স্বর্ণ আঁধার
লেখক: বিশ্বজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়
শিল্পী: সুমন দাস
“আরেক কাপ মার্সিয়ান জুস হবে নাকি?”
“না, আর নয়। বেশি খেলে ঝিমুনি মতো আসে। আর ঝিমুনি এলে বন্দিকে নির্বাসনের দায়িত্বগুলো ঠিকমতো পালন করতে পারব না।”
“আরে ধুর, কবে থেকে এইসব কাজ করছিস। এখনও কনফিডেন্স তৈরি হল না! নেহাত আমি স্পেস ভেহিকেলের পাইলট হিসেবে আছি বলে তাই। যদি বন্দি নির্বাসনের সরাসরি দায়িত্বে থাকতাম, তবে তোকে দেখিয়ে দিতাম চোখ বন্ধ করে কীভাবে কাজটা করা যায়।”
“বলা সহজ। একটা জলজ্যান্ত মানুষকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নির্জন উপগ্রহে মৃত্যুর মুখে ছেড়ে দিচ্ছি, এটা করতে গেলে দম লাগে, বুঝেছিস?”
“আচ্ছা বুঝেছি। তুই শালা পাপ করে আবার অনুশোচনা করিস। তোকে খেতে হবে না মার্সিয়ান জুস। আমি একাই খাচ্ছি। তুই যা গিয়ে কাজটা ফিনিশ করে আয়।”
নাথানের কাছে ‘কাজ’ শেষ করবার কথা শুনে দীপাঞ্জন আর দাঁড়াল না। তার গা’টা ম্যাজম্যাজ করছে। একটু ঘুমলে ভালো হয়। কিন্তু এখন ঘুমোবার সময় নয়। এক বিপজ্জনক বন্দিকে জুপিটারের চাঁদ ক্যালিস্টোতে ছাড়তে এসেছে দীপাঞ্জন আর নাথান। ওরা দুজন ইওরোপার স্পেস ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট বিভাগে অপরাধীকে নির্বাসনের কাজ করে।
দীপাঞ্জন খেয়াল করল যে আইসোলেশন চেম্বারে তাদের বন্দিটি ঘুমিয়ে আছে। সে তার হেঁড়ে গলায় হেঁকে উঠল, “ওঠ শালা। আর কত ঘুমোবি? ক্যালিস্টোর মাটিতে তোকে শিগগির নামিয়ে দেব। ওই ফালতু উপগ্রহটায় গিয়ে যত খুশি ঘুমোস।”
বন্দি মানুষটা ধীরে ধীরে মাথা তুলল। সে মোটেও ঘুমোচ্ছিল না। তার যান্ত্রিক চোখদুটো দপ করে জ্বলে উঠল। বন্দির জ্বলন্ত চোখ দেখে দীপাঞ্জনের মন্তব্য, “শালা, চোখরাঙানি কাকে দেখাচ্ছিস? বেশি ঔদ্ধত্য দেখালে এই মহাকাশযানের ভেতরেই খতম করে দেব। আর ক্যালিস্টোর মাটি পর্যন্ত যেতে হবে না। বুঝলি?”
বন্দির চোখের লাল আলো আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে এল। সে উত্তর দিল, “না, না, আপনারা জেলকর্মী। আপনাদের কি ঔদ্ধত্য দেখানো যায়? আমি আসলে সবে ঘুম থেকে উঠেছি কিনা। আমার চোখের সার্কিট গরম না করলে দৃষ্টিটা ঠিক পরিষ্কার আসে না। তাই…”
“হুম, ঠিক আছে। শোন, আমাদের মহাকাশযান এখন ক্যালিস্টোর ১০২ মাইল ওপর দিয়ে প্রদক্ষিণ করছে। শিগগিরই আমরা এখানকার জমিতে নামব। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকব না। তোকে আমরা ওখানে ছেড়ে দিয়ে ফিরে যাব ইওরোপা চাঁদের জেলখানাতে। তোকে আমরা সরাসরি মারছি না। আমরা তোকে স্পেসস্যুট শুদ্ধু ক্যালিস্টোতে নামিয়ে দেব। এই উপগ্রহে অনেক পুরোনো ভাঙা মহাকাশযানের ধ্বংসাবশেষ পাবি। যদি দেখিস যে সেইসব ধ্বংসাবশেষ থেকে খাদ্য, অক্সিজেন ট্যাবলেট ও রসদ সংগ্রহ করে টিঁকে থাকতে পারছিস, তো থাক। আমাদের বা সরকারের কিছু যায় আসে না। বুঝতেই পারছিস, আমাদের মহান সরকারের মন বড়ই দয়ালু। যদি সরকার খারাপ হত, তাহলে তোকে গ্যানিমিড বা আই ও উপগ্রহে ছুড়ে ফেলা হত। সেখানে যা রেডিয়েশন, তাতে কয়েক সেকেন্ডেই মারা পড়তিস।”
“হ্যাঁ, তোমাদের যা দায়িত্ব, সে তো তোমরা পালন করবেই। তবে কিনা…”
“তবে কী?”
“একবার ক্যালিস্টোতে নির্বাসিত হওয়া মানে মৃত্যুর অপেক্ষায় দিন গোনা। সভ্য জগতের সঙ্গে চিরকালীন ছাড়াছাড়ি। তাই বিদায় নেবার আগে একবার নিজের জীবন কাহিনি শুনিয়ে যেতে চাই।”
“আরে কিসসা তো শোনাবিই। তোর কিসসা রেকর্ড করব বলেই তো এখন এলাম। ঠিকঠাক বলিস। তোর জবানবন্দি কিন্তু সরকারি রেকর্ডে যাবে।”
“হুম, শুরু করি তাহলে?”
“দাঁড়া ভিডিয়ো রেকর্ডারগুলো চালু করি। ছ’টা অ্যাঙ্গেলে ভিডিয়ো তোর দিকে চালু করা হল। নে, এবার শুরু কর।”
বন্দি ব্যক্তিটি মুখ নিচু করে কিছুক্ষণ ভাবল। তারপর বলতে শুরু করল, “আমার নাম হল নীল। পুরো নাম নীল বসাক ওয়াই বিটা ৩৬১। আমার বাবা-মা পৃথিবীর অধিবাসী হলেও আমার জন্ম ইওরোপায়। ইওরোপায় জন্ম নেওয়া লোকদের কেরিয়ার নিয়ে অপশন বেশি থাকে না। প্রায় সবাইকেই স্পেস বায়োলজি, স্পেস মেটালার্জি, জেনারাল অ্যাস্ট্রোনমি নিয়ে পড়তে হয় এবং বড় হয়ে বিজ্ঞানী হতে হয়। আমিও তেমনই একজন। ইওরোপার দ্বাবিংশতি বিজ্ঞানী প্রজন্মের একজন ছিলাম আমি। আমাকে প্রথমে দেওয়া হল বৃহস্পতি গ্রহের বিভিন্ন গ্যাসীয় স্তর সরেজমিনে গিয়ে পর্যবেক্ষণ করার কাজ। কিন্তু সেই কাজে তেমন উন্নতি করতে পারলাম না। আমার রিপোর্ট বা গবেষণায় এমন কিছুই উঠে এল না যা থেকে বিজ্ঞানের নতুন কোনও তথ্য সামনে এল। কিছুদিন দেখে বড়কর্তারা আমাকে গ্রহাণু মাইনিং এর দলে নিযুক্ত করলেন। মঙ্গল ও বৃহস্পতির মাঝে বহু গ্রহাণু আছে। তাদের ব্যাস ১০ মিটারও হতে পারে, আবার ৫৫০ কিলোমিটারও হতে পারে। আমাদের কাজ ছিল সেইসব গ্রহাণুতে নির্দিষ্ট কিছু মূল্যবান মৌল খুঁজে বের করা। এবং তেমন কিছু পেলে ইওরোপায় সেসব এনে জড়ো করা।
এই সময় আমাদের মাইনিং টিমের ভাগ্য ভালো ছিল। একটা অ্যাস্টরয়েডের সন্ধান আমরা পেলাম যার বুকে রয়েছে… তাল তাল সোনা! আমরা আবিষ্কারের আনন্দে পাগল হয়ে গেলাম। আমাদের মহাকাশযান সেই গ্রহাণুতে ঘাঁটি গেড়ে বসল এবং দিন-রাত এক করে কাজ চলতে লাগল। বড়কর্তাদের কাছে খবর গেল। তাঁরা খবর পাঠালেন খোদ ইওরোপা সরকারের কাছে। আমরা যে এত সোনার সন্ধান পাব, এটা সরকার আশা করেনি। পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে সরকার এক অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নিল। আমাদের বলা হল ইওরোপা বা বৃহস্পতির আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশনে সোনা নিয়ে না ফিরতে। কারণ যে বিপুল পরিমাণ সোনা আমরা উদ্ধার করেছি, তাতে সোনার বাজারদর পড়ে যাবে। এর ফলে সৌরজগতের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
আমাদের বলা হল সরাসরি ক্যালিস্টো উপগ্রহে চলে আসতে। এখানে একটা মিলিটারি বেস আছে। নাম হেক্সা বেস। যদিও খাদ্য ও অক্সিজেন সমস্যার জন্য সেনারা কেউ এই বেসে থাকে না। হেক্সায় রয়েছে স্বয়ংক্রিয় আত্মরক্ষা ব্যবস্থা। অল্প কিছু আর্মি রোবট জায়গাটায় বাস করে।
সরকারি নির্দেশমতো আমরা হেক্সায় নামলাম। এর আগে কখনও ক্যালিস্টো চাঁদের জমিকে এত কাছ থেকে দেখিনি। ধূসর মাটির ওপর জমে রয়েছে বরফ। সূর্য থেকে বহু মিলিয়ন কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ক্যালিস্টোতে ভীষণ ঠাণ্ডার প্রকোপ রয়েছে। এখানে কোনও বড় পাহাড় নেই। কোথাও কোথাও সারি সারি বরফের ছোট্ট টিলা কাঁটার মতো উঁচু হয়ে রয়েছে। গোটা উপগ্রহটাই একটা বরফ শীতল মৃত্যু-রাজ্য।
আমাদের মহাকাশযান আস্তে আস্তে ক্যালিস্টোপৃষ্ঠে অবতরণ করল। সামনে মিশকালো অন্ধকারের মতো দাঁড়িয়ে একটা বিরাট আর্মি বেস। এত বড় কাঠামো কে, কবে তৈরি করল? প্রশ্নটা মাথায় আসতেই জিজ্ঞেস করলাম ফিওদোরকে। ফিওদোর একটু ভেবে বলল, “কাজ হয়তো শুরু হয়েছিল বহু আগে। হতে পারে এত বিশাল সামরিক কেন্দ্র কয়েক প্রজন্ম ধরে বিজ্ঞানীরা বানিয়েছে। তাই আজ এই রূপে দেখতে পাচ্ছ।”
আমি ফিওদোরের সঙ্গে কথা বলতে বলতে দেখলাম যে আমাদের অন্য দুই সহকারী অ্যানা এবং লিউক ইতিমধ্যেই হেক্সার মূল দরজা খোলার জন্য হেক্সা বেসের কন্ট্রোলিং সিস্টেমকে সাঙ্কেতিক মেসেজ পাঠাচ্ছে। সাঙ্কেতিক তথ্য আদানপ্রদানের পরে এক সময় বিশাল বড় ধাতব দরজা খুলে গেল। আমদের চার জনকে সঙ্গে নিয়ে একটা ল্যান্ড ক্যারিয়ার গাড়ি ভেতরে ঢুকে গেল। ল্যান্ড ক্যারিয়ারের ক্যারিং কেসের ভেতরে তাল তাল অপরিশোধিত সোনা। এখনও পর্যন্ত সেই সোনায় আমরা হাতও ছোঁয়াইনি। তবে গ্রহাণু থেকে সংগ্রহ করার সময় আমাদের স্পেসস্যুটে সেই সোনার স্পর্শ বহুবার লেগেছে।
হেক্সা বেসের ভেতরটা অত্যন্ত প্রশস্ত এবং ফাঁপা। চারদিকে মৃত্যুপুরীর নিস্তব্ধতা। একটা অদৃশ্য যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর আমাদের উদ্দেশে বলে উঠল, “নমস্কার। হেক্সা সামরিক বেসে আপনাদের স্বাগত। এখানে চার জন রোবট আছে। প্রত্যেককেই এনার্জি সংরক্ষণের জন্য নিষ্ক্রিয় করে রাখা আছে। আপনারা চাইলে অ্যাক্টিভেট করে দেব। আর একটা কথা। এই বেস কিন্তু পরিত্যক্ত। এখানকার কৃত্রিম বায়ুমণ্ডল মানুষের শ্বাসপ্রশ্বাসের উপযোগী নাও থাকতে পারে। আপনারা নিজেদের স্পেসস্যুট কোনও অবস্থাতেই খুলবেন না। নিজেদের কাজ হয়ে গেলে যত শীঘ্র সম্ভব এই স্থান পরিত্যাগ করবেন।”
অ্যানা জিজ্ঞেস করল, “এই বেস পরিত্যক্ত কেন?”
যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর নিরুত্তর। কয়েক সেকেন্ড অখণ্ড নিস্তব্ধতা।
ফিওদোর এবার অ্যানার প্রশ্নটাই আবার করল, “আমরা জানতে চাইছি যে এই এত বড় বেসে কোনও মানুষ নেই কেন? ইওরোপার সেনারা এই বেস ছাড়ল কেন? তা ছাড়া, এমন পরিত্যক্ত থাকলে তো মঙ্গলগ্রহের সেনারাও যে কোনও সময় অতর্কিতে আক্রমণ করে এই বেস দখল করে ফেলতে পারে!”
যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর উত্তর দিল, “মাফ করবেন। এই বিষয়ে আমার ডাটাবেসে কোনও তথ্য নেই।”
লিউক বলল, “আমাদের সঙ্গে কিন্তু প্রচুর পরিমাণ সোনা আছে। সোনা অত্যন্ত মূল্যবান ধাতু। এই মূল্যবান ধাতু আমরা ছেড়ে যাব কীসের ভরসায়?”
যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর জবাব দিল, “আমাদের এই বিশাল বেসে বহু লুকোনো কক্ষ আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে সুরক্ষিত কক্ষটি মাটির দুশো ফুট নিচে অবস্থিত। আপনাদের বর্তমান অবস্থান থেকে ডান দিক ঘেঁষে সামনের দিকে একটু হাঁটলেই একটা মাটির নিচে যাওয়ার বড় ক্যারিয়ার দেখতে পাবেন। উঠে পড়ুন। বাকি ব্যবস্থা করা আছে।”
লিউক বলল, “আশ্চর্য কথা। আমাদের নিচে পাঠিয়ে লাভ কী? সব সোনা তো আমাদের নিয়ে আসা ল্যান্ড ক্যারিয়ারেই থেকে গেল। সেটাকে তো নামাতে হবে নাকি?’
আবার কয়েক মিনিট নীরবতা। তারপরেই ভারী ঘট ঘট শব্দ করে প্রায় অন্ধকার ফুঁড়ে দুটো রোবট আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল। এবার যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর বলে উঠল, “এই দুজন রোবট আস্তে আস্তে সোনার কন্টেনারগুলোকে মাটিতে নিয়ে যাবে। আপনারা নিচে যান এবং রোবটদের কন্টেনার নামানো পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।”
যান্ত্রিক কণ্ঠস্বরের কথায় আমরা হাঁটতে থাকলাম। ক্রমে আমাদের গন্তব্য ভার্টিকাল ক্যারিয়ারটির চারপাশে লাল আলোর দপদপানি দেখতে পেলাম। চার জন ক্যারিয়ারে চেপে বসলাম। বসার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সেটা কেঁপে উঠল এবং ঘড় ঘড় শব্দ করে নিচে নামতে থাকল। একটু বাদে আমরা মাটির নিচে একটা বড় ঘরে পৌঁছলাম। এক নতুন অন্ধকারের রাজ্যে পা দিলাম আমরা। কোথাও কোনও শব্দ নেই। কিন্তু মনে হচ্ছিল যে অন্ধকারের ভেতর কিছু যেন আমাদের দেখছিল। কথাটা মনে হতেই আমরা চারপাশে আলো ফেললাম। থরে থরে সাজানো বাক্স ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলাম না। কিন্তু একটা বিষয় মনে হল। যেখানে যেখানে আমাদের আলো পড়ছে, অন্ধকার যেন কেমন যেন আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে। মানে, অন্ধকার পলকের মধ্যে মিলিয়ে যাওয়া নয়, কেমন যেন এক সজীব প্রাণীর মতো গুটিয়ে যাওয়া। যাইহোক, পেছনে ঘট ঘট শব্দ শুনে বুঝলাম যে রোবট দুজনও আমাদের পেছন পেছন নেমে এসেছে।
রোবটগুলো যখন আমার চোখের সামনে দিয়ে দুটো সোনার কন্টেনার ঘরের কোনও এক কোণে রেখে দিয়ে এল, তখন অদ্ভুত এক ক্ষোভের জন্ম নিল মনে। এই সোনা অনেক কষ্ট করে সংগ্রহ করা। জীবনের শেষ চার বছরের অক্লান্ত পরিশ্রম চলে গেছে এর পেছনে। এর সমস্তটা নিয়ে নেবে রাষ্ট্র? না, এ হতে দেওয়া যায় না। কী করা যায়? মাথার ভেতরটা যেন তোলপাড় হতে থাকল। আমার সামনেই আমার তিন সহকর্মী। আত্মরক্ষার জন্য স্পেস লেজার গান সবার কাছেই আছে। কিন্তু অন্যদেরটা গোঁজা বেল্টে। আমারটা ধরা আছে হাতে! বন্দুকে স্রেফ তিনবার লেজার অ্যাক্টিভেশন বোতাম টিপতে হল। লিউক আর ফিওদোর পেছনে তাকানোরও সময় পায়নি। অ্যানা পেয়েছিল। বলা ভালো, আমি তাকে সুযোগ দিয়েছিলাম। অ্যানার প্রতি আমার আবার একটু দুর্বলতা ছিল কিনা! সে আমার সিদ্ধান্তকে একটুও সমর্থন করল না। বরং আমার দিকে স্পেস লেজার গান তাক করে বলল, আমি নাকি খুনি, জোচ্চোর, সন্ত্রাসবাদী। আমাকে নিরাপত্তারক্ষীদের হাতে তুলে দিয়েই তার শান্তি। আমার দিকে বন্দুক তাক করলেও সে ফায়ার করতে পারেনি। তার হাত কাঁপছিল। আমিও তার দিকে বন্দুক তাক করে তার কথা শুনছিলাম। একসময় তার কথা শুনে রাগে উত্তেজিত হয়ে লেজার অ্যাক্টিভেশন বোতামে আমি ডান হাতের বুড়ো আঙুলে জোরে চাপ দিই। এবং না, আমার হাত কাঁপেনি। এর পরের ঘটনা সামান্যই। আমি আবার ল্যান্ড ক্যারিয়ারের সামনে এসে পৌঁছই। বাকি সোনার কন্টেনারগুলো নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে আসি হেক্সা বেস থেকে। ওদের কৃত্রিম কন্ট্রোলিং সিস্টেম আমাকে হঠাৎ চলে যাওয়া নিয়ে নানা প্রশ্ন করেছিল। আমি নীরব থাকি।
এরপর মহাকাশযানে চেপে ইওরোপায় না গিয়ে রওনা দিই মঙ্গলের উদ্দেশে। ইচ্ছে ছিল যে মঙ্গলগ্রহের মহাকাশ-রক্ষীদের একটা-দুটো সোনার কন্টেনার ঘুষ দিয়ে মঙ্গলে পালিয়ে যাওয়া এবং সেখানেই বাকি জীবন কাটিয়ে দেওয়া। কিন্তু সে আর হল কোথায়? মহাকাশ-রক্ষীরা খুবই সৎ। আমাকে আটক করা হল। তারপর দুই গ্রহের বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুসারে আমাকে পুনরায় ইওরোপায় ফেরত পাঠানো হল। তারপর তো এই জেলে এবং এখন মৃত্যুদণ্ড থুড়ি নির্বাসনের জন্য আবার এই ক্যালিস্টো চাঁদে।”
“শালা, তোর গল্প শুনে তো তাক লেগে গেল মাইরি। দেখ, কেমন তোর ভাগ্য। যে গ্রহের বুকে অপরাধ করে গেলি, সেই গ্রহের বুকেই তোকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। ক্যালিস্টোর সঙ্গে তোর গোপন নাড়ির যোগ আছে মাইরি। যাইহোক, তোর গল্প শেষ? জবানবন্দিতে আর কিছু বলবার আছে? নাকি আমি গিয়ে আমার পার্টনারকে জমিতে অবতরণ করতে বলব?”
“আর একটা বিশেষ কথা বলার আছে আপনাকে। কিন্তু ভিডিয়োগুলো সব অফ করলে তবেই বলতে পারি। এটা এমন একটা প্রস্তাব, যেটাতে আপনি আর আপনার পার্টনার আর্থিক দিক থেকে বেশ লাভবান হবেন। আর এই জেলের চাকরি করতে হবে না।”
“হুম, আর্থিক দিক থেকে কীসের লাভ হবে?”
“ক্যামেরাগুলো অফ করুন। বলছি।”
“বেশ, সব ভিডিয়ো রেকর্ডিং অফ করলাম। আশা করি, চালাকি করে কিছু বলবি না। এবার বল।”
“দেখুন, একটা অফার আছে আপনি ও আপনার বন্ধুর জন্য। হেক্সা বেসে যে সোনার কনটেইনারগুলো লুকোনো আছে, সেগুলোর কথা কিন্তু আমি কাউকে বলিনি। যদি আপনারা দুজন আমার সঙ্গে হেক্সা বেসে যেতে রাজি থাকেন তাহলে ওখানকার সোনার কন্টেইনারগুলো আপনাদের।”
“শালা শুয়োর, লোভ দেখাতে তো ভালোই পারিস। আমরা সোনা পেলে তোর কীসের লাভ?”
“লাভ আছে। আপনারা পাবেন সোনা আর আমি পাব জীবন। সোনার কন্টেইনারগুলি নিয়ে আমরা তিনজন এই মহাকাশযানে ফিরে আসব। তারপর আপনারা আমাকে নীহারিকা-ফিফাটি বলে মহাকাশে ভাসমান যে সরাইখানাটা আছে সেখানে ছেড়ে দেবেন। সেখানে আমার কিছু পুরোনো দোস্ত আছে। তাদের সাহায্যে আমি মঙ্গলে পালাব। এটাই হল আমার তরফ থেকে প্রস্তাব। এখন সিদ্ধান্ত আপনাদের।”
“হুম, প্রস্তাবটা লোভনীয়। আমরা যখন হেক্সা বেসের এতটা কাছেই আছি, তখন তোর প্রস্তাবটা ভাবা যেতেই পারে। দাঁড়া, একবার আমার পার্টনারের সঙ্গে আলোচনা করে দেখি।”
২
“মালটা যে মিথ্যে কথা বলছে না, তার প্রমাণ কি?”
“কোনও প্রমাণ নেই। আমাদের গিয়ে দেখতে হবে।”
“তাহলে ওর কথায় আমরা বিশ্বাস করব কেন? হতেও তো পারে যে কোনও অপরাধীদের ডেরায় নিয়ে যাচ্ছে!”
“যতদূর মনে হয় তেমনটা নয়। কারণ এর আগে ক্যালিস্টো উপগ্রহে আমাদের মহাকাশ ড্রোনেরা এসে ঘুরে গেছে। এখানে জীবিত মানুষ দেখা যায়নি। সুতরাং, সেই সম্ভাবনা নেই। দ্বিতীয় কথা, এই বন্দি আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। সে থাকবে নিরস্ত্র আর আমরা থাকব সশস্ত্র। কোনও ঝামেলা হলে সঙ্গে সঙ্গে ওকে মেরে ফেলব। আর হ্যাঁ, আমার প্ল্যান করা আছে। সোনা হাতে পেলেই এমনিতেও একে খতম করে দেব। তাহলে কোনও প্রমাণ থাকবে না।”
“হুম, তাহলে কাজটা করা যেতেই পারে। একবার যদি সোনা পাই তবে তো আমরা বড়লোক হয়ে যাব। তখন তো সত্যিই আর এই অপরাধী নির্বাসনের জঘন্য চাকরি করতে হবে না। মানুষ খুন করতে প্রথমে মজা লাগত। এখন বিরক্ত লাগে মাইরি।”
নাথান ও দীপাঞ্জন একমত হলে সেটা নীলকে জানাল। ক্রমে নাথান মহাকাশযানে বসে হেক্সা বেসের লোকেশন ট্র্যাক করল। কয়েক ঘণ্টা পরেই মহাকাশযান অবতরণ করল হেক্সা বেসের সামনে।
নীল গিয়ে হেক্সার মূল ফটকের সামনে দাঁড়াল। দু-একটা বাইরের কন্ট্রোলিং সিস্টেমের বোতাম টিপে সাঙ্কেতিক আদান-প্রদান শুরু হল। একটু পরে এক যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর ভেসে এল, “নমস্কার, হেক্সা বেসে স্বাগত জানাই। দয়া করে বিধ্বংসী বোমা নিয়ে ভেতরে ঢুকতে চেষ্টা করবেন না। নইলে আমরা আপনাকে অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তি হিসেবে চিহ্নিত করব এবং সমগ্র বেসের ডিফেন্স মেকানিজম চালু করা হবে।”
নীল কথা না বাড়িয়ে আগের গোপনীয় পাসওয়ার্ড দিল। কয়েক মুহূর্ত সবকিছু চুপচাপ। তার পরেই মূল প্রবেশদ্বার খুলে গেল। চাপ চাপ অন্ধকারের জগতকে ফালা ফালা করে দিল স্পেস স্যুটের সঙ্গে লাগানো টর্চের জোরালো আলো।
একটা বিশাল বড় ঘরে তিন জন ছাড়া কেউ নেই। কিন্তু তারপরেই নীলের গল্পে বর্ণিত ঘটনাবলীর মতো হুবহু সব কিছু ঘটতে থাকল। যান্ত্রিক কণ্ঠস্বরকে নীল বলল, “আমরা যে সোনা রেখে গেছিলাম, সেগুলো কি এখনও মাটির নিচের নির্দিষ্ট প্রকোষ্ঠে আছে? নাকি ইওরোপার অফিসিয়ালদের কেউ এসে নিয়ে গেছে?”
যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর জিজ্ঞাসা করল, “কোন সোনার কথা বলছেন? দয়া করে আইডেনটিফিকেশনের জন্য কিছু বলুন।”
নীল একটু ভেবে বলল, “আমার নাম নীল বসাক ওয়াই বিটা ৩৬১। পৃথিবীর দিনের হিসেবে ৪৩৩৩ দিনে ক্যালিস্টো তথা বৃহস্পতির এক বছর পূর্ণ হয়। চলতি ক্যালিস্টো বছরের ২৪৮৯ তম দিনে আমি ও আমার বন্ধুরা এখানে এসেছিলাম। আর আজকে ৩২২৩ তম দিন। এই তথ্য দিয়ে কিছু বের করা সম্ভব?”
কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। তারপরেই যান্ত্রিক কণ্ঠস্বর বলে উঠল, “আপনার তথ্য এবং রেখে যাওয়া সামগ্রীর বিবরণ পাওয়া গেছে। একজন সাহায্যকারী রোবট এসে আপনাদেরকে রেখে যাওয়া সামগ্রীর কাছে নিয়ে যাবে।”
কিছুক্ষণ বাদেই মাটিতে ঘন ঘন কম্পন টের পাওয়া গেল। অন্ধকারের সঙ্গে মিশে থাকা এক রোবটের অবয়ব হঠাৎ আলোর রেখার মাঝে উদ্ভাসিত হল। যন্ত্রমানবটি সংক্ষেপে বলল, “আসুন আমার সঙ্গে।”
নীল, দীপাঞ্জন ও নাথান আস্তে আস্তে এগিয়ে চলল সামনের দিকে। দীপাঞ্জনের অদ্ভুত একটা অস্বস্তি হচ্ছিল। চারপাশের নিঃসীম অন্ধকার সে মহাশূন্যেও দেখেছে। কিন্তু এই অন্ধকার যেন আলাদা। এই অন্ধকার যেন জীবন্ত। যেন সুযোগ পেলেই গিলে খেয়ে নেবে তাদের।
অন্যদিকে নাথানের মনে হচ্ছিল যে নীল হয়তো সুযোগ বুঝে পালাতে পারে। কিম্বা তাদের ওপর অতর্কিতে আক্রমণও করতে পারে। সুতরাং সে তার স্পেস গানটা শক্ত করে ধরেছিল।
কিন্তু সেরকম কিছুই ঘটল না। তিনজন ব্যক্তি রোবটের সঙ্গে মাটির নিচে নামার ভার্টিকাল ক্যারিয়ারের কাছে পৌঁছল। ক্যারিয়ার তাদের নিয়ে আস্তে আস্তে নিচে নামতে শুরু করল। নামতে নামতে নাথান খেয়াল করল যে চারদিকের দেওয়ালগুলো থেকে কেমন যেন সরসর করে শব্দ হচ্ছে। যেন কোনও কিছু সরে গিয়ে ক্যারিয়ারকে পথ করে দিচ্ছে। কী হতে পারে? কোনও জীর্ণ তার বা অন্য টুকরো পাথর হবে হয়তো।
কিছুক্ষণ পরে ক্যারিয়ার এক জায়গায় এসে থামল। সামনে বহু কন্টেইনারের স্তূপ। রোবট বলল, “সামনের দিকে এগিয়ে যান। আপনাদের সুবিধের ধন্য আপনাদের কন্টেনার লেবেলিং করা আছে। ৩৪ থেকে ৫২ নম্বর কন্টেনার আপনাদের।”
কথাটা শুনে দীপাঞ্জন চমকে উঠল, “৩৪ থেকে ৫২ নম্বর কন্টেনার! কিন্তু কয়েদী নীল তো বলেছিল যে মাত্র দুটো কন্টেনার নিচের এই প্রকোষ্ঠে রাখা হয়েছিল। তাহলে?”
কথাটা মনে হতেই দীপাঞ্জন চেঁচিয়ে উঠল নীলের উদ্দেশে, “এই কুত্তা নীল, আমাদের মিথ্যে কথা বলেছিলি? এই এতগুলো কন্টেনারে কী লুকিয়ে রেখেছিস শালা?”
কথাটা বলে নীলের দিকে তাকাল দীপাঞ্জন। এবং হতভম্ব হয়ে গেল। বন্দিটা কোথায়? এই তো এখানেই ছিল। নীলাঞ্জনের অনেকটা সামনে নাথান। তার বেশ কিছুটা পেছনে সেই রোবটটা। তাহলে নীল গেল কোথায়? চিন্তা করতে করতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল দীপাঞ্জন। হঠাৎ নাথানের চিৎকারে সম্বিত ফিরল তার। দেখল নাথানের চারদিকে অন্ধকার কেমন যেন ঢেউয়ের মতো দুলছে। তার পরমুহূর্তেই এক নাথানের স্পেসস্যুটের ওপর যেন অদ্ভুত কিছু যেন ঝাঁপিয়ে পড়ল। তার স্পেসস্যুটের হেলমেটের কাচ ভাঙার শব্দ পেল দীপাঞ্জন। তারপরেই নাথানের হাড়হিমকরা আর্তনাদ শুনতে পেল সে। নাথান ও তার পুরো স্পেসস্যুটটা যেন গিলে খেয়ে ফেলল অন্ধকার।
প্রবল ভয়ে পালাবার জন্য পেছনে ফিরল দীপাঞ্জন। দেখল যে রোবটটা একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু রোবটের ধাতব চামড়ার ওপরে কী যেন বাইছে। কী ওগুলো? যেন শত শত ক্ষুদ্র কালো পোকা! চরম আতঙ্কে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে দীপাঞ্জন। মাটি ঘেঁষে, চারপাশ থেকে দীপাঞ্জনের দিকে এগিয়ে আসে এক কালো তরলের ঢেউ। দীপাঞ্জনের স্পেসস্যুটের বর্ম ভেঙে যায়। সঙ্গে সঙ্গে মিশকালো কোনও তরল তার চামড়ার ওপর দিয়ে বইতে থাকে। দীপাঞ্জন প্রাণপণে চেঁচিয়ে উঠল। দীপাঞ্জনের সর্বাঙ্গ অধিকার করার পরে সেই রহস্যময় অন্ধকার তরল কান, নাক ও মুখের ফুটো দিয়ে শরীরের ভেতর ঢুকতে থাকল। দীপাঞ্জন অজ্ঞান হয়েছিল আগেই। এবার সে শ্বাসকষ্টের জন্য প্রাণ হারাল। সেই অপার্থিব, ভয়ানক অন্ধকার তরল দীপাঞ্জনের হাড় ও মজ্জার সঙ্গে মিশে গেল। তার মৃত শরীরের চামড়া কুরে কুরে খেতে লাগল সেই ভয়ঙ্কর অজ্ঞাত জীব (কিম্বা জীবের সমষ্টি!)
৩
আমার পুরো নাম নীল বসাক ওয়াই বিটা ৩৬১। এটা সত্যি সত্যিই আমার নাম। তবে হেক্সা বেস নিয়ে যে গল্পটা আমি আগে নাথান ও দীপাঞ্জনকে শুনিয়েছিলাম, সেটা মিথ্যে। সত্যি গল্পটা এবার বলি। অবশ্য এটাও কতটা সত্যি, তা নিয়ে যে কেউ প্রশ্ন তুলতে পারে। কারণ এই গল্পের কিছুটা আমি সত্যি বলে জানি, আর কিছুটা আমার কল্পনা বা অনুমান। তাহলে বলেই ফেলি কথাগুলো।
হ্যাঁ, এটা ঠিক যে আমি ও আমার তিন সহকর্মী হেক্সা বেসে এসেছিলাম। এটাও ঠিক যে সোনার লোভ আমাদের চার জনেরই ছিল। কিন্তু গ্রহাণু থেকে সোনা সংগ্রহ এবং হেক্সা বেসে সোনাগুলো রেখে আসার জন্য আমাদের মোটা অঙ্কের বহির্বিশ্ব মুদ্রা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি হয় সরকারের তরফে। সুতরাং বুঝতেই পারছেন, সোনার জন্য আমি ফিওদোর, লিউক বা অ্যানাকে খুন করিনি। আমি আসলে ওদের কাউকে খুনই করিনি!
হেক্সা বেসে ওই যে ঘরটা আছে, ওই যে মাটির নীচের ঘরটা, ওখানেও আমি প্রথমে যাইনি। গিয়েছিল ফিওদোর ও লিউক। আমি ও অ্যানা ছিলাম ল্যান্ড ক্যারিয়ারের কাছে। রোবটের দল ওপর থেকে সব সোনার কন্টেনারগুলো নিচে ঠিকঠাক নিয়ে যাচ্ছে কিনা সেটা দেখাই ছিল আমার আর অ্যানার কাজ। হঠাৎ আমাদের হাতে ধরা রেডিয়ো ওয়েব ডিকোডার থেকে শব্দ ভেসে এল, “নীল, অ্যানা, তোমরা শুনতে পাচ্ছ? এখানে সাংঘাতিক কাণ্ড! একটা কুচকুচে কালো অতিকায় জন্তু তার শুঁড় বাড়িয়ে আমায় ধরতে চাইছে। ওয়েট! ঠিক শুঁড় নয়। সব ক-টা শুঁড় জুড়ে জুড়ে একটা বিরাট বড় হাঁ হয়ে যাচ্ছে। ওটা আমাকে আর লিউককে তাড়া করছে। মহান গ্রহ জুপিটারের দিব্যি আমি এমন অদ্ভুত ধরনের প্রাণী আর দেখিনি। ওহ না! আঠালো কিছু আমাদের স্পেসস্যুটে জমি থেকে উঠে আসতে চাইছে। স্পেসস্যুটের বর্মে ফাটল ধরেছে। ভয়ানক কিছু আমাদের জড়িয়ে ধরেছে। সারা শরীরে কেউ যেন দাঁত ফোটাচ্ছে! উহ, এই ব্যথা অসহ্য! পালাও তোমরা, এখান থেকে পালাও!” এর পরে ফিওদোরের গলা আর শোনা গেল না। শোনা গেল ফিওদোর ও লিউকের সম্মিলিত কানফাটানো চিৎকার। কয়েক সেকেন্ড পরে গোঙানি। তারপর সব চুপচাপ। কেবল রেডিয়ো ডিকোডারের ঘড়ঘড় শব্দ।
অ্যানা উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, “ফিওদোর ও লিউকের নির্ঘাত কিছু হয়েছে। চলো নিচে যাই। ওদের সাহায্য করি।”
আমি বিমর্ষভাবে বললাম, “সম্ভবত, ওরা আর বেঁচে নেই। আমাদের এই স্থান অবিলম্বে ত্যাগ করা উচিত।”
অনেকবার জোরাজুরি করার পরেও অ্যানা কথা শুনল না। আমাদের দুজনের তর্ক যখন চলছে, ঠিক তখনই অন্ধকার ফুঁড়ে একটা রোবট এগিয়ে এল। রোবটটার সর্বাঙ্গ মিশমিশে কালো। কিছুটা অস্বাভাবিক রকমের কালো। সেই সময়েই খেয়াল করলাম, তার গায়ের ধাতব বর্মের ওপর চ্যাটচ্যাটে কালো কিছু লেপ্টে আছে। অ্যানার কাছাকাছি রোবটটা আসতেই সেই কালো বস্তুটা রোবটের গা ছেড়ে অ্যানার মুখ লক্ষ্য করে ঝাঁপ দিল। মুহূর্তের মধ্যে অ্যানার মুখটা যেন কালো আলকাতরা দখল করে নিল। তার তীব্র চিৎকার হেক্সা বেসের নিস্তব্ধতা ভেঙে খান খান করে দিল। আমি প্রাণ ভয়ে দৌড়তে শুরু করলাম ল্যান্ড ক্যারিয়ারের দিকে। ক্যারিয়ারে ঢুকেই চতুর্দিক লক করে দিলাম। ক্যারিয়ারটি বর্গক্ষেত্রাকার এবং চাকাগুলি সবদিকেই চলতে সক্ষম। ফলে আর সেটিকে ঘোরাতে হল না। ব্যাকওয়ার্ড মোশন অ্যাক্টিভেট করে গতিবেগ সর্বোচ্চ করে দিলাম। হেক্সা বেস থেকে দ্রুত বেগে বেরিয়ে এলাম। সেখান থেকে মহাকাশযানে। মহাকাশযানে পৌঁছে আর চোখের জল ধরে রাখতে পারলাম না। আমার সারা শরীর কাঁপছিল। দীর্ঘদিনের সহকর্মীদের হারানোর চরম হতাশা। কিন্তু বসে থাকলে চলবে না। আমায় বাঁচতে হবে।
বেশ কয়েকদিন মহাশূন্যে ওড়ার পরে পৌঁছলাম ইওরোপার লোকালয়ে। সেখানে সরকারি বড়কর্তারা আমার কথা বিশ্বাসই করল না। নিজের সহকর্মীদের খুনের মিথ্যে অভিযোগে আমায় ফাঁসানো হল। পুরোটাই যে রাষ্ট্রের ষড়যন্ত্র সেটা বুঝতে পারলাম, বিনা সাক্ষ্যপ্রমাণ ছাড়াই আমাকে হাজতবাস ও পরে ক্যালিস্টো গ্রহে নির্বাসনের শাস্তি শোনানোর পরে। আসলে আমাদের সোনা আবিষ্কারের খবরে সরকার মোটেও খুশি হয়নি। যে পরিমাণ সোনার সন্ধান আমরা গ্রহাণুতে পেয়েছিলাম তার পুরোটা ইওরোপা ও মঙ্গলগ্রহের বাজারে চলে এলে সোনার আর কোনও মূল্যই থাকবে না। অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই সরকার এক ষড়যন্ত্র করে। সম্ভবত বহুদিন আগে হেক্সা বেসে কোনও শয়তানি পরীক্ষানিরীক্ষার ফলে এক শেপ চেঞ্জিং প্রাণী তৈরি হয়। আবার হতে পারে যে সৌরজগতের অন্য কোথাও থেকে সৈন্যরা সেই প্রাণীর নমুনা সংগ্রহ করেছিল। কোনওভাবে সেই প্রাণী ছাড়া পেয়ে যায় এবং হেক্সা বেসে নিজের নিধনযজ্ঞ চালায়। বাধ্য হয়ে সৈন্যরা স্থানটা পরিত্যক্ত ঘোষণা করে। রাষ্ট্র বেশ জেনেবুঝেই আমাদের হেক্সা বেসে পাঠায়। সেখানে সোনাও সুরক্ষিত থাকবে আর আমরাও মারা যাব। সোনা আবিষ্কারের কথা আর পাঁচকান হবে না। কিন্তু আমার বেঁচে ফেরায় সমস্যা তৈরি হয়। অগত্যা আমায় বিনা দোষে…
এবার বলা যাক কেন আমি নাথান ও দীপাঞ্জনকে মিথ্যে বলে এখানে নিয়ে এলাম। ইওরোপার জেল আধিকারিকরা যে বন্দিদের ওপর কত সৃষ্টিশীল অথচ বীভৎস অত্যাচার করে, তা নিজের অভিজ্ঞতা ছাড়া বোঝাই যায় না। এই যে আমি ল্যাংড়া হয়ে গেছি, বাঁ কানটা আমার কাটা এবং কৃত্রিম চোখ বসাতে হয়েছে, এর জন্য তো জেল আধিকারিকদের মধুর ব্যবহারই দায়ী! তাই ঠিক করেছিলাম যে নিজে মরার আগে অন্তত এদের একজনকে শেষ করে তারপর মরব।
তবে মৃত্যুর দিকে কয়েক পা এগিয়ে গেলেও অন্য অনেকের মতোই আমারও বাঁচার ইচ্ছে প্রবল। তাই তো মরবার আগে দীপাঞ্জন আমায় দেখতে পেল না, কারণ আত্মরক্ষার তাগিদে আমি আমার স্পেসস্যুটের সব আলো নিভিয়ে দেওয়ালের সঙ্গে একেবারে সেঁটে দাঁড়িয়েছিলাম। নিজেকে আঁধারে ঢেকে নিলে সেই অন্ধকারের প্রাণী আবার আক্রমণ করে না! সেটা আলো লক্ষ করে ঝাঁপাতে ভালোবাসে। এছাড়া সচল বস্তুও তাকে আকর্ষণ করে।
নাথান ও দীপাঞ্জন মরে গেছে। আমার সামনে এখন অনেকটা পথ। ভার্টিকাল ক্যারিয়ার দিয়ে ওপরে পৌঁছতে হবে, এই হেক্সা বেস নামক মৃত্যুপুরী থেকে বেরোতে হবে, মহাকাশযানে পৌঁছতে হবে। সবই করতে হবে, কিন্তু, কিন্তু… আশেপাশে হঠাৎ অদ্ভুত একটা সরসর করে শব্দ হচ্ছে, হয়তো সেই প্রাণীটা আমার হাঁটাচলার শব্দটুকু টের পেয়েছে। কোনও ভয়াল কিছু হেক্সা বেসের মাটির নিচের ঘরে আমার চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে… হয়তো বা আমার স্পেসস্যুটের গা ঘেঁষে…
Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, বিশ্বজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়, ষষ্ঠ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা