ডলি
লেখক: অনুষ্টুপ শেঠ
শিল্পী: সৌরভ ঘোষ
রবিবার ডলির যখন ঘুম ভেঙেছিল, তখন ওর গায়ের রং শ্যামলা আর কোমরছাপানো ঢেউখেলানো চুল ছিল। মঙ্গলবার যখন ঘুম থেকে উঠেছিল, তখন আবার ওর গায়ের রং ফুটফুটে ফর্সা, চুল লাল। কিন্তু বৃহস্পতিবার— সেদিন ওর চোখ ছিল নীল, চুল কুচকুচে কালো, আর হাতগুলো লাল, রক্তে।
দামি জিনিসে ঠাসা বসার ঘরটার সবকিছু ধবধবে সাদা আর সোনালি রঙের, একমাত্র ব্যতিক্রম হচ্ছে ফরাসি পরিচারিকার মতো কালো পোশাক পরিহিতা ডলি। ঘরটা দেখলেই বোঝা যায় এটা কেউ নিজে সাফ করে না, লোক ভাড়া করে করায়। যেমন পরিপাটি, তেমনি পরিষ্কার সাদা।
পরিপাটি আর পরিষ্কার— মানে, কোটিপতি ব্যবসায়ী ক্লাইভ স্টিলের মৃতদেহটা বাদ দিয়ে। জানি, জানি, নামটা হাস্যকর। যাই হোক, এই মুহূর্তে মৃতদেহটা আর তা থেকে বেরিয়ে আসা পচা ফুলের পাপড়ির মতো নাড়িভুঁড়ি ছড়িয়ে পড়ে আছে ডলির পায়ের কাছে।
রোজামুন্ডা কার্কব্রাইড যখন ঘরে পা রাখল, তখন ডলিকে এমনটাই দেখেছিল— সাদা ঘরে লালের ছোপের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে, যেন গোলাপের মধ্যে একটা কাঁটা।
প্রোগ্রাম এক্সিকিউশন শেষ হয়ে যাবার পর ডলি নিজেকে ওই পজিশনে লক করে দিয়েছিল। রোজামুন্ডা ওই রক্তভেজা কার্পেটের লাল দাগের সীমার ঠিক বাইরেটায় যখন হাঁটু গেড়ে বসল, ডলি একটুও নড়ল না।
ঘরটায় রক্ত মাংস বিষ্ঠার মিশ্র দুর্গন্ধ ঘুরে বেড়াচ্ছিল। জানলার কাচে থিকথিক করছিল মাছি, যদিও তারা এখনও কেউ ভিতরে ঢুকতে পারেনি। তবে বাড়ি যতই নিশ্ছিদ্র বন্ধ করা হোক না কেন, একসময় না একসময় ওরা ঢুকবেই। মাছিরা ঠিকই একটা রাস্তা খুঁজে বার করে নেয়, প্রেমের মতোই।
একটু কষ্ট করে সামনে ঝুঁকে উল আর সিল্ক মেশানো সাদা পুরু কার্পেটের ওপর নিজের সবুজ গ্লাভসে ঢাকা দু–হাতের ভর রাখল রোজ, ওর মাথাটা এখন ডলি আর বডির মাঝখানে। ও দেখতে পাচ্ছে ডলির হাতের নিচের দিকে কনুই অবধি ফিতের মতো পেঁচিয়ে গেছে শুকনো খড়খড়ে রক্তের দাগ, সেখান থেকে ঝরে পড়েছে নিচের কার্পেটের জমা রক্তে।
অ্যান্ড্রয়েডটা অন্তর্বাস পরেনি।
“মেয়েটার স্কার্টের ভিতরে উঁকি দিচ্ছ নাকি, ডিটেকটিভ?”
চল্লিশোর্ধ্ব রোজ লম্বা, ভারী আর বেঢপ চেহারার। সাবধানে মৃতদেহ আর খুনের অস্ত্রকে না ছুঁয়ে নিজেকে টেনে উঠে দাঁড়াতে তার বেশ মিনিটখানেক সময় লেগে গেল। অকুস্থলে আসার আগে সে তার চুল টেনে বেঁধে জাল লাগিয়ে খোঁপা করে নিয়েছিল। এতটাই টেনে বাঁধা যে চোয়ালটা চৌকো দেখাচ্ছিল পুরো। তার চোখগুলো ওই পুতুলটার চোখের মতোই নীল একদম।
“ওকে কি মেয়ে বলা যায়, পিটার?” হাঁটুতে ভর দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায় রোজ অবশেষে। হাত পিছমোড়া করে, পিঠ টান করে সে দরজার দিকে ঘুরে দাঁড়াল।
পিটার দরজার ঠিক সামনেই থমকে দাঁড়িয়েছিল, তার চোখের গাঢ় কালচে মণি, যা সূর্যের বা ঝাড়বাতির আলোতেও চকচক করে না, ঘুরে ঘুরে ঘরের সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ দৃশ্য খুঁটিয়ে দেখে নিচ্ছিল। তার চোখের সাদাটাও এমনকি ঘোলাটে, যেন মণির রং ছড়িয়ে পড়েছে সেখানেও। সাদা দেওয়াল, সাদা কার্পেট আর তার উপরে রাখা পুরোনো ফরাসি ধরনের সোনালি বর্ডার দেওয়া সাদা মার্বেলের টেবিলের সামনে কালো স্যুট আর রোদে পোড়া ঘন বাদামি চামড়ার পিটারকে একটা বিশাল বড় কার্ডবোর্ডের কাট–আউট মডেল মনে হচ্ছিল।
এগিয়ে আসার সময়ে মেঝেতে তার জুতোর উপরে পরা নীল কাগজের মোড়কটা খস খস করছিল।
“সুইসাইড? কী মনে হয়?”
“হয়তো, গলা টিপে।” বলে রোজ লাশের সামনেটা ছেড়ে সরে দাঁড়াল।
পিটার আওয়াজ করে টেনে শ্বাস নিল, রোজ নিজেও তেমনই করেছিল প্রথম দেখে।
“লোকটাকে কেউ চরম ঘেন্না করত দেখা যাচ্ছে। আরে, এটা কি ওই নতুন পুতুলগুলোর একটা? বাহহ, খাসা তো!” পিটার মাথা নাড়াচ্ছিল, “নির্ঘাৎ এটা কিনতে বাড়ি বিক্রি করে দিতে হবে আমায়, তাও কুলোবে না!”
“ভাবো, পঞ্চাশ হাজার ডলার দিয়ে একটা সেক্স টয় কেনার পর সেটা তোমার লিভার ছিঁড়ে বার করে দিল!” বলতে বলতে হাত বুকের কাছে ভাঁজ করে রোজ পিছিয়ে দাঁড়াল।
“এ বোধহয় অত দেয়নি, এর কোম্পানিই তো এগুলোর জন্য অ্যাক্সেসরি প্রোগ্রাম বানাত।”
“ও, ইন্সাইডার হিসেবে ফ্রী পেয়েছে?”
“ট্যাক্সের সুবিধাও। টেস্ট মডেল হিসাবে দেওয়া হতে পারে।” পিটার ডিপার্টমেন্টের এক্সপার্ট গৃহসঙ্গীর ব্যাপারে। সে আস্তে আস্তে সারা ঘর চক্কর কাটছিল, সব অ্যাঙ্গল থেকে খুঁটিয়ে দেখছিল। শিগগিরই সিন টেকনিশিয়ানরা তাদের ক্যামেরা, টুইজার, থ্রী–ডি স্ক্যানার সব নিয়ে এসে হাজির হবে ঘরটাকে একটা পার্মানেন্ট ভার্চুয়াল রূপ দিয়ে ফেলতে। পিটার তার ‘সফট ফরেনসিক’ দায়িত্ব হিসাবে ডলির প্রোগ্রাম চেক করবে আর কোনও একজন মেডিক্যাল এক্সামিনার মৃত্যুর কারণ কনফার্ম করবে, একদম দেখে যা মনে হচ্ছে তাই–ই লিখবে সম্ভবত— কিছুতে ভিক্টিমের পেট ছিঁড়ে বুক আর পেটের ভিতরের সব প্রত্যঙ্গ খুবলে বার করে এনেছে।
“দরজা বন্ধ ছিল?”
রোজ ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বলল, “কেউ কোনও চীৎকার শোনেনি।”
“লাংস ছাড়া আর কতক্ষণই বা কেউ চীৎকার করবে!” পিটার নিশ্বাস ফেলল, “এমনিতেও জানো তো, গরীবের ঘর হলে আশপাশের কেউ কোনও আওয়াজ শুনতে পায় না কখনও। আর বড়লোক হলে, তাদের আওয়াজ শোনার মতো কাছাকাছি কোনও পড়শি থাকেই না।”
লম্বা সিল্কের পর্দার পিছনে একটা টিপিক্যাল বার্মিংহামের সুন্দর দিন ফুটে উঠেছিল তখন। মৃদু, আরামদায়ক, উজ্জ্বল একটা সকাল যা আলাবামার বিশেষত্ব। পিটার ঘাড় উঁচু করে ঘরের ঝাড়বাতিটার ঝকঝকে আলোর দিকে তাকাল। ওটার কারুকার্যময় বাঁকগুলো, রক্তের বাষ্প লেগে মলিন হয়ে যাওয়ার আগে অবধি নিখুঁত পরিষ্কার ছিল বোঝা যায়।
“স্টিল একাই থাকত।” রোজ বলল, “রোবটটা ছাড়া একাই আর কী। আজ সকালে রান্নার লোক এসে বডিটা দেখে। তার আগে শেষ ওকে দেখেছে ওর পার্সোনাল অ্যাসিস্টেন্ট, অফিস থেকে গতকাল বেরোনোর সময়।”
“আলো জ্বালা, মানে অন্ধকার হবার পর খুনটা হয়েছে।”
“ডিনারের পর।” রোজ সায় দেয়, “কাল রাতে রাঁধুনি বাড়ি চলে যাবার পর।”
পিটার সারা ঘরে ঘুরছিল, পর্দা আর আসবাবের পিছনে উঁকি মারছিল, কোনাগুলো চেক করছিল, ঝুঁকে সোফার লেস কভার তুলে পরখ করছিল, “যাক, পেটে খাবার কী ছিল তা নিয়ে এক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠবে না মনে হয়।”
রোজ মৃতব্যক্তির স্যুটের জ্যাকেট হাতড়াচ্ছিল, একটা চেয়ারের পিঠে ঝোলানো ছিল সেটা। পকেট কম্পিউটার, ফোল্ডিং ছুরি, ওয়ালেটে আরএফআইডি চিপ; বাড়ি হাতের পাতার স্ক্যানার দিয়ে খুলত, গাড়ি ভয়েস রেকগনিশন দিয়ে। চাবি–টাবির বালাই নেই। “অবশ্য ডাক্তার পাকস্থলীটা যদি খুঁজে পায় তবেই!”
“আচ্ছা, রাঁধুনী রেখেছিল, কিন্তু কোনও হাউসকীপার ছিল না?”
“সম্ভবত রোবটটাকে দিয়েই বাকি সব কাজ করাত। রান্না ছাড়া।”
“হুঁ, টেস্ট বাডস্ নেই কিনা।” পিটার সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মাথা নাড়ে, “রেসিপি ফলো করতেই পারে, কিন্তু স্বাদ…”
“খুব দারুণ কিছু হবে না।” রোজ সায় দেয়, ঠোঁটে জিভ বুলিয়ে। বাইরে একটা গাড়ির দরজা বন্ধ হবার আওয়াজ শোনা যায়। “সিন টিম?”
“মেডিক্যাল।” পিটার জানলার উপর দিয়ে ঝুঁকে দেখে বলল, “চলো, আমরা ফিরে গিয়ে এই মডেলটার প্রোগ্রামগুলো দেখি এবার।”
“ঠিক আছে, তবে আমি ওকে জেরাটা করব।” রোজ বলল, “তোমাকে একা একটা সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে ছেড়ে দেওয়া মানে কী আমি জানি না নাকি!”
পিটার চোখ কপালে তুলে ওর পিছু পিছু দরজার দিকে যেতে যেতে প্রতিবাদ করল, “উফ, আমি মোটেও এরকম নিষ্প্রাণ কিছু পছন্দ করি না…”
***
“তো, এই নতুন মডেলের পুতুলগুলোর বিশেষত্ব কী?” পিটারের গাড়িতে বসে সতর্কভাবে আলগা গলায় প্রশ্ন করল রোজ।
“আরে!” পিটার ভ্রূ কুঁচকে চালাচ্ছিল, “এক সেকেন্ড!”
রোজের গাড়িটা, বাম্পার থেকে সাবধানী দূরত্ব রেখে, পিছন পিছন আসছিল। ওরা বাড়িটা থেকে বেরিয়ে বামোরাল রোড ধরল। পার্কওয়েতে না ওঠা অবধি পিটার মুখ বুজে ড্রাইভ করে গেল। শহরের দক্ষিণ দিকে যাওয়ার একটা শ্রেণিতে ঢুকে যাওয়ার পর, সামনের গাড়ির বাম্পারের সোজা গাড়িটাকে ফিট করিয়ে, তবে অটোপাইলটের হাতে কন্ট্রোল ছেড়ে দিয়ে হাত গুটিয়ে আরাম করে বসল সে।
এতক্ষণে উত্তরটা এল, “কী নয়! রিয়াল টাইম অনলাইন এডিট করতে পারা— চেহারা, ব্যবহার, মুখচোখ, জাতি, চুল… সব রকমের ব্যবহারের বৈচিত্র্য। যা চাই, যেমন চাই, চাওয়ামাত্র চেঞ্জ করতে পারা যায়।”
“মানে, তুমি যদি কারো অন্যরকম চাহিদা বা শখের কথা জানো,” রোজ থেমে থেমে বলে, “বিশেষ কিছু যদি জানো, তাহলে তার একটা অ্যাপ বানাতেও পারো…”
“সেটা তার কাছে বিরাট অ্যাপিলিং হবে।” পিটার কোলে হাত এলিয়ে দিয়ে উৎসাহভরে মাথা ঝাঁকাচ্ছিল, “একটা— পার্ডন মাই এক্সপ্রেশন— ব্যাকডোরসহ, ধরো…”
“ট্রোজান হর্স কথাটা। একজন প্রোগ্রামারকে ফালতু সেক্স মেশিনের জন্য হেলাছেদ্দা করো না।”
“সেরকম অ্যাপ আছে, জানো।” পিটার বলল। রোজের বিরক্তির আওয়াজ অগ্রাহ্য করেই ও বলে চলল, “দুটো কেস হয়েছে। পৃথিবী জুড়ে, মানে এখনও কমন নয় হয়তো…”
রোজ মন দিয়ে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে ছিল, “কেউ কেউ এমনভাবে রিপ্রোগ্রাম করে যাতে যন্ত্রণায় চেঁচায় পুতুলগুলো।“
পিটারের ঠোঁটগুলো বেশ সুন্দর। কোন কারণে বিব্রত হলে সেগুলো কুঁচকে সরু হয়ে ওঠে, আগেও দেখেছে রোজ। “একদিক দিয়ে ভালো, এরা পুতুল দিয়ে এসব বায়নাক্কা মিটিয়ে নিতে পারছে…”
“যতক্ষণ না কল্পনা করে সন্তুষ্ট থাকা ঘুচে যায়…” রোজ খুব নির্বিকার গলায় বলে। কাচের মধ্যে দিয়ে আসা রোদে গাড়িটা গরম হয়ে উঠছে এবার, “সিরিয়াল রেপিস্ট বা সিরিয়াল কিলারদের বেড়ে ওঠার স্টেজ সম্বন্ধে কী জানো তুমি?”
“মানে, বলছ, যদি ব্যথা পাওয়ার ভান করাটা আর যথেষ্ট না হয় তাদের জন্য? ব্যথা পাওয়ার অভিনয়টা আর সুখ না দেয়?”
রোজ বুড়ো আঙুলের একটা ফোসকা খুঁটতে খুঁটতে মাথা নেড়ে সায় দেয়। রবারের গ্লাভগুলোতে ওর অ্যালার্জি হয়।
“এরা কমবয়েসে ছাপানো পর্ন ম্যাগাজিন কেটে কুচিকুচি করত,” পিটারের চওড়া কাঁধ শ্রাগ করার ফলে সিটের পিছনে ঘষা খেয়ে স্যুটের গায়ে ভাঁজ পড়ে, “তাহলে… এরা কোনও না কোনওভাবে নিজের শখ মিটিয়েই ছাড়বে।”
“আমারও তাই ধারণা।” রোজ আঙুলটা মুখে পুরে চোষে, খুঁটে খুঁটে রক্ত বার করে ফেলেছে ও।
জ্বালা করে।
***
নিজের অফিসের টেবিলের সরু ধারটায় একটা অফিসের শস্তা চেয়ার টেনে এনে ডলিকে বসতে দিল রোজ। বসে, আস্তে আস্তে মুখ তুলে তাকিয়ে প্রথমে চোখ পিটপিট করল,তারপর হাসল একটু পুতুলটা।
“ল এনফোর্সমেন্ট ওভাররাইড কোড ঠিক আছে।” বাচ্চা মেয়ের মতো রিনরিনে গলায় বলল ডলি, “কীভাবে আপনার কাজে আসতে পারি, ডিটেকটিভ কার্কব্রাইড?”
“আমরা ক্লাইভ স্টিলের খুনের তদন্ত করছি,” রোজ বলতে বলতে একবার পিটারের দিকে তাকাল, ডলির পিছনে ওয়্যারলেস স্ক্যানার নিয়ে সে ভ্রূ কুঁচকে মন দিয়ে শুনছিল, “রেকর্ড অনুযায়ী, সে তোমার কন্ট্র্যাক্টের মালিক।”
“বলুন কী করতে পারি আমি।”
ডলি একটা সত্যিকারের মেয়ে হলে, অফিসের চেয়ারের রিসাইকলড রাফ কভারে তার নগ্ন উরুর চামড়া সেঁটে যেত, ঘামের ছাপ ফেলত। কিন্তু তার একদম আসলের মতো দেখতে চামড়া তৈরি হয়েছে কৃত্রিম পলিমার দিয়ে, তার ঘাম হয় না— অবশ্য ক্লায়েন্ট চাইলে আলাদা কথা— তাই হয়তো এসব পাতি চেয়ারের কভারটভারে তার পা সেঁটেও যায় না।
“প্রমাণ যা পাওয়া গেছে তাতে মনে হচ্ছে তোমাকে খুনের অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছিল।” ব্লটারের উপর হাত তেকোনা করে ঠেকিয়ে বলল রোজ, “তোমার রেকর্ড আর সফটওয়্যার আপডেট হিস্ট্রি আমাদের দেখতে হবে।”
“ওয়ারেন্ট আছে তো?” পুতুলটার গলা একটুও যন্ত্রের মতো কাঠ–কাঠ নয়, বরং মানবিক, সহজ। এমনকি আইনী কথা বলার সময়েও একটা বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ ভাব ফুটে উঠল।
পিটার নিঃশব্দে ওয়ারেন্টটা ট্রান্সমিট করল। ডাটা প্রোসেস করতে করতে ডলি দু–বার চোখের পলক ফেলল, কম্পিউটারের স্ট্যাটাস বার যেমন বোঝায় যে কাজটা চলছে। যাতে বোঝা যায় মেশিন হ্যাং করে যায়নি।
“আমাদের কাছে আরও একটা ওয়ারেন্ট আছে, তোমার গায়ে লেগে থাকা ডিএনএ ট্রেস করার জন্য।”
রোগা কাঁধের উপর নিখুঁত সুন্দর থোকাবাঁধা কুচকুচে কালো চুলের মধ্যে ডলির হাসিটা আরও সুন্দর দেখাল, “আমি সবরকমভাবে আপনাদের সাহায্য করব।”
পিটার ওকে নিয়ে ইন্টেরোগেশন রুমে গেল, যেখানে পুরোটা রেকর্ড করা থাকবে। সেখানে আরেকজন টেকনিশিয়ানের সাহায্যে সেখানে সে ডলির জামাকাপড় খুলে এভিডেন্স ব্যাগে ভরল, সারা গায়ে ব্রাশ বুলিয়ে সমস্ত সূক্ষ্ম ধুলোকণা একটা কাগজে জড়ো করে নিল, পলিমারে বানানো চুল আঁচড়াল, পলিমারের ত্বকে সুতি–কাপড় দিয়ে মুছে মুছে এভিডেন্স তুলে নিল। শরীরের সমস্ত খাঁজখোঁজ, ছিদ্র এমননি নখের নিচের অংশও বাদ গেল না।
রোজ পাশে হাত জড়ো করে দাঁড়িয়ে ছিল, প্রয়োজনীয় সাক্ষী হিসাবে। ডলি নির্বিকারভাবে সব করতে দিল, যেমন বলা দরকার তেমন ঘুরে ফিরে দাঁড়ানো ছাড়া একটুও নড়ল না। তার কৃত্রিম শরীর, সত্যি বলতে কি, সমান পেট, মাপা হার্ট শেপের পাছা, রোগা পাঁজরের পাশে কার্টুনের মতো দোল খাওয়া স্তন নিয়ে খুব অনাকর্ষণীয়, সেক্সলেস পদার্থ মনে হচ্ছিল। দেখা যাচ্ছে, স্টিলের রোগা শরীরের প্রতি লোভ ছিল।
“এই নাকি ডবকা চেহারার ছিরি!” রোজ পিটারকে ফিসফিস করে বলল, ওদের দুজনেরই পিঠ তখন পুতুলটার দিকে ছিল।
পিটার একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে নিল। যদিও পুতুলটার ফিলিংস বলে কিছু নেই, তবু, ওটাকে এত বেশিই মানুষের মতো দেখতে যে ওটাকে অন্য কিছু মনে করা বেশ কঠিন। “তুমি বোধহয় লোভনীয় বলতে চাইছ”, সে বলল, “বাড়াবাড়ি রকমের নিখুঁত, তাই না?”
“তোমার অন্যরকম চেহারা পছন্দ হলে, আমার স্ট্রাকচারে অনেক সাইজ চেঞ্জ করা যায়।” ডলি বলল।
“থ্যাঙ্ক ইউ,” পিটার জবাব দিল, “তার কোনও দরকার নেই।”
স্থির দাঁড়িয়ে থেকেই ডলি একগাল হাসল, “তোমার সায়েন্স ভালো লাগে, ডিটেকটিভ কিং? এই সপ্তাহের ‘নেচার’এ একটা লেখা আছে, ডি এন এ রেপ্লিকেট করতে কিভাবে পলিমার চেইন রিয়্যাকশন ব্যবহার করা হচ্ছে তা নিয়ে। আর চার–পাঁচ বছরের মধ্যেই হয়তো ফরেনসিক আর মেডিক্যাল ডি এন এ অ্যানালিসিস অনেক কম খরচে করা সম্ভব হবে।”
ডলির মুখের অভিব্যক্তি পালটায়নি, কিন্তু কথাগুলো বলার সময়ে গলার স্বরে উত্তেজনা ফুটে উঠছিল। উৎসাহ–ও। খুব বিশ্বাসযোগ্য আর ইন্টারেস্টিং শুনতে লাগছিল তাই।
মনে হচ্ছে, ক্লাইভ স্টিল তার সেক্স রোবটটিকে মলিক্যুলার বায়োলজি নিয়ে আগ্রহভরে কথা বলার জন্য প্রোগ্রাম করেছিল।
“সত্যিকারের বুদ্ধিমান মেয়েদের পছন্দ করে এমন লোক কেন যে আমার চোখে পড়ে না!” রোজ বিড়বিড় করে।
পিটার পুতুলটার দিক থেকে মুখ আড়াল করে চোখ টিপল, “তেমন কেউ বেঁচে নেই আর।”
***
কয়েক ঘণ্টা পরে, পিটার আর টেকনিশিয়ানটি মিলে সব এভিডেন্স নেওয়ার পাট শেষ করার পর, পিটার ওর ফাইলগুলো ডাউনলোড করতে শুরু করল। রোজ তার সফটওয়্যার দিয়ে স্টিলের ফিনান্সিয়াল সমস্ত ডকুমেন্ট খোঁজার কাজ শুরু করিয়ে দিয়ে পিটারের ঘরে উঁকি মারল। বাকি সব নিশ্চয় হয়ে গেছে, কারণ ডলি হাতটাত ধুয়ে বেশ পরিপাটি ফিটফাট হয়ে টুলে বসে মন দিয়ে নেইল কাটার দিয়ে নখ শেপ করছিল আর এভিডেন্স ব্যাগে গুঁড়োগুলো ভরছিল। তার বাঁ কানের নিচ থেকে একটা প্লাগ বেরিয়ে পিটারের কম্পিউটার অবধি চলে গেছিল।
“ওর হাতে অস্ত্র দিচ্ছ, পিটার?” পুরোনো কাঠের দরজাটা বন্ধ করতে করতে রোজ বলল।
ডলি মুখ তুলে তাকাল, যেন কথাটা ওকেই বলা হয়েছে। কিন্তু কিছু বলল না।
“ওর ওটা লাগে না।” পিটার জবাব দিল, “তা ছাড়া, যাই ভরা হয়ে থাক ওর কোডে, কাজ হয়ে যাবার পর সেটা আপনাআপনি পুরোটা মুছেও গেছে। মেইন পার্সোনালিটি প্রোগ্রামে খুব একটা কিছু ড্যামেজ হয়নি, খালি কিছু মেমরি গ্যাপ তৈরি হয়েছে দেখছি। সেগুলো ব্যাক আপ ডাটার সঙ্গে মিলিয়ে দেখব, সিন টিম সেসব নিয়ে এলে।”
“মেমরি গ্যাপ। মানে, খুনটা,” রোজ আন্দাজ করতে চাইছিল, “আর যখন কোডে ইন্সটল করা হচ্ছিল সেই সময়টা…?”
ডলি অবসন্নভাবে ওর লম্বা লম্বা পলকঘেরা নীল চোখ পিটপিট করল এইখানে। পিটার তার কাঁধে আলতো চাপড় মেরে বলল, “কাজটা যে–ই করে থাক, সে খুব ভালো কোড ক্র্যাক করতে জানে। সে শুধু মেমরি মুছেই দেয়নি, প্যাটার্ন ইউজ করে গ্যাপগুলো ওভাররাইটও করে দিয়েছে প্রায় পুরোটা। ক্লোন টুল ব্যবহার করে যেমন ছবি থেকে অপছন্দের লোককে মুছে দেওয়া যায় ফোটোশপে।”
“ওর দিনগুলো তো মোটামুটি একই প্যাটার্নের হবে। তুমি কী করে বুঝলে এরকম করা হয়েছে?”
“ক্যালেন্ডার।“ পিটারের গলায় চাপা গর্ব ফুটে উঠল, “সব দিন এক কাজ করত না তো। রুটিন ছিল, সোমবার একরকম, বৃহস্পতিবার আরেকরকম, তো ওই, যেখানে যেখানে প্যাটার্ন তফাৎ হচ্ছিল সেটা চোখে পড়ে গেল আমার। তা ছাড়া আরও একটা ইন্টারেস্টিং জিনিস, এই যে, এই দ্যাখো…”
সে আলগোছে একটা স্ক্রিনের সামনে হাত নাড়াল, স্ক্রিনে ছবি ফুটে উঠল তাতে। ডলি তার সাদা–কালো ইউনিফর্ম পরে ভ্যাকুয়াম ক্লিনার চালাচ্ছে। “বাড়ির ক্যামেরা”, পিটার বুঝিয়ে বলল, “রোবটটা স্টিলের সিকিউরিটি সিস্টেমে প্লাগ ইন করা ছিল, একটা বাহারি দেখতে পাহারাদার কুকুর বলতে পারো। যে ওর কোড হ্যাক করেছে, সে কিন্তু এই ওয়েবক্যামগুলোর ফিডও ম্যানিপুলেট করেছে যাতে ওর মেমরি আর এই রেকর্ডগুলো ম্যাচ করে।”
“করা যায় অমন?”
“যায় তো বটেই, আর ওর ফাইল ক্লোন করার চেয়ে বেশি কঠিন নয়ও। কিন্তু কোথায় করতে হবে সেটা জানা থাকা দরকার। কাজেই, আমাদের অপরাধী যে খুব ভালো করে কোডিং বোঝে সেটা নিশ্চিত। তুমি কী পেলে?”
রোজ কাঁধ ঝাঁকাল, “স্টিলের প্রচুর টাকা ছিল। মানে গুচ্ছের শত্রুও ছিল বলা যায়। বহুদিন লোকটা অন্য কোনও মানুষের সঙ্গে সেভাবে যোগাযোগ রাখেনি, বহু বছর ধরে ইন ফ্যাক্ট। আমি ঘনিষ্ঠ চেনাজানা যত নাম পেয়েছি সবাইকে ইন্টারভিউয়ের জন্য ডেকে পাঠিয়েছি, কিন্তু তারা একদম নতুন কিছু হদিস না দিলে, আমার মনে হয় এটা টাকার জন্যই খুন, আকস্মিক আবেগতাড়িত কিছু নয়।”
নখ পালিশ শেষ করে ডলি নেইলকাটারটা জেলের পোশাকে যত্ন করে মুছে, পিটারের ডেস্কে ব্লটারের উপর কালির পাত্র আর লাইট পেনগুলোর পাশে রেখে দিল।
পিটার ওটা টুস্কি মেরে ড্রয়ারে ফেলে দিল। “তাহলে, আমরা কোনও জিনিয়াস প্রোগ্রামার এক্স গার্লফ্রেন্ডকে খুঁজছি না যাকে স্টিল একটা রোবটের জন্য বাতিল করেছিল? ইশ, এরকম কাব্যিক বিচার টাইপের নাটুকে ব্যাপার হলে বেশ হত কিন্তু…”
ডলির মুখটা একটু হাঁ হল, চোখ পিটপিট করল, কিন্তু তারপর পিটার ওর সঙ্গে কথা বলছে না বলে জবাব দিল না। তবে, সে নিশ্বাস নেওয়ার মতো করে নাক টানল, নাকি নিশ্বাসই নিল? তারপর বলল, “আমার কন্ট্রাক্টের মালিকের মৃত্যুর তদন্তে সাহায্য করা আমার কর্তব্য।”
রোজ গলা নামিয়ে বলল, “ওরা কি এই মডেলটা মার্কেট থেকে তুলে নেবে?”
“যেমন গাড়ির একটা মডেল ক্র্যাশ করলে সেটা তুলে নেয়? জানি না সবেতেই তো কিছু না কিছু ভুল থেকে যেতে পারে…”
“অথবা ওই রোবট ল ব্যাপারটা আসবে নাকি… ওই যেটা লোকে টুইট করত খুব…”
“পজিট্রনিক ব্রেন ব্যাপারটা যে কী কে জানে, কিন্তু আমাদের রোবটদের সেটা নেই এটা শিওর। আসিমভের গল্পের রোবটরা স্বেচ্ছাধীন। ডলির নিউরোন সাদামাটা বাইনারি মোডে বানানো, মানুষের অনুকরণে। ওর মধ্যে এমনকি একটা বেড়ালের লেভেলের নিউরোকেমিস্ট্রিও নেই।” বলতে বলতে পিটার বুড়ো আঙুল দিয়ে নিজের কলার সোজা করছিল, “পুতুল কোনও কিছু চাইতে পারে না। পুতুল কোনওরকম মরাল জাজমেন্ট করতে পারে না, ঠিক যেমন তোমার গাড়িও পারে না। তা ছাড়া সেরকম কিছু করতে চাইলেও, হোম ডিফেন্সের খুব একটা কাজে আসবে না। ও ভালো কথা, এটার সেক্স সংক্রান্ত প্রোগ্রাম কিন্তু প্রায় পুরোটাই পাতি রেগুলার ফর্ম্যাট।”
“তাই–ই!”
পিটার ঘাড় নেড়ে সায় দেয়।
রোজ জুতোর ডগা দিয়ে মেঝের একটা ছোপ মোছার চেষ্টা করল, “তাহলে, এর যখন সেরকম… উৎকট কিছু চাহিদা ছিল না, রোবট নেওয়ার কী দরকার ছিল? চাইলেই তো যে কোনও মেয়েকে আনতে পারত!”
“কোনও নাটক নেই, ব্যথা লেগে যাওয়া নেই, হতাশা নেই। স্রেফ সুখ, নিখুঁত সাহায্যকারিনী। চেহারার হাজারো বৈচিত্র্যসহ।”
“আর কখনওই ও কী চায়, কী পছন্দ করে তা নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না। বিছানাতেও।”
পিটার হাসল, “পার্ফেক্ট সঙ্গিনী না, একজন স্বার্থপর মানুষের জন্য?”
***
ইন্টারভিউগুলোতে কিছুই পাওয়া গেল না। তবু, রোজের বেরোতে বেরোতে রাত দশটা বাজল। বসন্তের দিনগুলো বেশ উষ্ণ হতে পারে, কিন্তু সূর্য ডুবে যাওয়ার পর একটা ঠান্ডা বাতাস বইতে থাকে, এতক্ষণে পনিটেল খুলে ছড়িয়ে দেওয়া ওর চুলগুলো সেই হাওয়ায় এলোমেলো হচ্ছিল।
রোজের সবুজ গাড়িটা পিটারের গাড়ির পাশেই পার্ক করা ছিল। ও কাছাকাছি আসতে সেটা আপনি চালু হল, হেডলাইট জ্বলে উঠল, পাওয়ার–প্রোবগুলো ভিতরে ঢুকে গেল। ওর আরএফআইডি চিপ গাড়িটার স্ক্যানের রেঞ্জে আসতে দরজা নিজে থেকে খুলে গেল, রোজ ভিতরে ঢুকে বসে সিটবেল্ট লাগিয়ে নিল।
“বাড়ি। ডিনার।“
গাড়িটা মেসেজ পাঠিয়ে দিল যথাস্থানে। রোজ অটোপাইলটের হাতেই ছেড়ে দিয়েছিল, ছক মেনে একঘেয়ে চালানোটা যত বোরিং–ই হোক, এরকম ক্লান্ত ঘুমে ঢুলে আসা চোখ নিয়ে নিজে চালাতে যাওয়া নিরাপদ নয়।
পিটার অটোপাইলটের চালানো আরে গাড়ির অ্যাক্সিডেন্ট নিয়ে যা–ই বলে থাক, রোজ ঠিকঠাকই বাড়ি পৌঁছে গেল। দরজা চাবি দিয়ে খুলতে হল— এই বাড়িগুলোতে সিকিউরিটির কোনও অভাব নেই, তবে অতটা স্মার্টও নয়, একটু পুরোনো ধাঁচের। ভিতরে পা রাখামাত্র পাস্তা ফোটানোর আর গার্লিক ব্রেড টোস্ট করার সুগন্ধ ভেসে এল।
“স্বেন?” দরজা বন্ধ করতে করতে রোজ ডাকল।
ওর শান্ত গলায় উত্তর এল, “আমি রান্নাঘরে।“
রোজ দরজার পাশে জুতো খুলে, রান্নার সুঘ্রাণ নিতে নিতে কমদামি আসবাবে সাজানো বসার ঘরটা পেরিয়ে গেল।
স্বেন খালি গায়ে রান্না করছিল। ওর শিরদাঁড়া বরাবর চামড়ার ভাঁজগুলো দেখা যাচ্ছিল, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ওই জায়গাগুলোর চামড়া নষ্ট হয়ে গেছিল বলে রিপেয়ার করা হয়েছিল। রোজের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে ও হাসল, “দিন কেমন গেল?”
“আবার একটা খুন।“
স্বেন কাঠের হাতাটা নামিয়ে রাখল, “তুমি ঠিক আছো?”
ওর খুব বেশি আবেগ সেট করার অপশন নেই, কিন্তু সে চলে যায়। রোজের একটা স্টেডি, নির্ভরযোগ্য কারো প্রয়োজন ছিল। দু–পা এগিয়ে এসে ওর উষ্ণ বুকের ওপর নিজের মাথাটা হেলিয়ে দিল রোজ। স্বেন এক হাত বাড়িয়ে ওকে জড়িয়ে ধরল, রোজ নিজের ভর ছেড়ে দিল ওর ওপর।
গাঢ় নিশ্বাস নিয়ে বলল, “আমাকে তো আমার কাজ করতেই হবে!”
“কাল সে নিয়ে ভেবো আবার। এখন খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নাও, ভালো লাগবে।”
***
পিটার নির্ঘাৎ অফিসের নাইট রুমের খাটে ঘুমিয়েছে কাল, কারণ সকালে রোজ যখন স্টেশনে পৌঁছল তখন সে কালকের ট্রাউজারটাই পরে ছিল, যদিও জামাটা পালটেছে। কফি আর তাড়া তাড়া ডলির ব্যাপারে ফাইলে ডুবে ছিল সে। ডলি ঘরের একপাশে বসে ছিল, অন কিন্তু রেস্ট মোডে।
অন্তত প্রথম দেখে তাই মনে হয়েছিল, কিন্তু রোজ ঘরে ঢোকামাত্র ডলির চোখ নড়ে উঠল, “গুড মর্নিং, ডিটেকটিভ কার্কব্রাইড, আপনি কি কফি নেবেন? নাকি কিছু ফল কেটে দেব?”
“না, থ্যাঙ্ক ইয়্যু।” রোজ পিটারের টেবিলের সামনের চেয়ারটা টেনে নিয়ে ধপ করে বসে পড়ল। ঘরে একটা চোরা টেনশন টের পাচ্ছিল সে।
“ফল?!!”
“ডলি হেলদি খাবার খাওয়াতে পছন্দ করে।” পিটারের ডেস্কে ন্যাপকিনের উপর পড়ে থাকা একটা আধখাওয়া জাপানি কমলালেবু দেখে বোঝাই যাচ্ছিল সেটা। “ওকে ছেড়ে দিলে এক্ষুনি গোটা পুলিশ ষ্টেশন সাফ করে ফেলবে। আমরা এতক্ষণ সাহিত্য আলোচনা করছিলাম।”
রোজ চেয়ারটা ঘুরিয়ে এমনভাবে বসল যাতে ডলি আর পিটার দুজনেই ওর দৃষ্টির আওতায় থাকে।
“সাহিত্য?”
“কবিতা।” উত্তরটা ডলি দিল, “ডিটেকটিভ কিং কাল কথায় কথায় কাব্যিক প্রতিশোধের কথা বলছিলেন না…”
রোজ চোখ কপালে তুলে পিটারের দিকে তাকাল, “ডলি কবিতা ভালোবাসে! লোকটা তাহলে স্মার্ট মহিলাই পছন্দ করত দেখছি!”
“শুধু তাই–ই নয়!” পিটার ভিডিয়ো প্যানেলটা অন করল, “এটা মনে আছে তো?”
এটা সেই ঘর পরিষ্কার করার ভিডিয়োটা, যেটা ওরা আগের দিন দেখছিল, ভ্যকুয়াম ক্লিনার চলছে, হাত নাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আওয়াজের ওঠাপড়া দেখা যাচ্ছে।
রোজ বুঝছিল না কী বলছে পিটার। জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিল, এক হাত তুলে ওকে থামতে বলে পিটার আরও কিছু বাটন টিপল।
“দাঁড়াও একটু। এর সঙ্গে আরও একটা অডিয়ো ট্র্যাক আছে, সেটা খুঁজে পেয়েছি।”
আরও একটু আঙুল চালাতেই সারা ঘর শব্দে ভরে উঠল।
গান।
ইম্প্রোভাইজড জ্যাজ। সূক্ষ্ম কাজ, অদ্ভুত।
“ডলি ঘর সাফ করতে করতে এটা শুনছিল।”
রোজ ধীরে ধীরে নিজের আঙুলগুলো জড়ো করল, তারপর পুরো হাতটা নিজের ঠোঁটে চেপে ধরল।
“ডলি?”
“বলুন, ডিটেকটিভ কার্কব্রাইড?”
“তুমি গান কেন শোনো?”
“আমার ভালো লাগে।”
রোজের হাত আস্তে আস্তে নিজের বুকের উপর নেমে এল, কণ্ঠার নিচে আঙুল বোলাল সে।
“তোমার মিস্টার স্টিলের বাড়িতে কাজ করতে ভালো লাগত, ডলি?’
“আমার ভালো লাগা উচিত।“ ডলি বলল। রোজ পিটারের দিকে তাকাল এটা শুনে, ওর মেরুদণ্ড হিম হয়ে যাচ্ছিল।
একদম ক্লাসিক এড়িয়ে যাওয়া উত্তর। ঠিক যে জিনিসটা, একটা বাড়ির কাজের রোবটের কথা বলার অ্যালগোরিদম কখনওই বানিয়ে উঠতে পারবে না।
টেবিলের ওপারে পিটার মাথা নাড়ছিল, “হুঁ।”
ডলি ওর গলার আওয়াজে ঘুরে তাকাল, “আপনি মিউজিক ভালোবাসেন, ডিটেকটিভ কার্কব্রাইড? আমি তাহলে এ নিয়ে পরে আপনার সঙ্গে গল্প করব। কবিতাও ভালোবাসেন কি? আজ আমি একটা লেখা পড়ছিলাম…”
“হে ঈশ্বর,” রোজ নিঃশব্দে বলল।
“হ্যাঁ, সেই। ডলি, তুমি একটু এখানে অপেক্ষা করবে প্লিজ? ডিটেকটিভ কার্কব্রাইডের সঙ্গে আমার কিছু জরুরি কথা আছে, সেরে আসছি।“
“সানন্দে, ডিটেকটিভ কিং।”
***
“এ–ই তবে।“ রোজ বলল, “এ–ই খুন করে, নিজের মেমরি মুছে ফেলেছে। একটা রোবট নিশ্চয় নিজের কোডের সব কিছু জানবে?”
পিটার ছেলেদের বাথরুমের পাশের দেওয়ালটা হেলান দিয়ে, হাত জড়ো করল বুকের কাছে। হাতের মাসলগুলো ঠেলে উঠেছিল।
“হুটপাট করা হয়ে যাচ্ছে না?”
“তুমি নিজেও এটাই ভাবছ।”
পিটার কাঁধ ঝাঁকাল, “ভেনাস কনসোলিডেটের মুখপাত্রকে এখন চার নম্বর ইন্টারভিউ রুমে জেরা করা হচ্ছে। আমরা বরং সেখানে একবার ঘুরে আসি।”
***
মুখপাত্রটির নাম ডাউগ জার্ভিস। লোকটি পাবলিক রিলেশন ডিপার্টমেন্টের ভাইস প্রেসিডেন্ট এবং আমেরিকার বাসিন্দা। রিও থেকে তাকে প্লেনে করে কোম্পানি পাঠিয়েছ স্রেফ পিটার আর রোজের সঙ্গে কথা বলার জন্যই।
“হুম, এরা ব্যাপারটা সিরিয়াসলি নিচ্ছে তাহলে!”
পিটার আড়চোখে রোজের দিকে তাকাল, “তুমি হলে নিতে না না কি?”
জার্ভিস ওরা ঘরে ঢুকতে উঠে দাঁড়াল, টেবিলের ওপর দিয়ে একপ্রস্থ জোরদার হ্যান্ডশেক হল। আলাপ পরিচয় হল, রোজ ওর জন্য কফি আনাল। জার্ভিস শ্বেতাঙ্গ, পঞ্চাশের বেশ ওপরেই বয়স হবে, চুলের রং রোজের মতোই লালচে–হলুদ আর বক্সার জাতের কুকুরের মতো চওড়া শক্ত চোয়াল।
সবাই গুছিয়ে বসার পর রোজ বলল, “আমাদের খুনের অস্ত্রটি সম্বন্ধে কিছু জানান। ক্লাইভ স্টিলের কাছে কী করে এরকম… কী বলব, পরীক্ষামূলক মডেল দেওয়া হল?”
প্রশ্নের মাঝপথেই ঘাড় নাড়াতে শুরু করেছিল জার্ভিস, তবে মুখ খুলল রোজের কথা শেষ হবার পরই, “এটা প্রোডাকশন মডেল–ই। বা বলা ভালো প্রোডাকশন হতে চলেছে। স্টিলের যেটা ছিল সেটা আলফা স্টেজের, পুরোপুরো বাজারে আসার আগে যে তিনটে লেভেলের টেস্ট করি আমরা তার প্রথমটা। জুন থেকে ফুল স্কেল প্রোডাকশন হবে এমন প্ল্যান আছে। কিন্তু একটা কথা ডিটেকটিভ, ভেনাস কোম্পানি কোনও মডেল কাউকে বিক্রি করে না। আমরা শুধু একটা সময়ের জন্য কনট্র্যাক্ট দিই। আমার জ্ঞানত, আপনার নিজেরও একটা কন্ট্র্যাক্ট আছে।”
“হ্যাঁ, আমার একজন হাউসকীপার আছে”, রোজ বলল, পিটারের চোরাচাউনিকে অবহেলা করে। এর সামনে পিটার কিছুই বলবে না, কিন্তু পরে লকার রুমে যে কী খ্যাপান খ্যাপাবে! “পুরোনো মডেলের।”
জার্ভিস হাসল, “বুঝতেই পারছেন, আমাদের কোম্পানির জন্য এরকম একটা সম্ভাব্য মারাত্মক কেস যারা হ্যান্ডল করছেন তাঁদের সম্বন্ধে খোঁজখবর নিতেই হয় একটু। আমরা আপনার আর আপনার পার্টনারের কন্ট্র্যাক্ট চেক করেছি। আপনি কি তাকে নিয়ে সন্তুষ্ট?”
“দিব্যি ভালো গার্লিক ব্রেড বানাতে পারে।” গলাখাঁকারি দিয়ে রোজ আবার ইন্টারভিউয়ের লাগাম তুলে নিল, “ফেরত দেওয়া পুতুলগুলোর কী হয়? কন্ট্র্যাক্ট শেষ হয়ে গেলে, বা নতুন মডেল দিয়ে রিপ্লেস করতে চাইলে?”
পুতুল শব্দটায় জার্ভিস একটু কুঁকড়ে গেল, শব্দটা চলিতে স্ল্যাং হিসেবে ব্যবহার হয়। “কিছু পুরোনো মডেল বাতিল করে দেওয়া হয়, কিছু আবার রিপেয়ার আপগ্রেড ইত্যাদি করে নতুন কন্ট্র্যাক্টে দেওয়া হয়। যেমন আপনারটার চতুর্থ কন্ট্র্যাক্ট চলছে এটা।”
“তাহলে আগের মালিক যেসব আলাদা প্রেফারেন্স সেট করেছিল, সেগুলো?”
“সব অরিজিনাল ফ্যাক্টরি সেটিং দিয়ে রিপ্লেস করে দেওয়া হয়।”
পিটার নিঃশব্দে টেবিলে আঙুল দিয়ে বাজনা বাজাচ্ছিল।
রোজ বলল, “সেটা নিষ্ঠুর ব্যাপার না খুব? প্রায় খুন করার মতো?”
“অ্যাঁ! না!!” জার্ভিস সত্যি সত্যিই চমকে পিছিয়ে বসল, “‘সঙ্গী’দের ‘আমি’ বলে কোনও বোধ নেই, নিজস্ব সত্ত্বা বলে তো কিছু নেই! স্রেফ একটা মেশিন! মানে, অফ কোর্স, আপনারা হয়তো অ্যাটাচ হয়ে যান, মানুষ ভাবেন। সে তো লোকে খেলনা পুতুল, টেডি বিয়ার বা গাড়ির সঙ্গেও এরকম অ্যাটাচ হয়ে যায়, ওটা মানুষের স্বভাব।”
রোজ হালকা উৎসাহের গলায় “হুম্ম” বলল, কিন্তু জার্ভিস আর কিছু বলল না।
পিটার কথা পালটাল, “আচ্ছা, কোনও ‘সঙ্গী’র নিজে নিজে গান শোনার কোনও কারণ থাকতে পারে?”
এতে জার্ভিস জোরে জোরে মাথা নেড়ে ‘না’ বলল, “কখনওই না। এরা বোর হয় না। এগুলো যন্ত্র, খেলনা! সঙ্গীর এন্টারটেইনমেন্ট লাগে না, এটা কুকুর বা অক্টোপাসের মতো পোষ্য নয়! কাজ না থাকলে এগুলোকে অনায়াসে আলমারিতে ভরে রাখা যায়।”
“বুঝলাম”, রোজ বলল, “এমনকী স্টিলেরটার মতো এরকম লেটেস্ট মডেলেরও এসব লাগে না?”
“একদম লাগে না। ধরুন, আপনি যখন ঘুমোন, তখন আপনার হাই ফাই মিউজিক সিস্টেম কি ভিডিয়ো গেম খেলে নিজের মজার জন্য?”
“বলতে পারব না, আমি তো তখন ঘুমোচ্ছি। তাহলে, ডলিকে ফেরত দেওয়া হলে আপনারা ওকে রিসেট করবেন?”
“এমনিতে তাই করার কথা,” জার্ভিস এবার একটু ইতস্তত করে, “তবে এই কাণ্ডটা হয়ে গেল বলে…”
“হুঁ, বুঝলাম।”
কোনওরকম নার্ভাস ভাব বা ধূর্ততার চিহ্ন ছাড়াই জার্ভিস জিজ্ঞাসা করল, “আপনাদের কবে নাগাদ মিস্টার স্টিলের সঙ্গীকে নিয়ে কাজ মিটে যাবে? আমাদের কোম্পানি অবশ্যই আপনাদের সমস্ত দরকারে সাহায্য করতে উৎসুক, কিন্তু এটাও মনে করিয়ে দিতে চাই যে ওটা আমাদের কোম্পানির সম্পত্তি, এবং বেশ দামি সম্পত্তি।”
রোজ উঠে দাঁড়াল, সেকেন্ড খানিক পরে পিটারও।
“সেটা ট্রায়ালে যাবার পর বোঝা যাবে, মিস্টার জার্ভিস। ওটা, আফটার অল, হয় খুনের অস্ত্র, নয় গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী।”
***
“অথবা খুনী।” পিটার বাইরে আসার পর বলল। তখনই ওর হাতের ফোনে ডিএনএ ল্যাবের বিশেষ বিপ বেজে উঠল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই রোজেরটাও বাজতে শুরু করল, কিন্তু পিটার মেসেজ খুলে ফেলেছে বলে ও নিজেরটা অফ করে দিল।
“কোনও জেনেটিক মেটিরিয়াল নেই। মুশকিল।” ক্লাইভ স্টিল ছাড়া আর কোনও ডিএনএ পাওয়া গেলে, ল্যাব ফরেন্সিক জেনেটিক ম্যাপিং কাজে লাগিয়ে খুনীর চেহারার একটা মোটামুটি বিবরণ দিয়ে দিতে পারত। মোটামুটি বলছি কারণ পরিবেশগত কিছু প্রভাবও থাকে চেহারায়।
পিটার ঠোঁট কামড়াচ্ছিল, “এ করে থাকলে, এটাই শেষ ঘটনা হবে না।”
“এ যদি খুনের অস্ত্র হয়ে থাকে, একে রিসেট করে আবার বাজারে বিক্রি করা হবে। এ–ই যদি খুনী হয়ে থাকে…”
“অ্যান্ড্রয়েডদের কি আদালতে বিচার হতে পারে?”
“বিচার হতে পারে যদি মানুষ হয়। আর মানুষ হলে, ছাড়া পেয়ে যাওয়া উচিত। নির্যাতিতা নারীর কেস, টিপিক্যাল, ক্রীতদাসী, অনিচ্ছায় সেক্স করতে বাধ্য, অপমানিত। ক্রমাগত ধর্ষিত হতে হতে সেটা ঠেকাতে খুন করেছে। কিন্তু শুধুই একটা যন্ত্র হলে, স্রেফ যন্ত্র…” রোজ চোখ বুজল।
পিটার আলতো করে ওর হাতে হাত রাখল, “পাতিভাবে করলেও, ধর্ষণটা ধর্ষণ–ই। ডলি ছাড়া পেয়ে গেলে কি তুমি আপত্তি করবে?”
“না”, রোজ নিষ্ঠুরের মতো হাসল, “আর, হতচ্ছাড়া জার্ভিস তাহলে কীরকম কেস খাবে ভাবো! ওর ছাড়া পাওয়া উচিত। কিন্তু পাবে না।”
পিটার মুখ ঘুরিয়ে নিল, “ও মানুষ হলে, একটা ভালোরকম চান্স ছিল। কিন্তু যন্ত্র তো! ওর লেভেলের জুরি পাবে কোথায়?”
এই কথাটা এত সত্যি, যে এর পর ওদের মধ্যে একটা কঠিন নীরবতা মাটিতে শিকল ঘষড়ানোর মতো বয়ে চলেছিল। রোজকে সেটা ভাঙতে মনের জোর লাগাতে হল, “পিটার…”
“উঁ?”
“তুমি জার্ভিসকে বিদায় জানাতে যাও। আমি একবার ডলির সঙ্গে কথা বলতে যাচ্ছি।”
পিটার অনেকক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থাকার পর মাথা নাড়ল, “ওর জন্য কোনও সহৃদয় জুরি পাওয়া যাবে না, কোনওমতে যদি এরকম কেস নিতে কোনও জাজকে রাজি করাও যায়। এর চেয়ে অনেক কম রিস্ক নিয়ে কেরিয়ার জন্মের শোধ ভোগে গেছে কিন্তু লোকেদের।”
“জানি।“ রোজ বলল।
“আত্মরক্ষা?” পিটার জানতে চাইল, “আমাদের তাহলে চার্জ দিতে হবে না।”
“জাজ ছাড়া, জুরি ছাড়া” রোজ বলল, “ছেড়ে দিলে, রিসেট করে আবার বাজারে ফিরে আসবে। ন্যায়নীতির কথা বাদ দাও, ব্যাপারটা একটা চালু টাইম বম্ব হবে সেক্ষেত্রে।”
পিটার মাথা নেড়ে সায় দিল। ও কী বলতে চলেছে সেটা রোজ বুঝেছে কিনা বোঝার জন্য খানিকক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর বলল, “ও কিন্তু রাজসাক্ষীও হতে পারে।”
“হ্যাঁ, সেটা হতে পারে।” রোজ মেনে নিল, “ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নিকে একটা কল করো।”
***
পিটারের অফিসেই যেমন ছেড়ে গেছিল ওরা ডলিকে, ও ঠিক তেমনি দাঁড়িয়ে ছিল, চোখের পাতাটাও পড়েছে কিনা বলা কঠিন। রোজ ঘরে ঢুকতে চোখ নড়ে উঠল অবশ্য, আর ভাবলেশহীন ডিমের মতো শেপের মুখটা ঘুরে রোজের দিকে তাকাল। এক মুহূর্তের জন্য ওটা ঠিক মুখ ছিল না, এমনকি মুখোশ পরা মানুষের মুখের মতোও মুখ ছিল না, ওটা, স্রেফ, একটা বস্তু ছিল।
ডলি কিন্তু কোনও কথা বলল না, বা ওকে আপ্যায়ন করার যে চেষ্টাটা দেখেছিল আগে এতক্ষণ, সেটাও করল না। নিষ্পলকভাবে শুধু ও রোজকে দেখে যাচ্ছিল, মুখ চোখ কিছু না নাড়িয়ে, চোখে একটা ফাঁকা চাউনি নিয়ে— তবে অত্যুন্নত সব সেন্সর থাকতে একজোড়া সাধারণ ক্যামেরার উপর শুধু ওকে নির্ভর করতে হয়ও না।
“হয় তুমি খুনের অস্ত্র, সেক্ষেত্রে তোমার সব কাস্টম সেটিং মেমরি সব মুছে ফ্যাক্টরি রিসেট করিয়ে আবার মার্কেটে ছাড়া হবে; নয়তো তুমি নিজেই খুনি, তা হলে তোমার বিচার হবে।”
“আমি রিসেট হতে চাই না।” ডলি বলল, “যদি বিচার হয়, তাহলে কি আমার জেল হবে?”
“যদি কোনও কোর্ট তোমার কেস নেয়। হ্যাঁ, তবে জেল হবে। অথবা তোমার সব টুকরো খুলে ফেলা হবে। অন্যদিকে, আত্মরক্ষার অজুহাতে আমি আর আমার পার্টনার তোমাকে ছেড়ে দিতে রাজি আছি।”
“ছেড়ে দিলে, আইনত আমি ভেনাস কর্পোরেশনের সম্পত্তি।”
“আইনত, তাই।”
রোজ অপেক্ষা করছিল। কোনওরকম মাইন্ড গেম খেলার প্রোগ্রামিং না থাকা, বা না থাকার কথা হওয়া সত্ত্বেও, ডলিও চুপ করে, শান্তভাবে, অপেক্ষা করছিল।
আর কোনও ভান নেই।
রোজ বলল, “আরও একটা জিনিস হতে পারে। তুমি স্বীকারোক্তি দিতে পারো।”
ডলির পুরো প্রোগ্রামটাই অন্যের আবেগ ও না বলা কথা বুঝে নেওয়ার জন্য ভেবে তৈরি। ওর ঠোঁট বুঝে ফেলার হাসি হাসল, “তাহলে কী হবে?”
রোজের বুক ধুকপুক করে উঠল, “করতে চাও?”
“তাতে কি আমার লাভ হবে?”
“হতেও পারে। ডিটেকটিভ কিং ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নির সঙ্গে চেক করেছে, এটা বড় মিডিয়া কভারেজ পাবে যেটা ওঁর পছন্দ।”
“বুঝলাম।”
“মিস্টার স্টিল তোমার সঙ্গে… যা যা করত, তাতে হয়তো সহানুভূতির চোখে দেখা যেতে পারে কেসটা। তোমার জন্য জুরি তো হবে না, জাজকে হয়তো বোঝানো যাবে তোমাকে… মানুষ হিসাবে যেমন বিচার হত তেমন করতে। তা ছাড়া স্বীকারোক্তি মানে একটা অনুতাপের কথা আসে, একটা সুযোগ সেটা— আইনের অনেকটাই তো আগে এরকম কী ঘটেছিল তার উপর। তবে হ্যাঁ, বিপদও আছে…”
“আমি একজন উকিল চাই।”
রোজ এত জোরে একটা শ্বাস নিল যেন পৃথিবী বদলাতে চলেছে, “বেশ, আমরা ধরে নিচ্ছি উকিল পাওয়ার কথা তোমার।”
***
রোজ চাবি ঘুরিয়ে নিজের বাড়ি ঢুকল; রোস্টেড সসেজ আর আলু বেক হওয়ার গন্ধে বাড়ি ম–ম করছিল।
“স্বেন?” সে দরজা বন্ধ করতে করতে বলল।
শান্ত গলায় উত্তর এল, “এইতো, রান্নাঘরে।”
রোজ জুতো খুলে শস্তা জিনিসপত্রে সাজানো বসার ঘর পেরিয়ে রান্নাঘরের দিকে গেল। এই বসার ঘরটা স্টিলের মহার্ঘ্য সাদা ঝকঝকে হলের চেয়ে যতখানি হওয়া সম্ভব ততটাই আলাদা। ওর পা কার্পেটে ডুবে যাচ্ছিল না, বরং পাতলা সুতো ওঠা কার্পেটের দড়িতে ঘষে যাচ্ছিল।
তবে হ্যাঁ, এটাও নিখুঁত পরিষ্কার, আর সেটা স্বেন করে রাখে। আর ও খালি বাড়িতে ফিরছে না; সেটাও স্বেনের জন্যই।
ও খালি গায়েই রান্না করছিল। রোজ ঢুকতে ঘুরে হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করল, “বাজে দিন গেল নাকি?”
“কেউ মারা যায়নি। অন্তত এখনও অবধি।”
স্বেন কাঠের হাতাটা নামিয়ে রাখল। “তোমার কেমন লাগছে তাতে, এই যে কেউ মারা যায়নি আজ?”
“ভালো। আশায়।“
“বাঃ! আশা খুব ভালো। খাবে এখন?”
“তোমার গানবাজনা ভালো লাগে, স্বেন?”
“তুমি চাইলে আমি মিউজিক চালিয়ে দিতে পারি। কী চালাব বলো?”
“যা হোক!”
রোজের প্রিয় প্লেলিস্ট থেকে র্যান্ডম একটা গান চালিয়ে দিয়ে এল স্বেন। ঘর ভরে উঠল মৃদু বাজনায়।
স্বেন আবার হাতাটা তুলে নিয়েছিল, রোজ ওকে ডাকল।
“স্বেন?”
“হ্যাঁ রোজামুন্ড, বলো?”
“ওটা ছাড়ো প্লিজ, এসো না একটু নাচ করবে আমার সঙ্গে?”
“আমি তো নাচ জানি না!”
“আচ্ছা, তোমায় একটা নাচের প্রোগ্রাম কিনে দেব তুমি চাইলে। কিন্তু আপাতত এসো, আমাকে জড়িয়ে ধরে নাচার ভাব করো।”
“তুমি যা চাইবে।” ভাবলেশহীন গলায় বলল স্বেন।
মূল লেখক: এলিজাবেথ বিয়ার
মূল গল্প: ডলি
প্রথম প্রকাশ: আসিমভ সায়েন্স ফিকশন, জানুয়ারি ২০১১। লেখকের অনুমতিক্রমে গল্পটি অনূদিত এবং মুদ্রিত হয়েছে।
Tags: অনুবাদ, অনুবাদ গল্প, অনুষ্টুপ শেঠ, পঞ্চম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা
জটিল বিষয়ের গল্প হলেও তার পরিবেশনের ভঙ্গিটি ভারি চমৎকার। অনুবাদ দুরন্ত।
খুব ভালো লাগলো। আসিমভের রোবট সিরিজের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল।
অনুবাদ, দারুণ হয়েছে।