তুমি একটা ম্যাজিকহীন দরজার ছবি এঁকে সেটা খুলে ঢোকার চেষ্টা করছো। অবশ্য অন্য একটা দিকও আছে। সেটাই এবার দেখি। মিঃ বিগলস!’ জোকারটি নিজের নাম শুনে লাফিয়ে উঠে অতিরিক্ত মনোযোগের ভঙ্গী নিয়ে জ্যাক্সনের দিকে তাকালো। মধ্যের ছবিটার দিকে হাত তুলে জ্যাক্সন বললেন, ‘আপনি কি মিঃ ইয়ারোর সঙ্গে ওই ছবির মধ্যে জায়গা ভাগ করে নিতে পারবেন ?’

করনেলিয়াস ইয়ারো চমকে গেলেন প্রথমে তারপর আতঙ্কিত হলেন কারণ জোকারটি নিজের ছবি থেকে বেরিয়ে ঢুকে পড়লো ওনার ছবিতে। উপস্থিত হল ইয়ারোর চেয়ারের পেছনে। শুধু তাই নয় চেয়ারটাকে ধরে এতো জোরে ঝাঁকুনী দিলো যে ইয়ারো আর একটু হলে পড়েই যেতেন। আর্তচিৎকার করে উঠলেন। বিগলস নিজের মাথাটা ইয়ারোর বামকাঁধের ওপর দিয়ে সামনের দিকে বের করে আনতেই। পুঁচকে জোকারের মাথাটা এইসময় ওর ডানদিকের কানের মধ্যে র‍্যাস্পবেরীর দানা ছিটিয়ে দিলো।

‘প্রফেসর জ্যাক্সন!’ ইয়ারো উচ্চমাত্রার কম্পিত কাতরস্বরে ডাক ছাড়লেন এবং তারপরেই অতিক্ষীন কণ্ঠে বললেন, ‘আমি আপনাকে বাধ্য করতে চাইছি…এই পাগলটাকে আমার ছবির মধ্যে থেকে এইমুহূর্তে বিদায় করুন!’

গোটা ক্লাস হোহো করে হেসে উঠলো বিগলসের আচরণ দেখে। কাঁধের ওপর দিয়ে ফুড়ুত করে লাফিয়ে গিয়ে বসলো মিঃ ইয়ারোর কোলে। দুহাতে সরু গলাটাকে বেড় দিয়ে ধরলো। লাঠির ওপরের জোকারের মুণ্ডুটা ওদিকে শুরু করেছে ইয়ারোর নাকে চুমু খাওয়া। ‘মিঃ বিগলস,’ জ্যাক্সন চিৎকার করে উঠলেন, ‘যথেষ্ট হয়েছে। এবার আপনি নিজের ছবির ফ্রেমে ফিরে যান।’

জোকারটিকে দেখে মনে হলো সে এই আদেশে পাত্তা দিতে নারাজ। ইয়ারোর কোল থেকে নেমে লুকালো চেয়ারের আড়ালে। উঁকি মারলো ডানকাঁধের ওপর দিয়ে, আর পুঁচকে জোকারের মাথাটা ওর ডানদিক থেকে। ইয়ারো ঘুরে সন্ত্রস্তভাবে জোকারটিকে দেখছিলেন। মনে হচ্ছিল ওটা একটা মাকড়সা যাকে উনি ছুঁতে চাননা কিন্তু মেরে ফেলতে চান। জ্যাক্সন এবার তার জাদুদন্ড বার করলেন – একটা বারো ইঞ্চি লম্বা হিকোরী– তাক করলেন জোকারটার ছবির ফাঁকা ফ্রেমটার দিকে। ‘মিঃ বিগলস আপনি কি চান আমি আপনার ছবির প্রেক্ষাপটটা বদলে দিই? আপনি দ্রুত ওখানে ফিরে যান। নাহলে আমি ওই জায়গাটা কাঁটার ঝোপ দিয়ে ভর্তি করে দেবো। সেটাই কি চান?’

জোকারটা রঙমাখা ভুরু কুঁচকে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো। তারপর ইয়ারোর ছবি থেকে বেরিয়ে এসে হেলেদুলে নিজের ফ্রেমে ফিরে গেল।

‘একটা খুব সাধারণ নিয়ম,’ জ্যাক্সন বললেন, একইসঙ্গে তাকিয়ে দেখলেন জোকারটা ওকে ভেংচি কাটছে। ‘এখানে দেখা গেল, যে, একমাত্রার ব্যক্তিত্ব অতিসহজে দুমাত্রার ব্যক্তিত্বের আবহাওয়াতে ঢুকতে পারে, কিন্তু উল্টোটা সম্ভব নয়। কোনোসময়ে জীবিত ছিল এমন মানুষ তার নিজের ফ্রেমগুলোর মধ্যেই আবদ্ধ। কিন্তু কল্পনার চরিত্ররা ইচ্ছেমতো যেখানে সেখানে যেতে পারে। আমার মনে হয় তুমি তোমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছো মিঃ পটার?’

‘ইয়েস স্যার,’ জেমস জবাবটা দিয়েই আর একটা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো। ‘আর একটা বিষয় স্যার। কোনোভাবে কি একটি চরিত্র একই সঙ্গে তার একাধিক ফ্রেমে উপস্থিত হতে পারে?’

জ্যাক্সন একইসঙ্গে হাসলেন এবং ভ্রুকুঞ্চিত করলেন। ‘এই বিষয়টা নিয়ে তোমার জানার আগ্রহের মনে হচ্ছে কোন সীমাপরিসীমা নেই মিঃ পটার। আমি বলতেই পারি, যে হ্যাঁ সেটা সম্ভব, যদিও সেই ঘটনা খুবই বিরল। মহান জাদুকরদের অনেক অনেক পোর্ট্রেট বানানো হয়েছে। তাদের মধ্যে কেউ কেউ নিজের পারসোনালিটি বিভক্ত করার কৌশল জানতেন বা জানেন। সেই সুযোগটা কাজে লাগিয়ে এটা করতে পারেন। আর সেটা তোমাদের চেনা একটি মানুষ প্রায় করেন। আশাকরি অনুমান করতে পারছো তিনি হলেন আলবাস ডাম্বলডোর। এই ঘটনাটি ঘটানো খুবই কঠিন। কারণ অনেক সুক্ষ মাপ এক্ষেত্রে কাজ করে, যাকে নিয়ন্ত্রন করা উইচ বা উইজার্ডের দক্ষতার ওপর নির্ভরশীল। আর কিছু জানার আছে মিঃ পটার?’

‘প্রফেসর জ্যাক্সন স্যার ?’একটা অন্যকন্ঠ এবার শোনা গেল। জেমস মাথা ঘুরিয়ে দেখলো, ফিলিয়া গয়েল হাত তুলেছে।

‘ইয়েস মিস গয়েল ?’

‘আমার বোঝাটা যদি সঠিক হয় তার মানে এটাই দাঁড়ায় যে জীবিত চরিত্র যা যা জ্ঞান লাভ করেছিল সবই পোর্ট্রেট এর জ্ঞান সীমায় থাকে, তাই তো?’

‘আমার ও বিশ্বাস সেটাই মিস গয়েল। পোর্ট্রেট সেই ব্যক্তিত্ব, জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতাই ফুটিয়ে তোলে যা জীবদ্দশায় আসল মানুষটির ছিল। একটুও বেশি বা কম প্রদর্শিত হয় না।’

‘তার মানে কি এটাই যে একটি পোর্ট্রেট আসলে একটি চরিত্রকে আসলে অমর করে দেয়?’ ফিলিয়া জানতে চাইলো চিরন্তন কাঠিন্য ভরা ভাবলেশহীন মুখে।

‘আমি মনে হচ্ছে মিস গয়েল তুমি দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়েছো যা প্রকাশিত হচ্ছে এবং আসলে জিনিষটা যা এই দুই এর মধ্যে,’ ফিলিয়ার দিকে একভাবে চেয়ে থেকে জ্যাক্সন বললেন। ‘এই দ্বিধার কারনেই একজন উইচ বা উইজারড বাস্তবিক ক্ষেত্রে সাঙ্ঘাতিক রকমের ভুল করে ফেলে। এটা বলা যেতেই পারে অনেক পরিমাণ ম্যাজিক এবং অনেক পরিমানে জীবন বাস্তবিকক্ষেত্রে নির্ভরশীল হয়ে থাকে প্রাথমিক ভাবে তৈরী করা বিভ্রমের ওপর। চরম বাস্তব থেকে বিভ্রমকে আলাদা করার ক্ষমতা অর্জন করার জন্যই আমাদের টেকনোম্যান্সির ভিত্তিগত সূত্রাবলী পড়তে হয়। একটা পোর্ট্রেট আসলে কোনো সময়ে জীবিত কোন এক মানুষের নেহাতই একটা প্রতিচ্ছবি, যাকে তুলনা করা যেতেই পারে তোমার ছায়ার সঙ্গে যা সব সময়েই তোমার সঙ্গে থাকে কিন্তু সে জীবিত নয়। না, কোনোভাবেই এই ছবি একদা এই জগত থেকে বিদায় নেওয়া মানুষটার আয়ুকে প্রলম্বিত করে না। সব রকমের প্রায় বাস্তব উপস্থিতি সত্বেও একজন উইজারডের পোর্ট্রেট বা আর কোনও ম্যাজিক্যাল পেইন্টিং আসলে ক্যানভাসের ওপর আঁকা একটা ছবি ছাড়া আর কিছুই নয়।’

জ্যাক্সন কথা শেষ করে মিঃ বিগলস এর ছবিটার দিকে ঘুরলেন। দ্রূত নিজের জাদুদন্ডটা বার করে ছবিটার দিকে তাক করলেন। হলদে রঙের একটা তরল পদার্থ ধেয়ে গেল জাদুদন্ডর মাথা থেকে। ছড়িয়ে পড়লো গোটা ছবিটার ওপর। কিছুক্ষনের মধ্যেই গোটা ছবিটা ঝাপসা হতে শুরু করলো। থেমে গেল বিগলসের নড়াচড়া। একসময় সব রং গলে নিচে নেমে গেল। গোটা ঘরে ছড়িয়ে গেল তারপিন তেলের উগ্র গন্ধ। পুরো ক্লাস নিস্তব্ধ হয়ে রইলো।

প্রফেঃ জ্যাক্সন ধীরে ধীরে ডেস্কের কাছে ফিরে এলেন। ‘অল্প বয়সে আমি নিজে আর্টিস্ট হওয়ার একটু চেষ্টা করেছিলাম,’ জাদুদন্ডটির প্রান্তদেশটি দেখতে দেখতে বললেন। ‘মিঃ বিগলস, যে মাত্রার বদমাইশ, আমার এই কাজটাও সেই অন্যতম মাত্রার ভালো ছবির একটি ছিল। তোমরা যা খুশী কল্পনা করতেই পারো কি ধরনের জীবন পরিস্থিতিতে আমি এরকম একটি ছবি আঁকতে বাধ্য হয়েছিলাম। আসল কারণটা আমি নিজেই ভুলে গিয়েছি। মিঃ বিগলস এর কথাও আমি ভুলে গিয়েছিলাম। এখানে আসার আগে জিনিষপত্র গোছাতে গিয়ে ওটাকে খুঁজে পাই। আমার মনে হয়,’ উনি ছবিটার দিকে আবার তাকালেন। যেটা থেকে এইমুহূর্তে গলে যাওয়া রঙ টপ টপ করে মেঝেতে পড়ছে। ‘এরকম কিছু একটা অনেক আগেই করা উচিত ছিল।’

জ্যাক্সন ডেস্কে বসলেন, সামনে সাবধানে রাখলেন জাদুদন্ডটা। ‘এবার বলো দেখি এতক্ষন আমি যা তোমাদের দেখালাম সেখান থেকে কোন টেকনোম্যান্সি সত্য আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হল।’

কাউকে নড়তে দেখা গেল না প্রাথমিক ভাবে। তারপর একটি হাত উঠলো আস্তে আস্তে।

জ্যাক্সন মাথা তুলে বললেন, ‘মিঃ মারডক?’

মারডক গলা ঝেড়ে নিয়ে বললো, ‘স্যার বুঝলাম যে টেকনোম্যান্সির শিক্ষক হতে চাইলে আর্টিস্ট হওয়ার চেষ্টা করার কোন দাম নেই।’

‘মিঃ মারডক আমি কিন্তু এই উত্তরটা আশা করিনি। তবে হ্যাঁ স্বীকার করতেই হবে তোমার কথাটা খুব সত্যি। আসলে আমি যে সত্যিটা বোঝাতে চেয়েছি তা হলো, যখন কোন উইজার্ড কিছু আঁকবেন সেটা পোর্ট্রেট বা যাই হোক না কেন। যা কেবলমাত্রই ক্যানভাসের ওপর একটা পেইন্টিং… ’ জ্যাক্সন গোটা ক্লাসটার ওপর চোখ বুলিয়ে এসে দৃষ্টি থামালেন জেমসের ওপর। ‘…তবু সেটা নষ্ট বা ধ্বংস করার অধিকার থাকে শুধু মাত্র সেই আর্টিস্ট এর যে ওটা এঁকেছে। আর অন্য কেউ বা কোন কিছুর সেই অধিকার নেই। ক্যানভাস জীর্ণ হয়ে যেতে পারে, ফ্রেম নষ্ট হতে পারে, বাঁধন ছিঁড়ে যেতে পারে কিন্তু পেইন্টিং থেকে যাবে। ওই আঁকা তার বিষয়কে চিরন্তনভাবে সবার সামনে তুলে ধরবে, তা সে যাই করা হোক না কেন ওটার সঙ্গে। এমন কি একশো টুকরো করে কেটে ফেললেও ওটার বক্তব্য বদলাবে না। একমাত্র স্রষ্টা আর্টিস্ট এই বিশেষ ভাবটাকে নষ্ট করতে পারে। আর যখন এরকম কিছু করা হয় তখনই কেবলমাত্র ওই শিল্পটি চিরতরে বিলীন হয়ে যায়।’

ক্লাস শেষ হয়ে যাওয়ার পরে, জ্যাক্সনের নষ্ট করে দেওয়া ছবিটার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় জেমস কিছুক্ষনের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে যাওয়া থেকে নিজেকে আটকাতে পারলো না। ক্যানভাসের মাঝখানটায় জোকারটার মুখটা এখন একটা ধূসর কাদার মত রঙ এ পরিণত হয়েছে। ফ্রেমের নিচের অংশে সাদা আর রক্তলাল রঙের গলে যাওয়া রঙ দলা পাকিয়ে জমে আছে। বেশ খানিকটা রঙ চক রাখার ট্রের ওপর দিয়ে গড়িয়ে গিয়ে পড়েছে মেঝেতে।

গোটা শরীরে কাঁটা দিয়ে উঠলো জেমসের। এগিয়ে যেতে যেতে অর মনে হলো কোনো উইজার্ড পেইন্টিংয়ের এরকম শেষ পরিণতি ও আর দেখতে চায় না।

পরের ক্লাসে একটা পেইন্টিংয়ের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় সহসাই জেমস লক্ষ্য করলো ওর মধ্যে একজন শক্তসমর্থ চেহারার উইজার্ড, কালো গোঁফ চশমার ভেতর দিয়ে ওকে দেখছেন। ছবিটাতে অনেক উইজার্ড একত্রিত হয়ে একটি বিশাল মাপের গ্লোব পর্যবেক্ষণ করছেন। জেমস হাঁটা থামিয়ে ঝুঁকে তাকালো ছবিটার দিকে। উইজারডটির দৃষ্টি আরো কঠোর হলো। জেমসের শরীর ভেদ করে সব কিছু দেখার ইচ্ছে সে চোখে।

‘আপনার চিন্তা করার কোন কারণ নেই,’ জেমস শান্তভাবে বললো। ‘আমি আঁকতেই জানি না। ওসব জ্যান ভালো পারে।’

ছবির উইজার্ডটি মুখ কুঁচকালেন তবে বিরক্তির সাথে। বোঝাই গেল জেমস যে মূল বিষয়টা অনুধাবন করতে পারেনি এতে উনি বিরক্ত হলেন। অদ্ভুত রকমের একটা ঘোঁতঘোঁত শব্দ করে যেদিকে জেমস যাচ্ছিলো সেদিকেই ইশারা করলেন। সম্ভবত বলতে চাইলেন কেটে পড়ো এখান থেকে, এখানে দেখার মতো কিছু নেই।

জেমস এগিয়ে গেলো মন্ত্রের ক্লাস অভিমুখে। মনের মধ্যে ছবির উইজার্ড এর চিন্তা নিয়ে। খুব চেনা চেনা লাগছিল, কিন্তু ঠিকঠাক মনে করতে পারছে না। প্রফেসর ফ্লিটউইকের ক্লাসে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই ওর মনে থেকে মুছে গেল ছবির উইজারড এবং সেই অন্তর্ভেদী দৃষ্টির ভাবনা।

 

 

অবশেষে এসেই গেল বহু প্রতীক্ষিত বিতর্ক সভার দিন। জেমস অবাক হয়ে গেল দর্শক উপস্থিতির পরিমাণ দেখে। ওর ধারনা ছিল এই সব বিতর্কসভাতে খুব একটা মানুষ আসে না। যে দল অংশ গ্রহন করছে তারা ও তাদের সমর্থক, কিছু শিক্ষক শিক্ষিকা এবং কিছু অতি মাত্রায় পড়ুয়ার দলের আগ্রহ থাকে এসব ব্যাপারে। শুক্রবার লাঞ্চ এর সময় হতে না হতে বিতর্ক সভা নিয়ে এক দারুন মাত্রার উত্তেজনা অনুভব করা যাচ্ছিল সমগ্র আবহাওয়ায়। ঠিক যেন কোন বিশেষ কুইডিচ ম্যাচ হতে চলেছে। এসবের মধ্যে একটাই ব্যাপার শুধু অনুপস্থিত ছিল। আর সেটা হলো এক দলের সমর্থকদের অন্য দলের সমর্থক উদ্দেশ্যে করা বন্ধুত্বপূর্ণ টোন টিটকারীর চালাচালি। যদিও বুঝতে অসুবিধা হচ্ছেনা এর কারণ। বিতর্ক সভার প্রচারের সময়ে ওই বিশেষ ধরনের ব্যানার আর সাইন ব্যবহার করাটা পরিষ্কার ভাবেই শিক্ষার্থীদের দুটো দলে ভাগ করে দিয়েছে। যেটা আর কোন রকম প্রতিযোগিতা ক্ষেত্রেই হওয়া সম্ভব নয়। জেমস ভালোই বুঝতে পারছে এর ফলে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে তার প্রভাব হগওয়ারটসে পড়বেই। ঠিক এই কারণেই ওখানে যাওয়ার একটা তাগিদ ও অনুভব করছে। একই সঙ্গে একটা কৌতূহলও হচ্ছে। তাছাড়াও, জ্যান যদি উপস্থিত দর্শকদের সামনে হ্যারি পটারের পক্ষে বক্তব্য রাখে তাহলে তাকে সমর্থন করার জন্যও জেমসের ওখানে থাকা দরকার।

ডিনারের পর জেমস টেড সহ অন্য গ্রেমলিন সদস্যদের সঙ্গে রওনা দিল সভার উদ্দেশ্যে।

ডিবেট হয় অ্যাম্পি থিয়েটারে। যেখানে নাটক এবং কনসার্টের অনুষ্ঠানও হয়ে থাকে। জেমস আগে কোনোদিন অ্যাম্পি থিয়েটারে আসেনি। দুর্গের পূর্বদিকের টাওয়ারের পেছন দিকের পাহাড় কেটে ওটা বানানো হয়েছে। মাথার ওপর কোনো ছাদ নেই, মুক্ত মঞ্চর দিকে সিঁড়ির ধাপের মত বসার জায়গা নেমে গিয়েছে। জেমস বাকিদের পেছন পেছন ওপরের দিকের ধাপে বসার জন্য এগিয়ে চললো। মঞ্চ এখনো ফাঁকাই বলা চলে। একেবারে মধ্যে একটি হাইব্যাক চেয়ার রাখা হয়েছে। দুটি বক্তব্য রাখার বেদী এবং দুটি লম্বা টেবিল দুপাশে রাখা। দুটি টেবিলের পেছনেই কয়েকটা করে চেয়ার পাতা আছে। প্রফেসর ফ্লিটউইক একটি ফসফরাস গ্লোবকে তার জাদুদন্ড দিয়ে শূন্যে ভাসিয়ে দিচ্ছেন। আরো কয়েকটাকেও ভাসমান দেখা যাচ্ছে। যাদের আলো সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ছে মঞ্চের ওপর। অর্কেস্ট্রা বাজানোর জায়গাটাকে বড় কাঠের প্ল্যাটফর্ম দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে। সেখানে রাখা হয়েছে ছয়টি চেয়ার এবং একটি লাইব্রেরী টেবিল। জ্যান আগেই জানিয়েছিল ওখানে বিচারকরা বসবেন। উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে খুব একটা চিৎকার চ্যাঁচামেচি হচ্ছে না। যেটুকু হচ্ছে তাও রাত্রীকালীন অরণ্য ও পাহাড় থেকে ভেসে আসা শব্দে ঢেকে যাচ্ছে। টেড, সাব্রিনা ও ড্যামিয়েনের পিছু নিয়ে জেমস পৌঁছে গেল আসনের সারির মাঝখানটায়, যেখানে গ্রেমলিনের অন্য সদস্যরা বসে আছে। নোয়া আগে থেকেই ওখানে ছিল। ওরা আসন খুঁজে বসার সঙ্গে সঙ্গেই হাত নাড়লো জেমসের ঊদ্দেশ্যে।

‘গ্রেমলিন স্যালুট,’ কথাটা উচ্চারণ করে নোয়া সোজা ওদের দিকে তাকিয়ে দুহাত দিয়ে বেশ কিছু অঙ্গভঙ্গী করলো। যার মধ্যে ছিল কপালে হাত ঠেকিয়ে চিরন্তন স্যালুট। কনুই নাচিয়ে খানিকটা মুরগী নৃত্য এবং সবশেষে দুহাতের বুড়ো ও কড়ে আঙুল টানটান করে মাথায় থাকিয়ে গ্রেমলিনের কানের নকল দেখানো।

টেড মাথা ঝুঁকিয়ে এক হাত দিয়ে দিয়ে ওই কানের আকৃতি করে মাথায় ঠেকিয়ে প্রতি সম্ভাষণ করলো।

‘ট্রিপল ডবলু এর বন্ধুরা কি এসেছে?’

নোয়া মাথা ঝোঁকালো। একটু হেসে বল লো, ‘আমরা বিকেলে একটা ছোট্ট পরীক্ষার ব্যবস্থা করে ছিলাম গোপনে। কাজ করেছে আমাদের চিন্তার থেকেও বেশী ভালো ভাবে। জানিস বোধহয় ওরা ওটা কোন পারিশ্রমিক না নিয়েই দিয়েছে। জর্জ প্যাকেজের সঙ্গে একটা নোট পাঠিয়ে ছিল। লেখা ছিল, যেমনটা চেয়েছিলাম সেরকম ঘটলো কিনা সেটা যেন জানিয়ে দিই।’

টেড মজা করে বললো, ‘আমরা ওকে যেভাবেই হোক এক্কেবারে ফুল রিপোর্ট পাঠিয়ে দেব।’

জেমস টেডকে খোঁচা মেরে জানতে চাইলো, ‘ব্যাপারটা কি?’

‘এলিয়েন সোনা, তোমার কি কোন ধারনা আছে,’ টেড চারদিকটা একবার দেখে নিয়ে বললো, ‘প্লঊসিবল ডিনাইবিলিটি মানে কি হতে পারে?’

জেমস মাথা নেড়ে বললো, ‘না।’

‘তোর বন্ধু জ্যানকে জিজ্ঞাসা করে নিস। এটা আবিষ্কার করেছে আমেরিকানরা। একটা কথা আপাতত বলে রাখছি, কিছু কিছু সময় ঘটনা ঘটার আগে তার সম্বন্ধে কিছু জানতে না পারাটাই ভালো।’

জেমস কাঁধ ঝাঁকালো, বুঝতে পারলো বিশেষ কিছু একটা ঘটতে চলেছে। যেটা কেউ না জানুক বা বুঝুক গ্রেমলিনরা জানে। কাছেই একজন একটা ছোট্ট ওয়্যারলেস যন্ত্রে উইজারডিং ওয়্যারলেস নেটওয়ার্কটা চালু করলো। সামান্য একটা শব্দ বিশাল রুপ নিয়ে ছড়িয়ে গেল দিকে দিকে। যেন প্রচুর মানুষ একসঙ্গে চিৎকার করছে। জেমস শুধু শুনতে পেল একটা কথা “দর্শকে পরিপূর্ণ অ্যাম্ফিথিয়েটার”। জেমস তাকালো মুক্ত মঞ্চের কাছে জড় হওয়া মানুষগুলোর দিকে। একজন লম্বা মানুষ বেগুনী রঙের বোলার হ্যাট পড়ে জাদুদন্ডের মাথা মুখের কাছে এনে কথা বলছেন। কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই শব্দগুলো ধোঁয়ার দ্বারা লেখা হয়ে ওপরে উঠে যাচ্ছে ভাসতে ভাসতে। লোকটার কাছেই একটা ছোট্ট টেবিলে একটা যন্ত্র রাখা আছে যেটা দেখতে পুরানো দিনের বড় চোঙাওয়ালা রেকর্ড প্লেয়ারের মত। হাওয়ায় উড়তে থাকা শব্দগুলোকে ওই চোঙাটা টেনে নিচ্ছে। জেমস এর আগে কখনো ম্যাজিক্যাল ব্রডকাস্টিং সামনাসামনি হতে দেখেনি। ও শব্দগুলোকে পড়ছিল কাছেই চলতে থাকা ওয়্যারলেসটায় শুনতে পাওয়ার আগেই।

‘একই সঙ্গে কৌতূহলজনক এবং ঘটনাবহুল কিছু একটা অপেক্ষা করে আছে আজকের রাতের প্রতিযোগিতায়। বর্তমান সময়ে উইজার্ডিং জগতে জাদুমন্ত্রকের নিয়মকানুন এবং অরোরদের কাজকর্ম নিয়ে যে প্রশ্ন ইতিহাসকে ভিত্তি করে চারদিকে গুঞ্জিত হচ্ছে তার ছোঁয়া আমরা আজকের বিতর্কে দেখতে পাবো। আজ রাতে কারেন্ট উইজার্ডস নিউজ ওয়াচ এর বিশেষ এই সম্প্রচারে আপনারা জানতে পারবেন দেশের অন্যতম সেরা জাদুশিক্ষন কেন্দ্র এই বিশেষ বিষয়টি নিয়ে কি ভাবছে। আমি আপনাদের হোস্ট মিরণ ম্যাড্রিগ্যাল। আপনাদের কাছে এই সম্প্রচার উপস্থাপন করছি আমাদের স্পনসরার উইম্নটস ওয়ান্ড পালিস এবং এঞ্চ্যান্ট এনহ্যান্সার এর তরফ থেকে। মনে রাখবেন ভালো মন্ত্র সব সময় উইম্নটের জাদুদন্ড থেকেই প্রবাহিত হয়। কিছুক্ষনের মধ্যেই ফিরে আসছি উদ্বোধনী মন্তব্য শোনার জন্য। তার আগে কিছু জরুরী বিজ্ঞাপন।’

ঘোষক তার সহকারীর দিকে ইশারা করলেন। সহকারী চোঙাটাকে আর একটা বড় যন্ত্রের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে একটা রেকর্ড ঘোরানো শুরু করলো। উইম্নট ওয়ান্ড পালিস এর একটা বিজ্ঞাপন শোনা গেল এবারে ওয়্যারলেস সেটটাতে। গোটা জাদুজগত এই বিতর্কের প্রত্যেকটা শব্দ জানতে বা শুনতে পাবে বলে জেমস একটু চিন্তাতেই ছিল। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে এটাই ঠিক। অন্তত রীটা স্কীটারের সাজানো বানানো প্রতিবেদনের তুলনায়। ঠিক কি কথা কে বললো সেটা অন্তত সবাই জানতে পারবে। আপাতত অর একটাই চাহিদা, টাবিথা করসিকা আর ওর দলবলের সন্দেহ আর অর্ধ সত্য দিয়ে বানানো অ্যাজেন্ডার বিরুদ্ধে জ্যান, পেট্রা আর ওদের দল যেন ঠিকঠাক যুক্তিগুলো প্রয়োগ করে।

ওয়্যারলেস সেটে বিজ্ঞাপন শেষ হওয়া মাত্র মঞ্চের বামদিকে প্রবেশ করলেন বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন। শোনা গেল ঘোষকের চাপা উত্তেজনা ভরা কন্ঠস্বর, ‘আজ রাতের এই অনুষ্ঠানকে আর রোমাঞ্চকর করতে মঞ্চে হাজির হয়েছেন আমেরিকান উইজার্ডিং স্কুল আল্মা আলেরনের চ্যান্সেলর বেঞ্জামিন আমাদিঊস ফ্র্যাঙ্কলিন। এই অনুষ্ঠান পরিচালনার মূল দায়িত্বে থাকার অনুরোধ উনি গ্রহণ করেছেন।’

‘গুড ইভিনিং, সমস্ত বন্ধু বান্ধব, শিক্ষার্থীগন এবং অতিথিবৃন্দ,’ ফ্র্যাঙ্কলিন বললেন নিজের জাদুদন্ড সামনে রেখে পরিষ্কার ভরাট গলায়। ‘সকলকে স্বাগত জানাই হগওয়ারটসের উদ্বোধনী অল স্কুল ডিবেটে। আমার নাম বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন। আমি সম্মানিত বোধ করছি আজকের রাতে অংশ গ্রহনকারী প্রতিযোগীদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সুযোগ পেয়ে। বেশি কথা না বাড়িয়ে, টিম এ এবং টিম বিকে মঞ্চে উপস্থিত হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।’

সামনের সারির আসন থেকে দশজন উঠে দাঁড়ালো। ওখান থেকে পাঁচ পাঁচ জন ভাগ হয়ে চলে গেল মঞ্চের ডান ও বাম দিকে। গিয়ে বসলো দুটি টেবিলের পেছন দিকে রাখা চেয়ার গুলোতে। ফ্র্যাঙ্কলিন ওদের পরিচয় করিয়ে দিলেন দর্শকদের সঙ্গে। টিম এ তে আছে জ্যান, পেট্রা, জেন্নিফার টেল্লাস, হাফলপাফের অ্যান্ড্রূ হুবারট এবং আল্মা আলেরনের একটি ছাত্র নাম জেরাল্ড জোন্স। টিম বি তে প্রথম চারজন পঞ্চম থেকে সপ্তম বর্ষের ছাত্রছাত্রী। টাবিথা করসিকা, ওর চেলা টম স্কোয়ালাস এবং অন্য দুজন হিদার ফ্ল্যাক ও নোলান বিটলব্রিক। দলের পঞ্চম জনা ওদের তুলনায় বয়সে ছোট, র‍্যালফ। ও চেয়ারে কাঠের পুতুলের মতো বসে একদৃষ্টে ফ্র্যাঙ্কলিনের দিকে চেয়েছিল যেন ওকে হিপ্নোটাইজ করা হয়েছে।

‘আজ রাতের বিতর্কে,’ নিজের চশমাটা ঠিক করে নিয়ে ফ্র্যাঙ্কলিন বলতে থাকলেন, ‘শ্রোতাদের উপস্থিতির হার এবং প্রেস এর বিশেষ সম্প্রচারের ব্যবস্থা দেখেই বোঝা যাচ্ছে বিষয়টি যথেষ্টই ওজনদার এবং সুদূর প্রভাবী। বলা হয়ে থাকে একটি সহমত না হওয়াটাই হল সেরা অভিব্যক্তি স্ব্বাধীনতার ক্ষেত্রে। একটি সুস্থ সরকার পরিচালনা করার সঠিক জন গনতান্ত্রিক পদ্ধতি হল বিতর্ক এবং আলোচনা। এর সাহায্যেই আমরা নিজেদের সঠিক ভাবে জানতে পারি। আজ রাতে আমরা সেটাই দেখতে চলেছি। আসুন আমরা শপথ নিই, আপন আপন মতামত যাই হোক না কেন আমরা একে ওপরের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা থেকে বিরত হবো না। আজ রাতে বিতর্কের ফলাফল যাই হোক না কেন তার জন্য এই স্কুল বা এই হলের ঐতিহ্যে কোন দাগ যেন না লাগে।।’ ফ্র্যাঙ্কলিন এবার ঘুরলেন, দেখলেন দুটো টিমের সদস্যদের, ‘যা শুনবো বা বুঝবো সে ভাবনাকে এখানেই রেখে যাবো।’

একটা উচ্ছাসধ্বনি শোনা গেল, যেটা জেমসের শুনে মনে হল জোর করে সাজানো, স্বতঃস্ফূর্ত নয়। ফ্র্যাঙ্কলিন তার পোষাকের ভেতর থেকে একটা কাগজ বের করে দেখে নিলেন।

‘হুম, এরকমই আশা করেছিলাম,’ উনি গম্ভীর কাটাকাটা উচ্চারনে বললেন, ‘টিম বি প্রথমে তাদের যুক্তি পেশ করবে। প্রথম বক্তব্য রাখবেন মিস টাবিথা করসিকা। মিস করসিকা।’

ফ্র্যাঙ্কলিন পিছিয়ে গিয়ে মাঝখানে রাখা হাইব্যাক চেয়ারটায় বসলেন। টাবিথা বামদিকের বক্তব্য রাখার স্থানে গেল। হাতে কিছু নেই। দর্শকদের দিকে তাকিয়ে প্রথমেই উপহার দিলো তার মনভোলানো হাসি। বেশ কিছুটা সময় নিয়ে সবাইকে দেখলো। ‘উপস্থিত বন্ধু এবং সহপাঠী, শিক্ষক এবং প্রেসের সদস্যগন, হয়তো শ্রদ্ধেয় প্রফেসর ফ্র্যাঙ্কলিন এর কথার প্রেক্ষিতে আমার বক্তব্যর শুরুটা একটু সমালোচনামূলক ভাবেই হবে। কিন্তু সেটা না করলে আজকের বিতর্কের মুল বিষয়টার অন্তর্নিহিত সত্যকেই ভুল পথে চালানো হবে।’

দর্শকদের ভেতর থেকে একটা সামগ্রিক ঢোঁক গেলা বা প্রত্যাশামূলক নিঃশ্বাস ফেলার শব্দ গুঞ্জরিত হল। টাবিথা এই সময়ে ঘুরে প্রফেসর বেঞ্জামিনের দিকে তাকিয়ে হাসলো। ‘শ্রদ্ধেয় প্রফেসর ক্ষমা করবেন।’ ফ্র্যাঙ্কলিন দেখে সামান্যও বিচলিত মনে হল না। উনি একটা হাত তুলে একটু ঝুঁকে বক্তব্য চালিয়ে যাও ধরনের ইঙ্গিত করলেন।

‘অবশ্যই, ভব্যতা এবং শ্রদ্ধা আজকের এই আলোচনা সভাকে নিয়ন্ত্রন করবে,’ টাবিথা বললো, দর্শকদের দিকে মুখ ফিরিয়ে। ‘আর সেই কারনেই,আমরা প্রফেসরের কথার সঙ্গে সহমত হতে পারছি না। না, পারছি না। কারণ উনি শেষে যা বললেন তাতেই আমার আপত্তি। উনি আমাদের বললেন, “ কারণ আমরা একে অপরের বন্ধু, সহশিক্ষার্থী এবং সহকর্মী উইচ এবং উইজারড। আর সেটা হয়েই থাকতে চাই।” যার অর্থ উনি আমাদের আবার মনে করিয়ে দিলেন সব কিছুর শেষে আমাদের আসল পরিচয় আমরা জাদুকর ও জাদুকরী। এটা কি ঠিক? যদি তাই হয় তাহলে আমি বলতে চাই, আমরা হলাম স্বেচ্ছাচারের সবচেয়ে নিকৃষ্ট উদাহরণ। সঙ্কীর্ণ মানসিকতার চূড়ান্ত। আমরা কি শুধুই উইচ বা উইজার্ড ? জাদুদন্ড এবং মন্ত্রতন্ত্র বাদ দিয়ে আমরা কি আসলে মানুষ নই? নিজেদেরকে ম্যাজিক এর সঙ্গে চিহ্নিত করে আমরা আসলে মানবতা এবং জাদুবিহীন জগতের সঙ্গে আমাদের যে সমস্ত মিল তাকেই অস্বীকার করছি। আরো খারাপ ব্যাপারটা হলো, এটা করে আমরা আমাদের কমিউনিটির বাইরে যে জগতটা আছে তাদেরকে নিম্নমানের এবং গুরুত্বহীন আখ্যা দিয়ে রেখেছি। না,আমি এই ব্যাপারগুলোর জন্য বিশেষ ভাবে প্রফেসর ফ্র্যাঙ্কলিনের দিকে আঙুল তুলছি না। এরকমই চলে আসছে দীর্ঘ দিন ধরে। এই সমস্ত গোঁড়ামীগুলোর কারনেই বর্তমান দিনের জাদুজগতের পদ্ধতি ও আচরণগত দিকটা চিহ্নিত হয়ে পড়েছে উড়ুক্কু ঝাড়ুর সমগোত্র রুপে। আজকের দিনের জাদুজগতে এই বিশ্বাস মনে গেঁথে বসেছে যে মাগলদের অংশটা আমাদের থেকে অনেকাংশে নিম্নমানের। এর কারণ আর কিছুই নয়, এসবই আসলে জাদুমন্ত্রক দ্বারা বানানো রীতিনীতির বিষম এবং দুর্ভাগ্য জনক ফলাফল।

‘আমাদের আজকের বক্তব্য এটাই যে, আমরা মনে করি এর জন্য দায়ী বর্তমানে যারা জাদুজগত শাসন করার কাজ পরিচালনা করছেন তাদের কিছু নিছক অনুমান। এই অনুমানের তিনটি ধাপ। প্রথম, আমাদের অস্তিত্বকে সুরক্ষিত করার জন্য মাগল দুনিয়া যাতে আমাদের বিষয়ে কিছু জানতে না পারে তার জন্য ল অফ সিক্রেসি চালু রাখা। যেটা হয়তো গত যুগে দরকারি ছিল কিন্তু এখনকার সময়ে এর আর প্রয়োজন নেই। এর ফলে একটা এমন সমাজের সৃষ্টি হচ্ছে যা মাগল এবং জাদুদুনিয়াকে একে অপরের থেকে দূরে ঠেলে রাখছে পারস্পরিক অনেক রকম সুযোগসুবিধা নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা থেকে।

‘অনুমানের দ্বিতীয় ধাপটি হলো ইতিহাসকে দিয়ে প্রমান করা যে মাগল দুনিয়া আর জাদু জগতের মধ্যে কোন সম্মেলন করার চেষ্টা হলে তার পরিণতি হয় যুদ্ধ। আমরা এ বিষয়ে বলতে চাই যে এই দাবি বা অনুমান আসলে সাজানো একটা ব্যাপার যার ভিত্তি কিছু একে অপরের সঙ্গে সূত্রবিহীন ঐতিহাসিক ঘটনা। যার বেশীর ভাগই দুর্ভাগ্যজনকভাবে অগুরুত্বপূর্ণ এবং ব্যক্তিগত ব্যাপার। শয়তানি শক্তির বলে বলীয়ান দুষ্ট উইজার্ড সমগ্র জগতকে দখল করার চেষ্টা করছে এরকম একটা গল্প চালু করে দুর্বল মানসিকতার মাগলদের প্রভাবিত করা হচ্ছে। অথচ একই সঙ্গে জাদুজগতের অস্তিত্বকে লুকিয়ে রাখার প্রচেষ্টাও চলছে। আমাদের মনে হয় পরস্পর বিরোধ সম্পন্ন এই ভয়ের বাতাবরণ তৈরী আর লুকিয়ে থাকার চেষ্টার পেছনের আসল কারণ হল নিজেদের প্রকৃত স্বরূপ ঢেকে রেখে শক্তি ও শাসন বজায় রাখা।

‘আর আমাদের পক্ষ থেকে উনাদের বানিয়ে রাখা তৃতীয় অনুমান বিষয়ে যথেষ্টই সন্দিহান রয়েছি আমরা। বিষয়টি হল তথাকথিত “ডার্ক” ম্যাজিক। আমাদের ভাবনা অনুযায়ী ডার্ক ম্যাজিক আসলে একটা বাড়িয়ে চড়িয়ে বলা গল্পকথা। বর্তমানে শাসন ক্ষমতায় থাকা মানুষদের পক্ষে যখনই কোনো জাদুবিদ্যা বিপদজনক বলে প্রতিভাত হয়েছে তাকেই ওরা শয়তানী বলে ছাপ মেরে দিয়েছেন। একই সঙ্গে তাদেরকেই শয়তান বলে চিহ্নিত করেছেন যারা এর ব্যবহার করেছে। সোজা কথায় এটা অরোর ডিপার্টমেন্ট বানানো একটা গল্প। যারাই শাসক দলের বিরুদ্ধাচরণ করে সেইসব উইচ বা উইজার্ড বা তাদের কোন দলকে নিশ্চিহ্ন করতে ওরা এর ব্যবহার করেন।

‘আমরা জোর দিয়েই বলতে চাই এই তিনটি অনুমানই হল মাগল দুনিয়া বিষয় কিছু গোঁড়া ভাবনা পোষণ করার উৎস। আমাদের লক্ষ্য সমতা ফেরানো। আর কিছুই নয়। আর সেটা কেবলমাত্র মাগলদের জন্য নয় আমাদের নিজেদের স্বার্থে। ভুলে গেলে চলবে না উইচ বা উইজারড কিংবা মাগল বা জাদুজগতের মানুষ হওয়ার আগে কিন্তু আমাদের একটাই পরিচয়…… আমরা সাধারণ …মানুষ।’

কথা শেষ করেই টাবিথা ঘুরে গিয়ে টিম বি এর টেবিলে বসলো। কিছুক্ষন নীরব থাকার পর, জেমসকে হতবাক করে দিয়ে উচ্ছাসের ধ্বনি শোনা গেল গোটা অ্যাম্ফিথিয়েটারে। জেমস মাথা ঘুরিয়ে এদিক ওদিক দেখলো। নাহ, সবাই উচ্ছসিত নয় মোটেই, তবে প্রায় অর্ধেক দর্শক এর পক্ষে বলেই মনে হচ্ছে।

ওয়্যারলেস থেকে ভেসে এলো ঘোষকের কণ্ঠ, ‘…উপস্থিত শিক্ষার্থীদের প্রবল উচ্ছাসপূর্ণ সমর্থন নিয়ে স্থৈর্য ও সংবদ্ধতার প্রতিমা মিস করসিকা নিজের আসনে ফিরে গেলেন। এবার টিম এ এর ক্যাপ্টেন মিস পেট্রা মরগ্যানস্টারণ এগিয়ে যাচ্ছেন বক্তব্য প্রদান স্থানের দিকে …’

উচ্ছাস কমার সঙ্গে সঙ্গে পেট্রা কিছু নোট কার্ড নিজের বক্তব্য মঞ্চের ওপর রাখলো। তাকালো, মুখে হাসি নেই।

‘উপস্থিত লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলম্যান এবং সহশিক্ষার্থী বৃন্দ, শুভেচ্ছা রইলো,’ পেট্রা বললো, ঝরঝরে সুন্দর উচ্চারনে। টিম বি দলের পক্ষ থেকে তিনটি বিষয় তোলা হয়েছে আলোচনার জন্য। ওদের মতে তিনটি নেহাত অনুমান। এই সুত্রে টিম এ জানাতে চায় যে আজ রাতের বিতর্ক সভার জন্য কেবলমাত্র একটি বিষয়কেই বাছা হয়েছে। বাকি অনুমান দুটি এই অনুমানটির ওপর ভিত্তি করে রচিত। ধরে নেওয়া হচ্ছে ইতিহাস স্টাডি বা সায়েন্স কোন অর্থেই বিশ্বাস যোগ্য নয়। টিম বি আমাদের এটা বিশ্বাস করাতে চাইছে যে ইতিহাসের ঘটনা বিশ্বাসযোগ্য বাস্তব ঘটনার পরিবর্তে আসলে সম্পূর্ণ রুপে বানানো গল্প কথা। যা বানিয়েছে এই জগতকে শাসন করতে থাকা কিছু শক্তিশালী উইচ এবং উইজার্ড। তাহলে বলতেই হয় এই শাসনকারী মানুষগুলো নিঃসন্দেহে দারুনভাবে ক্ষমতাসম্পন্ন। কারণ তারা যে ইতিহাস বানিয়েছেন তার আসল রুপকে নিজের চোখে দেখা অনেক মানুষ এই মুহূর্তে এই জগতে বেঁচে আছেন। প্রকৃত পক্ষে ঘটে যাওয়া সেই সব ঘটনার স্মৃতি আজও তাদের কাছে অমলিন। সেই সব মানুষদের মধ্যে আছেন আমাদেরই মা বাবা দাদু দিদা। আমাদের শিক্ষকগণ এবং অবশ্যই আমাদের নেতারা। তাদের অনেকেই সেখানে ছিলেন যখন ইতিহাসটা বানানো হচ্ছিল। আর সেই জায়গাটা হলো এই স্কুলের চত্বর। টিম বি এর যুক্তি মানলে বলতে হয় হগওয়ারটসের মহাযুদ্ধ কখনোই হয়নি। অথবা যেটা হয়েছিল সেটার কোন তাৎপর্য ছিল না। যদি তাই হয় তাহলে আমরা ওদের আর অন্য অনুমান দুটির দিকে নজর দিতে পারি। ওদের মতে ল অফ সিক্রেসীর কোন দরকার নেই এবং ডার্ক ম্যাজিক ব্যাপারটা অরোরদের বানানো কল্পকাহিনী। সেগুলো তো ইতিহাসের জন্য সংগ্রহ করে রাখা বিভিন্ন তথ্য খতিয়ে দেখলেই মিথ্যে বলে প্রমানিত হয়ে যাবে। ডার্ক লর্ড বিষয়ে এবং তার ক্ষমতা দখলের জন্য রক্তমাখা পরিকল্পনার বিভিন্ন তথ্য এবং মাগল দুনিয়া শাসন করার অনৈতিক ইচ্ছের প্রচুর প্রমান ওরা এমনিতেই পেয়ে যাবেন। তার জন্য ইতিহাস ঘাঁটতেও হবে না। সে জন্যই আমরা নিজেদের এনার্জি নষ্ট করতে চাইছি না ও নিয়ে বেকার আলোচনা করে। ক্ষমা চাইছি টিম বি এর সদস্যদের কাছে।’

এবারেও কিছু সময় নিস্তব্ধ হয়ে রইলো সকলে। সম্ভবত ডার্ক লর্ড এর উল্লেখ এর অন্যতম কারণ। আর তারপরই আগের মতই উচ্ছাসে ভেসে গেল এলাকাটি। সঙ্গেই কিছু সিটির শব্দও শোনা গেল।

‘পরিমাণে ছোট কিন্তু ওজনে ভারি উদ্বোধনী জবাব দিলেন মিস মরগ্যান্সার,’ শোনা গেল ঘোষক কন্ঠ। জেমস বেগুনী বোলার হ্যাট পড়া লোকটার দিকে তাকালো এবং পড়তে থাকল ওর জাদুদন্ড থেকে সৃষ্টি হতে থাকা শব্দগুলোকে। ‘বেশ সুন্দর ভাবে গোছানো উত্তর পাওয়া গেল মিস করসিকার তিনতরফা প্রশ্নের। লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলম্যান বলা যেতেই পারে উত্তরটা ছিল সরাসরি এবং বিশ্বাসে ভরপুর।’

পরের চল্লিশ মিনিটে দুই দলের প্রত্যেক সদস্য তাদের যুক্তি এবং যুক্তির বিপক্ষ পেশ করলো এক এক করে। যা অতি মনোযোগ সহকারে শুনলেন প্রফেঃ ফ্র্যাঙ্কলিন। শ্রোতাদের বারণ করা হচ্ছিল উচ্ছাস প্রকাশ করার ক্ষেত্রে কিন্তু সেটা সম্ভব হল না। একটি দলের সমর্থকদের উচ্ছাসের জবাব দিতে অপরপক্ষ পিছু হঠতে রাজি নয়। অ্যাম্ফিথিয়েটারে রাত ঘনিয়েছে, দিগন্ত রেখায় এক ফালি চাঁদ ঝুলে আছে। মন্ত্রপূতঃ লন্ঠনগুলো জ্বলে উঠেছে দিকে দিকে। আসনের এলাকাগুলো যদিও ছায়ায় ঢাকা। মূল মঞ্চে অবশ্য একেবারে দ্বিপ্রাহরিক আলোর বন্যা। প্রফেঃ ফ্লিটউইকের ভাসিয়ে রাখা ফসফরাস গোলকগুলি তাদের কাজ করে চলেছে। জ্যান মুখোমুখী হল হিদার ফ্ল্যাক এর। বিতর্কের বিষয় এটাই ধরে নেওয়া হয় যে নথিবদ্ধ ইতিহাস সব সময় জয়ীদের দ্বারা সাজিয়ে লেখা হয়।

জ্যান হিদার ফ্ল্যাককে উদ্দেশ্য করে বললো, ‘সবার আগে আমি জানিয়ে দিতে চাই আমি আমেরিকা থেকে এখানে এসেছি। তুমিও সেটা জানো বোধ হয়,’। ‘যদি তোমার তোলা অভিযোগ সত্যি বলে মেনে নিই, তাহলে তো এটা স্বীকার করতেই হবে যে, আমরা এমন অনেক কিছু ইতিহাস থেকে জানতে পেরেছি যা জানাটা অসম্ভব বলাই শ্রেয়। উদাহরণ স্বরুপ বলতে পারি, নেটিভ আমেরিকানদের ওপর আমাদের অত্যাচারের কথা বা সালেম উইচহান্টের কথা বা একসময়কার ক্রীতদাস প্রথার কথা। জয়ীরাই ইতিহাস সাজিয়ে লেখেন একথা যদি মেনে নিতে হয় তাহলে আমি কি করে জানতে পারলাম থমাস জেফারসন নিজেই একসময় ক্রীতদাস পুষতেন?’

বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন এই কথাগুলো শুনে সামান্য হাসলেন, তারপর স্বীকৃতির চিহ্নরূপে সামান্য ঝুঁকলেন। টিম এ এর সমর্থকরা উল্লাসে ফেটে পড়লো।

অবশেষে কোন স্থির সিদ্ধান্ত না পাওয়ায় দুই অধিনায়ক পুনরায় মঞ্চে উপস্থিত হল চুড়ান্ত বক্তব্য পেশ করার জন্য। টাবিথা করসিকাই আবার প্রথম সুযোগ পেল মতামত প্রকাশের।

‘আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি,’ পেট্রার দিকে তাকিয়ে বললো টাবিথা, ‘এই জন্য যে, আমার বিপক্ষ দল এই বিতর্কের আলোচনাটা একটি বিশেষ বিষয়েই স্থিত রেখেছেন। আর তা হলো বর্তমানের ইতিহাসকাররা কোন এক গল্পকথার দানবিক শত্রুকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে একটা ভয়ের বাতাবরণ সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছেন। আর পরিষ্কার করে বললে ওনারা একজন ডার্ক লর্ডের চরিত্র তুলে ধরেছেন সকলের সামনে। হ্যাঁ, ডার্ক লর্ড, এই নামেই ওরা ওকে ডাকতে ভালোবাসেন। যদি মিস মরগ্যানস্টারণ আজ রাতের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গুলি নিয়ে আলোচনায় নামতেন আমি অতি সহজেই জিতে যেতাম। কিন্তু ওনার মতে একটি বিষয়ের সঙ্গেই বাকি দুটি বিষয় জড়িয়ে আছে। তাহলে আসুন আমরা লর্ড টম রিডলকে নিয়েই আলোচনা আগে বাড়িয়ে নিয়ে যাই।’

ভলডেমরটের নামটা উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে দর্শকদের ভেতর থেকে একটা চমকে যাওয়ার শব্দগুঞ্জন শোনা গেল। জেমসের মনে হল টাবিথা নিজেও কিছুটা সন্ত্রস্ত টম রিডল নামক বিষয়টিকে সামনে এনে। এমনকি জেমস নিজেও এটা নিয়ে সংশয়ের দোলাচলে। লাফাতে থাকা হৃদপিণ্ড নিয়ে জেমস সামনের দিকে ঝুঁকে বসলো।

‘ডার্ক লর্ড, অরোর ডিপার্টমেন্ট টম রিডলকে এই নামে ডাকতেই পছন্দ করেন,’ টাবিথা বেশ থমথমে স্বরে কথাগুলো বললো। ‘নিঃসন্দেহে একজন শক্তিশালী উইজার্ড ছিলেন। শাসক জগতের মতে উনি একজন ভুল পথে পরিচালিত মানুষ। আসলে একটু বেশি অহংকারী ছিলেন বোধহয়। কিন্তু আমরা সঠিকভাবে তার পরিকল্পনা ও পদ্ধতি বিষয়ে কি বা কতটুকু জানি? মিস মরগ্যানস্টারণ আপনাদের বললেন উনি ছিলেন একজন শয়তান। উনি ছিলেন এক জন ডার্ক উইজার্ড, যার লোভ ছিল শুধু ক্ষমতা আর হত্যায়। কিন্তু বাস্তবে কি এরকম কোন মানুষের অস্তিত্ব থাকতে পারে? হ্যাঁ থাকতে পারে, তবে সেটা কমিক্স বইয়ের পাতায়। আর সেই সব মানুষের মনের কল্পনায়, যারা আতঙ্কের জাল বোনেন। কিন্তু বাস্তবে কোন একটি মানুষ সম্পূর্ণ ভাবে শয়তান হতে পারে কি? না, আমার মত অনুসারে টম রিডল হয়তো বা ভুল পথে হাঁটা মানুষ ছিলেন কিন্তু একই সঙ্গে একজন এমন উইজার্ড ছিলেন যিনি চেয়েছিলেন মাগল আর জাদু জগতের সমতা। আর সেটাই ছিল জাদু জগত শাসনকারী কট্টরপন্থীদের কাছে একটা চিন্তার বিষয়। এর ফলেই এক কাউন্টার পরিকল্পনার জন্ম দেওয়া হয়। যেখানে অর্ধ সত্য আর চরম মিথ্যাকে একত্র করে রিডলের পরিকল্পনাকে তছনছ করার কাজ শুরু হয়। উনার সমর্থকদের শয়তানের অনুচর ডেথ ইটারস নামে অভিহিত করে মন্ত্রক নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া। এসব সত্বেও অতি অল্প সময়ের জন্য হলেও রিডলের অনুচররা মানুষের মন জয় করে জাদুমন্ত্রক নিজেদের নিয়ন্ত্রনে আনেন। আর তারপরই এক জঘন্য রক্ত মাখা “ক্যু” এর আয়োজন করে প্রাচীনপন্থীর দল টম রিডল আর তার অনুচরদের শেষ করে দেওয়ার জন্য। টম রিডলকে হত্যা করা হয় যতটা নৃশংস ভাবে সম্ভব।’

টাবিথার বক্তব্য চলাকালীন সময়ে দর্শকদের মধ্যে একটা গুঞ্জন শুরু হয়। সেটা একসময় চিৎকারে বদলে যায়। যার মূল কথা “ওকে বলতে দেওয়া হোক!” বক্তব্য শেষ হওয়া মাত্র একটা দারুন উচ্ছাস উদ্দাম বন্য উল্লাস ধ্বনিত হয় অ্যাম্পি থিয়েটার জুড়ে। যা জেমসকে ভেতরে ভেতরে কেঁপে উঠতে বাধ্য করে। ও এদিক ওদিক দেখতে থাকে। অনেক শিক্ষার্থী উঠে দাঁড়িয়ে মুখের কাছে দুহাত নিয়ে গিয়ে সজোরে চিৎকার করে চলেছে। অনেকেই নিজের আসনের ওপর উঠে দাঁড়িয়ে শূন্যে মুষ্ঠিবদ্ধ হাত ছুঁড়ছে। বুঝতে পারা যাচ্ছে না এই চিৎকারে কে টাবিথার পক্ষে বলছে আর কে বিপক্ষে।

চিৎকার চ্যাঁচামেচির এই উৎকণ্ঠাময় মুহূর্তে জেমস লক্ষ্য করলো টেড লুপিন আর নোয়া মেটজকার কিছু একটা নাড়াচাড়া করছে। সহসাই একটা চোখ ধাঁধানো আলোর ঝলক দেখা গেল ওদের মাঝে। নোয়া আর টেডকে দেখাল শিল্যুয়েটের মতো। আলোটা ওপর দিকে উঠে গেল। পুরো অ্যাম্থিথিয়েটার আলোকিত হয়ে উঠলো আলোতে। একশো ফুট দূরে থাকা আলোর গোলকটায় বিস্ফোরণ হলো। অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আলোর কনা ছিটকে গেল চারদিকে। দর্শকেরা শিহরিত হল, থমকে গেল, চমকে উঠলো। সবার চোখ ওপরের দিকে। ছোট আলোগুলো ঘুরতে ঘুরতে একটা অবয়ব বানাতে শুরু করলো। একটা ভয়ের শব্দ বেরিয়ে এলো প্রায় সকলের মুখ থেকেই যখন দেখা গেল আলোগুলো পরিণত হল সেই শয়তানি চিহ্নে। একটা নরকরোটি, যার মুখ থেকে বেরিয়ে আছে সাপের মাথা। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটা বিশেষ ধরনের বিদ্যুৎশিখা চিহ্নর আবির্ভাব হল। আছড়ে পড়লো করোটিটার ওপর। যার ফলে দাঁতের চাপে কেটে গেল সাপটার মাথা। ওটার চোখ গেল বন্ধ হয়ে। করোটিটাও ভেঙে দুটুকরো হয়ে গেল। অদৃশ্য হলো বিদ্যুত শিখা আর করোটিটার ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো কিছু লেখা –

আপনি কি হাসতে চান আপনার নিজের করোটিটা দেখে

তাহলে আসুন… উইস্লি উইজার্ড হুইজস’এ… সব কাজ ফেলে রেখে

ডায়াগন অ্যালি আর হগসমীডে আমাদের অবস্থান

বিশেষ অর্ডার দিয়ে বাড়িতে বসেই পেয়ে যান!

 আলোকোজ্জ্বল লেখাগুলোর দিকে চেয়ে বেশ খানিকটা সময় অ্যাম্থিথিয়েটারের দর্শকেরা বাক্যহীন থেকে গেল। একসময় লেখাগুলো ভেঙে গিয়ে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ঝরে পড়লো চারদিকে। একটা হাসির শব্দ শোনা গেল এবারে।

‘ব্যাপারটা তাহলে এরকম,’ প্রফেঃ ফ্র্যাঙ্কলিন বললেন উঠে দাঁড়িয়ে, এগিয়ে এলেন সামনের দিকে, ‘হুম, আমি স্বীকার করছি, এটা ছিল একটা চমকে দেওয়ার মতোই ব্যাপার। আর সেটাও একেবারে দারুন একটা সময়ে ভাবনাকে অন্যপথে চালিয়ে দেওয়ার জন্য।’ কিছু অস্বস্তিকর হাসির আওয়াজ শোনা গেল। আস্তে আস্তে আবার যে যার আসনে বসে পড়লো। জেমস ঘুরে তাকালো নোয়া আর টেডের দিকে। এখনো চোখ পিটপিট করছে ওদের। বোঝাই যাচ্ছে ভালোই হতভম্ব এবং প্রায় অন্ধ হয়ে গেছে ওয়েস্লী ব্রাদারস এর বিশেষ আতসবাজির কল্যাণে।

টেড বিড়বিড় করে বললো, ‘ব্যাটা ওয়েস্লী এটা দিয়ে একটা নিজের ভালো প্রচার করে নিলো।’

নোয়া কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো, ‘এবার বুঝলাম কেন এটা ফ্রীতে দিয়েছে।’

‘লেডিজ অ্যান্ড জেন্টলম্যান,’ ফ্র্যাঙ্কলিন বলা শুরু করলেন, ‘এই ব্যাপারটা আমি জানি অনেকেরই বেশ পছন্দের কিন্তু তার জন্য আমরা আমাদের নিজেদের কাজ থেকে সরে যেতে পারি না। মিস করসিকা এমন কিছু অভিযোগ তুলেছেন যা আমাদের অনেকের পক্ষেই শোনা ও মেনে নেওয়া বেশ কষ্টকর। উনি বেশ জোর দিয়ে বললেন, ‘এটা একটা বিতর্ক সভা এবং আমরা যে দেশ থেকে এসেছি সেখানে আমরা কখনোই কোন বিতর্ক থামিয়ে দিই না এই যুক্তিতে যে আলোচিত কথাগুলো আমাদের পছন্দ হচ্ছে না। আমি আশা করছি আমরা এই আলোচনা সভাও সম্মানের সঙ্গেই শেষ করতে পারবো। তা না করতে পারলে আমার মনে হয় মাননীয়া হেডমিস্ট্রেস আমার সঙ্গে একমত হবেন যে এখানে চুড়ান্ত বক্তব্য পেশ করতে দেওয়া অসম্ভব। বিতর্ক সভা বন্ধ করে দেওয়াই তখন একমাত্র পথ হয়ে দাঁড়াবে। মিস মরগ্যানস্টারণ আমার মনে হয় তুমি জবাব দিতে প্রস্তুত।’

ফ্র্যাঙ্কলিন গিয়ে নিজের আসনে বসলেন। জেমস বুঝতে পারছি ওর ভেতরে দারুন একটা রাগের ছটফটানি হচ্ছে। পেট্রা বক্তব্য মঞ্চে অনেকটা সময় চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো। চোখ নিচের দিকে। যখন তুললো, সেখানে আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখা গেল কি!

‘আমি স্বীকার করছি মিস করসিকার কথাগুলোর জবাব আমি কোনখান থেকে দিতে শুরু করবো বুঝতে পারছি না। উনি যা বলেছেন তা এক অবিশ্বাস্য বিষয়। ডার্ক লর্ড আসলে শয়তান নন! এটা ক্ষমতায় থাকা মানুষরা ওকে জোর করে উপাধি দিয়েছেন। মিস করসিকা কি ভুলে যাচ্ছেন, ডার্ক লর্ড সেইসব না বলা শক্তি ব্যবহার করেছিলেন ক্ষমতা আহরণ এবং পরিচালনা করার করার জন্য যা নিষিদ্ধ। শুধু তাই নয় উনি পরিচিত ছিলেন সেই তিনটি অবিস্মরণীয় অভিশাপের যথেচ্ছ ব্যবহারের জন্য। আর সেগুলো উনি উনার অনুচরদেরও ব্যবহার করার সুযোগ দিতেন। লর্ড ভলডেমরট কখনই মাগলদের সঙ্গে সমতা আনয়নে আগ্রহী ছিলেন না বরং …বরং …’ পেট্রা থেমে গেল। জেমস নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরলো। ও পেট্রার অবস্থাটা অনুভব করতে পারছিল। কত রকমের যে মিথ্যে আছে করসিকার বক্তব্যে … যার একটা ফস্কে গেলে সেটাই সত্য বলে মেনে নিতে হবে।

‘মিস মরগ্যানস্টারণ,’ টাবিথা ক্রুরভাবে বলে উঠলো, ‘আপনি যা বলছেন সে বিষয়ে আপনার কাছে কোন প্রমান আছে নাকি আগে যা বলে গেছেন সেসবই নতুন করে বলতে চলেছেন?’

পেট্রা টাবিথার দিকে তাকালো, মুখ ফ্যাকাশে এবং রাগের অভিব্যক্তিতে পূর্ণ। ঝট করে উত্তর দিল, ‘আমার বক্তব্যের ভিত্তি নথিবদ্ধ ইতিহাস এবং যারা সেই সময় তাকে নিজের চোখে দেখেছেন তাদের বলা অভিজ্ঞতা। তবে এটা আপনার ওপরেও বর্তায় মিস করসিকা। আমি চাই আপনি লর্ড ভলডেমরট বিষয়ে যে দাবিগুলো করছেন যা সম্পূর্ণভাবে আলাদা জানাশোনা নথির সাপেক্ষে, সেগুলোর প্রমান দাখিল করুন।’

‘ঠিক আছে। তাই হোক,’ টাবিথা ধীরে ধীরে বললো, ‘আমি নিশ্চিত এখানে এমন অনেকেই আছেন যারা সেদিন ব্যাটল অফ হগওয়ারটস স্বচক্ষে দেখেছেন। আমরা বিষয়টার ফয়সালা এখনই করে ফেলতে পারি। অবশ্য যদি আমরা চাই। সেই সব মানুষদের কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে। অবশ্যই এটা কোন কোর্টরুম নয়, তাই আমি সাধারণভাবেই প্রশ্নটা করছি – শ্রোতাদের মধ্যে এমন কেউ হাজির আছেন? যিনি ওই দিন যুদ্ধের সময় হাজির ছিলেন। থাকলে তিনি কি এটা অস্বীকার করতে পারবেন যে লর্ড টম রিডল সেদিন এক ফোঁটাও রক্তপাত করতে চান নি ? কেউ অস্বীকার করতে পারবেন যে, উনি সেদিন চেয়েছিলেন বিপক্ষ দলের নেতা ওর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলুন যাতে বিনা রক্তক্ষয়ে সব মিটিয়ে নেওয়া যায়?’

টাবিথা শ্রোতা দর্শকদের দিকে চেয়ে থাকলো। নিষিদ্ধ অরণ্যের গাছের শব্দ, হাওয়ার শব্দ আর ঝিঁঝিঁ পোকাদের ডাক ছাড়া সমগ্র স্থানটিতে বিরাজ করছিল চরম নীরবতা।

‘না, কেউ এটা অস্বীকার করতে পারবেন না। কারণ এটাই যে সত্যি,’ নিজেই উত্তর দিলো অতি বিনয়ের সঙ্গে। ‘অনেকে মারা গিয়েছিল এটা সত্যি। কিন্তু এটাও সত্যি যে লর্ড টম রিডলের ভাবনার চেয়ে বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল সেদিন। আর এর কারণ একটাই। যারা তার বিরোধিতা করেছিল তারা চায়নি ওই মানুষটাকে অন্যেরা রক্ত পিপাসু পাগল ছাড়া আর কোনো ভাবে চিনুক।’

পেট্রা ইতিমধ্যে নিজেকে ধাতস্থ করে নিয়েছে অনেকটাই। এবার কন্ঠস্বর অনেক পরিষ্কার এবং জোরালো, ‘একজন শান্তিকামী মানুষের এটা কি ধরনের আচরণ জানতে পারি কি? এক সদ্যোজাত শিশুর মা বাবাকে হত্যা করে এই সদ্যোজাতকেও হত্যা করার চেষ্টা করা?’

বিন্দুমাত্র না থমকে টাবিথা উত্তর দিলো, ‘ও আপনি তাহলে এবার হ্যারি পটারের কথা বলছেন? যে মানুষটা ভবিষ্যতে, বেশ চমকপ্রদ ভাবেই বলা যেতে পারে, হতে চলেছেন হেড অফ দ্যা অরোর ডিপার্টমেন্ট?’

‘তাহলে এটা যে সত্যি সেটা আপনি অস্বীকার করছেন?’

‘আমি কিছুই অস্বীকার করিনি। আমি শুধু প্রশ্ন আর চ্যালেঞ্জ করেছি। আমি মনে করি সত্যি হল আমরা যা বিশ্বাস করি তার থেকেই জটিল একটা জিনিষ। আমি বলতে চাই যে ওই ঠাণ্ডা মাথার খুনের গল্প এবং শিশুর ওপর আক্রমনের কাহিনী প্রমানিত কোন সত্যি নয়। আসলে ওটা বানানো গল্প যা চলে আসছে গত কুড়ি বছর ধরে আতঙ্ক সৃষ্টি করে শাসন ক্ষমতা চালানোর কাজে।’

‘এই সাহসটা হয় কি করে আপনার?’ জেমস নিজের বলা কথা নিজেই শুনতে পেলো। ওর ভাবনার সঙ্গে সঙ্গেই ওর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। উঠে দাঁড়িয়ে রাগে কাঁপতে কাঁপতে আঙুল তুলে ধরেছে টাবিথার দিকে। ‘আমার বাবাকে মিথ্যেবাদী বলার এতো সাহস কি করে হয় আপনার ? টম রিডল নামক রাক্ষসটা হ্যারি পটারের বাবা মাকে হত্যা করেছিল! আমার দাদু দিদা মারা যান ওই শয়তানের কারনে, আর আপনি ওখানে দাঁড়িয়ে অবলীলায় বলে দিচ্ছেন ওগুলো সব বানানো গল্প! এ সাহস আসছে কি করে?’ জেমসের গলা আওয়াজ খসখসে হয়ে গেল।

‘আমি সরি জেমস,’ টাবিথা উত্তর দিল। মুখে একটা সহমর্মীতার ছাপ। ‘আমি জানি তুমি ওইগুলো সত্যি বলেই বিশ্বাস করো।’

প্রফেসর ফ্র্যাঙ্কলিন উঠে দাঁড়ালেন, এগিয়ে এলেন সামনের দিকে। কিন্তু কিছু বলার আগেই জেমস চেঁচিয়ে বললো, ‘আমার ড্যাড আপনার গ্রেট হিরোকে শেষ করে দিয়েছিল !’ রাগে জ্বল জ্বল করছিল জেমসের চোখ। ‘কারণ ওই দানব আমার ড্যাডকে হত্যা করার দু দুবার চেষ্টা করেছিল। দুবার কারণ দ্বিতীয়বার আমার ড্যাড নিজেই ওর কাছে নিজেকে নিয়ে গিয়েছিল। আপনার ওই তথাকথিত রক্ষাকর্তা আসলে শয়তান ছাড়া আর কিছুই নয়। যাকে আমার ড্যাড ভালোর জন্য পরাজিত করতে পেরেছিল।’

‘তোমার বাবা,’ টাবিথা এবার গলা তুলে কঠোর স্বরে বললো, ‘একজন মাঝারী মানের উইজার্ড যার সহযোগিতায় ছিল পি আর ডিপারটমেন্ট। যদি তোমার বাবার চারপাশে দারুন সব জাদুকররা না থাকতেন আজ ওই নামটা কেউ জানতেই পারতো না।’

এই কথা বলামাত্রই দর্শকদের ভেতর থেকে একটা ক্রোধের চিৎকার ধ্বনিত হল, চিৎকারে গমগম করে উঠলো সারা এলাকাটি। মঞ্চের ওপর হঠাৎ একটা খটর মটর আওয়াজ শোনা গেল। জেমস তাকিয়ে দেখলো র‍্যালফ লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে, যে এখনো পর্যন্ত একটা কথাও বলেনি, নিজের চেয়ারটাকে সজোরে ঠেলে দিয়ে। টাবিথা ঘুরে ওর দিকে তাকালো, র‍্যালফও তাকালো টাবিথার দিকে এক মুহূর্তের জন্য। ‘বসে পড়ো র‍্যালফ!, চোখ পাকিয়ে বললো “টাবিথা!!” র‍্যালফ একই ভাবে আগুন ঝড়ানো দৃষ্টিতে টাবিথাকে দেখে মঞ্চ ছেড়ে নেমে গেল। এতো রাগের মধ্যে ও এটা দেখে জেমসের মনে অনেকটা আনন্দ এবং স্বস্তি ফিরে এলো।

বিতর্ক সভাটিকে থামিয়ে দেওয়া ছাড়া এবার আর কোনো পথ খোলা থাকলো না। অ্যাম্ফিথিয়েটারে শান্তি ফিরিয়ে আনতে মঞ্চে উঠে গেলেন হেড মিস্ট্রেস ম্যাকগনাগল স্বয়ং এবং প্রফেঃ ফ্র্যাঙ্কলিন। দুজনেই নিজ নিজ জাদু দন্ড থেকে লাল আলোর বিচ্ছুরণ ঘটালেন। সঙ্গে সঙ্গেই এটাও ঘোষনা করলেন যত দ্রুত সম্ভব শিক্ষার্থীরা যেন নিজের নিজের হাউসের কমন রুমে ফিরে যায়। এই মুহূর্তে উনার মুখ ফ্যাকাসে এবং চোয়ালে কাঠিন্য। বিভিন্ন রকম কথাবার্তা বলতে বলতে উপস্থিত জনতা ফিরে চললো সেইদিকে যেদিক দিয়ে দুর্গে ফেরা যাবে। জেমস দেখতে পেল র‍্যালফ এদিকেই আসছে, একপাশে সরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকলো যতক্ষণ না ওই বিশালদেহী ছেলেটি এসে পৌছায়।

কাছে এসে র‍্যালফ জেমসকে নিচুস্বরে মাথা নামিয়ে বললো, ‘আমার এর চেয়ে বেশী কিছু করার ক্ষমতা ছিল না। আমি ক্ষমা চাইছি টাবিথার বলা ওই সব অর্থহীন ভয়ঙ্কর কথাগুলোর জন্য। চাইলে তুই আমাকে ঘৃণা করতেই পারিস, কিন্তু আমার পক্ষে ওই প্রোগ্রেসিভ এলিমেন্ট এর মতো হতচ্ছাড়া ব্যাপারটাকে আর একদমই সহ্য করা সম্ভব না। আমি ওটার ব্যাপারে সত্যিই এতো কিছু জানতাম না। এরা কোনমাত্রায় নিজেদের নিয়ে যেতে পারে বুঝতেই পারিনি … এতো সাঙ্ঘাতিক রকমের রাজনীতি।’

জেমস হাসিটা আটকাতে পারলো না। ‘আরে ব্যাটা পাহাড় ! নারে র‍্যালফ তোকে আমি ঘৃণা করি না। আমারই উচিত তোর কাছে ক্ষমা চাওয়া।’

‘ঠিক আছে ক্ষমাটা পরে চাইলেও হবে, অসুবিধা নেই তো ?’ র‍্যালফ বললো, মূল ধনুকাকৃতি দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে। ‘এই মুহূর্তে আমি এই জায়গা থেকে বেরিয়ে যেতে চাই। টাবিথা আমার দিকে নজর রেখেছে আমি স্টেজ ছেড়ে চলে আসার পর থেকেই। ওদিকে জ্যান বললো আমাকে তোদের কমনরুমে যেতে। টেড এর আমন্ত্রণ। টিম বি এর একজন সদস্যকে জয় করতে পারার খুশীতে হুল্লোড় হবে।’

‘এটা তোকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছে বোধহয়?’ জেমস জানতে চাইলো।

‘না একদমই না,’ র‍্যালফ কাঁধ ঝাঁকিয়ে উত্তর দিলো, ‘বরং এটা অনেক বেশী লোভনীয় আমার কাছে কারণ গ্রীফিন্ডোর এর স্ন্যাক্সগুলো আমাদের হাউসের থেকে ভালোই হয়।’

 

[চলবে]

লেখক পরিচিতিঃ  জর্জ নরম্যান লিপার্ট আমেরিকান লেখক এবং কম্পিউটার অ্যানিমেটর। তবে ওনার বর্তমান পরিচয় উনি জেমস পটার সিরিজের লেখক। যে কারনে ওনাকে “আমেরিকান রাউলিং” নামেও ডাকা হয়ে থাকে। এই সিরিজের প্রথম লেখা “জেমস পটার অ্যান্ড দ্য হল অফ এল্ডারস ক্রসিং” প্রকাশিত হয় ২০০৭ সালে। নানান কারনে এটি অনেক বিতর্কে জড়িয়ে যায়। সেসব সমস্যা পেরিয়ে আজ এটি পাঠক পাঠিকাদের চাহিদায় সারা বিশ্বে যথেষ্ট জনপ্রিয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই সিরিজের সব কটি বই ই-বুক এবং ফ্রি হিসাবেই প্রকাশ করেছেন মাননীয় জর্জ নরম্যান লিপারট। এই সিরিজ ছাড়াও ওনার আরো ১২ টি বই আছে। বর্তমানে উনি এরি, পেনসিল্ভ্যানিয়ার বাসিন্দা।

অনুবাদকের পরিচিতিঃ উপন্যাসটির অনুবাদক প্রতিম দাস মূলত চিত্র শিল্পী, ২০১৩ সাল থেকে ভারতের সমস্ত পাখি আঁকার লক্ষ্য নিয়ে কাজ চলছেন। ৭৭৫+ প্রজাতির ছবি আঁকা সম্পূর্ণ হয়েছে। তবে শুধু পাখি নয় অন্যান্য বিষয়েও ছবি আঁকা চলে একইসঙ্গে। দারুণ রকমের পাঠক, যা পান তাই পড়েন ধরনের। প্রিয় বিষয় রূপকথা, ফ্যান্টাসী, সায়েন্স ফিকশন, অলৌকিক। টুকটাক গল্প লেখার সঙ্গে আছে অনুবাদের শখ। 

Tags: জর্জ নরম্যান লিপারট, জেমস পটার অ্যান্ড দ্য হল অফ এল্ডারস ক্রসিং, ধারাবাহিক উপন্যাস, প্রতিম দাস, সুদীপ দেব

Leave a Reply

Connect with

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!
Verified by MonsterInsights