শোণিতরাঙা শ্বেতগোলাপ

  • লেখক: উৎস ভট্টাচার্য
  • শিল্পী: টিম কল্পবিশ্ব

এমনিতেও ‘দূরদর্শী’ হিসেবে খুব একটা সুনাম নেই আমার, তার উপর আবার ধূসর কুয়াশার পুরু আস্তরণটা বেশিদূর অবধি দেখার পথে অন্তরায় হচ্ছে! মাথার মধ্যে অদ্ভুত একটা ঝিমধরা ভাব। মাথাটা একটু ভার হয়ে আছে ঠিকই, কিন্তু মাদকতা’টুকু বেশ উপভোগ্য। কানের কাছে অনেকগুলো মৌমাছি যেন মৃদু একটা গুঞ্জন তুলছে অবিরত। নাহ! একটু ভুল হল, ঠিক কানের কাছে নয়। বরং বলা ভালো, কানের মধ্যেই তাদের বাস— তবে যেন অনেকটা গভীরে আর তাই সেই গুনগুন ধ্বনি বড়ই ক্ষীণ।

কুয়াশায় গা ভিজিয়ে এগিয়ে চলেছি ধীরে ধীরে সেই কুয়াশামাখা পথে। অনির্দিষ্টভাবে নিরুদ্দেশের পথে এগিয়ে চলাই বোধহয় আমার ভবিতব্য। এগিয়ে চলাই তো জীবন আর থেমে যাওয়াটাই…

ভাবনাটার মাঝেই নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে পা পিছলে একটা গর্তে পড়ে গেলাম। ছোটখাটো কোনও গর্ত সেটা নয়, পরিবর্তে প্রাথমিকভাবে একটা সুদীর্ঘ সুড়ঙ্গের প্রবেশ মুখ বলেই মনে হল। নিকষকালো অন্ধকারে তলিয়ে যেতে লাগলাম অনেকটা সময় ধরে। সময়ের সঠিক কোনও হিসেব নেই। দারুণ বেগে নীচে, আরও নীচে তলিয়ে যাচ্ছিলাম। অনেকক্ষণ পর একটা স্যাঁতসেঁতে নরম জায়গায় গিয়ে পড়লাম। জায়গাটা কিছুটা অন্ধকার হলেও সেই অন্ধকার আগের মতো গাঢ় নয় বরং খানিকটা আলো আসছে। চোখ অন্ধকারে এতক্ষণে সয়ে এসেছিল, তাই বেশ দেখতে পেলাম ঘন নীল কার্পেটের মতো অজানা এক শ্যাওলার পুরু স্তরের উপর এসে পড়েছি আর সেই কারণেই, সৌভাগ্যবশত চোট পাইনি বেশি। আলো কোথা দিয়ে ঢুকছে দেখতে গিয়ে খুব সংকীর্ণ একটা বাইরে যাওয়ার পথ দেখতে পেলাম। হামাগুড়ি দিয়ে কোনওক্রমে বেরিয়ে এলাম বাইরে।

কুয়াশার পরিবর্তে এখন চড়া রোদ। বাতাসে একটা কটু পোড়া পোড়া গন্ধ আর কিছু ছাইরঙা প্রজাপতি ইতস্তত উড়ে বেড়াচ্ছে। একটা চিল তীক্ষ্ণ স্বরে ডেকে উঠল হঠাৎ। বিবর্ণ প্রজাপতিগুলোর মধ্যে একটা বারবার গায়ে এসে বসছে আবার উড়ে খানিকটা এগিয়ে যাচ্ছে। ইশারায় যেন সঙ্গে যেতে বলছে সেটা। পিছু নিলাম অগত্যা।

উড়তে উড়তে একটা কাচের দেওয়ালের সামনে অবধি এসে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল সেই প্রজাপতিটা। থমকে দাঁড়াতে হল নতুন সেই প্রতিবন্ধকের সামনে। ক্ষণিকের বিহ্বলতা কাটিয়ে উঠতে চোখে পড়ল দেওয়ালটায় আমার চেহারা প্রতিবিম্বিত হচ্ছে। খেয়াল করে দেখলাম, যে দেওয়ালটাকে সহজাত প্রবৃত্তিতে জড় মনে করেছিলাম, সেটাই এখন ধূর্ত শিকারির মতো আমায় ঘিরে ফেলেছে! শিরশিরে ভয়ের একটা অনুভূতি টের পেলাম। খুব মন দিয়ে দেখলে বোঝা যায় মৃদু একটা স্পন্দন আছে আপাত নির্জীব দেওয়ালটাতে। মোট ছ-খানা প্রতিবিম্ব ঘিরে রয়েছে আমাকে। কিন্তু এ কী! ওরা আমার দিকে আঙুল তুলে হাসছে কেন? নিজেরই প্রতিবিম্বগুলোর মুখে বিকৃত হাসি দেখে গাটা কেমন যেন শিউরে উঠল! বড় অচেনা ঠেকল নিজেকে!

ক্ষণিকের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠে হাত দিয়ে কাচের দেওয়ালটা স্পর্শ করতে যেতেই সাবান জলের বুদ্‌বুদের মতো অদৃশ্য হল এতক্ষণের মৃদু স্পন্দনশীল জীবন্ত দেওয়ালটা।

এতক্ষণ পর্যন্ত মানুষজন বিশেষ চোখে পড়েনি, এখন দেখতে পেলাম অস্বাভাবিক দ্রুততায় আমার পাশ দিয়েই অনেকে যাতায়াত করছে। এতই দ্রুত, যে তাদের স্পষ্ট অবয়বই দেখা যায় না, মুখ তো অনেক দূরের কথা! যেন রংবেরঙের খাপছাড়া দৃশ্যমান তরঙ্গ! আবার অনির্দিষ্টভাবে বালির উপর দিয়ে হাঁটতে লাগলাম।

হাঁটতে হাঁটতে একটা ছোট রেস্টুরেন্ট কাম বার চোখে পড়ল। ঝিনুক দিয়ে অগোছালোভাবে সাজানো সেটা। জানি না একে আদৌ সাজানো বলা চলে কিনা— এদিক ওদিকে অবহেলায় পড়ে আছে কিছু মুক্তো, কোনওটা ঝিনুকসহ, কোনওটা আবার একলাই! বসার জায়গাগুলো এক একটা আকাশী রঙের বাক্সের মতো, আর খাবার বা পানীয় রাখবার জায়গা হিসেবেও একইরকম দুটি বাক্স উপর নিচে রাখা। সেই আকাশী রঙের বাক্সের মাঝে পেঁজাতুলোর মতো মেঘ ভাসছে, স্পষ্ট দেখতে পেলাম। কাছেই একটি অদ্ভুতদর্শন লোক বড়ই বিষণ্ণ সুরে বেহালা বাজাচ্ছেন— এমনই সেই সুর যে বুকটা মোচড় দিয়ে উঠছে থেকে থেকে। একটা বাক্সের উপর উপবিষ্ট একজন মাঝবয়সী লোক। লোকটি গালে হাত দিয়ে অপেক্ষা করছেন। তাঁর সামনে একটা ঈষৎ পূর্ণ পানপাত্র। গাঢ় লাল রঙের খানিকটা তরল তখনও অবশিষ্ট রয়েছে তাতে। তারপর ভীষণ অস্বস্তির সঙ্গে দেখলাম সেই রক্তাভ পানীয়টায় ভর্তি একটা বৃহদাকার জগ খর্বাকার মানুষের মতো পায়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে এগিয়ে এল আর নিজেকে কাত করে লোকটির পান পাত্রটাকে ভর্তি করে দিল। তীব্র একটা আঁশটে গন্ধ ভক করে নাকে এসে লাগল হঠাৎ!

অদূরেই আর একটা আকাশী বাক্সের উপর বসে আছেন ধোপদুরস্ত পোশাক পরা এক প্রৌঢ়। ভালো করে লক্ষ করতে যা দেখতে পেলাম, তাতে তীব্র ঘেন্না, ভয় আর অস্বস্তির একটা শক্তিশালী মিশ্র আবেগ, আমার অস্তিত্বটাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। আমি দেখলাম মুখে ভয়ার্ত অভিব্যক্তিযুক্ত কিন্তু জড়বৎ এক হতভাগ্য যুবক প্রৌঢ়ের অঙ্কদেশে শায়িত। গলা পর্যন্তই কেবল তার মানুষের, বাকি গোটা দেহটাই একটা বিশালাকার মাংসপিণ্ড! সেই প্রৌঢ় ধারালো একটা চপার দিয়ে মাংসের টুকরো নিপুণভাবে কেটে কেটে পাশে রাখা একটা কন্টেনারে রেখে দিচ্ছেন! কী আশ্চর্য! প্রৌঢ়ের মুখে কিন্তু কোনও নৃশংসতা নেই, পরিবর্তে একটা অদ্ভুত প্রশান্তি আর ঠোঁটে লেগে আছে একটা অসংজ্ঞায়িত অভিব্যক্তির হাসি! কয়েক মুহূর্তের জন্য স্থবির হয়ে পড়েছিলাম। তারপর সেই প্রৌঢ় আমার দিকে চেয়ে অমায়িক একটা হাসি হাসলেন। আমি তড়িতাহতের মতো কেঁপে উঠলাম। একটা অস্ফুট আর্তনাদ করে দৌড়ে নারকীয় রেস্টুরেন্টটা থেকে বেরিয়ে এলাম এবং উদ্ভ্রান্তের মতো দৌড়াতে লাগলাম যেদিকে দু-চোখ যায়।

দৌড়াতে দৌড়াতেই অনুভব করলাম একটা ধুলোর ঝড় আছড়ে পড়েছে। ধুলোবালি খড়কুটো সব পাক খেয়ে উড়ছে চারপাশে। কোনওমতে চোখ-মুখ বাঁচিয়ে ধীরে ধীরে এগোতে লাগলাম।

কে যেন কানের কাছে অনবরত বলে চলেছে, “চরৈবেতি! চরৈবেতি! থেমে যাওয়া আর মৃত্যু সমার্থক। এগিয়ে চলো!”

ঝড়টা এখন আর নেই। ফুটিফাটা মাটির ঊষর একটা প্রান্তরে দাঁড়িয়ে রয়েছি। পাতাঝরা বড় বড় গাছের মৃতদেহগুলো প্রেতমূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে, এটা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য যে, এই ধূসর প্রান্তর কোনও একদিন সবুজ ছিল।

একটা দৈত্যাকার বোতল মাটিতে পোঁতা রয়েছে। গাঢ় নীলচে তরলে তার কাঁধ অবধি পূর্ণ। বিন্দু বিন্দু ঘন লাল রঙের তরল মিশছে সেই নীলচে তরলে আর ধীরে ধীরে কালচে-বেগুনি রঙে রূপান্তরিত হচ্ছে সেটা। এ যেন রূপম ইসলামের সেই গানটিরই দৃশ্যরূপ— “আজ নীল রঙে মিশে গেছে লাল…”

সম্পূর্ণ তরলটা একই রঙে পরিবর্তিত হতে, একটা বিশাল বড় মাপের নাম না জানা পাখি কোথা থেকে উড়ে এসে বসল বোতলটার উপরে। মুহূর্তের মধ্যে তার ডানায় আগুন জ্বলে উঠল! বাতাসে পোড়া গন্ধটা প্রকট হয়ে উঠে শ্বাসরোধ করে দিতে লাগল আমার। জ্বলন্ত পাখিটা কিন্তু নির্বিকার ভাবে বসে আছে বোতলটির উপরেই!

সহসা আকাশ কালো হয়ে এল। বৃষ্টি নামতে চলেছে কি? বৃষ্টিই বটে, তবে জলের ধারা নয়! অগণিত পতঙ্গ ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ছে সেই অগ্নিদগ্ধ পাখিটির উপরে। অদূরেই হাজারটা দামামায় একসঙ্গে ঘা পড়ছে যেন! দ্রিমি দ্রিমি দ্রিম দ্রিম! দ্রিমি দ্রিমি দ্রিম দ্রিম!

এখন অবশ্য পাখিটার আর আলাদা কোনও অস্তিত্ব নেই। আগুন দ্রুত বেড়ে উঠেছে। গ্রাস করেছে পাখিটা আর পতঙ্গগুলো সমেত অনেকটা অঞ্চল। শুকনো গাছগুলো দহনের ইন্ধন যোগাচ্ছে এখন। সেই জতুগৃহে আমিও বন্দি হয়ে পড়েছি। শয়তানী কোনও ইন্দ্রজালে পাখিটাকে যেন নকল করছি আমি। আসন্ন মৃত্যু জেনেও পাদুটো কিছুতেই কথা শুনছে না। মাথার মধ্যে পাক খাচ্ছে, “থেমে যাওয়া আর মৃত্যু সমার্থক। পালাও! পালাও!”

কিন্তু আমি যে নিরুপায়!

এমন সময় একটা কোমল কিন্তু দৃঢ় হাতের টান অনুভব করলাম সঙ্গে একটা উদ্বিগ্ন এবং উত্তেজিত নারী কণ্ঠ, “এসো আমার সঙ্গে… তাড়াতাড়ি এসো!”

গাঢ় কৃষ্ণবর্ণ ধোঁয়ায় চারিদিক আবৃত হয়ে রয়েছে, শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছে, চোখে ভালো দেখতে পর্যন্ত পাচ্ছি না। এত কিছুর মধ্যেও সেই রহস্যময়ীর নির্ভরযোগ্য হাতটি আমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে, আমায় টেনে নিয়ে চলল। এভাবে কতক্ষণ ছুটে চললাম, তা বলতে পারব না। তবে পরিশেষে দেখতে পেলাম সেই ঊষর প্রান্তর পার হয়ে এসেছি আমরা, কালো ধোঁয়াটারও চিহ্ন মাত্র নেই।

এতক্ষণে আমার উদ্ধারকারিনীকে ভালোভাবে দেখবার অবকাশ মিলল। নানারকম অনান্দনিক দৃশ্যের ভিড়ে ইতিমধ্যে মন অবসন্ন হয়ে পড়েছিল, কিন্তু এক ঝলক টাটকা বাতাসের মতো অনুভূতি নিয়ে প্রাণভরে দেখতে লাগলাম তাকে; স্নিগ্ধ সৌন্দর্যের অধিকারিণী সেই রহস্যময়ীকে অপলকে দেখতে লাগলাম! নিটোল সৌন্দর্যের ডালি নিয়ে এমন অনৈসর্গিক স্থানে তার উপস্থিতি, যেমন অপ্রত্যাশিত তেমনই বহু আকাঙ্ক্ষিত— অনেকটা যেন শ্বাসকষ্টের সময়ে অক্সিজেনের মতো— অথবা, হয়তো বলা ভালো, নিষিদ্ধ অভিসারের মতো!

পরনে তার সমুদ্র-নীল শাড়ি, সুগভীর হরিণচোখে অনন্তের ব্যপ্তি— মুক্ত কেশরাজির মধ্যে কয়েকটা বুঝি পথ ভুল করে তার মুখে এসে পড়েছে। এতটা পথ দৌড়ে আসায়, তার পরিশ্রান্ত যৌবনে হাঁপরের ওঠা নামা। ঈষৎ উষ্ণ শ্বাসের স্পর্শ আমিও যেন পেলাম।

হঠাৎই আমায় চমকে দিয়ে কপট রাগে মেয়েটি বলে উঠল, “ওরকম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আগুনে পোড়ার জন্য অপেক্ষা করছিলে কেন? তার চেয়ে দৌড়ে গিয়ে ঝাঁপ দিলেই তো পারতে!”

কী বলব বুঝতে না পেরে আমতা আমতা করে আত্মপক্ষ সমর্থন করলাম, “আ… আমি কী করব? আমার পা যেন মাটির সঙ্গে আটকে গেছিল। কিছুতেই পালাতে পারছিলাম না যে! আচ্ছা, তোমার নাম কী? তোমায় তো ধন্যবাদ দেওয়াই হয়নি। থ্যাঙ্কু, থ্যাঙ্কু সো মাচ! তুমি না এলে যে কী হত!”

জানি না কেন, মেয়েটির মুখটা অদ্ভুত এক বিষণ্ণতায় ভরে উঠল। তারপর সে ধীরে ধীরে বলল, “নাম একটা ছিল ঠিকই, কিন্তু সে তো আর মনে নেই! অবশ্য কোনও প্রয়োজনও নেই তার। তুমি চাইলে আমায় ‘অনামিকা’ বলে ডাকতে পারো।”

কথাটা শুনে মেয়েটির মানসিক অবস্থা সম্পর্কে ক্ষণিকের জন্য সন্দিহান হলাম বটে, কিন্তু পরক্ষণেই মনে হল, নাহ! তার চোখে উন্মাদনার কোনও চিহ্ন তো নেই, বরং সম্পূর্ণ বিমূঢ় অবস্থায় চরম পরিণতি থেকে আমায় একটু আগেই সে রক্ষা করেছে… তাহলে?

এই ‘তাহলে’-টা নিয়েই সাত-পাঁচ ভাবছি, এমন সময় অনামিকা বড় বড় চোখ করে প্রশ্ন করে বসল, “এই! কী এত ভাবছ বলো তো?”

তারপর অনুযোগের সুরে বলল, “আচ্ছা! তুমি খালি ছন্দ মিলিয়ে কবিতা লেখো কেন? দেখছ না সব কিছু কীরকম ছন্নছাড়া হয়ে গেছে? এবার থেকে ছন্দ বেশি না মিলিয়ে এলোমেলো গদ্য কবিতা লিখবে— বুঝলে?”

হঠাৎ করে এরকম একটা কথা শোনার জন্য আমি একদম প্রস্তুত ছিলাম না। ঢোঁক গিলে ঠিকমতো ঘাড়টাও কাত করতে পারলাম না। মনে হাজারটা প্রশ্ন উঁকি দিতে শুরু করেছে। আমাকে অনামিকা এত ভালোভাবে চেনে? কিন্তু আমি তো আগে কখনও ওকে দেখেছি বলেও মনে করতে পারছি না!

ইতিমধ্যে অনামিকা নিজের মনে আবৃত্তি শুরু করেছে:

বেরঙা জীবন রঙিন হয় উৎসবে।

বেপথু বিবর্ণ পথিক রঙের নেশায় মাতে।

রোগ-জরা-বার্ধক্য আর মরণের শামিয়ানা ইতস্তত।

তবুও হাসি অমলিন চিরযৌবনের দুই প্রতিভূর মুখে।

হাজারটা যন্ত্রণা ভুলে, তবু তারা হাসে কোন সুখে?

ব্লটিং পেপারের মত জীবন যখন সুখ শুষে নেয়,

সূর্যাস্তের পর থাকে কি নতুন ভোরের প্রতিশ্রুতি?

মরণাপন্ন মানবতারও আছে এক বাঁচার আকুতি!

যাদের জীবন সাদাকালোর নানা শেডেই থাকে—

রঙের প্রতি আবেদন তাদের মনেও জাগে?

আনন্দের রং ফুরাতেই বিষণ্ণতার কালো!

আবৃত্তিটা শেষ করে সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। তার বেদনার কার্যকারণ আমার কাছে বড়ই দুর্বোধ্য ঠেকল। তবু ক্ষণিকের দ্বিধা কাটিয়ে আমি তাকে সান্ত্বনা দিতে চাইলাম। ধীরে ধীরে আমার কাঁধে আশ্রয় নিল অনামিকার মাথা। নিবিড়তায় আবেগের বিস্ফোরণও ধীরে ধীরে স্তিমিত হল। কিন্তু তার বেদনার ইতিবৃত্ত রহস্যাবৃতই রয়ে গেল।

আত্মনিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়ার পর চোখ মুছে অমানিকা হঠাৎ বলল, “আমায় এখন যেতে হবে। হয়তো আমাদের দেখা হবে আবার… হয়তো হবে না আর কোনওদিনও…”

কোথায় যাবে, কেন যাবে— এরকম কিছু অনধিকার প্রশ্ন করলাম। উত্তর অবশ্য মিলল না। অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে— সেই নানা রঙের দৃশ্যমান তরঙ্গের মতো মুহূর্তেই হারিয়ে গেল অনামিকা!

বেহালা বাজানো লোকটাকে আবার দেখতে পেলাম মর্মান্তিক করুণ সুরে বেহালাটা বাজিয়ে চলেছে। বুকটা মরুভূমির মতো খাঁ খাঁ করছে আমার। চিৎকার করে তার বাজনা থামাতে বললাম। সে কানে নিল না কথাটা। দারুণ ভয়ে দেখতে পেলাম আমার চারপাশটা দ্রুত পালটে যাচ্ছে। সেই নারকীয় রেস্টুরেন্টে কোনও মন্ত্রবলে আবারও ফিরে গেছি। বাকি সব দৃশ্যপট আমার চেনা। কেবল সেই ধোপদুরস্ত পোশাক পরিহিত লোকটির অঙ্কে শায়িত রয়েছে… না না না! এ হতে পারে না! দুর্ভাগা যুবকটির পরিবর্তে হতভাগিনী অনামিকা! মাথাটুকু কেবল তার আর বাকি দেহটা…

চপার দিয়ে একখণ্ড মাংস কাটার সময় রক্ত ছিটকে এসে লাগল আমার মুখে! আর সহ্য করতে পারছি না— দ্রুত অন্ধকার নেমে আসছে দু-চোখের সামনে। অনন্ত অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছি আমি… চেতনা লুপ্ত হওয়ার আগে কষাই এর মুখে দেখতে পেলাম আগের মতোই অমায়িক হাসি!

চেতনা ফেরার সময় মাথায় তীব্র বেদনা অনুভব করলাম। কোথায় রয়েছি বুঝতে অনেকটা সময় লাগল। কিন্তু চেতনা ফেরার পর থেকেই টের পাচ্ছি ঘন ঘন মাটিটা কেঁপে উঠছে। একটু থিতু হয়ে, অনির্দিষ্টভাবে চারপাশটা দেখতে গিয়ে চোখে পড়ল মর্মান্তিক দৃশ্যটা। বিশালাকার এক অসংবৃত নারী নির্মমভাবে শৃঙ্খলিত হয়ে রয়েছেন; নীরব অশ্রুমোচন করে চলেছেন অবিরত। তাঁর সারা দেহে চেনা অচেনা নানারকম অত্যাচারের যন্ত্রপাতি সংযুক্ত করা রয়েছে। বিবর্ণ হয়ে আসা রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত ত্বকে তাঁর খাপছাড়া সবুজের ছোপ! সারা মুখে তাঁর অসহ্য যন্ত্রণার অভিব্যক্তি স্পষ্ট ফুটে উঠছে। আরও ভয়াবহ ও অস্বস্তিকরভাবে, আবরণহীন অন্তর্যন্ত্রের মধ্যে কালো হয়ে আসা ফুসফুসটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। আর দেখা যাচ্ছে হৃৎপিণ্ডটা! অনিয়মিত ছন্দে সেটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। সঙ্গে সঙ্গে ভীষণ জোরে কেঁপে উঠছে মাটিও! বর্ণনাতীত বীভৎসতায় বুক কেঁপে উঠল!

বিশালাকার সেই অত্যাচারিত নারীকে কেন্দ্রস্থল করে, তার পরিধি বরাবর বৃত্তাকারে সংঘটিত হচ্ছে নারকীয়তার আরও কিছু ক্রিয়াকলাপ। নারীপুরুষের অগণিত আধপচা শবদেহের সঙ্গে বিকৃত রতিক্রিয়ায় লিপ্ত হচ্ছে বেশ কিছু প্রেত সদৃশ মূর্তি! তাদের পৈশাচিক উদ্দীপনা প্রত্যক্ষ করতে করতে আর বিষাক্ত দুর্গন্ধের প্রভাবে, তীব্র বিতৃষ্ণায় বমি পেয়ে গেল।

বমি করতে করতেই দেখতে পেলাম সেই দৈত্যাকার নারীর ফুসফুস আর হৃৎপিণ্ড ফেটে পড়ল— বিস্ফারিত ফুসফুস থেকে চটচটে কালো কীসব যেন দূর দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ল আর প্লাবনের মতো ধেয়ে এল রক্তের স্রোত। পালাতে চাইলাম, কিন্তু ভেসে গেলাম সেই শোণিত প্লাবনে।

পুতিগন্ধময় সেই রক্তস্রোতে ভাসছে শতাব্দীর সব আবর্জনা, পচাগলা শবদেহ। ভেসে থাকার চেষ্টা করছি আমিও। দম বন্ধ হয়ে আসছে ক্রমেই। আর বেশিক্ষণ ভেসে থাকা সম্ভব হবে না— বেশ বুঝতে পারছি। অবসন্ন দেহে ভেসে থাকার চেষ্টা করতে করতে কখন যে সংজ্ঞা হারালাম তা বলতে পারি না।

জ্ঞান ফিরল প্রচণ্ড কম্পনে আর নিদারুণ উত্তাপে। অনেক কষ্টে চোখ খুলে দেখলাম ভয়াবহ ভাবে কেঁপে উঠছে মাটি, ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে ক্রমান্বয়ে। ফাটল থেকে বেরিয়ে আসছে গনগনে লাল লাভার স্রোত। উঠে দাঁড়াবার মতোও আর শক্তি বুঝি নেই। ওদিকে লাভাস্রোত এগিয়ে আসছে অমোঘ গতিময়তায়। আবার উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোনওরকমে দাঁড়ালেও বেশিদূর পালাতে পারলাম না। চারদিক থেকে আমায় ঘিরে ধরেছে আসন্ন মৃত্যু। তিনদিক থেকে লোহিততপ্ত লাভাস্রোত ক্রমশ এগিয়ে আসছে সব কিছু গ্রাস করতে করতে আর পিছনে রয়েছে অতলান্ত খাদ!

হঠাৎই একটা রঙিন তরঙ্গ ভীষণ দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে এল। দমকা বাতাসের মতো আমায় ঘিরে পাক খেতে লাগল, আর আমায় প্রায় উড়িয়ে নিয়ে চলল অন্য কোথাও।

আবার যখন পায়ের তলায় মাটি পেলাম, তখন নরম ঘাসের স্পর্শও অনুভব করতে পারলাম। পঞ্চেন্দ্রিয়ের উপর বিশ্বাসটা এখন আর তেমন অবশিষ্ট নেই। তাই নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস হল না, আমার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে আর কেউ নয়, স্বয়ং অনামিকা!

মৃদু হেসে সে বলল, “আবার তবে দেখা হল আমাদের! আমায় মিস করছিলে তো?”

সত্যি-মিথ্যার বিচার বিবেচনা লোপ পেয়েছে আমার। তবু বলতে চাইলাম, যে বিভীষিকা প্রত্যক্ষ করেছি তা কি মিথ্যে ছিল, নাকি এখন যা দেখছি তা মিথ্যে? কিন্তু সেই বীভৎসতার কথা অনামিকাকে বলতে পারলাম না। তবু আগের বারে বলা হয়নি, এমন কিছু কথা অবশ্যই বললাম তাকে।

একটা পরিত্যক্ত নিচু পাঁচিলের উপর আমরা এখন পাশাপাশি বসে আছি। জানি না কেমন করে, কিন্তু অনামিকা খুব ভালোভাবে জানে আমার পছন্দগুলো। একটু আগেই সে একটা ডার্ক চকোলেটের ভাগ দিয়েছে আমায়। ঈষৎ তিক্ত ভালো লাগাটা এখন প্রাণভরে উপভোগ করছি আমরা দুজনে।

সূর্যাস্তের সময় হয়ে এসেছে। রক্তিম আভায় আকাশ সেজে উঠেছে নববধূর মতো।

হঠাৎ করে আমার মনে পড়ল অনামিকার আবৃত্তির একটা পঙক্তি, “সূর্যাস্তের পর থাকে কি নতুন ভোরের প্রতিশ্রুতি?”

আমার বিপদের সময় যেভাবে ঠিক জানতে পেরে চলে আসে ও, তেমনিভাবেই আমার মনের কথাটা বুঝে নিয়ে বলল, “কী হবে বলো তো অতীতে বেঁচে? কী হবে ভবিষ্যতের আশঙ্কায় বর্তমানটাকে নষ্ট করে? এখনকার এই ভালো লাগার মুহূর্তরা তো আর মিথ্যে হয়ে যাবে না। নতুন ভোরের প্রতিশ্রুতি নাই বা থাকলে সূর্যাস্তে!”

অনামিকার খোঁপায় বাঁধা আছে একটা সাদা গোলাপ। ভালোই লাগছে, তবে লাল হলে যেন আরও বেশি ভালো লাগত! কথাটা বললাম ওকে।

অনামিকা বলল, “তুমি সত্যিই চাও আমার মাথায় লালগোলাপ দেখতে?”

তারপর শ্বেতগোলাপটির দিকে ইঙ্গিত করে বলল, “জানো তো, ওর-ও না রঞ্জিত হতে ইচ্ছে করে… খুব ইচ্ছে করে। কিন্তু তার জন্য যে মূল্য দিতে হবে, সেটা দিতে কি তুমি প্রস্তুত? উষ্ণ রক্তে অভিষিক্ত হয়ে ও রঞ্জিত হয়ে উঠবে! তোমার ভয় করবে না তো?”

নাহ! আমার এখন আর একটুও ভয় করছে না। ভয় কী? অনামিকাকে যে পেয়েছি নিবিড় নৈকট্যে! আর সেই শ্বেতগোলাপটি আমারই শোণিতবিন্দু পান করে ধীরে ধীরে রঞ্জিত হয়ে উঠছে!

Tags: উৎস ভট্টাচার্য, ফ্যান্টাসি গল্প, ষষ্ঠ বর্ষ দ্বিতীয় সংখ্যা

2 thoughts on “শোণিতরাঙা শ্বেতগোলাপ

  • November 22, 2021 at 9:41 am
    Permalink

    আপনার রচনাটা সাহিত্যের কোন খাতে পড়বে তা ব্যাকরনগত ভাবে সঠিক বলতে না পারলেও, পড়ে বেশ ভাল লাগল। আমার মনে হয় এই ধরনের অনুভূতি অনেকেরই সম্ভবতঃ হয়, কিন্তু আপনি বেশ সুন্দর করে গুছিয়ে লিখেছেন অভিজ্ঞতাটা। আমার নিজের জীবনেও, স্বপ্ন আর জাগরনের মাঝামাঝি জায়গায়, এইরকম বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু তা কখনও লিখে দেখবার কথা এর আগে ভেবে দেখিনি কখনও। এখন মনে হচ্ছে সেগুলোর কী তাৎপর্য তা বিশ্লেষন করবার চেষ্টা না করেও, অন্যদের সঙ্গে বেশ ভাগ করে নাওয়া যায় অভিজ্ঞতাগুলো।

    Reply
    • January 6, 2022 at 12:27 am
      Permalink

      আন্তরিক ধন্যবাদ৷ নিরন্তর শুভেচ্ছা

      Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!