ইউটোপিয়া

  • লেখক: রঙ্গন রায়
  • শিল্পী: রনিন

ভীর রাত।

     শহরের প্রধান টাওয়ার ডিজিটাল ক্লকে রাত দুটোর ডিজিট শো করছে লাল দপদপে আলোয়।

     সারা শহর নিস্তব্ধ হয়ে আছে। প্রতিটি মানুষ এখন গাঢ় নিদ্রায় আচ্ছন্ন। কুকুরগুলোও এই প্রচণ্ড ঠান্ডায় অদৃশ্য হয়ে গেছে। শুধু হ্যালোজেন বাতিরা হলুদ আলো বর্ষণ করে যাচ্ছে অবিরাম। কুয়াশা থাকায় আরও রহস্যময় লাগছে আলোগুলো।

     ঠিক এই সময় কুয়াশার চাদর ভেদ করে দুটো বাইক এসে থামল চৌরাস্তার মোড়ে। আরোহী চারজনের শরীর কালো জ্যাকেটে সম্পূর্ণ ঢাকা। মাথায় টুপি থাকায় তাদের মুখ ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। বাইক থেকে নেমেই তারা ডিকি খুলে বের করে নিল কয়েকটা টিনের ক্যান। তারপর একটুও সময় নষ্ট না করে আশপাশের ফাঁকা দেওয়ালগুলোর দিকে এগিয়ে গেল।

     অতি তৎপরতায় দেওয়ালে তাক করে ক্যানের মাথায় আঙুলের চাপ দিয়ে স্প্রে করতে শুরু করল। চার জনের কারোর মুখেই কোনও কথা নেই। নিস্তব্ধে অতি দ্রুত কাজ করে চলেছে তারা।

     খানিক পরেই দেখা গেল দেওয়ালগুলোয় ভেসে উঠেছে লাল-কালো কালির কতগুলো বাক্য।

     দেওয়াল ভরে উঠতেই তারা আর সময় নষ্ট করল না। আবার বাইকে উঠে বসল। আজ রাতের মধ্যেই শহরের প্রতিটি জনবহুল এলাকায় লেখাগুলো ছড়িয়ে দিতে হবে। অনেক জায়গা এখনও কভার করা বাকি। চারজনের মধ্যে একজন হঠাৎ আবার বাইক থেকে নেমে এলো। তারপর দৌঁড়ে গেল মোড়ের ঠিক মাঝখানের ট্রাফিক পয়েন্টের কাছে। উপরের দেওয়ালের দিকে মুখ তুলে একবার হাসল সে। তার দাঁতগুলো বিদ্রুপে ঝকঝক করছে। এবার তার ডান হাতটা উঠে এল উপরে। মূহূর্তেই ক্যান স্প্রে থেকে বেরিয়ে আসল এক ঝলক কালো কালি। ভরিয়ে দিল সদা সতর্ক সিসিটিভি ক্যামেরার ভার্চুয়াল চোখ।

     বাইকের আরোহীরা চাপা গলায় ডেকে উঠল,

     “তাড়াতাড়ি চল। এসব পাগলামি করে লাভ নেই। অনেক জায়গা এখনও বাকি। রাত শেষ হতে চলল।”

     হাতের আঙুলে লেগে যাওয়া কালির বিন্দুগুলোকে জ্যাকেটের গায়ে মুছতে মুছতে সে দেখল সিসিটিভি ক্যামেরার আড়ালে একটা মাকড়সার জাল। তাতে খানিকটা রং বিন্দুর মতো ঝুলছে। ভোরের শিশির অনেকটা এভাবে ঝোলে। কিন্তু সেই দৃশ্যের সঙ্গে এর তুলনা করা কোনওভাবেই চলে না।

     মুহূর্তেই সে ছুটে চলে এল বাইকের কাছে। বাইকগুলোতে স্টার্ট দেওয়াই ছিল। সে উঠে বসতেই সেগুলো ফুল স্পিডে বেরিয়ে গেল সামনের কুয়াশা মাখা শহরের দিকে।

    

টহলদারি পুলিশের ভ্যানটা যখন সেখানে এসে থামল তখন বাইক আরোহীরা অনেক দূরে এগিয়ে গেছে। এই ফাঁকা রাস্তায় তাদের বাইক পক্ষীরাজ ঘোড়ার মতো উড়ে চলেছে একদম। সবার শেষে উঠে বসা সেই বাইক আরোহীর চোখে মুখে উত্তেজনার চাপা ছাপ। আশপাশের দিকে তাকিয়ে তার একবার মনে হল কয়েক বছর আগে পুরো শহরটাই এই রাতের মতো ছিল।

     সর্বক্ষণ ধুধু ফাঁকা।

     শুধু এই শহরটাই কেন, গোটা পৃথিবীটাই তো ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল মানুষের দোষে।

     আর তারপর …

    

(২)

    

কম্পিউটার স্ক্রিনে কয়েকটা ছবি ফুটে উঠল।

     “স্যার, এই যে, গতরাতে শহরের বিভিন্ন জায়গায় যেসব লেখাগুলো পাওয়া গেছে সেসবের ছবি।”

     ডিস্ট্রিক্ট জেনারেল অভিলাষ বর্মা প্রাইভেট সেক্রেটারির টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলেন। কম্পিউটার স্ক্রিনের ছবিগুলোয় কয়েকটা লেখা দেখা যাচ্ছে। এই লেখাগুলোই নাকি শহরে উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে।

     তিনি মন দিয়ে প্রতিটি লেখা পড়লেন।

     গো ব্যাক ডিক্টেটর। উই ডোন্ট সাপোর্ট ইয়োর ইউটোপিয়ান ওয়ার্ল্ড। লং লিভ সায়েন্স। গড ওয়াজ ডেড।

     ইউটোপিয়া ইজ সেকুলার সোসাইটি। নট ইয়োর রিলিজিন। উই হেট রিলিজিওন। রিলিজিওন কান্ট সেভ

     হিউম্যানিটি।

     লেখাগুলো পড়ে বর্মার ভ্রুযুগল কিঞ্চিৎ কুঁচকে উঠলো। এখনও সেকুলারেরা আছে? সবাইকেই তো নিকেশ করা হয়ে গেছে! এই উগ্রপন্থীরা কোত্থেকে উদয় হল আবার! মানুষকে একটু শান্তিতেও থাকতে দেবেনা এরা!

     “কারা করেছে এ সব দাস!”

     বর্মা বেশ অসন্তোষের সঙ্গেই জানতে চাইলেন।

     “সেটা জানা যায়নি স্যার। তবে খোঁজ চলছে। খুব শিগগিরই পুলিশ খুঁজে বের করবে বলে আশা করা যাচ্ছে।”

     “সিসিটিভি ফুটেজ?”

     দাস একটু মিইয়ে গিয়ে বলল, “স্যার ওরা প্রতিটি সিসিক্যামেরায় কালি ছিটিয়ে দিয়ে ছিল। তার আগের ফুটেজ আছে।”

     অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে বর্মা বললেন, “সেগুলো দেখি। যে কালি দিতে এসেছিল তাকে তো ওখান থেকেই আইডেন্টিফাই করা যাবে।”

     “লাভ নেই স্যার। দেখেছি আমি। ওদের সবার মুখ মাফলারে ঢাকা ছিল। যতদূর জানা গেছে চার জন মিলে বাইকে করে এসে খুব তাড়াতাড়ি এগুলো লিখে চম্পট দিয়েছে।”

     “তাহলে ওদের বাইকের নাম্বার তো পাওয়াই যাচ্ছে। ফুটেজে বাইকের নাম্বার প্লেটে জুম কর। এগুলোও বলে দিতে হবে নাকি!”

     বাস্তবিকই বিরক্ত হয়েছেন তিনি। এত সহজ একটা কেস হ্যান্ডেল করতেও এদের অবস্থা খারাপ হয়।

     দাস কাচুমাচু হয়ে বলে উঠল, “এক্সট্রিমলি সরি স্যার। আমি সেটা আগেই চেক করেছি। বাইকের কোনও নাম্বার প্লেটই ছিল না।”

     “সে কি! নাম্বার প্লেট-হীন বাইক! এতো বেআইনি! যাও যাও খোঁজ লাগাও কার কার বাইকের নাম্বার প্লেট নেই শহরে। এতো কেস আরও সহজ হয়ে গেল। খুঁজে পেতে সুবিধা হবে।”

     “আজ্ঞে স্যার শহরে প্রায় ৪লাখ লোকের বাইক আছে। এতগুলো বাইকের মধ্যে খুঁজে বের করা অসম্ভব স্যার। আর তা ছাড়া আমার মনে হয়…”

     দাস থেমে গেল। তার বলতে সঙ্কোচ হচ্ছে।

     “কী মনে হয়?” বর্মা রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে যাচ্ছেন। যতসব অপগন্ডের দল।

     “আমার মনে হয় ওরা অপারেশনের জন্য নাম্বার প্লেট খুলে কাজে নেমেছিল স্যার। এখন হয়তো আবার লাগিয়ে ফেলেছে।”

     দাস চুপ করে গেল। বর্মাও থেমে গেছেন। সত্যিই এই ব্যাপারটা তিনি ভেবে দেখেন নি। এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। যারা এই ধরনের ক্রাইম করে তারা অত্যন্ত ধুরন্ধর হয়। যদিও তিনিও ধুরন্ধর কম নন। এদের শায়েস্তা করার জন্য অত্যাধুনিক টেকনোলজি তৈরি করা হয়েছে।

     “আচ্ছা দাস, একবার বল তো ওরা কোন কোন জায়গায় এগুলো লিখেছে!”

     দাস সঙ্গে সঙ্গে কম্পিউটার স্ক্রোল করে বের করে আনল লোকেশন ডিটেইলস।

     “এই যে স্যার, লর্ড শিবা স্ট্রিট, শ্রীরাম অ্যাভিনিউ, সেন্ট্রাল স্কোয়ার, টাওয়ার ক্লক মোড়-”

     “ওকে ওকে, ওতেই হবে। ওদের খুঁজে পাওয়া যাবে এবার। তুমি এক্ষুনি ভেঙ্কটেশকে ফোন কর। স্পেশাল টেকনোলজি স্কোয়াড। ক্যুইক!”

     “ওকে স্যার।”

    

(৩)

    

জানালা দিয়ে আলো আসছে।

     চোখ কুচকে বিছানা থেকেই জানালার দিকে তাকালেন সৌত্রিক সেন। তার জানালার পর্দাটা সত্যিই পাতলা। একটু বেলা হয়ে গেলেই পর্দা ভেদ করে আলো ঢুকে পড়ে। শান্তিতে একটু ঘুমোনোর উপায় নেই।

     বিরক্ত হয়ে উঠে বসলেন তিনি। চোখ কচলে ঘড়ির দিকে তাকালেন। ১১টা বেজে গেছে।

     বাথরুম থেকে ঘুরে এসে ফ্রিজ খুলে খাবার বের করলেন। মাইক্রোওভেনে সেটা গরম করতে দিয়ে অ্যান্ড্রয়েডের লেটেস্ট মডেলটি বেড সাইড টেবিল থেকে তুলে নিলেন তিনি। কিছুদিন হল এই মডেলটি লঞ্চ হয়েছে। এর সাহায্যে অনেক কিছু সহজভাবে করা যায়। সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং বিষয়টি হল এর মেমোরি টাইপিং। যা তিনি মনে মনে ভাববেন এই অ্যান্ড্রয়েড সেগুলো সব রাইটিং মোডে নিয়ে আসবে। আর হাত দিয়ে খাটুনি করে লেখার দরকার নেই। এমনকি কিছুদিন আগের ভয়েস টাইপারও এখন পুরোনো হয়ে গেছে। কথা বলার খাটুনিরও প্রয়োজন নেই। লেখকদের কাছে এ এক স্বর্গীয় ইনভেনশন। কত কি ভাবা হয়, অথচ লেখার সময় সেগুলো মাথাতেই আসেনা। এখন আর সে কষ্ট নেই।

     সৌত্রিক ড্রয়ার খুলে জ্যাক পিনটা বের করে আনলেন। এই পিন কপালের পাশে রগের মধ্যে লাগিয়ে জ্যাকটা মোবাইলে লাগাতে হয়। আর তারপরই সেই আশ্চর্য ম্যাজিক!

     মাইক্রোওভেনের যান্ত্রিক কণ্ঠ ঘোষণা করে উঠল, “আপনার খাবার প্রস্তুত হয়ে গেছে। অনুগ্রহ করে গ্রহণ করুন। ধন্যবাদ।”

     সৌত্রিক ডাইনিং টেবিলে এসে বসলেন। খেতে খেতে সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখা যাবে। আজ সকালের ঝাঁঝালো পোস্ট। ম্যাজিকের আড়ালে রিয়েলিটি। এ সমাজের একটা পরিশোধন দরকার। রাষ্ট্র যন্ত্র প্রতিনিয়ত যন্ত্রণা দিয়ে চলেছে অথচ এটাই নাকি সেই ইউটোপিয়া। একটা সুখ শান্তির অপূর্ব সমাজ! দেখা যাক আজকের আপডেট।

     বিশাল বড় অ্যান্ড্রয়েডের স্ক্রিনে আঙুল বোলালেন তিনি। ঢুকে পড়লেন ইন্টারনেটের বিস্তীর্ণ দুনিয়ায়।

    

(৪)

    

এস টি এস। স্পেশাল টেকনোলজি স্কোয়াড।

     লেখাটা বিশাল বড় ডিজিটাল বোর্ডে দূর থেকে দেখা যাচ্ছে। ব্যস্ত শহরের ভীড় রাস্তার ধারে একটা ফুটপাতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে দাস। তার বস মিঃ বর্মা এখানেই পাঠিয়েছে তাকে। এস টি এস। যার মেইন অফিসার ভেঙ্কটেশ নামের লোকটা খুব একটা সুবিধার নয়। সেকুলারদের মানুষ বলেই মনে করে না। পিশাচ শ্রেনীর মানুষ একদম।

     দাস রাস্তা পার হল। এখানে অত্যন্ত ট্রাফিকের কড়াকড়ি। এই জায়গাটা জনবহুলও বটে। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে এই জায়গাটাই আন্দোলনকারীদের চোখ এড়িয়ে গেছে। এখানে রাস্তার মধ্যে ওরা ওই স্প্রে রং দিয়ে ওদের দাবিগুলো লিখলেই পারতো। তাহলে ওদেরও উদ্দেশ্য পূরণ হত আর তাদেরও। এখানে অজস্র সিসিটিভি আর পুলিশের গার্ড। সহজেই ধরা যেত ওদের। এই ঠান্ডার মধ্যে এত খাটুনি পোষায় নাকি!

     দাসের মুখ বিরক্তিতে ভরে উঠল। হাত দিয়ে টুপিটা খুলে একবার চুলগুলো ঘেটে নিলো সে। বহুদিন আগে নাকি শিল্পীরা রাস্তায় গ্রাফিত্তি আর্ট করতো। এখন তো সেসব ছবি হয়ে আছে খালি। বিপ্লবীরা সেই আর্টের মধ্য দিয়ে তাদের প্রতিবাদ জানাতো। অনেক শিল্পীরা মনের কথাটা ছবি দিয়ে লোকের কাছে পৌঁছে দিতো। রাস্তা ঘাট তাতে দেখতে ভালোই লাগত।

     তার ফর্সা মুখে এবার একটা অদ্ভুত এক্সপ্রেশন খেলে গেলো। এখন যা হচ্ছে তাকে রাষ্ট্র ইউটোপিয়ান সোসাইটি বলছে। এখানে খুব আনন্দের সঙ্গে অন্য ধর্মাবলম্বীদের উপর অত্যাচার করা যায়। শুধু একটাই ধর্ম থাকা উচিৎ একটা দেশে, এটাই রাষ্ট্রনেতাদের মত। আর আশ্চর্য ভাবে প্রতিটি লোকও এই ইউটোপিয়ান সোসাইটি গড়ে তুলতে তাই শুরু করে দিয়েছে! সরকার শিল্প, সাহিত্যকে দেশের শত্রু মনে করে। ইতিহাসকে জানলে মন খারাপ হবে বলে ইতিহাস ব্যান করা গোটা দেশে। আর দাসের মতো সাধারণ মানুষেরা তাই মেনে নিয়েছে। বলা ভালো মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে।

     সিড়ি দিয়ে উঠে কখন যে দাস কলিংবেল বাজিয়ে দিয়েছে তা বুঝতেই পারেনি। একটা ঘোরের ভেতর চলে গেছিল সে। ভেঙ্কটেশের সঙ্গে দেখা করতে একদম ইচ্ছে করছেনা। শুধু চাকরির খাতিরে করতে হচ্ছে। মিঃ বর্মা যে কী বুঝলেন ওই লোকেশনের নাম শুনে তা স্বয়ং ঈশ্বরই জানেন।

     “ইয়েস?”

     দরজা খুলে দাঁড়িয়েছে একজন সুন্দরী ওয়ার্কার। এই অফিস একদম সাধারণ ফ্ল্যাট বাড়ির মতো দেখতে বাইরে থেকে। কিন্তু ভেতরে ঢুকলে বোঝা যায় টেকনোলজির কীসব অভূতপূর্ব কারবার হয় এখানে।

     মেয়েটার দিকে তাকিয়ে সৌজন্যসূচক হাসি হেসে নিজের ডিজিটাল কার্ড এগিয়ে দিলো দাস। সেটা একঝলক দেখে মেশিনে চেক করে তাকে ভেতরে ঢোকার জন্য দরজাটা পুরো খুলে দিলো মেয়েটি।

     “ওয়েলকাম স্যার। প্লিজ গো ইনসাইড।”

     দাস ঝাঁ চকচকে চোখ ধাঁধানো স্পেশাল টেকনোলজি স্কোয়াড অফিসের ভেতর প্রবেশ করল।

    

(৫)

    

চেয়ারের পাশের দেওয়ালে মাকড়শাটি দেখে আঁৎকে উঠলেন সৌত্রিক।

     এখন সদ্য সন্ধ্যা নেমেছে। তার ঘর সম্পূর্ণ স্যানিটাইজ করা। পোকামাকড়ের উপদ্রব হওয়ার তো কথা নয়! তাহলে কি আজ ওষুধ স্প্রে করতে ভুলে গেছেন?

     মনে করতে পারলেন না তিনি। ধীরে ধীরে চেয়ার থেকে উঠে বইয়ের তাকের দিকে এগিয়ে গেলেন। মাকড়শাটা এখনও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাক থেকে একটা ভারী বই তুলে ছুড়ে মারলেন তিনি মাকড়শাটাকে লক্ষ্য করে। নিখুঁত লক্ষ্যভেদ। সঙ্গে সঙ্গে চেটকে গেল সেটা দেওয়ালে। দুটো পা আলাদা হয়ে দেওয়ালে আটকে রইল। বাকি দেহটা মেঝেতে কুঁকড়ে পড়ে গেছে। সৌত্রিক এবার এগিয়ে গিয়ে বইটা তুলে নিলেন। বইয়ের গায়ে পোকাটার দেহের রস লেগে আছে। তাড়াতাড়ি বাথরুমে গিয়ে সেটা স্যানিটাইজার দিয়ে ভালো করে মুছলেন তিনি। টিসু পেপারটা ওয়েস্টপেপার বিনে ফেলে আবার এসে দাঁড়ালেন মাকড়শার সামনে। এবার এটার কী ব্যবস্থা করা যায়!

     মাকড়শাটি আকারে বেশ বড়। পাগুলো কেমন রোমশ ধরনের। দেখলেই গা ঘিন ঘিন করে।

     ঘরের কোন থেকে এবার ঝাড়ুটা নিয়ে এসে ওটাকে ঝাড় দিয়ে নিয়ে এলেন ঘরের বাইরে। দরজার পাশে একটা ডাস্টবিন আছে। সেটার সুইচ টিপে দিতেই ডাস্টবিনের উপর থেকে যান্ত্রিক হাত বেরিয়ে এসে মাকড়শাটির দেহাবশেষ তুলে নিজের ভেতরে ভরে নিল। সৌত্রিক একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।

     এখন ঘরটা পরিস্কার করতে হবে। মাকড়শা তার একদম পছন্দ নয়।

     শুয়ে শুয়ে ঘুম আসছিল না সৌত্রিকের। আজ তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছেন তিনি। গতরাতে ঘুমই হয়নি। আজ ভালো করে ঘুমোতে হবে। নয়তো শরীর খারাপ হয়ে যাবে।

     ঘরে একটা হালকা নীল আলোর ডিমলাইট জ্বলছে। জানালাটা কি খুলে দেবেন? গায়ের মোটা ব্ল্যাঙ্কেটটা কেমন যেন গরম ধরিয়ে দিচ্ছে। এই শীতকালে এত গরম লাগছে কেন? আবার উঠে বসলেন তিনি। টেবিল থেকে ঢাকা দেওয়া জলের গ্লাসটা তুলে নিলেন। জল খেলে একটু ভালো লাগবে হয়তো।

     আবার শুয়ে পড়ার পর হঠাৎ তার সেই মাকড়শাটার কথা মাথায় এলো। ওটাকে মেরে যতটা শান্তি পাওয়া গেছিলো সেভাবে যদি এই ডিক্টেটরগুলোকে মারা যেত?

     কিছুক্ষণ পরই সৌত্রিকের মনে হল তার কম্বলের তলে কিছু একটা সুড়সুড় করছে। এবং সঙ্গে সঙ্গে সেই মাকড়শার কথাটা মাথায় আসতেই আতঙ্কে তার চুলগুলো খাড়া হয়ে গেল। গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। সত্যিই কি মাকড়শা ঢুকেছে তার কম্বলের তলে? একই কম্বলের তলে তিনি আর সেই ঘৃণ্য জীবটা?

     লাফিয়ে উঠে বিছানা থেকে নেমে পড়লেন তিনি। তাড়াতাড়ি গিয়ে সুইচ বোর্ডে স্পর্শ করে ঘরের আলোটা জ্বাললেন। উফফফ, এখনও বুকটা ধকধক করছে!

     নিজের শরীরটা একবার ঝেড়ে নিয়ে যখন নিশ্চিত হলেন যে ব্যাটা তার জামায় লেগে নেই, তখন তিনি এগিয়ে গেলেন বিছানার দিকে। এক ঝটকায় কম্বলটা তুলে ফেললেন বিছানা থেকে। নাহ! বিছানায় নেই। কম্বলের মধ্যে লেগে থাকতে পারে। সেটাকে আচ্ছামতো ঝাড়লেন। উহুঁ, কোথাও তো নেই! তাহলে কি ভুল বুঝলেন তিনি! মাকড়শার কথা চিন্তা করতে গিয়ে সেটাকে সত্যি মনে হয়েছে? কিন্তু তিনি যে স্পষ্ট অনুভব করলেন? ওই বীভৎস স্পর্শটা তাহলে কিসের ছিল?

     গোটা ঘর অনেক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে পরখ করে যখন সৌত্রিক নিশ্চিত হলেন তখন একটা শান্তির নিশ্বাস বেরিয়ে এল তার মুখ দিয়ে। কাল রাতের সেই টেনশনের কাজ, ভালো করে না ঘুমোনো, সন্ধ্যার সেই মাকড়শা এইসব কিছু একসঙ্গে হয়ে তার মস্তিষ্কে চাপ সৃষ্টি করেছে। তাইজন্যই ভুল বুঝেছেন তিনি। নিজের মনকে প্রবোধ দিয়ে আবার বিছানায় উঠে বসলেন। তার আগে অনেকটা জল খেয়ে নিলেন।

     এবার নিশ্চয়ই ঘুম আসবে। মাকড়শার চিন্তাটা হয়তো চোখ ধরে আসার সেই পাতলা ঘুমের দুঃস্বপ্ন। এরকম হয়। তেত্রিশ বছর হয়ে গেছে বয়স। এখনও একা একা থাকলে এসব দুঃস্বপ্ন আসাটা স্বাভাবিক।

     শুয়ে শুয়ে সৌত্রিক ভালো ভালো কথা ভাবার চেষ্টা করলেন। এতে ঘুম আসবে তাড়াতাড়ি। কিন্তু সেই দেওয়ালে চেটকে যাওয়ার দৃশ্যটা বারবার ফিরে আসছে। আর আবারও মনে হচ্ছে যে সেই মাকড়শাটা আবার তার ঘরের দেওয়ালে এসে উপস্থিত হয়েছে। শুয়ে শুয়েই এবার তার মুখে নিজের প্রতি বিদ্রুপের হাসি ফুটে উঠল। অনেক দিন আগে সত্যজিৎ রায়ের একটা এরকম গল্প পড়েছিলেন তিনি। একটা লোক যত রকম প্রাণীকে হত্যা করেছিল তারা সবাই এক এক করে তার ঘরে এসে উপস্থিত হচ্ছে। প্রতিশোধ নিতে। সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার পুরো।

     এগুলো পড়ে পড়েই নিজের মাথা খারাপ হয়ে এসব অদ্ভুত কল্পনা করছেন তিনি। ধুর যত্তসব! আচ্ছা কী যেন নাম ছিল গল্পটার?

     নাম ভাবতে ভাবতে একসময় গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলেন সৌত্রিক সেন।

     একটা অদ্ভুত ধরনের আলো চোখে এসে লাগছে।

     সৌত্রিক চোখ খুললেন। এবং সঙ্গে সঙ্গেই আঁতকে উঠলেন তিনি। এটা কার ঘর? চেনা যাচ্ছে না কেন?

     ওপাশ ফিরতে গিয়ে আরও অবাক হয়ে গেলেন তিনি। গোটা শরীরটা কেমন যেন করছে। নড়াচড়া করতে অসুবিধা হচ্ছে। আর বিছানাটা এত বিরাট মাঠের মতো লাগছে কেন? ঘরের দেওয়ালগুলো অনেক দূরে দূরে। ছাদটা প্রায় আকাশের মতো উঁচু। বিষয়টা কী? তার ঘরটা এত বড় হয়ে গেল কী করে?

     সঙ্গে সঙ্গে নিজের দিকে তাকালেন তিনি। একি? হাত পা তো সব ঠিকই আছে। তাহলে? ঘরটা কি সত্যিই বড় হয়ে গেল নাকি তিনিই ছোট হয়ে গেছেন?

     আতঙ্কে ছটফট করে উঠে বসলেন তিনি। কম্বলটাকে একটা বিরাট পাহাড়ের মতো লাগছে। সেটা অনেকটা দূরে পড়ে আছে।

     ঠিক এমন সময় ধ্রাক করে ফ্রান্তস কাফকার গল্পটার কথা মনে পড়ে গেলো তার। গ্রেগর সামসা। এই নামে একজন সেলসম্যান একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে সে একটা বিচ্ছিরি ত্যালাপোকা হয়ে গেছে।

     বড় বড় শ্বাস নিতে শুরু করলেন তিনি। সেই গল্পটা কি সত্যি হয়ে গেলো নাকি? নাকি এটাও স্বপ্ন? কাল রাতে যেমন ওই মাকড়শা… সঙ্গে সঙ্গে আতঙ্কে সারা শরীর তার ঝাকুনি দিয়ে উঠল। এই ছোট শরীরে তিনি ওই বড় মাকড়শার সঙ্গে লড়াই করবেন কীকরে?

     প্রচণ্ড ভয়ে তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে নামতে গেলেন সৌত্রিক। আর পরক্ষণেই পরে গেলেন অতল শূন্যে। ট্রাপিজের খেলোয়ারদের মতো একটা বিরাট জালের ওপর এসে পড়লেন তিনি।

    

(৬)

    

স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছেন বর্মা, দাস, ভেঙ্কটেশ ও আরও কয়েকজন সরকারি কর্মী। সেখানে এখন এক অদ্ভুত দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। যদিও একে এখন আর অদ্ভুত বলা যায় না। সরকারি কাজে এই ট্রিটমেন্ট ব্যবহার করার পারমিশন রাষ্ট্রনায়ক দিয়ে দিয়েছেন। বিশেষত এইধরনের ইন্টেলেকচুয়াল ক্রিমিনালদের জন্য।

     ভেঙ্কটেশ বললেন, “বলুন স্যার, আমার এই সিকিউরিটি সার্ভিস এবং তার সাজা আপনার কেমন লাগল?”

     আনন্দে চোখগুলো চকচক করছে ডিস্ট্রিক্ট জেনারেল অভিলাষ বর্মার। তিনি বললেন,

     “সত্যিই, তোমার জবাব নেই ভেঙ্কটেশ। কেউ কখনও ভাবতে পারবে যে সিসিটিভির আড়ালেই আসল সিসিটিভি লুকিয়ে আছে! তাও অন্য বেশে!”

     “হ্যাঁ স্যার, আমি এমন কিছুই ভাবি যা সাধারণ মানুষের সাইকোলজিতে ফালতু জিনিস বলেই মনে হবে। সিসিক্যামেরার পাশের মাকড়শার জালে কয়েক ফোটা কালি লেগেছিল। সৌত্রিকবাবু ওটুকুই দেখেছিলেন। অন্ধকারের আড়ালে যে এই স্পাইডার বসে আছে তা সে জানবে কী করে!”

     এক নাগাড়ে বলে যাচ্ছেন ভেঙ্কটেশ। দাসের খুব খারাপ লাগছে। কারণ যে শাস্তি সৌত্রিকবাবুকে দেওয়া হয়েছে তা অকল্পনীয় কষ্টের।

     “আমাদের হাইটেক টেকনোলজির রোবো স্পাইডার শুধুমাত্র আই কনট্যাক্টের মাধ্যমে আসল অপরাধী চিহ্নিত করে। কেউ মুখ লুকোতে পারে কিন্তু চোখ ঢাকবে কী করে!” বলে ভেঙ্কটেশ খ্যাকখ্যাক করে হাসতে লাগলেন। “আমরা জানি এই ধরনের বিপ্লবীরা নিজেদের ভীষণ স্মার্ট মনে করে, ভাবে সিসিক্যামেরা নষ্ট করলে বুঝি প্রমাণ লোপাট হয়। হেঁ হেঁ হেঁ, টেকনোলজির এই অপূর্ব উন্নতিতে আসল স্মার্ট যে যন্ত্রই তা তারা ভুলে গেছিলো।”

     “দাস, দেখো, এইজন্যই তোমাকে এস টি এস এ যেতে বলেছিলাম। আমি জানি ওরা শহরের নানা জায়গায় এধরনের বিভিন্ন অদ্ভুত যন্ত্র ইনস্টল করে রেখেছে।”

     বর্মার কথার কোনও উত্তর না দিয়ে দাস কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে তাকালো। সৌত্রিকবাবুর ঘরটা দেখা যাচ্ছে। সমস্ত ঘর মাকড়শার জালে ভরতি। তার মধ্যে একটা পোকার মতো পড়ে আছেন সৌত্রিকবাবু। আর আশপাশ থেকে বিভিন্ন সাইজের মাকড়শা তার দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে।

    

(৭)

    

হাত পা নড়ানো যাচ্ছে না।

     সৌত্রিক যত ছটফট করছেন তত জাল জড়িয়ে যাচ্ছে গায়ে। তিনি বুঝতে পারছেন আর কিছু করার নেই তার। ভাইরাস অ্যাটাকের পর রাষ্ট্র তাকে ঈশ্বরের অভিশাপ এবং তা থেকে মানব সভ্যতার মুক্তিকে ঈশ্বরের আশীর্বাদ বলে চালিয়ে সমস্ত মানুষকে ধর্মের নেশায় বুঁদ করে ফেলেছে। ইউটোপিয়ার নামে এই ধার্মিক সমাজ গড়ার বিরুদ্ধেই তিনি ও তার বন্ধুরা প্রতিবাদ করেছিলেন। ঈশ্বর যারা মানেন না তাদের কোনও অস্তিত্বই থাকবে না, এটা কোনও সমাজ হল নাকি! ভাইরাসের হাত থেকে ঈশ্বর নয়, বিজ্ঞান বাঁচিয়েছিল। কিন্তু তাদের এই আন্দোলন সফল হল না। টেকনোলজির কঠোর সাজায় তিনি এই মুহূর্তে জর্জরিত।

     এখন আর মাকড়শার ভয় লাগছে না তার। কালকের সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্টেও তিনি ম্যাজিকের আড়ালে আসল কথাটা লিখেছিলেন। প্রচুর লাইক লাভ রিঅ্যাক্ট পেয়েছেন। মানে অনেক মানুষের সমর্থন। মানুষ কি সত্যিই তাদের ভুলটা বুঝতে পারবে? তার এখন কান্না পাচ্ছে।

     তিনি দেখতে পারছেন তার ছোট্ট শরীরটার দিকে জাল ধরে ধরে চারদিক থেকে কতগুলো প্রাণী এগিয়ে আসছে। খুব ধীর গতিতে তারা এগিয়ে আসছে। মাকড়শার জালে কোনও পোকা আটকালে যেমন মাকড়শা আর কোনও হুড়াহুড়ি করেনা। জানে শিকার আর ফসকাবে না। এই প্রাণীগুলোরও আটটা করে কালো রোমশ পা। খালি শরীরের জায়গায় লাইক, লাভ রিঅ্যাক্ট, হাহা রিঅ্যাক্টের সমাহার। সোশ্যাল মিডিয়ার ভার্চুয়াল সমর্থন তার দিকে এগিয়ে আসছে। এগিয়ে আসছে হত্যার পৈশাচিক দৃষ্টি নিয়ে।

    

(৮)

    

বর্মা বললেন, “কিন্তু তুমি ওকে এত ছোট বানালে কী করে ভেঙ্কটেশ?”

     “কিছুই না। গতকাল রাতে আমাদের কোম্পানির রোবো স্পাইডারকে ওর ফ্ল্যাটে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। সৌত্রিকবাবু মাকড়শাটিকে হত্যা করেন। কিন্তু আসল মাকড়শার মৃত্যু হলেও রোবোট কখনও মরে না। সে রাত্রি বেলা সৌত্রিকবাবুকে একটা বাইট দেয়। ওই স্পাইডার ম্যানের গল্পের মতো। কিন্তু এখানে স্পাইডারের বাইটে কেউ স্পাইডার ম্যান হয় না। সেই বাইটে সৌত্রিকবাবুর শরীরে একটা ন্যানো চিপ ঢুকে যায়। যা ওর ভিসুয়ালে কাজ করছে। সৌত্রিকবাবুর মনে হচ্ছে যে এই ঘরটা বড় হয়ে গেছে এবং তিনি ছোট। আর আমরা ওই ইনস্টল হওয়া চিপের মেমোরি রিডের ভিসুয়াল মোড অন করে রেখেছি বলে ওর চোখেই ঘরটাকে দেখতে পাচ্ছি এখন। এই এবার দেখুন-”

     ভেঙ্কটেশ একটা সুইচ টিপলেন। সঙ্গে সঙ্গে স্ক্রিনে দেখা গেলো বিছানার পাশের মেঝেতে সৌত্রিকবাবু পড়ে আছেন। তার আশপাশে মাকড়শার জাল। কয়েকটা ছোট ছোট মাকড়শা তার দিকে এগিয়ে আসছে।

     বর্মার নির্দেশে দাস কয়েকজন পুলিশ নিয়ে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল সৌত্রিকবাবুকে গ্রেপ্তার করার জন্য। ভেঙ্কটেশ গদি আটা চেয়ারে একটা শান্তির নিশ্বাস ফেলে হেলান দিলেন। বর্মার ঠোঁটে বিদ্রুপের হাসি। এরা মনে করে সরকার নাকি ইউটোপিয়া সমাজের নামে ধোঁকা দিচ্ছে। মূর্খের দল। তারা নিজেরাই যে এই ইউটোপিয়ার সবচেয়ে বড় বাধা তা কি ওরা নিজেরাও জানে?

     দাস যখন সৌত্রিকবাবুর ফ্ল্যাটে এসে ঢুকল তখন দুপুর বারোটা পার হয়ে গেছে। আজকে ঠান্ডাটা তুলনামূলক ভাবে কম।

     মেঝেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন সৌত্রিকবাবু। ওর মেমোরি টাইপ করেই এখন ওর বয়ান এবং অপরাধ স্বীকার গ্রহণ করতে পারবে সরকার। তার আগের কাজটা রোবো স্পাইডার আইকনট্যাক্টের মাধ্যমে সৌত্রিকবাবুকে আইডেন্টিফাই করে তার বাড়িতে এসে শায়েস্তা করে চলে গেছে। কী ভয়ঙ্কর এই টেকনোলজি! কিন্তু তবুও একটা হাসি খেলে গেলো দাসের মুখে।

     সহকারী পুলিশ অফিসারের কথায় সংবিত ফিরলো তার।

     “স্যার, তাহলে এবার রইলো বাকি তিন। এস টি এসের রোবো স্পাইডার ওই বাকি তিন বদমাইশকেও নিশ্চয়ই শায়েস্তা করবে”

     দাস একটু অন্যমনস্ক ভাবে শুধু বলল, “হু।”

    

(৯)

    

চার মাস পর।

     দূর থেকে কতগুলো বাইক মতকা কুয়ার বাইকের মতো শব্দ করে ধেয়ে আসছে। এখন গরম পড়ে গেছে। রাস্তায় কয়েকটা কুকুর হাত পা ছড়িয়ে শুয়েছিলো। শব্দ শুনে তারা চিৎকার করে উঠলো। বাইকের আরোহীরা এস টি এস অফিসের সামনে এসে বাইক থামিয়েছে।

     প্রত্যেকের শরীরে কালো আলখাল্লা জাতীয় একটা পোশাক। মুখ ও মাথা পাগড়িতে সম্পূর্ণ ঢাকা। তারা নেমেই সঙ্গে সঙ্গে প্রধান সড়কের ওপর স্প্রে রং চালিয়ে দিল।

     রোবো স্পাইডারের চোখে এক এক করে সেভ হয়ে যাচ্ছে লেখাগুলো। কাল নিশ্চিত ভেঙ্কটেশ এগুলো দেখে চমকে উঠবে। চমকে উঠবে দাস এবং অতি অবশ্যই অভিলাষ বর্মাও। উঠবেই। কারণ রাস্তার মধ্যে নানা রঙের ফুলঝুরিতে লেখা হয়ে যাচ্ছে –

    

     উই আর নট ফোর। উই আর ইনফিনিটি।

     দ্যা ড্রিম শ্যাল নেভার ডাই।

    

 

Tags: কল্পবিজ্ঞান গল্প, পঞ্চম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, রঙ্গন রায়, রনিন

6 thoughts on “ইউটোপিয়া

  • October 26, 2020 at 9:38 pm
    Permalink

    চমৎকার কনসেপ্ট। দারুন এক্সিকিউশন। এতো ছোট পরিসরে এমন একটি কনসেপ্ট স্বার্থকভাবে তুলে ধরতে লেখায় মুন্সিয়ানায় থাকা লাগে। লেখক বেশ ভালো ভাবেই কাজটা করেছেন। অনেক শুভেচ্ছা রইল। সেই সাথে এমন লেখার পড়ার প্রত্যাশা।

    Reply
    • October 28, 2020 at 10:58 pm
      Permalink

      অনেক ধন্যবাদ। প্রত্যাশা পূরণের চেষ্টা করবো।

      Reply
    • October 29, 2020 at 8:28 pm
      Permalink

      রঙ্গন, গল্পের ভিতর অসম্ভব এক চকিত আভাস আছে এবং বিদ্রোহের আঙ্গিকে কথোপকথন রয়েছে যা আমার ভাল লাগে। বিকাশ ও নিরবিচ্ছিন্নতার পর্বকেও খুব সুন্দর বুনেছ। গল্প অনুভূতিগ্রাহ্য ও পুঞ্জীভূত অনুরণন তৈরি করতে না পারলে সে আর গল্প কেন? কিন্তু এক্ষেত্রে তা হয়নি। আরেকটা কথা আধুনিকতার আবহ এনেও তুমি অনুভূতিশীলতা ফুটিয়েছ এই গল্পে।

      Reply
      • October 30, 2020 at 12:40 pm
        Permalink

        ধন্যবাদ শানু দা

        Reply
        • October 31, 2020 at 9:59 am
          Permalink

          অসাধারণ কনসেপ্ট আর গল্পের জমাট বুননের জন্য পড়তে খুব ভালো লাগল।

          Reply
          • October 31, 2020 at 12:10 pm
            Permalink

            ধন্যবাদ মুন্নী

Leave a Reply

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!