গ্রেমলিন

  • লেখক: অদ্রীশ বর্ধন
  • শিল্পী: জটায়ু

সাবধান!

এ বাক্সে আছে একটা অত্যন্ত অসাধারণ প্রাণী। তাকে রোদে এনো না। তার গা ভিজিয়ো না। যতই প্যানপ্যান করুক-না কেন, যতই নাকে-কান্না কাঁদুক-না কেন, মাঝরাতের পর তাকে কক্ষনো খেতে দিও না।

    

[‘গ্রেমলিনদের কাহিনি নিয়ে রঙিন সিনেমা হয়েছে, গল্পের ক্যাসেট হয়েছে। গা-ছমছমে অথচ মজাদার সেই কাহিনি নিয়ে এখন উপন্যাস লেখা হচ্ছে।]

    

বিলির জন্যে বিশেষ উপহার

    

ড়দিনে ছেলের উপহার খুঁজতে গিয়ে ফি-বছরই জান কয়লা হয়ে যায় মিস্টার পেল্টজারের। এ-বছর তিনি ঠিক করলেন, এমন জব্বর একটা জিনিস কিনে দেবেন যার তুলনা নেই।

     অর্থাৎ সত্যিকারের বিশেষ উপহার। খুঁজে খুঁজে হাল্লাক হয়ে গেছেন মিস্টার পেল্টজার। শহরের হেন দোকান আর নেই যেখানে তিনি যাননি। সকাল থেকেই খুঁজছেন। এখন ক্লান্ত চরণে এসে ঢুকলেন… একটা কিউরিও শপে।

     কিউরিও মানে হচ্ছে দুর্লভ শিল্পবস্তু। চীনে পল্লির এক কোণে ছোট্ট এই দোকানেও আছে হরেকরকম কিউরিও।

     অন্যান্য দোকানের মতো এ দোকানে তেমন আলোর খেলা নেই। চোখ ধাঁধানো মন টানানো রংচং নেই। কীরকম যেন অন্ধকার-অন্ধকার।

     মিস্টার পেল্টজারের মনটা একটু দমে গেল। কাউন্টারে সাজানো নানারকম মূর্তি। শিল্প সামগ্রী। নাড়াচাড়া করে দেখছেন মিস্টার পেল্টজার। তাঁর ডানপাশে দোকান-মালিকের ছেলে। কাউন্টারের ওপাশে মিস্টার পেল্টজারের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চীনে মালিক। এক গাল সাদা দাড়ি। মাথার সাদা চুল বেজায় লম্বা ঘাড় পর্যন্ত লুটোচ্ছে। মাথায় চৈনিক টুপি। খর্বকায় আকৃতি। মিস্টার পেল্টজারের দশাসই আকৃতির তুলনায় কিছুই নয়।

     বৃদ্ধ মালিক এটা-সেটা দেখাচ্ছে, বোঝাচ্ছে। কিন্তু কোনওটাই মনে ধরছে না মিস্টার পেল্টজারের। বুড়োকে বোঝাতে লাগলেন ঠিক কী ধরনের জিনিস তাঁর চাই।

     কথা বন্ধ হয়ে গেল মাঝপথেই। কেননা, একটা অদ্ভুত কিচমিচ হাসি শোনা গেল দোকানের পেছন দিক থেকে।

     চমকে উঠেছিলেন মি. পেল্টজার। ঘাড় ফিরিয়ে বলেছিলেন, “এ আবার কী? কীসের আওয়াজ?”

     “দেখবেন?” বলেছিল চীনে ছেলেটা।

     “নিশ্চয়।”

     “আসুন।”

     একে তো পুরো দোকানটাতেই অন্ধকার জমে রয়েছে আনাচেকানাচে। সবকিছুই যেন রহস্যে ঘেরা এখানে। তার ওপরে ছেলেটা মি. পেল্টজারকে যেখানে নিয়ে গেল, সেখানটা আরও রহস্যময়।

     দোকানের পেছনে একটা খুদে ঘর। ঘরে রয়েছে একটা বাক্স।

     আলো-আঁধারিতে একটু একটু করে চোখ সয়ে যাচ্ছিল মি. পেল্টজারের। বাক্সের মধ্যে কী আছে দেখতে গিয়েই কিন্তু আঁতকে উঠলেন।

     “সর্বনাশ! এটা আবার কী?”

     “মোগওয়াই,” সংক্ষিপ্ত জবাব চীনে ছেলেটার।

     বিস্ফারিত চোখে বাক্সের মধ্যে চেয়ে রইলেন মিস্টার পেল্টজার।

     চেয়ে চেয়ে দেখলেন কিম্ভূতকিমাকার খুদে প্রাণীটাকে। আশ্চর্য! পুঁচকে জীবটাও যে পিটপিট করে দেখছে তাঁকে।

     হেসে ফেললেন মিস্টার পেল্টজার। ভারী মুখে ঝিকিমিকি দাঁতের চমক দেখেও কিন্তু চমকাল না বিচিত্র প্রাণীপুঙ্গব।

     হাসতে হাসতেই বললেন মিস্টার পেল্টজার, “এটাকেই কেনা যাক।”

     চীনে ছেলের মুখে কথা নেই।

     “একশো ডলার দেব,” উদার প্রস্তাব মি. পেল্টজারের।

     নীরস জবাব ছেলেটার, “মোগওয়াই বিক্রির জন্যে নয়।”

     ভুরু কুঁচকে গেল মিস্টার পেল্টজারের, “বটে! আরও দর চাই?”

     “আজ্ঞে না।”

     “দুশো ডলার দোব। এখনই দিচ্ছি। এই নে,” মানিব্যাগ বের করে নোট বার করতে গেলেন মিস্টার পেল্টজার। না কিনে ছাড়বেন না।

     ছেলেটাও তেমনি। চৈনিক মুখের একটা রেখাও কাঁপল না, কণ্ঠস্বরের উত্থান-পতন ঘটল না।

     বললে, “তা হবে না। মোগওয়াই আর পাঁচটা জন্তুর মতো নয়। কিনলেই হয় না, কেনার সঙ্গে সঙ্গে অনেক দায়িত্ব নিতে হয়। সবার দ্বারা তা সম্ভব নয়। তাই মোগওয়াইকে বেচা হয় না।”

     মহা ত্যাঁদোড় ছেলে তো! রোখ চেপে গেল মিস্টার পেল্টজারের।

     “খুব যে চ্যাটাং চ্যাটাং বুলি ছাড়ছিস! কত দর চাই তাই বল?”

     “কোনও দামেই নয়।”

     অকালপক্ক এই ছোঁড়ার সঙ্গে মাথা গরম করেও লাভ নেই। কাউন্টারে ফিরে এলেন মিস্টার পেল্টজার। বুড়োকে জপাতে গেলেন। কিন্তু বড় কঠিন ঠাঁই।

     মোগওয়াইকে আর কেনা হল না। মুখ চুন করে দোকান থেকে বেরিয়ে এলেন মিস্টার পেল্টজার।

     রাগে ব্ৰহ্মতালু পর্যন্ত জ্বলছে। বেজায় মুষড়ে পড়ার ফলেই রাগটাকে বাগে রাখতে পারছেন না। পুঁচকে প্রাণীটাকে দেখলে তাজ্জব হয়ে যেত বিলি। খাসা উপহার! অপূর্ব উপহার। অতুলনীয় উপহার।

     গাড়ির দিকে পা বাড়ালেন মিস্টার পেল্টজার।

     আহ্বান এল পেছন থেকে।

     “মিস্টার। দাঁড়ান।”

     ঘুরে দাঁড়ালেন মিস্টার পেল্টজার। বুড়োর সেই ডেঁপো ভাইপোটা দাঁড়িয়ে ফুটপাতে।

     হাতে কারুকাজ করা সেই কাঠের বাক্স।

     চোখ কুঁচকে পেল্টজার সাহেব তাকাতেই তড়বড় করে বলে উঠল ছেলেটা, “নিয়ে যান, নিয়ে যান, আপনিই নিয়ে যান।”

     “এখন কেন?” চাহনি শক্ত মিস্টার পেল্টজারের।

     “টাকার দরকার যে। অনেক টাকার। নিয়ম তিনটে কিন্তু মনে রাখবেন।”

     “নিয়ম?”

     “আগে প্রতিজ্ঞা করুন মেনে চলবেন?”

     নাচার ভঙ্গিমায় বললেন মি. পেল্টজার, “ঠিক আছে, ঠিক আছে।”

     “এক নম্বর, আলোর সামনে মোগওয়াইকে কক্ষনো আনবেন না। কক্ষনো না। কেন জানেন? দিনের আলো ওর গায়ে লাগলেই মারা যাবে।”

     “বেশ। তারপর?”

     “দু-নম্বর, জলের ধারেকাছেও ওকে আনবেন না। কক্ষনো না। কক্ষনো না।”

     “বেশ বেশ। তিন নম্বর?”

     “তিন নম্বরটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম।”

     “বলে ফ্যাল।”

     “যতই প্যানপ্যান করুক-না কেন, যতই নাকিকান্না কাঁদুক-না কেন, মাঝরাতের পর ওকে কক্ষনো খেতে দেবেন না। কক্ষনো না। কক্ষনো না।”

     নিয়ম আর শাসনের নমুনা শুনে হেসে ফেললেন মি. পেল্টজার। বাক্সটা হাতে নিয়ে টাকাপয়সা মিটিয়ে দিলেন।

     মনটা ভরে উঠল খুশিতে। এতদিনে মনের মতো একটা উপহার পেয়েছেন ছেলের জন্যে।

     ছোট্ট শহর কিংসটন ফলস-এ কিন্তু বিল বেচারির সারাদিন কাটছে বড় বাজেভাবে।

     সম্প্রতি সে একটা চাকরি জুটিয়েছে স্থানীয় ব্যাংকে। তবে কাজকর্মে তেমন সুবিধে করে উঠতে পারছে না। হাড়ে হাড়ে বুঝছে, গুছিয়ে কাজ করা, সবার মন রেখে কাজ করা চাট্টিখানি কথা নয়।

     ঝামেলার শুরু সকাল থেকেই। ফিটফাট সেজে কাজে বেরোতে যাচ্ছে— বেঁকে বসল বার্নি। বার্নি ওর বড় ন্যাওটা কুকুর। বিলি যেখানে, বার্নিও সেখানে। সুতরাং বিলির সঙ্গে সে-ও যাবে ব্যাংকে।

     সে এক মহা হুজ্জুতির ব্যাপার। সময় বয়ে যায় দেখে, বিলি বললে, “চল তাহলে, ব্যাংকের কাজকারবার একদিন দেখলেই আর ওমুখো হবি না।”

     তারপরেই উৎপাত আরম্ভ করল গাড়িটা, মান্ধাতার আমলের গাড়ি একটু-আধটু বেঁকে বসে, গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে (মানে, এটা-সেটা খুটখাট করে) আবার তাকে চালিয়ে নেয় বিলি।

     কিন্তু সেদিন হতচ্ছাড়া গাড়ি একেবারেই গোঁ ধরে বসল। স্টার্ট দিতেই সে কী কাশি! কেশেই যেন অক্কা পাবে। তারপরেই ঘড়ঘড় করে বেশ কিছুক্ষণ প্রতিবাদ— প্রাণ বুঝি যায় যায়, অবশেযে একেবারেই নিস্তব্ধ।

     অর্থাৎ মৃত্যু হল ইঞ্জিনের। একে বার্নির জন্যে দেরি হয়েছে, তারপরে এই আপদের বাঁদরামি। রাগে ব্রহ্মতালু পর্যন্ত জ্বলে গেল বিলির।

     দুরবস্থা দেখে এগিয়ে এলেন একজন প্রতিবেশী। নাম তাঁর মিস্টার ফাটারম্যান। তুষার সাফ করার গাড়ি হাঁকিয়ে যাচ্ছিলেন পাশ দিয়ে। হেঁকে বললেন, “এগিয়ে দেব?”

     তা-ই তো চায় বিলি। বার্নিকে নিয়ে লাফিয়ে উঠল গাড়িতে। বসল প্রতিবেশী ভদ্রলোকের পাশের সিটে।

     অমনি যেন আপন মনেই বলে উঠলেন মিস্টার ফাটারম্যান, “গ্রেমলিন।”

     “অ্যাঁ?” চমকে উঠেছিল বিলি।

     “গ্রেমলিন।”

     “মানে?”

     “যখনই দেখবে সব গুবলেট হয়ে যাচ্ছে, দায়ী জানবে এই গ্রেমলিন। হেসো না, হেসো না— সিরিয়াস কথা বলছি।”

     তা বিলি একটু হেসে ফেলেছিস বইকী। কোথাকার কে গ্রেমলিন (নাম শুনলেই হাসি পায়), তার জন্যে সবকিছু গুবলেট হতে যাবে কেন?

     মিস্টার ফাটারম্যান কিন্তু আরও গম্ভীর হয়ে গেলেন। গাড়ি চালাতে চালাতে বললেন, “এই যে তোমার চালু গাড়ি নিয়ে হঠাৎ বিভ্রাট, এর মূলে কিন্তু এই অপয়া গ্রেমলিন। মহা কুচুটে, পাজির পা-ঝাড়া। যে কোনও কাজে নাক গলাবেই— সব গোলমাল করে দেবে।”

     ফিকফিক করে হাসতেই থাকে বিলি। সত্যি! কত উদ্ভট ব্যাপারই না গজায় মিস্টার ফাটারম্যানের উর্বর মগজে।

     হাসি দেখে গুম হয়ে গেলেন ভদ্রলোক। বাকি পথটা আর কোনও কথাই বললেন না।

     ব্যাংকে পৌঁছোতে না-পৌঁছোতেই শুরু হল ঝামেলার পর ঝামেলা।

     বেশ দেরি হয়েছে বিলির। কাজেই প্রায় চোরের মতোই পা টিপে টিপে ঢুকল ভেতরে। কাউন্টারের পেছনে চালান করে দিল কুকুরভায়াকে— কেউ যেন দেখতে না পায়।

     চিফ ক্যাশিয়ার কিন্তু দেখে ফেলেছেন বিলির দেরিতে আসা। ভয়ানক কড়া লোক। ঝেড়ে কাপড় পরিয়ে দিলেন বিলিকে সবার সামনেই।

     মুখ গোঁজ করে বসে রইল বিলি। ধাতানি তো খেতেই হবে। এ যে চাকরি!

     কেট মেয়েটির সঙ্গে ওর খুব ভাব। একসঙ্গেই কাজ করে। বিলির মুখের অবস্থা দেখে নিজের চেয়ার ছেড়ে এসে দাঁড়াল ওর পাশে।

     মিষ্টি মুখে চোখে-চোখে তাকিয়ে একটু সমবেদনার হাসি হাসল। তার বেশি না। চিফ ক্যাশিয়ারের চোখ রয়েছে যে এদিকেই।

     কাষ্ঠ হেসে কাজ করে যাচ্ছে বিলি, কিন্তু বেলা বাড়তেই আর এক বিপত্তি।

     এবার সংঘাত লাগল মিসেস ডিগল-এর সঙ্গে। মিসেস ডিগল! ছোট্ট শহর কিংসটন ফলস-এর সব চাইতে অপ্রিয় বাসিন্দা। কেউই তাঁকে দু-চক্ষে দেখতে পারে না।

     ব্যাংকে তাঁকে নিয়ে নিত্য-নতুন ঝামেলা লেগেই থাকে।

     কিন্তু ব্যাংক তাঁকে খাতির করে। করতেই হবে। কেননা, মিসেস ডিগল বেজায় বড়লোক। এ শহরের অর্ধেকের মালিকানা তাঁর। মেজাজ অতিশয় খিটখিটে, কথাবার্তা রীতিমতো ক্যাটকেটে— হাড়পিত্তি জ্বলে যায় দুটো কথা শুনলেই।

     বুড়িরা যদি বড়লোক হয়, তাহলে বুঝি এমনিই হয়। ধরাকে সরা জ্ঞান করে। বিশেষ করে মিসেস ডিগল নামক এই জীবটি। তাঁর ভূসম্পত্তির মধ্যে যারাই বসবাস করুক-না কেন, তাদের প্রত্যেককেই ইনি অতিশয় অনুকম্পার চোখে দেখেন। জমি জায়গা নিয়ে কেউ যদি বিপদে পড়ে, সে জমি ছিনিয়ে নেওয়ার জন্যে উঠে-পড়ে লাগেন। জমি চাই, জমি চাই— আরও জমি চাই! গোটা শহরটার মালিক হতে পারলেই বুঝি তাঁর সাধ মেটে।

     এহেন তিরিক্ষে মেজাজের বৃদ্ধার সঙ্গেই টক্কর লাগল বিলি বেচারির।

     বিলির কাউন্টারের সামনে তখন লম্বা লাইন। যেহেতু টাকার কুমির, তাই মিসেস ডিগল লাইনফাইনের তোয়াক্কা না রেখে গটগট করে এগিয়ে এলেন এক্কেবারে সামনে— বগলে তাঁর একটা তুষারমানবের মুণ্ডু। মানে, খেলনা। সাদা মুখে বিরাট দুটো চোখ। দাঁতের জায়গায় কতকগুলো কালো পাথর বসানো এক লাইনে। নাক বলতে একটা লাল শঙ্কু।

     বিশাল সেই মুণ্ডুকে বুড়ির বগলের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে থাকতে দেখেই দাঁত বের করে হেসে ফেলেছিল বিলি।

     আর যায় কোথায়! এমনিতেই খাপ্পা হয়েছিলেন বুড়ি, এখন দাঁত মুখ খিঁচিয়ে এমন একখানা চিৎকার ছাড়লেন যে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল বেচারি বিলির।

     চেঁচিয়েমেচিয়ে মিসেস ডিগল যা বললেন, তার সারাংশ এই, বিলির প্রিয় কুকুর বার্নি মিসেস ডিগল-এর প্রিয় তুষারমানবকে আঁচড়ে খামচে কামড়ে বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। এটাকে আর মূর্তি বলা যায়? ভেঙেচুরে একশা করেছে। এটা কি কুকুর না কুত্তা?

     ধাতানির চোটে চোখে তখন ধোঁয়া দেখছে বিলি। আমতা আমতা করে বললে, “মিসেস ডিগল, যা বললেন তা শুনলাম। কিন্তু বার্নি আপনার তুষারমানবকে খতম করে দিয়েছে, তা মানতে পারছি না…”

     “কী! আমি মিথ্যে বলছি!” রাগের চোটে প্রায় নাচতে লাগলেন মিসেস ডিগল। বগলের ফাঁকে ধরে রয়েছেন কিন্তু বিধ্বস্ত তুষারমানবকে, “চাই! চাই! চাই! আমি ওই কুত্তাটাকেই চাই! রামধোলাই দেওয়ার পর ওকে আমি ছাড়ব। তারপর ধরব ওর মনিব মহাপ্রভুকে। ল্যাজেগোবরে করে ছাড়ব বলে দিলাম।”

     মিসেস ডিগল-এর কুতকুতে চোখের কুচুটেপনা দেখেই কিন্তু বার্নি খেপেছিল। এখন, যখন দেখল দু-চোখে ক্রোধের ঝিলিক, আর তাকে রোখা গেল না।

     একটি মাত্র লম্বা লাফ মেরে বেরিয়ে এল কাউন্টারের পেছন থেকে এবং রক্তজল করা হুংকার ছাড়ল মিসেস ডিগল-এর দিকে ধারালো দাঁতগুলো এগিয়ে দিয়ে।

     ব্যাস, মুহূর্তের মধ্যে দক্ষযজ্ঞ কাণ্ড বেঁধে গেল গোটা ব্যাংকে।

     মিসেস ডিগল গলার শির তুলে আর্তনাদ করে উঠেছিলেন। এবং বোধ হয় প্রাণের ভয়েই মূর্ছা যাওয়ার ভান করেছিলেন।

     পিলে চমকানো সেই চিৎকার শুনে বার্নি ভড়কে গিয়ে লাফঝাঁপ শুরু করে দিয়েছিল ব্যাংকের এদিক থেকে সেদিকে।

     কাস্টমাররা তাই দেখে কেউ হেসে গড়িয়ে পড়েছে, কেউ স্রেফ গলাবাজি করে গেছে।

     ব্যাপারটা মজার তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু ম্যানেজারমশাই মজা পাননি। মিসেস ডিগল যে বড় দামি খদ্দের! সুতরাং চোখ গরম করে গলা গম্ভীর করে তাঁকে ভারী রকমের একটা ধমক দিতেই হল, “পেল্টজার।”

     “ইয়েস, স্যার।” বিলি বিলক্ষণ কাঁচুমাচু।

     “কুকুর হটাও— এক্ষুনি।”

     “ই-ইয়েস স্যার।”

     “ফের যদি কুকুর নিয়ে অফিসে আসবে তো তোমাকে হটে যেতে হবে। চিরকালের মতো।”

     “ই-ই-ইয়েস স্যার।”

     মনমরা হয়ে বাড়ি ফিরল বিলি।

     সামনেই পেল মা-কে। ঘা-খাওয়া মনটা ককিয়ে উঠল সঙ্গে সঙ্গে, “মা, মাগো, সারাদিন যে কী ধকলের মধ্যে দিয়ে গেল!”

     ছেলের মুখচোখের অবস্থা দেখেই কিছুটা আঁচ করেছিলেন মা। মায়েরা জানে শুধু কথার জাদু দিয়ে মনের ক্ষতে প্রলেপ দিতে হয় কীভাবে।

     নরম সুরে তাই বললেন, “ঠিক আছে রে বাবা, ঠিক আছে। মুখখানা অমন গোমড়া করে থাকিসনি। বাবা তো এখুনি এসে পড়বে।”

     বলতে না-বলতেই দরজায় চাবি ঘোরানোর শব্দ হল। ফিরে এসেছেন মি. পেল্টজার।

     হলঘরে দাঁড়িয়ে চিৎকার ঝাড়লেন মহা উল্লাসে, “কই রে বিলি, গেলি কোথায়?”

     খুশিতে ডগমগ বাবাকে দেখে বিলির মনের ভার নেমে গেল নিমেষে। কিন্তু বাবা প্যাকেট নিয়ে এসেছেন কেন? ওজনের চোটে তো নুয়ে পড়েছেন।

     “কী আছে প্যাকেটে বাবা?” সাগ্রহে শুধোয় বিলি।

     “বড়দিন তো এসে গেল। আগে থেকেই আনলাম তোর জন্য উপহার। নে, নে, খুলে ফেল। ভেতরে যে আছে, তার যে আর তর সইছে না।”

     “কে? প্যাকেটের মধ্যে কে?” বিলি ফেটে পড়ে কৌতূহলে।

     “খুলেই দ্যাখ-না। দাঁড়া, আগে আলোটালোগুলো একটু কমিয়ে দে।”

     বিলি ততক্ষণে পড়পড় করে প্যাকেট ছিঁড়তে আরম্ভ করে দিয়েছে। বাবা আলো কমাচ্ছেন। প্যাকেটের কাগজ খসে পড়তেই ভেতর থেকে বেরিয়ে এল বাক্সটা, টেবিলের ওপর বাক্স রেখে ডালা খুলে ফেলল বিলি।

     প্রথমটা কিছু দেখা গেল না। কাজেই বিলিকে উকি-ঝুঁকি মেরে দেখতে হল ভেতরে।

     ঝকঝকে একজোড়া চোখ দেখা গেল। চোখের পাতা না-ফেলে চেয়ে আছে বিলির চোখের দিকে। নিবিড় কৌতূহল ভাসছে উজ্জ্বল সেই চোখে।

     বিলি হতবাক!

     পরমুহূর্তে থাবা বেরিয়ে এল বাক্সের বাইরে। বাক্সের কিনারা আঁকড়ে ধরে লোমশ মাথাটাকে ওপরে ঠেলে তুলল বিচিত্র প্রাণীটা।

     এবার কিন্তু উত্তেজনাকে আর বাগে রাখতে পারে না বিলি।

     “কী সর্বনাশ! বাবা, এ কে?”

     “মোগওয়াই। এ জাতের প্রাণী আর নেই— এই একটাই।”

     “নামটাও মোগওয়াই?”

     “নাম? ও হ্যাঁ, গিজমো— আমার দেওয়া নাম।” সস্নেহে খুদে প্রাণীটাকে দু-হাতে তুলে বুকের ওপর চেপে ধরে বিলি। খুশি হয় গিজমো। জিভ বের করে চেটে দেয় ওর মুখ।

     সারাদিনের ধকলে মনে কত বোঝাই না চেপে ছিল। গিজমোর জিভের ছোঁয়ায় নিমেষে হালকা হয়ে যায় বিলির মণি। হাসি ফোটে মুখে। আদরের ধমকও দেয় গিজমোকে, “সুড়সুড়ি লাগছে যে!”

     ছেলের মুখে হাসি দেখে হেসে ফেলেন বাবাও। বলেন, “তিনটে নিয়ম কিন্তু অবশ্যই মেনে চলতে হবে।” বলেই গড়গড় করে বলে যান সেই তিনটে নিয়মের বৃত্তান্ত যা তাঁকে শুনিয়েছে চীনে ছেলেটি।

     তক্ষুনি গিজমোকে বুকে চেপে ধরে দোতলায় ছোটে বিলি। যেতে যেতে বলে যায়, “দোতলায় আমার ঘরেই তাহলে থাকুক গিজমো। অন্ধকার ঘর। চাইলেও জল আর খাবার পাবে না।”

     ঘরে পৌঁছোতে না-পৌঁছোতেই শুরু হয়ে যায় হাঁকডাক।

     “গিজমো, এই তোর ঘর। নিজের ঘরের মতোই মনে করিস, বুঝলি?”

     প্রথমটা কিন্তু দ্বিধায় পড়েছিল মোগওয়াই। আগে জুলজুল করে দেখেছিল ঘরের চেহারাটা। তারপর চক্কর দিয়ে এসেছিল ঘরময়। নজরে এসেছিল একটার পর একটা উত্তেজনা-সঞ্চারী বস্তু। নির্নিমেষে এবং সাগ্রহে চেয়েছিল বিলির আঁকা সব ক-টা ছবির দিকে। তারপর একগাদা থ্রি-ডি কমিকস পড়ে ফেলেছিল আগাগোড়া। এরপর গ্যাঁট হয়ে বসে দেখেছিল টিভি চ্যানেল পালটাতে হয় কীভাবে, তাও শিখে নিয়েছিল কয়েক সেকেন্ডেই। বার্নি কুকুর ঘরময় ঘুরে ঘুরে নানা জায়গার গন্ধ শুঁকে শেষমেষ গিজমোকে মেনে নিয়েছে। বাড়ির নতুন জীবকে বার্নির পছন্দ হয়েছে।

     সবচেয়ে চমকপ্রদ ঘটনাটা ঘটল গিজমো গানবাজনা নিয়ে মেতে উঠতেই। ইলেকট্রিক অরগ্যান নিয়ে টুং-টাং করছিল গিজমো। পুঁচকে প্রাণীটার গানবাজনার শখ দেখে মজাই পেয়েছিল বিলি। তারপরেই চক্ষুস্থির।

     টুং-টাং করতে করতে ছোট্ট একটা সুর তুলে ফেলেছে গিজমো। ভারী মিষ্টি সুর। মন জুড়িয়ে গেল বিলির।

     লাল রঙের একটা বিরাট সস্তা টুপি নিয়ে গিজমোর মাথায় বসিয়ে দিল বিলি। বাজনার পুরস্কার।

     আয়না এনে ধরল সামনে।

     কিন্তু এই সব করতে গিয়ে ঘরের আলো কমানোর কথা একেবারে ভুলে মেরে দিয়েছিল বিলি। আয়নায় ঝলসে উঠল একটা আলো— ঝলক ঠিকরে পড়ল গিজমোর দুই চোখে।

     সঙ্গে সঙ্গে তীক্ষ্ণ আর্তনাদ। ধুপ করে শব্দ। গিজমো উলটে পড়েছে পেছনে।

     লাফিয়ে ওঠে বিলি। গিজমোকে বুকে জড়িয়ে ধরে ছুটে যায় বাথরুমে। বিষন্ননয়ন গিজমোর মাথায় আলতো করে বেঁধে দেয় ব্যান্ডেজ।

     রাত হল। বিলি আর গিজমো একই খাটে পাশাপাশি শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল অঘোরে।

    

মোগওয়াইয়ের গুপ্ত রহস্য

    

পরের দিন সন্ধে নাগাদ বিলির সঙ্গে দেখা করতে এল পিটি। বিলির বন্ধু। গিজমোকে দেখে সে তো অবাক!

     “কীরে এটা?”

     “মোগওয়াই। বাবা কিনে দিয়েছে। বড়দিনের উপহার।”

     “ফ্যান্টাসটিক। হাতে নিয়ে দেখব?” হাতে নিতে গিয়েই ঘটল বিপত্তি। ব্যাপারটা এত তাড়াতাড়ি ঘটে গেল যে সামাল দেওয়ার সময়ও পেল না বিলি।

     হাত বাড়িয়ে গিজমোকে কোলে নিতে গেছিল পিটি। হাতের ঠেলায় উলটে গেল জলের বোতল। বিলির রঙের বুরুশগুলো থাকে এই বোতলে।

     ব্যাস! কেলেঙ্কারি কাণ্ড সঙ্গে সঙ্গে।

     সাবধান! সাবধান! বলে চেঁচিয়ে উঠেছিল বিলি। আর সাবধান! জল ততক্ষণে ছলাৎ করে ছিটকে পড়েছে লোমশদেহী মোগওয়াইয়ের সর্বাঙ্গে।

     ভীষণ সরু কিন্তু সাংঘাতিক তীক্ষ্ণ গলায় আর্তনাদ করে চলেছে গিজমো তার শিরদাঁড়া বেঁকিয়ে ফেলেছে ধনুকের মতো।

     “পিটি। করলি কীরে? গিজমোকে ভিজোতে নেই— তিনটে নিয়মের দু-নম্বর নিয়ম…”

     বলতে বলতেই দেখা গেল কাণ্ডটা। অবিশ্বাস্য ব্যাপার। জলের ‘ছ্যাঁকা’ লেগে বড় বড় পাঁচটা ফোসকা দগদগিয়ে উঠল গিজমোর পিঠে আর যেখানে যেখানে জল পড়েছে সেইসব জায়গায়। প্রত্যেকটা ফোসকাই চড়চড় করে ফুলে উঠছে তো উঠছেই। বড় হতে হতে ফট-ফটা-ফট করে ফেটে গেল পাঁচটা ফোসকাই। আর ফেটে যাওয়া ফোসকাদের মধ্যে থেকে পাঁচখানা লোমশ বল ঠিকরে এসে গড়িয়ে গেল টেবিলের ওপর দিয়ে।

     ভয়ে-বিস্ময়ে চেয়ে দুই বন্ধু। বিদঘুটে কাণ্ডর অবসান নেই যে তখনও। লোমশ বলগুলো যে নড়েচড়ে উঠে চলমান হয়ে উঠল।

     অস্ফুট চিৎকার করে উঠেছিল বিলি, “মোগওয়াই হয়ে যাচ্ছে পাঁচটা বলই।”

     ঘটনা তা-ই বটে! সেকেন্ড কয়েক যেতে না-যেতেই পাঁচটা লোমশ বলের জায়গায় দেখা গেল পাঁচটা মোগওয়াই। গিজমোর মতোই লম্বাচওড়া লোমশদেহী। ফিকফিক করে কথা বলে চলেছে নিজেদের মধ্যে।

     ভয়ের চোটে গলা জড়িয়ে গেল পিটির— এ যে দেখছি হুবহু গিজমোর মতোই।

     কথাটা অক্ষরে অক্ষরে ঠিক নয় অবশ্য। হুবহু একরকম দেখতে নয় সব ক-টা মোগওয়াইকে। নবাগতদের একজনের চোখ বড়ই লাজুক। আর এক মুখে হিংস্র হাসি আর পিঠ বরাবর একটা সাদা ডোরা।

     ‘ডোরাকাটা’ নামেই ডাকা যাক একে, ভীষণ অবাক হয়ে দুই চোখ বড় বড় করে বললে বিলি।

     পিটি চলে যেতেই নতুন পাঁচজন মোগওয়াইকে বিছানায় বাক্সের মধ্যে রেখে দিল বিলি। সারাদিন মাছ যেভাবে টিনের মধ্যে ঠেসেঠুসে প্যাক করা থাকে সেইভাবেই শুয়ে রইল পাঁচমূর্তি। অতিশয় শান্তশিষ্ট, যেন ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না। পাঁচজনের নরম শ্বাসপ্রশ্বাসের আওয়াজ শুনতে শুনতে এক সময়ে ঘুমিয়ে পড়ল বিলি।

     জেগে রইল কিন্তু গিজমো। বিলির খাটে উপুড় হয়ে বড় বড় চোখে চেয়ে রইল নবাগত পাঁচ মোগওয়াইয়ের দিকে।

     ঘুম ভাঙল একটা শব্দে। চাপা গলায় কেঁউ কেঁউ করছে বার্নি।

     কিন্তু কোথায় বার্নি?

     আওয়াজ আসছে নীচের তলা থেকে। তরতরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল বিলি। ছুটে গেল সামনের গাড়িবারান্দায়— শব্দের উৎস সেইখানেই।

     থ হয়ে গেল দরজা খুলেই! বিশ্বাস করতে পারল না নিজের দুই চোখকে।

     অবিশ্বাস্য ব্যাপার! বার্নিকে বেঁধে রাখা হয়েছে বড়দিনের আলোর মালা দিয়ে সাজানো গাছে। বাঁধুনির ফলে দম আটকে আসছে, জিভ বেরিয়ে পড়েছে। হাড়কাঁপানো শীতে ঠকঠক করে কাঁপছে।

     তাড়াতাড়ি দড়ি কেটে বেচারাকে নামিয়ে বিলি সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দেখল আর কোথাও জখম হয়েছে কি না। কিন্তু এ কাজ করল কে? কেন?

     নিশ্চয় মিসেস ডিগল! বার্নির ওপর একহাত নেবেন বলেছিলেন বুড়ি।

     তারপরেই কিন্তু মোড় ঘুরে গেল সন্দেহের। বার্নিকে ঘরের গরমে নিয়ে আসার পরেই মনে হল, ওপরতলায় নিরীহভাবে ঘুমোচ্ছ ওই যে পাঁচ-পাঁচটা খুদে মোগওয়াই, কীর্তিটা তাদের নয়তো?

     পরের দিন সকালে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন বিলির মা, “একটায় আপত্তি নেই— কিন্তু ছ-টা! অসম্ভব! অন্য কারও কাছে রেখে আয়।”

     “মাগো, বড় দুষ্প্রাপ্য এই মোগওয়াইরা। দামিও নিশ্চয়। পিটি আর আমি একটাকে নিয়ে যাচ্ছি মি. হ্যানসনের কাছে। উনি তো স্কুলের বায়োলজি টিচার— দেখি-না কী বলেন।”

     বাবা বললেন, “নিয়ে যা ক্ষতি নেই। কিন্তু বেশিক্ষণ রেখে দিসনি। জলের ফোঁটা গায়ে পড়লেই তো সংখ্যায় বাড়তে থাকবে— দু-দিনেই পৃথিবীতে পিলপিল করবে শুধু মোগওয়াই।”

     বিলি আর পিটি যখন এল, মি. হ্যানসন তখন একলাই বসে ল্যাবরেটরিতে।

     সব শুনেটুনে বললেন, “দেখা তোদের আজব প্রাণী।”

     মোগওয়াই দেখেই কিন্তু তাজ্জব হয়ে গেলেন মি. হ্যানসন। এরকম কিম্ভূত প্রাণী দেখবার আশা তিনি করেননি।

     বিস্ফারিত চোখে তাই বলেই ফেললেন, “বলিস কী! চোখের পলক ফেলতে না-ফেলতেই সংখ্যায় বাড়ে। এ যে অসাধারণ কাণ্ড! আশ্চর্য ব্যাপার!”

     “নিজের চোখেই দেখনু-না,” বলে মোগওয়াইয়ের লোমের মধ্যে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে দিল বিলি। সঙ্গে সঙ্গে আবির্ভূত হল একটা ইয়াব্বড় ফোসকা, ফট করে ভেতর থেকে বেরিয়ে এল লোমশ বল। হয়ে গেল আর একটা মোগওয়াই। ভীষণ উত্তেজিত হলেন মি. হ্যানসন।

     বললেন, “রেখে যা। আরও এক্সপেরিমেন্ট করব।”

     “বেশ তো, রাখুন না,” এক কথায় রাজি বিলি— তবে নিয়ম তিনটের কথা খেয়াল রাখবেন। জলের নিয়মটা তো দেখলেনই। আর দুটো নিয়মের একটা হল, আলোর সামনে মোগওয়াইকে কক্ষনো এগিয়ে দেবেন না— বিশেষ করে দিনের কড়া আলোয়। আর, মাঝরাতের পর কক্ষনো খেতে দেবেন না মোগওয়াইকে। কক্ষনো না… কক্ষনো না।

     বাড়ি ফিরে চক্ষু স্থির হয়ে গেল বিলির।

     এ কী কাণ্ড করেছে মোগওয়াইরা। বেশ জাঁকিয়ে বসেছে বোঝাই যাচ্ছে। লন্ডভন্ড ঘরের সব কিছু। গুছোতেই জান কয়লা হয়ে যাবে। কতদিন যে লাগবে, তাও বোঝা যাচ্ছে না। নবাগতদের দুষ্টুমি সামলাতে গিয়ে গিজমো বেচারাকে হিমসিম খেতে হয়েছে, নিশ্চয় বিলিকে দেখেই যেন স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বাঁচল।

     টিভি দেখতে বসেছে বিলি, পাঁচ মোগওয়াই কিউমিউ শুরু করে দিল একই সঙ্গে— অর্থাৎ খিদে পেয়েছে, খাবার চাই।

     বিলি তো অবাক! পুঁচকে পুঁচকে ওই তো শরীর— পেটের সাইজ তো বোঝাই যাচ্ছে— এত খাবার খায় কী করে? এই তো একঘণ্টা আগে পেট ঠেসে গেলানো হয়েছে প্রত্যেককে।

     কিন্তু নাছোড়বান্দা পেটুকদের দাবি না মিটিয়েও পারল না বিলি। ইলেকট্রিক ঘড়িতে সময়টা দেখে নিল রাত ১১-৪০ মিনিট। মাঝরাত এখনও হয়নি। তার আগে আর এক দফা খাওয়ানো যেতে পারে।

     ফ্রিজ খুলে নিয়ে গেল ঠান্ডা মুরগির মাংস। মহালোভে গপাগপ তাই খেয়ে নিল মোগওয়াইরা, গিজমো বাদে। তার চোখ তখন ঘুমে জুড়ে আসছে। দাঁতেও কাটল না মুরগির মাংস।

     পরের দিন সকালে যখন ঘুম ভাঙল বিলির, ঘর অস্বাভাবিক শান্ত।

     টনক নড়ল তৎক্ষণাৎ। নিশ্চয় অঘটন কিছু ঘটেছে। তাকাল ঘড়ির দিকে ১১-৪০ মিনিট।

     এখনও এগারোটা চল্লিশ! অসম্ভব! ঘড়ি খামচে ধরল, ঝাঁকি দিল বারকয়েক। ঘড়ির কাঁটা আটকে রইল এগারোটা চল্লিশেই।

     তারের দিকে নজর গেল তারপরেই, চিবিয়ে কেটে দেওয়া হয়েছে ইলেকট্রিক ঘড়ির তার।

     গিজমোই বা এরকম চাঁচাছোলা গলায় আতঙ্ক-চিৎকার করে যাচ্ছে কেন হঠাৎ?

     মেঝের দিকে তাকিয়েই বিলি স্তম্ভিত। আঁশওলা বড় আকারের পাঁচটা শুঁটি এল কোত্থেকে? মটর শুঁটির গায়ে যেমন খোসা লাগানো থাকে। এদের গায়েও রয়েছে তেমনি খোসা— তবে চটচটে আঠালো খোসার আঁশওলা জীবগুলো যেমন কদাকার তেমনি কিম্ভূতকিমাকার!

     গায়ে কাঁটা দেয় বিলির। মনে পড়ে যায় রাত্রে খাওয়ানোর ব্যাপারটা। তারই দোষে ঘটল এই কাণ্ড! ঘড়িতে দেখেছিল এগারোটা চল্লিশ। ভেবেছিল রাত বারোটা তো এখনও হয়নি।

     কিন্তু ঘড়ির তার কাটা হয়েছিল এগারোটা চল্লিশেই— খাইয়েছিল তাদের বারোটার পর।

     তাই মোগওয়াইদের এহেন অসম্ভব রূপান্তর। নীচের রান্নাঘর থেকে ভেসে এল মায়ের চিৎকার, “বিলি, আর ঘুমোসনি— অফিসে যেতে আবার দেরি হবে।”

     মহা ভাবনায় পড়ল বিলি। মায়ের কাছে মোগওয়াইদের চেহারা বদলের খবরটা আনা যায় কীভাবে? চেঁচিয়ে পাড়া মাত করবে যে শুনলেই! দুশ্চিন্তার অবসান ঘটালেন কিন্তু বাবা। বাবা যে এত সহজভাবে ব্যাপারটাকে নেবেন, বিলি তা ভাবতেই পারেনি। অদ্ভুত বৃত্তান্তটা শুনে তিনি শুধু বললেন, “যা, অফিসে যা, আবার কিছু ঘটলে ফোন করে জানাব।”

     ব্যাংকে কিন্তু ফোন এল মি. হ্যানসনের।

     “বিলি, কাল রাতে আমি ঘুমোনোর পর একটা স্যান্ডউইচ চুরি করে খেয়েছিল মোগওয়াই। এখন তো দেখছি বেটা গুটিপোকার মতো খোসামোড়া অবস্থায় এসে ঠেকেছে। খোসা ফেলে কী আবার নিয়ে বেরোবে, ভাবতেও পারছি না।”

     “কাজ শেষ করেই স্কুলে যাচ্ছি।” বলে টেলিফোন নামিয়ে রাখল বিলি।

     মাথায় দুর্ভাবনার বোঝা! এসব কী ঘটাচ্ছে পুঁচকে প্রাণীগুলো?

    

গ্রেমলিনরা হানা দিল

    

শীতের রাত দ্রুত ঘনিয়ে আসে। বিলি যখন স্কুলে গিয়ে পৌঁছোল তখন আকাশ বেশ কালো। ক্লাসরুম আর করিডর খাঁ-খাঁ করছে। বাতাস পর্যন্ত থমথমে। ঘাবড়ে যায় বিলি। চটপট পা চালায় ল্যাবরেটরির দিকে।

     রক্ত জল হয়ে যায় সেখানকার দৃশ্য দেখে। খোসাভাঙা বাদামের মতো ভেঙে চৌচির গুটিটা। রক্তগঙ্গার মধ্যে মেঝেতে পড়ে মি. হ্যানসন। নিথর। নিস্পন্দ।

     খুব ক্ষীণ খচমচ খচমচ আওয়াজ আসছে কোত্থেকে। উৎকণ্ঠায় কাঠ হয়ে যায় বিলি। পা টিপে টিপে প্রাণটাকে যেন মুঠোর মধ্যে নিয়ে পৌঁছোয় টেবিলের ধারে— হাত বাড়ায় টেলিফোনের দিকে।

     সাঁত করে কী যেন সরে যায় ছায়ামায়ার মধ্যে। কোপ দেওয়ার ভঙ্গিমায় একটা থাবা ধেয়ে আসে ওর হাতের দিকে।

     চোখের কোণ দিয়ে দেখামাত্র পেছনে ঠিকরে আসে বিলি। সভয়ে তাকায় বিভীষিকাটার দিকে।

     সারা গায়ে তার বড় বড় আঁশ। দানবিক আকৃতির ভয়াবহ এক প্রাণী জ্বলন্ত ক্ষুধিত চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে।

     মরিয়া হয়ে যায় বিলি। প্রাণের মায়ায় তাকায় আশপাশে যে কোনও একটা হাতিয়ারের জন্যে। একই সঙ্গে মাথার মধ্যে উত্তাল হয়ে ওঠে একটা চিন্তা…

     মা! পাঁচ-পাঁচটা এই ধরনের দানব-প্রাণীকে নিয়ে মা একা রয়েছে বাড়িতে।

     বিলির বাড়িতে দোতলার ঘরে ঠিক এই সময়ে কী ঘটছে?

     ফট করে শব্দ হল। সবচেয়ে বড় গুটির খোলস চৌচির হয়ে গেল ভেতরকার চাপে। বেরিয়ে এল ‘ডোরাকাটা’— চেহারা বদলে গেছে একেবারেই। সেই নরম নরম লোমশ চেহারা আর নেই। সারা গা ঢেকে গেছে কদাকার আঁশে। ধারালো ক্ষুরের মতো সারি সারি দাঁত খিঁচিয়ে মরণকামড় দেওয়ার জন্যে তৈরি। দীর্ঘ বাহু বাড়িয়ে ধরেছে আড়মোড়া ভাঙার ভঙ্গিমায়, মুঠোয় ঝকমক করছে বিশাল থাবার কুটিল নখ!

     ক্রুরলোহিত দুই চোখের রক্ত-দ্যুতিতে গোপন নেই আর অশুভ অভিলাষ। মোগওয়াই সে ছিল এককালে— এখন আর নেই। বিকট চেহারাতেই প্রকট হয়েছে তার প্রকৃত পরিচয়।

     গ্রেমলিন… গ্রেমলিন… এখন থেকে সে গ্রেমলিন!

     অতিভীষণ, অতিকুটিল, অতিহিংস্র গ্রেমলিন। ধ্বংসই যার একমাত্র লক্ষ্য।

     ফট-ফটাৎ শব্দে অন্য চারটে গুটিও ফাটতে শুরু করেছে তাকে ঘিরে।

     ইতিমধ্যে টেলিফোনের রিসিভার পাকড়ে ধরেছিল বিলি। ডায়াল করে চলেছে উন্মাদের মতো। ভীত-ত্রস্ত চোখ ঘুরছে আশপাশে। পুঞ্জীভূত আতঙ্ক প্রকট হয়েছে দুই চোখে। খুনে গ্রেমলিনকে সে খতম করেছে। কিন্তু…

     পাওয়া গেল লাইন। ওদিকে মা তুলেছে রিসিভার।

     “মা?”

     “হ্যাঁরে।”

     “বেরিয়ে যাও বাড়ি থেকে— এক্ষুনি। গুটিগুলো ডিমের মতো ফাটছে দানব বেরিয়ে আসছে ভেতর থেকে। স্কুল থেকে কথা বলছি— এখানেই এসেছিল একটা— ভয়ংকর… পালাও… ভীষণ বিপদ…”

     লাইন কেটে গেল। মরা টেলিফোন। নেই কোনও শব্দ। বিদ্যুৎবেগে ঘুরে দাঁড়ালেন মিসেস পেল্টজার।

     কী দেখলেন? আচমকা গ্রেমলিনরা হানা দিয়েছে রান্নাঘরে— পিলপিল করছে ঘরময়… ডিস, বাটি, প্যান তুলে ছুড়ে মারছে তাঁকে… সামনে খাবারদাবার যা পাচ্ছে, তাই টপাটপ করে তুলে নিয়ে গিলছে গপাগপ করে।

     বিষম আতঙ্কে প্রথমে পিছু হটে এসেছিলেন ভদ্রমহিলা। শেষকালে পিঠ ঠেকল দেওয়ালে। তখনও দমাদম ঝনঝনঝন শব্দে প্লেট গেলাস বাটি আছড়ে পড়ছে তার আশপাশে দেওয়ালে আর মেঝেতে।

     মাথার রক্ত চড়ে যায় এবার। পাঁচ-পাঁচটা বিকট গ্রেমলিন আচমকা চড়াও হতে ঘাবড়ে গেছিলেন ঠিকই, কিন্তু সামলে নিয়েছেন এবারে। একটা গ্রেমলিন এগিয়ে এসেছিল খুব কাছে।

     খপাত করে টেবিল থেকে ছুরিটা তুলে নিলেন মিসেস পেল্টজার— কোপ মারলেন আগুয়ান আতঙ্ককে লক্ষ করে। নির্ভুল মার। ছুরির ফলা ফদাফাঁই করে দিল গ্রেমলিন-এর আঁশওলা দেহ।

     আর একটা বিকটদেহী মিক্সার যন্ত্রের মধ্যে ঢুকে বসেছে দেখেই সুযোগটাকে ঝটিতি কাজে লাগালেন মিসেস পেল্টজার। ছিটকে গেলেন বোতামের দিকে। কানফাটানো শব্দে ঘুরে গেল মেশিনের ব্লেডওলা চাকা এবং চোখের পলকে গ্রেমলিন মহাপ্রভুকে টেনে নিল ঘূর্ণমান চক্রের মধ্যে। অর্থাৎ মূর্তিমান ধ্বংস। নিজেই টুকরো টুকরো হয়ে গেল নিমেষের মধ্যে।

     দাঁত কিড়মিড় করে ওঠে মিসেস পেল্টজারের, “জন্মের শিক্ষা দেব তোদের। আমার রান্নাঘর তছনছ করার এই হল তোদের শাস্তি।”

     বলতে বলতেই ছোঁ মেরে তুলে নিলেন ‘এরোসল’। পুরোদমে স্প্রে করে দিলেন আর একটা গ্রেমলিনের দিকে… সে ব্যাটাচ্ছেলে চোখে অন্ধকার দেখতে দেখতে পেছিয়ে গেল মাইক্রোওয়েভের দিকে। সঙ্গে সঙ্গে দড়াম করে পাল্লা বন্ধ করে পুরো আঁচে উনুন চালিয়ে দিলেন মিসেস পেল্টজার!

     বিলি যখন বাড়ি ফিরল হন্তদন্ত হয়ে, মা তখন বড়দিনের জন্যে আলোর মালা দিয়ে সাজানো গাছের ধ্বংসাবশেষ নিজেই জড়িয়েমড়িয়ে একশা হয়ে আছেন— মরিয়া হয়ে লড়ে চলেছেন আর একটা গ্রেমলিনের সঙ্গে।

     দৃশ্যটা দেখামাত্র বিলির মাথায় যেন আগুন ধরে গেল। অদূরে দেওয়ালে ঝুলছিল একটা তলোয়ার। দৌড়ে গিয়ে সেটা এনেই এক কোপ মারল হানাদার গ্রেমলিনের গলা লক্ষ করে।

     মুণ্ডুখানা আলাদা হয়ে খসে পড়ল ধড় থেকে।

     কিন্তু এখনও পুরোপুরি খতম হয়নি গ্রেমলিন বাহিনী। বসবার ঘর তছনছ করে বেড়াচ্ছে ‘ডোরাকাটা’। বিলিকে তলোয়ার হাতে ধেয়ে আসতে দেখেই লুকিয়ে পড়েছিল বটে, পরক্ষণেই বিরাট লাফ মেরে বেরিয়ে গেল খোলা জানলা দিয়ে। খচমচ শব্দে মিলিয়ে গেল রাতের অন্ধকার।

     আগে মাকে নিরাপদে রাখা দরকার— তারপর গ্রেমলিন-নিকেশ পর্ব!

     পাড়ার একজনের বাড়িতে ঠাঁই হয়ে গেল ক্ষতবিক্ষত মায়ের। ‘ডোরাকাটা’র সন্ধানে দৌড়োল বিলি। সঙ্গে নিল গিজমোকে একটা থলির মধ্যে। পথে পুরু হয়ে পড়েছে তুষার— আশপাশ থেকে কানে ভেসে আসছে ছোট্ট ছেলেমেয়েদের গলায় বড়দিনের গান।

     বিলি তুষার-ছাওয়া রাস্তা মাড়িয়েই ছুটছে আর ভাবছে, ভাগ্যিস জমাট জলে ব্যাটাদের গায়ে ফোসকা পড়ে না। নইলে এতক্ষণে যা ঘটত, ভাবাই যায় না। ‘ডোরাকাটা’র পায়ের ছাপ সুস্পষ্ট রয়েছে তুষারের ওপর। তাই দেখেই ছুটছে বিলি। পায়ের ছাপ ঢুকে গেছে একটা গলির মধ্যে। বিলিও ঢুকল গলির মধ্যে।

     কিন্তু এই গলির শেষেই রয়েছে জিমন্যাসিয়াম! সুইমিং পুলটাও রয়েছে এই জিমন্যাসিয়ামে। ‘ডোরাকাটা’ শয়তান ভিজে গেলেই যে সর্বনাশ! পলকে পলকে বেড়ে যাবে সংখ্যায়। শয়ে শয়ে একই বিকটাকার দানব ধেয়ে যাবে শহরময়।

     আলো নেভাতে হবে সবার আগে। অন্ধকার করে দিতে হবে ব্যায়ামাগার। নক্ষত্রবেগে তাই লাইট সুইচ-এর বাক্স লক্ষ করে ছুটে যায় বিলি। কিন্তু… ‘ডোরাকাটা’র মগজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্যাঁচোয়া বুদ্ধি। সুইচবক্সের মধ্যেই ঢুকে বসেছিল সে এতক্ষণ। বাক্স লক্ষ করে বিলি লাফ মারতেই দংষ্ট্রা দেখিয়ে তেড়ে এল বিলির দিকেই এবং থতমত বিলিকে পাশ কাটিয়ে ছিটকে গেল সুইমিং পুলের দিকে।

     ঘুরে গিয়ে বিলিও ছুটল সেদিকে। কিন্তু অত জোরে ছুটেও নাগাল ধরতে পারল না ‘ডোরাকাটা’র, শুধু শুনতে পেল ঝপাং শব্দটা।।

     জলে ঝাঁপ দিয়েছে ‘ডোরাকাটা’! কয়েক সেকেন্ড যেতে না যেতেই বুড়বুড়ি কাটল জলে, ভেসে উঠল ফেনার স্তূপ, পাকসাট খেতে লাগল জল।

     তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে সুইমিং পুলের সমস্ত জল। পালটে যাচ্ছে রং— দেখতে দেখতে হল গা ঘিনঘিনে উৎকট সবুজ। জলতল থেকে ভেসে এল গুরগুর গুমগুম শব্দ… একটু একটু করে বেড়েই চলল রহস্যময় লোমকূপে লোমকূপে শিহরণ জাগানো সেই চাপা শব্দলহরী।

     সংখ্যায় বাড়ছে গ্রেমলিন। আতঙ্কে অবশ হয়ে গেছিল বিলির পা থেকে মাথা পর্যন্ত। তারপরেই থলিশুদ্ধ গিজমোকে আঁকড়ে ধরে পড়ি কি মরি করে দৌড়োল প্রাণটাকে বাঁচাতে।

    

গ্রেমলিনদের দখলে গোটা শহর

    

     হঠাৎ লন্ডভন্ড কাণ্ড লেগে গেল কিংসটন ফলস শহরে। বিপর্যয় সর্বত্র। লোমহর্ষক দুর্ঘটনার পর দুর্ঘটনায় ছোট্ট শহর স্তম্ভিত। কিংকর্তব্যবিমূঢ় শহরের লোকজনেরা।

     গ্রেমলিনরা এখন শহরময় ছড়িয়ে পড়েছে। তার কেটে দিয়েছে, জানলার কাচ চুরমার করে দিয়েছে, রাস্তার মোড়ে মোড়ে যত ট্রাফিক লাইট আছে সব ভেঙে দিয়েছে, যত্রতত্র ভাঙাচোরা জিনিসের স্তূপ রচনা করে ফেলেছে।

     মি. ফাটারম্যান নামক সেই ভদ্রলোক গ্রেমলিনদের গল্পই একদিন শুনেছিলেন। গাড়িতে করে বিলিকে ব্যাংকে নিয়ে যাওয়ার সময়ে হুঁশিয়ারও করে দিয়েছিলেন।

     কিন্তু সত্যিকারের গ্রেমলিন কখনও দেখেননি। তাদের কীর্তিকলাপ কতখানি জঘন্য এবং গা-কাঁপানো হতে পারে, তার চাক্ষুষ প্রমাণ কখনও পাননি।

     পেলেন সেই রাতে। গ্রেমলিনরা নেমে এল তাঁরই বাড়ির ছাদে— টিভির এরিয়ালে দোল খেয়ে।

     মনের আনন্দে টিভি দেখছিলেন ভদ্রলোক। হঠাৎ ছবি বিগড়ে যাওয়ায় মেজাজও গেল খিঁচড়ে। গজগজ করতে করতে দরজা খুলে বেরোতে যাচ্ছিলেন খারাপ ছবির কারণ খুঁজতে…

     ভড়কে গেলেন তুষার সাফ করার গাড়ি চলার গোঁ-গোঁ আওয়াজ শুনে। তারপরেই চোখ ঠেলে প্রায় বেরিয়ে পড়ে আরকী কোটর থেকে।

     এ কী দেখছেন ফাটারম্যান! চলমান মেশিন! তেড়ে আসছে বাড়ির দিকেই।

     ফ্যালফ্যাল করে চেয়েই রইলেন ফাটারম্যান। গজরাতে গজরাতে মেশিন ঢুকে গেল গ্যারেজের মধ্যে— মড়মড় করে দরজাটা ভেঙেই ঢুকল। তারপরেই হুড়মুড় করে ভাঙল দেওয়াল।

     গ্যারেজের মধ্যে দিয়ে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করল গ্রেমলিনরা।

     এবার দেখা যাক কী ঘটছে মিসেস ডিগল-এর বাড়িতে। টাকার পাহাড়ে বসে থাকলে কী হবে অত্যন্ত নীচ প্রকৃতি তো ভদ্রমহিলার। বড়দিনের আগে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে কচি গলায় গান গেয়ে চাঁদা তোলে। মিসেস ডিগল তাদের এক পয়সাও তো দেনই না— উলটে এমন দূর-দূর করে তাড়িয়ে দেন, যেন রাস্তার কুকুর তাড়াচ্ছেন।

     সে রাতেও দরজার বাইরে কচিগলার হরেক রকম সুর শুনে খাপ্পা হয়ে তেড়ে এসেছিলেন বুড়ি। দরজাও খুলেছিলেন কচিকাচাদের ঝেঁটিয়ে বিদেয় করবেন বলে। কিন্তু যা দেখলেন তাতে তাঁর আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার উপক্রম হল।

     গাঁ-গাঁ করে চেঁচিয়েই ধাঁই করে পাল্লা খুলেছিলেন ভদ্রমহিলা, খুলেই দেখলেন চৌকাঠের সামনে ভিড় করে কচিকাচারা দাঁড়িয়ে নেই— স্কুলের ছেলেমেয়ে তারা কস্মিনকালেও ছিল না— হবেও না…

     এক দঙ্গল বিকট দানব-প্রাণী কুচুটে হাসি হাসছে তাঁকে দেখে— ধারালো দাঁতে সে কী ঝিলিক!

     গাঁ-গাঁ চিৎকারটা মাঝপথেই আটকে গেল গলায়— তার বদলে বেরিয়ে এল পরিত্রাহি আর্তনাদ। পাঁইপাঁই করে বাড়ির ভেতর দিকে দৌড় লাগালেন বুড়ি। সামনেই পড়ল ওপর তলায় যাওয়ার ইলেকট্রিক চেয়ার-লিফট। আতঙ্কে দিশেহারা মিসেস ডিগল দানবদের খপ্পর থেকে চকিতে উধাও হওয়ার মতলবে ধপাস করে বসে পড়লেন এই চেয়ারে, খুট করে বোমও টিপলেন। কিন্তু…

     গ্রেমলিনরা যে ঝড়ের বেগে তাঁর আগেই পৌঁছে গেছে সিঁড়ির পাশে এই চেয়ার-লিফটের ধারে। কলকাঠিও নেড়ে দিয়েছে। নষ্টামিতে তাদের জুড়িদার হবার মতো প্রাণী তো আর নেই।

     ফলে যা হবার তা হয়ে গেল। নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল বিদ্যুৎচালিত চেয়ার-লিফট। রকেট-বেগে সাঁই করে উঠে গেল ওপর দিয়ে— প্রচণ্ড ধাক্কা মেরে মিসেস ডিগলকে ছুড়ে ফেলে দিল সিঁড়ির মাথা থেকে জানলার মধ্যে দিয়ে…

     বিলির বান্ধবী কেট-এর সঙ্গে ততক্ষণে প্রচণ্ড টক্কর লেগে গেছে গ্রেমলিনদের।

     সন্ধের দিকে ‘ডোরির খাবার দোকান’-এ ছোটখাটো কাজ করে দু-পয়সা রোজগার করে কেট। স্মরণীয় সেই রাতে দোকানে মানুষ-খদ্দেরদের বদলে দেখা গেল জনপঞ্চাশ গ্রেমলিনকে। টেবিলে টেবিলে বসে রীতিমতো হুল্লোড় করে ঘ্যাঁট চালিয়ে যাচ্ছে যাচ্ছেতাইভাবে। সবুজ রঙের বিদঘুটে প্রাণীদের শোরগোলে কানের পর্দা যেন ফেটে যাচ্ছে। যত না খাচ্ছে, ছড়াচ্ছে তার চেয়ে বেশি। পেটুক-দামোদর তিমিরাও এদের সঙ্গে পেরে উঠবে কি না সন্দেহ।

     সেই সঙ্গে চলছে দক্ষযজ্ঞ কাণ্ড। জিউকবক্স বাজিয়ে গমগমাগম গান শুনছে জনাকয়েক গ্রেমলিন, আর একটা দল টানা লম্বা কাউন্টারের ওপর দিয়ে গড়িয়ে দিচ্ছে সিরাপের বোতল— সে বোতল কাউন্টারের কিনারা থেকে ছিটকে পড়ে ভেঙেও যাচ্ছে ঝনঝন করে, কেউ খেলছে তাস, কেউ খেলছে বিলিয়ার্ড, কেউ আর কিছু না পেয়ে বাদাম ছোড়াছুড়ি করছে ঘরময়। চুরুট টেনে খকখক করে কেশে বেশ ক-টা গ্রেমলিন দামাল নাচ নেচে চলেছে ঘরের এখানে-সেখানে।

     পালে পালে গ্রেমলিনরা ঘিরে ধরেছে বেচারা কেটকে। পালাবার পথ তার নেই। তবে কুচুটেদের কাণ্ডকারখানা দেখে একটা জিনিস সে আঁচ করে নিয়েছে ঝটপট।

     জোরালো আলো একদম সইতে পারে না বজ্জাতের ধাড়ি গ্রেমলিনরা।

     দোকানের মালিক ডোরির একটা ক্যামেরার কথা মনে পড়েছিল তখনই। ধারেকাছেই কোথাও আছে ফ্ল্যাশগান লাগানো সেই ক্যামেরা। কাউন্টারের পেছনে ক্ষিপ্তের মতো হাতরাতে থাকে কেট।

     হরেকরকম আওয়াজে কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। তা সত্ত্বেও ক্যামেরা খুঁজে যাচ্ছে কেট। এমন সময়ে নচ্ছার একটা গ্রেমলিন খটখট করে গেলাস ঠুকতে শুরু করে দেয় কাউন্টারের ওপর।

     কেন? না খালি গেলাসে সরবত ঢেলে দিতে হবে এখুনি। খটখট আওয়াজ করে তাই হুকুম চালিয়ে যাচ্ছে কেট-এর ওপর।

     কেটয়ের বয়ে গেছে তার হুকুম তামিল করতে। ক্যামেরাটা গেল কোথায়? ছিল তো এইখানেই…

     ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায় অভব্য গ্রেমলিনের। দাঁত খিচিয়ে হুংকার ছেড়ে কাউন্টারের ওপর দিয়ে গেলাস আর বোতল, ছাইদানি আর প্লেট ছুড়ে মারতে থাকে কেট-এর পিঠ লক্ষ করে।

     কাঁহাতক সহ্য করা যায়! রক্ত চড়ে যায় কেট-এর মাথায়। আর ঠিক এই সময়ে পেয়ে যায় ক্যামেরাটা।

     ব্যাস! বোঁ করে ঘুরে দাঁড়ায় কেট। হাতে ক্যামেরা। লেন্স ফেরানো রয়েছে পাজির পা-ঝাড়া গ্রেমলিনটাকে লক্ষ করেই।

     ট্রিগার টিপে দিল কেট। দপ করে জ্বলে উঠল ফ্ল্যাশ বালব। কাউন্টারের সামনে ভিড় করেছিল যে ক-জন গ্রেমলিন— চিৎপাত হয়ে পড়ল সঙ্গে সঙ্গে।

     আর কি কেটকে থামানো যায়! ফ্ল্যাশবালব জ্বালিয়ে যায় মুহুর্মুহু। আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে একসঙ্গে গলাবাজি করে যায় সব ক-টা গ্রেমলিন। মহা কোলাহলে মনে হয় এবার বুঝি পটাং করে ফেটে গেল কানের পর্দাজোড়া।

     কেট কিন্তু হাতে অস্ত্র পেয়ে গেছে। চোখ ধাঁধানো আলোর ঝলক মেরে মেরে অসহ্য কাদাকার গ্রেমলিনদের হটিয়ে দিয়ে পথ করেও নিচ্ছে বাইরের দরজার দিকে, দরজা পর্যন্ত পৌঁছেই এক ধাক্কায় খুলে দিয়েছে কপাট।

     সঙ্গে সঙ্গে মহা উল্লাসে নেচে উঠেছে মনটা। চৌকাঠে দাঁড়িয়ে প্রিয় বন্ধু বিলি!

     পেছনেই দাঁড়িয়ে তার মোটর গাড়ি। জ্বলছে দুটো হেডলাইট। পেছনে আলো থাকায় ছায়ামূর্তির মতো দাঁড়িয়ে বিলি। মুখ দেখা যাচ্ছে না তার।

     কিন্তু কেট তো চিনেছে। সোল্লাসে চেঁচিয়ে উঠেছে। সে চিৎকার চাপা পড়ে গেছে অবশ্য গ্রেমলিনদের সম্মিলিত আর্তনাদে। হেডলাইটের জোরালো আলোয় বিমূঢ় প্রত্যেকেই। সবারই লক্ষ্য ঘরের অন্ধকার কোণ—হেডলাইটের আলো যেখানে পৌঁছোচ্ছে না।

     বিলি দেখল এই সুযোগ! কেটকে টেনে নিয়ে ছুটল গাড়ির দিকে। দুজনে দু-দিক থেকে লাফ দিয়ে উঠে বসল গাড়িতে। ইগনিশন চাবি ঘুরিয়ে দিল বিলি তক্ষণাৎ।

     কিন্তু চালু হল না ইঞ্জিন। খক-খক-খক-খক করে কেশেই গেল। বার বার চেষ্টা করে গেল বিলি পাগলের মতো চেঁচাতে চেঁচাতে। দোকানের জানলা দিয়ে একটা বোতল উড়ে এসে দমাস করে আছড়ে পড়ল গাড়ির বনেটে। কিন্তু একগুঁয়ে অবাধ্য ছেলের মতো অচল হয়ে রইল গাড়ির ইঞ্জিন।

     গিজমোকে তুলে নিয়ে লাফিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়ল বিলি। কেটকে হিড়হিড় করে টেনে নামাল গাড়ি থেকে। ব্যাংকের পাশ দিয়ে প্রাণপণে দৌড়ে যাওয়ার সময়ে দেখল দরজা দু-হাট করে খোলা।

     ভেতরে কী কাণ্ড চলছে দেখবার জন্যে ঢুকে পড়ল ঝড়ের বেগে।

     না। গ্রেমলিনরা কেউ নেই। তবে নষ্টামি যা করবার করে গেছে।

     ঘরময় ছড়ানো ছেঁড়া ডলার নোট, উলটে-পালটে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে চেয়ারগুলো, অতিশয় নিষ্ঠার সঙ্গে ভেঙে চুরমার করা হয়েছে প্রতিটা জানলা।

     চোখে জল এসে যায় বিলির। হতভাগা শয়তানদের কোনও রকমেই তো ঢিট করা যাচ্ছে না। টেলিফোন করে যে পুলিশ ডেকে আনবে— সে উপায়ও নেই। সব ক-টা টেলিফোনের তার কেটে দিয়েছে শয়তান শিরোমণিরা।

     কী করা যায় এখন?

    

পালটা মার দিল বিলি আর কেট

    

     ব্যাংক থেকে ভারাক্রান্ত মনে রাস্তায় পা দেয় দুজনে। থলি থেকে মুখ বাড়িয়ে রাস্তায় কী যেন বলে গিজমো তার মোগওয়াই ভাষায়। আঙুল তুলেও দেখায় চত্বরের দিকে।

     এবার দেখতে পেল বিলি। তুষারের ওপর আঁকা অসংখ্য পায়ের ছাপ। গ্রেমলিনদের পায়ের ছাপ। দলে দলে তারা গেছে শহরের সিনেমা হলের দিকে।

     আকাশের দিকে চোখ তোলে বিলি। অন্ধকার কেটে যাচ্ছে। ভোরের আলো দেখা যাচ্ছে।

     “কেট, দেখছ?”

     “আকাশ ফরসা হচ্ছে।”

     “হ্যাঁ। গ্রেমলিনরা ভয় পেয়েছে। দিনের আলো এড়াতে সিনেমা হলে ঢুকেছে।”

     “মাথায় মতলব এসেছে মনে হচ্ছে…”

     “হ্যাঁ কেট। জব্বর মতলব বলতে পারো।”

     “যথা?”

     “সিনেমা হলের পাতালঘরে একটা বয়লার আছে মনে পড়ে?”

     “হ্যাঁ, হ্যাঁ।”

     “এই বয়লারটা যদি ফাটিয়ে দিতে পারি গোটা সিনেমা হলে আগুন লেগে যাবে। সব ক-টা গ্রেমলিন খতম হবে একই সঙ্গে।”

     “তাহলে দাঁড়িয়ে কেন? চলো চটপট।”

     “চলো।”

     থলের মধ্যে গিজমোকে নিয়ে ঝড়ের মতো দৌড়ে যায় বিলি— পেছনে কেট। রাস্তা পেরিয়ে সিনেমা হলের সামনের গাড়িবারান্দায় ঢুকে থ হয়ে গেল গ্রেমলিনদের কীর্তি দেখে। মিষ্টির প্যাকেট দলা পাকিয়ে ছড়িয়ে রেখেছে, কোল্ড ড্রিংকস-এর বোতল গড়াগড়ি যাচ্ছে, সিনেমা টিকিট ছিঁড়ে ফালিফালি করে ছড়িয়ে রাখা হয়েছে।

     অডিটোরিয়াম থেকে ভেসে আসছে চড়া গলায় কিচমিচ শব্দ আর বিকট-বেসুরো চাপা হাসি।

     পা টিপে টিপে গিয়ে উঁকি মেরে একঝলক দেখে নিল ডাকাবুকো বিলি।

     হলঘর থুকথুক করছে গ্রেমলিনদের ভিড়ে। পঙ্গপালের মতো তারা ছেয়ে ফেলেছে সিটগুলো, নরম গদীর উপর বসে বসেই তুরুক নাচ নাচছে, গবগব করে খাচ্ছে মিঠাই আর পপকর্ন, কেক আর লজেন্স। উৎকট নিনাদে হলঘরের ছাদটাও বুঝি হুড়মুড় করে ভেঙে না পড়ে।

     আচমকা সব চুপচাপ। যে যার সিটে বসে পড়ে একদৃষ্টে চেয়ে পর্দার দিকে।

     সেখানে ফুটে উঠেছে সিনেমার দৃশ্য। নিশ্চয় এক বজ্জাত গ্রেমলিন প্রোজেক্টর চালু করে দিয়েছে— শুরু হয়ে গেছে সিনেমা।

     এই তো সুযোগ। ইশারায় কেটকে ডাক দেয় বিলি। দুজনে পা টিপে টিপে এগিয়ে যায় পাতাল ঘরের দিকে। বয়লারের গ্যাস জেট পেয়ে যায় একটু খুঁজতেই। খুলে দেয় জেট। হুশ-হুশ করে গ্যাস বেরিয়ে ভরিয়ে দেয় পাতাল ঘর।

     “এইবার… কেট, দৌড়োও বললেই দৌড়োবে,” বলেই একটা ছেঁড়া ন্যাকড়ায় আগুন ধরিয়ে নেয় বিলি। ছুড়ে দেয় একটা কোণ লক্ষ করে। চিৎকার করে ওঠে সঙ্গে সঙ্গে, “দৌড়োও!”

     দৌড়োল বটে দুজনে। অলিম্পিকের দৌড়বাজকেও হার মানিয়ে দেওয়ার মতো দৌড়।

     সটান বেরিয়ে এল রাস্তায়। বয়লারটাও ফাটল ঠিক তখুনি।

     সে কী প্রচণ্ড বিস্ফোরণ! সারা শহর থরথর করে কেঁপে উঠল সেই আওয়াজে। ঘরে ঘরে বিস্ময় নেমে এল প্রলয়ঙ্কর অগ্নিশিখা দেখে। আগুনের বিরাট বল ধেয়ে গেল আকাশ লক্ষ করে—আলোয় আলো হয়ে গেল সব ক-টা রাস্তা।

     সবশেষ এহেন বিস্ফোরণের পর আর কোনও গ্রেমলিনই বেঁচে থাকতে পারে না।

     বিভীষিকামুক্ত হল ছোট্ট শহরটা। কিন্তু সত্যিই কি হল?

    

শেষ গ্রেমলিন

    

     উল্লাসের হাসি হেসে পিঠের থলির দিকে ঘাড় ফিরিয়েছিল বিলি। কিন্তু গিজমো তো খুশি নয়। কিচমিচ করে মহা উত্তেজনায় চিৎকার জুড়েছে কেন? শুধু চেঁচানিই নয়— আঙুল তুলে দেখাচ্ছে। সামনের বড় দোকানটার দিকে।

     দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে মাত্র একজন গ্রেমলিন— দু-হাত বোঝাই চুরি করা মালপত্রে।

     ফিচেল বদমাস সেই ‘ডোরাকাটা’।

     তিন মূর্তিকে তার পানে চেয়ে থাকতে দেখেই বোঁ করে ঘুরে গিয়ে ক্যাঙারু লাফে অন্তর্হিত হল দোকানের ছায়াঘন অভ্যন্তরে।

     চাপা গলায় হিসহিসিয়ে উঠল বিলি সঙ্গে সঙ্গে, “কেট, চললাম আমি ওকে খতম করতে। নইলে আবার সংখ্যা বাড়িয়ে চলবে ব্যাটাচ্ছেলে।”

     ছুটল বিলি। পেছনে কেট।

     দোকানের ভেতরে নিবিড় অন্ধকার। হোঁচট খেতে খেতে ঢুকতে হল কোনওমতে। হাতের কাছে একটা বেসবল ব্যাট পেল বিলি। ‘ডোরাকাটা’কে পিটিয়ে যমালয়ে পাঠাবার জন্যে।

     বললে কেটকে, “যাও, গিজমোকে নিয়ে ভেতরে গিয়ে মেন সুইচ খোঁজো— আলো জ্বালো। আমি ততক্ষণে খুঁজি পালের গোদাটাকে।”

     বলেই মেঝে-ভরতি হাবিজাবি জিনিসে ঠোক্কর খেতে খেতে মিলিয়ে গেল আঁধারের মধ্যে। অমনি তমিস্রার মধ্যে থেকে ভেসে এল অতিপরিচিত কদর্য খলখল হাসি।

     ‘ডোরাকাটা’ বিদ্রুপের হাসি হাসছে। শব্দ লক্ষ করে সেইদিকেই ধেয়ে গেল বিলি— গাঢ় অন্ধকারে কিছু দেখতে না পেলেও। কিন্তু টের পেল সাঁই করে কী যেন একটা জিনিস বাতাস কেটে বেরিয়ে গেল মাথার পাশ দিয়ে। বলতে গেলে অল্পের জন্যে রেহাই দিয়ে গেল সাধের মাথাটাকে।

     দড়াম করে বস্তুটা গিয়ে পড়ল পেছনে। হাতুড়ি নিশ্চয়। ছুড়ছে ‘ডোরাকাটা’। স্প্যানার, রঙের খালি টিন এবং হাতের কাছে যা পাওয়া যায়— সব কিছুই এরপর একটার পর একটা নিক্ষিপ্ত হল বিলিকে তাক করে।

     বেগতিক দেখে বই সাজিয়ে রাখার একটা বড় তাকের আড়ালে গিয়ে প্রাণ বাঁচাল বিলি। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাক ভেঙেচুরে একশা হল ক্ষেপকস্ত্রের নিরন্তর আবির্ভাবে। তারপর সব চুপচাপ। শুধু শোনা যাচ্ছে ধড়িবাজ বজ্জাত গ্রেমলিনের শ্বাসপ্রশ্বাসের বাতাসকাটা শব্দ। কিন্তু তাকে দেখা যাচ্ছে না।

     আঃ। এত দেরি করছে কেন কেট? এতক্ষণেও কি পেল না আলোর সুইচ? কিন্তু আলোর প্রতীক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকাও তো সম্ভব নয়। একটা মুহূর্তও গ্রেমলিনকে এখন আর দেওয়া যায় না। না জানি কী অনর্থ বাঁধিয়ে বসে।

     অন্ধকারেই পা বাড়াল বিলি। বুঝতেও পারল না চলেছে অতর্কিত চোরাগোপ্তার মৃত্যুফাঁদের ঠিক মাঝখানে।

     বড় দোকানে সবরকম জিনিসের নানারকম বিভাগ থাকে। এখানেও আছে খেলার জিনিস বিক্রির একটা বিভাগ। ‘ডোরাকাটা’ সেঁধিয়ে পড়েছে সেখানকার অন্ধকারে। খুঁজেপেতে বের করেছে। একটা ধনুক আর এক তূণ তির। লুকিয়েছে এমন একটা জায়গায় যেখান থেকে বিলিকে দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। ধনুকে একটা তির লাগিয়ে ছিলে টেনেও ধরেছে। বিলির পিঠ লক্ষ করে এবার সে ধনুক তুলে ধরল চোখের সামনে।

     কাঠের যে প্যানেলটায় দোকানের বিদ্যুৎ ব্যবস্থার সুইচগুলো পাশাপাশি লাগানো থাকে, কেট সেটাকে খুঁজে পেয়েছে ঠিকই, কিন্তু এত বোতাম আর সুইচের মাঝে কোন সুইচটাকে টেপা উচিত তা বুঝতে পারছে না কিছুতেই। এলোপাতাড়ি টিপে যাচ্ছে একটার পর একটা— ভাগ্যক্রমে যদি টেপা হয়ে যায় সঠিক সুইচটা।

     কিন্তু টেপা হয়ে গেল একটা বেঠিক সুইচ। বেঠিক হয়েও সুইচটা সেই মুহূর্তে বাঁচিয়ে দিল বিলিকে নির্ঘাত মৃত্যুর হাত থেকে।

     বড় দোকানে আগে থেকে রেকর্ড করা ক্যাসেট থাকে। মাঝে মাঝেই তা বাজিয়ে শোনানো হয় খদ্দেরদের। কেট-এর বেঠিক সুইচ চালু করে দিল এমনই টেপরেকর্ডারের ক্যাসেট।

     গমগমে ঘোষণা ফেটে পড়ল নিস্তব্ধ দোকান ঘরের সব বিভাগে, “ভদ্রমহোদয় এবং মহিলাগণ, দোকান বন্ধ হবে আর দশ মিনিটের মধ্যেই।”

     নীচের তলায় ‘ডোরাকাটা’ লাফিয়ে উঠল মুখের সামনেই গুরুগম্ভীর ঘোষণাটা শুনে, ফলে এক লহমার জন্যে বেঁচে গেল বিলি।

     ধনুক থেকে নিক্ষিপ্ত তির হল লক্ষ্যভ্রষ্ট। শনশন ঠক-ঠকাস শব্দ শুনেই কিন্তু লাট্টুর মতো পাক খেয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল বিলি। পরক্ষণেই যখন টের পেল এলোপাতাড়ি তির ছুটে আসছে তাকে লক্ষ করে— সোজা ঝাঁপ দিল মেঝের ওপর।

     আর ঠিক এই সংকট মুহূর্তেই কেট তার প্রিয় বন্ধুকে প্রাণে বাঁচিয়ে দিল আবার। সেকশন লাইট দপ করে জ্বলে উঠল তার আন্দাজে এলোমেলোভাবে সুইচ টেপার ফলে।

     তির ধনুক ছুড়ে ফেলে দিয়ে কাতর আর্তনাদ করে উঠল ‘ডোরাকাটা’। আলো-প্রদীপ্ত জায়গা ছেড়ে পড়ি কি মরি করে দৌড়াল অন্ধকারের সন্ধানে।

     ঝাঁকে ঝাঁকে নিক্ষিপ্ত তিরের একটায় বাহু জখম হয়েছিল বিলির। কিন্তু ভ্রুক্ষেপ নেই তাতে। রক্ত ঝরছে ঝরুক। ‘ডোরাকাটা’কে তার চাই-ই চাই। ঝড়ের মতো তাই ছুটল পেছন পেছন। এসে পৌঁছোল দোকানের উদ্যান বিভাগে। এখানেও অন্ধকার। নিথর। থমথমে।

     কী করবে ভেবে পাচ্ছে না বিলি। কালান্তক যমের মতো ‘ডোরাকাটা’ ব্যাটাচ্ছেলে কোন দিকে ঘাপটি মেরে কী ফন্দি আটছে তা ঠাহর করা যাচ্ছে না কোনওমতেই।

     আচম্বিতে তীক্ষ্ণ গুনগুনে একটা আওয়াজ শুনেই ঝটিতি পেছন ফিরেছিল বিলি। ফিরেছিল বলেই রক্ষে পেয়ে গেল সে যাত্রাও।

     বিলির মতো ডানপিটে ছেলেও ভয়ে কাঠ হয়ে গেল দৃশ্যটা দেখে।

     অতি ভয়ানক একটা চেনে ঝোলানো করাতকে তার দিকেই চালিয়ে নিয়ে আসছে ‘ডোরাকাটা’। মুখে চাপা নির্দয় হাসি।

     পিছু হটে এল বিলি। পা আটকে গেল আবর্জনায়, উলটে পড়ে গেল মেঝেতে। সেই অবস্থাতে বেসবল ব্যাট চালাল বটে ‘ডোরাকাটা’-কে লক্ষ করে, কিন্তু বেশ বুঝল মৃত্যু এবার নিশ্চিত। ওই করাতের ধারালো দাঁত এখুনি টুকরো টুকরো করে ছাড়বে তার অঙ্গপ্রত্যঙ্গ।

     ক্ষিপ্তের মতো ফটাফট কট-কটাস করে সুইচের পর সুইচ টিপছে আর নেভাচ্ছে কেট— কিন্তু সব ক-টা আলোর মেন সুইচ খুঁজে পাচ্ছে না কিছুতেই।

     উদ্বেগে অস্থির হয়ে আর নিজেকে সামলে রাখতে পারে না কেট। ঝাঁপাই জোড়ে গিজমোর ওপরেই, “কী করি এখন বল-না…”

     কিন্তু কোথায় গিজমো? কেট-এর আকুল চিৎকারে সে তো সাড়া দিল না। কাঁইমাই করে কিছু বললও না।

     থলি থেকে কখন জানি নিঃশব্দে বেরিয়ে গেছে ছোট্ট মোগওয়াই। বিলি তার পরমপ্রিয় বন্ধু।

     উধাও হয়েছে বিলির খোঁজে— শেষ গ্রেমলিনটাকে যে ভাবেই হোক ধরণীর ধূলো করে ছাড়তেই হবে।

     লড়তে লড়তে বেদম হয়ে পড়েছিল বিলি। শরীর আর মন দুটোই এলিয়ে পড়ছে। মৃত্যুপণ লড়াইয়ে এবার বুঝি তাকেই হারতে হয়।

     আচমকা মূর্তিমান আতঙ্ক শেষ গ্রেমলিনয়ের মনোযোগ ছুটে গেল অন্য দিকে।

     দুমদাম করে সুইচ টিপতে টিপতে এবার যে সুইচটা টিপছে কেট, সেটা টিপলেই তোড়ে জল বেরিয়ে আসে ফোয়ারা থেকে। বড়দিন উপলক্ষে বাহারি আলো দিয়ে সাজানো বিশাল সেই ফোয়ারা এতক্ষণ ছিল শুকনো খটখটে।

     আচম্বিতে হুউউশ করে জল উথলে উঠল ফোয়ারায় বেশ খানিকটা উঁচুতে ঠিকরে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। বিকট উল্লাসে ফোয়ারার জলরাশি লক্ষ করে লম্বা লাফ দিল ‘ডোরাকাটা’।

     প্রাণান্তকর চিৎকার করে ওঠে বিলি “না… না…”

     শেষ গ্রেমলিনের রসবোধ তখনও যায়নি। বিলির ব্যাকুল বুকফাটা হাহাকারের জবাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে শুধু হাত নাড়ে বিজয়োল্লাসে— পরক্ষণেই ঝাঁপ দেয় হাতছানি দেওয়া উত্তাল জলের মধ্যে।

     বুড়বুড়কাটা শুরু হয়ে যায় পলক ফেলতে না ফেলতেই। রাশি রাশি বুদবুদ ভুড়ভুড় গুবগুব করে উঠে আসে ফুর্তি-উচ্ছল জলের ওপর। সেই সঙ্গে যেন ফুঁসে ওঠে কিছু জল, ফণা মেলে লাফিয়ে ওঠে বিষম তেজে… পলকে পলকে করাল চেহারা নেয় আনন্দদায়ক মনোহর ফোয়ারা।

     আতঙ্ক-অবশ বিলি শুধু চেয়েই থাকে। আর কিছু তো করার নেই। শেষ গ্রেমলিন আবার হাজার গ্রেমলিন হতে চলেছে। রক্তবীজের একটা কণা থেকে…

     ও কীসের শব্দ? ঘরঘর চাকা ঘুরছে, পঁক-পঁক করে ভেঁপু বাজছে— এমন দুঃসময়ে এহেন উদ্ভট মজা করার শখ হল কার?

     কার আবার— গিজমোর। খেলনা মোটর গাড়ি চলাচ্ছে মহানন্দে। ঘুরছে বাঁই বাঁই করে, হড়কে যাচ্ছে মসৃণ মেঝের ওপর দিয়ে।

     ধৈর্যচ্যুতি ঘটে বিলির। ধমক লাগায় তারস্বরে, “গিজমো! হচ্ছেটা কী? নেমে আয় বলছি।”

     পুঁচকে মোগওয়াই কিন্তু যা করছে তা জেনেশুনেই করছে। অনেক আগেই সে দেখে নিয়েছে দিনের আলো আসবার কাচের স্কাইলাইটগুলো তেরপল দিয়ে ঢাকা রয়েছে। তেরপলে লাগানো দড়িটা যে ঝুলছে মেঝে পর্যন্ত, তাও সে দেখেছে। এই দড়িটাকে কষে মুঠোর মধ্যে চেপে ধরে সে ঘুরপাক খাচ্ছে ঘরময়।

     আর তাই প্রচণ্ড টানে কাচের সিলিং থেকে খসে পড়ল তেরপল— দিনের আলোর বন্যা বয়ে গেল ঘরময়।

     যন্ত্রণাকাতর শব্দের পর শব্দ ভেসে এল ফোয়ারা থেকে। দিনের আলো যেন মরণ চাবুক হেনেছে ‘ডোরাকাটা’র প্রতিটি অণু পরমাণুতে… পাকসাট খাচ্ছে তো খাচ্ছেই। রোদ্দুর ঝলকিত জল থেকে দুমড়ে-মুচড়ে শরীরটাকে বাইরে এনে ফেলতে চাইছে— অন্ধকারের দিকে ধাবিত হওয়ার আত্যন্তিক প্রচেষ্টায় শরীরের শেষ শক্তিটুকুও প্রয়োগ করছে…

     কিন্তু পারল না… শেষ পর্যন্ত পারল না। বিকট কদাকার দেহটা রোদ্দুরের তেজে ইতিমধ্যেই গুঁড়িয়ে যেতে শুরু করেছিল… ঝপঝপানির মধ্যেই গুঁড়িয়ে গেল আর কিছুটা শরীর… তারপরেই দেখা গেল গ্রেমলিন আর নেই— তার জায়গায় রয়েছে খানিকটা ধুলো।

     ধরণীর ধুলো।

     শেষ গ্রেমলিনয়ের এই হল শেষ পরিণতি।

    

গুড বাই বলে গেল গিজমো

    

     সেদিন ছিল বক্সিং দিবস। পেল্টজারের বসবার ঘর। কম্বল মোড়া গিজমো শুয়ে সোফায়। বিলি একহাতে তার সেবা করছে— আর একটা হাতে ব্যান্ডেজ, ঝুলছে গলায় লাগানো ফেটিতে।

     কেট সবে এসে পৌঁছেছে গিজমোর খবর নিতে। মোগওয়াইয়ের গা কত গরম হয়েছে দেখতে দেখতে বিলি জানিয়ে দিলে— ভয় নেই, গিজমো সেরে উঠবে।

     সজল চোখে গিজমোকে বুকে টেনে নেয় কেট। সেই ভয়ংকর রাতে শেষ খেলটা পুঁচকে এই প্রাণীটাই দেখিয়েছে— গোটা শহরটাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।

     “সাহস আছে বটে!” সপ্রশংস চোখে বললেন বিলির মা। আরাম করে নড়েচড়ে কম্বলের মধ্যে শুতে যাচ্ছে গিজমো— আরামে বুজে আসা চোখ দুটো খুলে গেল হঠাৎ।

     কী যেন শুনছে কান খাড়া করে।

     ভুরু কুঁচকে দেখছিল বিলি। হঠাৎ কী মনে হল, ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল পেছনে।

     বুড়ো চীনেম্যানটা দাঁড়িয়ে পাথরের মূর্তির মতো। চোখ মুখ কঠিন। উদ্বেগ আর বিড়ম্বনা ফুটে উঠেছে মুখের প্রতিটা রেখায়।

     গিজমোও তাকে দেখছে। দেখেই দারুণ উত্তেজনায় কিচমিচ করে উঠেছে। হেঁট হয়ে তাকে কোলে তুলে নেয় বুড়ো চীনেম্যান— আদর করতে থাকে সস্নেহে।

     তারপরেই বললে মি. পেল্টজারকে, “বুঝতেই পারছেন আমি এসেছি কেন। তা পারছেন বইকী। গিজমোকে এবার বিদায় দিতে হবে।”

     “নিয়ে যাবেন?”

     “হ্যাঁ। হুঁশিয়ার করেছিলাম আগেই। মোগওয়াই-এর মালিক হতে গেলে অনেক বেশি দায়িত্ব নিতে হয়। কথায় কান দেননি। মোগওয়াইকে মানুষ করার মানুষ এখনও আপনারা হননি। তাই নিয়ে যাচ্ছি ওকে।”

     “একটু দাঁড়ান—” বাধা দিলে বিলি, “বাবা, উনি তো ঠিকই বলেছেন, তিনটে নিয়ম মেনে চলতে পারিনি বলেই তো এত অঘটন ঘটিয়ে গেল মোগওয়াই।”

     কথাটা নিশ্চয় মর্মান্তিক মনে হল গিজমোর কাছে। বিষন্ন চোখে চেয়ে রইল বিলির চোখের পানে।

     বিলি ওকে কোলে টেনে নিয়ে শেষবারের মতো আদর করে ফিরিয়ে দিল বৃদ্ধের হাতে। কাঠের বাক্সের মধ্যে সযত্নে গিজমোকে শুইয়ে দিল বুড়ো চৈনিক। সবিনয়ে অভিবাদন জানিয়ে ঘর থেকে যেই বেরোতে যাচ্ছে নতুন শব্দ গলা দিয়ে বের করে ফেলল গিজমো।

     পিনপিনে কিন্তু সুস্পষ্ট স্বরে শুধু বললে, “গুডবাই, বিলি।”

     সবিস্ময়ে ঘাড় ফিরিয়ে তাকায় চীনেম্যান।

     মৃদুহাসি ফুটে ওঠে চাপা ঠোঁটে। বলে, “মোগওয়াই তোমাকে বেশ সমীহ করে দেখছি। একদিন না একদিন তুমিই তাহলে মানুষের মতো মানুষ হবে, ওর ভার নিতে পারবে।”

     উজ্জ্বল হয়ে ওঠে বিলির মুখ। দরজায় দাঁড়িয়ে নির্নিমেষে চেয়ে থাকে চীনেম্যানের বিলীয়মান মূর্তির দিকে— যতক্ষণ না মোড় ঘুরে একেবারেই অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে মানুষটা…

     সেই সঙ্গে তার প্রাণপ্রিয় বন্ধু গিজমো।

     না। মোগওয়াইকে আর দেখা যাচ্ছে না। তবুও কেন শীতার্ত রাতের অন্ধকার ভেদ করে তার কানে ভেসে আসছে পুঁচকে প্রাণীটার কিচিরমিচির কোমল শব্দলহরী?

     চোখ খোলা রেখো। ধারেকাছেই থাকতে পারে গ্রেমলিন…

    

    

সিনেমা: গ্রেমলিন (১৯৮০), লেখা ক্রিস কলম্বাস এবং পরিচালনা জো দান্তে

প্রথম বাংলায় প্রকাশ: সেরা সঞ্চয়ন ১৯৯১

          

Tags: অদ্রীশ বর্ধন, অনুবাদ উপন্যাস, জটায়ু, পঞ্চম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, হরর গল্প

Leave a Reply

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!