ইডেন

  • লেখক: পরাগ ভূঞ‍্যা
  • শিল্পী: পরাগ ভূঞ‍্যা

আজ ইভার মন খুশিতে মাতোয়ারা।

অনেকদিন পর মনের মানুষ অদম্যের সঙ্গে ঘুরতে বেরিয়েছে। হবু বরটা একদম গোবর গণেশ। আন-রোমান্টিক। তার ওপর কাজ-পাগল। ইভাকে সময় দেওয়ার মতন সময় অদম্যের থাকেই না বলেই চলে। তা সত্ত্বেও ‘ট্যাড়া হ্যায় পর মেরা হ্যায়’ বলে ইভা নিজের মতন মানিয়ে নিয়েছে।

রেস্টুরেন্টের ছাদখানা ভারী চমৎকার! সাজানো-গোছানো, ছিমছাম। সবজে কার্পেটের ওপর মনোমুগ্ধকর নক্সা করা কাঠের চেয়ার-টেবিল। ভিড় তেমন একটা নেই।

রাঙা সূর্য, নীল দিগন্তে সিঁদুর লেপে ফিরে যাচ্ছে গোধূলির কোলে। মহানগরের ব্যস্ত রাজপথের শব্দ ছড়িয়ে কানে বাজছে পাখিদের ঘরে ফেরার কলতান।

আর এই সবের মাঝে সামনের চেয়ার আগলে ইভার দিকে তাকিয়ে শিশুসুলভ হাসি হাসছে অদম্য।

এর পর কী হবে ইভার জানা।

সারা সপ্তাহে কেন সময় দিতে পারেনি সেই নিয়ে অদম্য অজুহাতের পাহাড় গড়বে; ইভা অভিমানী বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়বে তাতে। তারপর মানভঞ্জন পর্ব মিটলে প্রেমালাপ শুরু।

ঠিক স্বপ্নের মতন!

বেয়ারা এসে দু-প্লেট স্যুপ এসে টেবিলে দিয়ে যায়।

ইভার ফেভারিট টমেটো স্যুপ। এক চামচ মুখে নিতেই, তৃপ্তিতে ইভার মন আরও উৎফুল্ল হয়ে ওঠে।

এদিকে গোবর-গণেশ অদম্য এখনও ইভার চোখের দিকে তাকিয়ে ভাবনায় মশগুল। অন্যান্য দিনের মতন ফোনে মুখ গুঁজে নেই। বোধহয় প্রেম সাগরে ডুব সাঁতার দেওয়ার অভিপ্রায় জেগেছে। হবু বরের এহেন উলটো-পুরাণ, নৈসর্গিক ভালো-লাগার পরশ হয়ে ইভাকে আলিঙ্গন করে।

“মাঝে মাঝে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে কী দেখো বলতো?” ইভার অভিমান গলে জল।

“ও তুমি বুঝবে না!” অদম্য জবাব দেয়।

“আচ্ছা তাই নাকি! ঠিক আছে বুঝব না যখন আমার এখানে থেকে কী লাভ! চলেই যাচ্ছি

অদম্য হাত বাড়িয়ে ইভার হাতটা চেপে ধরে, তারপর মোলায়েম সুরে বলে, “দেখতে পাই নীল! অন্তহীন নীল!”

কথাটা শুনে ইভার গালে রক্তিম আভা খেলে যায়। অদম্য আজ যেন খুব বেশি রকমের মুডে। লজ্জায় ইভার পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। সে প্রসঙ্গ এড়াতে, অদম্যের থেকে নজর লুকিয়ে চুপচাপ স্যুপের প্লেটে মন দেয়।

আজ দিনটা সত্যি ভালো যাচ্ছে। ঠিক যেন স্বপ্নের মতন।

তার ঠিক তখনই ঘটল ঘটনাটা।

ইভা মাথা নিচু করে প্লেট থেকে চামচে করে স্যুপ খাচ্ছিল বলে বুঝতে পারেনি। কিন্তু রেস্টুরেন্টের বাকিরা টের পেয়েছে।

তিন জন বেয়ারা খাবার পরিবেশন করছিল। তাদের হাত থেকে প্লেটগুলো সশব্দে মেঝেতে এসে পড়ে। তারপর যেন সব কিছু থেমে যায়। চারিদিক থেকে নৈঃশব্দ্যের শূন্যতা এসে গ্রাস করে।

ইভার টনক নড়ে। সে চেয়ে দেখে অদম্য চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ঘাড় উঁচু করে বেবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। শুধু অদম্য একা নয়, সমস্ত কাজ ফেলে রেস্টুরেন্টের সবাই রোবটের মতন তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। একটা আকস্মিক ত্রাসের ঢেউ খেলে যায় ইভার শরীর জুড়ে। তীব্র কৌতূহল নিয়ে ইভা মুখ তুলে ওপরের দিকে তাকায়।

কুসুম রাঙা আকাশ বদলে গিয়ে রৌদ্রজ্জ্বল নীল রং ধারণ করেছে। পশ্চিমের লাল সূর্য আর নেই তার পরিবর্তে একটা প্রকাণ্ড কালো গর্ত। সেখান থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে তরল অন্ধকার এসে নামছে মহানগরের বুকে। তারপর সেই অন্ধকার জমাট বেঁধে একটা সর্বভুক আলকাতরার ঢেউ হয়ে কংক্রিটের জঙ্গল গিলতে গিলতে এগিয়ে আসছে। এগিয়ে আসছে ইভার দিকে।

ইভার স্নায়ুগুলো সহ্যের শেষ সীমা ছাড়িয়ে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। সে হাঁ করে চেয়ে থাকে সেই অজানা সর্বগ্রাসী ক্রমশ এগিয়ে আসা অন্ধকারের দিকে।

সবাই কেমন মন্ত্রমুগ্ধের মতো এক-পা-এক-পা করে এগিয়ে যেতে থাকে ছাদের কিনারায়। তারপর লাফ দেয় নিচে।

অদম্য অনেক আগেই ঝাঁপ দিয়েছে। এবার ইভার পালা।

সেই অদ্ভুত অন্ধকার গহ্বরের দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে কিসের যেন টানে ইভা পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় একদম ছাদের কিনারায়।

পা দিয়ে হাওয়া ভর করতেই, ইভা দুর্বার গতিতে নিচে নামতে থাকে। শুধু…

মাটি স্পর্শ করার আগে ঘন অন্ধকারের ঢেউ গিলে খেল তাকে।

***

ঘুম ভেঙে গেল ইভার। কপালে ঘাম। শরীরের অসাড়-ভাব কাটেনি, নিঃশ্বাস ফুলছে। বুকটা এখনও কাঁপছে।

প্রায় দিনই ইভা দুঃস্বপ্নের শিকার হয়।

সে স্বপ্নে দেখে, রাতের আকাশচুম্বী ইমারতের সারি। ইভা ছাদ থেকে পা পিছলে পড়ে যাচ্ছে অতল অন্ধকারে, ইমারতের বাসিন্দারা বাতি জ্বালিয়ে মরিয়া হয়ে বারান্দায় ঝুঁকে পড়েছে, তাকে দেখছে!

অথবা, একটা ক্লাসরুম, সিলিং থেকে ঝুলন্ত ল্যাম্পের আলো এসে টেবিলের ওপর পড়ে ম্রিয়মাণ হয়েছে অন্ধকারে। একাকী ইভাকে চেয়ার সুদ্ধ চেন দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলা হয়েছে। অংকে সামান্য ভুল হওয়া মাত্রই মরচে পড়া লোহার চেনের করাল থাবা বসে যাচ্ছে ওর মখমলে শরীরের গভীরে… আরও গভীরে। ইভার আর্তনাদের সুযোগ নিয়ে অদৃশ্য কেউ ওর মুখের ভেতর হাত ঢুকিয়ে পাশবিক টানে ছিঁড়ে নিতে চাইছে জিভ।

আর সেদিন!

দু-পক্ষের চুমুর বর্ষণে সিক্ত, অদম্য আর ইভার অন্তরঙ্গ ঢেউয়ের আড়ালে অদম্যের পাঁজর ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে একটা মাংসপিণ্ড… তারপর সেটার রূপান্তর ঘটে… ধীরে ধীরে একটা মেয়ের মুখমণ্ডল স্পষ্ট হয়ে ওঠে। উফফ্ কি অসহনীয় ছিল সেই দৃশ্য!

এই মেয়েটাকে ইভা চেনে। লিলি। ছবি দেখছে। আসলে লিলির পুরনো কেবিনেই ইভার ঠাঁই হয়েছে। কথা প্রসঙ্গে অদম্য এক-দুবার ওর উল্লেখ করেছিল। ব্যাস ওই পর্যন্ত, তার বাইরে সব কিছু ধোঁয়াশা।

কেন এই দুঃস্বপ্নগুলো তার নিত্যরাতের সঙ্গী সে নিয়ে অনেক কিছু ভেবেও কুল-কিনারা পায়নি ইভা। আসলে ইভার মনের গহীনে এক অপ্রতিরোধ্য ভয় এসে বাসা বেঁধেছে। যদি কোনও ব্ল্যাক হোল এসে স্পেসশিপ ইডেন থ্রি’কে গিলে খায়! তার চেয়েও বড় ভয় অদম্যকে হারিয়ে ফেলার।

অদম্যের কথা মনে পড়ে ইভার। সে বিছানা ছেড়ে দৌড়ে দরজার কাছে যায়। নিউমেরিক কোড টিপে দরজা খুলে কেবিনের বাইরে আসে।

কেবিনের বাইরে হল। হলে কৃত্রিম মাধ্যাকর্ষণ নেই। অগত্যা নিজের সঙ্গে যেন নিজেই যুদ্ধ করে, শরীরটাকে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় ঘুরিয়ে, হাতের কাছে যে কোনও স্ট্রাকচারের অংশ ধরে, ভেসে অদম্যের কেবিনের ধারে পৌঁছে যায় ইভা।

দরজার সঙ্গে লাগোয়া কাচের জানলা দিয়ে ইভা দেখে পায়রার খোপের মতন কেবিনে অদম্য বিছানায় গা এলিয়ে ঘুমোচ্ছে।

স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ইভা। কিছুক্ষণ চোখ ভরে দেখে তার স্বপ্নের রাজকুমার শিপ কমান্ডার অদম্যকে। আহামরি সুন্দর নয়, কিন্তু মানুষটার পাশে বসে অনায়াসে একটা জীবন পার করে দেওয়া যায়।

তবে অদম্যের অনুমতি ছাড়া, তার, ভেতরে যাওয়ার অধিকার নেই। এই গোটা মহাকাশযানে তারা মাত্র দুটো প্রাণী। তা সত্ত্বেও শরীর বিনিময় ছাড়া তাদের মনের মিল কখনও ঘটেনি। কমান্ডার অদম্যের কাছে ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার ইভা কেবল একমাত্র ক্রু-মেম্বার হয়েই থেকেছে। এক অনুগত সঙ্গী যে কেবল আদেশ পালন করবে।

একটা ঝাঁকুনির অনুভবে ইভার চিন্তার মায়াজাল কেটে যায়। সত্যিই তো! ব্যাপারটা তার আগে লক্ষ করা উচিত ছিল। হে ঈশ্বর! এতক্ষণ ইন্দ্রিয়গোচর হয়নি কেন!

হলে এলোমেলোভাবে ভাসছে কতগুলো লেড-অ্যাসিড-ব্যাটারি।

কিন্তু এগুলো এখানে কেন? একজন মানুষের সাইজের এই ব্যাটারিগুলো আসলে স্পেয়ার ব্যাটারি। ব্যাক-আপ এনার্জির জন্য এদের ব্যবহার করা হয়। তাহলে কি ইভা যখন বিশ্রাম নিচ্ছিল, তখন স্পেসশিপ কোনও উল্কাবৃষ্টির কবলে পড়েছিল? যদি তাই হয় আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স মিডিসি তাকে ইনফর্ম করত না?

অদম্যের কেবিন ছাড়িয়ে ইভা এগিয়ে যায় হলের শেষ প্রান্তে। হলের ছাদে একটা বড় ফাটল জন্মেছে। ওখান থেকেই ওপর-তলার গোডাউন থেকে নেমে এসে সমুদ্রের এক দঙ্গল জেলিফিসের মতন হাওয়ায় ভাসছে ব্যাটারির দল।

কন্ট্রোল রুমে সব ঠিক আছে তো?

ভাসমান ব্যাটারিগুলো অতিক্রম করে ইভা সন্তর্পণে হলের শেষ প্রান্তে এল। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স মিডিসি কোনও কারণে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। নইলে থ্রি-ডি হলোগ্রাফিক একটা মেয়ের রূপ নিয়ে এতক্ষণে জ্ঞানের বুলি আউড়ে কান ঝালাপালা করে দিত।

ইভার কন্ট্রোল রুমে ঢোকা নিষেধ। বন্ধ দরজার আশপাশের ইমার্জেন্সি লাইটগুলো জ্বলছে। সর্বনাশ করেছে। কমান্ডারকে এখুনি জানাতে হবে।

ইভা ফিরতি পথে পা বাড়ায়।

প্রোজেক্ট NIL-এর পেছনে শেষ কয়েকবছরে হাইকমান্ড কয়েক হাজার কোটি ডলার খরচ করেছে। হাইপারস্পেস ড্রাইভের প্রোটোটাইপ। মহাশূন্যে ওয়ার্ম হোল খুঁড়ে তার মধ্যে দিয়ে পৌঁছে যাওয়া যাবে অন্য এক ডাইমেনশনে। স্পেসশিপের সঙ্গে বসিয়ে ফেলা হয়েছে ক্যাভিটি জেনারেটর, যেটা স্পেসটাইমকে ম্যানিপুলেট করে তৈরি করবে ওয়ার্ম-হোল। তারপর সেই ওয়ার্ম-হোল দিয়ে পাড়ি দেওয়া হবে অন্য মহাবিশ্বে।

এখনও পর্যন্ত হাইপারস্পেস-জাম্প দিয়ে পর পর দুটি স্পেসশিপকে পাঠানো হয়েছে ওপারে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল কোনওটা থেকেই কোনও উত্তর আসেনি।

প্রথম ট্রায়ালে ইডেন-ওয়ানকে যখন পাঠানো হয়, সে সময় হাইকমান্ড ডাইমেনশন-এক্স সম্বন্ধে কিছুই জানত না। তবে ইডেন ওয়ানের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব না হলেও কিছু ফরেন পার্টিকেল পাওয়া যায়। সেটা থেকে বোঝা যায় ওখানকার সময় একমুখী হলেও তুলনামূলক দ্রুত। আমাদের কয়েক সেকেন্ড ওখানকার একবছরের সমান। ইডেন-ওয়ানের এজিং এত দ্রুত হয়েছে যে সম্ভবত কয়েক সেকেন্ডে স্পেসশিপ হওয়ায় মিলিয়ে গেছে।

দ্বিতীয় দফায় ইডেন-টু’এর ক্ষেত্রে বিশেষ একধরনের শিল্ড দিয়ে মহাকাশযান ঢেকে ওয়ার্ম-হোলের ওপারে পাঠানো হয়। এই শিল্ড, দুটো ডাইমেনশনের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রাখবে। কিন্তু এবারে সমস্যা হল যে ওয়ার্ম-হোল বন্ধ হওয়ার আগে যে ফিডব্যাক সিগন্যালগুলো এসেছে সেগুলো ডিকোডিং করা সম্ভব হচ্ছে না।

ইডেন সিরিজের স্পেসশিপের জন্য হাইকমান্ড দুজনের বেশি মহাকাশচারী রাখার বিপক্ষে। একজন পুরুষ ও একজন মহিলা। কারণ পুরো প্রক্রিয়াটাই এ.আই. মিডিসি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।

“কমান্ডার! ঘুম থেকে উঠুন।”

“কী হল ইভা! কোনও সমস্যায় পড়েছ?” বিরক্তিসূচক মন্তব্য করে অদম্য। না বলে তার কেবিনে ইভা প্রবেশ করায় বেশ মনে মনে ক্ষুণ্ণ।

“কন্ট্রোল রুমে দুর্ঘটনা ঘটেছে। হয়তো কোনও জোরালো ইলেক্ট্রোমাগনেক্টিক ফোর্স ফিল্ড স্পেসশিপে হিট করেছে।”

“মস্করা করছ! হাই টেক ইলেক্ট্রোস্ট্যাটিক রেডিয়েশন শিল্ড রয়েছে।”

“আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স মিডিসি অকেজো। কোনও রেস্পস নেই। কন্ট্রোল রুমে এমারজেন্সি এলার্ট

“কি বলছ আমাকে এতক্ষণ জানাওনি কেন? হাইকমান্ডকে ইনফর্ম করেছ?”

“না কমান্ডার! আমার কমুনিকেশন সিস্টেম কাজ করছে না।”

ইভা আর অদম্য দুজনেই ছুটে যায় কন্ট্রোল রুমের দিকে।

অদম্য ভয়েস কমান্ড দিয়ে গোলাকার হাতল ঘুরিয়ে দরজা খুলল। কন্ট্রোল রুমে যেন কেউ এসে তাণ্ডব ঘটিয়েছে। সামনের ভিজুয়াল স্ক্রিনগুলো অকেজো হয়ে যাওয়ার জন্য স্টিমুলেশন মুছে গিয়ে বেরিয়ে পড়েছে আসল মহাশূন্যের দৃশ্য। দূরে ওয়ার্ম-হোলের নীলচে-সাদা আলোর তরঙ্গ এসে ধুয়ে দিয়ে যাচ্ছে কন্ট্রোল রুম। যত্রতত্র মুখ থুবড়ে পড়ে আছে প্রেশার গেজ, নিউমেটিক টিউব, মনিটরের ডিসপ্লে। হাই কমান্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না।

দুর্ঘটনা ঘটেছে কিন্তু কীভাবে? কে ঘটাল? সম্ভবত খুব শক্তিশালী একটা ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ এসে শুধু সেন্সরগুলোর বারোটা বাজায়নি, কন্ট্রোল প্যানেলের যাবতীয় যন্ত্রপাতি অকেজো করে তুলেছে। এর জন্য সোলার ফ্লেয়ারও দায়ী হতে পারে। কিন্তু কাল পর্যন্ত স্টার ম্যাপ উলটো পরিসংখ্যান দিচ্ছিল। দূর দূর পর্যন্ত কোনও সোলার সিস্টেম নেই।

“আমি তোমায় এক্সেস দিয়ে দিচ্ছি। ম্যানুয়াল ওভাররাইড করে হাইকমান্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করো।” অদম্যের গলায় শান্ত সুর। তার স্নায়ু ইস্পাতের তৈরি।

“রজার দ্যাট কমান্ডার!”

অদম্য এগিয়ে গিয়ে অন স্ক্রিন কিবোর্ডে আঙুল বুলিয়ে লিখল গোপন নিউমেরিক কোড। তারপর ডিসপ্লেতে একটা লাল রং খেলে গেল।

“ভরসা রাখো আমরা এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে পারব!”

কথাটা শুনে ইভা অদম্যের দিকে তাকায়। এই বিভীষিকাময় মুহূর্তেও তার মুখখানি ইভার কাছে এক টুকরো ভালো লাগার পরশ হয়ে দাঁড়ায়। ইভা আজীবন অদম্যর কাছে এই ভরসাটুকুই চেয়ে এসেছে। সে কিছু সময়ের জন্য পরিস্থিতি ভুলে ভাবনায় হারিয়ে যায়।

“তুমি হাইকমান্ডকে মেসেজ পাঠাও। ইভাইভা

“ইয়েস কমান্ডার!”

“অন্যমনস্ক কেন?”

“তেমন কিছু না

“খুব টেন্সড?”

“হ্যাঁ!”

মুখ তুলে অদম্যের দিকে তাকায় ইভা। প্রত্যুত্তরে হয়তো একটু সহমর্মিতা আশা করছিল সে। অদম্য তার দিকে স্থির, শান্ত দৃষ্টি রেখে প্রশ্ন করল, “এভিয়েশন সিস্টেম ঠিক আছে?”

এতটা অবহেলা! অদম্যের থেকে এক ঝটকায় চোখ সরিয়ে নিয়ে একটা চাপা অভিমানে নিজের কাজে অহেতুক বেশি মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করে ইভা। অনুভূতি যতটা সম্ভব চেপে রেখে, ধরা গলায় বলে, “এনালাইসিস করে রিপোর্ট দিচ্ছি!”

“আমি ওপরে যাচ্ছি। হলের ছাদের ফাটলটা বন্ধ করতে হবে। তারপর দেখছি কীভাবে বাকি ব্যাটারিগুলো সরিয়ে ফেলা যায়। রেডিয়োতে তোমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখব।”

কথাটা বলে বেরিয়েই যাচ্ছিল অদম্য। ইভার ডাকে ঘাড় ঘোরাল।

“কমান্ডার! এভিয়েশন সিস্টেম কাজ করছে!”

“গুড!”

“কিন্তু কমান্ডার, ক্যাভিটি জেনারেটরের কয়েকটা ইউনিট কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। ওয়ার্ম-হোল ক্রমশ ছোট হয়ে আসবে। এখনই প্রবেশ না করলে পরে কিন্তু সম্ভব হবে না।”

“না হাইকমান্ড এর আদেশ ছাড়া আমি কোনও সিদ্ধান্ত নেব না।”

“কিন্তু কমান্ডার!”

“দিস ইজ এন অর্ডার!”

অদম্যের রূঢ় এবং স্পষ্ট নির্দেশ। ইভার মনের মধ্যে আসন্ন বিপদ আর অদম্যের জন্য অনুভূতির যুগপৎ ঝড় কি সত্যিই অদম্য বুঝতে পারছে না?

কন্ট্রোল রুম থেকে বেরিয়ে হলে আসে অদম্য। হলের গ্র্যাভিটি অন করার এই মুহূর্তে প্রয়োজন নেই। নইলে এর চেয়েও মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

হলের দেওয়াল ধরে ধরে হাওয়ায় ভেসে অদম্য পৌঁছে যায় ছাদে; তারপর গোল হাতল ঘুরিয়ে খুব সাবধানে ছাদের সঙ্গে লাগোয়া দরজাটা খোলে। ব্যাটারি এসেম্বলি ভেঙে গেছে নিশ্চয়ই, সেই জন্যই এই ব্যাটারিগুলি অনাথ শিশুদের মতন ছন্নছাড়া হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আচমকা দরজা খুললে অদম্যের মাথায় এসে পড়তে পারে।

দরজার দিয়ে ওপরে এল অদম্য। লাইন দিয়ে দাঁড় করানো ব্যাটারির তাকগুলো একে অন্যের ওপর পড়ে যাচ্ছেতাই অবস্থা। সত্যিই কি ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ডের তাণ্ডব ? নাকি অন্য কিছু? যেন কেউ এসে ইডেন থ্রিকে দুধের বোতল ভেবে ঝাঁকিয়ে আবার যথাস্থানে রেখে দিয়েছে। তাদের বিশ্রামের সময়, এই সব যা ঘটেছে, নিশ্চয়ই বড় বেশি দ্রুত এবং বড় বেশি অকস্মাৎ ঘটেছে, নইলে পূর্বাভাস পেলে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স মিডিসি অকেজো হওয়ায় আগে তাদের জানাত। ব্যাটারিগুলো ঠিক করে সাজিয়ে রাখা তার একার পক্ষে সম্ভব নয়। আপাতত ‘এঢেসিভ গান’ দিয়ে মেঝের বড় ফাটলটা বন্ধ করতে অদম্যকে বেশ কসরত করতে হবে।

কিছু একটা যেন ঝলমলিয়ে উঠল! সত্যি কি তাই? কাজ থামিয়ে অদম্য বন্ধ কাচের জানালার দিকে নজর ফেরালো। বিন্দু-বিন্দু তারার মেলার মাঝে অসীম মহাকাশ ছাড়া কিছুই নজরে পড়ল না। কই কিছুই তো নেই! কেন জানি না ওর মনে হল একটা নক্ষত্র যেন জ্বলে নিভে উঠেছিল। অনেক সময় চরম প্রতিকূলতা মাথার মধ্যে চিন্তাভাবনার জট পাকিয়ে দিয়ে হ্যালুসিনেট করায়! ওর সঙ্গে তেমন কিছু ঘটছে না তো? মনের ভুল! তাই হবে হয়তো! অদম্য আবার কাজে মন দেয়।

দূরে, অনেক দূরে, কৃষ্ণসাগরের মহাশূন্যতা চিরে একটা জমাট বাঁধা অন্ধকার খুব দ্রুত এগিয়ে আসছে ইডেন থ্রিয়ের দিকে।

***

অডিয়ো-ভিজুয়াল ডিভাইস কাজ করছে না। যদিও এনক্রিপ্টেড অডিয়ো-ভিজুয়াল মেসেজ যেতে অনেক সময় নেয়। এই সংকটময় অবস্থায় প্রতিটা সেকেন্ডে অমূল্য। মান্ধাতা আমলের টেক্সট মেসেজ এই মুহূর্তে বেশি কার্যকারী। শিপে কী ঘটেছে ও তার সম্ভাব্য-কারণ সমূহ লিখে ইভা হাইকমান্ডকে পাঠিয়ে দেয়। কমান্ডারের ওপর তার বেশ রাগও হয়। হাইকমান্ড থেকে উত্তর আসতে কম করে আধ ঘণ্টা। কিন্তু তাদেরও তো হাত-পা বাঁধা! ওয়েভের এতটা দূরত্ব পাড়ি তো কম কথা নয়! টাইম ডিলে অবশ্যম্ভাবী। অথচ, ততক্ষণে ওয়ার্ম-হোল বন্ধ হয়ে যাবে। শেষ তিন দিন ধরে মহাশূন্যের বুকে ওয়ার্ম-হোল খোঁড়ার কাজ চলছে। ইডেন থ্রি সাইজের গর্ত খোঁড়া সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। কমান্ডারের অন স্পট সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল।

সাময়িক রাগ ইভার মনে অন্য অভিসন্ধির জন্ম দিল। আচ্ছা কন্ট্রোল রুমে হাতি-ঘোড়া তেমন কিছুই লুকিয়ে নেই। কেন তার প্রবেশ নিষেধ?

অদম্য কি কিছু লুকোচ্ছে? লিলির প্রসঙ্গ উঠতেই অদম্য এড়িয়ে চলে কেন?

লিলি নামে সার্চ করতেই সিস্টেম এক্সেস ডিনাই দেখায়। কী এমন কাণ্ড লিলি ঘটিয়েছিল যে তার সমস্ত তথ্য গোপন রাখা হচ্ছে? তখন আড়চোখে কমান্ডারের দেওয়া নিউমেরিক কোড ইভা পড়ে ফেলেছিল। দুরু দুরু বুকে ইভা অদম্যের নাম দিয়ে সেই পাসওয়ার্ড দেয়। কতগুলো মিশন রিপোর্ট; হাইকমান্ড আথরাইজেশন লেটার, প্রোজেক্ট NIL-এর প্রোগ্রেস রিপোর্ট বাদে নজরে আসে একটি avi ফাইল। তর্জনী দিয়ে কারসার সেই ফাইলের ওপর রাখতেই তাতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স মিডিসির digital siganture ফুটে উঠল।

ইভা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভিডিয়োটা প্লে করল।

***

কাজ শেষ করে আবার কন্ট্রোল রুমে ফিরে এলো অদম্য।

“হাইকমান্ড থেকে কোনও নিউজ? ইভাইভা

“না কমান্ডার! এখনও পর্যন্ত কোনও উত্তর নেই।”

“রেডিয়ো এক্টিভ ডিকে রেগুলেটর?”

“কাজ করছে!”

“ব্যাক-আপ এনার্জির জন্য ব্যাটারির এসেম্বলি কাজ করবে না। কোনও কানেক্টিভিটি নেই। ওপরের তলায় সব কিছু তছনছ হয়ে পড়ে আছে। যে ক-টা ইউনিট কাজ করছে, রেডিয়ো এক্টিভ ডিকে আরও বাড়িয়ে দাও। ওয়ার্ম-হোল বন্ধ করা যাবে না।”

“অলরেডি থ্রেসহোল্ড লিমিটে আছে। এর বেশি মাত্রা ছাড়ালে সেলগুলো আনস্টেবল হয়ে গিয়ে নিউক্লিয়ার ব্লাস্ট ঘটাবে

“যা বলছি করো!”

“আর দেরি করা যাবে না কমান্ডার। হাইপার ড্রাইভ করে ওয়ার্ম-হোলে ঢুকতেই হবে।”

“হাইকমান্ডের আদেশ অমান্য প্ৰথম শ্রেণীর রাষ্ট্রীয় অপরাধ। বুঝতে পারছ না আমাদের সিটিজেনশিপ বাতিল হয়ে যাবে।”

“কীসের সিটিজেনশিপ! আপনার কী মনে হয় আমরা ফিরতে পারব। শুধু রোবটের মতন আদেশ পালন।”

“তোমার সাহস কী করে হয় এইভাবে আমার সঙ্গে কথা বল।” এই প্রথম বোধহয় নিজের ইস্পাত কঠিন আবেগকে আটকে রাখতে পারে না অদম্য, রাগে ফেটে পড়ে।

তবে এবার তুলনায় যেন ইভা অনেক শান্ত। কোনরকম প্রতি-অভিব্যক্তি না দেখিয়ে অদম্যের চোখে চোখ রেখে বলে সে, “লিলির কী হয়েছিল আমি জানি। তুমি একটা কাপুরুষ অদম্য। আমি তোমাকে ভালোবাসতাম।”

অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল অদম্য।

ইভার চোখের কোণে আস্তে আস্তে মেঘ জমছে। সে বলতে থাকে, “শুধুমাত্র মতের অমিলে তুমি একটা মানুষকে মহাশূন্যে ছুড়ে ফেলে দিলে। তুমি শয়তানেরও অধম।”

আগের থেকে শান্ত কিন্তু কুটিল হিসহিসে স্বরে অদম্য বলে, “শোনো ইভা তুমি নিজেকে লিলির সঙ্গে তুলনা করো না। ওর একটা নিজস্বতা ছিল। তোমার মতন ল্যাবে তৈরি হয়নি।”

“আমি বিশ্বাস করি না। এক অক্ষরও নয়। তুমি একটা মিথ্যেবাদী।”

এবার অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল অদম্য।

“ভা-ল-বা-সা। ভালবাসা না ছাই। তুমি স্পেসশিপে আসার আগে কোথায় ছিলে? মনে করো। তোমার ছোটবেলা কেমন ছিল?”

ইভা থমকে দাঁড়ায়, অদম্যের কথা শুনে ওর গা জ্বলতে থাকে। স্মৃতি হাতড়ে খুঁজে বেড়ায় নিজেকে। কিন্তু কিছুই মনে করতে পারে না।

“কিছু থাকলে তো মনে পড়বে মূর্খ। অ্যাস্ট্রনট হওয়া অতোই সোজা! জানো পাঁচ বছর ধরে কড়া ট্রেনিং এর মধ্যে দিয়ে কাটাতে হয়। এই কমান্ডার পোস্টে জন্য কত কাঠ খড় পোড়াতে হয়েছে। দ্যাট বিচ, লিলি! নিজেকে ভগবান মনে করত। হাইকমান্ড কী করে একটা মেয়েকে শিপের দায়িত্ব দেয়! কমান্ডার হবে! যা করেছি বেশ করেছি।”

ইভা উত্তেজনায় ঠকঠক করে কাঁপতে থাকে। তার চোখ ভিজে উঠেছে।

তাহলে লিলি ছিল ইডেন-৩’এর আসল কমান্ডার। অদম্য নয়! শয়তানটা ওকে সরিয়ে দিয়ে নিজে ওর জায়গা দখল করেছে।

“কী এখনও বুঝতে পারছ না। তুমি কে?”

ইভা অবাক হয়ে ভালোবাসার মানুষটার বদলে যাওয়া রূপ লক্ষ করে।

“লিলিকে সরানোর পর আমার সহচরীর প্রয়োজন হয়। প্রথমে অনুমতি না দিলেও হাইকমান্ড পরে রাজি হয়ে যায়। তারপর

“তারপর” ইভা সত্যিটা ধরতে পেরেছে; তবুও সে অদম্যের মুখ থেকে শুনতে চায়।

“তারপর ইনকিউবিটার মডিউলের সাহায্যে আমি আমার একটা ক্লোন বানাই। যাকে সিলেক্টভ আইডেন্টিটি মেমরি দেওয়া হয়।”

ইভা নিরুত্তর। শুধু অদম্যের আদিম মনোবৃত্তি গর্জে ওঠে, “তুমি আমার ক্লোন ইভা… যে আমার কথা শুনবে। পদে পদে প্রশ্ন করবে না। আমার আদেশ পালন করবে। নিঃসঙ্গ রাতগুলোতে বিছানা গরম করবে।”

***

আবার গোটা শিপটা নড়ে-চড়ে বসল। আবার একটা অদৃশ্য ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফোর্স ফিল্ড এসে ধাক্কা দিল। ইভা আর অদম্য ছিটকে গিয়ে মেঝেতে চুয়িং গামের মতন আটকে গেল। তারপর ভেসে উঠল শূন্যে। আর্টিফিশিয়াল গ্রাভিটি কাজ করা বন্ধ করেছে। গ্লাস ককপিটে ফুটে উঠেছে ফাটলের এলোমেলো নক্সা, যে কোনও মুহূর্তে ভেঙে কন্ট্রোল রুমে ভেসে থাকা মানব-মানবীর ভবলীলা শেষ করবে।

কিন্তু আশপাশে কিছু নেই। কোথা থেকে আসছে এই তরঙ্গের ঢেউ? কী এর উৎস?

অদম্যের নজর বাইরে যায়। চেয়ে দেখতেই হৃদপিণ্ডটা পিছিয়ে এসে পাঁজরে ধড়াস ধড়াস বাড়ি মারে। নক্ষত্র খচিত মহাকাশের বুকে এক কৃষ্ণকায় গহ্বর ক্রমাগত বাড়ছে। শুষে নিচ্ছে আশপাশের সব আলোকবিন্দু। আর তারই মাঝে ফুটে উঠল

… বিশাল! হে ঈশ্বর, তখন সে এটাকে কোনও লাল নক্ষত্রের জ্বলে নিভে ওঠা ভেবে ছিল… এটা একটা… একটা দৈত্যাকার চোখ, সেই চোখ মহাকাশ ফুঁড়ে চেয়ে আছে স্পেসশিপের দিকে…

অদম্যের বুকের ওপর যেন কেউ কয়েক মণের পাথর বেঁধে দিয়েছে। সে যে কোনও মুহূর্তে আতঙ্কে ফেটে পড়তে পারে।

না, এ হতে পারে না! এমন জীবের অস্তিত্ব অসম্ভব…

অদম্য ধীরে ধীরে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ে।

“কমান্ডার কমান্ডার”, ইভা চিৎকার করতে করতে এগিয়ে আসে অদম্যের দিকে। প্রচণ্ড স্নায়বিক চাপেও ইভা সম্বিৎ হারায় না। এর চেয়েও ভয়ানক স্বপ্ন সে দেখেছে। পাঁচ বছরের ট্রেনিং সেশনের কঠোর অনুশীলন হয়তো তার নেই কিন্তু দুঃস্বপ্নের রাতগুলো তাকে তিলে তিলে শক্ত করেছে। ইভা অদম্যের নিষ্প্রাণ হাত ধরে টেনে নিয়ে যায় হলের দিকে।

ইভার নাক-মুখ থেকে রক্তের ধারা বয়ে শূন্যে ভেসে চলছে। সে ভয়ঙ্করভাবে আহত।

ইভার কাছে নিজের কথা ভাবার সময় নেই। যে করে হোক অদম্যকে বাঁচাতে হবে।

এলোমেলো ভাসমান ব্যাটারিগুলো এড়িয়ে ইভা অদম্যের কেবিনে আসে। বিছানায় অজ্ঞান অদম্যকে শুইয়ে দিয়ে স্পেসস্যুট পরিয়ে দেয়। তারপর কেবিনের দরজা বন্ধ করে পড-লঞ্চ-প্রসেস শুরু করে। ইডেন থ্রি-এর এক একটা কেবিন এক একটা লাইফ-পড। কোনও কারণে মহাকাশযান ধ্বংস হওয়ার দোরগোড়ায় এলে পডগুলি স্বয়ংক্রিয়ভাবে মহাশূন্যে বুকে ছুড়ে ফেলা হয়।

লঞ্চ-প্রসেস শেষ করে ইভা নিজের কেবিনের দিকে পা বাড়ায়। এবার তার পালা। আর ঠিক তখনই কন্ট্রোল রুমের গ্লাস-ককপিট ভেঙে চুরমার হয়ে একরাশ অন্ধকার শিপে প্রবেশ করে। ইভা কিছু বুঝে ওঠার আগে আগে একটা চ্যাটচ্যাটে হিমশীতল অন্ধকার ইভাকে সাঁড়াশির মতন জাপটে ধরে… তারপর টেনে নিয়ে যায় মহাশূন্যে। সে শুধু দেখতে পায় একটি প্রাণহীন উদাসীন হাঙ্গরের মতো বিশাল চোখ। ইভা জানে প্রাণীটা তাকে দেখছে, তার মনের কথা বুঝতে পারছে।

দূরে, ক্রমশ ছোট হয়ে ওঠা ওয়ার্ম-হোলের দিকে একটা লাইফ-পড দুর্বার গতিতে ছুটে চলছে, যেখানে রয়েছে তার স্বপ্নের রাজকুমার অদম্য, যে মানুষটার নিরাপত্তার জন্য নিজের জীবন সমর্পণ করা যায়।

আসন্ন মৃত্যুকে দু-হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে ইভা।

***

Emergency Alert. Oxygen level decreases. Automatic Repair not working. Emergency Alert. Oxygen level decreases. Automatic Repair…

কেবিনের ভেতর থেকে যান্ত্রিক শব্দ ভেসে এসে অদম্যের ঘুম ভাঙ্গিয়ে দেয়। সে চেয়ে দেখে বিদ্যুৎ-গতিতে লাইফ-পডে করে এগিয়ে চলছে নীল আকাশ চিরে। কোনও গ্রহের বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করছে। স্পেসস্যুটের টেম্পারেচার রেগুলেশন কাজ করছে না। ঘর্ষণজনিত তাপে যে কোনও সময় কেবিনের আগুন লাগতে পারে।

হঠাৎ সব কিছু কেমন স্লো মোশনে চলতে শুরু করেছে। শরীরে জুড়ে কয়েক হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎ খেলে গিয়ে অদম্যর মনে হতে লাগল কেউ ওকে চুল্লিতে জ্যান্ত ঢুকিয়ে দিয়েছে। কেবিনের ভেতরটা ভূমিকম্পে যেন উলটেপালটে যাবে। নিজেকে কেমন ভারশূন্য লাগছে। অদম্যর চোখের সামনে কালো যবনিকা নেমে আসে।

প্ল্যাস্টিক পোড়া গন্ধে অদম্যের ঘুম ভাঙে। ম্রিয়মাণ আগুনের উত্তাপ আর ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মাঝে কয়েক জোড়া জ্বলন্ত চোখ অদম্যকে দেখছে। ওরা আবর্জনার স্তূপে খাবারের খোঁজে এসে অদম্যকে আবিষ্কার করে। এই প্রাণীগুলোকে অদম্য চেনে। কয়েক শতাব্দী আগে লুপ্ত হয়েছিল, কেনিস লুপাস বা কুকুর।

সে কি তাহলে অতীতে ফিরে গিয়েছে?

উঠতে গিয়েও অদম্য পারে না।

আগুনে ঝলসে গিয়ে স্পেসস্যুটের কিছুই আস্ত নেই। শরীরে জায়গায় জায়গায় ফোস্কা পড়েছে। কোনওক্রমে লাইফ-পড থেকে ছিটকে যাওয়ার পর এই আবর্জনার স্তূপ তার জীবন বাঁচিয়েছে। ভাগ্য সহায় ছিল বলে এ যাত্রায় বেঁচে গিয়েছে।

কিন্তু ইভা কই? এই জায়গাটা বা কোথায়?

যেদিকে চোখ যায় জঞ্জালের পাহাড় আর পাহাড়। আকাশে উজ্জ্বল চাঁদ। নীল চাঁদের গায়ে তুলো-তুলো মেঘের আস্তরণ। ভূ-পৃষ্ট থেকে স্পেস এলিভেটরের কেবিল আকাশ ফুঁড়ে উঠে গিয়েছে মহাশূন্যে। অদ্ভুত দর্শন কিছু মহাকাশযান এই স্পেস এলিভেটর করে আকাশে পাড়ি দিচ্ছে, যাচ্ছে চাঁদে। চাঁদের টেরাফর্মিং চলছে।

তাজ্জব!

পৃথিবীতে এমন কিছু কি ঘটেছিল? কই খেয়াল পড়ছে না!

কুকুরদের ডাকে একদল মানুষের আগমন ঘটেছে। সাদা পোশাক পরিহিত বন্দুকধারীর দল ঘিরে ফেলেছে অদম্যকে!

তার মানে ইডেন টুয়ের মহাকাশচারীরা মারা যায়নি। তারা এখানেই পাকাপাকিভাবে বসবাস শুরু করে। এই মানুষগুলো তাদের বংশধর। তাই যদি হয়, তাহলে কি যে রহস্যময় গ্রহাণুর আঘাতে ডাইনোসরদের অবলুপ্তি ঘটেছিল সেটা সেটা আসলে ইডেন ওয়ান ছিল?

অনেক কিছুর উত্তর ভাবতে গিয়েও ভাবতে পারল না অদম্য। সে বিস্ময়ে বোবা সেজে দাঁড়িয়ে থাকে। শুধু প্রোজেক্ট NIL-এর সবচেয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্যটি মনে পড়ে, আমাদের কয়েক সেকেন্ড ওখানকার একবছরের সমান। আমাদের কয়েক সেকেন্ডে ওখানকার…

।। উৎসর্গ ।।

স্বর্গীয় অনীশ দেব, যিনি থ্রিলার লেখা শিখিয়েছেন।

টিম কল্পবিশ্ব, যারা না থাকলে আমার লেখক হওয়া হত না।

Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, পরাগ ভূঞ্যা, ষষ্ঠ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা

Leave a Reply

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!