অতিউল্কা

  • লেখক: অমিতাভ রক্ষিত
  • শিল্পী: সুমন দাস

মা আআআআআআ…….”

রবিবার। অন্তিমাদেবী বেশ জাঁক করে একটা সুস্বাদু প্রাতরাশ বানাচ্ছিলেন আজকে। নওরোজার চিৎকারে চমকে উঠে খুন্তী হাতেই মেয়ের ঘরের দিকে দৌড় দিলেন তিনি। আজকাল কী যেন হয়েছে নওরোজার। মাত্র নবছরের মেয়ে, ইতিমধ্যেই দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে রোজ! রাতে ভালো করে ঘুমোতে পর্যন্ত পারে না সে, বারবার স্বপ্ন দেখে কাঁদতে কাঁদতে ছুটে আসে ‘বাবামা’র ঘরের মধ্যে।

কী হয়েছে, চেঁচাচ্ছিস কেন? আবার স্বপ্ন দেখলি?”

হ্যাঁ” ফোঁপাতে ফোঁপাতে মাকে জড়িয়ে ধরে নওরোজা।

ঠিক আছে, ঠিক আছে, ও কিছু না। চল্‌, জলখাবার খাবি চল্‌, তোর জন্য পিঠে ভাজছি আজকে।”

নওরোজা চেয়ারে উঠে বসতে সমাপনবাবু বললেন, “কী হয়েছে সোনামণি, আবার বাজে স্বপ্ন দেখলি? আজ সকালেও?”

হ্যাঁ”

সমাপনবাবু মেয়েকে তখন একটু কাছে টেনে আদর করে বললেন, “ওই দেখ্‌, মা আরও পিঠে ভাজছে। তুই ততক্ষণ আমারটা নিয়ে খেতে থাক্‌। মুখ ধুয়েছিস্‌?”

নবকুমারের বয়স এখন এগারো। বোন জগতে আসবার আগে পর্যন্ত বাবামার সবটুকু আদর সে একাই কুড়িয়েছে। কিন্তু নওরোজা আসবার পর থেকেই যেন তার ভাগে একটু ঘাটতি পড়ে গেছে। এই কারণে বোনকে এমনিতে খুব ভালোবাসলেও, বাবা মা তাকে আদর করছে দেখলেই সে হিংসেয় জ্বলে ওঠে। তাই আজকাল একটু সময়সুযোগ পেলে, দুএকটু স্বরচিত ছড়া শুনিয়ে চিমটি কাটতেও ছাড়ে না কোনওমতে।

সে বলে ওঠে, “আবার টেরাডক্‌টিল হয়ে আকাশে উড়েছিস?”

নওরোজা কোনও উত্তর দেয় না, কেবল বেশ বড় করে একটু ভেংচি কেটে দেয় দাদাকে।

নবু টিপ্পনি কাটে—

ডাইনোসরের লেড়কি

ল্যাজ মোটা তাও উড়বি?

ঘুমের ঘোরে আজগুবি

স্বপ্ন দ্যাখে, হাসব কি?”

সমাপনবাবুর ধমক খেয়ে নবু চুপ করে যায়। ব্যাপারটা আর বেশিদূর গড়ায় না। পেট ভরে পিঠে খেয়ে নওরোজার মনটাও ভালো হয়ে যায়।

মা, এবারে একটু পার্কে গিয়ে জোলিনার সঙ্গে খেলতে পারি?”

কালকে হোমওয়ার্ক না থাকলে যেতে পারো, কিন্তু দূরে কোথাও যাবে না। এখন দিনকাল একটু খারাপ যাচ্ছে, দেখছই তো।”

নবু বকুনি খেয়ে একটু গোঁজ হয়ে এতক্ষণ ধরে তার শেষ পিঠেটাই খেয়ে যাচ্ছিল। এবারে নওরোজাকে বেরিয়ে যেতে দেখে সে বলে উঠল—

ধুলোর ঝড়ে নাক বোজা,

মাস্ক পরে না নওরোজা!”

অন্তিমা চেঁচিয়ে বললেন, “এই রোজা, মাস্ক পড়ে যা, খালি মুখে বেরোবি না, আজকে আবার ধুলোর ঝড়টা বাড়তে পারে বলেছে।” কিন্তু কে কার কথা শোনে! নওরোজা ততক্ষণে গেট খুলে রাস্তায়।

সমাপন থেরাপড্‌ চিলেসরাস, অভিজাত “টিরানোসরাস” পরিবারেরই একটি শাখার একজন অতি উজ্জ্বল তারকা। তিনি ইউকাটান পেনিনশুলার চিক্সালুব মহাদেশের বাসিন্দা এবং অতি নামকরা বৈজ্ঞানিক। প্রাকৃতিক ভারসাম্য ও জ্যোতির্বিদ্যাতেই তাঁর পারদর্শিতা। বৈজ্ঞানিক হিসেবে তিনি তাঁর অভিমত বহু বছর ধরেই প্রকাশ করে এসেছেন, কখনও কুণ্ঠা বোধ করেননি। তিনি বারবার বলে এসেছেন, ‘ডাইনোসরেরা যেরকম যথেচ্ছভাবে পৃথিবীর সমস্ত সম্পদ, খনিজ পদার্থ, গাছগাছালি, ইত্যাদি সব কিছু লুঠ করে নিয়ে শুধু নিজেদের ভোগেই লাগাচ্ছে, তার পরিণাম কখনও ভালো হতে পারে না।’ কিন্তু ডাইনোসরেরাই পৃথিবীর শীর্ষ সন্তান। কোটি কোটি বছর ধরে জীবনযুদ্ধে তাদের কেউ টেক্কা দিয়ে উঠতে পারেনি আজ পর্যন্ত। তাই তাদের বাধা দেবারও কেউ নেই। এদিকে ভারসাম্যহীনতার টাল সামলাতে না পেরে বহু প্রাণীই আস্তে আস্তে পৃথিবীর বুক থেকে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। আর শুধু অন্য প্রাণীই নয়, বহু দুর্বল, অপারগ ডাইনোসরের গোষ্ঠিরাও, শীর্ষস্থানীয়দের সঙ্গে সংগ্রামে হেরে গিয়ে, ধীরে ধীরে চোখের সামনে থেকে হারিয়ে গিয়েছে। এ নিয়ে শুধু সমাপন বাবুই নন, সমাজের সব চিন্তাশীলেরাই উদবিগ্ন। পৃথিবীর বহু দার্শনিক, ঐতিহাসিক, বৈজ্ঞানিক, এবং সমাজতান্ত্রিকেরা, একজোটে প্রকৃতিতে এই ভারসাম্যের অভাব নিয়ে চিন্তা প্রকাশ করে আসছেন বহুদিন ধরে।

সম্প্রতি একটা ব্যাপারে নিয়ে সমাপনবাবু এবং অন্যান্য জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা কিন্তু বিশেষ চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। তাঁরা কিছুদিন ধরেই তাঁদের দূরবীণ জাতীয় যন্ত্রগুলো দিয়ে লক্ষ করে আসছেন যে একটা খুব বড় মাপের উল্কা, সজোরে পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছে। পৃথিবীতে উল্কা পড়া অবশ্য নতুন কিছু নয়, লক্ষ কোটি বছর ধরেই মহাকাশ থেকে উল্কা এসে পড়ে এখানে; বেশির ভাগই বাতাসে পুড়ে যায়, বোঝাও যায় না। যেগুলো অবয়বে একটু বড় হয়, সেগুলো মাটিতে এসে পড়ে বটে, কিন্তু খুব বেশি হলে একটু গর্ত হয়ে যায় কোথাও কোথাও। তাই যখন বৈজ্ঞানিকেরা সবাই মিলে বলতে শুরু করলেন যে এই উল্কা কিন্তু সাধারণ উল্কা নয়— এটা একটা অতিউল্কা, এর সঙ্গে ঠিকমতন মোকাবিলা করতে হলে আন্তর্জাতিক সমন্বয়ের প্রয়োজন, তখন সমাজের শক্তিধরেরা সে কথায় কানও দিতে চাইলেন না। অনেকেই বলতে শুরু করলেন, “আরে এটা একটা পাথরের চাঁই বই তো নয়! মাটিতে এসে পড়লেই বা, কী আর হবে! ওই গরীব পাতাখেকো সেলুরোসরগুলো, যারা সবসময় মাঠেঘাটে গাছ খুঁজে বেড়ায়, হয়তো পড়লে তাদেরই কারুর মাথাতে পড়বে। দুএকটা মরবেও হয়তো। কিন্তু মোটা টুপি পরে থাকলে কারুরই বেশি ক্ষতি হবার কথা নয়। বরঞ্চ এই মওকায় টুপি কিছু বেশি বিক্রি হয়ে গেলে তো অর্থনীতির পক্ষে ভালোই। বেশি হইচই করবার কী আছে!”

আজকাল সমাপনবাবুর খাবার টেবিলে বসে এইসব কথা নিয়ে প্রায়ই আলোচনা হয় তাঁদের মধ্যে। সম্প্রতি খুব ধুলোর ঝড় উঠেছে। আকাশবাতাস যেন উলটেপালটে খাবি খাচ্ছে! প্রকৃতি খুবই অশান্ত। কিন্তু কেন যে তা হচ্ছে, সেটা কেউই খুব ভালো করে বুঝতে পারছেন না। সমাপনবাবু মনে মনে সন্দেহ করছেন যে দৈত্যের মতো উল্কাটাই হয়তো এর জন্য কোনওভাবে দায়ী। কিন্তু কাকে কী বোঝাবেন তিনি! মাসখানেক আগে যখন ধুলোর ঝড়টা শুরু হল, তখন তো নেতারা একে গুরুত্বই দিতে চাইলেন না। তারপর ধুলোর পরিমাণ যখন ক্রমে বাড়তে শুরু করল, তখন নিয়ম হল বটে, যে বাইরে বেরোতে হলে মাস্ক পরা বাঞ্ছনীয়, কিন্তু ব্যক্তিস্বাধীনতার কথা ভেবে তা আর আবশ্যক করা হল না।

 

()

আজ পিঠে খেতে খেতে সেইসব কথাই হচ্ছিল। অন্তিমা দেবী বিলাপ করে বললেন, “নওরোজা আজকাল কোনও কথা শোনে না। পই পই করে বলেছি যে কখনও মাস্ক না পরে বাইরে বেরোবি না এত ধুলোর মধ্যে, কিন্তু কে কার কথা শোনে।”

নবু ফুটকি কাটল—

মুখ ঢাকে না, মুখ ঢাকে না,

সুন্দরীরা মুখ ঢাকে না।

মাস্কে নাকি লুকিয়ে যায়

জন্মলব্ধ বিউটি খানা।“

হাঃ, হাঃ, তা কি আর করা, উঠতি বয়সি মেয়ে যে, একটু সচেতন তো হবেই” সমাপনবাবু হেসে সায় দিলেন “সত্যি বলছি, মাস্কের তলায় চাপা পড়ে তো আসল সুন্দর মুখগুলোই আর দেখা যায় না। আমার তো…”

তুমি চুপ কর” অন্তিমা ধমকে উঠলেন “তা বলে ধুলোর মধ্যে মাস্ক না পড়ে বেরোবে! আজকাল এমনিতেই কী জানি কী হয়েছে মেয়েটার…”

আজকে আবার কী স্বপ্ন দেখল?”

সেই একই ধরনের স্বপ্ন, আর কী!”

আকাশে উড়ছে?”

শুধু যে উড়ছে তা নয়, আজকাল সে আবার আরও অন্য কথা বলছে। সে নাকি নীচের দিকে তাকালেই দেখতে পায়, বিষম ঝড়, আগুন, আর বৃষ্টি— আর সে আগুনে পুড়ে, লক্ষ লক্ষ ডায়নোসর মরে পড়ে আছে চারিদিকে। তার মধ্যে নাকি আমরাও আছি সবাই— আমি, তুমি, নবু আর ও নিজেও! এইসব অলুক্ষুণে কথা আমার একদম শুনতে ভালো লাগে না সমাপন! এসব কী কথা বলছে ও? কেন এইসব বলছে তোমার মেয়ে?”

আহা, ঘাবড়ে যাচ্ছ কেন, এ তো শুধু স্বপ্ন! নওরোজাটা বড্ড কল্পনাপ্রবণ, এত নরম মনের মেয়ে। আজকাল ধুলোর ঝড়ে সকলেরই মন খারাপ, চারিদিকে নানারকম ডিপ্রেসিভ কথাবার্তা শুনছে, তাই এসব অনেক কিছু কল্পনা করে ফেলছে। ঝড়টা নেবে যাক একবার, তারপরে সাইকিয়াট্রিষ্ট্রের কাছে নিয়ে যাব ওকে।“

নবু বলল—

ভেবোনা, ভেবোনা, মা,

থেরাপডেরই ছা

সময় বুঝে মেলবে ডানা,

টেরাডক্‌টাল না।”

তুই থাম! যত্ত সব। সমাপন, বাসনগুলো ধুয়ে দাও এবারে, লাঞ্চের ব্যবস্থা করে ফেলি” অন্তিমা রাগ দেখিয়ে উঠে পড়লেন খাবার টেবিল থেকে।

 

()

ঘণ্টাদুয়েক পরের কথা। সমাপনবাবু বিজ্ঞান দপ্তর থেকে জরুরি ফোন পেয়ে দৌড়ে বেরিয়ে গেলেন। বলে গেলেন, “অফিসে গেলাম, যতক্ষণ না আমি ফিরে আসছি, ততক্ষণ আর তোমরা কেউ বাড়ি থেকে বেরিও না আজ। খবর ভালো না।“

অন্তিমা রান্নাঘরের জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখেন, আকাশটা একদম কালো হয়ে গেছে, আর মনে হচ্ছে যেন ঝড়টাও খুব বাড়তে শুরু করেছে। হঠাৎ খেয়াল হল, আরে, নওরোজা তো ফেরেনি এখনও! ভয়ে বুকের মধ্যেটা একেবারে ছ্যাঁৎ করে উঠল তাঁর। কোথায় গেল মেয়েটা!

নবু, শিগগির গিয়ে দেখ্‌, রোজাটা গেল কোথায়! এত দেরি করছে কেন সে। একদম কান ধরে ডেকে নিয়ে আয় বাঁদরীটাকে।”

 

()

নওরোজার মনটা আজ একেবারেই ভালো লাগছে না। জোলিনা খেলতে এল না। বলল, “বাড়ি থেকে বেরোতে দিচ্ছে না।” সন্ধ্যার বাড়িতেও একই কথা। ওর মা বললেন, “ধুলোটা বড্ড বেড়েছে আজ। তুইই বা বাইরে বাইরে ঘুরছিস কেন, বাড়ি চলে যা।” নওরোজা বিমর্ষ হয়ে একা একাই পার্কের দিকে এগিয়ে গেল, কিন্তু সেখানেও গিয়ে দেখে সবকিছু ফাঁকা। কেউ খেলা করতে বেরোয়নি আজ। কিছুক্ষণ নিজে নিজেই দোলনা খেলল সে প্রাণ ভরে। কিন্তু তেমন আনন্দ পেল না তাতে। ভাবল, ‘দূর, একা একা খেলে কী আর মজা হয়!’ আস্তে আস্তে বাড়ির দিকে ফিরতে শুরু করল সে।

কিন্তু যেতে যেতে মাঝপথে এসে, সারা শরীরে কেমনে একটা অস্বস্তি বোধ করতে থাকল সে। কী যেন এক দুর্যোগের পূর্বাভাস, কোনও এক অজানা আশঙ্কা, যেন নির্মমভাবে হাঁ করে তাকে গ্রাস করতে এগিয়ে আসছে। খুব ভয় লাগল তার। কিন্তু তবুও, তার মনের মধ্যে কে যেন গুঞ্জন করে বলে উঠল, ‘আহা কি এই সুন্দর পৃথিবী! দেখ্‌, ওই সবুজ মাঠের পেছনে কেমন শালপিয়ালের ঝাড়।’ নওরোজা থেমে পড়ল। যন্ত্রচালিতের মতো রাস্তা ছেড়ে মাঠের দিকে এগোতে থাকল সে। নরম ঘাসে তার পা ডুবে গেল মখমলের মতো। তাকিয়ে দেখল, দূরে, বড় বড় গাছগুলোর পাতার মধ্যে দিয়ে বইছে বাতাস; ঝোড়ো হাওয়া, কিন্তু তাও যেন মনে হচ্ছে সেটা কোনও এক মায়াবিনী নর্তকীর উত্তাল বিলাস ভঙ্গী! চারিদিকে এত ধুলো, তারও মধ্যে কত বসন্তের নামনাজানাফোটাফুলের ঘ্রাণ, মন মাতিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। কী আকর্ষনীয় মনে হচ্ছে তার এই মাঠটা! আবেগে বিহ্বল হয়ে ঘাসের ওপরে বসে পড়ল নওরোজা। দুই মুঠি ভরে ভরে মাটি নিয়ে, আকাশের দিকে হাত তুলে, ঝুরঝুর করে সেই মাটি বারবার নিজের গায়েমাথায় ছড়াতে থাকল সে। ঘনিয়ে আসুক না আজ আকাশে অন্ধকার, তবু ঈশান কোণ তো এখনও উজ্জ্বল নীল। সেইদিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে বিহ্বল হয়ে গেল নওরোজা। যেন কোন্‌ স্বপ্নের দেশে পৌঁছে গেল সে! কোথায় যেন কোন্‌ অজানা সুরের ঝঙ্কার! কই ধুলো! কোথায় অন্ধকার! এ যে অন্য কোনও এক সুরভিত পৃথিবী; নাজানা আনন্দের মূর্ছনায় চারিদিক পুলকিত। জোরে জোরে পাখনা মেলে ঈশানের নীল আকাশের দিকে উড়ে চলল সে। মনের মধ্যে গুঞ্জন করে উঠল, “এষাস্য পরমঃ গতি, আষাস্য পরমা সম্পৎ”— “হেথা নয়, হেথা নয়, অন্য কোথা, অন্য কোনওখানে।”

তখনই হঠাৎ, নীচের দিকে তাকাতে গিয়ে স্বপ্নভঙ্গ হয়ে গেল নওরোজার। এখন আর আকাশটা দেখা যাচ্ছে না। সামনের দীঘিটার নীল জল, কালো হয়ে গিয়েছে পুরোপুরি। আতঙ্কে চীৎকার করে উঠল রোজা, “না, না, এত অন্ধকার কেন? আমার রঙিন পৃথিবীটাকে ফিরিয়ে দাও শিগগির, এ অন্ধকার সরিয়ে দাও।” চোখে দেখতে না পেলেও, জোর করে নীল রংটা মনে আনবার চেষ্টা করল রোজা। এক অসাধারণ দুঃখ, কোথা থেকে এসে পাথরের মতো ভারী করে দিল তার মনটা। জীবনের যত সুখদুঃখঅবিচার, যা কিছু ভালো, যত কিছু দুর্ভাবনা, আর্তনাদ, সবই যেন এক পলকে ভেসে উঠল তার মনের মধ্যে।

অন্ধকার অপসারিত হল শুধু একটা মুহূর্তের জন্য। আকাশ ভেঙে একটা জ্বলন্ত ধুমকেতু এসে, আছড়ে পড়ল ইউকাটানের মাটিতে। তারপরে যত ভূমিকম্প, উষ্ণ বাতাস, বৃষ্টি, আর অসহনীয় উত্তাপের সৃষ্টি হল, তা অনুভব করবার মতো কেউ আর জীবন্ত রইল না চারিধারে। গভীর অতলে তলিয়ে যেতে যেতে, নওরোজা অনুভব করল শুধু বলিষ্ঠ দুটি পরিচিত বাহু। নবকুমার বলল—

আমার চিরদিনের সাথী,

তোমার কোলেই দুলবে জগৎ,

নতুন হবে সেই সূচনা।

মুক্ত আকাশে, সঙ্গীতে,

ছড়িয়ে দেবে দুই পাখনা।।”

চারিদিকে ছিটিয়ে পড়ে থাকা লক্ষ লক্ষ শবদেহের দিক তাকিয়ে নওরোজা বলে উঠল, “আর এরা?”

আকাশ ভরা বৃষ্টিতে ধুয়ে গেল তার প্রশ্ন। নওরোজা প্রতিবাদে কেঁদে উঠল—

ওগো বৃষ্টি, আমার চোখের পাতা ছুঁয়ো না

আমার এত দুঃখের স্মৃতি, অশ্রুকণা ধুয়ো না।

সময় যেন আবার ফেরে, নতুন করে চেয়ে দেখে,

সেদিন তারা যতই প্রাচীন, কেমন করে বেঁচেছে;

প্রাণের বাঁশি মধুর সুরে, করুন করে বেজেছে।”

 

Tags: অমিতাভ রক্ষিত, পঞ্চম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, ফ্যান্টাসি গল্প, সুমন দাস

2 thoughts on “অতিউল্কা

  • October 28, 2020 at 12:21 am
    Permalink

    বেশ অন্যরকম অনুভূতি হল লেখাটা পড়ে। এস্টেরয়েড হিট করার সময় সরীসৃপেরাও হয়ত আমাদের মতো উন্নত কলোনি গড়ে তুলেছিল। রূপকের মাধ্যমে তাদের সভ্যতার শেষের সেদিন খুব সুন্দর এঁকেছেন। ছোট লেখা, কিন্তু একটা সুন্দর অনুভূতি তৈরি করল।

    Reply
    • October 28, 2020 at 7:09 am
      Permalink

      অনেক ধন্যবাদ, পার্থ বাবু। খুব খুশী হলাম আপনার উৎসাহ পেয়ে।

      Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!