এ ক্রাইম ইন টাইম

  • লেখক: এস. সি. মন্ডল
  • শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব

১৯২০ সাল, লন্ডন। সন্ধে থেকে আকাশে মেঘ করেছে। হয়তো কিছু পরেই বৃষ্টি শুরু হবে। আপাতত গুরুগম্ভীর শব্দের সঙ্গে সাদা বিদ্যুতের রেখা খেলা করে চলেছে মেঘের বুক চিরে। সেই আলোতে ব্যাংক অব লন্ডনের সাউদার্ন এভিনিউ শাখার লাল ইটের ভবনটা থেকে থেকে আলোকিত হয়ে উঠে পরক্ষণেই আবার মিলিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারের ভিতর।

দূরে টেমসের তীরে দাঁড়িয়ে থাকা ক্লক টাওয়ারের বড় ঘড়িটায় যখন একটা বাজতে আর দশ মিনিট বাকি ঠিক তখন অন্ধকার ভেদ করে সহসাই দুজন মানুষ এসে দাঁড়াল ব্যাংকের নুড়ি ফেলা পথের সামনে। দুজনের পরনেই কালো ওভারকোট, মাথায় ফেল্টের হ্যাট আর হাতে দুটো কালো ডাফল ব্যাগ। সতর্ক দৃষ্টিতে চারপাশটা একবার জরিপ করে নিয়ে ব্যাংকের দিকে পা বাড়াল তারা। কয়েক পা সামনে বাড়াতেই একজন গার্ড এসে লোক দুজনের পথ রোধ করে দাঁড়াল, তারপর বাজখাই গলায় জিজ্ঞেস করল—

‘তোমরা কারা?’

লোক দুজন গার্ডের কথার কোনও উত্তর দিল না। বদলে ওভারকোটের পকেট থেকে ক্যানিস্টার বের করে এনে কিছু একটা স্প্রে করল গার্ডের নাকে মুখে। সঙ্গে সঙ্গেই টলে পড়ে গেল গার্ড। গার্ডের অচেতন দেহটা পথের পাশের ঝোপের ভিতর লুকিয়ে রেখে লোক দুজন এবারে এগিয়ে গেল সামনের দিকে। তারপর একে একে ব্যাংকের বাকি তিনজন গার্ডকেও চেতনানাশক স্প্রে দিয়ে অজ্ঞান করে ভিতরে ঢুকে পড়ল।

ব্যাংকের ভিতর থেকে লোক দুজন যতক্ষণে আবার বের হয়ে এল, ততক্ষণে পঁয়ত্রিশ মিনিট কেটে গেছে। তাদের হাতের ডাফল ব্যাগ দুটো এখন আর ফাঁকা নেই। গার্ডদের জ্ঞান তখনও ফেরেনি। দ্রুত পায়ে হেঁটে গেটের বাইরে আসতেই হঠাৎ থমকে দাঁড়াল সামনে থাকা লোকটা। সতর্ক হয়ে দাঁড়িয়ে কান পেতে কিছু একটা শোনার চেষ্টা করল। এমন সময় পিছনের লোকটা এগিয়ে এসে প্রথম লোকটার কাঁধে হাত রেখে কিছু একটা বলতেই প্রথম লোকটা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এল। তারপর দ্রুত পা ফেলে লাল ইটের ভবনের পিছনে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল দুজন।

পরদিন লন্ডন থেকে প্রকাশিত দৈনিক স্কটসম্যান পত্রিকার সান্ধ্য সংস্করণে খবরটা ছাপা হল।

“কাল রাতে ব্যাংক অব লন্ডন এর সাউদার্ন এভিনিউস্থ শাখায় এক দুর্ধর্ষ ডাকাতি সংঘটিত হয়েছে। ব্যাংকের ভল্ট অক্ষত থাকলেও লকারের বহুমূল্য দ্রব্যের সমস্ত কিছুই খোয়া গেছে।… ”

পরবর্তী দুটো সপ্তাহ টক অব দ্য টাউন হয়ে রইল এই খবরটা। সকালের ব্রেকফাস্টের টেবিল থেকে শুরু করে সন্ধ্যার চায়ের টেবিলে, অফিস পাড়া থেকে শুরু করে রেসের মাঠে বহু জল্পনাকল্পনা হল ঘটনাটা নিয়ে। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের চৌকশ অফিসারেরা নাওয়াখাওয়া ভুলে রহস্য উদ্ঘাটনের পিছনে পড়ে রইলেন।

কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। ডাকাতি করে লোক দুজন যেন বাতাসে মিলিয়ে গেছে। তারপর মাস পেরোতেই অন্য মামলা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল পুলিশবাহিনী। বার কয়েক ফলো আপ রিপোর্ট করার পর একসময় পত্রিকাওয়ালারাও হাল ছেড়ে দিল। তারপর ক্রমে লন্ডনের বিপুল ব্যস্ত জীবনের চাপে একসময় ঘটনাটার কথা বেমালুম ভুলে গেল সকলে।

১৫ অক্টোবর, ২০৭০, লন্ডন। নিউ হরাইজন টাওয়ারের একশো কুড়ি তলার স্কাই ভিউ রেস্টুরেন্টের এক কোনে বসে আছে রিক আর ডেভ। স্বচ্ছ কোয়ার্টজের জানালা দিয়ে বাইরের ডুবন্ত সূর্য দেখা যাচ্ছে। লালচে আভায় ভরে গেছে আকাশ। প্লেট থেকে একটা রোস্টেড টম্যাটো তুলে নিয়ে মুখে পুরে দিয়ে হাতের কাগজটা ডেভের দিকে এগিয়ে দিয়ে রিক বলল, ‘এটা দেখ।’

ডেভ কাগজটা নিয়ে খুলে দেখল সেটা একটা কোম্পানির কনসেন্ট লেটার— নোভা টাইম ট্যুরিজম কর্পোরেশন। এদের নাম ডেভ আগে শুনেছে, সারা বিশ্বে যে এগারোটা কোম্পানি টাইম ট্যুরিজম সার্ভিস দেয়, তাদের মধ্যে এরা বেশ নামকরা। লন্ডনে এদের এই শাখাটা খুলেছে প্রায় বছর পাঁচেক আগে। ডেভ জিজ্ঞেস করল, ‘কী এটা?’

‘আগামী সপ্তাহে একটা ছোট্ট টাইম ট্রাভেলে যাচ্ছি তুমি আর আমি। সেটার সম্মতিপত্র।’

রিকের উত্তর শুনে ভীষণ অবাক হল ডেভ। তারপর একটু সামলে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘এর জন্যই কী তুমি আমাকে ডেকেছ?’

‘হ্যাঁ, সেটা বললে ভুল হবে না।’

রিককে অনেকদিন ধরে চেনে ডেভ। সত্যি বলতে কি রিকের মতো ধান্দাবাজ লোক ডেভ আর দেখেনি। তবে ধান্দাবাজ হলেও রিকের কল্পনাশক্তি আর বুদ্ধির জুড়ি মেলা ভার। লোক ঠকানোর এমন সব বুদ্ধি রিকের মাথায় আসে যেটা ডেভের মাথায় কোনওদিনই আসত না। এখন পর্যন্ত রিকের এমন অনেক ধান্দাবাজিতেই পার্টনার হিসেবে ছিল ডেভ। তবে টাইম ট্রাভেল এর মধ্যে নতুন কি ধান্দা খুঁজে পেল রিক সেটা ডেভের বোধগম্য হল না। কাগজটা টেবিলে নামিয়ে রাখতে রাখতে সে জিজ্ঞেস করল, ‘তা হঠাৎ টাইম ট্রাভেল এর দরকার হচ্ছে কেন?’

‘ধরে নাও এমনিই। দুজন মিলে একটু ঘুরে আসব।’

‘রিক, ভুলে যেও না তোমার সঙ্গে আমার পরিচয় নতুন নয়। বরং এবারের প্ল্যানটা কী সেটা বল।’

ডেভের প্রশ্ন শুনে হেসে ফেলল রিক। তারপর ঝলসানো ট্রাউট মাছের একটা টুকরো মুখে দিয়ে চেয়ারে সোজা হয়ে বসে ডেভের দিকে চেয়ে বলল, ‘প্ল্যানটা খুব সহজ। অতি সরলভাবে বললে এবারে আমরা দুজন একটা ডাকাতি করতে যাচ্ছি।’

‘অতীতে না ভবিষ্যতে?’

‘অতীতে।’

টেবিলে রাখা কফির কাপটা তুলে নিয়ে নিজের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে ডেভ বলল, ‘বিষয়টা যে অসম্ভব আশা করি সেটা তুমি জানো। অতীতে গিয়ে সামান্য একটা প্রজাপতিও যদি তুমি মারো তবে সেটার ফলাফল কি হতে পারে জানো?’

‘বাটারফ্লাই এফেক্ট। জানি, জানব না কেন?’

‘তাহলে নিশ্চয়ই এটাও জানো টাইম কিপার দপ্তরে দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা টাইম লাইন মনিটর করা হয়। কাজেই অতীতে গিয়ে কিছু যদি আমরা ডাকাতি করিও, সঙ্গে সঙ্গেই টাইম কিপাররা সেটা টের পেয়ে যাবে।’

‘তা যাবে।’ স্বীকার করল রিক।

‘তাহলে?’

রিকের চেহারা দেখে মনে হল এর উত্তরটা তার কাছে আছে, কিন্তু বলার আগে কথাগুলো মনে মনে ঠিক করে গুছিয়ে নিচ্ছে। কথাগুলো গোছানো হয়ে গেলে রিক মুখ খুলল।

‘দেখ ডেভ, টাইম ট্রাভেলের খুঁটিনাটি নিয়ে আমি বিস্তর গবেষণা করেছি। আচ্ছা তুমি বলো টাইম কিপাররা যে টাইম লাইন মনিটর করে, সেটা কীভাবে?’

‘সেটা আমি ঠিক জানি না। তবে শুনেছি এনট্রপি মেজারমেন্ট করে।’

‘হ্যাঁ, সেটা কিছুটা ঠিক। আসলে বুঝলে আমাদের এই মহাবিশ্বের একটা গড় এনট্রপি আছে। এখন অতীতে গিয়ে কেউ যদি এমন কিছু করে যার কারণে মহাবিশ্বের এনট্রপি তাৎপর্যপূর্ণ পরিমাণে বেড়ে যায় তখন তার প্রভাব মহাবিশ্বের গড় এনট্রপির উপরেও পড়ে। এনট্রপির এই পার্থক্যটা থেকেই টাইম কিপাররা বুঝতে পারে যে অতীতে এমন কিছু করা হচ্ছে যা করাটা উচিৎ নয়। কিন্তু ধরো তুমি যদি অতীতে গিয়ে এমন কিছু করো যার কারণে এনট্রপির তেমন বিশাল কোনও পরিবর্তন হয় না, তবে টাইম কিপাররা সেটা আদৌ ধরতে পারবে না। অন্তত থিয়োরি বলে ধরতে পারার সম্ভাবনা অনেক অনেক কম।’

‘কীরকম, আরেকটু ব্যখ্যা কর।’

‘এই যেমন ধর, তুমি অতীতে গিয়ে কোনও একজন মৃত্যু পথযাত্রী লোকের কাছে ভবিষ্যৎ এর পৃথিবীতে কোন কোম্পানির শেয়ারের দাম সবথেকে বেশি হবে সেটা বলে এলে। আর তার কিছুক্ষণের মধ্যেই লোকটা মারা গেল। এক্ষেত্রে টাইম ট্যুরের নিয়ম ভাঙলেও টাইম কিপার দপ্তর তা ধরতে পারবে না। কারণ এই ঘটনায় টাইম লাইনের গড় এনট্রপির তেমন কোনও পরিবর্তন হবে না।’

‘বাহ, আপাতদৃষ্টিতে তোমার কথাটা যুক্তিযুক্ত বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু অতীতে গিয়ে গল্প করা আর ডাকাতি করা কি এক জিনিস হল?’

‘তা হয়তো হল না। আমি আসলে বোঝাতে চাইছি যে তোমার কাজের ফলে যদি এনট্রপির বিশাল পরিবর্তন না হয় তাহলেই হবে। আরেকটু সহজ করে বলি। ধর তুমি এখন টাইম ট্রাভেল করে আঠারোশো সালে লন্ডনে গিয়ে একটা খুন করে এলে, কিন্তু ধরা পড়লে না, তখন কী হবে?’

‘কী হবে?’

‘তখন বর্তমানে বসে তুমি যদি আঠারোশো সালের পুলিশ রেকর্ড বের কর তবে দেখবে এমন একটা খুনের ঘটনা সেখানে উল্লেখ আছে যেটার কিনারা পুলিশ করতে পারেনি।’

ডেভ খানিকক্ষণ নিজে নিজে চিন্তা করল পুরো বিষয়টা। তারপর বলল, ‘তার মানে তুমি বলতে চাইছ আঠারোশো সালের ওই খুনটা আসলে এই আমারই করার কথা ছিল, আর সেটা যদি আমি করি তাহলে টাইম কিপাররা সেটা ধরতে পারবে না?’

‘না পারবে না। যদি এমন হত যে ওই খুনটা অন্য কারও করার কথা ছিল, কিন্তু তুমি গিয়ে আগেই খুনটা করে ফেলেছ তাহলে এনট্রপি বাড়ত। কারণ সেক্ষেত্রে অতীতের ঘটনা পরিবর্তন করা হত। আর তাহলেই টাইম কিপাররা বিষয়টা টের পেত।’

রিকের যুক্তিটা নিয়ে অনেকক্ষণ ভাবল ডেভ। রিক ও তাকে ভাবার সময় দিয়ে নিজের কফির কাপে চুমুক দিতে লাগল। তারপর ভাবা শেষ হলে ডেভ নিজেই বলল, ‘এর মানে হল আমরা যদি অতীতে গিয়ে এমন কোন ডাকাতি করি যেটা আসলে আমাদেরই করার কথা ছিল তবে সেটাতে টাইম লাইনের কোনও পরিবর্তন হবে না। বরং যদি আমরা ডাকাতি না করি তবেই টাইম লাইনের পরিবর্তন হবে। তাই তো?’

‘একদম ঠিক বলেছ।’ হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল রিকের মুখ।

কিছুক্ষণের জন্য একটা নীরবতা নেমে এল টেবিলটায়। নিজের চেয়ারে হেলান দিয়ে কফির কাপ হাতে চোখ বন্ধ করে রইল ডেভ। সে সময়টায় রিক মন দিল টেবিলের বাকি খাবারগুলোর দিকে। মিনিট পাঁচেক পর ডেভই আবার মুখ খুলল।

‘একটা প্রশ্ন, অতীতের ঠিক কোন ডাকাতিটা আমাদের করার কথা সেটা তুমি জানছ কী করে?’

‘থিয়োরিটিক্যালি সেটা সম্ভব নয়। কিন্তু আমি কী করে জানলাম সেটা বলি। দিন পনেরো আগে একদিন রাতের বেলা আমি টেমসের পাশের সাউদার্ন এভিনিউ ধরে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি ফিরছিলাম। ব্যাংক অব লন্ডনের একটা শাখা আছে ওই রাস্তাটায়। সাইনবোর্ড দেখে বুঝলাম সেটার বয়স দেড়শোর উপরে। ঠিক সেই মুহূর্তেই আমার মনে হল যে অতীতে ফিরে গিয়ে যদি আমি এই ব্যাংকটায় চুরি করি তাহলে কী হবে?’

‘বলে যাও’ বলল ডেভ।

‘বাড়ি ফিরে দিন কয়েক টাইম ট্রাভেল এর খুঁটিনাটি বিষয়ে পড়লাম, জানলাম। তারপর ভাবলাম ব্যাংকটার ব্যাপারে আরও বিস্তারিত কিছু জানা যাক। আর সেটা করতে গিয়ে যা জানতে পারলাম তা রীতিমতো বিস্ময়কর।’

বলার মাঝে একটু থামল রিক। তারপর নিজের বুক পকেট থেকে একটা ভাজ করা কাগজের টুকরো বের করে ডেভের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘এটা পড়ো’। ডেভ দেখল সেটা একটা বহু পুরাতন পত্রিকার জেরক্স কপি।

রিক নিজেই আবার বলল, ‘এটা উনিনশো বিশ সালের ২৭শে জুনের ডেইলি স্কটসম্যান পত্রিকার সান্ধ্য সংস্করণ এর কপি। ন্যাশনাল আর্কাইভ থেকে বহু কষ্টে খুঁজে এনেছি…’

কাগজটা খুলে নিয়ে পড়তে লাগল ডেভ,

“কাল রাতে ব্যাংক অব লন্ডন এর সাউদার্ন এভিনিউস্থ শাখায় এক দুর্ধর্ষ ডাকাতি সংঘটিত হয়েছে। ব্যাংকের ভল্ট অক্ষত থাকলেও লকারের বহুমূল্য দ্রব্যের সমস্ত কিছুই খোয়া গেছে। প্রাথমিক হিসেব মতে এই ঘটনায় খোয়া গেছে প্রায় পাঁচশো আউন্স সোনা, চারশো আউন্স রুপো আর বেশ কিছু মূল্যবান রত্ন। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের একটি চৌকশ দল ঘটনার তদন্ত করছে। ব্যাংকের নিরাপত্তায় নিয়োজিত গার্ডদের বয়ান থেকে জানা যায় কমপক্ষে দুজন ব্যাক্তি এই ডাকাতির সঙ্গে যুক্ত ছিল। কিন্তু এর বেশি আর কিছুই পুলিশ জানতে বা জানাতে পারেনি…”

পড়া শেষ হলে রিক বলল, ‘এই ডাকাতির সমাধান এখনও হয়নি?’

‘নাহ, এই দেড়শো বছরে এখনও হয়নি। ইনফ্যাক্ট স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের অমীমাংসিত মামলার তালিকায় এই মামলাটার কথা এখনও উল্লেখ আছে।’

‘আচ্ছা বুঝলাম তোমার ধারণা হয়েছে যে এই ডাকাতিটা আসলে আমরা দুজন করেছিলাম বা করব। কিন্তু খবরের এই লোক দুজন তো অন্য কেউ ও হতে পারে, তাই না?’

ডেভের প্রশ্ন শুনে হেসে ফেলল রিক, তারপর হাসতে হাসতেই বলল, ‘আমি জানতাম এই প্রশ্ন আসবে। শোন ডেভ, এত কাঁচা কাজ করার মতো মানুষ আমি না সে তো তুমি জানোই। গত পরশু একটা ছোট্ট টাইম ট্যুরে গিয়েছিলাম আমি। ১৯২০ সালের ২৭ জুন রাত একটায়। কোথায় গিয়েছিলাম আশা করি বুঝতেই পারছ। সেখানে রাত একটা বেজে পঁচিশ মিনিটের সময় দুটো লোককে আমি ব্যাংক থেকে বেরিয়ে আসতে দেখি। সেসময় আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। সেই আলোতে লোকদুটোকে চিনতে আমার একটুও ভুল হয়নি। তাদের একজন হল রিক মর্টিমার মানে স্বয়ং আমি আর অন্যজন হল ডেভ লোগান, মানে তুমি।’

রিকের কথা শুনে থ হয়ে বসে রইল ডেভ। বোঝা যাচ্ছে প্ল্যানিং এ কোথাও ফাঁক রাখেনি রিক। মনে মনে ডেভ এর মধ্যেই রাজি হয়ে গেছে রিকের প্ল্যানে। তবু কনসেন্ট লেটারে সই করার আগে শেষ একবার সে জিজ্ঞেস করল, ‘অতীতে গিয়ে যখন দেখেই এসেছ যে ডাকাতিটা আমরাই করেছি, তাহলে ভবিষ্যতে গিয়েও একবার দেখে আসতে যে আমরা ধরা পড়েছি কিনা?’

‘ওহ ডেভ, তুমি কি ভেবেছ সেটা আমার মাথায় আসেনি? কিন্তু চাইলেও সে উপায় নেই। কারণ নির্দিষ্ট ভবিষ্যৎ বলে তো আসলে কিছু নেই। যা আছে তা হল শুধু সম্ভাবনা। ভবিষ্যৎ যে কেমন হবে তার কয়েক মিলিয়ন বিলিয়ন সম্ভাবনা আছে। তার কোনটায় হয়তো আমরা ধরা পড়লেও পড়তে পারি। যে কোনও অপরাধে এইটুকু ঝুঁকি তো থাকবেই, আর আশা করি সেটুকু ঝুঁকি নিতে তোমার আপত্তি নেই।’

এগ্রিমেন্টের কাগজটায় সই করতে করতে ডেভ বলল, ‘একদমই না। পাঁচশো আউন্স সোনার ব্যাপার যখন, তখন এইটুকু ঝুঁকি তো নেওয়াই যায়।’

১৯ অক্টোবর, ২০৭০। ব্যাংক অব লন্ডনের সাউদার্ন এভিনিউ শাখা থেকে তিনশো মিটার দূরে একটা ক্যাফেতে বসে আছে রিক আর ডেভ। ক্যাফের জানালা দিয়ে ব্যাংকের সামনেটা দেখা যাচ্ছে। চুরি করার অভিজ্ঞতা রিক আর ডেভ দুজনেরই আছে। কিন্তু এবারে তো শুধু চুরি নয়, বরং ডাকাতি। তায় আবার ব্যাংক ডাকাতি! এই ব্যাপারটা তাদের জন্য নতুন।

টাইম ট্যুরে যাবার আগে তাই মাঝের এই দুটো দিন দুজন ব্যয় করছে ডাকাতির প্ল্যানটা ঠিক করে সাজিয়ে নিতে। এই ক’দিনে ন্যাশনাল আর্কাইভ থেকে ১৯২০ এর পত্রিকা ঘেঁটে যতখানি সম্ভব খবর জোগাড় করে রিককে পাঠিয়েছে ডেভ। সেগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করে আজকে এখানে দেখা করতে বলেছে রিক।

দু-একটা সাধারণ কথা চালাচালির পর ডেভ জিজ্ঞেস করল, ‘খবরগুলো থেকে নতুন কিছু পেলে?’

‘অনেক কিছু ডেভ, অনেক কিছু। সত্যিই দারুণ কাজ করেছ তুমি।’

‘আরে আমি তো শুধু ওগুলো জোগাড় করে আনলাম। আচ্ছা বাদ দাও, তা কী পেলে বল শুনি।’

‘সেদিন রাতে ব্যাংকে গার্ড ছিল চারজন। দুজন নিরস্ত্র আর দুজন সশস্ত্র। অস্ত্র বলতে ছিল কোল্ট থ্রি এইট রিভলভার। গার্ড চারজনকে অজ্ঞান করা হয় কোনও এক ধরনের চেতনানাশক গ্যাস দিয়ে। ব্যাংকের ভল্ট ছিল চব্বিশ ইঞ্চি পুরু নিরেট লোহার তৈরি, সেটায় হাত দেয়নি ডাকাতেরা। তারা শুধু ব্যাংকের লকারগুলোই ভেঙেছে। লকারগুলো ছিল মিলিটারি গ্রেডের স্টিলের। সেই স্টিল গলিয়ে ফেলা হয়েছিল প্রচণ্ড উত্তপ্ত কিছু দিয়ে। কী দিয়ে সেটা পুলিশ বলতে পারেনি। ডাকাতির দুই ঘণ্টা পর ব্যাপারটা প্রথম টের পায় টহল পুলিশের একটা দল। তারা তখন নিকটস্থ পুলিশ স্টেশনে খবর পাঠায়। গুরুত্বপূর্ণ খবর বলতে এইটুকুই।’

‘বাহ, তা এর থেকে কী সিদ্ধান্ত নিলে?’

‘সিদ্ধান্ত হল সঙ্গে করে নার্ভ এজেন্টের ক্যানিস্টার আর লেজার কাটার নিয়ে যাচ্ছি আমরা। সেগুলো জোগাড় করার দায়িত্ব তোমার।’

‘আচ্ছা সেসব আমি জোগাড় করব।’

‘চমৎকার।’

খানিকক্ষণ চুপ করে বসে রইল দুজন। চায়ে চুমুক দিতে দিতে অদূরের ব্যাংকটাকে দেখতে লাগল। সব ঠিক থাকলে আর দু-দিন পরে দেড়শো বছর আগে এই ব্যাংকটায় ডাকাতি করতে যাচ্ছে তারা দুজন। ডেভের মুখ দেখে মনে হল আরও কোনও প্রশ্ন আছে তার। সেটা বুঝতে পেরে রিক জিজ্ঞেস করল, ‘আর কিছু জানতে চাও ডেভ?’

‘চুরি করা মালামাল আমরা আনব কী করে? টাইম ট্যুর থেকে ফেরার পথে চেক করবে নিশ্চয়ই!’

‘সে ভার তুমি আমার উপর ছেড়ে দাও’ ফাঁকা চায়ের কাপটা নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল রিক।

***

১৯২০, ২৭ জুন। রাত একটা বেজে পঁচিশ মিনিট। ব্যাংক অব লন্ডনের সাউদার্ন এভিনিউ শাখার লাল ইটের ভবন থেকে বাইরে বেরিয়ে এল রিক আর ডেভ। দুজনের হাতে দুটো ভারী ব্যাগ। সবকিছু প্ল্যান মতোই হয়েছে। ঠিক যেন আগে দেখা সিনেমার রিপিট টেলিকাস্ট। আকাশে এরই মধ্যে মেঘ করেছে, ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। হঠাৎই কোনও একটা শব্দ শুনে চমকে উঠল ডেভ। পিছন থেকে দ্রুত এগিয়ে এসে তার কাঁধে হাত দিয়ে একটা চাপ দিয়ে রিক বলল, ‘ভয় পেও না, ওটা ভবিষ্যতের আমি। গাছের আড়াল থেকে লুকিয়ে দেখছি আমাদের।’

নিজেকে দ্রুত সামলে নিয়ে ডেভ বলল, ‘এখন প্ল্যানটা কি? এসব সঙ্গে করে নিয়ে তো নিশ্চয়ই আমরা ভবিষ্যতে ফেরত যাচ্ছি না?’

‘অবশ্যই না। এখন এই জিনিসগুলো আমরা এমন একটা জায়গায় লুকিয়ে রাখব, আগামী দেড়শো বছরে যেখানটায় কোনও পরিবর্তন হবে না। তারপর ফিরে গিয়ে সেখান থেকে তুলে নিলেই হল।’

‘সেটা আমি আগেই কিছুটা আন্দাজ করেছি। কিন্তু সেই জায়গাটা কোথায়?’

‘টাইম ক্যাপসুলে করে যেখানটায় এসে নেমেছি আমরা দুজন।’

‘মানে কী?’

‘শোন ডেভ, টাইম ক্যাপসুল শুধু সেই সমস্ত জায়গাতেই ল্যান্ড করে যে সমস্ত জায়গার কোনও পরিবর্তন ভ্রমণের মধ্যবর্তী সময়ে হয়নি। তার মানে হল আমরা যেখানে ল্যান্ড করেছি, সেই জায়গাটা দেড়শো বছর পরেও একই রকম থাকবে।’

‘আরিব্বাস, এটা তো জানতাম না।’

‘এখন এসো আমার সঙ্গে’ বলে ব্যাংক ভবনের পিছনের অন্ধকারের দিকে পা বাড়াল রিক।

একটানা মিনিট পনেরো হাঁটার পর একটা লেকের পাড়ে এসে থামল দুজন। খানিক দূরে একটা পপলার গাছ দাঁড়িয়ে আছে। এই গাছটার পিছনেই ঝোপের আড়ালে লুকানো আছে রিক আর ডেভের টাইম ক্যাপসুল। রিক জানে ভবিষ্যতের পৃথিবীতেও এই পপলার গাছটা ঠিক এই জায়গাতেই আছে। দেড়শো বছরে শুধু সেটার উচ্চতা আর কাণ্ডের পরিধি বেড়েছে অনেকটা। গাছটাকে দেখিয়ে রিক বলল, ‘অনেক ভেবে এই জায়গাটাই ঠিক করলাম ডেভ। হাতে সময় কম যা করার দ্রুত করতে হবে।’

কথা শেষ করে ওভারকোটের পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা ইলেকট্রিক এক্সক্যাভেটর বের করল রিক। পরবর্তী পাঁচ মিনিটের মধ্যে রিক আর ডেভ মিলে গাছের গোড়ায় গভীর একটা গর্ত খুঁড়ে সোনাদানা ভর্তি নাইলনের ব্যাগ দুটো সেই গর্তে মাটি চাপা দিয়ে দিল। যে হারে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে, তাতে করে একটু পরেই বৃষ্টি নামবে বোঝা যাচ্ছে। আশা করা যায় বৃষ্টির জলে মাটি খোঁড়ার দাগ আর দুজনের পায়ের ছাপ সবই ধুয়ে মুছে যাবে।

কাজ শেষ হতে ডেভের দিকে ফিরে রিক বলল, ‘ডেভ তুমি প্লিজ ওই দূরের ওই জায়গাটায় গিয়ে দাঁড়াও একটু। দেখতো ওখান থেকে কিছু বোঝা যায় কিনা?’

রিকের আদেশ পালন করে হাত দশেক দূরে গিয়ে দাঁড়াল ডেভ। তারপর বলল, ‘সব ঠিক আছে, কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।’

ফিরে আসতে যাচ্ছিল ডেভ, কিন্তু রিক তাকে বাধা দিয়ে বলল, ‘ওখানেই একটু দাঁড়াও, প্লিজ।’

‘কেন?’ দু-হাত উঁচু করে ইশারায় জানতে চাইল ডেভ।

‘বুঝলে ডেভ, ২৭ শে জুনের যে কাগজটা থেকে আমি এই ডাকাতির খবরটা পেয়েছিলাম, সেই কাগজেই আরেকটা খবর ছেপেছিল।’

‘কী খবর?’

‘যেদিন ডাকাতি হয়, তার পরদিন এই পার্কে নাকি একটা পোড়া লাশ পাওয়া গিয়েছিল। পুলিশের ধারণা বজ্রপাতে মারা পড়েছিল লোকটা। শরীরটা একদম পুড়ে যাওয়ায় তার পরিচয় উদ্ধার করা যায়নি।’

রিকের কথা শুনে একটা অজানা বিপদের আশঙ্কায় মনের ভিতরটা কেঁপে উঠল ডেভের। কাঁপা কাঁপা গলায় সে জিজ্ঞেস করল, ‘কী বলতে চাইছো তুমি রিক?’

একটু হেসে রিক বলল, ‘সেদিন যখন অতীত ভ্রমণে এসে ডাকাতিটা দেখে গেলাম, তখন সেই ঘটনাটাও দেখে গিয়েছিলাম।’

‘কী দেখেছিলে?’ চিৎকার করে জানতে চাইল ডেভ।

‘দেখেছিলাম তুমি এখন ঠিক যেখানে দাঁড়িয়ে আছ, সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিলে। আর এমন সময় একটা তীব্র নীলচে আলো…’

কথাটা শেষ করতে পারল না রিক। তার আগেই একটা তীব্র আলোর ঝলকানি যেন আকাশ থেকে ছুটে এসে আছড়ে পড়ল ডেভের উপরে। ওজোন গ্যাসের গন্ধে ভরে গেল চারিপাশ। কাছে ছুটে গিয়ে রিক দেখল ডেভের শরীরটা ঝলসে কালো হয়ে গেছে। এক চিলতে জঘন্য হাসি ফুটে উঠল রিকের ঠোঁটের কোণে। এই পর্যন্ত সব কিছু প্ল্যান মতোই হয়েছে। এখন ২০৭০ এ ফিরে গিয়ে বাকি কাজটুকু যতদ্রুত সম্ভব শেষ করতে হবে। শেষ একবার ডেভের লাশটার দিকে চেয়ে তর্জনী দিয়ে নিজের বুকে ক্রুশ চিহ্ন আঁকল রিক, তারপর টাইম ক্যাপসুলে উঠে বসে ফেরার বাটন চেপে দিল।

২০৭০ এ ফিরে এসে প্রথমেই ট্রাভেল এজেন্টের কাছে ডেভের মারা যাবার ব্যাপারটা রিপোর্ট করল রিক। খবরটা শুনে নিজের চেয়ারে সোজা হয়ে উঠে বসল এজেন্ট লোকটা। টাইম ট্রাভেল এ গিয়ে মৃত্যু! এমন ঘটনার মুখোমুখি তাকে এর আগে হতে হয়নি।

প্রোটোকল অনুসারে সঙ্গে সঙ্গেই টাইম কিপার দপ্তরে ঘটনাটা রিপোর্ট করল সে। কিন্তু কোনও এক কারণে টাইম কিপার দপ্তর বিষয়টা নিয়ে তেমন কোনও উত্তেজনা দেখাল না। রিক শুনতে পেল ফোনের অপর প্রান্তের লোকটা বলছে, ‘শান্ত থাকুন। আমাদের হিসেব অনুসারে টাইম লাইনে কোনও পর্যবেক্ষণযোগ্য পরিবর্তন হয়নি। কাজেই এই ঘটনাটা নিয়তিই ছিল।’

‘মারা যাওয়া লোকটার দেহটা কী ফিরিয়ে…’

অন্য পাশের লোকটা উত্তর দিতে একটু সময় নিল। মনে হল যেন কিছু একটা মিলিয়ে দেখে নিচ্ছে। তারপর আবার ফোনের অপরপ্রান্তে লোকটার কণ্ঠ শোনা গেল, ‘না সেটাও এখন সম্ভব নয়। সেটা উনিশশো কুড়ির পুলিশ খুঁজে পাবে, সেটাই নিয়তি। এর পরিবর্তন আমরা করতে পারব না।’

টাইম কিপার দপ্তরের থেকে পাওয়া উত্তরটা সরাসরিই রিককে জানাল এজেন্ট লোকটা। তারপর ডায়েরিতে ঘটনাটা এন্ট্রি করে রেখে রিককে চলে যেতে দিল।

নোভা কর্পোরেশন এর অফিস থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে হাফ ছেড়ে বাঁচল রিক। এখন পর্যন্ত সবকিছু ঠিকই আছে। টাইম কিপার দপ্তরে টাইম লাইনের কোনও পরিবর্তন ধরা পড়েনি। তার মানে ডাকাতির হিসেবটা একদম নিখুঁতই ছিল বলতে হবে।

বাড়ি ফিরে দিনের বাকিটা সময় বিশ্রাম নিয়ে কাটাল রিক। মাঝে একবার পুলিশ দপ্তর থেকে ফোন এল। টাইম ট্যুরের দুর্ঘটনাটা তাদের কাছে রিপোর্ট করেছে নোভা কর্তৃপক্ষ। কোথায় গিয়েছিলেন, কেন গিয়েছিলেন এই ধরনের সামান্য দুয়েকটা রুটিন প্রশ্ন করে রিককে রেহাই দিল তারা। টাইম ট্যুরে যাবার আগে কারণ হিসেবে নোভা কর্তৃপক্ষকে যা বলেছিল রিক, পুলিশকেও ঠিক সেটাই বলল। টাইম কিপার দপ্তর যেহেতু বলেছে টাইম লাইনে ঘটনাটার কোনও প্রভাব পড়েনি কাজেই পুলিশও ব্যাপারটা নিয়ে বেশি মাথা ঘামাল না। রিককে শুভ সন্ধ্যা জানিয়ে ফোন রেখে দিল তারা।

***

রাত একটার সময় নিজের গাড়িটা নিয়ে বাড়ি থেকে বের হল রিক। রাস্তাঘাট একদমই ফাঁকা। কাকতালীয় ভাবে আজকেও বৃষ্টি হচ্ছে। ঠিক সেই দেড়শো বছর আগের রাতটার মতো। লেকের থেকে খানিকদূরে নিজের গাড়িটা পার্ক করে নেমে পড়ল রিক। তারপর পায়ে হেঁটে সেই পপলার গাছটার নিচে গিয়ে দাঁড়াল। আশেপাশের অনেক কিছুই বদলে গেছে এত বছরে, শুধু পপলার গাছটা এখনও ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।

সঠিক জায়গাটা খুঁজে নিয়ে পিঠের ব্যাগটা থেকে পোর্টেবল এক্সক্যাভেটর বের করে গর্ত খুড়তে শুরু করল রিক। কিছুদূর খুড়তেই মুখটা হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল তার। আছে, নাইলনের ব্যাগ দুটো এখনও এখানেই আছে। নাইলন সহজে পচে না, তাই এত বছর পরে কিছুটা জীর্ণ হলেও ব্যাগ দুটো ঠিক টিকে আছে। রিকের খুব ইচ্ছে হচ্ছিল একবার ব্যাগের চেন খুলে দেখতে। কিন্তু মনের ইচ্ছেটাকে পাত্তা দিল না সে। দেরি করাটা ঠিক হবে না, কেউ দেখে ফেলার আগেই দ্রুত সটকে পড়া দরকার।

ব্যাগ দুটো কাঁধে তুলে নিয়ে গাড়িতে ফেরার জন্য পা বাড়িয়েছে রিক এমন সময় হঠাৎ করেই পুলিশের সাইরেনের শব্দে প্রকম্পিত হয়ে উঠল চারিদিক। সেই সঙ্গে একটা উজ্জ্বল আলো এসে পড়ল রিকের উপর। কিছু বুঝে ওঠার আগেই একজন পুলিশ অফিসার পিস্তল তুলে এগিয়ে এসে চিৎকার করে বলল, ‘মিস্টার রিক মর্টিমার, ব্যাংক অব লন্ডনে ডাকাতির অভিযোগে আপনাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে।’

এমন সময় পিছন থেকে আরেকজন পুলিশ অফিসার এগিয়ে এসে রিকের হাতে এক জোড়া শক্ত হাতকড়া পড়িয়ে দিল। পুরো ঘটনায় রিক এতটাই হতবাক হয়ে পড়েছিল যে বাধা দেবার চিন্তাটাও তার মাথায় এল না। বিস্ময়ের প্রথম ধাক্কাটা কেটে গিয়ে সম্বিত ফিরে পেতেই, রিক জিজ্ঞেস করল, ‘এর মানে কী?’

‘আপনার হাতের ব্যাগ দুটো খুললেই এর উত্তর জানা যাবে’ শীতল গলায় উত্তর দিল পুলিশ অফিসার। একটু চিন্তা করতেই রিক বুঝতে পারল সে ফেঁসে গেছে। বমাল সমেত ধরা পড়েছে পুলিশের হাতে। কিন্তু পুলিশ খবরটা পেল কী করে? কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে রিক জিজ্ঞেস করল, ‘আপনারা খবরটা পেলেন কী করে?’

হাতের ইশারায় অন্য অফিসারকে রিকের ব্যাগ দুটোকে গাড়িতে তুলে দিতে বলে মুখ খুললেন প্রথম অফিসার, ‘উনিশশো কুড়িতে ডাকাতিটা করার সময় অসাবধানে লকারের গায়ে নিজেদের আঙুলের ছাপ রেখে এসেছিলেন আপনি আর ডেভ লোগান। স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড তখন অনেক চেষ্টা করেও সেই ছাপের সঙ্গে কোনও অপরাধীর হাতের ছাপের মিল খুঁজে পায়নি। সেই ছাপগুলো এই দেড়শো বছর ধরে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের কাছেই আছে। পনেরো বছর আগে আপনি যখন ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেন তখন আমাদের কম্পিউটার পুরোনো সেই ছাপের সঙ্গে আপনার হাতের ছাপের মিল খুঁজে পায়। আর মি. ডেভের ছাপের মিল খুঁজে পাওয়া যায় তার দু-বছর পরে। কিন্তু আপনাদের আঙুলের ছাপ কি করে দেড়শো বছর আগে গেল সেটা আমরা তখনও বুঝতে পারনি। কিন্তু ছয় বছর আগে যখন প্রথমবারের মতো টাইম ট্যুরিজম চালু হল তখন ঘটনাটার একটা সাম্ভাব্য ব্যাখ্যা আমাদের গোয়েন্দারা দাঁড় করাল।’

‘তা তখনই আমাদের গ্রেফতার করলেন না কেন?’ খানিকটা রুক্ষ স্বরেই জিজ্ঞেস করল রিক।

রিকের প্রশ্ন শুনে হেসে উঠলেন পুলিশ অফিসার। তারপর হাসতে হাসতেই বললেন, ‘তখন যদি আপনাদের গ্রেফতার করা হত তবে অপরাধটা তো আপনারা করতেই পারতেন না। আর অপরাধ না করলে গ্রেফতার করাটা কি ঠিক হত বলুন?’সমস্ত ব্যাপারটা বুঝতে পেরে প্রচণ্ড হতাশায় কাঁধ দুটো নুয়ে পড়ল রিকের। এত কাছে এসেও সামান্য আঙুলের ছাপের কারণে পুরো প্ল্যানটাই মাটি হয়ে গেল।

অফিসারের নির্দেশে এবার রিককে পুলিশের গাড়িতে তুলে দেওয়া হল। কিছুক্ষণের মধ্যেই লাল নীল আলো জ্বালিয়ে সেটা ছুটে চলল স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের উদ্দেশে।

গাড়িটা চলে যেতেই অঝোর ধারায় বৃষ্টি নামল। সেই বৃষ্টিতে শত বছর আগের এক অপরাধের অন্তিম পরিণতির সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রইল রিকের সদ্য খোড়া গর্ত আর পপলার গাছটা।

Tags: এস. সি. মন্ডল, কল্পবিজ্ঞান গল্প, ষষ্ঠ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা

2 thoughts on “এ ক্রাইম ইন টাইম

  • October 12, 2021 at 7:26 pm
    Permalink

    ওয়াও! দুর্দান্ত টাইম ট্রাভেলিং কল্পগল্প। একেবারে শুরু থেকেই আটকে গেছি। একটানে শেষ করলাম। তবে শুরু থেকে যেভাবে সাসপেন্স বজায় ছিলো, সেই তুলিনায় শেষটা কিঞ্চিৎ সাদামাটা লেগেছে।

    সময় সংক্রান্ত ব্যাখ্যা, টাইম লাইন ভেরিয়েশনের সাথে এন্ট্রোপির ব্যাপারটা খুবই মনে ধরেছে। দারুন আইডিয়া। এমন গল্প সামনে আরও চাই।

    শুভেচ্ছা ও শুভকামনা রইলো।

    Reply
    • October 16, 2021 at 11:15 am
      Permalink

      অশেষ ধন্যবাদ ভাইয়া। আপনার মত বিদগ্ধ লেখকের মতামত আমাদের মত নতুনদের আরো ভালো লেখার জন্য অনুপ্রেরণা জোগায়। আপনার ভালো লেগেছে জেনে খুব আনন্দিত হলাম।

      Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!