সময়নদীর বাঁকবদল

  • লেখক: পার্থ দে
  • শিল্পী: রনিন

    

     (এটা একটা বিকল্প ইতিহাসের কাহিনি। বাংলায় অল্টারনেট হিস্ট্রির ধারাটি নতুন। এই কাহিনিকে একটি জিও-পলিটিক্যাল কমেন্ট্রি বলা যায়। এই ধারাভাষ্য সম্পূর্ণ কাল্পনিক, অন্তত এই বিশ্বে। কোনও সমান্তরাল বিশ্বে সত্যিও হতে পারে।)

    

     প্রাককথন

    

 ২১২০ সাল, কলকাতা

      ফিসের বায়োমেট্রিক গেটে বুড়ো আঙুল ছুঁয়ে লোকটা ভিতরে ঢুকতেই কাউন্টারে বসা লিজা মুখ তুলে বলল, “হরিপদ, তোমাকে একবার মুখার্জিসাহেব ডেকেছেন, যাও দেখা করে এসো।”

    

     হরিপদর ইউএনএইচআরসি-র অফিসটা রাজারহাটের ‘মরমী মানুষ’ বিল্ডিংয়ে। বাড়িটার গোটাটাই রাষ্ট্রসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের দখলে। মুখার্জিসাহেব বসেন তেরো তলায়। মুখার্জিসাহেব হরিপদর বস, আপাতত তিনি কোল্ড কেস ডিভিশনের হোমিসাইড আর জেনোসাইডের কেসগুলো সামলান। ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট ফর ইটারনাল জাস্টিস থেকে নিষ্পত্তি হয়ে আসা কেসগুলোর অর্ডার এক্সিকিউশনের কাজ হরিপদকে দেওয়া হয়। তবে এই কাজ হরিপদ একা করে না, তার অন্যান্য কলিগদেরও দেওয়া হয়।

        মুখার্জিসাহেবের চেম্বারে ঢুকতেই তিনি ব্যস্তসমস্ত হয়ে বললেন, “আরে, এসো এসো হরিপদ, এবার একটা বড় কাজের দায়িত্ব দেব তোমাকে।”

     “হ্যাঁ স্যার বলুন কী কাজ?”

     “গতকাল একটা কেসের রায় দিয়েছেন জাস্টিস লেনা হিডি আর জাস্টিস আইয়ারের ডিভিশন বেঞ্চ। রায় দেওয়ার সময় একটা ঐতিহাসিক উক্তি করেছেন বিচারকদ্বয়। ‘অ্যান আনন্যাচারাল ডেথ ইজ আনফরচুনেট। দিস আনফরচুনেট ডেথ ট্রিগারস সিরিজ অফ আনফরচুনেট ডেথস। সো ইট মাস্ট বী প্রিভেন্টেড।’”

     “আদালতের রায়টা শুনেছি। সত্যিই ঐতিহাসিক রায়! স্যার, মামলার পিটিশনটা কারা করেছিল? মানে প্লেইনটিফ কারা ছিল?”

     “প্লেইনটিফ ছিল ভারতের দুশো পঁয়ত্রিশ বছরের পুরোনো একটি রাজনৈতিক দল। ওদের পক্ষেই রায়টা এল… সেই কোর্ট অর্ডারটা এক্সিকিউট করার কাজ এটা… কিন্তু ভাবছি, তুমি পারবে তো… নাকি মনোতোষকে দেব?” বলতে বলতে মুখার্জিসাহেব গম্ভীর হয়ে গেলেন।

     মনোতোষ! নামটা শুনতেই হরিপদর মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। এই ছোকরা সহকর্মীটি একেবারেই সুবিধের নয়, হরিপদর অনেকগুলো কাজ সে নিয়ে নিয়েছে। তাই নিয়ে দুজনের মধ্যে একটু রেষারেষিও আছে। হরিপদ রাগটা গিলে ফেলে বলল, “স্যার, আপনার কোন কাজটা আমি করিনি বা করতে পারিনি আপনিই বলুন। তবুও যে কেন আপনি আমাকে ভরসা…”

     “আরে না না, আমি এই কাজটার জন্য তোমার কথা ভেবে রেখেছি বলেই না তোমাকে ডেকে পাঠালাম,” মুখার্জিসাহেব হেসে বললেন, “রাগ করো না হে! কাজটায় সময়টা খুব বড় ফ্যাক্টর, কাজটা করার জন্য মাত্র পাঁচ মিনিট সময় পাবে, সময়ের এই উইন্ডোটা খুব ছোট, তার মধ্যেই সারতে হবে… তাই ভাবছিলাম… তোমার তো আবার সবকিছু টিপিকাল বাঙালি টাইমে হয়, তাই…”

     “না স্যার, সত্যি বলছি আর দেরি হবে না,” আজ অফিসে দেরি করে আসার গুনাগারি দিতে হচ্ছে বুঝতে পেরে হরিপদ মরীয়া হয়ে বলল, “স্যার, এবারের মতো একটা চান্স দিয়ে দেখুন, সত্যি বলছি কাজটা আমি করতে পারব।”

     “আচ্ছা হরিপদ, তোমার ছেলেটা যেন এখন কী করছে? তোমার তো একটিই ছেলে তাই না?”

     “না স্যার, একটি মেয়েও আছে,” হরিপদ লাজুক স্বরে বলল, “ছেলে বড়, মেয়ে তারপরে। ছেলে, স্যার, এখন অ্যাস্টেরয়েড মাইনিং নিয়ে পড়ছে। ফিফথ সেমিস্টার চলছে, সামনের বছর ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ, কী জানি কোথায় চাকরি পাবে। আর মেয়ে, স্যার, এখন Mach10 ফ্লাইট অ্যাটেন্ড্যান্টের ডিপ্লোমা করছে।”

     “বাহ, বাহ, খুব ভালো। আমার ছেলেটাও অ্যাস্টেরয়েড মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েছে, এমআইটি-তে। এখন ফার্স্ট পোস্টিং পেয়ে অ্যাস্টেরয়েড বেল্টের সেরিস-এ আছে। যাক, এবার কাজের কথায় আসি। বুঝলে হরিপদ, তোমাকে এই বাক্সটা দিল্লিতে একটা জায়গায় ডেলিভারি দিতে হবে।”

     সুদৃশ্য বাক্সটার দিকে তাকাল হরিপদ। দেখে জুতোর বাক্স মনে হচ্ছে। কৌতুহল গোপন করতে না পেরে হরিপদ বলল, “স্যার, এটা কি জুতোর বাক্স?”

     “ঠিক ধরেছ। একটা দামি কোম্পানির স্পোর্টস শ্যু, এটাই দিল্লিতে একজনকে ডেলিভারি দিতে হবে।”

     “কপি, স্যার।”

     “তাহলে আর কি, বেরিয়ে পড়ো, তবে মনে রেখো হরিপদ, তোমার কলটাইম কিন্তু সকাল ৭.৪৫ থেকে ৭.৫০ এর মধ্যে।”

    

     প্রথম পর্ব

    

     ।। ১ ।।

    

     কাজ শুরুর আগে হরিপদ প্রতিবার টাইমলাইন মেন্ডিং ম্যানুয়ালটা মন দিয়ে দেখে নেয়। ক্লাউড থেকে ডিভাইসে অরিজিনাল টাইমলাইনের সাইম্যুলেশনটা ডাউনলোড করে বারবার প্লে করে দেখে নেয় সে। এতে কাজ করতে খুব সুবিধা হয়, অরিজিনাল টাইমলাইনের ল্যুজ এন্ডসগুলো বুঝতে পারে। সেক্ষেত্রে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট ফর ইটারন্যাল জাস্টিসের রায়টাকে এক্সিকিউট করতে সুবিধা হয়।

     হরিপদ তার ডানহাতের কবজিতে পরা ডিজিটাল সময়যানটার দিকে তাকাল। ২৩ জুন, ১৯৮০, সকাল ৭টা ৪০। হরিপদ ডিভাইসের বোতামটা ক্লিক করতেই দিল্লির সফদরজং বিমানবন্দরের লে-আউটটা স্ক্রিনে ভেসে উঠল। ওই তো ওইদিকে রানওয়ে, তার পাশেই হ্যাঙ্গারে বিমানগুলো রাখা থাকে। ১৯৬২ সালের পর থেকে সফদরজং বিমানবন্দরে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক যাত্রীবাহী বিমান ওঠানামা বন্ধ হয়ে গেলেও কিছু ব্যক্তিগত ছোট বিমান এখান থেকে ওঠানামা করে। দিল্লি ফ্লাইং ক্লাবের সদস্য পাইলটেরাও এখানে বিমান চালানোর প্রশিক্ষণ নেয়, প্র‍্যাকটিস করে।

     ডিভাইসের জিপিএস অ্যাকটিভ আছে। হরিপদ দেখতে পেল তার টার্গেট হ্যাঙ্গারের দিকে মুভ করতে শুরু করেছে। সঙ্গে সঙ্গে দ্রুত সে বিমানের হ্যাঙ্গারের সামনে পৌঁছে গেল। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই চোখে পড়ল হাঁটতে হাঁটতে হ্যাঙ্গারের দিকে এগিয়ে আসছে দুজন মানুষ। একজন কুর্তা-পাজামা পরা, পায়ে কোলাপুরী চপ্পল, অন্যজন টিশার্ট প্যান্ট পরিহিত।

     কুর্তা-পাজামা পরিহিত ফরসা উজ্জ্বল চেহারার ভদ্রলোক হরিপদর দিকে জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল। অমনি তড়িঘড়ি হরিপদ বলে উঠল, “সঞ্জয়স্যার, আপনি আমাকে চিনবেন না, মাইসেল্ফ হরিপদ জোগানদার। আপনার দাদা ইতালি থেকে আপনার জন্য এই ডিজাইনার জুতোটা পাঠিয়েছেন, বলেছেন এটা পরে যেন আপনি প্লেন চালান।”

     সঞ্জয় গান্ধী অচেনা লোকটার বাড়ানো বাক্সটা হাতে নিয়ে খুলল। ভিতরে বাদামি রঙের ঝকঝকে একটা জুতো। তার চোখদুটো জ্বলজ্বল করে উঠল, সে সোল্লাসে বলল, “ওয়াও, দাদা পাঠিয়েছে ইতালি থেকে? ফেরাগ্যামোর জুতো, দারুণ!”

     “হ্যাঁ স্যার, উনি পইপই করে বলে দিয়েছেন আপনি যেন কোলাপুরী চপ্পল পরে প্লেন না চালান, চটি পরলে ফুট প্যাডেলে কন্ট্রোল থাকে না। স্যার প্লিজ এখনই ওই চপ্পল ছেড়ে জুতোটা পায়ে গলিয়ে নিন।”

     “বেশ বেশ,” সঞ্জয় গান্ধী পায়ের কোলাপুরী চটি ছেড়ে ফেরাগ্যামোর জুতোজোড়া পরে নিয়ে এরোটেক পিটস এস-২এ বিমানের ককপিটের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে পিছন ফিরে বলল, “আমার হয়ে দাদাকে একটা ধন্যবাদ জানিয়ে দেবেন।”

     “নিশ্চয়ই স্যার,” মৃদু হেসে উত্তর দিয়ে হরিপদ নিজের মনে স্বগতোক্তি করল, “বিমান দুর্ঘটনাটা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য যে নতুন টাইমলাইন তৈরি হবে তা দেখার জন্য মহাকালও উদগ্রীব হয়ে রইল।”

     ততক্ষণে এস-২এ টু-সিটার বিমানটা ধীরে ধীরে হ্যাঙ্গার ছেড়ে রানওয়ের দিকে এগিয়ে চলেছে। ঘড়িতে তখন বাজে সকাল ৭টা ৫৮।

    

     ।। ২ ।।

    

     ‘জনতা কি গাড্ডি’ প্রকল্পের ভূতটা এখনও সঞ্জয়ের মাথায় মাঝেমধ্যেই ঘোরে, যদিও জনতার জন্য সস্তার গাড়ি তৈরি করার স্বপ্নটা এখনও সফল হয়নি। তার মায়ের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় সরকারের আনুকুল্যে গড়ে ওঠা মারুতি মোটরস লিমিটেডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর হওয়ার পর গত দশ বছরে দেশের অনেক কিছু বদলে গেছে। ’৭১-এ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ভারতের জয়লাভ, ইস্ট-পাকিস্তানকে ইসলামাবাদের কবল থেকে ছিনিয়ে এনে স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করার মতো সাফল্য যেমন ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার পেয়েছে, তেমনই এই সময়ের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সংবিধানের ৩৫২ ধারা প্রয়োগ করে ২১ মাসের ইমার্জেন্সি জারি করেছেন, গণমাধ্যমের ওপর নানারকমের নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দিয়েছেন। সঞ্জয় জানে, তার মা শ্রীমতী গান্ধী জয়প্রকাশ নারায়ণ, জে বি কৃপালনি, মোরারজী দেশাই, লালকৃষ্ণ আদবানী, অটলবিহারী বাজপেয়ী, বার্নালার মতো নেতাদের বেআইনীভাবে জেলে ভরে দেশের মানুষের নিন্দা কুড়িয়েছেন। শ্রীমতী গান্ধীর জনপ্রিয়তা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। তারপরে তো ‘৭৭ সালের নির্বাচনে জনগণের রায়ে হেরেও গেছেন। মোরারজী দেশাইয়ের জনতা পার্টির সরকার তাঁকে গ্রেফতার করে জেলে পাঠিয়েছে কিন্তু তারপরে ১৯৮০ সালের লোকসভা নির্বাচনে শ্রীমতী গান্ধী ফের স্বমহিমায় ক্ষমতায় ফিরে এসেছেন।

     সপ্তম লোকসভা নির্বাচনের পর সঞ্জয় বিভিন্ন কারণে গত কয়েকমাসে তার লোকসভা নির্বাচনকেন্দ্র আমেথিতে যেতে পারেনি। মাঝখানে জুন মাসে প্লেন চালানোর সময় একটা বিমান দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থেকে অল্পের জন্য বেঁচে গেছে। সেদিন সফদরজং বিমানবন্দর থেকে বিমান ওড়ানোর সময় তার সঙ্গে ছিল বন্ধু সুভাষ সাক্সেনা। সে সঞ্জয়ের মা মিসেস গান্ধীকে ঘটনাটা জানাতে সঞ্জয়ের প্লেন ওড়ানোর উপর পারিবারিক নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে। সঞ্জয়ের স্ত্রী মানেকাও তাদের তিন মাসের শিশুপুত্রের মাথায় হাত রেখে তাকে দিয়ে দিব্যি কাটিয়ে নিয়েছে যাতে ভবিষ্যতে সঞ্জয় প্লেন না চালায়। কিন্তু গতকাল আমেথিতে গিয়ে পার্টিকর্মীদের সঙ্গে মিটিংয়ের পর তার মনে ফের ‘জনতা কি গাড্ডি’ তৈরির ইচ্ছেটা চাগাড় দিয়ে উঠেছে। বারবার তার মনে পড়ে যাচ্ছিল ইংল্যান্ডে থাকাকালীন রোলস রয়েস কোম্পানির ইন্টার্নশিপ করার দিনগুলোর কথা। মনে হচ্ছিল ভারতের মোটরগাড়ি শিল্পের জন্য তার কিছু করা উচিত, একমাত্র সেই হয়তো পারবে ভারতীয় মধ্যবিত্তদের জন্য বিদেশি প্রযুক্তি ব্যবহার করে সরকারি ও বেসরকারি পুঁজির যৌথ বিনিয়োগের মাধ্যমে একটি সস্তা অথচ সুন্দর গাড়ি তৈরি করতে, যা হবে আমজনতার গাড়ি। শুধুমাত্র সরকারি সাহায্য দিয়ে হিন্দুস্থান মোটরসের মতো সাবেককালের ভারতীয় মোটর কোম্পানিকে যে বেশিদিন টানা সম্ভব নয় সেটা বিলক্ষণ বুঝতে পারছিল, তা ছাড়া গাড়ি বানানো যে দেশের সরকারের কাজ নয় সেটাও সে জানে, বরং সরকারের উদ্দেশ্য বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে প্রশাসনকে নিয়োজিত রাখা।

     আমেথি থেকে তাদের সফদরজং রোডের বাংলোয় ফিরে আসার সময় সে আজ গুরগাঁওয়ে গিয়েছিল। মারুতি মোটরস লিমিটেডের তালাবন্ধ অফিসটার সামনে দাঁড়িয়ে অনেক কিছু ভাবছিল সে। পুরোনো অনেক কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল, তার মারুতি নির্মাণের স্বপ্ন নিয়ে যত কুৎসা ছড়িয়েছে গত দশ বছরে, সব তার মনে পড়ে যাচ্ছিল। মারুতিকে ঘিরে তার স্বপ্ন দেখা শুরুর পর দশ বছর অতিক্রান্ত অথচ আজও কিছু করে ওঠা গেল না। দশ বছর ধরে বন্ধ থাকা অফিসটার দিকে তাকিয়ে সে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করল। এখন রাতের নৈশাহারে বসে থালা থেকে চাপাটি ছিঁড়তে ছিঁড়তে সে যেন সেই সব কথা ভেবে বারবার অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছে।

     “সঞ্জয়, আজ তোমাকে কেমন অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে। কিছু হয়েছে কী?” মিসেস গান্ধী তাঁর সারাদিনের কর্মব্যস্ততার মধ্যে এই ডিনারের টেবিলেই ছেলের সঙ্গে কথা বলার সময় পান। তা ছাড়া সঞ্জয়ও এখন আমেথির সাংসদ, সেও তার নির্বাচনকেন্দ্রের উন্নয়নের কাজে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়। ইদানীং ভারতের যুব কংগ্রেসের অনেক বাড়তি দায়িত্বও সে নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে।

     “মা, আমার মনে হয়, সপ্তম লোকসভা নির্বাচন জিতে আসার পর কংগ্রেস পার্টিকে এমন কিছু উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে যাতে অদূর ভবিষ্যতে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো জনতাজনার্দনের ভোট পেয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসতে না পারে। আমি ভাবছিলাম, আমাদের “জনতা কি গাড্ডি” এজেন্ডাটা যদি আবার ফ্লোট করা যায়। বিগত জনতা পার্টির সরকার মারুতি মোটরস লিমিটেড লিক্যুইডেট করে দিয়েছে। তাই মারুতি উদ্যোগ লিমিটেড নাম দিয়ে আরেকটা কোম্পানি গঠন করতে হবে, সঙ্গে বিদেশি কোনও কোলাবোরেটর খুঁজতে হবে।”

     “কিন্তু ভালো কোলাবরেটর কি পাওয়া যাবে, সঞ্জয়? অরুণ নেহরু, মানে তোমার অরুণ ভাইয়া, বলছিল জাপানের সুজুকি কর্পোরেশনের সঙ্গে কথা বলা যায়। সত্তর বছরের পুরোনো কোম্পানি, অটোমোবাইল ইন্ডাস্ট্রিতে ভালো কাজ করছে।”

     “জার্মানির ফক্সভাগেন গ্রুপের সঙ্গে আমার দীর্ঘদিন ধরেই কথাবার্তা চলছে, প্রাথমিক সমস্যাগুলো কেটে গেছে, সব কিছু ঠিকঠাক চললে আশা করি মারুতি-ফক্সভাগেন কোলাবোরেশানটা হয়ে যাবে। ভারতীয় মার্কেটের জন্য ফক্সভাগেনের বিটল মডেলের মতো একটা গাড়ি আনার ইচ্ছে আছে আমার।”

     “তুমি কি বিষয়টা নিয়ে একবার অরুণের সঙ্গে কথা বলবে?”

     “দরকার নেই, মা। মারুতি ইজ মাই ব্রেইন-চাইল্ড!”

     “বেশ, এগিয়ে চলো,” বলে খাবার টেবিলে বসেই শ্রীমতী গান্ধী একটা ফাইল টেনে নিয়ে বলেন, “যা করবে, ঠান্ডা মাথায় করবে। প্রয়োজনে কংগ্রেসের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে কথা বলে নেবে, গতবার তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ইন্দ্রকুমার গুজরালের সঙ্গে যে সমস্যা হয়েছিল, তেমন কিছু যেন না ঘটে।”

    

     শ্রীমতী গান্ধী রাতে খাওয়ার টেবিলে বসে বেশির ভাগ সময় কনিষ্ঠপুত্র সঞ্জয় ও পুত্রবধূর সঙ্গে কথাবার্তা বলে কাটান। তাঁর বড় পুত্র রাজীব যখন তার ইতালিয়ান স্ত্রী সোনিয়াকে নিয়ে দেশে আসে তখন শ্রীমতী গান্ধীর খাওয়ার টেবিল দুই পুত্র, পুত্রবধূ আর নাতিনাতনিদের উপস্থিতিতে ভরে ওঠে। কথায় বার্তায়, হাসিঠাট্টায় তখন গমগম করে সফদরজংয়ের বাংলো। তবে শ্রীমতী গান্ধী পুত্রদের সঙ্গে রাতের ডিনার টেবিলে খেতে বসে মাঝেমধ্যে দল এবং দেশের রাজনীতি নিয়েও আলোচনা করেন।

     আজ তাঁর সামনে রাখা ফাইলটা ভারতীয় গুপ্তচর সংস্থা র’ থেকে পাঠানো হয়েছে। এই ফাইলের ভিতরের তথ্যগুলো ক্লাসিফায়েড, এগুলো জনসমক্ষে তো আসেই না, এমনকি তাঁর বাইরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রতিরক্ষামন্ত্রী, মুখ্যসচিব, প্রতিরক্ষা সচিব এবং সর্বোচ্চ স্তরের কয়েকজন আর্মি অফিসারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। র’-এর ফাইলটা পড়তে পড়তে তাঁর কপালে চিন্তার ভাঁজ ফুটে উঠল।

     সেদিকে তাকিয়ে সঞ্জয় প্রশ্ন করল, “মা, এনিথিং রং? সব ঠিক আছে তো?”

     কিছুটা দ্বিধাগ্রস্তভাবে শ্রীমতী গান্ধী উত্তর দিলেন, “খালিস্তান আন্দোলনটা ধীরে ধীরে শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে উঠছে। র’ এর রিপোর্ট বলছে মাসছয়েক পরে দিল্লিতে যে এশিয়ান গেমস হতে চলেছে সেখানে অকালি দলনেতা হরচাঁদ সিংহ লঙ্গোয়াল এবং জার্নেল সিংহ ভিন্দ্রানওয়ালের ‘ধরম যুদ্ধ মোর্চা’ একটা বড়সড় গন্ডগোল পাকাতে চলেছে। দিস ভিন্দ্রানওয়ালে ইজ বিকামিং আ রিয়েল পেইন ইন আর্স!”

     “মা, আমার মনে হয়, হরচাঁদ সিংহ লঙ্গোয়াল আর জার্নেল সিংহ ভিন্দ্রানওয়ালে একদলে থাকলেও এদের উদ্দেশ্য ভিন্ন ভিন্ন। ভিন্দ্রানওয়ালে উগ্রপন্থার মাধ্যমে স্বাধীন খালিস্তান চায়, কিন্তু লঙ্গোয়ালের মতো অপেক্ষাকৃত নরমপন্থীরা সরাসরি স্বাধীন খালিস্তান চায় না, বরং কিছু সায়ত্তশাসন আর কেন্দ্রীয় সরকারের থেকে শিখদের জন্য কিছু বাড়তি সুবিধা আর অধিকার পেলেই ওরা সন্তুষ্ট। লঙ্গোয়াল আলোচনার টেবিলেই বিষয়টা মেটাতে চায়। দুজনের পথ এবং মতোও যখন ভিন্ন ভিন্ন, তখন এদেরকে পৃথক করা কি খুব কঠিন হবে? আর সেটা সম্ভব হলে খালিস্তান আন্দোলনকেও দুর্বল করে দেওয়া সম্ভব হবে।”

     শ্রীমতী গান্ধী মুগ্ধ চোখে তাঁর কনিষ্ঠ সন্তানের দিকে তাকালেন। মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়সেই সঞ্জয় রাজনীতিতে দ্রুত পরিণত হয়ে উঠেছে। তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র রাজীব তো আর রাজনীতির আঙিনায় পা রাখল না, সে আশাও আর তিনি করেন না, রাজীব আর পাঁচটা ভারতীয় উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানের মতো প্লেনের পাইলট হয়ে সারা জীবনটা কাটিয়ে দেবে, হয়তো সে ভাবছে প্লেন চালানোটা বুঝি দারুণ অ্যাডভেঞ্চারের। কিন্তু রাজনীতির চেয়ে বড় অ্যাডভেঞ্চার যে জীবনে হয় না সেই সারসত্যটা রাজীব বুঝল না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখের জল সংবরণ করলেন মিসেস গান্ধী।

    

     ।। ৩ ।।

    

     সঞ্জয় তার প্রিয় বন্ধু জগদীশ টাইটলারের সঙ্গে সেন্ট্রাল ডায়নামো স্টেডিয়ামে পাশাপাশি বসেছিল। জুলাই মাসেও মস্কোয় জম্পেশ ঠান্ডা। এবার অলিম্পিকে ভারতীয় প্রতিনিধি দলের কর্মকর্তা হিসেবেই এসেছে সঞ্জয়, থাকছেও অলিম্পিক ভিলেজেই। আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসনের প্রতিবাদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পঁয়ষট্টিটা দেশ এই ’৮০ সালের মস্কো অলিম্পিক বয়কট করেছে। তাতে সোভিয়েত ইউনিয়ন আর চিনের কিছুটা সুবিধেই হয়েছে, তারা বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় টপাটপ করে সোনার পদক ঘরে তুলছে।

     সামনের সবুজ টার্ফে হকির ফাইনাল ম্যাচ খেলছে ভারত-স্পেন। এই একটা খেলাতেই ভারত ফাইনালে উঠেছে, প্রতিযোগী মাত্র ছ-টা টিমের মধ্যে একটি টিম হয়ে। অস্ট্রেলিয়া, হল্যান্ড, পশ্চিম জার্মানির মতো শক্তিশালী টিম কেউ নেই, পাকিস্তানও নেই। ভারত একাই বাঁশবাগানে শেয়াল রাজা! স্পেনের সঙ্গে খেলাটাও যথেষ্ট বিরক্তিকর খেলছে। মানে স্পেনের মতো দেশও হকিতে ভারতকে টক্কর দিচ্ছে!

     সঞ্জয়ের এই সময়ে একটু অন্যরকমের বিনোদন হলে ভালো হত। সে খেলার মাঠ থেকে দৃষ্টিটা দর্শকাসনের দিকে ঘোরালো। হাত দশেক দূরেই একটা খাসা দেখতে রাশিয়ান মেয়ে বসে আছে। মেয়েটা তখনই মুখ ঘুরিয়ে পিছনে তাকাল। সোনালি চুল, নীল চোখের তারা। বসে থাকলেও বেশ বোঝা যায় তম্বী মেয়েটির শরীরের গড়ন অপূর্ব। সঞ্জয় শিস দিয়ে বলে উঠল, “ওয়াও, ক্রাসিভায়া দেভুশকা!”

     “ইসকা মতলব কেয়া?” পাশ থেকে জগদীশ বলল।

     “কিসকা মতলব?”

     “আরে, রাশিয়ানে যেটা বললি।”

     “খুবসুরত লেড়কি,” একটা ফাজিল হাসি হেসে সঞ্জয় বলল।

     জগদীশও হেসে ফের মেয়েটাকে এক ঝলক দেখল। তখনই একটা চিৎকার শুনে দুজনেই মাঠের দিকে তাকাল। যাঃ ভারত একটা গোল খেয়ে গেল! স্পেনের সমর্থকরা চেঁচাতে শুরু করেছে— ‘এস্পানিয়া আরিবা আরিবা’! আর ঠিক তার পরেই সহজ একটা পেনাল্টি কর্নার থেকে গোল মিস করল ভারতের মহারাজ কৃশান কৌশিক। জগদীশ অক্ষম হতাশায় হাতটা শূন্যে ছুড়ে বলল, “বেহেনচোদ, হামারি দেশ কি আবাদি সৌ কড়োর, অউর এক আচ্ছা প্লেয়ার ইয়া অ্যাথলিট নেহি বনা সকতা!”

     “হবেটা কী করে শুনি,” সঞ্জয় সুন্দরী মেয়েটার দিকে ইশারা করে বলল, “জগদীশ, অগর তেরা বাচ্চা ইয়ে দেভুশকা কি কোক সে নিকলেগা তো তন্দুরস্ত হোগা, অ্যাথলিট বন সকতা।”

     খানিকক্ষণ পরে সোধি, শাহিদ আর কৌশিকেরা তেড়েফুঁড়ে খেলে ম্যাচটা ৪-৩ ফলাফলে জিতে নিল। অলিম্পিকে ভারতের সোনাজয়ের মুহূর্তটায় সঞ্জয় আর জগদীশ পরস্পরকে জড়িয়ে ধরল।

     সঞ্জয় বলল, “ভারতকে এবার শক্তিশালী অ্যাথলিট তৈরি করতে হবে। তার জন্য দরকার তন্দুরস্ত বাবা আর মা। পরিবার ছোট হতে হবে, দুয়ের বেশি বাচ্চা হলে চলবে না। বুঝলি জগদীশ, আমার ’৭৬ সালের জবরদস্তি নাসবন্দির প্রকল্পটা আবার চালু করতে হবে।”

     “ইউ মিন ভ্যাসেক্টমি? ম্যাডাম রাজি হবেন? প্রায় চার বছর ক্ষমতার বাইরে থাকার পর কিন্তু কংগ্রেস ক্ষমতায় ফিরেছে। ওয়ান রং স্টেপ অ্যান্ড উই কুড গেট ইন ট্রাবল!” জগদীশ বলল।

     “মাকে আমি রাজি করাবো। ফাইন্ড বেস্ট ব্রেইনস ইন দ্য সেক্রেটারিয়েট টু ড্রাফট দিস বিল। মোটামুটি আমি যেরকম ভেবেছি— কোনও পরিবারের কর্তা অর্থাৎ বাবার রেশন কার্ডে ছেলেমেয়ের সংখ্যার উল্লেখ থাকবে। যদি দুইয়ের বেশি বাচ্চা হয় তবে রেশন তো পাবেই না, হাসপাতালের দাতব্য চিকিৎসা আর ছেলেমেয়ের জন্য অবৈতনিক সরকারি স্কুলের সুবিধাও বন্ধ হয়ে যাবে। দারিদ্র‍্যসীমার নিচে হলে নাসবন্দির খরচ সরকার দেবে, উপরে হলে পঞ্চাশ শতাংশ ইনকামবেন্ট দেবে বাকি পঞ্চাশ শতাংশ ভর্তুকি হিসেবে সরকার দেবে। নাসবন্দির টাকা যা যৎসামান্য লাগবে তা ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ পাওয়া যাবে। ডাক্তারদের জন্যও জাতীয় অ্যাওয়ার্ড থাকবে, যে সবচেয়ে বেশি নাসবন্দি করবে সে ‘সুশ্রুত’ পুরস্কার পাবে।”

     “কিন্তু ’৭৬ সালে কী পরিণতি হয়েছিল মনে আছে তো?”

     “মাই ডিয়ার ফ্রেন্ড জগদীশ, থিংস চেঞ্জ, মেন চেঞ্জ, দেয়ার ভিউজ চেঞ্জ। এখন জনতা পার্টি নেই, জনমোর্চা নেই। তাদের বদলে বিজেপি এসেছে, যারা হিন্দুবাদী দল। তাদের মতামত আলাদা।”

     “মানে?” ঠিক বুঝলাম না,” জগদীশ বিভ্রান্ত চোখে তাকাল।

     “আমরা, মানে কংগ্রেস, ধর্মনিরপেক্ষ দল। আমাদের ধারণা ছিল গ্রামীন নিম্নবিত্ত মানুষ, যাদের মধ্যে শিক্ষার প্রসার ঘটেনি, তাদের মধ্যে বেশি সংখ্যক সন্তান উৎপাদনের প্রবণতা বেশি। নাসবন্দির প্রকল্প মূলত তাদের মধ্যে নিয়ে যেতে হবে। বিজেপিও এই লাইনেই ভাববে শুধু নয়, দে আর ওয়ান স্টেপ অ্যাহেড। ওই দল মনে করে একটি বিশেষ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে সন্তান উৎপাদনের প্রবণতা বেশি। তাই নাসবন্দি বিল আনলে বিজেপি বাধা দেবে না। বিল আনার আগে যুব কংগ্রেসের সদস্যদের দিয়ে গ্রামেগঞ্জে প্রচার চালাতে হবে। আমি একটা পাঞ্চলাইন ভেবেছি— ‘নাসবন্দি কর লে, আপনে দো বাচ্চোঁ কো আচ্ছে জিন্দেগি দে।’

     “কিন্তু বিল পাস করাতে সাংসদদের সিম্পল মেজরিটির ভোট লাগবে। সেটা কি পাওয়া যাবে?”

     “জগদীশ, ভুলে যাস না, লোকসভায় আমাদের ৩৫৩টা এমপি, যা বিল আনব সব পাস হয়ে যাবে। বামপন্থী আর জনতা পার্টির সাংসদরা হয়তো বাধা দেবে কিন্তু তাতে কিস্যু যায় আসে না। নাসবন্দি আইন আমি ঠিক চালু করে দেব,” সঞ্জয় আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল, “ডোন্ট ওয়রি, তুই এখন বল দেখি আজ রাতে ওই সোনালি চুলের দেভুশকার সঙ্গে শুবি কিনা?”

     “সঞ্জয়, তুই কি আবার একটা ঝামেলায় পড়তে চাস?” মনে আছে বারো বছর আগে কী ঘটেছিল?” জগদীশ নীচু গলায় বলল, “সেবার বিমলা গুজরালজী তোকে কেচ্ছার হাত থেকে বাঁচিয়ে ছিলেন।”

     এই প্রথম সঞ্জয়কে একটু অপ্রতিভ দেখাল। তবু স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করে বলল, “ওই চ্যাপটার ক্লোজ হয়ে গেছে। মেয়েটার মুখটা বন্ধ করে দিয়েছি, প্রকাশ্যে আর কোনওদিন কিছু বলতে আসবে না। তা ছাড়া সেও মুভ অন করে গেছে জীবনে, তারও তো এখন নিজস্ব পরিবার হয়েছে, স্বামীসন্তান হয়েছে। সে আর এখন মুখ খুলবে না।”

     “বাট হোয়াট অ্যাবাউট দ্য কিড, দ্যাট লিটল গার্ল?”

     সঞ্জয় চুপ করে মাথা নীচু করল। পাপ যে বাপকেও ছাড়ে না! অতীতের ছায়া দীর্ঘতর হয়ে বর্তমানকে ঢেকে ফেলে। তখন মানুষের জীবনে গ্রহণ লেগে অন্ধকার নেমে আসে।

     “ও এখন কোথায় আছে জানিস?” সঞ্জয় নীচু গলায় প্রশ্ন করে।

     “কে? বাচ্চাটা?”

     “হ্যাঁ।”

     “এখন আর বাচ্চা বলা যায় না। এগারো বছর বয়স হল,” জগদীশ সঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “শীলা সিং পল নামের একজন মহিলা ডাক্তার ওকে অ্যাডপ্ট করেছেন। নতুন ফস্টার পেরেন্টসের কাছে শুনলাম ভালোই আছে।”

     “কী… কী নাম রেখেছে ওর?”

     “প্রিয়া… প্রিয়া সিং পল।”

    

     ।। ৪ ।।

    

     সঞ্জয় তাঁর বন্ধু জগদীশ টাইটলার ও কমল নাথকে নিয়ে বার্লিন এয়ারপোর্টের বাইরে এসে দেখল তাদের জন্য একটা নীল রঙের ফক্সভাগেন ডার্বি গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। বার্লিন এয়ারপোর্ট থেকে ফক্সভাগেনের হেডকোয়ার্টার উলফসবার্গ প্রায় ১৭০ কিলোমিটার। গাড়ি চেপে সরাসরি সেখানেই কোম্পানির অতিথিশালায় গিয়ে উঠবে সঞ্জয় ও তাঁর বন্ধুরা। ফক্সভাগেনের চেয়ারম্যান ড. কার্ল হর্স্ট হানের অতিথি হিসেবে তিনজন বার্লিনে পা রেখেছে, এই ভ্রমণ কোনও সরকারি ভ্রমণ নয়, তেমন কোনও নথিও কোথাও রাখেনি সঞ্জয়। পিএমও-তে কেউ সেভাবে জানে না তার এই জার্মানী ভ্রমণের কথা।।

     উলফসবার্গে কোম্পানির অতিথিশালায় পৌঁছে সঞ্জয় একটু ঘুমিয়ে জেটল্যাগটা কাটিয়ে নিল। সন্ধে সাতটায় ডিনার আছে কার্ল হানের সঙ্গে, সেখানেই মারুতি উদ্যোগের সঙ্গে ফক্সভাগেনের কোলাবোরেশানের পেপারসে সইসাবুদ হবে। কিন্তু তার আগে সঞ্জয়কে অন্য কিছু ভাবাচ্ছে। তাঁর কপালে চিন্তার ভাঁজ আরও গভীর হচ্ছে, ঘনঘন সে বেডরুমের বেডসাইড টেবিলে রাখা টেলিফোনটার দিকে তাকাচ্ছে। সম্ভবত কোনও টেলিফোনের প্রতীক্ষা করছে।

     হঠাৎ টেলিফোনটা বেজে উঠতেই জগদীশ টাইটলার আর কমলনাথ তাদের বন্ধুর দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। সঞ্জয় ওদের আশ্বস্ত করে এগিয়ে গিয়ে ফোনের রিসিভারটা তুলে কানে ঠেকিয়ে বলল, “হ্যালো।”

     ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে এল, “গুটেন টাগ। ইখ বিন জোনাস ডপলার।”

     “হ্যাঁ, অনুরাগ শুক্লা আপনার কথা বলেছিল। ইউ সার্ভড জার্মান আর্মড ফোর্স, ভেয়ারমাক্সট, ইজন্ট ইট?”

     “হ্যাঁ, আমি জার্মান এয়ার ফোর্স লুফ্তওয়েফ-এ সার্ভ করেছি। এখন হেকলার অ্যান্ড কখের কনসালট্যান্ট হিসেবে কাজ করি।”

     “মিঃ ডপলার, আমাদের কি দেখা হওয়া সম্ভব?” সঞ্জয় বুকে একটু দম টেনে নিয়ে বলে, “ধরুন, আজ রাত ন’টা নাগাদ, আমাদের ফক্সভাগেনের গেস্টহাউসে যদি আসেন… মানে, শুক্লা নিজে গিয়ে আপনাকে এখানে নিয়ে আসবে।”

     “ওক্কে। আউফ ভিডাজেন।”

     ওপাশ থেকে ফোনটা কেটে যেতেই সঞ্জয় প্রবল উত্তেজনা নিয়ে তাকাল জগদীশ আর কমলনাথের দিকে। দুজনের চোখই উৎসাহে জ্বলজ্বল করে উঠল। তিনবন্ধু মিলে এই প্রথম দারুণ কিছু একটা করতে চলেছে। মারুতি-ফক্সভাগেনের মার্জারের থেকেও বড় কিছু। হয়তো লার্জার দ্যান লাইফ।

    

     সন্ধে সাতটা নাগাদ কার্ল হানের স্পেশাল ব্যাঙ্কোয়েট ডিনারে হাজির হল তিনবন্ধু। মারুতি আর ফক্সভাগেনের জয়েন্ট ভেঞ্চারের সূচনার মুহূর্তটি স্মরণীয় করে রাখতে দামি সিঙ্গল মল্ট স্কচ হুইস্কি ঢালা হল পানপাত্রে। মেমোরেন্ডাম অফ এগ্রিমেন্ট অনুযায়ী ফক্সভাগেন ১৯৮২ সালে মারুতির ২৬ শতাংশ মালিকানা কিনে নিয়ে তাদের যৌথ ব্যাবসা শুরু করছে ভারতে। তাদের প্রযুক্তি দিয়ে গুরগাঁওয়ের ফ্যাক্টরিতে মারুতি-ফক্সভাগেনের প্রথম দুটি মডেল— মারুতি ৮০০, যা মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য, এবং মারুতি ডয়েশ, যা উচ্চবিত্ত মানুষের জন্য, তা নির্মাণ করতে তারা সাহায্য করবে। চুক্তি অনুযায়ী পাঁচবছর পর ১৯৮৭ সালে মারুতিতে ফক্সভাগেনের শেয়ার বেড়ে হবে ৪০ শতাংশ এবং তারও পাঁচ বছর পর ১৯৯২ তে তাদের শেয়ার বেড়ে দাঁড়াবে ৫০ শতাংশে।

     শিল্পক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর বিষয়টা নিয়ে সঞ্জয় তার মা শ্রীমতী গান্ধীর সঙ্গে দীর্ঘদিন আলোচনা করেছে। সরকারের পক্ষে জনকল্যাণমুখী কাজকর্ম থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পুঁজির বিনিয়োগ বাড়িয়ে ইস্পাত বা মোটর শিল্পের মতো রুগ্ন শিল্পগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলা সম্ভব নয়, আর সেটা উচিতও নয়, সেটা করলে দেশের কৃষি, পানীয় জল, সড়ক যোজনা, স্বাস্থ্যের মতো সাধারণ মানুষের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলো অবহেলিত হবে। তাই শিল্পক্ষেত্রে বেসরকারি পুঁজির বিনিয়োগ অবশ্যম্ভাবী। সেজন্য দেশীয় পুঁজির পাশাপাশি বিদেশি পুঁজিকেও শিল্পক্ষেত্রে সাদরে আমন্ত্রণ জানানো উচিত। সঞ্জয় জানে, তার দাদুর মতো সোভিয়েত ইউনিয়ন বা চিনের মতো সমাজতান্ত্রিক দেশের সঙ্গে গা ঘষাঘষি করেও লাভ নেই, তাতে দেশের উন্নয়ন ব্যাহত হবে। সে তার মাকে বারবার বুঝিয়েছে, অর্থমন্ত্রী পদে এমন একজন মানুষকে দরকার যিনি শুধু প্রণব মুখার্জির মতো বিদ্বানই নন, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের বিষয়ে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হবেন। সঞ্জয়ের চোখে এই মুহূর্তে এমন একজন রয়েছেন। তিনি অবশ্য এই মুহূর্তে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর পদে বহাল আছেন, তাঁর নাম ড. মনমোহন সিংহ।  

     সঞ্জয়দের চুক্তিপত্র দেখে কার্ল হান যথেষ্ট খুশি, সে দ্রুত চুক্তিপত্রে ফক্সভাগেনের পক্ষে সই করে দিল। মারুতি উদ্যোগের পক্ষে ম্যানেজিং ডিরেক্টর সঞ্জয় গান্ধী চুক্তিপত্রে সই করল। জগদীশ টাইটলার ও কমলনাথেরা সাক্ষী হিসেবে সই করল। উভয়পক্ষই খুশি, সইসাবুদ শেষ হওয়ার পর সাত কোর্সের ডিনার এল। কিন্তু ডিনার টেবিলে বসে সঞ্জয় যেন ঈষৎ উসখুস করছে। দ্রুত ডিনার শেষ করে ন’টা বাজার মিনিট বিশেক আগে তিনজনই ফক্সভাগেনের চেয়ারম্যান কার্ল হানকে বিদায় জানিয়ে তাদের গেস্টহাউসে ফিরে এল।

     পাঁচ মিনিটের মধ্যেই তাদের গেস্টহাউসের ঘরের দরজার বেলটা বেজে উঠল। টাইটলার গিয়ে দরজা খুলতেই দেখতে পেল দরজায় দুজন লোক দাঁড়িয়ে রয়েছে। প্রথমজন মাঝারি উচ্চতার, ঈষৎ স্থুলকায় এবং খাঁটি ভারতীয়। নাম অনুরাগ শুক্লা। তার পিছনে দাঁড়িয়ে এক দীর্ঘকায় চেহারার মাঝবয়সি জার্মান সাহেব। বলাবাহুল্য ইনিই মিঃ জোনাস ডপলার। দুজনে ঘরে প্রবেশ করতেই সঞ্জয় তাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে ঘরের দামি চামড়ায় মোড়া সোফায় বসতে বলল।

     অনুরাগ শুক্লা হাসিখুশি মোটাসোটা চেহারার মানুষ, সে এগিয়ে এসে সঞ্জয়ের দুটি হাত ধরে বলল, “সঞ্জয়স্যার, আপ ক্যায়সে হো? আপকা মাতাজী কো হমারা পরনাম কহেনা, উনকো বোলিয়েগা কি ম্যায় উনকি বড়া ফ্যান হুঁ।”

     সঞ্জয় মৃদু হেসে মাথা নাড়ল। বসার ঘরের সেন্টার টেবিল ঘিরে পাঁচজন মানুষ এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় বসল।

     সঞ্জয় গান্ধী প্রথম বলতে শুরু করল, “ভারতীয় সামরিক বাহিনীর কাছে ভালো অ্যাসল্ট রাইফেল নেই, আমরা পাকিস্তান আর চিনের বিরুদ্ধে সাবেক আমলের .৩০৩ বোল্ট অ্যাকশন রাইফেল দিয়ে লড়েছি। সামান্য কিছু কালাশনিকভ-৪৭ এবং মাইক্রো উজি সাব-মেশিনগান রয়েছে যা একেবারেই যথেষ্ট নয়। তা ছাড়া আমাদের দেশের অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরিগুলোর উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করা যায় না, ভালো বন্দুক তৈরি করার জন্য তাদের মডার্নাইজেশন দরকার, পশ্চিমের দেশগুলোর মতো আধুনিক প্রযুক্তি দরকার। তাই আমরা ভাবছি নতুন অ্যাসল্ট রাইফেল কিনব আপনাদের কাছ থেকে। আপনি কোন ধরনের আর্মস সাজেস্ট করেন আমাদের মিলিটারির জন্য?”

     লালমুখো জার্মান সাহেব ডপলার এতক্ষণে মুখ খুলে বলল, “হেকলার অ্যান্ড কখের অনেক রকমের অ্যাসল্ট রাইফেল আছে তবে আমি জি-১১ সাজেস্ট করব। ব্যারেল লেংথ, রেট অফ ফায়ার, মাজল ভেলোসিটি সবই বেশ ভালো। কতগুলো নেবেন?”

     “প্রথমে আপাতত এক লক্ষ অ্যাসল্ট রাইফেল নেব, আমাদের দেশের আর্মির জন্য। কিন্তু মিঃ ডপলার… এই আর্মস ডিলের থ্রি পার্সেন্ট কাট আমি নেব, জগদীশ আর কমল ওয়ান পারসেন্ট ইচ। শুক্লার কমিশন আপনি আলাদা করে দেবেন। তবে আমার টাকাটা শুক্লার মাধ্যমে নেব। আমার সুইস ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট নম্বর শুক্লাই আপনাকে বলে দেবে।”

     এক লক্ষ অ্যাসল্ট রাইফেলের অর্ডার শুনে ডপলার একটা ঢোঁক গিলল। এতটা প্রথমবারে সে আশা করেনি, তা ছাড়া সঞ্জয়ের পরিচয় ও ক্ষমতা নিয়েও তার আগাম কোনও ধারণা ছিল না। একটু চিন্তিত হয়ে সে বলল, “কিন্তু ভারতের ডিফেন্স মিনিস্ট্রির টেন্ডারে কিরকম কোট করব…”

     সঞ্জয় তাকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলে, “চিন্তা করবেন না, আমি সবকিছু দেখে নেব। এই যে দেখছেন আমার দুই বন্ধু মিঃ জগদীশ টাইটলার ও মিঃ কমল নাথ, ওরা সবকিছু ম্যানেজ করবে। ডোন্ট ওয়রি, আপনি শুধু একটা এক্সপ্রেশন অফ ইন্টারেস্ট পাঠিয়ে দেবেন। বাদবাকি সব ঝামেলা আমি দেখে নেব। মনে রাখবেন, ইনভয়েস ভ্যালুর থ্রি পার্সেন্ট কাটমানি যেটা আমি নেব, সেটা ওয়ার্ক অর্ডার হাতে পাওয়ার পর দেড় পার্সেন্ট দেবেন আর বাকি দেড় পার্সেন্ট অস্ত্র ডেলিভারি দিয়ে ফাইনাল বিল পাওয়ার পর দিতে হবে।”

     এমন একটা ডিল ফাইনাল হওয়ার পর জার্মান বিয়ারের মগ হাতে সবাই টোস্ট করল। ডপলার হেসে বলল, “মিঃ গান্ধী আপনার সঙ্গে কাজ করে মনে হচ্ছে আনন্দ পাব। উই উইল হ্যাভ আ গ্রেট রাইড টুগেদার।”

     ইতিমধ্যে সঞ্জয়ের বন্ধু জগদীশ ঘরের রেকর্ড প্লেয়ারে একটা লং প্লেয়িং রেকর্ড চালিয়ে ঘরের সবাইকে আহ্বান জানিয়ে বলল, “পার্টি শুরু হোক। লেটস ডান্স!”

    

     লং প্লেয়িং রেকর্ড থেকে তখন পশ্চিম জার্মানির বিখ্যাত ইউরো-ক্যারিবিয়ান পপ সঙ্গীত ব্যান্ড ‘বনি এম’-এর গান ভেসে আসতে শুরু করেছে— ‘আয়াম ক্রেজি লাইক আ ফুল, ওয়াইল্ড অ্যাবাউট ড্যাডি কুল… ড্যাডি, ড্যাডি কুউউল!’

     ঘরের পাঁচজন মানুষ তাদের জীবনের একটা বড় সাফল্য সেলিব্রেট করতে উদ্দাম নাচ শুরু করেছে। বেশির ভাগ কাজে একপক্ষ লাভবান হলে অন্যপক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কিন্তু এই গেস্ট হাউসের ঘরে খানিক আগে যে বন্দোবস্ত হল তাতে ঘরে উপস্থিত পাঁচজনই লাভবান হবে, কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। এমন সুখের দিন যে বড় কমই আসে জীবনে!

     নাচানাচির মধ্যেই হঠাৎ যেন ঘরের টেলিফোনটা একবার বেজে উঠল। সঞ্জয় সামনে গিয়ে ফোনের রিসিভারটা কানে তুলতেই ফোনের ওপাশ থেকে একটা বিশ্বস্ত কণ্ঠ ভেসে এল, “ভিন্দ্রানওয়ালের একটা অ্যান্টিডোট খুঁজে পাওয়া গেছে। পুরোনো পাপী, আপনি চিনবেন।”

     সঞ্জয় গান্ধীর মুখে এক অপার্থিব হাসি ফুটে উঠল, “তাহলে নেক্সট অপারেশন শুরু করে দাও। অপারেশন ভিন্দ্রানওয়ালে।”

    

     ।। ৫ ।।

    

     লম্বাচওড়া প্রৌঢ় মানুষটা একা একা সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিলেন তাঁর গাঁয়ের দিকে। অমৃতসর থেকে চোদ্দো কিলোমিটার দূরে তাঁর গ্রাম খিয়ালা। রাত প্রায় ন’টা বাজে, এবার নভেম্বরের শেষেই অমৃতসরে বেশ হাড়কাঁপানো ঠান্ডা পড়ে গেছে। মানুষটা অবশ্য প্রাক্তন ফৌজি, তাঁর সাতান্ন বছরের শরীরটা পুরোনো হলেও এখনও অফুরন্ত শক্তির আধার, তাই চট করে ঠান্ডা লাগে না। তবু এতটা রাত করা ঠিক হয়নি। পথঘাটের ভয়বিপত্তি নিয়ে তিনি আদৌ উদ্বিগ্ন না হলেও তাঁর বাড়ির মানুষগুলো তো তাঁর পথ চেয়ে বসে আছে, তারা তো উদ্বিগ্ন হচ্ছে। আসলে আজ ধরম যুদ্ধ মোর্চার জার্নেল সিংহ ভিন্দ্রানওয়ালের সঙ্গে গোপন বৈঠক সারতে অনেকটা রাত হয়ে গেল। অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির হরমন্দির সাহিবের কাছেই অকাল তখ্ত সাহিবে বসেছিল আজকের গোপন বৈঠক। সেই বৈঠকে ধরম যুদ্ধ মোর্চার নেতা ও ধর্মযোদ্ধা মিলিয়ে তিরিশ জনের কোর কমিটির সদস্যরা উপস্থিত ছিল। জার্নেল চায় তিনি মোর্চার সদস্যদের অস্ত্রশিক্ষা দিন। কথায় কথায় তাঁর ফৌজি জীবনের কথা উঠে এসেছিল। তখনই জার্নেল বলল, “ওয়াহে গুরুজী চান, আপনি ফৌজে থাকার সময় ‘৭১ সালে যেভাবে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধাদের ট্রেনিং দিয়েছিলেন, সেভাবে আমাদের ধরম যুদ্ধ মোর্চার ধর্মযোদ্ধাদের ট্রেনিং দিন। তারা আপনার প্রশিক্ষণে এক একজন বড় যোদ্ধা হয়ে উঠুক, আমাদের ধর্মযুদ্ধে বীরের মতো লড়াই করে পাঞ্জাবের বুকে স্বাধীন খালিস্তান কায়েম করুক।”

     গোপন বৈঠকের আলোচনার সিদ্ধান্তের তিনি বিরোধিতা করেননি। তাঁর মৌনতাই যে রাজি হওয়ার লক্ষণ সেটা জার্নেল সিংহ ভিন্দ্রানওয়ালে বুঝতে পেরেছিল। কিন্তু তাঁর মনের ভিতর যে তখন এক তুফান উঠেছিল তা কেউ টের পায়নি। সেই তুফান শান্ত হতে এক সর্বগ্রাসী বিষণ্ণতা যেন তাঁকে গ্রাস করে নিচ্ছিল। তিনি, মেজর জেনারেল শাহবেগ সিংহ, ভারতীয় সেনাবাহিনীর পরম বিশিষ্ট সেবা মেডেলপ্রাপ্ত প্রাক্তন ফৌজি, তিনি কিনা উগ্রপন্থী খলিস্তানিদের প্রশিক্ষণ দেবেন! তিনি একজন দেশপ্রেমিক যোদ্ধা হয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পাশে দাঁড়াবেন? ভাবনাটা তাকে প্রাথমিকভাবে হতাশায় ডুবিয়ে দিলেও পরক্ষণেই যেন বুকের ভিতর এক ক্ষোভের স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠেছিল। তিনি প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলে উঠেছিলেন। যে দেশের জন্য তিনি ফৌজি হয়ে চৌত্রিশটা বছর লড়ে গেছেন প্রাণ তুচ্ছ করে, সেই দেশ তাঁকে কী দিল! তাঁর অবসরগ্রহণের মাত্র একদিন আগে তাঁকে চাকরি থেকে সাসপেন্ড করে দিল! মিথ্যা দুর্নীতির অভিযোগে তাঁর মাথায় কলঙ্কের দাগ এঁকে দিল!

     অন্ধকারে সাইকেল চালাতে চালাতে তাঁর মনের মধ্যে ফের সেই হতাশা ফিরে এল। চৌত্রিশ বছরের কষ্টের ফৌজি জীবনে তিনি কী প্রতিদান পেলেন দেশের কাছ থেকে? ভারাক্রান্ত হৃদয়ে সাইকেল চালাতে চালাতে তাঁর হঠাৎ মনে হল কীসের যেন শব্দ শুনতে পেলেন। সাইকেল থামিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকাতেই দেখলেন দূরে একটা মোটরগাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। তাঁকে পিছন ফিরে তাকাতে দেখেই গাড়িটার হেডলাইট দুটো নিভে গেল। অনেকক্ষণ ধরে কি গাড়িটা তাঁকেই অনুসরণ করছে? গাড়ির ভিতর কারা বসে আছে?

     শাহবেগ সিংহ যেন কিছুটা আন্দাজ করতে পারছেন। বছরখানেক আগে মিলিটারি থেকে তাঁকে বরখাস্ত করার অর্ডারকে চ্যালেঞ্জ করে তিনি মামলা করেছেন। তিনি জানেন কুমায়ুন রেজিমেন্টের কম্যান্ডার জেনারেল রায়নার ঘুষ নেওয়ার বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার হয়েছিলেন বলে তাঁকে এই লাঞ্ছনা সহ্য করতে হচ্ছে। তাঁর অবসরগ্রহণের মাত্র একদিন আগে তাঁর বিরুদ্ধেই ঘুষ নেওয়ার মিথ্যে অভিযোগ এনে তাঁকে সাসপেন্ড করে তাঁর পদকগুলি কেড়ে নিয়ে তাঁকে কলঙ্কিত করেছে শ্রীমতী গান্ধীর কংগ্রেস সরকার। আসলে তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছিল আরও আগেই। ‘৭৩ সালে যখন জয়প্রকাশ নারায়ণের আন্দোলন শ্রীমতী গান্ধীর কংগ্রেস সরকারের ভিত নড়িয়ে দিয়েছিল, তখন পুলিশের উপর ভরসা হারিয়ে সরকার ভারতীয় আর্মির শাহবেগ সিংহকে আদেশ করে জয়প্রকাশ নারায়ণকে গ্রেফতার করার। শাহবেগ তখন বিহারেই পোস্টেড ছিলেন, কিন্তু তিনি সরকারের আদেশ অমান্য করে জয়প্রকাশকে অ্যারেস্ট করতে অস্বীকার করেন। ষড়যন্ত্র তখনই শুরু হয়ে যায়।

     শাহবেগ সিংহ আরেকবার গাড়িটাকে দেখে নিয়ে সাইকেলের প্যাডেল চেপে তাঁর বাড়ির দিকে এগিয়ে চলেন। তাঁর মনের মধ্যে এক অশুভ চিন্তা উঁকি দিয়ে যায়। তিনি খিয়ালা গ্রামে তাঁর হাভেলির দিকে দ্রুত এগিয়ে যান। কিছুদূর যাওয়ার পর তাঁকে অনুসরণ করে আসা গাড়িটার আর হদিশ পান না।

     রাত তখন প্রায় সাড়ে দশটা। শেষ নভেম্বরের রাতে একটা ঠান্ডা কুয়াশার চাদর জড়িয়ে ধরেছে গোটা খিয়ালা গ্রামটাকে। এমনিতে খিয়ালা অবস্থাপন্ন চাষীদের গ্রাম। অনেক রাত পর্যন্ত বাড়ির দাওয়ায় খাটিয়ায় বসে আড্ডা দেয় গাঁয়ের মানুষ। বাড়ির মেয়েরা হেঁশেলের চুল্লিতে গরম গরম রোটি সেঁকে, চিকেন ভুনা করে। পুরুষেরা অনেকে মদ্যপান করে, গল্পগুজব করে অনেক রাত পর্যন্ত। গোটা পরিবার একসঙ্গে বসে রাতের খাবার খায়। কিন্তু আজ যেন কিঞ্চিৎ সুর কেটেছে। সমস্ত গ্রামে একটা সন্নাটা ছেয়ে আছে, একজন পুরুষও দাওয়ায় লাগানো খাটিয়ায় বসে নেই, মেয়েদের হেঁশেলের চুলা জ্বলছে না। সবাই যেন আগেই ঘরের ভিতর সেঁধিয়েছে। কোথাও একটা বেওয়ারিশ কুকুরও ডাকছে না।

     নিজের বাড়ির বাইরের লোহার গেটটা খুলে ভিতরে ঢুকেও বাইরের খাটিয়ায় কাউকে দেখতে পেলেন না। একতলার সারিবদ্ধ ঘরগুলোর ভিতর থেকেও কোনও শব্দ ভেসে আসছে না, অদ্ভুত একটা থমথমে পরিবেশ। শাহবেগের বুকটা কেঁপে উঠল। তিনি ভেজানো দরজাটা ঠেলে বসার ঘরটায় ঢুকতেই দেখতে পেলেন স্ত্রী আর পরিবারের লোকজন থমথমে মুখে ঘরের মেঝেতে বসে আছে। একজন মহিলা হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠলেন, “সিবিআইওয়ালে আঈ সি। উহা গুড্ডি নু আপনে নালা লাই গয়ে। উসে নু পুছতাছ করনা লাঈ।”

     সাংঘাতিক ব্যাপার! গুড্ডিকে ইন্টারোগেট করার জন্য সিবিআই তুলে নিয়ে গেছে! তাও তাঁর নিজের আর্মির কেসটার জন্য! কথাটা শুনেই শাহবেগ সিংহ শিউরে উঠলেন। বজ্রাহতের মতো ধপাস করে মেঝের উপর বসে পড়লেন। বাড়ির মানুষগুলোর উদ্বিগ্ন মুখগুলোর দিকে তাকালেন। ওই ভয়ে শুকিয়ে যাওয়া মুখগুলোর দিকে তিনি আর তাকাতে পারছেন না। জীবনে এই প্রথমবার তাঁর নিজেকে যেন অপরাধী মনে হচ্ছে!

    

     ।। ৬ ।।

    

     শাহবেগ সকাল এগারোটার মধ্যেই সিবিআই দপ্তরে পৌঁছে গিয়েছিলেন। তাঁকে একটা আধো অন্ধকার ঘরে বসিয়ে গেল একজন জুনিয়র অফিসার। মাথার ওপর একটা তীব্র আলো জ্বলছে। যাওয়ার সময় লোকটাকে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, “গুড্ডি কঁহা হ্যায়?”

     লোকটা কোনও উত্তর না দিয়ে চলে গেল। শাহবেগ গোটা ঘরটায় একবার চোখ বোলালেন। ঘরের তিনদিকের দেয়ালে সাদামাটা চুনকাম করা। চতুর্থ দেয়ালটা জুড়ে মস্ত এক আয়না। শাহবেগ খুব ভালো করেই জানেন ওই আয়না লাগানো দেয়ালটা আসলে স্বচ্ছ। ওর পিছন থেকে এই ঘরের ভিতরটা পরিষ্কার দেখা যায়, এই মুহূর্তে ওই আয়নার পিছন থেকে কয়েকজোড়া চোখ তাঁর উপর নজর রাখছে।

     খানিকক্ষণ পরে দরজা খুলে ঘরে যে দুজন প্রবেশ করলেন তাদের মধ্যে দ্বিতীয়জনকে দেখে শাহবেগ চমকে উঠলেন। এই মুহূর্তে ভারতের দ্বিতীয় ক্ষমতাশালী ব্যক্তিত্ব হলেন এই ব্যক্তি। সঞ্জয় গান্ধী। প্রথমজন উলটোদিকের চেয়ারে বসে নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, “হ্যালো, আমি জে এস বাজওয়া, সিবিআই ডিরেক্টর।”

     সঞ্জয় গান্ধী চেয়ারে বসল না। টেবিলের পিছনের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। শাহবেগ দেখলেন সঞ্জয় তাঁরই দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অদ্ভুত কঠিন দৃষ্টি দুচোখে, কিছুটা যেন নৃশংসও। ওই চোখের দিকে তাকিয়ে শাহবেগ বুঝতে পারছে এদের হাতে গুড্ডি মোটেই নিরাপদ নয়। গুড্ডি এখন কোথায় আছে কে জানে।

     “গুড্ডি ইজ ইন সেফ হ্যান্ড মেজর জেনারেল।”

     শাহবেগ সিংহ চমকে তাকালেন সঞ্জয় গান্ধীর দিকে। এই লোকটা কি মনের কথা পড়তে পারে! কিন্তু তাঁকে কী করতে হবে? কী করলে এরা গুড্ডিকে ছেড়ে দেবে? শাহবেগ তো ইতিমধ্যেই কলঙ্কিত ও বরখাস্ত এক সামরিক অফিসার। তা ছাড়া সিবিআই তাঁর বিরুদ্ধে আনা দুর্নীতির তদন্ত তো করছেই, হয়তো কিছুদিনের মধ্যে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে চার্জশিটও পেশ করবে। এই অবস্থায় গুড্ডিকে কিডন্যাপ করে এদের কী লাভ হবে?

     “জার্নেল সিংহ ভিন্দ্রানওয়ালের সঙ্গে আপনার যোগাযোগটা কী রকমের?” বাজওয়া প্রথম প্রশ্নটা করলেন।

     শাহবেগ নড়েচড়ে বসলেন। এবার ছবিটা যেন তাঁর আছে ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে। তিনি বললেন, “জার্নেলকে পাঞ্জাবের মানুষ যেমন চেনে, আমিও তেমনই চিনি। সে শিখদের দমদমি তকসলের চতুর্দশ জাঠেদার। খালিস্তান আন্দোলনের নেতা, ব্যস, এটুকুই জানি।”

     “আর ধরম যুদ্ধ মোর্চার সঙ্গে আপনার সম্পর্কটা কী?” এবার সঞ্জয় মুখ খুলল।

     “আমার কোনও সম্পর্ক নেই। তবে আমি যতদূর জানি ধরম যুদ্ধ মোর্চা যৌথভাবে শিরোমণি অকালি দলের সঙ্গে আনন্দপুর সাহিব রেজোল্যুশন ইমপ্লিমেন্ট করতে চায়…”

     “আপনি নিশ্চিত যে জার্নেল সিংহ ভিন্দ্রানওয়ালে আনন্দপুর সাহিব রেজোল্যুশনকে বাস্তব রূপ দিতেই অকালি দলের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে?” বাজওয়া বললেন।

     “হ্যাঁ, আমার তো তাই মনে হয়,” কথাটা বলে শাহবেগ তাঁর শুকনো ঠোঁট চাটলেন। মনের মধ্যে তাঁর তোলপাড় চলছে, গুড্ডি কোথায়?

     “জেনারেল শাহবেগ সিংহ, আনন্দপুর সাহিব রেজোল্যুশনের কোথাও স্বাধীন খালিস্তানের উল্লেখ নেই। উনশশো তিয়াত্তর সালে যখন আনন্দপুর সাহিব রেজোল্যুশন গ্রহণ করা হয় তখন বার্নালা, তোহরা, বলবন্ত সিংহ এঁরা কেউ স্বাধীন খালিস্তানের কথা বলেননি, কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করে সংযুক্ত রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যেই শিখদের জন্য আরও বেশি ক্ষমতা চেয়েছিলেন ওঁরা। এমনকি এখন এই উনিশশো তিরাশি সালে দাঁড়িয়েও অকালি দলনেতা হরচাঁদ সিংহ লঙ্গোয়ালও স্বাধীন খালিস্তানের দাবি করেননি। কিন্তু ভিন্দ্রানওয়ালে ধরম যুদ্ধ মোর্চা গঠন করে রাষ্ট্রের সঙ্গে লড়াই করে স্বাধীন খালিস্তান কায়েম করতে চায়, এটা আপনার মতো পোড় খাওয়া প্রাক্তন ফৌজি কী করে বুঝতে পারল না? নাকি আপনি বুঝেও বুঝতে চাইছেন না?” 

     “কিন্তু আমি তো ভিন্দ্রানওয়ালেকে চিনিই না। মানে…”

     “মিথ্যে কথা বলে বা সত্য অস্বীকার করে কোনও লাভ নেই জেনারেল শাহবেগ। আপনার গতিবিধির উপর আমরা অনেকদিন ধরেই নজর রাখছি। ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের কাছে খবর আছে আপনি ধরম যুদ্ধ মোর্চার উগ্রবাদী শিখ যোদ্ধাদের ট্রেনিং দিচ্ছেন, মিলিটারি ওয়ারফেয়ার শেখাচ্ছেন… “

     “চৌত্রিশ বছর! ব্লাডি থার্টিফোর ইয়ার্স,” শাহবেগ হঠাৎ ক্ষোভে ফুঁসে উঠে বললেন, “আই ওয়ার্কড ফর ইন্ডিয়ান আর্মি… অ্যান্ড নাউ… নাউ আই রট ইন হেল। আপলোগোঁ নে তো মেরা গাঁন্ড মার ডালা… “

     “জেনারেল শাহবেগ,” সঞ্জয় ঠান্ডা গলায় বলল, “আপনি একজন প্যাট্রিয়ট, সাচ্চা দেশপ্রেমিক, আপনি সারাজীবন দেশের জন্য লড়েছেন, ভারতমাতার সেবা করেছেন, আপনি… আপনি শুধু ক্ষোভের বশে বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসবাদীদের সাহায্য করবেন?”

     “কিন্তু যে দেশের জন্য লড়েছি, সে দেশ আমাকে কী দিল? আমার সারাজীবনের অর্জিত সম্মান মুছে দিয়ে কলঙ্কের দাগ এঁকে দিল মাথায়। আমি জেনারেল রায়নার দুর্নীতি ধরে ফেলেছিলাম বলে আপনার সরকারই আমাকে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিপন্ন করে ছাড়ল! বাট হোয়াই মিঃ গান্ধী?”

     “জেনারেল, আপনি কি জানেন ভিন্দ্রানওয়ালেদের খালিস্তানি আন্দোলনের পিছনে পাকিস্তানের ফান্ড আসছে? জিস গ্যায়ের মুল্ক কি দুশমনোঁ সে আপলোগোঁ নে লড়াই কিয়ে হ্যায়, ওয়াহা সে ফান্ড আ রহা হ্যায়,” বাজওয়া বললেন।

     এই প্রথম শাহবেগ সিংহকে যেন কিছুটা দিশেহারা দেখাল। তিনি চুপ করে মাথা নীচু করে নিলেন।

     “জেনারেল শাহবেগ সিংহ,” সঞ্জয় বলল, “আমি আপনার সামনে কয়েকটা প্রস্তাব রাখছি। এক নম্বর, আপনার বিরুদ্ধে করা সমস্ত অভিযোগ ইন্ডিয়ান আর্মি তুলে নেবে। সিবিআই আপনার দুর্নীতির অভিযোগে যে তদন্ত চালাচ্ছে তা আজ এই মুহূর্ত থেকে বন্ধ করে দেবে। দুনন্বর, আপনাকে আর্মির সমস্ত হৃত সম্মান ফিরিয়ে দেওয়া হবে। আপনার সমস্ত রিটায়ারমেন্ট বেনিফিট ফিরিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আপনার নাম পরমবীর চক্রের জন্য সুপারিশ করা হবে।”

     “কিন্তু গুড্ডি? গুড্ডি কোথায়, তাকে ছাড়বেন না আপনারা?”

     বাজওয়া টেবিলের উপর রাখা ফোনে একটা নম্বর ডায়াল করে রিসিভারটা তুলে শাহবেগের হাতে দিয়ে বললেন, “জেনারেল নিন, কথা বলুন।”

     শাহবেগ রিসিভারটা কানের কাছে চেপে ধরতে ওপাশ থেকে ভেসে এল পরিচিত কণ্ঠ, “আপ কঁহা হ্যায়? গুড্ডি তো কব কা ঘর পঁহুচ চুকি।”

     রিসিভারটা রেখে শাহবেগ সিংহ সরাসরি সঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমাকে কী করতে হবে?”

     “সিম্পল। জার্নেল সিংহ ভিন্দ্রানওয়ালের গতিবিধির খুঁটিনাটি আমাদের জানাতে হবে। তার ধরম যুদ্ধ মোর্চায় কতজন উগ্রবাদী যোদ্ধা আছে? ভিন্দ্রানওয়ালের নিজস্ব সুরক্ষা ব্যবস্থা কিরকমের… এই সব সাধারণ তথ্য রেগুলার আমাদের জানাতে হবে।”

     জেনারেল শাহবেগ সিংহ একটা বড় করে শ্বাস নিয়ে শিরদাঁড়া টানটান করে বসলেন। তাঁর মুখেচোখের হতাশা সরে গিয়ে একটা অদ্ভুত আলো ফুটে উঠল।

     সেদিকে তাকিয়ে সঞ্জয় গান্ধী বলল, “এই তো আমি আপনার মধ্যে আবার এক প্রকৃত দেশপ্রেমিককে দেখতে পাচ্ছি।”

    

     ।। ৭ ।।

    

     ১৯৮৪ সালের ঝলমলে শীতের দিন। দিল্লির পারদ গতকাল রাতে ৩ ডিগ্রি নেমে গিয়েছিল। সকালে কিন্তু সূর্য বেশ উসুম কুসুম রোদ ছড়িয়ে দিচ্ছে। সফদরজং রোডের বাংলোর সবুজ লনে বসে এই সময়টায় সঞ্জয় পরিবারের সঙ্গে সকালের চা পান করে। টি-টেবিলের উপর টাইমস অফ ইন্ডিয়া, দ্য হিন্দু, দৈনিক জাগরণ, দৈনিক ভাস্করের মতো পত্রিকা সাজানো থাকে। সাড়ে সাতটা থেকে সাড়ে ন’টা পর্যন্ত চলে তার খবরের কাগজ পড়া। এই সময় দেশের রাজনীতির একটা বার্ডস আই ভিউ পায় সঞ্জয়।

     সামনের সবুজ লনে খেলে বেড়াচ্ছে সঞ্জয়ের চার বছরের ছেলে বরুণ। ওর পিছনে একটা দুধের গ্লাস হাতে ‘বরুণ বাবা দুধ পি লো’ বলতে বলতে দৌড়চ্ছে বাড়ির এক পুরোনো পরিচারিকা। সেই দৃশ্য দেখে সঞ্জয়ের পাশে বসে মানেকা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে। শ্রীমতী গান্ধী একটা জগার্স শ্যু পরে বাংলোর লনের চারপাশে দ্রুত পায়ে হাঁটছেন, এই সময়ে তিনি মৃদু শরীরচর্চা করেন।

     সঞ্জয় দৈনিক জাগরণের প্রথম পাতাটা খুলে খবরটা দেখতে পেল। ইংরেজি, হিন্দি প্রতিটা সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় বড় ফন্টের শীর্ষক দিয়ে তলায় তিন কলাম জুড়ে খবরটা ছেপেছে। সঙ্গে একটা বড় ছবি।

     “গুড মর্নিং সঞ্জয়, মানেকা।”

     মিসেস গান্ধী সদ্য স্নান করে সাদা-নীল রঙের একটা শাড়ি পরে লনের টি টেবলের পাশে রাখা বেতের সোফাটায় এসে বসেছেন। সঞ্জয় মায়ের দিকে তাকিয়ে ঈষৎ হেসে টাইমস অফ ইন্ডিয়ার একটা কপি এগিয়ে দিল। চোখের চশমাটা শাড়ির আঁচলে একবার মুছে নিয়ে ফের চোখে চাপিয়ে ইংরেজি দৈনিকটার প্রথম পাতার সবচেয়ে বড় খবরে চোখ রাখলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী।

     নয়াদিল্লি, ৮ জানুয়ারি, ১৯৮৪: পাঞ্জাবের উত্তর-পশ্চিম প্রান্তের জেলা শহর তরন তারন সাহিবে গতকাল গভীর রাতে একটি গুরুদ্বারার নিকটে খালিস্তানি উগ্রপন্থীদের সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সরাসরি সংঘর্ষে খালিস্তানি আন্দোলনের নেতা তথা দমদমি তকসলের চতুর্দশ জাঠেদার এবং ধরম যুদ্ধ মোর্চার প্রধান নেতা জার্নেল সিংহ ভিন্দ্রানওয়ালে নিহত হয়েছেন। গতকাল রাতের সংঘর্ষে ভিন্দ্রানওয়ালের সঙ্গে ধরম যুদ্ধ মোর্চার ৭০ জন উগ্রপন্থী যোদ্ধার মৃত্যু হয়েছে। তরন তারন সাহিবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাত ঘণ্টার খলিস্তানি দমণমূলক অপারেশনের নাম দেওয়া হয়েছে অপারেশন ব্লু ফক্স। এই অভিযানে ভারতীয় সেনাকে নেতৃত্ব দেন মেজর জেনারেল কুলদীপ সিংহ ব্রার। তাঁর সঙ্গে সহায়তা করেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল রণজিৎ সিংহ দয়াল এবং লেফটেন্যান্ট জেনারেল কৃষ্ণস্বামী সুন্দরজী। খলিস্তানি জঙ্গীদের সঙ্গে সংঘর্ষে চারজন জওয়ান মারা গেছেন এবং সাতজন আহত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বলেছেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর এই অভিযানের ফলে খালিস্তানি জঙ্গী আন্দোলন অঙ্কুরেই বিনষ্ট করা সম্ভব হয়েছে। দেশী বিদেশি রাজনৈতিক মহলের ধারণা ভারতীয় সামরিক বাহিনীর এই সাফল্যের ফলে পাঞ্জাবে মাথা চাড়া দেওয়া উগ্রপন্থী আন্দোলন চিরতরে তার পায়ের তলার জমি হারিয়ে ফেলল। বিবিসি-র মতো সংবাদ সংস্থার ধারণা শ্রীমতী গান্ধীর এই সাফল্য আগামী বছরে ভারতে অনুষ্ঠিতব্য লোকসভা নির্বাচনের আগে ভারতীয় কংগ্রেসকে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির থেকে কয়েক যোজন এগিয়ে রাখবে। জার্নেল সিংহ ভিন্দ্রানওয়ালের মৃত্যু নিয়ে অকালি দলনেতা হরচাঁদ সিংহ লঙ্গোয়াল সরাসরি কোনও মন্তব্য করতে চাননি, তবে তিনি জানিয়েছেন আনন্দপুর সাহিব রেজোল্যুশনের সিদ্ধান্তগুলির রূপায়ণের জন্য তাদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন আগামীদিনেও জারি থাকবে।

    

     শ্রীমতী গান্ধী খবরের কাগজটা ভাঁজ করে পাশে রেখে সঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “নাউ হোয়াট?”

     সঞ্জয় হেসে বলল, “এবার অষ্টম লোকসভা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। তার আগে মন্ত্রীসভায় একটা ছোট রদবদল করা দরকার। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর ড. মনমোহন সিংহকে রাজ্যসভার সদস্য করে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব দিতে হবে। মা, ১৯৮৫ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রধান এজেন্ডা হোক— উদারীকরণের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক সংস্কার।”

     “সঞ্জয়, সম্ভবত তুমি ঠিকই বলছ। গত দু-বছর ধরে গোটা বিশ্বে একটা পরিবর্তন শুরু হয়েছে। আমার বিগত সোভিয়েত ইউনিয়ন ভ্রমণের সময় লক্ষ করেছি, সে দেশে একটা নতুন কথা চালু হয়েছে। গ্লাসনস্ত। সেখানকার সাধারণ মানুষও চাইছে সমাজতান্ত্রিক দেশের সামাজিক পরিবেশ খোলামেলা হোক, পার্টির কার্যকলাপে স্বচ্ছতা আসুক, বহির্জগতের সঙ্গে দেশের মানুষের যোগাযোগ বাড়ুক। এই অবস্থায় মিখাইল গর্বাচভের নেতৃত্বে সোভিয়েত ইউনিয়ন একটা পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, হয়তো তার জন্য তাদের অনেক মূল্য চোকাতে হবে, আমেরিকার তুলনায় আগামী কয়েক বছর অর্থনীতি ও সামরিক শক্তিতে তারা হয়তো পিছিয়ে পড়বে। সেক্ষেত্রে কোল্ড ওয়ার শেষ হয়ে যাবে। আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নকে নিয়ে যে দ্বিমেরু বিশ্ব ছিল তার খোলনলচে বদলে গিয়ে বর্দ্ধিত শক্তি নিয়ে আমেরিকা এককভাবে একমেরু বিশ্বের রূপ দেবে।”

     “মা, আমাদের দেশে শিল্পের বৃদ্ধির জন্য মাশুল সমীকরণ নীতি প্রত্যাহারের পাশাপাশি আমদানি-রপ্তানি নীতির সরলীকরণ প্রয়োজন, বেসরকারি বিনিয়োগকেও বাড়ানো দরকার। সেজন্য আমাদের প্রয়োজন ড. মনমোহন সিংহের মতো লোক। আমাদের ‘৮৫ সালের লোকসভা নির্বাচনের মূল এজেন্ডাই হোক উদারনৈতিক ভারতীয় অর্থনীতি, যা বনিকমহলের পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও উন্নয়নের পথে নিয়ে যাবে। শুধু একটা কথা মাথায় রাখতে হবে, আমাদের আগামীদিনের অর্থনৈতিক উদারীকরণের নীতিকে হয়তো বামপন্থী দলগুলি সমর্থন করবে না, তবু তারা কিন্তু আমাদের সরকার চালানোর পথে প্রতিবন্ধকতা নয়। বরং আমাদের আসল শত্রু গোকুলে বাড়ছে। মনে রেখ, ১৯৮০ সালে জনতা পার্টি লোকসভা নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর জনতা পার্টি এবং ভারতীয় জনসংঘ মিলে মিশে যে নতুন ভারতীয় জনতা পার্টি তৈরি হয়েছে তারাই আমাদের আসল শত্রু। ওরা হিন্দুত্বের ধর্মচেতনা উসকে দিয়ে ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুসমাজের ভোট আকর্ষণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।”

     “সঞ্জয়, তোমার হাতে কোনও তাস তো নিশ্চয়ই আছে? কী করা যায়?” শ্রীমতী গান্ধী ছেলেকে প্রশ্ন করেন।

     “আমাদের পারিবারিক শক্তি বাড়ানো প্রয়োজন। কংগ্রেস পার্টির প্রয়োজনেই আরেকটা মুখ দরকার। একই পরিবারের একাধিক মুখ থাকলে পার্টির মধ্যে আমাদের পরিবারের গুরুত্ব আরও বাড়বে, পরিবারতন্ত্রের তানাশাহী বজায় থাকবে। দ্য মোর দ্য মেরিয়ার! দিস ইজ হাই টাইম ইউ কল ‘বড়ে ভাইয়া’!”

     “রাজীব! আর ইউ শিওর? ওর ফ্লাইংয়ের প্যাশন ছেড়ে আসবে?”

     “হ্যাঁ মা, আই উইল মেক ইট হ্যাপেন।” সঞ্জয় হাসল।

    

     ।। ৮ ।।

    

     ২৮ জুন, ১৯৮৫, রাষ্ট্রপতি ভবন

     অষ্টম লোকসভা নির্বাচনে ভারতের কংগ্রেস পার্টি ৩০৫ টি আসন জিতে একক রাজনৈতিক দল হিসেবে নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভ করেছে। ৬০টি আসন জিতে ভারতীয় জনতা পার্টি বিরোধী দলের মর্যাদা লাভ করেছে। খানিকক্ষণ পরেই শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে গড়া দেশের অষ্টম ক্যাবিনেটের মন্ত্রীরা রাষ্ট্রপতির কাছে শপথগ্রহণ করবেন। দ্বিতীয় সারিতে ভাজপা নেতা লালকৃষ্ণ আদবানী, অটলবিহারী বাজপেয়ী আর মুরলী মনোহর যোশী বসেছিলেন। ওরা ঈষৎ নীচু গলায় আলোচনা করছিলেন। তাঁদের পিছনের সারিতে বসেছিল একজন তরুণ বিজেপি নেতা, নাম প্রমোদ মহাজন। ভাজপার সর্বভারতীয় দলের সম্পাদকের কাজও করেছে বছর পঁয়ত্রিশের এই তরুণ।

     “অযোধ্যার রাম জন্মভূমিতে রাম মন্দির গড়ার এজেন্ডাটা সামান্য হলেও আমাদের পক্ষেই গেছে। মাত্র পাঁচ বছর আগে আমাদের পার্টি গড়ে ওঠার পর লোকসভার সাধারণ নির্বাচনে ষাটটা সিট পাওয়া কম কথা নয়,” যোশীজী বললেন।

     “মানুষ যদি চায় তবে রাম মন্দির গড়ার পথে আমরা এগোব। দেশের মানুষ কী চায় সেটা ভালো করে বোঝা দরকার। মানুষকে বাদ দিয়ে পার্টির অগ্রগতি সম্ভব নয়,” বাজপেয়ীজী খুব ধীরে উচ্চারণ করে কথাগুলো বললেন। তাঁর কথা শুনলে বোঝা যায় তিনি যা বিশ্বাস করেন সেটাই বলেন।

     “কিন্তু অযোধ্যায় শুধু রামমন্দির গড়ার এজেন্ডাই যথেষ্ট নয়,” পার্টির লৌহপুরুষ লালকৃষ্ণ আদবানী বললেন, “বাবরি মসজিদ ভাঙার বিষয়টাকেও ফোকাস করা দরকার। মানুষকে বোঝানো দরকার রামলালা বিরাজমান ওখানে আবহমানকাল ব্যাপী আছেন, কিন্তু মীর বাঁকি ওখানে বাবরি মসজিদ গড়েছেন মাত্র পাঁচশো বছর। তাই রামমন্দির গড়া আর বাবরি মসজিদ ভাঙার কাজটা যুগপৎ হওয়া প্রয়োজন। “

    

     “ঠিক বলেছেন, স্যার।”

     চতুর্থ ব্যক্তির মন্তব্যে ভাজপার তিনজন প্রাজ্ঞ নেতাই চমকে পিছন ফিরে তাকালেন। দেখলেন বছর পঁয়ত্রিশের সুদর্শন যুবক প্রমোদ মহাজন তাঁদের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসছে।

     “যদি অভয় দেন তো দুটো কথা বলি,” আড়ষ্ট ভঙ্গিতে প্রমোদ বলে।

     “হ্যাঁ নিশ্চয়ই বলবে,” বাজপেয়ী অভয় দিয়ে বললেন, “তুমি যা বলতে চাও নির্ভয়ে বলো। পার্টির প্রতিটি নেতাকর্মীর কথা শোনা উচিত।”

     “ভাজপার নিজস্ব মতাদর্শ এবং ভবিষ্যতের কর্তব্য যেমন মানুষের সামনে তুলে ধরা উচিত, ইস্যুভিত্তিক আন্দোলন ও কর্মসূচীর মাধ্যমে যেমন পার্টির ভিত মজবুত করা উচিত, তেমনই উচিত বিরোধী রাজনৈতিক দলের দুর্বলতা ও কেচ্ছাগুলোও মানুষের সামনে তুলে ধরা।”

     “কেচ্ছা! তুমি ঠিক কী বলতে চাও বল তো?” আদবানীজী সরু চোখে ছেলেটিকে ভালো করে মাপেন।

     “স্যার, জার্মানির হেকলার অ্যান্ড কখের সঙ্গে যে আর্মস ডিল হয়েছে তার কথা বলছি। প্রতিরক্ষা দপ্তর নিয়মনীতি বহির্ভূতভাবে জি-১১ অ্যাসল্ট রাইফেল কেনার জন্য হেকলার অ্যান্ড কখের সঙ্গে অস্ত্র সরবরাহের চুক্তিতে সই করেছে।”

     “সে তো বুঝলাম, এটা নিয়ে আমি নতুন সংসদের প্রথম অধিবেশনেই চর্চা করব, কিন্তু তোমার কাছে তথ্যপ্রমাণ কী আছে বলো?” আদবানীজী বললেন।

     “আমার কাছে তথ্যপ্রমাণ রয়েছে অন্তত চার-পাঁচজন এই অস্ত্র চুক্তিতে লাভের গুড় খেয়েছে। এই চুক্তিবাবদ মোট একশো কোটি টাকার মতো ঢুকেছে সুইস ব্যাঙ্কের বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে। মোহন শুক্লা নামে জার্মানির এক অনাবাসী ভারতীয় এই ডিলে মিডলম্যানের কাজ করেছে…”

     হঠাৎ প্রবল করতালির শব্দে ভাজপা নেতাদের কথোপকথন থমকে গেল। সদ্য অষ্টম লোকসভায় নির্বাচিত মিসেস ইন্দিরা গান্ধী চতুর্থবারের জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথগ্রহণ করলেন। তাঁকে শপথবাক্য পাঠ করালেন রাষ্ট্রপতি জ্ঞানী জৈল সিংহ।

     তারপরে নবগঠিত মন্ত্রীসভার অন্যান্য পূর্ণ মন্ত্রীরা শপথ নিতে শুরু করলেন। বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং সমগ্র দেশের মানুষের জন্য অষ্টম কংগ্রেস সরকারের তিনটি চমক ছিল। অর্থমন্ত্রী পদে শপথ নিলেন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর ড. মনমোহন সিংহ, প্রতিরক্ষামন্ত্রীর পদে শপথ নিলেন মান্ডার রাজা বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ। মন্ত্রীসভার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদে শপথ নিলেন শ্রীমতী গান্ধীর কনিষ্ঠ পুত্র সঞ্জয় গান্ধী এবং বিদেশমন্ত্রীর পদে শপথগ্রহণ করলেন শ্রীমতী গান্ধীর জ্যেষ্ঠপুত্র রাজীব গান্ধী। অষ্টম লোকসভা নির্বাচনে সঞ্জয় গান্ধী তার দাদা রাজীব গান্ধীকে আমেথি লোকসভা আসনটি ছেড়ে দিয়ে নিজে সরে এসেছিলেন পিলভিত লোকসভা আসনে।

     শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের মঞ্চের কাণ্ডকারখানা দেখে প্রচণ্ড উষ্মা প্রকাশ করে লালকৃষ্ণ আদবানী বিড়বিড় করে বললেন, “ইয়ে ক্যায়সা তানাশাহী। অব ইয়েলোগ তো আপনি ঘর কি বহু বেটিয়া অউর নৌকর চাকর কো ভি মন্ত্রী বনা দেগা!”

    

     ।। ৯ ।।

    

     ১৯৮৭ সালের জুলাই মাসের বাদল অধিবেশন শুরু হয়েছে সংসদে। অধিবেশনের তৃতীয় দিন আদবানীজী সকাল সাড়ে ন’টার আগে সাংসদে পৌঁছে গেছেন। তার চোখেমুখে ফুটে উঠেছে দারুণ আত্মবিশ্বাসের ঝলক। মিনিট দশেকের মধ্যে বাজপেয়ীজী, যোশীজী, যশবন্ত সিংহজী চলে আসতেই ভাজপা সাংসদদের দলটা স্পিকার বলরাম জাখরের ঘরের দিকে রওনা দিলেন। নেতৃত্বে রয়েছেন লালকৃষ্ণ আদবানী।

     “বাজপেয়ীজী, জলদি চলিয়ে। ১১টা থেকে জিরো আওয়ার শুরু হবে। আমাদের সকাল দশটার মধ্যে স্পিকারের হাতে আলোচ্য বিষয়টার নোটিস দিতে হবে, নাহলে ওরা আজ এটা নিয়ে আলোচনা করতেই দেবে না,” আদবানীজী বাজপেয়ীজীর যন্ত্রণাক্লিষ্ট মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ নরম সুরে বললেন, “কেয়া আপ ঘুটনোঁ কি দর্দ সে ফির সে পরেশান?”

     বাজপেয়ীজীর ইদানীং একটা হাঁটুর সমস্যা শুরু হয়েছে। দ্রুত হাঁটতে পারেন না, হঠাৎ করে যন্ত্রণা শুরু হয়। তিনি জানেন পৃথিবীতে মাত্র দুজন মানুষই রয়েছেন যারা তাঁর মতো অবিবাহিত ও সংবেদনশীল রাজনীতিবিদকে শ্রদ্ধা করেন, তাঁর কবিতাগুলি পড়ে মতামত ব্যক্ত করেন। প্রথমজন লালকৃষ্ণ আদবানী। দ্বিতীয়জন রাজকুমারী কউল। গোয়ালিয়রে কলেজে পড়ার দিন থেকে তিনি রাজকুমারীকে চেনেন। হয়তো বন্ধুত্বের বাইরেও রাজকুমারীর প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল কিন্তু সেই আবেগকে তিনি প্রশ্রয় দেননি। পরবর্তী কালে রাজকুমারী এবং তার অধ্যাপক স্বামী দুজনের সঙ্গেই তাঁর বিশেষ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। কিন্তু আজ লালকৃষ্ণ আদবানীর জীবনেও এক বিশেষ দিন। নবগঠিত ভাজপা বিগত সাত বছরে কংগ্রেস সরকারের বিরুদ্ধে বড় কোনও লড়াইয়ের আহ্বান জানাতে না পারলেও আজ অনেকদিন পর ভাজপার পালে হাওয়া লেগেছে, তাদের হাতে যুদ্ধ ঘোষণার নতুন অস্ত্র এসেছে এবং সেই অস্ত্র জোগাড় করেছেন আদবানী স্বয়ং।

    

     বাজপেয়ীজী হাঁটুর অসহ্য যন্ত্রণা নিয়েই তাঁর দলের অন্য সাংসদদের সঙ্গে যখন স্পিকারের ঘরের সামনে পৌঁছলেন তখন ঘড়িতে দশটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। লালকৃষ্ণ আদবানী জিরো আওয়ারে আলোচনায় উত্থাপন করার জন্য একটি বিষয়ের উপর নোটিশ ধরালেন স্পিকারের হাতে। বলরাম জাখর কাগজটার উপর চোখ বোলাতেই তার শিরদাঁড়া টানটান হয়ে উঠল, কিন্তু তাঁর ভিতরের তটস্থ ভাবটা বিরোধীদলের নেতাদের সামনে প্রকাশ করা দুর্বলতার লক্ষণ। তিনি বললেন, “আর কিছুক্ষণের মধ্যেই লোকসভার জিরো আওয়ার শুরু হবে। আপনারা এগোন আমি আসছি।”

     লোকসভার জিরো আওয়ার শুরু হয়েছে ঠিক এগারোটায়। চলবে দুপুর বারোটা পর্যন্ত। ইতিমধ্যে প্রায় আধঘণ্টা অতিক্রান্ত, কিন্তু স্পিকার বলরামজী এখনও কেন আদবানীজীর কাঙ্খিত বিষয়টি উত্থাপন করার সুযোগ দিচ্ছেন না! মুরলী মনোহর যোশীজী আড়চোখে তাকালেন লালকৃষ্ণ আদবানীর দিকে। দেখলেন আদবানীজীর চোয়াল ক্রমেই শক্ত হয়ে উঠছে, তিনিও সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছেন।

     “মাননীয় স্পিকার, আমরা বিজেপির পক্ষ থেকে একটি বিশেষ ইস্যু উত্থাপনের প্রস্তাব নিয়ে জিরো আওয়ারের অনেক আগেই সকাল দশটা নাগাদ আপনার কাছে নোটিস দিয়ে এসেছিলাম, কিন্তু এখন দেখছি, বাদল অধিবেশনের এই তৃতীয় দিনের জিরো আওয়ারের প্রথম আধঘণ্টা কেটে যাওয়ার পরও আপনি সেটা নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য করছেন না। কেন জানতে পারি?” আদবানীজী হঠাৎ দাঁড়িয়ে উঠে চিৎকার করে উঠলেন।

     আদবানীজীর আচমকা চিৎকারে স্পিকারকে কিছুটা অপ্রস্তুত দেখাল। কংগ্রেস সাংসদদের বেঞ্চ থেকেও শ্রীমতী গান্ধী ঘুরে তাকালেন। রাজীব গান্ধী জিজ্ঞাসু চোখে তাকাল। অন্যান্য কংগ্রেস সাংসদদের মধ্যেও ঈষৎ গুঞ্জন শুরু হল। সঞ্জয়ের ষষ্ঠেন্দ্রিয় তার মগজে হঠাৎ বিপদ সংকেত পাঠাল, সে সন্দিগ্ধ চোখে আদবানীজীর দিকে ঘুরে তাকাল।

     ততক্ষণে আদবানীজী বলতে শুরু করেছেন,”ফ্রাঙ্কফুর্ট জাইটুং পত্রিকায় গত সপ্তাহে ছাপা একটি খবর আমার নজরে এসেছে। সেখানে একটি প্রতিবেদন পড়ে আমার এবং আমার পার্টির সাংসদদের ধারণা হয়েছে যে পাঁচ বছর আগে জার্মান অস্ত্র প্রস্তুতকারক সংস্থা হেকলার অ্যান্ড কখের থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর জন্য যে লক্ষাধিক অ্যাসল্ট রাইফেল কেনার চুক্তি হয়েছিল তাতে যথেষ্ট দুর্নীতির হয়েছে। সেই চুক্তি স্বাক্ষরের পর প্রায় দেড়শো কোটি টাকার ঘুষের আদানপ্রদান হয়েছে সুইস ব্যাঙ্কের মাধ্যমে। প্রসঙ্গত ওই চুক্তি স্বাক্ষর হওয়ার সময় দেশের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ছিলেন সঞ্জয় গান্ধী। আমরা এই প্রসঙ্গে সংসদে বিস্তারিত চর্চা করার জন্য যেমন আবেদন জানাচ্ছি, তেমনই দেশের মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধীর কাছে এই অস্ত্র কেলেঙ্কারির পুর্ণাঙ্গ তদন্ত সিবিআইয়ের মাধ্যমে করার জন্য আবেদন জানাচ্ছি।”

     লালকৃষ্ণ আদবানীর অভিযোগটি শুনতে শুনতেই শ্রীমতী গান্ধীর চোখমুখ ক্রমশ লাল হয়ে উঠল। একটা লজ্জা আর চাপা ঘৃণাবোধ জন্ম নিচ্ছিল তাঁর মনের মধ্যে। নেহরু পরিবার ভারতের সবচেয়ে অভিজাত ও সম্মানীয় পরিবার, ভারতের রাজনীতি ও ইতিহাস নির্মাণের কারিগর তারা। তাদের বিরুদ্ধে অর্থ ঘুষ নেওয়ার মতো ঘৃণ্য অভিযোগ উঠল আজ! আর এসবের জন্য দায়ী তাঁর সুযোগ্য কনিষ্ঠপুত্র সঞ্জয়! যে পুত্রকে তিনি জ্যেষ্ঠপুত্রের চেয়েও বেশি স্নেহ দিয়ে বড় করেছেন। যে পুত্রের উপর তাঁর এত আশা ভরসা, সেই সঞ্জয় আজ তাঁকে হতাশ করল। একটা চাপা ক্রোধ নিয়ে তিনি ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে তাকালেন পাশে বসা সঞ্জয়ের দিকে। সঞ্জয়ও তাঁর দিকেই তাকিয়ে আছে, মিটমিট করে হাসছে, ঠিক ছোটবেলায় কোনও দোষ করে যেভাবে হাসত, অবিকল সেই ভাবে। মিসেস গান্ধী শুনতে পেলেন সঞ্জয় তাঁর কানের কাছে মুখটি এনে ফিসফিস করে বলল, “ডোন্ট বিলিভ, অল বুলশিট।”

     শ্রীমতী গান্ধী সফদরজং বাংলোয় ফেরার আগে থেকেই তাঁর শরীরটা কেমন অস্থির হয়ে উঠেছিল। তাঁর উপস্থিতিতে সংসদভবনে আজ যে কাণ্ড ঘটল তা নজিরবিহীন। লালকৃষ্ণ আদবানীর অভিযোগকে অবাস্তব ও আকাশকুসুম বলে চিহ্নিত করে সংশ্লিষ্ট বিষয়টির উপর চর্চা চালনোর প্রস্তাব স্পিকার খারিজ করে দেন। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই বিজেপি সাংসদেরা প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠে। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে বর্তমান প্রতিরক্ষামন্ত্রী ভি পি সিংহ বলতে উঠে পুরো বিষয়টা ঘেঁটে ফেলেন, পক্ষান্তরে তাঁর বক্তব্য বিজেপির অভিযোগকেই প্রতিধ্বনিত করে। তিনি প্রতিরক্ষা দপ্তরের ভিতরে তদন্ত কমিটি গঠন করে নিরপেক্ষ তদন্তের আশ্বাস দেন। তা সত্বেও ভাজপা সাংসদরা সরাসরি প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর পুত্র সঞ্জয়কে অভিযোগের তীরে বিদ্ধ করতে থাকে। কিছুক্ষণ পর তারা সভার ওয়েলে নেমে চেঁচামেচি করে সভা থেকে ওয়াকয়াউট করে।

     বাংলোয় ফেরার পথে শ্রীমতী গান্ধী সঞ্জয়কে নিজের গাড়িতে ডেকে নিয়ে বলেন, “এমন কাণ্ডজ্ঞানহীন কাজ তুমি করলে কিভাবে? এভাবে আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ে নেহরু পরিবারকে কলঙ্কিত করলে?”

     “সমস্ত অভিযোগ মিথ্যা, মা। জাস্ট আ কক অ্যান্ড বুল স্টোরি। ওরা আমাকে ফ্রেম করার চেষ্টা করছে।”

     “কিন্তু ওরা যে বলছে, সমস্ত তথ্য ওদের হাতের কাছে রয়েছে, কোথায় কিভাবে ডিল হয়েছে, কে কত টাকা পেয়েছে। মন্ত্রী হিসেবে তোমার পদত্যাগও দাবি করছে।”

     সঞ্জয়ের চোয়ালটা শক্ত হয়ে উঠল, “তুমি কী চাইছ মা?”

     “আমি… আমি চাই না কোনও আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগের কালিমা লাগুক আমাদের পরিবারে,” একটা বড় দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শ্রীমতী গান্ধী বললেন, “আই ওয়ান্ট ইওর রেজিগনেশন টুমরো।”

     সঞ্জয় মৃদু হেসে বলল, “তা কী করে হয় মা? তার মানে তো অভিযোগটা মেনে নেওয়াই হল, কিন্তু আমি তো ঘুষ কেলেঙ্কারীতে কোনওভাবেই যুক্ত নই। তা ছাড়া আমি এখন প্রতিরক্ষামন্ত্রীও নই, আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তার চেয়ে বর্তমান প্রতিরক্ষামন্ত্রী বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহকে ওই পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হোক। মন্ত্রীসভায় একটা রিশাফলিং দরকার।”

     “কিন্তু আগামী দিনে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে গেলে, মনে রেখো, পরিবার ও সরকারের ফেস সেভিংয়ের জন্য তোমাকে পদত্যাগ করতে হবে,” নিজের অবস্থানে অনড় থেকে মিসেস গান্ধী ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে উঠলেন।

     সঞ্জয় অবাক হয়ে মায়ের দিকে তাকাল। সে মায়ের এমন বিরক্তি ঝরানো দৃঢ় কণ্ঠ আগে কখনও শোনেনি। মৃদু হেসে সে বলল, “মা ডোন্ট ওয়রি, আই উইল ফিক্স দিস।”

     “তুমি চুপ করো। আমি এখন তোমার সঙ্গে কোনও কথা বলতে চাই না, আমাকে একটু শান্তি দাও,” বলে বাকি রাস্তাটা শ্রীমতী গান্ধী গাড়ির জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকলেন। সঞ্জয় বাকি রাস্তাটা চুপ করে থাকল, যদিও তার ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠল।

     বাংলোয় ফেরার পর শ্রীমতী গান্ধী কিঞ্চিৎ অসুস্থবোধ করতে শুরু করলেন। তাঁর মাথায় অজস্র চিন্তা ভিড় করে আসছে, বুকের বাঁদিকে একটা চাপ চাপ ভাব। তাঁকে অন্ধকার ঘরে শুয়ে থাকতে দেখে সঞ্জয় ফোনটা তুলে হাউস ফিজিশিয়ান ড. কৃষ্ণপ্রসাদ মাথুরকে কল করল। আধঘণ্টার মধ্যে ড. মাথুর এসে হাজির হলেন বাংলোয়। শ্রীমতী গান্ধীকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখার জন্য পারিবারিক ডাক্তার ভিতরে ঢুকতেই সঞ্জয় বাংলোর বাইরের লনে এসে বসল।

     খানিক বাদে ডাক্তার মাথুর প্রধানমন্ত্রীর ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে দাঁড়ালেন লনে। এই বাংলোয় রাজীব থাকে না, তাদের মায়ের স্বাস্থ্যবিষয়ক কথাবার্তা সঞ্জয়কেই জানানো উচিত ডাক্তার মনে করেন।

     “কেমন দেখলেন?” সঞ্জয় প্রশ্ন করল।

     “সামান্য রক্তচাপ বেড়েছে। হার্টের অবস্থা ভালোই। বুকে ব্যথা অনুভব করলেই জিভের তলায় একটা সরবিট্রেট রাখতে বলেছি। নতুন ওষুধ তেমন কিছু দিইনি। ঘুমটা যেন একটু ভালো করে হয়, খেয়াল রেখো।”

     “কিন্তু মা আপনাকে আসল সমস্যাটার কথা কিছু কি বলেছেন?” সঞ্জয় গার্ডেন চেয়ারটায় সোজা হয়ে বসে বলল। “ইদানীং মায়ের মধ্যে একটু মানসিক বিকলন দেখা দিয়েছে। কখন রেগে যাচ্ছেন, কখন মুষড়ে পড়ছেন কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। আমি লক্ষ করেছি, অনেক সময় একা একাও বিড়বিড় করে কী যেন বলছেন মা। আপনি মাকে কয়েকটা ভালো অ্যান্টি ডিপ্রেস্যান্ট প্রেসক্রাইব করুন।”

     “কিন্তু… আমি… আমি তো ওঁকে ঘুমের ওষুধ দিয়েছি।”

     “ড. মাথুর আপনি সুচিকিৎসক, নেহরু পরিবারের পারিবারিক ডাক্তার হওয়ার সুবাদে আপনি যথেষ্ট গৌরব অর্জন করেছেন। এটুকুই তো যথেষ্ট নয়, বৃহত্তর সমাজের মানুষও আপনাকে চিনুক, সেটাই আমরা চাই। চিকিৎসক সমাজেও আপনি বিশেষ গৌরব অর্জন করুন, আপনার সহকর্মীদের থেকে আপনি আরও অনেক উঁচুতে উঠবেন এটাই কাম্য। নাহলে আমরা কোনও চিকিৎসককে হঠাৎ পদ্মশ্রী দেওয়ার কথা ভাবব কেন? ও আপনাকে বোধহয় বলা হয়নি, আমি পদ্মশ্রী পুরস্কারের জন্য আপনার নাম সাজেস্ট করে কালকেই পাঠাব। সেটার সইও মা করবেন। অতএব পরিস্থিতিটা বুঝতেই পারছেন… এই সময়ে মায়ের মাথাটা ঠান্ডা থাকা দরকার, তাই তাঁর কেন অ্যান্টি ডিপ্রেস্যান্ট প্রয়োজন সেটা আশা করি বুঝতে পারছেন।”

     ড. মাথুর এক মুহূর্ত কী যেন ভাবলেন, চিন্তাগ্রস্ত মুখে নিজের ঠোঁটটা কামড়ে ধরলেন। পরক্ষণে অ্যাটাচি কেস খুলে প্রেসক্রিপশন প্যাড বের করে খসখস করে তিনটে ওষুধ লিখে ফেললেন। অ্যামিট্রিপ্টিলিন, জোলপিডেম এবং এসিলেটোপ্রাম।

    

     ।। ১০ ।।

    

     রাতের ফ্রাঙ্কফুর্টে দু-একটা নতুন নাইটক্লাব গজিয়ে উঠেছে। বেশ কয়েকটা মদ্যপানের পাবও ইদানীং সারারাত খোলা থাকছে। মাঝারি উচ্চতার ভারতীয় লোকটা ফক্সভাগেনটা রাস্তার ধারে দাঁড় করিয়ে নাইটক্লাবটার ভিতরে ঢুকল। ঈষৎ স্থুল চেহারার লোকটার নাম অনুরাগ শুক্লা। কুকি’স নামের এই নতুন নাইটক্লাবটা বেশ ট্রেন্ডি। ইদানীং সে এখানেই আসছে। ভিতরে ওক কাঠের একটা দারুণ ড্যান্সফ্লোর তৈরি করেছে এরা। চারপাশে লাল নীল রঙের সাইকিডেলিক লাইট জ্বলছে। শুক্লা দুই মগ জার্মান বিয়ার শেষ করে সোজা ড্যান্সফ্লোরে নেমে গেল। ইতিমধ্যে সাত-আটটি যুগল নাচতে শুরু করেছে। হাজার ওয়াটের সাউন্ড সিস্টেমে বিখ্যাত জার্মান ইলেক্ট্রোপপ ব্যান্ড ক্রাফটওয়ার্কের ম্যান-মেশিন অ্যালবাম থেকে জনপ্রিয় সাউন্ডট্র‍্যাক ‘উই আর দ্য রোবটস’ বাজছে। শুক্লা দেখল দুটি যুগল গানের ট্র‍্যাকের সঙ্গে অবিকল রোবটের ভঙ্গিতে নাচছে। এই নতুন ঘরানার নাচটা তাকে তেমন টানল না। অনুরাগ শুক্লার শিকারী চোখ চারপাশে ঘুরতে লাগল। নাইটক্লাবের ভিতর বেশির ভাগই যুগল এসেছে। তবে বার কাউন্টারের কাছে যে চার-পাঁচজন হুকার দাঁড়িয়ে আছে তা তার চোখ এড়ায়নি। একটা নরম-সরম আদুরে চেহারার হুকার শুক্লার দিকে এগিয়ে এল। সে মেয়েটাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল। মেয়েটা একটু হতাশ হল। শুক্লার এই ধরনের মেয়ে পছন্দ নয়। সে বার কাউন্টারের পাশে দাঁড়ানো লেদার বডিস্যুট পরা লম্বা দশাসই চেহারার একটা মেয়েকে পছন্দ করল। মেয়েটার উচ্চতা প্রায় ছ’ফুট, শুক্লার চেয়ে অন্তত ইঞ্চিছয়েকের লম্বা। চুলের রং লালচে তামার মতো। মেয়েটার অন্তর্বাসের ভিতর একটা একশো ডয়েশ মার্কের নোট গুঁজে দিয়ে শুক্লা নাইটক্লাব ছেড়ে তার গাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। মেয়েটাও স্টিলেটো পরা বড় বড় পদক্ষেপে তাকে অনুসরণ করল।

     ঘরের ভিতর একটা নীল আলো জ্বলছে। একটা লোহার খাটের উপর সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে শুয়ে আছে অনুরাগ। দুটো হাত মাথার পিছন দিকে একটা হাতকড়া দিয়ে খাটের ডাশার সঙ্গে বাঁধা। লোকটার চোখদুটোও একখন্ড রেশমের কাপড় দিয়ে বাঁধা। আধো অন্ধকার ঘরের কোণা থেকে লেদারের বডিস্যুট পরা লালচুলো মেয়েটা বাঘিনীর মতো হামাগুড়ি দিয়ে শুক্লার দিকে এগিয়ে এল। মেয়েটার হাতে একটা ফ্লগার্স, সেটা চাবুকের মতো সপাং সপাং করে শুক্লার বুকের উপর চালাতে লাগল। শুক্লা চাবুকের আঘাতে যন্ত্রণায় কেঁপে কেঁপে উঠল।

     অনুরাগ শুক্লা সদ্য বাসেল থেকে জেনিভা হয়ে ফ্রাঙ্কফুর্ট ফিরেছে। সে সুইস ব্যাঙ্ক কর্পোরেশনে সঞ্জয়, জগদীশ, কমল সহ তার নিজের অ্যাকাউন্টটাও হ্যান্ডেল করে। এরকম অনেক ক্লায়েন্টের সুইস ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্ট সে দেখাশোনা করে। তার ক্লায়েন্টরা যেমন তাকে বিশ্বাস করে তেমনই সুইস ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও তার সম্পর্কটা মজবুত হয়েছে বিগত কয়েক বছরে। সুইস ব্যাঙ্কের বিশেষত্ব হল এখানে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আর্থিক ঝুঁকি কম, সুইজারল্যান্ডের অর্থনীতিও গোটা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে সুস্থির। অন্তত বিগত একশো বছরে সুইস অর্থনীতি কখনও নিম্নগামী হয়নি। তবে সবচাইতে বড় সুবিধা হল এখানকার অ্যাকাউন্ট হোল্ডারদের সমস্ত তথ্য সুনিপুণভাবে গোপন রাখা হয়। তাদের নাম, ধাম, অ্যাকাউন্টে টাকা আগমণ বা বহির্গমণের উপর কোনও নজরদারি নিষেধাজ্ঞা নেই।

     অনুরাগ শুক্লার নিজের জীবনটিও যেন সুইস ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের মতো গোপনীয়তায় ঢাকা। কোনও পাসপোর্টে তার নাম নারায়ণ প্যাটেল, কোনও পাসপোর্টে আবার ইথান শাহ। দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিক্স থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর পাস করার পর লন্ডনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করতে শুরু করেছিল অনুরাগ শুক্লা। মাঝপথে গবেষণার কাজ মুলতুবি রেখে ওল্ড ব্রড স্ট্রিটের লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জে কাজ করতে শুরু করে সে। তখন শুক্লার নাম ছিল ইথান শাহ। স্টক এক্সচেঞ্জে ইনসাইডার ট্রেডিংয়ে যুক্ত থাকার অভিযোগে তার দুবছরের সাজা হয়। জেল থেকে ফিরে আসার পর অনুরাগ অন্ধকার জগতে মিশে যায়। ধীরে ধীরে সে অস্ত্রব্যবসায়ীদের সঙ্গে ওঠা বসা করতে করতে ইউরোপের বড় দালাল হয়ে ওঠে। জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স সহ বিভিন্ন দেশের নানারকমের বেআইনী ব্যবসায়িক চুক্তির মধ্যস্থতা করতে শুরু করে।

     লালচুলো দশাসই চেহারার মেয়েটা দেশলাই দিয়ে একটা মোমবাতি জ্বালাল। ধীরে ধীরে গলন্ত মোমটা অনুরাগের বুকের উপর আঁকা চাবুকের লাল হয়ে ওঠা দাগগুলোর উপর ঢালতে শুরু করল সে। যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠল সে, দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরল ঠোঁট। তার শিকল বাঁধা হাতের আঙুলগুলো যন্ত্রণায় বেঁকে উঠছে, যেন কিছু আঁকড়ে ধরতে চাইছে। মেয়েটা হঠাৎ অবাক হয়ে দেখল অনুরাগের মুখ থেকে যন্ত্রণার চিহ্ন মুছে গিয়ে একটা পরিতৃপ্তির হাসি ফুটে উঠছে, তার অসাড় পুরুষাঙ্গ আকস্মিকভাবে জেগে উঠছে। অনুরাগ তার ডান হাত দিয়ে মেয়েটার কোমর বেষ্টন করে ধরতেই হুকার মেয়েটা অনুরাগের সঙ্গে সঙ্গমে লিপ্ত হল।

     রমণ আর মেয়েটার তীব্র শীৎকারের মধ্যেই অনুরাগ শুক্লার মনে পড়ল তিন সপ্তাহ আগে তার সুইস ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে আরও দু কোটি টাকা ঢুকেছে। সব মিলিয়ে তার সুইস ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে প্রায় চল্লিশ কোটি টাকা জমেছে। আচ্ছন্ন অবস্থায় অনুরাগের মনে হল তার সমস্ত ঘর জুড়ে যেন ডয়েশ মার্ক, সুইস ফ্রাঁ, পাউন্ড আর ডলার উড়ছে। ঘরের লালচে আলোয় উড়তে থাকা নোটগুলো দেখতে দেখতে অনুরাগ শীর্ষসুখ ছুঁয়ে ফেলল আর সেই মুহূর্তেই লালচুলো মেয়েটা রমণক্লান্ত হয়ে তার শরীরের উপর নেতিয়ে পড়ল।

     ক্রীং ক্রীইং! সশব্দে ঘরের টেলিফোনটা বেজে উঠতেই শুক্লার সুখের চটকাটা ভেঙে গেল। সে এক ঝটকায় মেয়েটাকে ঠেলে সরিয়ে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল। ফোনটা রিসিভার থেকে তুলে কানে ধরতেই সে বুঝতে পারল এটা লং ডিসট্যান্স কল। ভারত থেকে কলটা এসেছে। প্রথমে একটু অবাক হলেও ফোনের ওপাশের পরিচিত কণ্ঠটা শুনে সে আশ্বস্ত হল।

     “হ্যালো শুক্লা, হাউ ইজ লাইফ?”

     “বড়িয়াঁ, সঞ্জয়স্যার,” হেসে উত্তর দিল অনুরাগ শুক্লা।

     “কিন্তু এদিকের খবর ভালো নয়। মাসখানেক আগে ফ্রাঙ্কফুর্ট জাইটুং নামের একটা জার্মান সংবাদপত্রে একটা খবর বেরিয়েছে, তুমি দেখেছ কী?”

     “নেহি সঞ্জয়জী,” বিস্মিত গলায় শুক্লা বলল, “কোনও বড় খবর আছে কি?”

     “হুম, হেকলার অ্যান্ড কখ ডিলের ব্যাপারটা নিয়ে খবর হয়েছে। জার্মান গুপ্তচর সংস্থা বুন্ডেশনাখরিকটান্ডিশট তোমাকে খুঁজছে। তুমি এক্ষুণি ফ্রাঙ্কফুর্টের অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে যাও। কিছুদিন কোথাও গা ঢাকা দিয়ে থাকো।” ফোনের ওপাশের গলাটা বলে উঠল।

     খবরটা শোনামাত্র একটা ভয়ের স্রোত অনুরাগ শুক্লার শিরদাঁড়া বেয়ে নিচের দিকে বয়ে গেল। মাথার মধ্যে যেন একটা টাইমবোমা টিকটিক করতে শুরু করেছে। তাকে এক্ষুণি এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবে, হাতে সময় খুব কম। সে দ্রুত আরও কিছু ডয়েশ মার্ক দিয়ে হুকারটাকে তার ফ্ল্যাট থেকে বিদায় করল। দ্রুত একটা ডাফেল ব্যাগে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস আর টাকা নিয়ে তার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে সে বেরিয়ে এল। ঘড়ির দিকে তাকাল, রাত বারোটা বাজে। গ্যারেজ থেকে তার ফক্সভাগেন ডার্বি গাড়িটা বের করল। এখন রওনা দিলে সে ভোরের আগে ফ্রাঙ্কফুর্ট ছেড়ে অনেকটা রাস্তা এগিয়ে যাবে। তারপর সে আগামীকাল জার্মানি ছেড়ে ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া কিংবা লিশটেনস্টাইন কোথাও একটা আশ্রয় পেয়ে যাবেই।

    

     গাড়ি স্টার্ট দিয়ে অনুরাগ শুক্লা দক্ষিনদিকে রওনা হল। ফ্রাঙ্কফুর্ট জার্মানির একেবারে মধ্যভাগে পড়ে। অন্তত দশ-বারো ঘণ্টা টানা ড্রাইভ করলে সে জার্মানির সীমান্তে পোঁছবে। লাক্সেমবার্গ, লিশটেনস্টাইন ছোট দেশ, সেখানে লুকোলে ধরা পড়ার চান্স বেশি। ফ্রান্স বড় দেশ, সুইজারল্যান্ডও যথেষ্টই বড়, এসব দেশে লুকোলে পুলিশ বা গুপ্তচর সংস্থার চোখে ধুলো দেওয়া সহজ হবে। রাতের অন্ধকার চিরে তার গাড়ি চলেছে মাইন নদীর ধার দিয়ে। এমন জনবিরল রাস্তা দিয়ে গাড়ি চালানো সুবিধা। রাতের অন্ধকারে জার্মান পুলিশের নজর এড়িয়ে যাওয়া সুবিধা হলেও দিনের আলোয় ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়। যতটা সম্ভব গতিতে গাড়ি চালিয়ে তাকে রাতের মধ্যেই অনেকটা দূরত্ব অতিক্রম করতে হবে।

     মাইন নদীর ধার দিয়ে তীব্র গতিতে চলেছে অনুরাগ শুক্লার গাড়ি। নদীর ধারের পাথর দিয়ে বাঁধানো রাস্তা পেরিয়ে সে একঘণ্টার মধ্যেই নির্জন রাস্তায় চলে এসেছে। এখানে নদীর ধারে বার্চ আর ওক গাছের সারি। এরপরেই রাস্তা নদীর ধার থেকে দুরন্ত বাঁক নিয়ে হাইওয়েতে গিয়ে উঠেছে। সেখান থেকে হাইওয়ে ধরে রাস্তা সোজা চলে গেছে ফ্রান্সের সীমান্তের দিকে। অনুরাগ গাড়ির চালকের আসনে বসে দেখতে পাচ্ছিল রাস্তা বাঁদিকে বেঁকে নদীর দিক থেকে সরে গেছে। সে গাড়ি বাঁদিকে ঘোরাতেই একটা উজ্জ্বল আলোয় চোখটা ধাঁধিয়ে গেল। সামনেই প্রকাণ্ড একটা ডেইমলারের হেভি ডিউটি পিকআপ ট্রাক। কিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রচণ্ড শব্দে ট্রাকটা এসে ধাক্কা মারল অনুরাগের ডার্বির সামনে। হেড-অন কলিশনে ফক্সভাগেন ডার্বি গাড়িটা দুমড়ে মুচড়ে ছিটকে গিয়ে পড়ল মাইনের জলে। সলিলসমাধি হয়ে মৃত্যুর আগের মুহূর্তেও অনুরাগ শুক্লা ওরফে নারায়ণ প্যাটেল ওরফে ইথান শাহ একটি টুঁ শব্দ করারও সুযোগ পেল না।

    

     ।। ১১ ।।

    

     রাজীব গান্ধী বিদেশমন্ত্রী হওয়ার পর ৭ রেসকোর্স রোডের বাড়িটায় থাকছেন। সঞ্জয় আগের মতোই তার মায়ের সঙ্গে সফদরজং রোডের বাংলোয় রয়ে গেছেন। মাঝেমধ্যে রাজীব সপরিবারে নৈশভোজ করতে মা ও ভাইয়ের বাংলোয় চলে আসেন। আজ রাজীবের জ্যেষ্ঠপুত্র রাহুলের জন্মদিন উপলক্ষে একটা পারিবারিক অনুষ্ঠান হচ্ছে সফদরজংয়ের বাংলোয়। বাংলোর লনে স্কচের গ্লাস হাতে আড্ডা দিচ্ছে দুই ভাই। তাদের দুই স্ত্রী বাচ্চাদের নিয়ে বাংলোর লনের মাথার উপর রাতের আকাশে আতসবাজি পোড়ানোর জৌলুস দেখছে। রাহুলের জন্মদিন উপলক্ষে বাংলোর কর্মচারীরা এই আতসবাজির প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেছে। রাহুল, প্রিয়াঙ্কা ও বরুণ তিন ভাইবোন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আকাশের বুকে আলোর রোশনাই দেখে আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠছে।

    

     সময়টা ১৯৮৮ সাল। প্রতিবেশী দ্বীপরাষ্ট্র শ্রীলঙ্কায় সিংহলী এবং তামিলদের মধ্যে উত্তেজনার পারদ চড়তে চড়তে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। গতকালই শ্রীমতী গান্ধী শ্রীলঙ্কার কয়েকটি তামিল অধ্যুষিত এলাকা পরিদর্শন করে দেশে ফিরেছেন। যা দেখেছেন তাতে তিনি মোটেই সন্তুষ্ট হতে পারেননি। শ্রীলঙ্কার সিংহলী নাগরিকদের সত্তর শতাংশের বেশি থেরবাদী বৌদ্ধধর্মের। তামিলদের গোটাটাই অর্থাৎ মোট শ্রীলঙ্কান জনসংখ্যার ছয় সাত শতাংশ হিন্দু। শ্রীলঙ্কার সরকারের তরফে দীর্ঘদিনের অবহেলার ফলে সেখানকার তামিলদের মধ্যে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়েছে। থেরবাদী বৌদ্ধ সিংহলীরা সেই ক্ষোভে অগ্নিসংযোগ করেছে। ইদানীং তামিলরাও ঘুরে দাঁড়িয়েছে, ভেলুপিল্লাই প্রভাকরণ নামে এক তরুণ তামিল জঙ্গীনেতা শ্রীলঙ্কার তামিলদের একত্রিত করে গেরিলা যোদ্ধাবাহিনী গঠন করে সিংহলীদের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধ শুরু করেছে।

     ইদানীং শ্রীমতী গান্ধী শারীরিকভাবে যেন একটু জবুথবু হয়ে পড়েছেন। সব সময় তাঁর ঘুম পায়, সারাদিন শরীর জুড়ে ক্লান্তি জড়িয়ে থাকে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতেও সময় নেন, দ্বিধা বোধ করেন। শ্রীলঙ্কার তামিল সমস্যাটা নিয়েও কী সিদ্ধান্ত নেবেন তা ভেবে কুল-কিনারা করতে পারছেন না।  

     “মা, তুমি ঠিক আছ?” সঞ্জয় স্কচের গ্লাস হাতে শ্রীমতী গান্ধীর দিকে এগিয়ে এসে বলে, “ইজ দেয়ার সামথিং বদারিং ইউ?”

     শ্রীমতী গান্ধী চোখ তুলে তাকান। দেখেন তাঁর দুই পুত্র কখন যেন তাঁর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বড় ছেলে রাজীব যেন কিছুটা শান্ত, স্থিতধী। অন্যদিকে সঞ্জয় যেন পাওয়ার হাউস, সবসময় কিছু না কিছু নিয়ে ব্যস্ত হয়ে আছে। রাজনীতির জটিল সমস্যাগুলো যেন সঞ্জয়কে আরও উদ্দীপনা জোগায়। সে সবসময় আউট অফ দ্য বক্স কোনও সমাধানসূত্র বের করে আনবেই।

     “প্রেসিডেন্ট জয়বর্ধনে চাইছে আমি শ্রীলঙ্কায় জঙ্গী তামিলদের দমণ করতে শ্রীলঙ্কা সরকারের পাশে দাঁড়াই। শ্রীলঙ্কায় অবিলম্বে পিস কিপিং ফোর্স পাঠাই। কিন্তু আমি ওখানে ঘুরে দেখলাম তামিলরা কোনঠাসা হয়ে পড়েই ঘুরে দাঁড়িয়েছে… দীর্ঘদিনের জমে থাকা ক্ষোভ সেফটি ভালভের মতো জঙ্গী আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে আসছে…” শ্রীমতী গান্ধী চিন্তিত মুখে বললেন।

     “তামিল জঙ্গী দমণ করতে শ্রীলঙ্কায় পিস কিপিং ফোর্স পাঠালে তো ভালোই হয়, এই সুযোগে প্রতিবেশী দ্বীপরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা ভালো হয়,” রাজীব বলল।

    

     “কিন্তু পিস কিপিং ফোর্স পাঠালে ওখানকার তামিলরা তো আমাদের প্রতি বিদ্বিষ্ট হতে পারে। মনে রাখতে হবে তামিলরা মূলত ভারতেরই জনজাতি। শ্রীলঙ্কার তামিলরা আক্রান্ত হলে আমাদের দেশের তামিলদের মধ্যেও ক্ষোভ তৈরি হবে যার জের তামিলনাড়ুর মতো দক্ষিণের রাজ্যগুলোর উপর পড়বে, ফলে সেখানকার তামিলরাও ভারত সরকারের বিরুদ্ধে চলে যাবে। দাদা, একটা কথা মনে রাখা দরকার, শ্রীলঙ্কার তামিলরা আমাদের লোক, ওখানকার সিংহলীরা নয়। তাই আমাদের উচিত শ্রীলঙ্কার তামিলদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া,” সঞ্জয় বলল।

     “কিন্তু শ্রীলঙ্কায় শান্তিরক্ষী বাহিনী না পাঠালে তো বিশ্বের কাছে ভুল বার্তা যাবে, শ্রীলঙ্কা সরকারও সেটাকেই হাতিয়ার করে অন্যান্য দেশগুলির সামনে ভারতকে ভিলেন বানাতে পারে,” শ্রীমতী গান্ধী সঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন।

     “তাতে আমাদের কিস্যু যায় আসে না। শ্রীলঙ্কা সরকার তামিল জঙ্গীদের সামলাতে না পারার ব্যর্থতা আমাদের ঘাড়ে চালান করতে চাইছে। নিজেদের সমস্যা ওরা নিজেরাই মেটাক, আমরা হস্তক্ষেপ করব না। তবে এর বাইরেও আরেকটা পথ আছে যাতে সাপও মরবে আবার লাঠিও ভাঙবে না।”

     “কী সেটা?” শ্রীমতী গান্ধী এবং রাজীব সঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে সমস্বরে বললেন।

     “আমরা শ্রীলঙ্কা সরকারকে জাফনার মতো তামিল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জায়গাগুলোয় প্লেবিসাইট করার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে পারি। সেখানকার তামিলরা নিজেরাই ভোট দিয়ে সিদ্ধান্ত নিক তারা শ্রীলঙ্কার সঙ্গেই থাকতে চায় নাকি ভারতের সঙ্গে যুক্ত হতে চায়। শ্রীলঙ্কার উপর প্লেবিসাইট করার চাপ সৃষ্টির জন্য আমরা ভারতবান্ধব দেশগুলোকেও প্রয়োজনে প্রভাবিত করব। বিভিন্ন দেশ থেকে চাপ বাড়লে শ্রীলঙ্কা তামিলদের বিষয়ে সুর নরম করতে বাধ্য হবে।”

     “কিন্তু এখানে একটা সমস্যা আছে,” শ্রীমতী গান্ধী বললেন, “সেক্ষেত্রে আমেরিকার মতো বেশ কিছু দেশ পাকিস্তানের পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের কাশ্মীরেও প্লেবিসাইট করার জন্যও চাপ দিতে পারে।”

     “সেরকম কিছু দাবি উঠলে আমরা তা অবশ্যই করব না। এমনকি আমাদের প্লেবিসাইটের দাবি শ্রীলঙ্কা না মানলেও কিস্যু যায় আসে না আমাদের। কিন্তু সেখানে তামিল জঙ্গীদমণে পিস কিপিং ফোর্স পাঠানোটা অ্যাভয়েড করা যায় অনায়াসে। আমরা চাই না পাঞ্জাবের খালিস্তানি জঙ্গীদের মতো শ্রীলঙ্কার তামিল জঙ্গীরাও ক্ষুব্ধ হয়ে ভারত সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করুক। এটাই সময়ের চাহিদা, কারণ মাত্র দেড় বছরের মধ্যে ১৯৯০ সালে ফের আমরা একটা লোকসভা নির্বাচনে যাব। এই মুহূর্তে আবার একটা জঙ্গী আন্দোলন সামলানোর মতো সময় বা অভিরুচি আমাদের নেই। আমাদের সামনের লোকসভা নির্বাচন যথেষ্ট কঠিন হতে চলেছে। আমার বিরুদ্ধে ওঠা হেকলার অ্যান্ড কখ অস্ত্র কেলেংকারির মিথ্যা অভিযোগ, মান্ডার রাজার মন্ডল কমিশন, অযোধ্যায় ভাজপা দলের রামমন্দির প্রতিষ্ঠার হিড়িক ওঠার মতো আরও অনেক জটিল সমস্যার নাগপাশ আগামীদিনে আমাদের জড়িয়ে ধরতে পারে। নির্বাচনের আগে বিরোধীরা হয়তো আগামী দেড় বছর ধরে প্রতিদিন অভিযোগের তীরে আমাদের সংসদে বিদ্ধ করবে। এই মুহূর্তে আমাদের যেটা দরকার সেটা হল পারিবারিক অখন্ডতা বজায় রেখে রাজনৈতিক বিরোধীদের সঙ্গে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করা।”

     স্কচের গ্লাস হাতে ঈষৎ নেশাগ্রস্ত চোখে সঞ্জয় কথাগুলো বলে যাচ্ছিল। শ্রীমতী গান্ধী ও রাজীব মুগ্ধ হয়ে তার প্রতিটি কথা মন দিয়ে শুনছিলেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন তাঁর কনিষ্ঠ পুত্রের প্রতিটি কথা বর্ণে বর্ণে সত্যি। একবর্ণও মিথ্যে নয়, সবই চূড়ান্ত বাস্তব। পুত্রগর্বে শ্রীমতী গান্ধীর বুক ভরে উঠছে। তাঁর দুচোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে আনন্দাশ্রু। তিনি সঞ্জয়ের মাথার চুল আলতো করে ঘেঁটে দিয়ে বললেন, “অনেক রাত হল, চল খেতে যাবি না?”

     “মা, প্লিজ ওয়ান মোর ড্রিংক, জাস্ট ওয়ান। চল দাদা, একটা ড্রিংক নিবি,” মায়ের অনুমতি চেয়ে দাদার দিকে তাকিয়ে সঞ্জয় বলল।

     দুজনের দিকে তাকিয়ে শ্রীমতী গান্ধী হেসে প্রশ্রয়ের সুরে বললেন, “বেশ, যা। কিন্তু মনে রাখিস, জাস্ট ওয়ান।”

     তিনি দেখলেন সঞ্জয় আলতো করে দাদা রাজীবের কাঁধটি জড়িয়ে ধরে ঈষৎ টলতে টলতে বার কাউন্টারের দিকে চলেছে। তিনি পিছন থেকে দেখতে পাচ্ছেন তাঁর দুই পুত্রের দুটি চওড়া কাঁধ। স্তম্ভের মতো যে দুটি কাঁধের উপর দাঁড়িয়ে আছে ভারতের আগামীর ভবিষ্যৎ।

    

     ।। ১২ ।।

    

     ১৯৮৯ এর শুরুতেই মান্ডার রাজা বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর পদ ছাড়লেন। মাঝখানে শ্রীমতী গান্ধী যখন একবার মন্ত্রীসভার রদবদল করেন তখন সঞ্জয় প্রতিরক্ষা দপ্তর ছেড়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকে চলে আসে। রামজন্মভূমি-বাবরি মসজিদ মামলার ফায়দা তুলে বিজেপি দেশের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে শুরু করার আগে কাশ্মীরেও সন্ত্রাসবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে শুরু করে, কাশ্মীরী ব্রাহ্মণদের পরিবারগুলি উপত্যকা থেকে বিতাড়িত হয়, এই অবস্থায় সঞ্জয়কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের দায়িত্ব নিতেই হত।

     এদিকে সঞ্জয়ও মাসখানেক ধরেই টের পাচ্ছিল দলের ভিতর অনেক নেতাই তাকে দুর্নীতিবাজ পলিটিশিয়ান হিসেবে বারবার বিদ্ধ করছিলেন। শ্রীমতী গান্ধীর আহ্বান করা কংগ্রেসের শেষবারের ওয়ার্কিং কমিটির মিটিংয়ে বলতে উঠে ভি পি সিংহ সরাসরি তার বিরুদ্ধে আঙুল তুলে বলেছিলেন, “হেকলার অ্যান্ড কখ আর্মস ডিলে যেখানে বারবার প্রধানমন্ত্রীর পুত্র সঞ্জয় গান্ধী সহ আরও দুজন কংগ্রেস নেতার নাম উঠে আসছে, সেখানে দলের ভিতর স্বচ্ছতার স্বার্থেই মাননীয়া প্রধানমন্ত্রীর উচিত জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটি গঠন করে নিরপেক্ষ তদন্ত করে পার্টিকে অভিযোগ মুক্ত করা।”

     জগদীশ টাইটলার বলল, “যেখানে সিবিআই এই বিষয়ে তদন্ত করছে সেখানে জেপিসি গঠন করা অর্থহীন। যতক্ষণ না সিবিআই তদন্ত করে তার অন্তিম রিপোর্ট পেশ করছে ততক্ষণ দ্বিতীয় কোনও তদন্ত কমিটি গঠন করার প্রয়োজন নেই৷”

     কংগ্রেসের সাংসদ এবং নেহরু-গান্ধী পরিবারের একদা ঘনিষ্ঠ অরুণ নেহরু উঠে ভি পি সিংহের সমর্থনে বললেন, “যেহেতু, জগদীশ টাইটলার নিজে প্রধানমন্ত্রী পুত্রের সঙ্গে আর্মস ডিল দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত তাই সে নিজে এই তদন্ত বিষয়ে কোনও স্বাধীন মতামত ওয়ার্কিং কমিটির সভায় পেশ করতে পারে না।”

     সঞ্জয় চুপচাপ বসেছিল। সে মন দিয়ে সভার কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করছিল। সে বুঝতে পারল, হেকলার অ্যান্ড কখ আর্মস ডিল নিয়ে কংগ্রেসের কার্যসমিতির সভা দ্বিধাবিভক্ত হলেও যদি ভোটাভুটি হয় তবে তাদের পক্ষ বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহের পক্ষকে হারিয়ে দেবে। দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা এখন তার অনুগামী। কিন্তু এই ইস্যু আর কিছুদিন যদি এভাবে ফেলে রাখা হয় তবে মান্ডার রাজা ও অরুণ নেহরুদের পক্ষ পাল্লায় ভারী হয়ে উঠবে। সঞ্জয় ওয়ার্কিং কমিটির সভাপতির আসনে বসা তার মায়ের দিকে তাকাল। ইদানীং তার মা মিসেস গান্ধীও যেন তাকে সন্দেহ করতে শুরু করেছেন। তিনি সঞ্জয়ের সঙ্গে কথা বলার সময় ইদানীং খুব সহজেই মেজাজ হারিয়ে ফেলছেন, অস্থির হয়ে উঠছেন। প্রেশার, কোলেস্টেরল দুটোই সাম্প্রতিক সময়ে উর্দ্ধমুখী হয়েছে তার মায়ের।

     সঞ্জয় দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “কর্মসমিতির সভার সভাপতির কাছে আমি এই আবেদন রাখছি যে এই সভাতেই প্রস্তাব আনা হোক— সিবিআই যতদিন আর্মস ডিল নিয়ে তদন্ত করে তার রিপোর্ট না দিচ্ছে ততদিন যেন জেপিসি গঠন করা না হয়।”

     সভাপতি প্রস্তাবটি সভায় ফেলার সঙ্গে সঙ্গে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধ্বনি ভোটে তা পাস হয়ে গেল। সাংসদ বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ, অরুণ নেহরু এবং আরিফ মহম্মদ খান সভা ত্যাগ করে ওয়াক আউট করে বেরিয়ে গেলেন। ঠিক এক সপ্তাহ পর ওই তিনজনের নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক দল জনমোর্চা গঠন করে তাঁরা সঞ্জয় গান্ধী এবং মিসেস গান্ধীর নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে প্রচার শুরু করলেন। সেই সুযোগে ভাজপা নেতারাও কংগ্রেস দলের অন্দরে শ্রীমতী গান্ধী ও তাঁর দুই পুত্র সঞ্জয় ও রাজীবের আধিপত্য এবং শক্তির অপব্যবহারকে সমালোচনা করে পরিবারতন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠলেন।

     পরিস্থিতি সাময়িকভাবে সামাল দিলেও সঞ্জয় বুঝতে পারছিল দলের ভিতর যে অন্তর্দ্বন্দ্বের বীজ ভি পি সিংহরা রোপন করে গেছেন তা অচিরেই বিষবৃক্ষ হয়ে বেড়ে উঠবে। ইতিমধ্যে প্রধান বিরোধী দল বিজেপি রামজন্মভূমিকে কেন্দ্র করে আন্দোলন শুরু করেছে। তাদের সহায়ক সংগঠন বিশ্ব হিন্দু পরিষদ অযোধ্যার রামজন্মভূমিতে মীর বাঁকি প্রতিষ্ঠিত বাবরি মসজিদের নির্মাণকাল নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলেছে, সমাজের একটা বড়সড় অংশের হিন্দুদের মধ্যে বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলারও প্ররোচনা দিতে শুরু করেছে। দেশজুড়ে ভাজপা-র সদস্য সংখ্যাও ইদানীং বাড়তে শুরু করেছে। স্বাধীনতার পর থেকে ভারতের মতো ধর্মনিরপেক্ষ দেশে সংখ্যালঘু মুসলমান নাগরিকদের তোষণ করে যেভাবে সঞ্জয়দের দল কংগ্রেস ভোটব্যাঙ্ক অক্ষুণ্ণ রেখেছে, তারই বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে ভারতীয় জনতা পার্টি সংখ্যাগুরু হিন্দুদের প্রলুব্ধ করছে রামজন্মভূমিতে রামমন্দির গড়ার ডাক দিয়ে।

     ঘটনা হল ১৯৯০ এর নবম লোকসভার ভোট আর মাত্র দুমাস পরে এবং সেই ভোটে অবশ্যই ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতে চলেছে। কংগ্রেস, ভাজপা এবং নবগঠিত জনতা দল। জনমোর্চা, জনতা পার্টি, লোকদল এবং কংগ্রেস(এস) সদ্য মিশে গিয়ে নতুন জনতা দলের সৃষ্টি হয়েছে, যার মাথায় নেতা হিসেবে রয়েছেন বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ। অর্থাৎ, সঞ্জয় পরিষ্কার বুঝতে পারছে আগামী ভোটের জনমত তিনভাগে ভাগ হতে চলেছে, যা কংগ্রেসের পক্ষে অত্যন্ত চিন্তার বিষয়।

     সঞ্জয় সফদরজংয়ের বাংলোয় ফিরে বিষয়টা নিয়ে গভীর চিন্তায় ডুব দিল। এমন কিছু একটা করা দরকার যা ভারতের নাগরিকদের চোখে কংগ্রেসকে নয়নের মণি করে তুলবে, একমাত্র তার ফলেই আগামী ‘৯০ সালের লোকসভার ভোট কংগ্রেসের দিকে স্যুইং করবে।

    

     সন্ধে সাতটা নাগাদ সঞ্জয় যখন বাংলোর লনে বসে চাঁদের আলোয় ঈষৎ পানাহার করছিল। তখন বাংলো থেকে বেরিয়ে আসছিলেন শ্রীমতী গান্ধীর পার্সোনাল ফিজিশিয়ান ড. কৃষ্ণপ্রসাদ মাথুর। সঞ্জয় জানে দিনকয়েক ধরে মায়ের শরীরটা ভালো নেই, উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যা বেড়েছে। ডাক্তারকে দেখে সে বলল, “ডক্টর মাথুর, মাকে কেমন দেখলেন?”

     “রক্তচাপটা বেশ বেড়েছে দেখলাম। ট্রাইগ্লিসারাইড ও কোলেস্টেরলও বেড়েছে। ইদানীং ওঁর মধ্যে কিছু অস্থিরতা টের পাচ্ছি, সবসময় যেন কী চিন্তা করেন, রাতে ঘুমও কমে গেছে। আমি অনেকগুলো নতুন ওষুধ লিখে দিয়েছি, সব মিলিয়ে দিনে ন’টা ওষুধ, সেগুলো যেন উনি রোজ সময় করে খান, একটু নজর রাখবেন।”

     “ন-খানা ওষুধ! বাপরে! এত ওষুধ খেলে তো সুস্থ মানুষও অসুস্থ হয়ে পড়বে। আচ্ছা ডক্টরসাব, একটা কথা বলুন তো, আমাদের পুর্বপুরুষেরা কি এত ওষুধ খেতেন? অথচ তারা দীর্ঘায়ু হতেন। আমি ‘৮০ সালে যখন দেরাদুন গিয়েছিলাম, সেখানে গিয়ে তখন আনন্দময়ী মাকে দেখেছিলাম। ওঁর কথা শুনে আমার মনে হয়েছিল জীবনে সুন্দরভাবে, সুস্থ শরীরে বেঁচে থাকার জন্য আর্ট অফ লিভিং বা জীবনশৈলী জানা দরকার। আপনার কি মনে হয় না যে জীবনের প্রতি একটা হলিস্টিক অ্যাপ্রোচ আমাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ করে তুলতে পারে যতটা না ওষুধপথ্যি পারে? ডক্টরসাব, আপনি এক কাজ করুন, অ্যান্টি ডিপ্রেস্যান্ট ওষুধ তিনটে ছাড়া মায়ের সমস্ত ওষুধ মাসখানেকের জন্য বন্ধ করে দিন। আমার স্থির বিশ্বাস।”

     পদ্মশ্রী পুরস্কারপ্রাপ্ত ড. মাথুর নীরবে মাথা নাড়লেন, তবে সেই মাথা নাড়ায় প্রত্যয়ের অভাব ছিল, বরং এক অনিশ্চয়তা ছিল।

     “ড. মাথুর, আপনি মায়ের স্বস্থ্য নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন হবেন না। আমি আগামীকালই মাকে নিয়ে দিন পনেরোর জন্য দেরাদুন, মুসৌরি ঘুরে আসছি। ওখানে মুক্ত বায়ু সেবন আর পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটাচলা করলে মা পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবেন,” সঞ্জয় হেসে জানাল।

     “আমি কি তবে ওঁর সঙ্গে যাব?” মাথুর আমতা আমতা করে প্রশ্ন করলেন।

     “নাহ, আপনার যাওয়ার দরকার নেই। মা, আমাদের সঙ্গে ফ্রি মাইন্ডে কয়েকদিন কাটালে পাহাড়ের জলহাওয়ায় দিব্যি সুস্থ হয়ে উঠবেন।”

    

     পাঁচদিন হল প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী দেরাদুন এসেছেন। সঞ্জয় তাঁকে বোঝাতে সমর্থ হয়েছে যে অত্যধিক কাজের চাপ তাঁর শরীর খারাপ হওয়ার আসল কারণ। শী নিডেড আ ব্রেক। মুসৌরি আসার পর প্রতিদিন ভোরবেলা তিনি সরকারি সার্কিট হাউস থেকে হাঁটতে বের হন। কোনও কোনওদিন বছর দশেকের সঞ্জয়পুত্র বরুণ তাঁর সঙ্গী হয়। স্পোর্টস শ্যু পরে ঘণ্টাখানেক পাহাড়ি পথে হেঁটে গা ঘামিয়ে তিনি সার্কিট হাউসে ফিরে আসেন। সেখানে মানেকা ও সঞ্জয় ব্রেকফাস্ট টেবিল সাজিয়ে তাঁর জন্য অপেক্ষা করে।

     এখানে আসার পর দিন পাঁচেক অতিক্রান্ত হয়েছে, শ্রীমতী গান্ধীর নিজেকে বেশ ফুরফুরে লাগছিল। পুত্র সঞ্জয় ঠিকই বলেছে তাঁকে, ওষুধপথ্যিতে কিস্যু হয় না, শুধু নির্মল মুক্ত বায়ু আর সামান্য শারীরিক কসরত করলেই শরীর ঠিক থাকে। শরীরের নাম হল মহাশয়, যা সওয়ানো হয় তাই সয়! পাঁচদিন হল শ্রীমতী গান্ধী তাই ওষুধপথ্যি একটিও ছোঁননি। আজ, সকালে বেরিয়ে বরুণ বায়না ধরেছে কেম্পটি ফলস বেড়াতে যাবে। এখানে আসার পর সে বিখ্যাত জলপ্রপাতটি এখনও দেখেনি। দিল্লি ফিরে ইস্কুলের বন্ধুদের সে কী করে বলবে যে কেম্পটি ফলস দেখেনি!

     মিসেস গান্ধী তাঁর পৌত্রপৌত্রীদের বড্ড ভালোবাসেন। রাহুল, প্রিয়াংকা, বরুণ সবাই তাঁর প্রিয়। প্রিয়াংকার মধ্যে তিনি নিজের ছায়া দেখতে পান। কিন্তু নাতি নাতনিদের মধ্যে বরুণ সবার ছোট হওয়ায় হৃদয়ে বিশেষ জায়গা নিয়ে রয়েছে। বরুণের আবদার তাই ফেলতে পারেন না। আজ বরুণকে নিয়ে সার্কিট হাউস থেকে গাড়িতে কেম্পটি ফলসের কাছে এসেছেন। রাস্তা থেকে একশো মিটার ঢাল বেয়ে নিচে নামলে কেম্পটির সামনে গিয়ে দাঁড়ানো যায়। তাঁর প্রাতঃভ্রমণের সময় রোজ সঙ্গে ছয়জন সশস্ত্র দেহরক্ষী থাকে। এদের সবার হাতেই মাইক্রো উজি থাকে।

     পাহাড়ি রাস্তার ঢাল বেয়ে বরুণ নামছে ছটফটে ছাগলছানার মতো। শ্রীমতী গান্ধী হাঁটছেন কিছুটা ধীর গতিতে, ইদানীং হাঁটুর সমস্যাতেও ভুগছেন। তাঁর মনটা আজ বেশ ফুরফুরে, নাতির সঙ্গে কেম্পটিতে ছবি তুলবেন বলে একজন প্রফেশনাল ফোটোগ্রাফারও এনেছেন। সামনে অপরূপ সুন্দর কেম্পটি জলপ্রপাত। প্রপাতের মূল জলরাশি প্রায় সাড়ে চার হাজার ফুট উপর থেকে শুরু হয়ে চার-পাঁচটা জলপ্রপাত সৃষ্টি করেছে। শেষের অংশটির উচ্চতা ৪০ ফুট। জলরাশি পাথরের উপর আছড়ে পড়ে মিহি জলকণার ধোঁয়াশা সৃষ্টি করেছে, তার উপর ভোরের সূর্যের নরম আলো পড়ে অপূর্ব বেনীআসহকলা সৃষ্টি করেছে। জলপ্রপাতকে পিছনে রেখে মিসেস গান্ধী নাতিকে পাশে নিয়ে দাঁড়ালেন। তাঁর পরনে সবুজ-সাদা পিওর সিল্ক শাড়ি, গায়ে চড়ানো মাখন রঙের কার্ডিগান। লাল জামা পরা বরুণ তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে গ্র‍্যান্ডমা-র আঙুল জড়িয়ে ধরতেই পেশাদার ফোটোগ্রাফার এগিয়ে এসে তার পেনট্যাক্স ক্যামেরার শাটার টিপে ছবি তুলল।

     এবার ফেরার পালা। বরুণ লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে চড়াই পাথুরে রাস্তা। মিসেস গান্ধী তাঁর হাঁটু নিয়ে যথেষ্ট সতর্ক, উঁচু পাথরগুলোয় সাবধানে পা ফেলে উঠছেন। কিন্তু আচমকা তাঁর মনে হল মাথাটা যেন একটু রিল করে গেল। শরীর জুড়ে এক অদ্ভুত অস্বস্তি শুরু হয়েছে, বুকের বাঁদিকে একটা খামচে ধরা ব্যথা জেগে উঠছে। এমন ঠান্ডা আবহাওয়াতেও তিনি ঘামতে শুরু করলেন কেন! তিনি এক মুহূর্ত উপরের দিকে তাকিয়ে বরুণকে দেখলেন, ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন পিছনের দেহরক্ষীটিও ঢালের অনেকটা নিচে, হঠাৎ নিজেকে কেমন অসহায় মনে হল তাঁর, পরমুহূর্তেই সংজ্ঞাহীন হয়ে ঢলে পড়লেন। তাঁর দেহরক্ষীরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাঁর পা টলে গিয়ে সংজ্ঞাহীন শরীরটা প্রায় দশ মিটার গড়িয়ে নিচে একটা পাথরের খাঁজে আটকে গেল।

    

     রাত বারোটা নাগাদ দিল্লি এইমসের বোর্ড অফ ডক্টরসের প্রধান ড. কুলকার্নি মাথা নীচু করে এসে দাঁড়ালেন সঞ্জয় আর রাজীবের সামনে। সঞ্জয়ের অন্য পাশে দাঁড়িয়ে আছেন ড. মাথুর। দেখলেই বোঝা যাচ্ছে তিনি বেশ অসন্তুষ্ট হয়ে আছেন গান্ধী পরিবারের সদস্যদের উপর।

     “সিভিয়ার ইন্টারন্যাল হেমারেজ, একটা নয় অন্তত তিন-চারটে জায়গায়, ব্রেনের ভেন্ট্রিকলেও রক্ত জমছে, প্রোফিউজ ব্লিডিং হয়েছে,” ড. কুলকার্নি একটা বড় করে দম নিয়ে বললেন, “এই অবস্থায়, ইউ নো…কনশাসনেসও নেই… শি ইজ আন্ডার ভেন্টিলেশন… অনেকক্ষণ হল কোমায় চলে গেছেন। সরি টু সে, এখান থেকে একমাত্র মিরাক্যাল ছাড়া ফিরে আসার কোনও সম্ভাবনা নেই। জাস্ট প্রে টু গড… আমরা আমাদের মতো যথাসাধ্য চেষ্টা করছি।”

     সঞ্জয় ব্যথিত চোখে রাজীবের দিকে তাকাল। কোমল হৃদয়ের মানুষ রাজীবের দুচোখ বেয়ে ততক্ষণে জল গড়াতে শুরু করেছে। সোনিয়া, মানেকা এবং জনাদুয়েক নিকট আত্মীয়কে বিশ বছরের রাজীবপুত্র রাহুলের জিম্মায় রেখে দুই ভাই এইমস ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলেন। বাইরে পা-রাখা মাত্র সঞ্জয় দেখল হাসপাতাল প্রাঙ্গন অন্তত শ’খানেক প্রেস জার্নালিস্টের ভিড়ে পরিপূর্ণ। দূরদর্শনের মতো সরকারি বৈদ্যুতিন মিডিয়ার সাংবাদিকেরাও ক্যামেরা নিয়ে হাজির। চারদিক থেকে নানা রকমের প্রশ্ন ছুটে আসছে। ‘স্যার, ম্যাডাম কেমন আছেন?’, ‘এটা কি স্বাভাবিক দুর্ঘটনা নাকি দুর্ঘটনার পিছনে কোনও ষড়যন্ত্র থাকতে পারে?’, ‘কাশ্মীরের জেকেএলএফ কিংবা জিহাদি জঙ্গীদের কি কোনও যোগ থাকতে পারে?’ অথবা ‘স্যার, আর মাত্র একমাস পরে লোকসভা নির্বাচন, এই অবস্থায় ম্যাডামের এই দুর্ঘটনা পার্টির উপর কত বড় আঘাত বলে মনে করছেন?’

     সঞ্জয় ও রাজীব কোনও প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ভিড় ঠেলে গাড়ির কাছে পৌঁছে গেল। বড় সেডান গাড়িটায় চেপে জানলার কাচ নামিয়ে দিল সঞ্জয়। তার সামনে এখন অনেক বড় কাজ, সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সময় নষ্ট করার মতো সময় তার হাতে নেই। আপাতত তাদের গন্তব্য হল ২৪ নং আকবর রোড।

     ২৪ নং আকবর রোডে কংগ্রেস পার্টির সর্বভারতীয় দপ্তরের ভিতর ওয়ার্কিং কমিটির রুদ্ধদ্বার বৈঠক শুরু হয়েছে ঘণ্টাখানেক আগে। রাত পৌনে দুটো বাজে। বাংলোর সামনের পোর্টিকোয় দাঁড়িয়েছিলেন কলকাতার বর্তমান পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক বরুণ সেনগুপ্ত। তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকার বছর চল্লিশের তরুণ সাংবাদিক এম জে আকবর। তার মুখেচোখে উদ্বেগ স্পষ্ট। আকবর প্রধানমন্ত্রীপুত্র রাজীবের ঘনিষ্ঠ।

     “তোমার থিয়োরি কী, আকবর?” বরুণ বললেন।

     “কী ব্যাপারে?”

     “কোনও রকমের কনস্পিরেসি, ফাউল প্লে আছে কি মুসৌরির দুর্ঘটনার পিছনে?”

     “দেখুন দাদা, সঞ্জয়, রাজীব দুজনেই আমার ঘনিষ্ঠ, মায়ের হাতে সঞ্জয়ের রাজনীতির হাতেখড়ি হলেও সঞ্জয়ের দূরদৃষ্টি ভারতের পূর্বতন সব প্রধানমন্ত্রীর চেয়ে অনেক বেশি। তাই দুর্ঘটনার পিছনে কোনও ফাউল-প্লে থাকলে তা অনেক আগেই সঞ্জয়ের স্ক্যানারে চলে আসতো,” এম জে আকবর ধীরে ধীরে কথাগুলো বলল। “আমি ভাবছি অন্য কথা, সামনেই লোকসভা নির্বাচন, নির্বাচন কমিশনের প্রকাশিত নির্বাচনের নির্ঘন্ট অনুযায়ী মাত্র এক সপ্তাহ পর থেকে শুরু হচ্ছে মনোনয়ন পত্র পেশ… এই অবস্থায় পার্টি কিভাবে এই মহাসংকট পেরোবে সেটাই ভাবছি।”

     হঠাৎ পার্টি অফিসের সামনে জড়ো হওয়া সাংবাদিকদের মধ্যে একটা গুঞ্জন উঠল। বরুনবাবু এবং আকবরের কথোপকথনে ছেদ পড়ল। দুজনেই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল বাংলোর বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে পার্টির অন্যতম নেতা ও মুখপাত্র জগদীশ টাইটলার। তার হাতে একটা প্রেসনোট। সে জড়ো হওয়া সাংবাদিকদের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করল, “আগামী নবম লোকসভা সাধারণ নির্বাচনে ভারতীয় কংগ্রেস দল মাতৃসমা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরাজীর আশীর্বাদ নিয়ে লড়াই করবে। আকস্মিক দুর্ঘটনায় শয্যাশায়ী প্রধানমন্ত্রী এখন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। দেশের প্রতিটি মানুষের মতো আমরা ব্যথিত ও উদ্বিগ্ন। আমরা তাঁর সুস্থতার জন্য প্রতিনিয়ত ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা জানাচ্ছি। আমাদের বিশ্বাস ঈশ্বরের অশেষ কৃপায় তিনি আবার সুস্থ হয়ে আমাদের মাথার উপর ফিরে আসবেন, মায়ের মতো আমাদের ফের তাঁর স্নেহডোরে বাঁধবেন। কিন্তু তার আগে আমাদের লোকসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে, জয়লাভ করতে হবে। আপনাদের জানাই, আজ পার্টির ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি যে আগামী নবম লোকসভা সাধারণ নির্বাচনে কংগ্রেস দল প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী শ্রী সঞ্জয় গান্ধীর নেতৃত্বে ৫৪৫ টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে দেশের মানুষের জনাদেশ এবং ইন্দিরাজীর আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে পুনরায় জয়যুক্ত হবে। প্রসঙ্গক্রমে জানাই সঞ্জয় গান্ধী জানিয়েছেন, ইন্দিরাজীর এই আকস্মিক দুর্ঘটনার তদন্তের জন্য সুপ্রিম কোর্টের তিনজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারককে নিয়ে নিরপেক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে এবং দোষীকে খুঁজে বের করে ভারতীয় আইনের দণ্ডবিধি প্রয়োগ করে কঠোরতম শাস্তি দেওয়া হবে।”

     বরুণ সেনগুপ্ত ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন ইতিমধ্যেই সরকার নিয়ন্ত্রিত দূরদর্শন ২৪ নং আকবর রোডের প্রাঙ্গন থেকে পার্টির মুখপাত্র জগদীশ টাইটলারের প্রেসনোট পাঠের সরাসরি সম্প্রচার শুরু করেছে জাতির উদ্দেশ্যে।

    

     দ্বিতীয় পর্ব

    

     ।। ১৩ ।।

    

     “স্যার, তাহলে এবার বেস্ট টাইম ট্রাভেলার অব দ্য ইয়ারের অ্যাওয়ার্ডটা হরিপদদাই পাচ্ছে?” মনোতোষ ঈষৎ অভিমানের সুরে বলল।

     “হরিপদ এফিশিয়েন্ট। নতুন টাইমলাইনে সে তিন তিনটে অ্যাসাসিনেশন আটকে দিয়েছে। তবে শেষে কি হবে কেউ কি বলতে পারে, ইতিহাসের ঘটনাপ্রবাহ তার সুনির্দিষ্ট গতিপথ খুঁজে নেয়।” তেরোতলায় নিজের অফিস চেম্বারে বসে মুখার্জিসাহেব বললেন।

     তিনি লক্ষ করে দেখেছেন হরিপদ আর মনোতোষের মধ্যে একটা প্রফেশনাল রাইভ্যালরি রয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অফ ইটারন্যাল জাস্টিসের নিষ্পত্তি হওয়া কেসগুলোর এক্সিকিউশন নিয়ে দুজনেই আগ্রহী। এই কাজগুলোয় যেমন ভালো ট্রাভেলিং অ্যালাউন্স আর ডেইলি অ্যালাউন্স পাওয়া যায় তেমনই এমপ্লয়ি অ্যাকাউন্টে স্টার পয়েন্ট যোগ হয়। বছরের শেষে এই স্টার পয়েন্ট যার সবচেয়ে বেশি হয় সে বেস্ট টাইম ট্রাভেলার অফ দ্য ইয়ার হয়।

     “স্যার, আমাকেও একটা বড় কাজ দিন,” মনোতোষ কাঁচুমাচু মুখে বলল, “তিন মাস হল বিয়ে করেছি। কোনও বড় কাজ করতে না পারলে যে বউয়ের মুখ থাকে না। আপনি সব বড় কাজ হরিপদদাকে দিয়ে দিচ্ছেন…”

     “আরে, দাঁড়াও দাঁড়াও, একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব দেব বলেই তো তোমাকে এখানে ডেকেছি,” মুখার্জিসাহেব তাকে মাঝপথে থামিয়ে বললেন। “তুমি সদ্য বিবাহিত বলেই এই কাজের গুরুত্ব বুঝবে। গতকাল আইসিইজে আদালতের একটা পুরোনো মামলার রায় বেরিয়েছে। রূপিন কাটিয়াল নামে তোমার মতো এক সদ্য বিবাহিত তরুণ তার নববিবাহিত স্ত্রী রচনা কাটিয়ালকে নিয়ে নেপালে গিয়েছিল। ফেরার পথে তাদের বিমানটি ১৭০ জন যাত্রীসহ পাকিস্তানি জঙ্গীরা হাইজ্যাক করে এবং রূপিন কাটিয়ালকে খুন করে। তোমার কাজ হল রূপিনকে বাঁচানো।”

     “অনেক ধন্যবাদ, স্যার। আমি এক্ষুণি কাজে বেরিয়ে পড়ছি, আপনি একদম চিন্তা করবেন না।”

    

     ।। ১৪ ।।

    

     হাতঘড়ির মতো সময়যানটা অন করে মনোতোষ যখন নেপালের ত্রিভূবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের প্রবেশদ্বারের সামনে অবতরণ করল তখন সময়যান যে কালখন্ডের সামনে এনে দাঁড় করাল তা হল— ২৪ ডিসেম্বর, ১৯৯৯, বিকেল সাড়ে তিনটে। সময়যানটা নিউট্রাল মোডে দিয়ে সে বিমানবন্দরের ভিতরে ঢুকল। লবিটা লোকে লোকারণ্য, বড়দিনের ছুটির ভিড়টা চোখে পড়ার মতো। মনোতোষের হাতে মাত্র আধঘণ্টা, তার মধ্যেই কাজ সারতে হবে।

     মনোতোষ বিমানবন্দরের ফোনবুথে ঢুকে পড়ল। বুথের কাচের ভিতর দিয়ে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের চেক-ইন কাউন্টার। দিল্লিগামী এয়ারবাস ৩০০ -এর যাত্রীদের চেক-ইন শুরু হয়ে গিয়েছে। মনোতোষ দেখতে পাচ্ছে একটা সুন্দরী নেপালী মেয়ে কাউন্টারে বসে যাত্রীদের টিকিট ও পরিচয়পত্র দেখছে। বুথের ভিতরের ফোনের রিসিভারটা তুলে মনোতোষ একটা নম্বর ডায়াল করল। ওপাশে রিং হচ্ছে, হয়েই যাচ্ছে, কেউ তুলছে না। আবার নন্বরটায় রিং করে উৎকন্ঠিত চোখে কাচের বাইরে তাকাল মনোতোষ। দেখতে পেল ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের চেক-ইন কাউন্টারের মেয়েটা কিছুটা বিরক্ত হয়ে তার সামনে রাখা ফোনের রিসিভারটা তুলে তার কানে চেপে ধরল।

     দৃশ্যটা দেখে মনোতোষ তড়িঘড়ি বলল, “হ্যালো, প্লিজ স্টপ দ্য ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্স এয়ারবাস ৩০০ ইমিডিয়েটলি। ইটস গোয়িং টু বি হাইজ্যাকড।”

     “হোয়াট! হু… হু ইজ দিস… হোয়াট কাইন্ড অফ জোক ইজ দিস?” মেয়েটা তোতলাতে শুরু করেছিল, কিন্তু পরক্ষণেই তার মনে হল কেউ রসিকতা করছে।

     “জোক নয় ম্যাডাম৷ পাঁচজন… পাঁচজন হাইজ্যাকার অন বোর্ড রয়েছে… তারা পাকিস্তানি জঙ্গী, নিজেদের আইডেন্টিটি গোপন রেখে ফ্লাইটের ১৭৬ জন সাধারণ যাত্রীদের মধ্যে মিশে আছে। তাড়াতাড়ি এই প্লেনের টেক অফ আটকান… “

     “আ… আপনি কে বলছেন… আপনার পরিচয় কি… আপনি যে সত্যি বলছেন তার কি…”

     “এত সময় নেই ম্যাডাম… এটুকু বলি, আয়াম উইথ র’ কিন্তু আমার আইডেন্টিটি ডিসক্লোজ করতে পারব না… হাতে একদম সময় নেই ম্যাডাম। দিস ইজ আ কোয়েশ্চেন অফ ন্যাশনাল সিকিউরিটি। এই প্লেনকে অন্তত একদিন পরে রিশিডিউল করুন, প্রত্যেককে আলাদা করে ফের চেকিং করুন। অ্যান্ড প্লিজ ইনফর্ম ইওর সিকিউরিটি অফিসার… প্লিজ ইনফর্ম পুলিশ ইমিডিয়েটলি…

     “স্যার, প্লিজ আমার সিনিয়রের সঙ্গে কথা বলুন। শুনে আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে… আমি সিনিয়রকে ডাকছি…

     “নো ম্যাডাম, আই কান্ট রিভিল মাই আইডেন্টিটি। আপনাকে সব জানালাম… নাউ দিস ইজ ইওর কল।”

     “স্যার প্লিজ… প্লিজ টক টু মাই সিনিয়র… স্যার… স্যার? আর ইউ দেয়ার?”

     ততক্ষণে মনোতোষ ফোনটা কেটে দিয়ে ফোনবুথের কাচের দেয়ালের বাইরে তাকিয়ে দেখল কাউন্টারের সুন্দরী মেয়েটার মুখেচোখে চরম আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। নিজের আসন ছেড়ে মেয়েটা একটা নির্দিষ্ট দিকে ছুটতে শুরু করেছে। চেক-ইন করতে আসা এয়ারবাসের যাত্রীদের মধ্যেও হতভম্ব ভাব ফুটে উঠতে শুরু করেছে, হঠাৎ কি হল তারা বুঝে উঠতে পারছে না। ধীরে ধীরে দিশেহারা ভাবটা আতঙ্কের রূপ নিচ্ছে। দশ মিনিটের মধ্যে মাইকে ঘোষণা ভেসে এল দিল্লিগামী ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের এয়ারবাস-৩০০ অনিবার্য কারণবশত ক্যান্সেল করা হয়েছে। নেপাল পুলিশের একটা বড় দল বিমানবন্দরটা ঘিরে ফেলল। চেক-ইন করে এয়ারবাসের দিকে রওনা দেওয়া যাত্রীদের বিমানবন্দরের সিকিউরিটিরা ফিরিয়ে দিল। তাদের ফের সিকিউরিটি চেকিংয়ে ডেকে নিতেই চারদিকে হুলুস্থুল শুরু গেল।

     মনোতোষ মৃদু হেসে ফোনবুথ থেকে বেরিয়ে এল। তারপর হাঁটতে হাঁটতেই হাতঘড়ির মতো সময়যানের একটা ছোট নব টিপতেই তার শরীরটা সবার অলক্ষ্যে ফিকে হতে হতে হাওয়ায় মিশে গেল।

    

     ।। ১৫ ।।

    

     ২৮ জানুয়ারি, ২০০০, কাশ্মীর

     জম্মুর কোট ভালওয়াল সেন্ট্রাল জেলের ভিতর বসেছিল লোকটা। মুখের দাড়ি বিগত চার বছরে আরও লম্বা হয়েছে, তবে লোকটার চেহারা একটু ভারীর দিকে। এই ভারী চেহারার জন্য একবার জেল থেকে পালাতে পারেনি লোকটা। চোখে চশমা, মুখে একটা শান্ত ভাব। দেখলে মনে হয় ইসলামিক শিক্ষার অধ্যাপক। অবশ্য জেলের ভিতরে অনেকেই বলে লোকটা নাকি সত্যিই পড়াত। সেজন্য জেলের ভিতর বেশির ভাগ কয়েদি আর কারারক্ষীরা তাকে মৌলানা বলে ডাকে। জেলের খাতায় পোশাকি নাম লেখা আছে— মৌলানা মাসুদ আজহার। পাক অধিকৃত কাশ্মীর তথা আজাদ কাশ্মীরের রাজধানী মুজফফরাবাদ থেকে থেকে শুরু করে গিলগিট-বালটিস্তান অঞ্চল আর ভারতের পূর্ব কাশ্মীরের সীমান্ত অঞ্চল লোকটার ক্রীড়াক্ষেত্র। সেখানকার সব মানুষ তাকে ভয় পায়, মান্যিগন্যি করে। হরকত-উল-জিহাদ-আল-ইসলামি অর্থাৎ হুজি-র সঙ্গে যখন হরকত-উল-মুজাহিদিন যুক্ত হয়ে নতুন জঙ্গী সংগঠন হরকত-উল-আনসার তৈরি হল, সেই জন্মলগ্ন থেকে যে জঙ্গীনেতারা সংগঠনটার দায়িত্ব নিয়েছিল মৌলানা তাদের অন্যতম। পাঁচ বছর আগে ১৯৯৪ তে লোকটাকে ভারতে জঙ্গী কার্যকলাপ চালানোর অভিযোগে অনন্তনাগের কাছ থেকে গ্রেপ্তার করেছিল ভারতীয় পুলিশ। কিন্তু লোকটা যে কাশ্মীর ও পাকিস্তানের জঙ্গী সংগঠনগুলোর কাছে কতটা দামি তা এক বছরের মধ্যেই টের পাওয়া গিয়েছিল। আল ফারহান নামে একটি জঙ্গী সংগঠন কাশ্মীর উপত্যকা থেকে ছয়জন বিদেশি পর্যটককে অপহরণ করে তাদের বিনিময়ে মৌলানার মুক্তি দাবি করেছিল। প্রধানমন্ত্রী সঞ্জয় গান্ধীর সরকার আল ফারহানের দাবি না মানায় ওরা অস্ট্রো নামে এক বিদেশি পর্যটকের শিরোচ্ছেদ করে উপত্যকায় ফেলে রেখে যায়। একজন পর্যটক জঙ্গীদের ডেরা থেকে পালাতে সক্ষম হলেও বাকি চারজনের আর কোনও খোঁজ পাওয়া যায়নি। সম্ভবত জঙ্গীরা তাদের মেরে ফেলে। সবই মৌলানা মাসুদ আজহারের জন্য।

    

     একটা চকখড়ি দিয়ে মৌলানা মেঝের উপর অর্থপূর্ণ কয়েকটা দাগ কাটছিল। প্রায় এক বছরের সলিটারি কনফাইনমেন্টের যন্ত্রণা সহ্য করে মাত্র এক সপ্তাহ আগে তিনজন কয়েদির কারাগারে ফিরেছে মৌলানা। শাস্তিস্বরূপ তাকে অন্ধকার ও সংকীর্ণ একক-কয়েদি জেলে পাঠানো হয়েছিল। প্রায় এক বছর আগে তার জেলের সঙ্গী সাজ্জাদ আফগানির সঙ্গে জেল থেকে পালানোর ছক কষেছিল মৌলানা। চার বছর ধরে তার নিজের কারাগার থেকে সেপটিক ট্যাঙ্কের ভিতর দিয়ে একটু একটু করে ১৮০ ফুটের লম্বা সুড়ঙ্গ কেটেছিল আফগানি, কিন্তু একটা ভুল করে ফেলেছিল সে। মৌলানার ভারিক্কি শরীরের আন্দাজ না বুঝতে পেরে সুড়ঙ্গের বেড়টা কম কেটেছিল। ফলে পালানোর সময় মৌলানা সুড়ঙ্গে আটকে যায় আর জেলের পাগলাঘন্টি বেজে ওঠে। তখন সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে বের হতে সক্ষম হলেও সাজ্জাদ আফগানি পুলিশের গুলিতে মারা যায়।

     মৌলানার এক অদ্ভুত ক্ষমতা আছে। জেলের ভিতর ইসলামিক বই পড়াশোনার পাশাপাশি অন্য কোনও ধরনের বই বা সংবাদপত্র পড়ার অনুমতি পাওয়া যায় না, তা সত্ত্বেও বহির্জগৎ বা বহির্জগতের ঘটনা সম্পর্কে তার একটা ধারণা আছে। ঠিক যেন টেলিপ্যাথি। তাকে মুক্ত করার জন্য পাকিস্তান ও কাশ্মীরের বিভিন্ন জঙ্গী সংগঠনগুলো যে সক্রিয় মৌলানা সেটা শুধু অনুমানই করেন না, অনেকটা নিশ্চিতও। আরও চারমাস পরে ঈদ, অথচ কয়েদিদের খাবার ঘরে যে লোকটা চাপাটি, ডাল আর লপসি সার্ভ করে সে দু-দিন আগে মৌলনার থালায় খাবার পরিবেশন করার সময় ফিসফিসিয়ে বলল, “ঈদ মুবারক হো, ভাইজান।”

     সেদিন লোকটার কথা শুনে মৌলানা অবাক হলেও তাকে ঈদের শুভেচ্ছা জানিয়েছিল। তবে শব্দবন্ধটার ভিতরের বার্তা বুঝতে পারেনি। গতকালই কোডটা ক্র‍্যাক করে ফেলেছে সে। আর তারপর থেকেই চকখড়ি দিয়ে তার আঁকিবুঁকি আঁকা শুরু হয়েছে। শৌচাগারের এককোণে ট্যালি মার্ক দিয়ে দিন গুনতেও শুরু করেছে। রাত গভীর হলে তার কক্ষের দুজন ইনমেটস সালাউদ্দিন আর বশিরকে নিয়ে একটু একটু করে তার পরিকল্পনার রূপায়ণ করতেও শুরু করেছে।

     সপ্তাহের দু-দিন দিনের বেলা বশির জেলের কিচেনে আনাজপত্র কাটাকাটি, ধোয়ামোছার কাজ করে। সে লুকিয়ে একটা লোহার শিক জোগাড় করে আনল, মাটির চুল্লীতে কয়লাপোড়া ছাই খুঁচিয়ে বের করার কাজে লাগে। হাতুড়ির মতো একটা ভারী পাথরের টুকরো জোগাড় করে এনেছিল সালাউদ্দিন। রাতের অন্ধকার নামলে যখন কারারক্ষীরা ঘুমে অচেতন থাকে তখন মৌলানার নির্দেশে কাজ শুরু হয়। ইসলামি জিহাদে যুক্ত হওয়ার আগে, সোভিয়েত-আফগান যুদ্ধে অংশ নেওয়ারও আগে তরুণ বয়সে মৌলানা মাদ্রাসায় পড়িয়েছে। ইসলামিক শিক্ষার পাশাপাশি মাদ্রাসার ছাত্রদের সময় ও কাজের পাটিগণিতের অঙ্ক শেখানোর অভিজ্ঞতা থেকে মৌলানা খুব ভালো করেই জানে সাড়ে তিনমাস পরে ঈদের আগে সুড়ঙ্গ কাটার কাজ শেষ করতে গেলে কত ঘণ্টা ধরে ক’জনকে কাজটা করতে হবে।

     কোট ভালওয়ালের জেলে রমজানের মাসে অনেক কয়েদিকে রোজা রাখতে দেওয়া হয়। তাদের জন্য সূর্যোদয়ের পূর্বে সেহরির ব্যবস্থা থাকে। অন্ধকার থাকতে থাকতেই তাদের জন্য খাবার ঘর স্বল্প সময়ের জন্য খুলে দেওয়া হয়। খাবার ঘরে সাময়িক ভিড়ের জন্য কোলাহল সৃষ্টি হয়।

     প্রতিদিনের মতো জেল-কিচেনের পিছনদিকে জেলের এক সপ্তাহের প্রভিশন নিয়ে আসে ইমতিয়াজ। ভোররাতে একটা ম্যাটাডোরে চাল, ডাল, আটা, ইফতারের ফলাহারের জন্য পর্যাপ্ত ফল এবং সবজি আনাজের সঙ্গে ঈদের স্পেশাল গোস্ত নিয়ে এসেছে সে। গাড়িটা জেল গেট থেকে সবুজ সংকেত পেয়ে সোজা ভিতরে ঢুকে আসে। আজ রমজানের শেষ দিন। তারকাঁটা দেওয়া উঁচু পাঁচিলের ভিতরে জেলপ্রাঙ্গণে তখনও অন্ধকার, কয়েদিদের ঘুম ভাঙেনি। সূর্যোদয় হতে এখনও ঘণ্টাখানেক দেরি। মিনিট খানেকের মধ্যেই রোজা রাখা কয়েদিরা সেহরির জন্য খাবার ঘরের দিকে ছুটবে। সালাউদ্দিন আর বশির এসে মৌলানার সামনে দাঁড়ালো। মৌলানার বাড়ানো হাতের উলটোপিঠে তারা একবার করে চুম্বন করল। মৌলানাও তাদের করস্পর্শ করে কোরআনের দুটি পবিত্র সূরা পাঠ করল বিড়বিড় করে। তারপর মৃদু হেসে শৌচালয়ের ভিতরের দেয়ালের একটি সাদা আবরণ সরাতেই সুড়ঙ্গদ্বার উন্মুক্ত হল। কারাকক্ষের বাইরের দিকে তাকিয়ে বশির ইঙ্গিত করে জানাল যে সেহরির খানা খাওয়ার ভিড় শুরু হয়েছে ডাইনিং হলের দিকে। বাইরে অস্পষ্ট কোলাহল শোনা গেল।

     মৌলানা মাসুদ আজহার দ্রুত সুড়ঙ্গ দিয়ে নির্গত হল। ছয় মিনিটের মধ্যে সে কিচেনের পিছনের রাস্তায় দাঁড় করানো ম্যাটাডোরের তলার ম্যানহোলের ঢাকনা সরিয়ে বেরিয়ে এসে ম্যাটাডোরের তলার একটি খোপে নিজেকে সেঁটে নিল। ইমতিয়াজ তার মালপত্র আনলোডের কাজ শেষ করে কিচেনের ইনচার্জ রাঁধুনিকে বলল, “জনাব, গোস্ত বহুত আচ্ছা দিয়া। লাজিজ পকানা।”

     রাঁধুনি হেসে তাকে বিদায় জানাতেই ইমতিয়াজ গাড়ির চালকের আসনে গিয়ে বসল। তিন মিনিটের মাথায় যখন গাড়ি চালিয়ে সে কোট ভালওয়ালের মেন গেটের কাছে পৌঁছল তখন দুজন কারারক্ষী গাড়ি চেকিংয়ের জন্য এগিয়ে এল। একজন চালকের মুখের উপর টর্চের আলো ফেলল, অন্যজন ম্যাটাডোরের পিছনের ক্যারিয়ারের তেরপল সরিয়ে শূন্য জায়গাটায় টর্চের আলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে সন্তুষ্ট হয়ে গেটের কিয়স্কে বসা সিনিয়র সিকিউরিটি অফিসারের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলল, “স্যার, ক্লিন হ্যায়।”

     গেট দিয়ে বেরোনোর সময় ইমতিয়াজ সিনিয়র সিকিউরিটি অফিসারের দিকে তাকিয়ে ঝকঝকে হেসে বলল, “জনাব, ঈদ মুবারক হো। খুদা খ্যায়ের করে।”

     তিন দিন ধরে রোড চেকিং এড়িয়ে, ভারতীয় সেনা ও সীমান্তবাহিনীর চোখে ধুলো দিয়ে চতুর্থ দিনের মাথায় সীমান্ত পেরিয়ে আজাদ কাশ্মীর হয়ে মুজফফরাবাদ পৌঁছলো মৌলানা মাসুদ আজহার।

    

     ।। ১৬ ।।

    

     দশম লোকসভার আগে পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী সঞ্জয় গান্ধী এত বড় সংকটে কখনও পড়েনি। কাশ্মীরের জঙ্গী আন্দোলন তার শিরঃপীড়ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদ বলতে শুধুমাত্র জম্মু কাশ্মীর লিবারেশন ফ্রন্ট ছিল। মকবুল ভাট, আমানুল্লা খানের মতো নেতারা বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সূচনা করলেও তাঁরা ছিলেন কিছুটা তাত্ত্বিক নেতা। তখন কালাশনিকভ, উজি কিংবা রকেট লঞ্চারের মাধ্যমে জবাব দেওয়ার চেয়ে তারা দ্বিপাক্ষিক বা ত্রিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে কাশ্মীর সমস্যা সমাধানে বেশি আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু নব্বইয়ের পরবর্তী শেষ দশকে হুজি, হরকত-উল-আনসার, লস্কর-ই-তৈবা আসার পর কাশ্মীরের সিনারিও পুরোপুরি বদলে গেছে। এই জঙ্গী সংগঠনগুলো তাদের প্রতি মানুষের আতঙ্ক তৈরি করার জন্য নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড শুধু কাশ্মীর নয়, গোটা ভারতে ছড়িয়ে দিয়েছে। এই নতুন ধারার ভয় উদ্রেককারী জঙ্গী কার্যকলাপের সূচনা হয়েছে ১৯৯৩ সালের বম্বে ব্লাস্টের মাধ্যমে। দালাল স্ট্রিটের স্টক এক্সচেঞ্জ, জাভেরি বাজার সহ দু-তিনটি জায়গায় বিস্ফোরণ ঘটিয়ে জঙ্গী সংগঠনগুলি মানুষকে সন্ত্রস্ত করে তুলেছে যা কাশ্মীর ইস্যুকে ছাপিয়ে তাদের শো-অফ করাকেই আন্ডারলাইন করেছে।

     অবশ্য সঞ্জয়ের সরকার ‘৯৩ এর বম্বের বিস্ফোরণের পিছনে জড়িত ব্যক্তিদের খুঁজে বের করতে, সত্য উদঘাটন করতে যেমন তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল, তেমনই সাধারণ মানুষের মধ্যে এটাও বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে এই বিস্ফোরণ ছিল অযোধ্যায় হিন্দু করসেবকদের বাবরি মসজিদ ভাঙার প্রত্যুত্তর। দেশের মানুষও নিশ্চয়ই বুঝেছিল ভারতীয় গণতন্ত্রের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামো ভাঙার ঝুঁকি নিলে মুসলমান ও প্রো-পাকিস্তানি জঙ্গীরাও এভাবেই নাশকতামূলক কার্যকলাপ করবে।

     সঞ্জয় ইদানীং বারবার তার দাদা রাজীবের কাছেও কবুল করেছে, তার দশ বছরের প্রধানমন্ত্রীত্বে এই প্রথম মৌলানা মাসুদ আজহারের মতো দুর্ধর্ষ জঙ্গী নেতা জেল থেকে পালালো। এটা জঙ্গীদমণে তার বড় একটা ব্যর্থতা। এইসব ভাবনাচিন্তা যখন তার মাথায় ঘোরাফেরা করে তখন তার মায়ের কথা খুব মনে পড়ে। বছর দশেক আগে লোকসভা নির্বাচনের শুরুর প্রাক্কালে তার মা শ্রীমতী গান্ধী মারা যান, সঙ্গে নিয়ে চলে যান তার অভিজ্ঞতা আর প্রজ্ঞা। তাই সঞ্জয় ইদানীং তার মায়ের পরামর্শের অভাব বোধ করে। তার মায়ের সঙ্গে একত্রে সঞ্জয় পাঞ্জাবের খলিস্তানি আন্দোলনকে নিশ্চিহ্ন করেছে, শ্রীলঙ্কার তামিল সংগঠন এলটিটিই ও সিংহলীদের মধ্যে গৃহযুদ্ধকেও সুচতুরভাবে সামলেছে, কিন্তু আজ কাশ্মীরে পাকিস্তানের ইন্টেলিজেন্স আইএসআই-এর মদতপুষ্ট জঙ্গী সংগঠনগুলি যেভাবে নাশকতামূলক কার্যকলাপ ছড়িয়ে দিচ্ছে তা দমণে সঞ্জয় ব্যর্থ হচ্ছে বারবার। বিগত দশ বছর ধরে সে অত্যন্ত সুচতুরভাবে তার বিরুদ্ধে ওঠা হেকলার অ্যান্ড কখ আর্মস ডিলের দুর্নীতির অভিযোগগুলি লোকসভায় এড়িয়ে গেছে কিন্তু ইদানীং কাশ্মীরের জঙ্গীসন্ত্রাস দমণে তার ব্যর্থতার কথা সংসদে উঠলে সে কিঞ্চিৎ অসহায়বোধ করে।

     কাশ্মীরের কোট ভালওয়াল জেল থেকে মৌলানার পলায়ন যে কত বড় সিকিউরিটির ব্যর্থতা এখন তা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যাচ্ছে। জেল থেকে পালিয়ে মৌলানা মাসুদ আজহার হরকত-উল-আনসারের থেকেও এক ভয়ংকর জঙ্গী সংগঠন তৈরি করেছে, যার নাম জইশ-ই-মহম্মদ।

     গভীর চিন্তায় ডুবে গিয়েছিল সঞ্জয়। দরজার কাছে মৃদু শব্দ হতে চোখ তুলে তাকাল সে। দরজায় প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজীব গান্ধীর পিছনে হাজির এক মাঝারি উচ্চতার মানুষ। মানুষটার সদাসতর্ক চোখের দৃষ্টি দেখে বোঝা যাচ্ছে তিনি সাদা পোশাকে থাকলেও আসলে একজন পোড়খাওয়া পুলিশ অফিসার।

     “মিঃ অজিত ডোভাল, প্লিজ কাম,” সঞ্জয় মুখের দুশ্চিন্তা মুছে হাসার চেষ্টা করল।

     “স্যার, খুব চিন্তায় পড়েছেন মনে হচ্ছে,” মিঃ ডোভাল প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করলেন। “আপনি কি এই মুহূর্তে গাজিয়াবাদের জেলে বন্দি একটি বিশেষ কয়েদির কথা ভাবছিলেন?”

     “কী করে বুঝলেন?” সঞ্জয় চমকে তাকাল।

     “ভারতের কারাগারে এই মুহূর্তে বিশ্বের মোস্ট ওয়ান্টেড টেররিস্টদের মধ্যে দুজন বন্দি ছিল। মৌলানা মাসুদ আজহার এবং আহমেদ ওমর সঈদ শেখ। প্রথমজন মাসখানেক আগে কাশ্মীরের জেল থেকে পালিয়েছে আর দ্বিতীয়জন এই মুহূর্তে গাজিয়াবাদের জেলে বন্দি রয়েছে।”

     সঞ্জয় আর রাজীব দুজনেই তারিফের চোখে এক দশক ধরে দেশের ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চের প্রধানের পদ অলংকৃত করা মানুষটার দিকে তাকাল।

     “আপনি আমার কাছ থেকে কী জানতে চান তা আমি বিলক্ষণ বুঝতে পারছি। সেই প্রসঙ্গে জানাই একটাই মাত্র উপায় আছে।”

     “কী উপায়?”

     “আপনি নিশচয়ই অবগত আছেন যে ওমরের বাবা সঈদ শেখ ইতিমধ্যে তিনবার ভারত সরকারের কাছে আবেদন করেছেন— ওমর যেহেতু ব্রিটিশ নাগরিক তাই তার বিচার ব্রিটেনের কোনও আদালতে হোক।”

     “অসম্ভব! সেক্ষেত্রে আমরা তাকে ব্রিটেনের হাতে তুলে দিতে যাব নাকি!” রাজীব বিস্ময়ের সঙ্গে বলে উঠল।

     “অবশ্যই স্যার। সেক্ষেত্রে আমরা ওমরের পিতার দাবি মেনে তাকে ব্রিটেনের হাতে প্রত্যার্পণ করব। আপনিই বলুন স্যার, পাকিস্তান ও পাকিস্তানবান্ধব দেশগুলিও তো তাই চায়, নয় কি?” শেষ কথাটা ডোভাল সঞ্জয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন।

     এক মুহূর্তের জন্য ডোভালের চোখের দৃষ্টিতে লেখা বার্তাটা পাঠ করে সঞ্জয় অর্থপূর্ণ হেসে বলল, “নিশ্চয়ই, আমরা ওম্র সঈদকে এক্সট্রাডাইট করে ব্রিটেনের হাতে তুলে দেব।”

     আহমেদ ওমর সঈদ শেখের এক্সট্রাডিশনের আবেদনপত্রে সীলমোহর পড়ে গেল সপ্তাহখানেক বাদে। ভারত সরকার ব্রিটেনের নাগরিক প্রৌঢ় সঈদ শেখপুত্র ওমরকে ব্রিটেনের হাতে প্রত্যার্পণের দিন ধার্য করল একমাস পরে। ইতিমধ্যে সঈদ শেখও সমস্ত রকমের ফর্মালিটি সম্পূর্ণ করলেন। ওমরকে প্রত্যার্পণের জন্য সাধারণ যাত্রীবাহী বিমানের বদলে বিশেষ বিমানের ব্যবস্থা করার আর্জি জানিয়েছিলেন সঈদ শেখ। ভারত সরকারও বিশেষ বন্দির নিরাপত্তার স্বার্থে সেই দাবি মেনে নেয়। এদিকে প্রাইভেট জেটের খরচ বহন করতেও সঈদ শেখ সম্মত হয়েছেন।

    

     একমাস পরের প্রত্যার্পণের দিনটি হাজির। দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সঈদকে রাতের বিশেষ বিমানে ব্রিটেনে পাঠানো হচ্ছে। রাত আটটা নাগাদ গাজিয়াবাদ জেল থেকে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তায় একটা প্রিজন ভ্যানে ওমর সঈদ শেখকে তোলা হল। ওমরের পিরনে সাদগারণ পোশাক। হাতে হাতকড়া, পায়ে শিকল বাঁধা। প্রিজন ভ্যানের সামনে তিনটি পাইলট কার এগিয়ে চলেছে অন্ধকারের বুক চিরে।

     গাজিয়াবাদ থেকে দিল্লিগামী এই রাস্তায় রাতের এই সময়টায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। প্রিজন ভ্যানের চালক রাস্তার যানজট এড়াতে ভ্যানের অভিমুখ দিল্লিগামী নতুন গাজিয়াবাদ ব্রিজের দিকে ঘোরালো। এই সেতুটিকে ইন্দো-জাপান ফ্রেন্ডশিপ ব্রিজ বলেও লোকে চেনে। এই সেতু ধরলে যানজট কিছুটা এড়ানো সম্ভব, ড্রাইভার জানে। ভিড় এড়িয়ে প্রিজন ভ্যান ব্রিজের দিকে এগিয়ে চলল। ড্রাইভার জানে রাতের এই সময়টায় সবারই বাড়ি ফেরার তাড়া। ভ্যানের আশপাশ দিয়ে মোটরবাইক, ছোট গাড়ি ওভারটেক করে হুস হুস করে এগিয়ে চলেছে। বিরক্ত হলেও প্রিজন ভ্যানের ড্রাইভারের কিছু করার নেই।

     হঠাৎ রিয়ার ভিউ মিররে তার চোখে পড়ল একটা ষোলো চাকার ট্রেলার দ্রুত পিছন থেকে এগিয়ে আসছে। প্রিজন ভ্যানের ড্রাইভার বারচারেক গাড়ির হর্ন টিপল বেশ জোরে জোরে। তবুও নির্বিকারভাবে গতি বাড়িয়ে উঠে এল ভারী ট্রেলারটা। আচমকা ভ্যান-ড্রাইভার কিছু বোঝার আগেই ট্রেলারটা গাড়িটাকে বাঁয়ে সেতুর রেলিংয়ের দিকে চেপে দিল। প্রিজন ভ্যানটা লেন ছেড়ে সেতুর অপ্রশস্ত ফুটপাতে উঠে পড়ল। ড্রাইভার সাহায্যের জন্য চেঁচিয়ে উঠল, তার প্রিজন ভ্যান অন্তত বিশ গজ সেতুর রেলিং য়ে ঘষটাতে ঘষটাতে এগিয়ে চলেছে। পাইলট কারগুলো ততক্ষণে অনেকটা এগিয়ে গেছে, প্রিজন ভ্যানের চালকের সাহায্য প্রার্থনার আর্তি কারও কানে পৌঁছায়নি। অতর্কিতে ট্রেলারটা আরও বাঁদিকে চেপে প্রচণ্ড এক ধাক্কা মারতেই প্রিজন ভ্যানটা নিজাম্মুদ্দিন ব্রিজের সাইড রেলিং ভেঙে দুবার পাল্টি খেয়ে গিয়ে পড়ল যমুনার কালো জলে। প্লবতার কারণে কয়েক পল ভেসে থেকে প্রিজন ভ্যানটা চিরতরে ডুবে গেল গভীর যমুনার জলে।

     দশ মিনিটের মাথায় সফদরজং বাংলোর ফোনটা বেজে উঠল। ফোনের ওপাশে অজিত ডোভালের ধীর স্থির কণ্ঠ বলে উঠল, “মিশন অ্যাকমপ্লিশড।”

     সঞ্জয় মৃদু হেসে ফোনের রিসিভারটা নামিয়ে রাখল।

    

     ।। ১৭ ।।

    

     ১৩ ডিসেম্বর, ২০০১

     মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার ও পেন্টাগনের উপর ১১ সেপ্টেম্বরের জঙ্গী হানার পরে তিনমাস অতিক্রান্ত। তবুও মার্কিন মুলুক সহ গোটা বিশ্ব যেন সন্ত্রাসবাদের ভয়ে কম্পমান। ইতিমধ্যে আমেরিকা আফগানিস্তানের তালিবান জঙ্গীদের বিরুদ্ধে আক্রমণ শানাতে শুরু করেছে। ব্রিটেনের মতো বেশ কিছু দেশও ইসলামি জঙ্গীদের সন্ত্রাস নির্মূল করতে আমেরিকার পাশে দাঁড়িয়েছে।

     লোকসভার শীতকালীন অধিবেশনের শুরু থেকেই বিরোধীদল ভারতীয় জনতা পার্টি প্রধানমন্ত্রী সঞ্জয় গান্ধীকে তীব্র আক্রমণ শুরু করেছে। কংগ্রেসের তানাসাহীর বিরুদ্ধে ভাজপা দীর্ঘদিন ধরে আক্রমণ তো শানাচ্ছিলই, বেশ কয়েক বছর ধরে তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে হেকলার অ্যান্ড কখ আর্মস ডিল কেলেঙ্কারি এবং কাশ্মীর উপত্যকায় পাকিস্তানি জঙ্গীদমণে সঞ্জয়-সরকারের ব্যর্থতার খতিয়ান।

     লোকসভার অধিবেশনে এই প্রথম যেন সঞ্জয়ের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের অভাব চোখে পড়ছে। একাদশ লোকসভায় ভারতের ইতিহাসে প্রথমবার জাতীয় কংগ্রেস দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। সিপিএম, সিপিআই সহ বামদলগুলি, কাঁসিরাম ও মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি, পশ্চিমবঙ্গে সদ্যগঠিত তৃণমূল কংগ্রেস সহ আরও কিছু আঞ্চলিক দলের সমর্থন নিয়ে কংগ্রেসের নেতৃত্বে গঠিত ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স যৌথভাবে একাদশ লোকসভার ম্যাজিক সংখ্যা ২৭৩ ছুঁতে পেরেছে। এই ইউপিএ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন সঞ্জয় গান্ধী। ভারতীয় রাজনীতিতে কোয়ালিশন সরকারের গঠন প্রমাণ করতে শুরু করেছে শতাব্দী প্রাচীন কংগ্রেস দলের উপর দেশের মানুষের আস্থা কমতে শুরু করেছে। অন্যদিকে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলির উত্থান শুরু হয়ে গিয়েছে।

     আজ লোকসভা অধিবেশনের প্রথম অর্ধ পরিচালনার সময় সিপিএম দলের বর্ষীয়ান নেতা ও স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় রীতিমতো হিমশিম খেয়েছেন। প্রতিরক্ষামন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় একবার কাশ্মীর বিষয়ে বলতে উঠেছিলেন কিন্তু বিরোধীদের প্রবল প্রতিবাদে তিনি আর বলতে পারেননি। প্রায় একবছর আগে গাজিয়াবাদ জেলে বন্দি আন্তর্জাতিক জঙ্গী ওমর সঈদ শেখকে ব্রিটেনের হাতে প্রত্যার্পণের প্রাক্কালে যে পথদুর্ঘটনা ঘটে তার ফলে ভ্যানসহ যমুনার জলে পড়ে ওমর নিখোঁজ হয়ে যায়। সেই ঘটনার তদন্তের ভার সিবিআইকে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু সঞ্জয়ের সরকারকে ফেস সেভিং করতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের জায়গায় রাজীব গান্ধীকে আনতে হয়েছে। বর্ষীয়ান নেতা প্রণবকেও পাঠাতে হয়েছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকে।

    

     দুপুর আড়াইটে নাগাদ ভারতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ দিকের গেট দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের স্টিকার লাগানো দুটো সাদা অ্যাম্বাসাডর গাড়ি ভিতরে ঢুকে পার্কিং লটের দিকে এগিয়ে গেল। তখন সংসদ ভবনের ভিতরে দিনের দ্বিতীয় পর্যায়ের অধিবেশন শুরু হয়ে প্রায় চল্লিশ মিনিট অতিক্রান্ত। দ্বিতীয় পর্যায়ের অধিবেশনের শুরুতেই বিরোধী দলনেতা লালকৃষ্ণ আদবানী হেকলার অ্যান্ড কখ আর্মস ডিলের দুর্নীতি উন্মোচন করতে জয়েন্ট পার্লামেন্টারি কমিটি গঠন করার পক্ষে সওয়াল জবাব শুরু করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজীব গান্ধী জানান সিবিআইয়ের তদন্ত অন্তিম পর্যায়ে এবং শিগগিরই সরকারের কাছে তা জমা পড়বে। অতএব তদন্তের সেই রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। রাজীবের বক্তব্য শুনে আদবানীজী, বাজপেয়ীজী, যোশীজী সহ অন্যান্য বিজেপি নেতারা তীব্র রাগে ফেটে পড়েন। লোকসভার ওয়েলে নেমে বিজেপি সাংসদেরা প্রতিবাদ জানিয়ে সভার কাজ মিনিট পনেরো বন্ধ করে দেওয়ার পর আচমকা সবাই একসঙ্গে ওয়াক আউট করে সংসদ ভবন ত্যাগ করে বেরিয়ে যান।

     সাদা অ্যাম্বাসাডর গাড়ি দুটো পার্কিং লটে এসে সন্দেহজনকভাবে উপরাষ্ট্রপতির গাড়িতে ধাক্কা মারার সঙ্গে সঙ্গে সিকিউরিটি গার্ডরা ছুটে আসে, কিন্তু ততক্ষণে দুটি গাড়ি থেকে দশজন জঙ্গী নেমে এসে রক্ষীদের উপর এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়তে শুরু করেছে। অতর্কিত আক্রমণে হতচকিত রক্ষীরা আত্মরক্ষার জন্য রাইফেল থেকে গুলি চালাতেও ভুলে যায়। জঙ্গীদের গুলিতে নিমেষের মধ্যে ঝাঁঝরা হয়ে গেল পাঁচজন রক্ষীর দেহ। ততক্ষণে কালাশনিকভ, উজি, গ্রেনেড লঞ্চার হাতে নিয়ে দশজন জঙ্গী ছুটতে শুরু করেছে মূল সংসদ ভবনে ঢোকার গেটটার দিকে। সংসদ ভবনের সুরক্ষার দায়িত্বে থাকা দিল্লি পুলিশের স্পেশাল কমব্যাট ফোর্স সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত থাকায় তারা জঙ্গীদের গোলাগুলির জবাব দিতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। জঙ্গীদের ম্যানুভারিং দক্ষতার সামনে তারা হতবুদ্ধি হয়ে পড়ল আর সেই সুযোগে জঙ্গীরাও সুরক্ষাবাহিনীকে পর্যুদস্ত করে লোকসভায় প্রবেশের মূল গেটে পৌঁছে গেল।

     দ্বিতীয়ার্ধের অধিবেশনে ভাজপা-র সাংসদরা ওয়াক আউট করে বেরিয়ে যাওয়ার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজীব গান্ধী কিছুটা বিহ্বল হয়ে পড়ে। তার মুখরক্ষার তাগিদেই সংসদে অনেকদিন পর তার জায়গায় বলতে উঠেছিল প্রধানমন্ত্রী সঞ্জয় গান্ধী। বিরোধীদের ওয়াক আউট করে সংসদ ত্যাগ কতটা নিন্দনীয় এবং অসহিষ্ণুতার পরিচয় তা ব্যক্ত করে জ্বালাময়ী বক্তব্য রাখছিল সঞ্জয়। হঠাৎ প্রচণ্ড দুটো বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে উঠল সংসদের লোকসভার কক্ষ। আকস্মিক বিস্ফোরণের শব্দে সাংসদদের কেউ ভয়ে টেবিলের তলায় আশ্রয় নিল, কেউ আবার প্রাণভয়ে সভার ওয়েলে নেমে এল। সামনের আসনে বসা রাজীব টেবিলের তলায় আশ্রয় নিল। কমল নাথ, জগদীশ টাইটলারের মতো নেতারাও প্রাণভয়ে ছুটোছুটি শুরু করল। সঞ্জয় দেখল গ্রেনেড বিস্ফোরণের ধোঁয়া সমস্ত সভাঘরকে অস্পষ্ট করে তুলেছে। ধোঁয়ার আড়ালে কি ঘটছে ভালো করে বুঝে ওঠার আগেই সঞ্জয়ের কান ঘেঁষে সাঁ করে প্রচণ্ড গতিতে ছুটে যাওয়া একটা বুলেট পিছনের দেয়ালে গিয়ে লাগল। সঞ্জয়ের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ততক্ষণে সজাগ হয়ে উঠেছে। পার্লামেন্টে কি তবে জঙ্গীরা হামলা করেছে! লোকসভার কক্ষ জুড়ে ততক্ষণে মহিলা সাংসদেরা প্রাণভয়ে চিৎকার শুরু করেছে। পুরুষ সাংসদেরা টেবিলের তলা থেকে চিৎকার করছে— “আতঙ্কবাদিয়োঁ নে হামলা কিয়া! ভাগো ভাগো!”

     একটা টেবিলের তলা থেকে সঞ্জয় দেখতে পেল জনা ছয়েক মাস্ক পরা আতঙ্কবাদী সভার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। তাদের সবার হাতে অত্যাধুনিক কালাশনিকভ, উজি আর গ্রেনেড লঞ্চারের মতো আগ্নেয়াস্ত্র। দ্রুত ওরা এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে শুরু করেছে। সঞ্জয় ভাবল, সংসদ ভবনের নিরাপত্তা রক্ষীরা কোথায়! এত বড় সিকিউরিটি ফেলিওর! নাকি এটা ইন্টেলিজেন্সের ব্যর্থতা? এই জঙ্গীরা কোন সংগঠনের, কেনই বা ওরা সংসদ ভবন আক্রমণ করল? প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দের মধ্যে তার কানে যেন ভেসে এল জঙ্গীদের মধ্যে কেউ চিৎকার করে বলে উঠল— ‘জইশ-ই-মহম্মদ জিন্দাবাদ। লস্কর-ই-তৈবা জিন্দাবাদ। মৌলানা মাসুদ আজহার জিন্দাবাদ।”

     সঞ্জয় কেঁপে উঠল। মৌলানা মাসুদ আজহারের জেল পালানো আটকাতে না পারার জন্য তাকে কত বড় দাম দিতে হচ্ছে। হঠাৎ সঞ্জয় দেখল একজন মহিলা সাংসদের দেহ গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে তার সামনে লুটিয়ে পড়ল। অদূরে একজন বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা গুলিবিদ্ধ হয়ে হাঁটু ভেঙে মাটিতে পড়ে গেলেন। সংসদের স্পিকারের চেয়ারে গুলি লেগে এলিয়ে পড়েছেন স্পিকার। সংসদের ওয়েল ভেসে যাচ্ছে মানুষের রক্তে। যেন কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সভাকক্ষটা একটা নরকের চেহারা নিল।

     আজ সভায় কংগ্রেস সহ ইউপিএ-র শরিক দলগুলির সাংসদেরাই কেবলমাত্র উপস্থিত রয়েছে। আধঘণ্টা আগে ভারতীয় জনতা পার্টির সাংসদেরা ওয়াক আউট করে চলে গেছে। সঞ্জয়ের মনে হঠাৎ একটা সন্দেহ উঁকি দিল, বিজেপি সাংসদেরা কি তবে আগেভাগেই এই জঙ্গী হামলার কথা জানতো! কোথাও যেন একটা ষড়যন্ত্রের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। সঞ্জয় এই হামলার পিছনের আসল উদ্দেশ্য ও ষড়যন্ত্রকারীর স্বরূপ খুঁজে বের করবেই। সে এর শেষ দেখেই ছাড়বে।

     টেবিলের তলায় শুয়ে সাত-পাঁচ ভাবনার মধ্যে হঠাৎ বিকট একটা গুলির শব্দে সঞ্জয়ের চিন্তাজাল ছিন্ন হয়ে গেল। সে দেখল মাত্র কয়েক হাত দূরে উজি থেকে ছোঁড়া একটা বুলেট এসে বিদ্ধ হয়েছে রাজীবের কপালের মাঝখানে। সেখান থেকে গড়িয়ে নামছে লাল সান্দ্র তরল। রাজীব যন্ত্রণার শেষ উচ্চারণটি করারও সময় পায়নি। তার আধখোলা চোখের মধ্যে তখন ছড়িয়ে আছে ভয়জড়িত বিস্ময়ের চিহ্ন। দৃশ্যটা দেখে সঞ্জয়ের মুখ থেকে দুটো অস্ফুট আতঙ্কের শব্দ ছিটকে বেরিয়ে এল, “ওহ্, ভাইয়া!’

     দৃশ্যটা দেখে সঞ্জয় আর নিজেকে সামলে রাখতে পারল না। টেবিলের তলা থেকে বেরিয়ে সে রাজীবের রক্তাক্ত শরীরটার সামনে হাঁটু গেড়ে বসল। তখনই মাথা তুলে ডানদিকে তাকাতেই দেখতে পেল আততায়ীর চেহারাটা। উজি হাতে লম্বা চেহারার এক জঙ্গী, আপাদমস্তক কালো পোশাকে ঢাকা। মাস্কের ভিতর থেকে শুধু দুটি চোখ দপদপ করে জ্বলছে। নিরস্ত্র সঞ্জয় একবার দাদার মৃতদেহের দিকে তাকাল। মাথা না তুলেও সে বুঝতে পারল আততায়ী এগিয়ে এসে তার সামনে দাঁড়িয়েছে। খুট করে একটা শব্দ শুনে সঞ্জয় বুঝতে পারল লোকটা উজিতে নতুন ম্যাগাজিন লোড করছে। সে মাথা তুলে তাকাতেই বুঝতে পারল লোকটা লিভার লক করে ট্রিগারে আঙুল রেখেছে। সঞ্জয় পালাল না, তার সে প্রবৃত্তি হল না। লম্বা চেহারার মুখোশধারী জঙ্গীটা ট্রিগারে আঙুল রেখে পরপর চারবার ফায়ার করল। প্রধানমন্ত্রী সঞ্জয় গান্ধীর হৃৎপিণ্ডটা এফোঁড়ওফোঁড় হয়ে গেল এক মুহূর্তে। যন্ত্রণা অনুভব করার সময়টুকুও পেল না। রাজীবের পাশে তার শরীরটা লুটিয়ে পড়ল। তারপর বারতিনেক কেঁপে উঠে একেবারে নিথর হয়ে গেল।

    

     উত্তরকথন

     ২১২০ সাল

     মুখার্জিসাহেবের টেবিলের সামনে দুই যুযুধান সহকর্মী হরিপদ আর মনোতোষ এসে দাঁড়াল। মুখার্জিসাহেব ঘরের দেয়াল কাঁপিয়ে হা হা করে হেসে উঠে বললেন, “হরিপদ, তোমার একটা জুতোর বাক্সের ডেলিভারি যে তিন তিনটে অমূল্য প্রাণ বাঁচিয়ে দিল হে! শুধু তিনটে পলিটিক্যাল অ্যাসাসিনেশন আটকানো গেল তাইই নয়, ভারতের পলিটিক্যাল টাইমলাইনটাই বদলে গেল, হা হা হা।”

     মনোতোষ বলল, “তাহলে কি বেস্ট টাইম ট্রাভেলার অব দ্য ইয়ারের অ্যাওয়ার্ডটা হরিপদদাই পাবে স্যার?”

     তার এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মুখার্জিসাহেব বললেন, “মনোতোষ, ইউ অলসো হ্যাভ ডান আ গুড জব। একটা আস্ত বিমান হাইজ্যাক হওয়া আটকে রূপিন কাটিয়ালকে যেমন বাঁচিয়ে দিলে তেমনই পরোক্ষভাবে সাংবাদিক ড্যানিয়েল পার্লকে বাঁচিয়ে দিলে।”

     “কিন্তু অন্তিম পরিণতি তো একই হল, স্যার?” হরিপদ অপ্রতিভ কণ্ঠে বলল।

     মনোতোষ হরিপদর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়াল। সম্ভবত জীবনে প্রথমবার সে তার সহকর্মী হরিপদর কোনও কথায় সম্মতি জানাল।

     “না হে হরিপদ,” মুখার্জিসাহেব বললেন, “ইতিহাসের কোনও কালখন্ডে এসে বাঁকবদল হলেও ইতিহাস নদীর মতোই তার গন্তব্য, তার পরিণতি ঠিক খুঁজে নেবেই। আমরা কোর্ট অর্ডার এক্সিকিউশনার। ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট ফর ইটারন্যাল জাস্টিসের নিষ্পত্তি হওয়া মামলার রায়গুলো রূপদানের কাজ আমাদের। সেই মামলায় যদি কেউ নির্দোষ প্রমাণিত হয় বা কোনও অবাঞ্ছিত মৃত্যু সাব্যস্ত হয়, শুধু সেই কালখন্ডে ফিরে টাইমলাইন মেন্ডিংয়ের কাজটুকুই আমরা করতে পারি। আমরা মিস্তিরি, আমাদের কাজ ফুটোফাটা সারানো, নতুন ইতিহাস রচনা করা নয়।”

     দুজনেই বসের কথায় সম্মতি জানালো।

     “স্যার, একটা আর্জি ছিল,” হরিপদ ঘাড় চুলকে বলল, “পরের মাসে আমার টাইম-ট্রাভেলার লাইসেন্সটা এক্সপায়ার করার আগে রিনিউয়ালটা করে দেবেন তো?”

     “আরে নিশ্চয়ই, সে আর বলতে, তোমার মতো এফিশিয়েন্ট টাইম-ট্রাভেলার আমার কোম্পানিতে আর দুটি নেই।”

     “ধন্যবাদ স্যার, আর লজ্জা দেবেন না,” আহ্লাদে গদগদ হয়ে হরিপদ বলে।

     “তবে হরিপদ,” মুখার্জিসাহেব টেবিলে রাখা একটা ফাইল খুলে বলেন, “এবার তোমাকে আরও বড় কাজের দায়িত্ব নিতে হবে।”

     “সেটা কী স্যার।”

      “আগের বার তুমি যাকে বাঁচিয়েছ সে একজন একনায়ক হয়ে উঠতে চেয়েছিল। এবার তোমাকে একজন প্রকৃত নায়ককে বাঁচাতে হবে,” গম্ভীর গলায় মুখার্জিসাহেব বললেন, “তোমাকে এবার ১৮ আগস্ট, ১৯৪৫ সালে ফিরে গিয়ে একটা বিমান দুর্ঘটনা আটকাতে হবে। সামরিক পোশাকে সজ্জিত নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস ফরমোজার তাইহোকু যাবার জন্য বিমানে চড়তে চলেছেন। তোমার এই একটা কাজ ভারতের ইতিহাসের টাইমলাইন আমূল বদলে দিতে পারে। যাও, আর দেরি কোরো না, এক্ষুণি বেরিয়ে পড়ো, না হলে অনর্থ হবে।”

    

    

    

    

Tags: পঞ্চম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, পার্থ দে, বিকল্প ইতিহাস, রনিন

17 thoughts on “সময়নদীর বাঁকবদল

  • October 23, 2020 at 1:55 pm
    Permalink

    আধুনিক ভারতবর্ষের রাজনীতির ওপর একটা দুঃসাহসিক কাজের জন্যে অফুরান শুভেচ্ছা রইল। অবশ্য আমি আগেই আশা করেছিলাম খুব তাড়াতাড়ি এই দিশা দেখানোর কাজটা করে ফেলবেন আপনি। নিঁখুত ও বাস্তবভিত্তিক ঘটনাপ্রবাহের জটিলতা কোথাও বাধা সৃষ্টি করেনি, বরং আমার মতো জিওপলিটিকাল ল্যান্ডস্কেপে উত্সাহীদের কাছে ব্যাপারটা অতিরিক্ত পুরস্কারের স্বরূপ। এই সুত্রে বলে রাখি, রাজনীতির কোন চরিত্রকে নিয়ে এই লেখাটা আসতে চলেছে সেটা আমি সঠিক আন্দাজ করেছিলাম, তাই নিজেকেও একটু পিঠ চাপড়ে দিলাম 🙂 অতীতে গিয়ে ঐতিহাসিক ঘটনার কিছু কিছু পরিবর্তন করার কংসেপ্টটা অবশ্য নতুন নয় ( Netflix এ এই নিয়ে একটা সিরিজ আছে, মিনিস্ট্রি অফ টাইম), কিন্তু উপস্থাপনার ফলে কোথাও একঘেয়েমি আসেনি। সব নিয়ে লেখাটা আমার কাছে স্মরণীয় হয়ে রইল। আশা করি এইটাও দু মলাটে আসবে। অনেক অনেক শুভেচ্ছা রইল পার্থদা। আপনার কলম দীর্ঘজীবী হোক।

    Reply
    • October 23, 2020 at 2:17 pm
      Permalink

      অনেক ধন্যবাদ সুদীপ। সত্য ঘটনার উপর আধারিত জিও-পলিটিক্যাল থ্রিলার লেখার কিছু সমস্যা আছে, অনেক সময় সত্যিটা বলা যায় না, রাজনৈতিক দলের স্ক্যানারের নিচে চলে আসে, তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। সেজন্য বিকল্প ইতিহাসের আড়ালে লেখার ইচ্ছা হল, বিশেষত যখন একটা নেগেটিভ চরিত্রকে পোট্রে করতে হবে। বিকল্প ইতিহাস নিয়ে লিখতে গিয়ে কোনো বড় ঘটনাকেই সাধারণত বেছে নেওয়া হয়, যার বদলের পরিপ্রেক্ষিতে ইতিহাসের বদলটা ঘটে। সেখানে কোনো মূল চরিত্রের চেয়ে পটভুমিকা আর তার পরিবর্তনকেই কাহিনির মূল উপজীব্য করে তোলা হয়। আমি চেষ্টা করেছি চরিত্রটাকেও গুরুত্ব দিতে। এই প্রসঙ্গে বলি বিখ্যাত মার্কিন টিভি সিরিজ ‘হাউস অফ কার্ডস’-এ কেভিন স্পেসি অভিনীত মূল প্রোটাগনিস্ট মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রান্সিস আন্ডারউডের চরিত্রটা আমার মনে খুব দাগ কেটেছিল। এত ডার্ক শেডের চরিত্র খুব কম দেখেছি।

      Reply
  • October 24, 2020 at 10:08 am
    Permalink

    খুব ভাল লাগল, অন্যরকম এই উপন্যাসটি। খুব বাস্তবানুগ, এরকমটি যেন হতেই পারত। সবচেয়ে ভাল লাগল, সময় নদীর বাঁকবদল কোনও ইচ্ছাপুরণের কাহিনি হয়ে দাঁড়ায়নি। ইতিহাস আবার তার মূলধারায় ফিরে গেছে।
    চমৎকার হয়েছে।

    Reply
    • October 24, 2020 at 1:02 pm
      Permalink

      ত্রিদিবেন্দ্রদা অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাকে। নতুন রকমের একটা চেষ্টা করেছি, এইটুকুই। আপনার উপন্যাস ‘লম্বাগলি’ কিছুক্ষণ আগে পড়তে শুরু করেছি। বেশ ভাল লাগছে😊 পুরোটা পড়া শেষ করে জানাব। শারদ শুভেচ্ছা নেবেন।

      Reply
      • October 24, 2020 at 2:44 pm
        Permalink

        দারুণ লাগলো। বিষয়বস্তুর অভিনবত্ব তো আছেই, তার সঙ্গে যোগ হয়েছে খুব pacy একটা স্টোরিলাইন। পরের কাহিনীর অপেক্ষায় রইলাম।

        Reply
  • October 24, 2020 at 11:59 am
    Permalink

    বাংলায় এ জিনিস আগে পড়িনি। একটানে পড়িয়ে নিল লেখাটি। অনবদ্য।

    তবে কয়েকটি প্রশ্ন থেকে গেল। বিশেষত আশির দশকের সঞ্জয় গান্ধী পর্ব যে অতিরিক্ত দ্রুততায় শেষ হল, আমার মনে হয়েছে লেখক বিরাট এক সম্ভাবনাকে কিছুটা নষ্ট করেছেন। কথোপকথন-নির্ভর হওয়ার জন্যই সম্ভবত অতিরিক্ত পেস আরোপিত হয়েছে। দুই মলাটে আনার আগে প্রতিটি পর্বে, ন্যারেটিভে আরও যত্নবান হলে, এ লেখা মাইলফলক হতে পারে।

    একটি তথ্যপ্রমাদ চোখে পড়ল অলিম্পিক নিয়ে। ১৯৮০ অলিম্পিকে চিন অংশ নেয়নি।

    যাইহোক, সব মিলিয়ে অন্যরকম পাঠ অভিজ্ঞতা হল। লেখককে ধন্যবাদ।

    Reply
    • October 24, 2020 at 1:19 pm
      Permalink

      দেবতোষ অনেক অনেক ধন্যবাদ তোমার পাঠ প্রতিক্রিয়ার জন্য। এটা আমার অল্টারনেট হিস্ট্রির দ্বিতীয় কাহিনি। প্রথম গল্পটি কয়েকদিন আগে দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য দার সম্পাদনায় জয়ঢাক প্রকাশনা থেকে প্রকাশিত ‘অন্য দুনিয়া’ গল্পসংকলনে আছে। সেই কাহিনির নাম ‘হিমালয়ান সাকসেস’। সেটা ‘৬২-র ভারত-চিন যুদ্ধের ভিন্ন ফলাফলের উপর ভিত্তি করে বিকল্প ইতিহাসের কাহিনি।
      তবে সত্যি বলতে বাংলায় বিকল্প ইতিহাসের কাহিনি যেহেতু খুব কমই হয়েছে এবং এই ধরণের জিও-পলিটিক্যাল কমেন্ট্রি লেখার ক্ষেত্রে আমিও অনভিজ্ঞ। তাই বেশ কিছু ত্রুটি রয়ে গেছে। ইংরেজি সাহিত্যে এই ধারার কাহিনি অনেক আছে। ফিলিপ কে ডিকের ‘দ্য ম্যান ইন দ্য হাই ক্যাসল’ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। তবে ইংরেজিতেও বিকল্প ইতিহাসের কাহিনি আমাকে আরও পড়তে হবে, তবে হয়ত আরও অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারব। হ্যাঁ, শব্দসংখ্যার কিছু লিমিটেশন ছিল, তাই এই উপন্যাসিকাটি ১৬৭০০ শব্দে লেখা। এটা অবশ্যই মিনিমাম ৩০,০০০ শব্দে লিখতে পারলে ভাল হত। তবে ‘৮০ অলিম্পিকসে চিন ছিল না, এটা সত্যি। এক্ষেত্রে আমারই ভুল হয়েছে তথ্য পরিবেশনে, ভুল স্বীকার করে নিচ্ছি। অনেক কৃতজ্ঞতা জানাই ভুলটি ধরিয়ে দেওয়ার জন্য।

      Reply
  • October 25, 2020 at 3:01 pm
    Permalink

    দিব্যি লাগলো পড়তে। বিশেষত এই কনসেপ্টটা যে, সময়নদীর সাময়িক বাঁকবদল হলেও, চূড়ান্ত গন্তব্য একই থাকে।
    আরেকটি তথ্যপ্রমাদ চোখে পড়লো। শ্রীমতী গান্ধীকে আশির দশকে যে তিনটি অ্যান্টিডিপ্রেস্যান্ট প্রেসক্রাইব করা হয়েছিল, তার মধ্যে, এসসিটালোপ্রাম ব্যবহার হচ্ছে ২০০২ সাল থেকে। এবং জলপিডেম মূলত ঘুমের ওষুধ, যা প্রথম ব্যবহার হয় ১৯৯৪ সালে।

    Reply
    • October 25, 2020 at 4:07 pm
      Permalink

      হিমাংশুবাবু অনেক ধন্যবাদ। তথ্যপ্রমাদটি ধরিয়ে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। যদি ভবিষ্যতে এটি কখনও বই হয় তবে জোলপিডেম আর এসিট্যালোপ্রামের তথ্যটা ঠিক করে নেব। তবে এমিট্রিপ্টিলিনের ব্যাপারটা বোধহয় ঠিক আছে, তাই তো?

      Reply
      • October 27, 2020 at 5:13 am
        Permalink

        হ্যাঁ, অ্যামিট্রিপ্টিলিন আমাদের কলেজ লাইফের অনেক আগে থেকেই ব্যবহার হচ্ছে, অতএব, একদম যথাযথ।

        Reply
  • October 26, 2020 at 6:09 am
    Permalink

    পার্থ বাবু, আপনার গল্পটা খুব উপভোগ করলাম। বাংলায় এর আগে রাজনৈতিক ইতিহাসের বিকল্প কাহিনী পড়িনি। আপনার সাম্প্রতিক ঐতিহাসিক ঘটনার ওপরে পড়াশুনা ও দখল দেখে খুব ভাল লাগল। আশা করি ভবিষ্যত বাঙ্গালী লেখকেরা আপনার উদাহরন দেখে তথ্য পরিবেশনা সম্বন্ধে আরও সচেতন হবেন। আমাদের কৃষ্টিতে লেখার বিষয় বস্তু নিয়ে – তা সে যা নিয়েই হোক না কেন, পর্যাপ্ত পরিমান অনুসন্ধান না করেই তাকে পরিবেশনা করবার একটা প্রবনতা দেখা যায়। আশা করি এই কৃষ্টিটা ধীরে ধীরে বদলাবে।

    Reply
    • October 26, 2020 at 10:58 am
      Permalink

      অমিতাভবাবু, আপনার পাঠ প্রতিক্রিয়া পেয়ে আমিও আপ্লুত। সবিনয়ে জানাই, কল্পবিশ্বে এর আগে আপনার যে কয়টি লেখা পড়েছি সেগুলো আমারও খুব ভাল লেগেছে। আসলে এই অল্টারনেট হিস্ট্রি জঁনরার কাহিনি বাংলায় খুব বেশি। এই ধারায় এটি আমার দ্বিতীয় উপন্যাস। বিখ্যাত লেখক দেবজ্যোতি ভট্টাচার্য দার জন্যই এই ঘরানার লেখায় উৎসাহিত হই, তাঁর সম্পাদিত এবং জয়ঢাক পাবলিকেশন প্রকাশিত ‘অন্য দুনিয়া’ গল্প সংকলনটিই বাংলায় বিকল্প ইতিহাস ধারার প্রথম বই। সেই বইতেই আমি প্রথম অল্টারনেট হিস্ট্রির কাহিনি লিখি। এই ‘সময়নদীর বাঁকবদল’ উপন্যাসটি আমার দ্বিতীয় বিকল্প ইতিহাসের উপন্যাস। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ জানাই। শারদ শুভেচ্ছা নেবেন।

      Reply
  • October 31, 2020 at 9:00 am
    Permalink

    সেই ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের ‘অঙ্গুরীয় বিনিময়’ থেকে শুরু করে পরশুরামের ‘উলটপুরাণের’ মতো বিকল্প ইতিহাসের আখ্যান লেখা হয়েছে এই বাংলায়। সেই ধারায় একটা গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হয়ে থাকবে এই রচনা। চেনা ইতিহাসের পথচলার বাঁকে বাঁকে বিকল্প বা সমান্তরাল কিছু অধ্যায়ে অন্য কোন সময় সরণিতে পাড়ি দিয়েছে গল্পের নির্মিতি। কিন্তু খুবই মুন্সিয়ানার সঙ্গে আবার ফিরে আসা এই চেনা কালস্রোতে। এমন লেখা আরো আসুক।

    Reply
  • November 1, 2020 at 9:44 pm
    Permalink

    অসাধারণ একটা লেখা পড়লাম। উপভোগ্য একটি বিকল্প রাজনৈতিক ইতিহাস। আর শেষটুকু এক কথায় দারুণ। যে কাহিনীর ইঙ্গিত দিয়ে আপনি শেষ করলেন, সেটা পড়তে চাই খুব তাড়াতাড়ি।

    Reply
  • November 8, 2020 at 10:08 pm
    Permalink

    একটা কথা, ওমার শেখ সঈদ জানতাম 9/11 এর terror financer ছিলেন। উনি fund raise করেছিলেন। তাই উনি jail এ থাকলে ঐ ঘটনা হয়তো হত না বলে আমার ধারণা।

    Reply
    • November 10, 2020 at 1:33 pm
      Permalink

      কিন্তু জেলে থাকলে তার বাবা তাকে তো এখান থেকে ছাড়িয়ে ব্রিটিশ আইনের আওতায় নিয়ে যেতেন। তাই তার নিধন করতে হয়েছে। ফলে ড্যানিয়েল পার্লের অপহরণ ও মৃত্যুটা সংঘটিত হয়নি।

      Reply
  • November 22, 2020 at 1:11 am
    Permalink

    পার্থবাবু, খুব সুন্দর হয়েছে লেখাটি। বাংলায় এ এক অন্য ধারার লেখা। আশা রাখি পাঠকদের মধ্যে সাড়া ফেলে দেবে এই লেখা। আরো চাই এধরণের লেখা।

    Reply

Leave a Reply

Your email address will not be published.

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.

error: Content is protected !!